ক্রস কানেকশন
ক্রস কানেকশন
অনেকদিন পর বাড়ি ফিরেছে তমাল। সারাদিন ধরে বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। তাই আর বাইরে যাবার কোন উপায় দেখল না ও। বাড়িতে মা আর তমাল দুইজন। কাজের জন্য বাইরে থাকতে হয় তমালকে। একটা কাজের লোক রাখা আছে সেই সারা বছর ওর মায়ের দেখাশুনা করে। তমাল মাসে একবার বাড়ি আসতে পারে। ও এলে কাজের মহিলাটি ছুটি পায় তার বাড়ি যাবার জন্য। কিন্তু এবার তমালের আসতে তিনমাস হয়ে গেল। কাজের মহিলাও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিল তার বাড়ি না যেতে পেরে। তাই তমাল আসার সঙ্গে সঙ্গে ছুটি নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল।
তমালের মা বিকাল হতেই পাশের ফ্ল্যাটে যান প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ গল্প গুজব করতে। তমালকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে চলে গেলেন তিনি। তমালও দরজা বন্ধ করে ঘুমাতে লাগল। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে কি হচ্ছে না তা বোঝার উপায় নেই ভিতর থেকে।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তমালের। বেশ ঘুম হচ্ছিল। কিন্তু কানের কাছে ফোনটা বেজে ওঠায় আমেজের ঘুমটার সমাপ্তি টেনে দিল। বেশ বিরক্ত হল তমাল। এই সময় ফোন আসাটা যেন কোন গর্হিত কাজ হয়েছে ভাবটা এমন। ঘুম জড়ানো চোখটা কোনোরকম খুলে বিছানার পাশে রাখা ল্যান্ডফোনের দিকে তাকালো ও। ল্যান্ডফোনের রমরমা এখন আর না থাকলেও ওদের ফ্ল্যাটে অনেকেই রেখেছে। বয়স্ক লোকেদের এতেই সুবিধা হয়। কল আসলেই শুধু রিসিভার তুললেই হল। আর নম্বর দেওয়া বোতাম টিপে কল করা তাদের কাছে নাকি বেশি সহজ মোবাইলের চেয়ে।
বিরক্তি নিয়ে রিসিভারটা তুলে কানে লাগিয়ে তমাল বলল, 'হ্যালো।'
ওপাশ থেকে একটা বয়স্ক লোকের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল তমাল। লোকটা বলল, 'হ্যালো তমাল। আমি মেজো দাদু বলছি।'
এবার যেন চোখের ঘুমটা ছুটে গেল তমালের। ও বলল, 'আরে দাদু বল। আমি এসেছি জানলে কীভাবে? না এমনি ফোন করলে?' কথা বলতে বলতে বিছানায় উঠে বসল ও।
'সে কথা পরে হবে। এখন যা বলছি শোন। খুব বিপদে পড়ে ফোন করলাম। তোর সাহায্য দরকার।' বৃদ্ধের কণ্ঠস্বরে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পেল। সেটা বুঝতে পারল তমাল।
তমাল তার দাদুকে বলল, 'আরে এ ব্যাপারে এতো কিন্তু কিন্তু করছ কেন? বলোনা কি করতে হবে।'
ওপাশ থেকে লোকটা বলল, 'আসলে তোর দিদা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মনে হয় হাসপাতালে নিতে হবে। কি করব বুঝতে পারছি না। ওদিকে বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। একটু যদি আসতি খুব ভালো হত। নইলে-'
ওর দাদুর কণ্ঠস্বর শুনে তমাল বুঝতে পারল অবস্থা খুব ভালো নয়। এবার নিজেই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। তবু নিজের অভিব্যক্তি লুকিয়ে রেখে ফোনে বলল, 'তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমি এক্ষুণি আসছি। তারপর দেখছি কি করা যায়।'
তমালের এই মেজো দাদু নিজের দাদু নয়। মায়ের দুঃসম্পর্কের কাকা হয় সেই হিসাবে দাদু। দাদু আর দিদা দুজন এখানে থাকে। দুই মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে। দুজনই বাইরের রাজ্যে থাকে। মাঝে মাঝে এসে দেখে যায়। অনেকদিন ধরে মেয়েরা বলেছে তাদের কাছে গিয়ে থাকতে। কিন্তু তারা দুজন নিজেদের বাড়ি ছেড়ে যেতেই চায় না। দাদুর বাড়িটা তমালদের ফ্ল্যাট থেকে খুব একটা বেশি দূরে নয়। তবে দ্রুত যেতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি উঠে বসল বিছানা ছেড়ে। জানালার কাছে গিয়ে পর্দাটা টেনে বাইরে দেখল তমাল। অন্ধকার নেমে গেছে বাইরে। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। ছাতা ছাড়া বাইরে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করা যাবে না। তাই তমাল ছাতাটা খুঁজে নিয়ে বের হল বাইরে। রাস্তাটা এখনই শুনশান হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টি হচ্ছে বলে লোকজন আর নতুন করে বের হয়নি ঘর থেকে একমাত্র যারা বেরিয়ে পড়েছে তারা ছাড়া।
