কড়চা #১২ | বাতি মোম, তারক বোম
কড়চা #১২ | বাতি মোম, তারক বোম


০৫এপ্রিল ২০২০
কাল রাতে মানুষদের বন্ধু আমার জ্ঞাতিভাই ফাজ ভাইরাসের সাথে গল্প জুড়েছিলাম। কাজের মাঝে একটু বিরাম তো চাই। ও-ই বলছিল আমার অনারে আজ নাকি আগাম দীপাবলী!
এদেশের প্রধানমন্ত্রী লকডাউন ঘোষণা করেছিলেন থালা, বাসন বাজিয়ে, সেটা ছিল আমাকে তাড়ানোর জন্যে সেই আদি শব্দব্রহ্মের আরাধনা। কদ্দূর কি সাফল্য এসেছে তা নিয়ে তর্কে যাব না। পরদিন কাগজে অনেকেই, বিশেষতঃ ওনার বিরোধীরা, সরব হয়েছিল। বলেছিল, ছাই পরিকল্পনা, সবকিছুতেই বিদেশের নকল। স্পেন ও ইটালিতে লোকেরা একজোট হয়ে এক বিশেষ সময়ে যে যার বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে করতালি দিয়েছিল সেবাকর্মীদের। এখানে কি হল? শব্দদানব জেগে উঠল। তার তাণ্ডবে শব্দদূষণ বাড়ল বই কমলো না
আজ রাতের বিধান কি? ঘরে ঘরে আলো নিভবে, জ্বলবে মোমবাতি। মোবাইলের টর্চও জ্বলতে পারে। সংখ্যার হিসেবটাও সুন্দর। মাসের ন' তারিখ, রাত ন'টা, নিষ্প্রদীপ থাকবে ন'মিনিট। ভারি মজা, নহলে পে দহলা! এটা শোনার পর থেকেই দীপকবাবু পুরোপুরি নাজেহাল, হাতে হ্যারিকেন। উনি কাজ করেন পাওয়ার সাপ্লাইয়ের ডিস্ট্রিবিউশনে; গত চব্বিশ ঘন্টায় যত ফোন ধরেছেন, তা গত চব্বিশ বছরেও ধরতে হয়নি। কোথায় তাঁর চাকরি সেটা কি আদৌ কেউ জানত? উনি অন্তত ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। ফেসবুক, হোয়াটসেঅ্যাপ কোনোটাতেই ওনার নাম নেই। পরে বুঝলেন কীর্তিটা কার। বন্ধু শ্যামল পরশু ফোন করে খুব গর্ব করে বলল,
- গ্রুপে এখন তোর খুব ডিমান্ড বুঝলি? একে গরম, তারপর লকডাউন, তারপর আবার ন মিনিটের লাইট অফ। সবারই মনে কি হবে কি হবে ভাব, ঝুড়ি ঝুড়ি প্রশ্ন ... আমি তোর কথা বলতেই সবাই হৈহৈ করে উঠলো, তাইতো, দীপককে জিগ্যেস করা যাক, ওই-ই ভালো গাইড করতে পারবে।
- আরে, এতে আমি কি করবো?
- এই অন্ধকারই তো পরিচিতদের মধ্যে তোকে লাইমলাইটে আসার সুযোগ দেবে রে ভাই...
গ্রামের বুড়ি পিসিমা থেকে পাশের বাড়ির ঢলানি বৌদি নীলিমা পর্যন্ত সবার হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে দীপকবাবুর কাল ভাল করে পেটসাফাও হয়নি। এমনিতেই ওনার ইয়েতে একটু বেশি সময় লাগে। সিগারেটে দু'টান দিলে তবেই একটু বেগ আসে। ওদিকে লকডাউনের জন্যে সব পানবিড়ির দোকান বন্ধ। নেহাত এমারজেন্সি সার্ভিসে আছেন - শহরতলিতে একটু যাতায়াত আছে, তাই একে তাকে ধরে কিছু বিড়ি জোগাড় করেছেন। ওটা নিয়ে আবার বউ শান্তিশ্রী যা অশান্তি জুড়েছে, ঘরে থাকাই দায়। এদিকে লোকের প্রশ্নেরও অন্ত নেই। কারোর ভাবনা এটা আলোর লকডাউনের শুরু নয়তো? কেউ চিন্তিত ন'মিনিট এতটা কম চাহিদা থাকলে পাওয়ার গ্রিড হয়ত ফেল করবে; কেউ আবার ভাবছে এই সময় ভোল্টেজ ওঠানামায় ফ্রিজ, টিভি, এসি এসব না ট্রিপ করে!
