মুক্তির স্বাদ
মুক্তির স্বাদ


তমাল দোতালার বারান্দায় গ্রিলের পাশে চেয়ারে বসে আছে। এক অস্থির অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলেছে সারা পৃথিবী। ঘরে বসে থাকা ছাড়া আর কোন কাজ নেই এখন ওর হাতে। বসে বসে অতীতের সব কথা ভাবছিল। ছোটবেলার কিছু কথা মনে পড়ল ওর।
বয়স কথা হবে তখন ছয় কি সাত। বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে প্রতিদিন পাশের ফাঁকা মাঠটায় যেত। সারা বিকাল ধরে খেলাধুলা চলত ওদের। শুধু খেলাধুলা নয় নানা রকম দুষ্টুমিতেও পারদর্শী ছিল ওরা। সেরকম খেলতে গিয়ে একদিন একটা আহত পাখিকে দেখতে পায় ওরা গাছের নিচে। হয়তো গাছের উপর থেকে পড়েছিল। কিন্তু উপরে কোন পাখির বাসা দেখতে পায়নি ওরা।
তমাল পাখিটাকে সঙ্গে করে ওর বাড়িতে নিয়ে আসে। ভালো করে শুশ্রূষা করে পাখিটাকে সুস্থ করে তোলে। পাখিটার জন্য বেশ মায়া পড়ে গিয়েছিল ওর। যখন সেটা সুস্থ হল ওর বাবাকে বলে একটা খাঁচার ব্যবস্থা করল তমাল। বাবা প্রথমে খাঁচা কিনে দিতে রাজি হয়নি। তার কথা ছিল বনের পাখি বনেই ভালো। মুক্ত পরিবেশে ঘুরে বেড়াবে। তাকে খাঁচায় বন্দি করে রাখা ঠিক নয়। কিন্তু তোমার তখন নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত তার বাবা খাঁচাটা কিনে দিতে বাধ্য হলেন।
খাঁচাটায় পাখিটাকে ভরে দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছিল বারান্দায় গ্রিলের সঙ্গে। অবশ্য সবসময় খেয়াল রাখত তমাল। একদম নিজের বন্ধুর মত। নিজের হাতে খাওয়াতো পাখিটাকে। আর পাখিটাও যেন ওর বন্ধু হয়ে গিয়েছিল।
একদিন তমাল খেয়াল করল বারান্দার বাইরে অন্য অনেক পাখি এসে ভিড় করেছে। নিজের প্রজাতির বন্ধুদের দেখে খাঁচার পাখিটাও বোধহয় আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছে। তাই কিচিরমিচির করে ডেকেই চলেছে। তমাল সেটা দেখে বাইরের পাখিগুলোকে তাড়ানোর চেষ্টা করলো। কারণ ও ভাবল ওই পাখিগুলো একে জ্বালাতন করছে।
কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। পাখিগুলোকে তাড়ানোর পর থেকেই খাঁচার পাখিটা যেন মন মরা হয়ে গেল। অনেকদিন পর নিজের বন্ধুদের হয়তো পেয়েছিল। তাদের সঙ্গে বেশ মনের মতামত বিনিময় হচ্ছিল। কিন্তু তমাল এসে বাঁধ সাধল। এভাবে পরপর চলছিল বেশ কয়েকদিন। যতক্ষণ বাইরের পাখিগুলো ওখানে থাকে খাঁচার পাখিটাও বেশ আনন্দে থাকে। কিন্তু সেগুলো চলে গেলে এও চুপচাপ হয়ে যায়।
একদিন তমালের মা ওকে বলল,' অনেক হয়েছে এবার পাখিটাকে ছেড়ে দে। ও ওর নিজের জায়গায় ফিরে যাক। বন্দী জীবন কারো ভালো লাগে নাকি? তোকে যদি কেউ এরকম আটকে রাখতে তোর কি ভালো লাগতো?'
তবু তমাল কিছু শুনতে চাইল না। ও পাখিটাকে ছাড়বেই না। শেষ পর্যন্ত ওর মা জোর করেই খাঁচাটার দরজা খুলে দিল। পাখিটা খাঁচা থেকে বেরিয়ে উড়ে চলে গেল। মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াতে লাগলো ওর সঙ্গীদের সঙ্গে।
তখন তমাল এই জিনিসটা বুঝতে পারেনি। কিন্তু আজ নিজেই গৃহবন্দি হয়ে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। পাখিটা সেদিন মুক্ত হয়ে মুক্তির যে স্বাদ পেয়েছিল তমালও ঠিক সেই স্বাদটাই পেতে চাইছে এখন। কবে পাবে কে জানে?