HIMABANTA DUTTA

Horror Thriller Others

3  

HIMABANTA DUTTA

Horror Thriller Others

গাছ

গাছ

5 mins
164



 অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙল সায়কের। একার সংসারে সবই নিজের হাতে করতে হয়, তাই সেরকম তাড়াহুড়োর প্রশ্ন-ই আসে না, তার উপর আজ আবার রবিবার। টেবিল থেকে কালো ফ্রেমের মোটা কাঁচের চশমাটা তুলে নিয়ে চোখে লাগাল সায়ক। বেশ ফ্রেশ লাগছে, শরীরটাও বেশ ঝরঝরে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাঁ হাতে চুল ঠিক করতে করতে মনে মনে ভাবল, "নাহ্ শুধু শুধুই ভাবি বুড়ো হয়ে গিয়েছি। এখনও তো চুলে পাক-ই ধরেনি।" ভেবে নিজের মনেই মুচকি হাসল। হাসলে সায়কের ডান গালে সুন্দর একটা টোল পড়ে।


ফ্রেশ হয়ে চা আর টোস্ট বানিয়ে খবরের কাগজ-টা খুলে ওল্টাতে থাকল। "ধুস্! সেই একই খবর প্রতিদিন!" - বিরক্ত হয়ে চায়ে একটা বড় চুমুক দিয়ে খবরের কাগজের দ্বিতীয় পাতা-টা ওল্টালো সায়ক। তৃতীয় পাতার ঠিক নীচে একটা ছোট্ট খবরে চোখ আটকালো তার। "কলকাতার নামকরা স্বর্ণ ব্যবসায়ী আদিত্য কর্মকারের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অস্বাভাবিক মৃত্যু। পরিবারের তরফে জানানো হয়েছে বেশ কিছুদিন ধরে তিনি মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন।" 

নামটা দেখে খুব চেনা লাগল সায়কের। আদিত্য , ছোটবেলার স্কুল লাইফের বন্ধু। প্রায় বছর কুড়ি হ'ল দেখা সাক্ষাৎ নেই, সেই উচ্চমাধ্যমিকের পর দু'জনের শেষবার দেখা হয়েছিল, অবশ্য সায়ক ওকে তার পরেও দেখেছে। এই মাসখানেক আগেই, টিভি-তে একটা ইন্টারভিউ ছিল আদিত্য-র। ইন্টারভিউ-তেই দেখছিল ছেলেটার গাছের খুব শখ, ছাদে খুব সুন্দর বাগান করেছে। অনেক নামি-অনামি গাছ সেখানে ভর্তি।আসলে গাছ সায়কের-ও খুব ভালো লাগে। ও বটানি-তে মাস্টার্স । বিষয়টাকে খুব ভালোবাসত তাই এখনও একটা টান থেকেই গেছে। খবরটা পড়ে মনে হল এরকম একটা সময়ে অন্ততঃ mental সাপোর্টের জন্য বন্ধুর পরিবারের পাশে কিছুটা সময় দাঁড়ানোটা স্কুল জীবনের বন্ধু হিসাবে ওর কর্তব্য।


"আপনাকে তো ঠিক.......!" - মহিলার কথা শেষ হওয়ার আগেই সায়ক বলল -"আমি আদিত্য-র ছোটবেলার বন্ধু ছিলাম। স্কুল কমপ্লিট হওয়ার পর বেশিরভাগ সময়টাই আমার কলকাতার বাইরে কাটে। তাই contact টা আর থাকেনি। খবরটা আজই পেলাম। পেয়েই......"


-"ভিতরে আসুন।" 


মহিলাকে অনুসরণ করে সায়ক ভিতরে ডাইনিং-এ একটা সোফাতে বসল।

সেখানে আগে থেকেই বেশ কয়েকজন উপস্থিত। কয়েকজন পুলিশের লোকজনও আছেন। তাদের মধ্যে একজনের হাতে একটা ব্রাউন কালারের ডায়েরি ধরা আছে।


"কিভাবে কি হ'ল এসব? মানে.....ও কি অসুস্হ ছিল?" - নরম গলায় জিজ্ঞেস করল সায়ক। 


"বেশ কিছুদিন ধরে কেমন একটা অদ্ভুত আচরণ করছিলেন। খাওয়া দাওয়া ঠিকমত করছিলেন না। কারোর সাথে ঠিকমত কথাও বলছিলেন না। শরীর ভেঙ্গে যাচ্ছিল। তারপর কাল রাতে......সব শেষ।" - চোখের জল কোনোরকমে আটকে ধরা গলায় বললেন আদিত্য-র স্ত্রী।


