কড়চা #১০ | চৈত্র সেল ডাহা ফেল
কড়চা #১০ | চৈত্র সেল ডাহা ফেল
০৩ এপ্রিল ২০২০
আমার জন্ম-রহস্য জানার আগ্রহ আপনাদের খুব না? আদৌ প্রকৃতি আমার জন্মদাত্রী নাকি প্রাচ্যের কোনো এক ল্যাবরেটরিতে আমি তৈরি, তা নিয়ে আপনারা বিশেষ ভাবিত। রোজই নতুন নতুন তথ্য প্রকাশ হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েকজন কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলে দিয়েছেন যে আমি ল্যাবে তৈরি নয়। গুগল করে দেখুন তো একবার বাড়তি কিছু জানতে পারেন কিনা! আচ্ছা, আমার জন্মের পেছনে আরও কোনো রহস্যের কথা কি আপনাদের মাথায় আসছে না? আপনারা ভাবতে থাকুন। তবে আমি এইটুকু বলতে পারি যে আমার জন্মদাতা বা জন্মদাত্রীকে আমি শ্রদ্ধা করি আপনাদের মতোই। আপনি করেন না?
আলগা ঘুমটা ভেঙে গেল একটা ফোনের শব্দে। মনে রাখার মতো রিংটোন -- ম্যয় হুঁ, ম্যয় হুঁ, ম্যয় হুঁ ডন্! বেশ মজার তো! এই সাতসকালে এটা শুনতে পেয়ে আমার মনে হচ্ছে আমি ডন-ই বটে। ঘুমের কথা বললাম বলে অবাক হচ্ছেন! হবারই কথা, কারণ আমিই তো আগে বলেছি ভাইরাসদের ঘুম নেই। আমার স্বভাবচরিত্রটা অনেকটাই ওই দেশটার লোকেদের মতো, যে দেশে আমি জন্ম নিয়েছি। ওরাও খাওয়া ও ঘুমের সময়টুকু বাদ দিলে প্রায় সারাক্ষণ কাজ করেই চলেছে। তবে এই ঘুমের কথা আসছে কি করে? আসলে, এসেছি তো কলকাতায়। এখানে এসেছি অথচ আলসেমি আসবেনা, দুপুরে ভাতঘুম দেবনা - তাও কি হয়!
একটা মেসবাড়ির সামনে ঘুরঘুর করছিলাম। কোন ফাঁকে যে ভোরের দিকে একটু চোখ লেগে গেছিল বুঝতেই পারিনি। এক বছর তিরিশের ছোকরা বুবান এখানে থাকে, ওরই ফোন বাজছে। ছোকরার বাড়ি মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে। কলকাতায় চাকরি করে, রোজগারপাতিও মন্দ না, কিন্তু পয়সা বাঁচানোর চক্করে মেসেই থাকে, এখনও ফ্ল্যাট কেনেনি। বাপ-মা দেশের গ্রামে থাকে। আগে খুব গরিব ছিল ওরা। এখন ছেলের কল্যাণে একটু পয়সার মুখ দেখেছে। শুয়েই হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিল। ট্যাপ করতেই দেখল বাবা ফোন করেছে। বুবানের চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়ায়। গতকাল রাতে ঘুম ঠিক মতন হয়নি। ওর বান্ধবী সুদেষ্ণার সাথে ফোনেই ঝগড়া চলেছে অনেক রাত অবধি। ও জানে বাবা কেন ফোন করেছে - মাসের শেষে ও এখনও টাকা পাঠায়নি বাড়িতে। লকডাউন হলেও পোস্ট অফিস খোলা। কিন্তু সুদেষ্ণা তো পিরীতির আঠা। ওকে বারবার সাবধান করে বলেছে পোস্ট অফিসে যদি বুবান যায় তবে ও কথা বন্ধ করে দেবে। বুবানকে মেসবাড়ি থেকে বেরোতেই বারণ করেছে। এও বলেছে পোস্ট অফিসে নাকি সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেক বেশি; কারণ ওখানে দেশ, বিদেশের থেকে জিনিস আসে! বুবানের রাগ হয় বাবার উপর - এতবার বলা সত্ত্বেও কিছুতেই এটিএমের ব্যবহার শিখলো না। ওদের পাশের গ্রামেই এটিএম আছে। এখন যা পরিস্থিতি পাড়া থেকে চেয়েচিন্তে কাটাতে হবে কয়েকটা দিন। সে অভ্যেস যে বাবা-মার আছে, তা বুবান গ্রামে থাকার সময় চাক্ষুষ করেছে। গ্রামের লোকেরা এখন ওদের হিংসে করে, তবু এই অসময়ে চাইলে নিশ্চয়ই দেবে। জানে পরে ঠিক পেয়ে যাবে। ছেলে তো ভালো রোজগেরে। ফোনটা ধরতেই বুবানের বাবা একে একে শুধোলেন ওর শরীর, মন ঠিক আছে ক
িনা, খাওয়াদাওয়ায় কোনো অসুবিধে হচ্ছে কিনা - মেসবাড়িতে কি রান্নার মাসি আসছে, অফিসে টাকা বা ছুটি কাটবে না তো... মা শেষে ফোন ধরে কান্না ভেজা গলায় বললেন - শোন বাবা, একটা নতুন জামা পারলে কিনিস, সামনে পয়লা বৈশাখ...