গেট দিয়ে দাদুর বাড়ির ভিতর ঢুকল তমাল। বৃষ্টির তেজ এখনও কমেনি। ও সিঁড়ি বেয়ে উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছাতাটা বন্ধ করে দরজায় থাবড়াতে লাগল। কিন্তু কেউ এসে দরজা খুলল না। বেশ কয়েক সেকেন্ড কেটে গেল। বেশ অবাক হল তমাল। তারপর আরেকবার জোরে থাপ্পড় মারতে যাবে এমন সময় দেখল দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। অবাক হয়ে ভিতরে ঢুকল তমাল। কিন্তু আশেপাশে কোথাও কাউকে দেখতে পেলনা। জোরে জোরে দাদুকে ডাকতে লাগল তমাল।
দিদার ঘরে গিয়ে দেখল চেয়ারে এলিয়ে পড়ে আছেন তিনি। বিছানায় পড়ে আছে তার দাদু। দাদুর কাছে গিয়ে শরীরে ধাক্কা দিয়েও কোন সাড়া পেলনা তমাল। দিদারও একই অবস্থা। ঘাবড়ে গেল তমাল। মোবাইলটা বের করে অ্যাম্বুলেন্সকে ফোন করল ঝটপট। যতক্ষণ অ্যাম্বুলেন্স না এলো ততক্ষণ টেনশনে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল তমাল।
* * *
আই সি ইউ থেকে ডাক্তার বাইরে বেরিয়ে আসতেই তমাল ছুটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, 'কি খবর ডাক্তারবাবু?'
ডাক্তার বললেন, 'আপনার দাদু তো এখানে আনার আগেই মারা গেছেন। তাও আনুমানিক দুপুর নাগাদ। তবে আপনার দিদা অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন। সময়মতো না আনতে পারলে উনিও-'
ডাক্তার এই কথা বলে চলে গেলেন। কাঁচের দরজা দিয়ে ভিতরে তাকালো তমাল। বেডে শুয়ে আছে তার দিদা। কিন্তু যে দাদু তাকে ফোন করে ডাকল তিনি আর এই পৃথিবীতে নেই। তমাল ভাবতে লাগল সেটা কীভাবে সম্ভব? ডাক্তার বলল তিনি দুপুর নাগাদ মারা গেছেন। তাহলে তিনি একটু আগে কীভাবে তমালকে ফোন করলেন? নাকি ক্রস কানেকশন হয়ে অন্য কারো ফোন লেগে গিয়েছিল? যদি তাই হয় একই রকম ঘটনা অন্য পরিবারে একই সঙ্গে ঘটা সম্ভব কি? প্রশ্নগুলো মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল।
তমালের মোবাইলটা বেজে উঠলো হঠাৎ। কল রিসিভ করতেই তমালের মায়ের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, 'কিরে কোথায় গেলি না বলে?'
তমাল বলল, 'আমি হসপিটালে। মেজো দাদু আর দিদাকে নিয়ে এসেছি। দিদা আই সি ইউ-তে তবে দাদু-দাদু মারা গেছে।'
'সেকি? কখন হল এসব?' তমালের মা একটানা প্রশ্ন করল।
'এইতো তুমি বেরোবার পর।' তমাল বলল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, 'তা তুমি কার ফোন থেকে ফোন করছ? এটা তো আমাদের ফোন নম্বর নয়।'
'আমাদের ফোন তো গতকাল থেকে ডেড হয়ে পড়ে আছে। এখনও ঠিক করতে আসেনি। তাই পাশের ফ্ল্যাটের দিদির ফোন থেকে করছি।' তমালের মা বললেন।
মায়ের কথাগুলো শোনার পর মাথাটা যেন হঠাৎ ঘুরে গেল তমালের। মনে মনে ভাবল, 'গতকাল থেকে ফোন ডেড? তবে বিকালে ফোন এলো কীভাবে?'
তার মানে এতক্ষণ ধরে তমাল যা ভাবছিল সেটা ভুল? কোনো ক্রস কানেকশন হয়নি? ফোনই যখন ডেড তখন ক্রস কানেকশনের প্রশ্নই ওঠে না। কীসব অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল ওর সঙ্গে ভেবেই পেল না তমাল।
ফোনের ওপাশ থেকে মায়ের গলা ভেসে আসতে লাগল, 'হ্যালো তমাল। হ্যালো। কি হল কথা বলছিস না কেন?'
ভাবনা থেকে বেরিয়ে বাস্তবে ফিরে এলো তমাল।
'এখনও অনেক কাজ বাকি মা ফিরতে দেরি হবে।' বলেই ফোনটা কেটে দিয়ে পকেটে রেখে দিল। অদ্ভুত অবাস্তব চিন্তা ভাবনা মাথায় ঘুরতে লাগল তমালের। যেসবের কোনো ব্যাখ্যা ও খুঁজে পেল না।