Rima Goswami

Horror Crime Thriller

3.0  

Rima Goswami

Horror Crime Thriller

কঙ্কাবতীর অনন্ত অপেক্ষা

কঙ্কাবতীর অনন্ত অপেক্ষা

7 mins
1.2K


যুগ যুগ ধরে এই পরিত্যক্ত রাজবাড়ীতে অপেক্ষা করছি মুক্তির , হয়ত শিগ্র সেই দিন আগত । আমি কঙ্কাবতী , সেদিনের নাম করা বাইজি । রাজা অংশুমান সিংহল তার রাজ্য সিংহলে আমাকে যেচে আনিয়ে ছিলেন মিরাট থেকে , নিজের মনোরঞ্জন করার জন্য । মিরাটের রাজা বাহাদুর শাস্ত্রী আমাকে যত্নেই রেখেছিলেন । আমার দীর্ঘ মেঘের ন্যায় কেশরাসি , মড়ালের মত গ্রিম্বা , কমলের ন্যায় দুই নয়ন আর উজ্জ্বল গাত্র বর্ন । দাসীরাই না রানিমহলে ও গুঞ্জন ছিল তাম্বুলের আরক নাকি আমার গলা দিয়ে পেরোনোর সময় বাহির থেকে তার আভাস পাওয়া যেত । আমি সুন্দরী ও কলায় পারদর্শী এক নারী কঙ্কাবতী । নাটোর হতে গজে হাউদা তে আমাকে আনা হলো সিংহলে । রাজা অংশুমান আমায় রেশমের গালিচা বিছিয়ে মহল পর্যন্ত নিয়ে গেলেন । সদ্য বিবাহিত তখন উনি , রানী সৌদামিনি তখন সদ্য যৌবনে প্রবেশ করেছেন । ওনাকে ও দেখলাম পর্দার অন্তরালে থেকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমাকে দেখছেন । সুপুরুষ রাজার ব্যবহার ও অমায়িক , উনি আমাকে বললেন ভদ্রে আপনি নিঃসঙ্কোচে সারা মহলে বিহার করবেন । আপনি আমার অতিথি , নাটোর রাজ সত্য ভাগ্যবান যে আপনার মত উর্বশী ওনার কাছে বিরাজ করছেন । আপনার নৃত্যশৈলী দেখে আমি ধন্য হবো , আপাততঃ আপনি বিশ্রাম নিন । আমি এক বাইজি , নাটোরে আমার সন্মান আছে । তবু রাজার এই ব্যবহার আমায় মুগ্ধ করলো , উনি আমাকে প্রথম দর্শনে আর পাঁচজন রাজ অতিথিদের মত সত্কার করলেন আর সারা মহলে স্বাভাবিক ভাবেই থাকার অনুমতি ও দিলেন । কথায় আছে প্রেম প্রথম দর্শনেই হয় , আমার ক্ষেত্রে ও তাই হলো । আর সেটাই আমার কাল হয়ে দাঁড়ালো , আজও মুক্তি নেই আমার । রাজা অংশুমান এর স্ত্রী সৌদামিনি যেচেই আলাপ জমালো আমার সাথে । ওর গল্পের সাথী হয়ে গেলাম অচিরে । একসাথে সকাল থেকে ঘুরে ঘুরে বাগানে ফুল তোলা , দোলনা দোলা , একে অপরকে সাজানো , পানের খিলি বানানো এই সব নিয়েই আমরা দুজনে পরে থাকতাম । একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করলাম মিনি মানে সৌদামিনি কিন্তু মহাদেবের বড় একনিষ্ঠ ভক্ত ছিল । রাজন অংশুমান এর মা , রাজমাতা আমাদের মধ্যে এই সখী পাতানোটা খুব একটা ভালো চোখে দেখতেন না । মুখে কিছু না বললেও বুঝতাম , দুজনের তোলা ফুলের সাজি থেকে রাজমাতা মিনির টাই তুলে নিতেন , মহাদেবের পুজোয় আমার তোলা ফুল উনি ব্যবহার করতেন না । আমার খারাপ লাগত কিন্তু সত্যি তো আমি এক বারঙ্গনা আর মিনি রানী ।


