কড়চা#১৩| ডুবছে দেশ, ভুল সন্দেশ
কড়চা#১৩| ডুবছে দেশ, ভুল সন্দেশ


০৬এপ্রিল ২০২০
লোকটার নাম নগেন। থাকে হাওড়ার জেলার একটা গ্রামে, ক্ষেতের সব্জি নিয়ে পাইকারদের কাছে বেচে। সবসময় যে ন্যায্য দাম পায় তা নয়, তবু... নেই মামার থেকে কানা মামা ভালো এই কথা ভেবে মেনেও নেয়। যেটুকু পয়সা পায় তা দিয়ে মোটামুটিভাবে ওর সংসার চলে যায়। পাইকাররা ওদের কাছ থেকে এখন জলের দরে জিনিস কিনছে - কিলো প্রতি পাঁচ টাকা, যেকোনো আনাজ। বলছে, বাজারে কেনবার লোক নেই। নগেনের ছেলের বন্ধু কলকাতায় কাজ করে, ওখানেই থাকে। সপ্তাহের শেষে গ্রামের বাড়িতে আসে আবার সোমবার ভোরে শহরে ফেরে। এবার তো লকডাউনের জেরে আসতে পারে নি, কলকাতার মেসেই আটকা পড়ে আছে। ওরই সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল ছেলের। জানিয়েছে ওসব পাইকারদের চালাকি। কলকাতায় সব সব্জি-আনাজের বাজার বেশ গরম। চাহিদার তুলনায় যোগান কম বলে চড়া দামে বিকোচ্ছে। কোনোটাই সস্তা নয়, সবকিছুরই দাম পঞ্চাশ টাকা কিলোর ওপরে। সেসব শুনে নগেন মনে মনে ভাবলো - নাঃ, এই লকডাউন কতোদিন চলবে ঠিক নেই। রোগটা যেভাবে ছড়াচ্ছে তাতে তো মনে হয় না সরকার এটা চট করে তুলে নেবে। বরং ধাপে ধাপে বাড়িয়েই যাবে। মধ্যে এক-দু'দিন ছাড় দিলেও দিতে পারে। তাহলে... ? পাইকাররা ওদের ঠকিয়েই যাবে আর ওরা পড়ে পড়ে মার খাবে! না, এ হতে দেওয়া যায়না। যেমন ভাবা তেমন কাজ।
নগেন ওর প্রতিবেশী কয়েকজন বন্ধু চাষীর সঙ্গে শলাপরামর্শ করল। গেল কাছাকাছি থানা আর বি ডি ও অফিসে। সেখানে গিয়ে সবকিছু জানিয়ে কাগজপত্র জোগাড় করলো। চাষীদের নিয়ে একটা লরি ভাড়া করে চলে এল কলকাতায়। প্রথমে দুটো বাজারে বসে সব্জি বেচার চেষ্টা করেছিল। বসতে দেয়নি উটকো বিক্রেতা বলে। তবু দমে নি নগেনরা। রিকশা-ভ্যান কয়েকটা ভাড়া করে ওরা পাড়ায় পাড়ায় হাঁক পেড়ে বিক্রি করছে। পাড়ার বাসিন্দাদের সুবিধে। বাজারে যেতে হচ্ছে না। ঘরে বসে কম দামে টাটকা শাকসব্জি পাচ্ছে। নগেনদের মুখে হাসি। খাটনি বেড়েছে বটে কিন্তু ভালোই বিক্রিবাটা হচ্ছে।
বাপরে, কি চড়া রোদ রে বাবা! আর তেমনি ভ্যাপসা গরম। দু'দণ্ড বাইরে থাকা দায়। ফ্যাট দিয়ে তৈরি আমার গায়ের চামড়া তো ঘাম হয়ে গলে বেরিয়ে যাবে মনে হচ্ছে! তাহলে তো দফারফা, জারিজুরি খতম! এই জন্যেই কি মানুষগুলো ভাবছিল যে গরমই আমার যম! কিন্তু আমি কি এতই বোকা যে গরমে গরমে ঘুরবো? দুপুর হলেই এখন অনেক বাড়িতে এসি চালিয়ে দেয়। ব্যস্, সুট্ করে সেঁধিয়ে পড়ি ঠাণ্ডা ঘরে, নিশ্চিন্তে জিরিয়ে নিই। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা কুল্ কুল্! শেষ বিকেলে রোদের তাপ অনেকটাই কমে, সন্ধ্যেটা যখন আসবো আসবো করে আমি আবার বেরিয়ে পড়ি। রাত বাকি, আমার কাজও বাকি!
