ফটোফ্রেম
ফটোফ্রেম
(একটি বর্ষণমুখর রাতের অলৌকিক ঘটনা)
"ওফ্! বৃষ্টিটাও এখন- ই আসতে হ'ল!" - বিরক্ত হয়ে বলল অর্ঘ্য।
"আর কি করা যাবে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই....... ইয়ে, যাকগে, গাড়ি টা side করে দে।" - বলল রাজেশ।
কলকাতা থেকে এখনও আমরা প্রায় ২৫০ কি. মি দূরে। শিলিগুড়ি থেকে ফেরার পথে হঠাৎই ইচ্ছা হয়েছিল NH12 ছেড়ে NH19 ধরার। যদিও অনেক আগেই আমাদের আরো কিছুটা রাস্তা cover করে ফেলার কথা, কিন্তু highway থেকে নেমে জঙ্গলে ঢুকে sunset দেখার চক্করে পড়ে দেরি হয়ে গেল। স্বাভাবিক ভাবেই তাই আমরা আরও ২ ঘন্টা late -এ চলছি।
গাড়ি side করে দাঁড় করানোর পর প্রায় ১ ঘন্টা কেটে গেছে। বৃষ্টি কমার কোনো সম্ভাবনা এখনও দেখা যায়নি। "এইভাবে ফেরা যাবে না। already ৯ টা বেজে গেছে। " -বললাম আমি। এই জায়গাটাও ভারী অদ্ভুত। আমরা শেষ ১ ঘন্টায় হাতে গোনা ২-৩ টে গাড়ি দেখেছি আমাদের cross করে বেরিয়ে যেতে। পুরো রাস্তায় একটাও আলো নেই। আরো প্রায় আধঘন্টা পর বৃষ্টি থামল। গাড়ী থেকে নেমে আমরা দেখলাম এতক্ষণ বৃষ্টির আওয়াজে বোঝা না গেলেও এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে দুমকা-র কাছাকাছি কোনো একটা জায়গায় আমরা এই চারটে প্রাণী ছাড়া চারদিকে পুরো শ্মশানের নিস্তব্ধতা।
"কাছাকাছি কোথাও ধাবা বা থাকার জায়গা দেখে ঘন্টাখানেক আড্ডা মেরে কাটিয়ে দিই। তারপর ভোর ভোর বেরিয়ে পড়ব। কি বলিস? "-বলল অর্ঘ্য।
" তখন আবার sunrise দেখার জন্য জঙ্গলে ঢুকে যাবিনা তো? " - খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বলল অরিত্র।
কিছুটা এগিয়ে একটা ছোট খাবার জায়গা পাওয়া গেল। সেখানে বসে চা, সিগারেট, ডিম-ম্যাগি খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম কয়েকটা ঘন্টা কাটানোর মত জায়গা পাওয়া যাবে কি না! জবাবে দোকানদার জানাল সে এখনই ঝাঁপ ফেলবে। আমরা উঠে পড়লাম । ঘড়ির কাঁটা প্রায় ১১ টা ছুঁই ছুঁই। "চল গাড়িতেই কাটিয়ে দেবো ৪-৫ ঘন্টার- ই তো ব্যাপার। " - বলল অর্ঘ্য।
গাড়ি start দিয়ে আরেকটু এগোতেই কিছুটা দূরে জ্বলতে থাকা আলোটা আমাদের নজর এড়ালো না। কিন্তু যাবো কোনদিক থেকে সেটাই বুঝে উঠতে পারলাম না। এদিক ওদিক করতে করতে দেখলাম রাস্তার পাশ থেকে নেমে যাওয়ার জায়গা, সেখান থেকেই সম্ভবত যাওয়ার একটা রাস্তা আছে। কিন্তু সেখানেও প্রচুর জল কাদা। হেডলাইট জ্বেলে কোনোরকমে এগোনো শুরু করতে এটুকু বোঝা গেল আলোর উৎস -টা আমরা যতটা দূরে ভাবছিলাম, তার চেয়েও অনেকটা দূরে। জল, কাদা, বড় বড় গাছপালা পেরিয়ে আমরা যে জায়গাটার সামনে এসে দাঁড়ালাম, সেটা একটা অনেক পুরনো প্রায় ভগ্ন জমিদার বাড়ি।
"ভাই! নিজেকে কেমন জমিদার জমিদার লাগছে! " - বলল অরিত্র
পাশ থেকে রাজেশ বলল, "জমিদার বাড়ির দারোয়ান বল ওটা! "
আমাদের হাসির মধ্যেই এই গরমে শাল মুড়ি দিয়ে একটা অদ্ভুত জীব আমাদের সামনে এল। ইনিই সম্ভবত কেয়ারটেকার। মাথায় পাকা চুল, গাল ভর্তি পাকা দাড়ি গোঁফ, চোখে একটা গোল ফ্রেমের ঝাপসা চশমা, ফ্যাঁশফ্যাঁশে গলায় বলল, "হ্যাঁ বাবা বলো? "
অর্ঘ্য বলল, "কাকু আমরা ঘন্টাখানেক থাকবো এখানে যদি অসুবিধা না থাকে। আসলে কলকাতা ফিরছিলাম ঝড়বৃষ্টি- তে আটকে গিয়েছি। "
কেয়ারটেকার ভ্রু কুঁচকে বলল, "তোমরা চোর ডাকাত নও তো? অবশ্য হ'লেও অসুবিধা নেই। "
আমরা হেসে ফেললাম আর মনেমনে ভাবলাম এই ভাঙা পোড়ো বাড়িতে চুরি করার মত কি হিরে-জহরৎ আছে কে জানে!