ফোনে আড়ি পেতে পেতে আমারও কানমাথা ঝালাপালা হয়ে গেছে। তাই একটু রাস্তায় এলাম হাওয়া খেতে। কাছের একটা বস্তিতে থাকে তারক, অটো চালায়। বস্তির এক কামরায় তার বউ আর উঠতি বয়সের ছেলে বোমের ছোট সংসার। বাড়ির সামনে পড়ে থাকা অটোতে স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করছিল তারক, ব্যাটারিটাকে চালু রাখতে। পয়লা বৈশাখের আগে এই সময়টায় চেতলা - গড়িয়াহাট রুটে ওর পক্ষীরাজ ছোটে হাওয়ার বেগে। বোম এসে পাশে দাঁড়ালো, ওর ইচ্ছে কয়েকটা হাউই আর চকলেট বোমা কিনে আনবে। করোনা তাড়ানোর জন্যে মহাশক্তিকে জাগ্রত করার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। মহাশক্তি মানেই মা কালী, আর কালী মানেই দিওয়ালি। বাড়িতে চাল শেষ বলে ওর বউ সীমা একটু আগেই ঘ্যানঘ্যান করছিল। বোম ওর ইচ্ছের কথাটা বাপকে বলেই টাকার জন্য হাত বাড়ালো। বাপ ক্যাঁৎ ক্যাঁৎ করে দুটো লাথি ছুঁড়লো ছেলের দিকে, একটা লাগলো, একটা ফসকে গেলো।
এসব দেখে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। আরো একটু দূরে জ্যোতিষসমুদ্র নটরাজের বাড়ি। চেম্বার অনেক দূরে, এই লকডাউনের বাজারে বাড়িতে বসে ফোনে আর ভিডিও কলেই সার্ভিস দিচ্ছেন জনগণকে। আজ চারটে বাজতেই বিছানা ছেড়ে ব্রাহ্মমুহূর্তে লম্বা ধ্যানে বসেছেন। ওনার মেয়ে আবার হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ ফরোয়ার্ড করেছে। পড়াশুনার সূত্রে থাকে জাপানে। এই সময়ে সেটাও এক চিন্তা। মেসেজটা গ্লোবাল পিস মেডিটেশন থেকে। ওঁরা বলছেন এদেশের সকাল আটটা পনেরো মিনিটে ধ্যানে বসতে, কুড়ি মিনিটের জন্যে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষাধিক লোক প্রার্থনা করবেন যাতে পৃথিবী রোগমুক্ত হয়ে দ্য এজ অফ একুয়ারিয়াসে উত্তরণ ঘটাতে পারে। উনি যখন ধ্যানে, ওনার ফোনে একটা ভিডিও দেখে চমকে গেলাম। কাল মেয়েকে পাঠিয়েছে একজন আই আই টি পাশ ছেলে, যে এখন জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা করে, করোনা নিয়ে তার ভবিষ্যৎবাণী। সে বলেছে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে নাকি আমার ওষুধ তৈরি হয়ে যাবে। আমার খেল তখন খতম্। কি সব অলুক্ষুণে কথা বলুন দিকি! তবে আবার নাকি আমি ফিরে আসব, এই বর্ষায়…
একটু ভয়ে ভয়েই সারাটা দিন কাটালাম। না জানি রাতে কি হবে! নটা বাজার একটু আগে ঢুঁ মারলাম দীপকবাবুর বাড়িতে। দেখি উনি শ্রীঘরে আটকে, পেটের গ্যাস ঊর্দ্ধমুখী সন্ধ্যে থেকেই। বাইরের ঘরে ওনার ফোন বেজেই যাচ্ছে, আর শান্তিশ্রী মেয়ে শ্রীদীপাকে নিয়ে বারান্দায় মোমবাতি জ্বালাচ্ছে ওনার গুষ্টির তুষ্টিপুজো করতে করতে। বেঁচে থাকা দুটো বিড়ির একটা ধরালেন দীপকবাবু। ঘনঘন দুটান দিতেই সুফল, নিম্নচাপ অনুভব করলেন। কমোডে ঠিকঠাক পজিশন নিতে যাবেন ... বুমম্, বুমম্, বুমম্! আতসবাজির শব্দে ওনার কোষ্ঠ আবার ব্যাকগিয়ার দিয়ে বন্দী হলো দীর্ঘ অন্ত্রের প্রকোষ্ঠে।
ধন্যবাদ - শ্রী অমরনাথ মুখোপাধ্যায়