বুবানের মেসটা দক্ষিণ কলকাতায়, অশ্বিনী দত্ত রোডে। ও জানে প্রত্যেক বছর এই সময়টায় পয়লা বৈশাখের আগে রাসবিহারী মোড়, লেক মার্কেট, গড়িয়াহাট গমগম করে। ফুটপাথে হাঁটা দায়, দোকানে, স্টলে প্রচণ্ড ভিড়, লোক গিজগিজ করে আর একটু পরে পরেই হকারদের মিলিত চিৎকার - সেল সেল সেল! পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে এই সেলের ব্যাপারটা ছিল অনেকটাই অন্যরকম। পাইকারদের সঙ্গে দোকানীদের সারা বছরের হিসেব পুরোপুরি মিটমাট করার এটাই ছিল সময়, ধারবাকি সব মিটিয়ে দিতে হবে। বাংলা নতুন বছর শুরু হবে হালখাতা দিয়ে, আবার শুরু হবে নতুন হিসেবপত্তর। তাই যা স্টকে থাকতো, সেগুলো ছেড়ে দিত লাভ না রেখে কেনা দামেই, কখনও বা তার থেকেও কম দামে। কোনো ধুতিতে হয়ত একটু ময়লা দাগ, কোনো শার্টের হয়তো একটা হাতার সুতো একটু খোলা কিম্বা কলারে ধুলোর দাগটা বসে গেছে, শাড়ির ছাপাটা হয়তো একটু আবছা এক জায়গায়, ম্যাক্সি, নাইটির পাটের ভাঁজে হালকা দাগ - এইরকম আরকি। দোকানীরা বোঝাতো - ওসব কিছু না, জিনিসটা নিয়ে যান, ঠকবেন না। নিশ্চিন্তে নিয়ে যান, বাড়িতে গিয়ে সাবানজলে একবার কেচে নেবেন, সব দাগ চলে যাবে। কোথাও পাবেন না এই দামে। ভিড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়া খদ্দেররাও অনেক বেছেটেছে অনেকটা কম দামেই সেসব লুফে নিত।
আমার জ্ঞাতিভাই ম্যালেরিয়াল প্যারাসাইট বয়সে অনেকটাই প্রবীণ, তারই মুখে শুনলাম এসব কথা। স্বাধীনতার আগে থেকেই এই কলকাতায় ওর আনাগোনা। ওর দাপটে তখন লোকে কাঁপতো। ভালুকের জ্বরের মতো কাঁপুনি দিয়ে মানুষের শরীরে জ্বর আসতো, গাদাগুচ্ছের কুইনাইন খেয়ে বাঁচার চেষ্টা করতো, অনেকে আবার কাঁপতে কাঁপতে টেঁসেও যেত। লোকে ভয়ে বলতো ম্যালেরিয়া মহামারী। ওই বলছিল আরও দক্ষিণে গড়িয়া অঞ্চলে নাকি গরুর হাট বসতো, পাইকাররা যাবার পথে এখানে ঘাঁটি গেড়ে জিরোতো। সেই থেকে গড়িয়াহাট নাম!
- তাহলে তুমি বলছো এই সব দাগ ধরা, রদ্দি মাল কেনার জন্য এত কাণ্ড?
- আরে না না, তোকে আগেই বললাম তো, সেসব ছিল স্টক ক্লিয়ারেন্স সেল। এখনও কিছুটা তাই, কিন্তু বেশিরভাগই কিছুদিন আগে থেকে দাম বাড়িয়ে রেখে এইসময় কমিয়ে ডিসকাউন্ট দিয়ে বিক্রি করে মহাজনের পাওনার টাকা জোগাড় করে। আজকাল তো এই সেলের বাজারের জন্যে শাড়ী কাপড়জামা নতুনভাবে তৈরিও হয় শুনছি।
- তাহলে লোকেই বা কেনে কেন? পাব্লিক কি এত বোকা?
- বোকা তো বটেই! না হলে কি এখন, তোকে রোখবার জন্যে যখন দূরে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে তখন এরা রেশন দোকানের সামনে ভিড় করে হুটোপাটি, মারপিট করে?
- ঠিক বলেছো দাদা। এবছর তো বন্ধ সেল! বোঝ ঠ্যালা! আমার সাথে এইসব লড়াইয়ে এরা এখনো ডাহা ফেল!
ধন্যবাদ - শ্রী অমরনাথ মুখোপাধ্যায়