"ওনার ঘর থেকে আমরা কিছু কাগজপত্র, একটা ল্যাপটপ, একটা মোবাইল আর এই ডায়েরি-টা নিয়ে যাচ্ছি, ওনার ডিপ্রেশনের কারণ হিসেবে যদি কিছু পাওয়া যায়। আর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তো এসেই যাবে কালকের মধ্যে।" - জিনিসগুলো হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন ইন্সপেক্টর ইন্দ্রজিত বোস।


১০.০৬.২০১৮ - একটা গাছ কিনে এনেছি তিন দিন হ'ল, ইনডোর প্ল্যান্ট। ঘরের উত্তর দিকের জানলাটার পাশেই রেখেছি। হালকা গোলাপী রং এর ফুল আর ছোট ছোট গোল গোল পাতা। সারাদিন গন্ধটা ঠিক বোঝা যায় না। কিন্তু রাতে ফুলগুলো থেকে বেশ মিষ্টি গন্ধ বেরোয়।


১২.০৬.২০১৮ - কাল রাতের স্বপ্নটা বেশ অদ্ভুত ছিল। স্বপ্ন না কি জেগেই পুরোটা শুনছিলাম ঠিক জানিনা। একটা গাছ ফিসফিস করে মিষ্টি গলায় ডাকছে!


১৪.০৬.২০১৮ - শেষ ২ দিন রাতে গাছের শিকড়গুলো আমাকে নরম হাতে জড়িয়ে ধরছিল। আমার সারা শরীরে বটগাছের নরম ঝুড়ির মত শিকড় মাকড়সার জাল বিস্তার করে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল, ঠিক যেমন কোনো প্রেমিকা তার প্রেমিককে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরে।


১৮.০৬.২০১৮ - আজ খুব মনে পড়ছে সেই ছোটবেলায় খেলার মাঠের ভেঙে দেওয়া জংলি গাছ গুলোর কথা। স্কুলের বাগানে খেলার সময় উপড়ে দেওয়া চন্দ্রমল্লিকা , ডালিয়া গুলোর কথা। মনে পড়ছে এই বাড়িটা বানানোর সময় কেটে ফেলা নারকেল, সুপারি গাছ গুলোর কথা। আচ্ছা ওদের তো কোনো দোষ ছিলনা , তাও কেন ওদের সাথে এরকম করলাম আমি?


২১.০৬.২০১৮ - নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হচ্ছে। এখনও রোজ রাতে গাছের শিকড়গুলো চারদিক থেকে আমাকে জড়িয়ে ফেলে। আমার সাথে কথা বলতে চায়......অনেক কথা! আস্তে আস্তে শিকড়গুলো আমার শরীরের মধ্যে ঢুকে যায়। ঠিক যেন মনে হয় শরীর থেকে সব রক্ত শুষে নিতে চাইছে ! 


২২.০৬.২০১৮ - গাছটা বেশ বড় হয়ে গেছে এই ক'দিনেই। ফুল গুলো আর হালকা গোলাপী নেই। এখন ওগুলোর রং টকটকে গাঢ় লাল...... ঠিক অনেকটা টাটকা রক্তের মত!


২৪.০৬.২০১৮ - রোজ কথা বলে চলেছে আমার সাথে গাছটা। না না......গাছগুলো......অনেক গাছ! খুব রাগ ওদের। সব কিছু ফেরত চায়। যা যা দিয়েছে আমাকে সারাজীবন ধরে। সব....সব ফেরত নিয়ে নেবে। আমার শরীর থেকে সব শুষে নিতে চাইছে। ওদের থেকে আমি সারা জীবন যা যা নিয়েছি, সব কিছু.....সব কিছু। এত কিছু নিয়েও ওদের ক্ষতিই করে গিয়েছি সারা জীবন। নিজেকে প্রচন্ড অপরাধী মনে হয় আজকাল।


ডায়রিটা বন্ধ করলেন ইন্সপেক্টর ইন্দ্রজিত বোস।

"কি বুঝলে ভবেশ?" - সামনে বসা অ্যাসিস্টেন্ট সাব-ইন্সপেক্টরের উদ্দ্যেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন।

"এ তো স্যার বদ্ধ উন্মাদ? বলে না কি গাছ জড়িয়ে ধরছে, কথা বলছে, সব ফেরত চাইছে!" - খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উত্তর দিলেন মিস্টার ভবেশ মিত্র।


-"তাই কি? না কি এ একপ্রকার বিবেকের দংশন?"