যদিও কপাল ভালো ছিলো আমার নাটোর রাজ বা তার পরিবারের কেউ আমার নৃত্যে উপভোগ করলেও আমাকে ভোগ করেননি , এটাই ছিল ওনার রীতি । আমি ছিলাম শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ কুমারী । এই নিয়ে আমার অহংকার ও ছিল ভীষণ । এসবের মধ্যে জলসা ও বসছিল নাচের , রাজা মুগ্ধ হচ্ছিলেন দিন প্রতিদিন । মিনির কাছে জানতে পারি রাজার সাথে তার দাম্পত্য জীবন বড়ই সাদামাটা । তিনি ব্যস্ত থাকেন নিজের রাজকার্যে , আর তার পর ক্লান্ত রাজন মিনির ঘরে এসেই শুয়ে পড়েন , দুটো কথা ও তিনি বলেন না মিনির সাথে । মিনির যদিও এই নিয়ে কোন অভিযোগ ছিল না , সে দিব্য মত্ত ছিল আমার সাথে , হয়ত বোঝার বয়সটা ই তখন ওর ছিলোনা । এভাবেই দিন পেরিয়ে যেতে লাগলো আমার প্রতি অনুরাগ বাড়তে লাগলো অংশুমানের । ওনার ধর্মপত্নী ওনার প্রেমিকা হয়ে উঠতে পারেনি আমি সেই স্থান অনায়াসে দখল করে নিলাম সবার অগোচরে । অংশুমান আমার হয়ে গেল ধীরে ধীরে , এবার আমি মিনিকে আর তেমন সময় দিতাম না , অংশুমান তো আগেও কোনদিন ই ওকে সময় দিত না । মিনি রোজ আমার অপেক্ষায় থাকত , আমি যেতাম না ওর কাছে । আমি তো অংশুমানের সাথে ব্যস্ত ছিলাম , জলকেলী শিকার আর ঘরসওয়ারী নিয়ে । সেদিন রাজন ব্যস্ত ছিলেন তাই গেলাম মিনির কাছে দেখা করতে । দেখলাম মিনি তার ঘরে নেই , বেরিয়েই আসছিলাম রাজমাতার সাথে দেখা । উনি আমার দাঁড়াতে বললেন , দাঁড়ালাম । বললেন আমি কবে নাটোর ফিরবো ? বিনীত ভাবে জানালাম রাজা যেদিন আজ্ঞা দেবেন । রাজমাতা বললেন , তা হলে তো কোনদিনই আর নাটোরে ফেরা হবেনা কঙ্কাবতী ! এস আমার সাথে তোমাকে কিছু দেখাতে চাই । গেলাম ওনার সাথে , উনি আমাকে মন্দিরের গর্ভগৃহে নিয়ে গেলেন । দেখলাম মিনি আদিদেব মহাদেবের সামনে বসে তপস্যা রত । এই কদিনে এ কি হাল হয়েছে তার ? আমি অবাক হলাম । সুন্দরী সে কোনদিনই নয় তবে আজ এই এলোকেসি , গেরুয়া বসনে আবৃত নারী যে আমার পরিচিত নয় ! সামনে এগিয়ে গেলাম , মিনির বন্ধ দুই চোখের কোলে কালি , কেমন যেন রুগ্ন শরীর তবে মুখে ফুটে উঠেছে এক জেদ আর রাগের সমন্বয় । রাজমাতা বললেন , সৌদামিনি সন্তানসম্ভবা কঙ্কাবতী তুমি হয়ত তোমার সই এর এ খবর জানোনা । আসলে তুমি জানার সময় তো পাওনা এখন । তোমার সই সিংহলের রানী শুধু তাই না , সে একজন সিংহলগনা । এই ধরণের নারী সতী তথা খুব ভালো মানুষ হয় তবে এর বিশ্বাস হরণ করা মানে তো কালকে ডেকে নিয়ে আসা । আর তুমি এই ভুলটাই করলে , মেয়েটা তোমাকে ভালোবাসলো তুমি ওরই স্বামীকে ছিনিয়ে নিতে চাইলে ।


