কড়চা#৬ বাজারে বাচ্চা হাতি
কড়চা#৬ বাজারে বাচ্চা হাতি


৩০শে মার্চ ২০২০
কড়চা লেখা এখন আমার নিত্যকর্ম। না লিখে উপায়ও নেই। ওপরওয়ালার নির্দেশ তো মানতেই হবে! আপনারাও তো ঘরবন্দী জীবন কাটাচ্ছেন। বিরক্তিকর অবস্থায় সময় কাটানোর মধ্যে কোথাকার কোন একটা উড়ে এসে জুড়ে বসা ভাইরাসের দৈনন্দিন কড়চা আপনাদের চোখেও পড়ছে, এটাই আমার সৌভাগ্য। আমিও লেখার অনুপ্রেরণা পাচ্ছি!!
মিছিমিছি ভণিতা ছেড়ে কাজের কথায় আসি। খবর তো পেয়েই গেছেন দেশের সব রাজ্যের সীমানা সিল করে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলগুলোতে ভিড় কমাতে মোট প্রায় হাজার তিনেক বন্দীকে প্যারোলে বা অন্তর্বর্তী জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই যখন গৃহবন্দী হচ্ছে, তখন এই এতগুলো বন্দী পেল মুক্তির স্বাদ। তা পাক, কিন্তু আমাকে যে কবে মুক্তি দেবে আমার বস তাই ভাবছি। এই অল্প কদিনেই বেশ হাঁফিয়ে উঠেছি - বেশিরভাগ লোক ভয়ে ভয়ে দূরে দূরে থাকছে বলে আমার দৌড়ঝাঁপটাও অনেক বেড়ে গেছে। আমার আরো এক ইয়ার চিকেন পক্স ভাইরাসের সাথে কথা হচ্ছিল। পশ্চিমবঙ্গে এই সময়টা ওরই দাপট থাকে। এবারে আমার জন্যে ওর বাজারটা ঠিক জমে নি, ও নাকি শুকিয়ে মরছে। ও যদি হাতির মতন গদাই লস্করী চালে চলে, তাহলে আমি কি করি বলুন তো!
তবে একটা সুখবরও আছে। আজকের খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে কিরকম যেন একটা পাশবিক আনন্দ পেলাম - সারা দেশে এবার হাজারে হাজির আমি! আক্রান্তের সংখ্যা অবশেষে ফোর ফিগারে! নিজেকে যেই হনু মনে করতে শুরু করেছি, বসের নতুন হুকুম এলো। সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং চলছে বলে সব মানুষ ঠাঁই নিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেখানেই চলছে ব্যাপক মেলামেশা, মতবিনিময়। এবার তাহলে ওখানেই নজর রাখতে হবে, প্রতিপক্ষ কি চাল চালছে সেটা বোঝার জন্যে। যেমন কথা, তেমন কাজ। সেঁটে গেলাম এক মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং-এ ফ্ল্যাট-বাসিন্দা এক মাসিমার গায়ে-পায়ে। পঞ্চান্নতে পা দিয়েছেন গত জানুয়ারীতে। একটু আদুরে, একটু নেকুনেকু, অনেকটাই আলসে প্রকৃতির। দেখতে শুনতে মন্দ না, সেজেগুজে পটের বিবি হয়ে থাকতেই ভালোবাসেন। ইদানীং নিয়মিত পার্লারে যান। স্বচ্ছল পরিবার। স্বামী একটা বিদেশী ব্যাঙ্কে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ। স্বচ্ছল অবস্থা। বেসমেন্টের গ্যারেজে মারুতি সিয়াজ শোভা পায়। ছেলে বড়, লণ্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সে পড়ে। তা এ হেন মাসিমা আগে ল্যাণ্ডলাইনে ফোন এলে বা করতে হলে সোফায় পা ছড়িয়ে বসেই থাকতেন। স্বামী বা লোরেটো কলেজে পড়া মেয়েকে হুকুম করতেন কর্ডলেস হ্যাণ্ডসেটটা এগিয়ে দিতে। এখন বছরখানেক সেটাও বিদেয় হয়েছে। কাজ চালান গত বছরের জন্মদিনে স্বামীর দেওয়া স্যামসুঙ গ্যালাক্সি অ্যাণ্ড্রয়েডে। এখনও খুব একটা সড়গড় হন নি ওটার নাড়াচাড়ায়। লকডাউনে মেয়েও ঘরবন্দি। তারই পাঁচদিনের ক্র্যাশকোর্স ট্রেনিংয়ে তিনি স্বামীর ফেসবুক ফ্রেণ্ডলিস্টে ধরে ফেলেছেন অজানা পাঁচ মহিলাকে। আর যায় কোথা! চিৎকারপর্ব শেষে প্রায় হাতাহাতির আঁচ পেতেই আমি চুপটি করে সটকে পড়লাম ওখান থেকে।