দুপুর থেকে শুরু হয় সায়নের কনফারেন্স কলগুলো। ও কাজ করে এক বহুজাতিক সংস্থায় - থাকে জার্মানির মিউনিখে, ওখানের লোকেরা মুখটা একটু ছুঁচোলো করে বলে - 'ম্যুনশেন'। হপ্তাখানেকের ছুটিতে দেশে ফিরেছিল মেয়ের পাঁচ বছরের জন্মদিন ধুমধাম করে পালন করবে বলে। লকডাউনের ফলে দুম করে সেটা ক্যান্সেল করতে হয়েছে। মনটা সেইজন্যে বেশ খারাপ। শুধু তাই নয়, ওর ফিরে যাওয়াটাও এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে গেছে। বেশিরভাগ কাজই যেহেতু এখন অনলাইনে সারা যায়, সায়নকে ওর কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট অনুমতি দিয়েছে আপাততঃ এখানে থেকে কাজ করার। সায়ন একজন ইকনমিক রিসার্চার, বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করছিল, তার মধ্যে একটা ছিল আমাকে নিয়ে। এই যে আমি সারা দুনিয়া তোলপাড় করছি, দেশে দেশে মারণকাণ্ড চালাচ্ছি, এসবের কি ফল হবে বিশ্বের অর্থনীতিতে। ওর এই গবেষণার বিষয়ের কথা জানতে পেরে আমারও মনে একটা কৌতুহল দানা বেঁধেছে। আমার এই তাণ্ডবলীলার প্রভাব কোথায় কতটুকু সেসব জানতে পারলে তবেই না বুঝবো আমি কতবড় কেউকেটা! তাই মনে একরাশ আগ্রহ নিয়ে ওর অজান্তে আমি চোখ রাখলাম ওর ল্যাপটপের স্ক্রিনে আর কান রাখলাম স্পিকারে। ওর বস রবার্ট বয়সে ওর থেকে সামান্য বড়। সায়ন শুরু করলো।
- গুড মর্নিং রবার্ট, সব ভালো তো?
- এখনো অবধি...উইকএন্ডে একটু জ্বর সর্দি কাশি ছিল
- বলো কি?
- এখন ফীলিং মাচ্ বেটার। আরে, নাথিং টু ওয়রি, সেরকম কিছু না। জানো লাস্ট উইকে যার সাথে টেনিস খেলেছি পার্টনারশিপে, সে করোনা-অ্যাফেক্টেড, ট্রিটমেন্ট চলছে!
- ওহ মাই গড!
- তবে ঠিক আছে, রিকভারিং নাও।
- নাইস টু হিয়ার দ্যাট!
- হুমম্।
-এখনো টেনিস খেলতে যাচ্ছ নাকি?
- পাগল নাকি, এভরিথিং ইজ্ শাটডাউন।এমন কি পার্কের বেঞ্চে বসলেও পুলিশ ২০০ ইউরো ফাইন করছে।
- মাই গুডনেস। দুশো! আমাদের এখানে তো রাস্তায় দেখলেই পুলিশ লাঠি দিয়ে এন্তার পেটাচ্ছে...
- তবু ঠিক আছে। ২০০ ইউরোর থেকে লাঠি খাওয়া ফার বেটার! বাই দ্য ওয়ে, হোয়াটস্ অন দ্য প্লেট বিহাইন্ড ইউ? আই ক্যান সি দ্যাট!
সায়ন একটু হেসে প্লেটটা তুলে ল্যাপটপের ক্যামেরার সামনে ধরলো
- ব্লাডি হেল, দ্যাট লুকস লাইক...
- আ নিউ প্রোডাক্ট; করোনা সন্দেশ
- হোয়াট ডিড্ ইউ সে, স্যান্ডওয়াস? সাউন্ডস্ মোর লাইক হ্যান্ডওয়াশ।
দুজনের হাসির মাঝে আমি নিজের একটা সুন্দর প্রতিমূর্তি দেখলাম - লাল রঙের। মিষ্টির দোকান বন্ধ রাখায় প্রচুর দুধ নষ্ট হচ্ছিল। তাই কয়েকদিন হলো মিষ্টির দোকানগুলোকে চার ঘন্টা খুলে রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাই বলে আমাকে নকল করে মিষ্টি, কি অনাছিস্টি!
সায়ন আর রবার্টের মধ্যে যা কথা হলো, তাতে বুঝলাম এবারের মতন ধাক্কা, সারা পৃথিবীর সব বাজার আগে কখনো খায়নি। আই এম এফ বলেছে ১৯৩০র থেকেও অনেক বড় মন্দা আসতে চলেছে। পৃথিবীর সব শেয়ার মার্কেটে এই দুমাসেই লালবাতি। আমেরিকার এস অ্যাণ্ড পি ইনডেক্স ২০০১ বা ২০০৯ সালে ৫০ শতাংশ নেমে যেতে দু বা এক বছর সময় নিয়েছিল, এবারে নাকি ৬৭ শতাংশ নেমেছে মাত্র তিন মাসে, কারণ আর কেউ নয়, আমি! শ্রীশ্রীশ্রী করোনা। হিঃ, হিঃ কি মজা!
এই ঘোরতর মন্দা যদি পৃথিবীর লোকেরা খুব তাড়াতাড়ি কাটাতে পারে, তাহলে সেই পড়তি থেকে আবার স্বাভাবিক বা চাঙ্গা হয়ে ওঠার গ্রাফটা নাকি ইংরেজি অক্ষর ‘ভি’-এর মতন হতে পারে, যদি মাঝারি সময় নেয় তাহলে অক্ষর 'ইউ' আর অনেক অনেক সময় নিলে 'এল', মুখ থুবড়ে পড়েই থাকবে বহুদিন...
মন্দা থেকে ছন্দে ফিরতে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি, ভি-ইউ-এল যে আকারই নিক না কেন - 'সন্দেশ'(শব্দটা সমাচারও তো বোঝায়) কি বলছে, কিছু ভুল?
ধন্যবাদ - শ্রী অমরনাথ মুখোপাধ্যায়