স্বর্ণ-ব্যবসায়ী আদিত্য কর্মকারের মোবাইল ফোনটা ঘেঁটে তেমন কিছু পাওয়া গেল না। তবে ঘরের মধ্যে রাখা একটা গাছের কিছু ছবি পাওয়া গেল, যার ফুলের রং পরিবর্তন হয়ে হালকা গোলাপি থেকে গাঢ় লাল হয়েছে, পাতার গোল আকৃতি ছোটো থেকে বেশ বড় হয়েছে এবং গাছের উচ্চতা অদ্ভুত ভাবে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

আর ...... এই সবগুলি ঘটনা ঘটেছে মাত্র পনেরো দিনের মধ্যে।


পোস্টমর্টেম রিপোর্টে স্বভাবতই অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়নি, massive heart attack বা heart failure -কেই মৃত্যুর কারণ হিসাবে পাওয়া গেল। কিন্তু যেটা সামনে এলনা সেটা হল, আমাদের শরীরে রক্তে উপস্হিত হিমোগ্লোবিনের হিম-রঞ্জক এবং গ্লোবিন-প্রোটিনের মধ্যে এই হিম নামক লৌহঘঠিত রঞ্জকটি মানবদেহে মলিকিউলার অক্সিজেনের প্রধান বাহক। ফলে হঠাৎ যদি রক্ত তথা হিমোগ্লোবিন তথা এই লৌহঘঠিত রঞ্জকের পরিমাণ কমতে থাকে, তাহলে তা স্বাভাবিক ভাবেই শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি সৃষ্টি করে, যার ফলস্বরুপ শ্বাসকষ্ট এবং হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে।





১ বছর পর..........


পড়ন্ত বিকেলের শেষ সূর্যটা বড় বড় ফ্ল্যাটবাড়ির পিছনে ঢাকা পড়েছে সবে। পাখিদের ঘরে ফেরার কোলাহল, গাড়ীর শব্দ আর গলির মধ্যে বাচ্চাদের ছোটাছুটি-দৌড়দৌড়ি করার শব্দ মিলেমিশে প্রতিদিনের মত আজকেও একটা সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। গলির মুখে তাকাতেই চোখে পড়ল এক বছর চল্লিশের ভদ্রলোক একটা তিন চাকার ঠেলাগাড়ি নিয়ে বাঁকের মুখ থেকে গলিতে ঢুকছে। ঠেলাগাড়িতে অনেক রকম গাছ আছে! গাঁদা, টগর, পেয়ারা, কিছু বাহারি-গাছ আর কিছু ইনডোর প্ল্যান্ট। 


'এই যে ভাই..... দাঁড়াও....' - জনৈক ভদ্রলোকের ডাকে থামল সেই ঠেলাগাড়িটি।

'কত করে তোমার গাছ?' - জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।


'আপনি দেখুন কোনটা নেবেন।' - বলল সেই গাছবিক্রেতা।


চেনা-অচেনা গাছের ভিড়ে চোখে পড়ল একটা সুন্দর দেখতে ছোট গাছ, গোল গোল পাতা আর তাতে বেশ সুন্দর হালকা গোলাপি রং-এর ফুল হয়ে আছে।

'এটা কি গাছ গো? বেশ সুন্দর দেখতে! কি নাম এটার?' - জিজ্ঞেস করলেন সেই ভদ্রলোক।


বাঁহাতে চুলটা একটু ঠিক করে নিয়ে কালো ফ্রেমের মোটা কাঁচের চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে টোল পড়া গালে মুচকি হাসল গাছবিক্রেতা,


"গাছেদের কি আর আলাদা নাম হয়? ওরা সবাই গাছ। তবে আপনি চাইলে ওদের যে কোনো নাম দিতে পারেন। এমনকি নিজের নামেও ডাকতে পারেন। আমি এই গাছটার আপাতত নাম দিয়েছি .......আদিত্য।"



(পুনশ্চঃ - একটি গাছ , একটি 'প্রাণ' ..... সারাজীবন আমরা অনেক কিছুই পাই গাছের থেকে, এমনকি বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও। কিন্তু পরিবর্তে আমরা কি ফেরত দিই? হয়ত এভাবেই কোনোদিন ওরা নিজেদের দেওয়া সমস্ত জিনিস ফেরত চেয়ে নেবে........কারোর মাধ্যমে!)


Rate this content
Log in