বাড়িটা বেশ বড় আর অনেকগুলো ঘর। বেশিরভাগ- ই তালা দেওয়া। দোতলার দু'টো খোলা ঘরের মধ্যে একটাতে আমাদের থাকার জায়গা হ'ল। বেশ বড় ঘর, পুরনো একটা খাটে সুন্দর বিছানা করা। "কাল সকালে উঠে জমিদার বাড়ির ইতিহাস জানব, আজ আপাতত বডি ফেলি। " -বলল রাজেশ
আমি, অর্ঘ্য আর অরিত্র একটু এদিক ওদিক ঘুরে দেখতে লাগলাম। পাশের খোলা ঘরটায় ঢুকে চোখে ধাঁধা লাগল। প্রচুর জিনিস এদিক ওদিক ছড়ানো। পুরনো দামী কিছু পাথরের কাজ করা জিনিস, কাঠের অসাধারণ কিছু আসবাব আর দেওয়ালে একটা নর্তকীর প্রায় ছয় ফুট লম্বা ছবি। অরিত্র ছবিটার উপর হাত বুলিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। আমি আস্তে করে ওর কানের কাছে গিয়ে বললাম, " দারোয়ান, তুমি প্রেমের ফাঁদে পড়েছ। " "শুয়ার...." বলে হাসতে হাসতে একটা পাথরের তৈরি সুন্দর কাজ করা ঘোড়া হাতে তুলে নিয়ে বলল, "এটা নিয়ে যাব। "
অর্ঘ্য একটু বিরক্ত হল। ক্লান্ত ছিলাম সকলেই, তাই ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। অরিত্র, ঘোড়া-টা ব্যাগে ভরে নিয়ে পাশে এসে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম এসে গেল।
পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়িতে প্রায় ৭ টা। শরীরটা বেশ হালকা লাগছে। পাশে দেখলাম অরিত্র নেই। হয়ত আশপাশটা ঘুরে দেখছে। আরো কিছুক্ষণ পর তিনজন- ই উঠলাম। কাল রাতে বাড়িটাকে যতটা ভাঙাচোরা মনে হচ্ছিল, তার চেয়েও কয়েকগুণ খারাপ অবস্হা। চারদিকে কয়েক বছরের জমে থাকা ধূলো। যাইহোক, এবার বেরোতে হবে। অরিত্র-কে ফোন করে switched off পেলাম, কেয়ারটেকার-কেও দেখলাম না কাছাকাছি। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক খোঁজার পরেও দুজনকেই দেখা গেল না। টেনশন বাড়ল এই অজানা অচেনা জায়গায়। অর্ঘ্য বলল, "পাশের ঘরটায় চল দেখি। হয়ত ওখানে আবার হাতি, ঘোড়া খুঁজতে ঢুকেছে। "
তিনজন- ই দৌড়ে গিয়ে ঢুকলাম সেই ঘরটায়। নাহ্ এখানেও নেই। বেরিয়ে আসতে যাব, হঠাৎ চোখ চলে গেল ডানদিকের দেওয়ালে। আমাদের পাঁচটা ইন্দ্রিয়-কে একসাথে নাড়িয়ে দিয়ে হৃদপিন্ডের গতি কয়েকগুণ বেড়ে গেল। ধূলোপড়া ফটোফ্রেমের মধ্যে ওটা কে? পাকা চুল, পাকা দাড়ি গোঁফ, গোল ফ্রেমের চশমা, গায়ে....... শাল জড়ানো!
সবেমাত্র কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, আমার আর রাজেশের গায়ে আস্তে একটা ধাক্কা মারল অর্ঘ্য। ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম উল্টোদিকের দেওয়ালে দৃষ্টি স্হির আর মুখে একরাশ ভয়। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে উল্টোদিকের দেওয়ালে তাকালাম।
কালকের সেই নর্তকী-র ছবি-টা দেওয়ালে ঝুলছে। কিন্তু.....কিন্তু আজ ছবির মধ্যে আরেকজন!! কে ওটা!!!! অবিকল অরিত্র-র মত দেখতে......সেই চশমা, গাল ভর্তি চাপদাড়ি, মুখে হালকা হাসি.....! আর একহাতে ধরা আছে কালকের রাতের সেই সুন্দর কাজ করা পাথরের ঘোড়া-টা।
-----------------------------------------------------------------------