বিকেলে মেন রাস্তার চৌমাথার মোড়ে গিয়ে দেখি একটা হোমড়াচোমড়া পুলিশ পান বিড়ির দোকানের সামনে খুব হম্বিতম্বি করছে। দোকানী মনে হয় দোকান খুলে একশো টাকা প্যাকেটের সিগারেট কাউকে দুশো টাকায় বেচছিলো। পুলিশের তৎপরতা দেখে ভালো লাগলো। দাঁড়িয়ে গেলাম। যে দু চারটে লোক আশেপাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিল, তারা ঝামেলা দেখে সুড়সুড় করে সরে পড়ল। এই ফাঁকে চারটে কিং সাইজ গোল্ড ফ্লেকের প্যাকেট দোকানীর কাছ থেকে হাতিয়ে নিলেন বাবু। চেপেচুপে টাইট প্যান্টের দু পকেটে ঢুকে গেল প্যাকেটগুলো! হাতের লাঠিটা আর একবার দোকানীর দিকে উঁচিয়ে তাকে সাবধান করলেন বীরপুরুষ। পরক্ষণেই সেটা বাঁ বগলে চেপে অন্যদিকে টহলে গেলেন।
আমিও হাঁটছি। পৌঁছলাম একটা বাজারের কাছে। সন্ধ্যের এই বাজারে স্বাভাবিক দিনগুলোয় বাইরেও বাজার উপচে পড়ে। আনাজপাতির নানার পসরা নিয়ে লোকে যে যেখানে পারে বসে পড়ে। আজ বিক্রেতা বেশি, ক্রেতা কম। একজন খদ্দের জিগ্যেস করলো - তোমরা সাদা দাগ দাওনি কেন। দোকানী বললো - ওসব লক্ষ্মণরেখা বাবু সকালে দেখতে পাবেন, না মানলেই বাটাম দিচ্ছে। এমন সময় একটা মার্সিডিজ এসে থামল রাস্তায় আনাজের বড় দোকানটার ঠিক সামনে। কালো কাঁচটা ধীরে ধীরে নামতেই দেখলাম পেছনের সিটে বসে আছে কমবয়েসী একটা মেয়ে। মাথায় স্টেপকাট চুল, বাই-কালার। মুখে এন-নাইনটি ফাইভ মাস্ক; গাড়ি থেকে না নেমে মুখ বাড়িয়েই জিনিসপত্র দরদাম করতে লাগলো। পটল একশো, ক্যাপসিকাম আশি টাকা কিলো শুনে অবাঙালী টানে বললো - মুর্গা সোচ্ রহা হ্যায় ক্যা; সহী দাম বোল্। হঠাৎ তুইতোকারিতে কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও সত্তরের কাছাকাছি দোকানী বললো - দিদিভাই, কি যে বলো! কাল পুলিশের ডান্ডা খেয়েছি মাল আনার সময়। টাকা নিয়ে তবে মাল ছাড়ছে। ওই যে মুর্গার কথা বললে, গিয়ে দেখ, সেও আজ আড়াইশো টাকা কিলো। আজ ছাড়লো, কিন্তু মালের দামের থেকে গাড়ি ভাড়া বেশি; টেরেন বন্ধ, বাচ্চা হাতিতে করে এনেছি অন্যদিনের থেকে ডবল ভাড়া দিয়ে। এর থেকে কমে বেচে কি করে পোষাব? মেয়েটা এবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, ভুরু কুঁচকে চোখ কপালে তুলে বলে উঠল - বাচ্চা হাতি! দোকানী এবার হেসে ফেললো - ও মা, তাও জানো না! টাটা কোম্পানির ঐ যে ছোট ভ্যানগাড়ী -- চারশো সাত --- ওটাকেই তো বাচ্চা হাতি বলে গো দিদিভাই ...
কৃতজ্ঞতা স্বীকার - শ্রী অমরনাথ মুখোপাধ্যায়