এবার তুমি যদি স্বইচ্ছায় না সরে যাও তুমি ওর অভিশাপের শিকার হবে । তোমার মুক্তি মৃত্যুর পর ও সম্ভব হবে না । তুমি বাইজি হলেও আমায় মেয়ের মত , আর সেই জন্যই বলছি ফিরে যাও নাটোর । এক অবাধ্য পুরুষকে বোঝানোর থেকে তোমাকে বোঝানোই আমার সহজ মনে হলো । এবার তুমি যা ভালো বোঝো , এই পর্য্যন্ত বলে উনি চলে গেলেন । ওনার কথা গুলো তখণ আমার মাথার উপর দিয়ে গেছিলো , একটা কথাই আমার মাথায় ঘুরছিল মিনি সন্তানসম্ভবা । রাজা অংশুমান তা হলে গাছের ও খাচ্ছেন আর তলার ও কুড়াচ্ছেন ? আমি রাগে অন্ধ হয়ে বিবেক হারালাম । ভুলে গেলাম এটা তো স্বাভাবিক , রাজনের সন্তান তো রানিই ধারণ করবেন । ক্রোধে পাগল আমি মহাদেবের সামনে প্রতিষ্ঠা করা ত্রিশূল তুলে নিলাম , গর্ভগৃহ ত্যাগ করে বেরিয়ে এলাম । রাজন এই সময় মন্ত্রণালয়ে থাকেন , আমি এগিয়ে গেলাম। উন্মাদিনী আমি কঙ্কাবতী মন্ত্রণালয়ে প্রবেশ করে কারো কিছু বোঝার আগেই অংশুমানের বুকে গেঁথে দিলাম ত্রিশূল । এফোর ওফর হয়ে গেল সেটা , সবাই হই হই করে উঠলো । রাজা মাটিতে পড়ে গেল , আমাকে তৎক্ষণাৎ বন্দি করা হলো । বেচারা অংশুমান জানতেই পারলো না তার আগত সন্তানের খবর , আমি তার প্রেয়সী তাকে চির ঘুমে পাঠিয়ে দিলাম । রাজমাতা খবর পেয়ে ছুটে এলেন , পুত্রের এই অবস্থা দেখে শোকে কাতর হয়ে উঠলেন । ওনার আসার আগেই অংশুমানের মৃত্যু ঘটে , কিছুক্ষন কাঁদার পর উনি উঠে দাঁড়ালেন । আমার হাত ধরে আবার টানতে টানতে নিয়ে গেলেন মিনির কাছে । মিনি তখনো জানে না তার সিঁদুরের অধিকার সে হারিয়েছে , সে তপস্যায় রত । রাজমাতা তাকে ডাকলেন , অনেক সময় ধরে ডাকার পর সে সমাধি ভেঙে তাকালো । রাজমাতার কাছে সব শুনে সে মোহাবিষ্ট র মত কিছু না বলে মন্ত্রণালয়ের দিকে এগিয়ে গেল । আমাকেও আবার ওখানে নিয়ে যাওয়া হলো , আমি তখন সিংহলের বন্দি । অংশুমান কে মৃত দেখে শান্ত মিশুকে মিনি আচমকাই পরিবর্তিত হয়ে গেল এক ক্রোধে পরিপূর্ণ নারীতে । অংশুমানের বুক থেকে নিষ্ঠুর ভাবে ওই ত্রিশূল বার করে সে এগিয়ে এলো আমার দিকে । তার পর বিকট গম্ভীর হয়ে বললো , সখী বানলাম যাকে সেই আমার সন্তানকে জন্মানোর আগেই অনাথ করে দিল ? তুমি বাইজি সত্য তুমি তা প্রমাণ করে দিলে , আমাদের ভালোবাসা যত্ন তোমার স্বভাব পাল্টাতে পারলো না । আমার সিঁথি শুন্য করার জন্য তোমার শাস্তি তো শুধুমাত্র মৃত্যু হতে পারে না । তুমি আরো শাস্তির অধিকারী তুচ্ছা নারী । আমি সিংহলগনা নারী তোমায় নিজের সমস্ত পূর্ণ র বিনিময়ে অভিশাপ দিচ্ছি তুমি এই রাজবাড়ী তেই অভিশপ্ত আত্মা হয়ে বিচরণ করবে যুগ যুগ ধরে । তোমার মুক্তি নেই কঙ্কা , তোমার মুক্তি নেই । কোনদিন যদি আমার স্বামী পুনর্জন্ম নেন আর এই রাজবাড়ীর মধ্য ফিরে আসেন একমাত্র উনি তোমাকে মুক্তি দিতে পারবেন । ওনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তবেই তুমি মুক্তি পাবে কঙ্কা । এই বলে সৌদামিনি ওই অংশুমানের রক্ত মাখা ত্রিশূল আমার উপর গেঁথে দিলো । মরতে মরতে শুনতে পেলাম ওর কথা গুলো , ও রাজপুরোহিত কে বলছিল আমার দেহটা এই রাজবাড়ী র কোন থামে গেঁথে দিতে । আর তার পর যুগ যুগ পেরিয়ে গেছে আমায় কঙ্কাল হয়ে যাওয়া দেহটা এই রাজবাড়ী র থামে গাঁথা তার সাথে আমার আত্মাটা । এই কবছর ধরে টের পাচ্ছি অংশুমানের অস্তিত্ব , ও আছে আশেপাশে কোথাও । জন্ম নিয়েছে কোন পরিবারে হয়ত , আমি আশায় আছি ও ঠিক আসবে এই দাঁত বের হয়ে যাওয়া রাজবাড়ীতে আর মুক্তি দেবে আমায় সিংহলগনার অভিশাপ থেকে । আমি আজও তোমার অপেক্ষায় অংশুমান , আমি আজও তোমার অপেক্ষায় ।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror