কালচক্র
কালচক্র
তৃতীয় পর্ব
ঋ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, "বিরজু ভাই গাড়ী রোকো।" গাড়ী দাঁড়িয়ে গেল ব্রেক কষে। "ইঁয়াহা কোই গুফা কে বারে মে আপ জানতে হো?" -বলল ঋ। ড্রাইভার অবাক হয়ে জানাল সে জানেনা। ঋ তখন সামনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, "উনসে পুছিয়ে"
সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একজন আদিবাসী মহিলা মাথায় কলসি আর হাতে কিছু কাঠ নিয়ে এগিয়ে আসছে। তার গলায় মাকড়ি, কানে বেশ বড় পোড়ামাটির দুল, শাড়ী টা বেশ অদ্ভুত ভাবে পরা, মানে আমাদের বাঙালিদের মত না। বিরজু তাকে তেলুগু ভাষায় কিছু জিজ্ঞেস করল। সে ও হাত নেড়ে কিছু বলল। আবার গাড়ী স্টার্ট দিয়ে চলতে লাগল। পিছনে তাকিয়ে একঝলক সেই মহিলা -কে দেখলাম, সে ও পিছনে ঘুরে আমাদের দেখছে। হয়ত এরকম গাড়ী এখানে কম- ই আসে!
"অর আধা ঘন্টা লাগেগা" -ড্রাইভার বলল।
আমরা ঋ-কে গুহার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে ও বলল আগের দিন রাতে জায়গা-টা সম্পর্কে net ঘাঁটতে গিয়ে ও কিছু information পেয়েছে। যাই হোক, বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর গাড়ী থামল। ড্রাইভার বলল এরকম জায়গার কথা-ই বলেছিল ঐ আদিবাসী মেয়েটি। আমরা খাবার carry করছিলাম। আসার পথে খাবার আর জল কিনে নিয়েছিলাম। সেগুলো খেয়েই গাড়ী থেকে নেমে চারদিক-টা দেখলাম, "কি view রে! পারলে সারাজীবন এখানেই থেকে যাবো!" সিগারেটে টান দিয়ে বলল নীল। পাশ থেকে ছবি তুলতে তুলতে রাহুল বলে উঠল, "কিন্তু সাবধান, আশপাশে একটাও T. B Hospital নেই কিন্তু! আর ফোনে টাওয়ার ও নেই"
ঘড়ির কাঁটা প্রায় ৪টে ছুঁই ছুঁই। বিগত ১ ঘন্টায় আমরা অনেক টা হেঁটেছি আর প্রচুর ছবি তুলেছি।গাছপালা ঘেরা প্রান্তর, জঙ্গল পেরিয়ে এখন যে জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়েছি, সেটা প্রায় কয়েক কিলোমিটার বিস্তৃত স্বল্প ঘাসের ফাঁকা জমি, ডানদিকে আবার জঙ্গল আর বড় গাছ। বাঁদিকে সম্ভবত দূরে একটা জলাশয় আর তার চেয়েও দূরে পাহাড়ের সারি। এই নিস্তব্ধ জঙ্গলে, অচেনা অজানা পাহাড়ের কোলে আমরা পাঁচটা প্রাণী যেন ইস্টার আইল্যান্ডের মোয়াই স্ট্যাচু।
"চলিয়ে নিকলতে হ্যায়" -বলল ড্রাইভার
"Sunset দেখনে দিজিয়ে, আভি তো সির্ফ সাড়ে চার বজে হ্যায়।" -বলল নীল। ঋ এখন আর আগের মত চুপচাপ নেই। ড্রাইভার বলল -"আজ অমাবস্
হ্যায়, আন্ধেরা যাদা হোগা। জঙ্গল কা রাস্তা হ্যায়"
কথাটা logical মনে হলেও sunset দেখার লোভ সামলানো গেল না। এরকম সুযোগ তো বারবার আসেনা!
আরো কিছুটা এদিক ওদিক ঘোরার পর দূরের পাহাড়টা লাল হল, সূর্য নেমে গেছে দীগন্ত রেখার নীচে। আর তখনই অঘটন টা ঘটল। নীল ছবি তোলার জন্য একটা জংলি গাছে ঢাকা ঢিবির উপর উঠেছিল। কোনোভাবে সেটা ভেঙে বেশ কিছুটা নিচে ঢুকে গেল। একটু ওঠার চেষ্টা করলেও পারল না। পুরোটাই ঢুকে গেল। আমরা খুব তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে নীল -কে ডাকলাম। অনেকটা নীচ থেকে নীল এর গলা পাওয়া গেল। মোবাইলের টর্চ জ্বেলেছে। একা বেরোনো অসম্ভব, অনেকটা নীচু।
ড্রাইভার ওর ব্যাগ টা আমাদের হাতে দিয়ে বলল, "হাম দেখতে হ্যায়" বলে সে ঐ ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে নীচে নামতে লাগল।
ঝুপ করে অন্ধকার নেমে গেল, বাতাস ভারী, যেন খারাপ কিছুর পূর্বাভাস। হালকা বাতাসের সিরসিরানি যেন কোনো মায়াবিনী-র তীক্ষ্ণ হাসি। যেন কানে কানে ফিসফিস করে কয়েক যুগের অপেক্ষার গল্প বলতে চায়।
-"ঠিক আছিস?"
-ভিতর থেকে উত্তর এল "হাত কেটে গেছে"
নহঠাৎ নীল আর ড্রাইভার দু'জনের চিৎকার, নীল কিছুটা উঠেছে, বিরজু ওকে ধরে তুলে দিয়েছে অনেকটা উপরে। একটা পাথরে ভর দিয়ে বেরোনোর আগে শেষবার পিছন ফিরে তাকালো, ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমরাও তাকালাম সেই গহ্বরের ভিতরে।
ভিতরটা হাল্কা লাল আলোতে ভরে গেছে, অল্প আলোয় স্পষ্ট দেখা না গেলেও দেখতে পেলাম একটা আবছা নারী মূর্তি, গলায় মাকড়ি, কানে বড় দুল...যার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমাদের ড্রাইভার বিরজু-র দিকে। হয়ত একঝলক তাকালো আমাদের দিকে!! হাত ধরে নীল-কে টেনে বের করার আগে শেষবার আমার চোখ গেল গুহার ভিতরের দেওয়ালে। হালকা আলোতে ভিতরের দেওয়ালে মনে হল কোনো দেবতার মূর্তি।
না, ড্রাইভার বেরোতে পারেনি। নীল কে আমরা হাত ধরে টেনে তোলার সাথে সাথেই সেই গহ্বরের মুখ ধস নেমে ঢাকা পড়ে যায়। আমরা ঘটনার রেশ কাটিয়ে উঠে কিছুক্ষণ সেই গহ্বরের মুখ খোঁজার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হই। তারপর উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়ে এসে কোনোরকমে আমরা ৪ জন গাড়িতে পৌঁছাই।
(ক্রমশঃ)