গোলাপী কাঁকড়া
গোলাপী কাঁকড়া
কন্টাই পুলিশ স্টেশনে ঢুকতে আমার প্রায় দুপুর ২ টো হয়ে গেল।ঢুকে visitors chair এই বসলাম। ও.সি মিস্টার দাসের লাঞ্চ করে আসতে আরো প্রায় ২০ মিনিট লাগবে। সময় কাটানোর জন্য আমি সামনের টেবিলে রাখা নিউজপেপারের পাতা ওল্টাতে থাকলাম। দু-তিন পৃষ্ঠা ওল্টানোর পর ডানদিকের পাতার নিচের দিকে একটা ছোট্ট খবরে আমার চোখ আটকালো, যেটা দেখলাম তাতে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
এই ছোট্ট খবরটির কথা বলতে গেলে, আপনাদের বলতে হবে আজ থেকে ঠিক দু'মাস আগের একটা ঘটনা , বা বলা ভাল শেষ দু'মাস ধরে ঘটে চলা কয়েকটি ঘটনার কথা।
আমি একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করি। অর্ঘ্য আমার অফিস কলিগ। প্রায় সমবয়সী আর প্রায় একই সঙ্গে আমাদের দুজনের এই কোম্পানিতে joining -এর সুবাদে ভালো বন্ধুত্ব হতে বেশী সময় লাগেনি। অফিসের কাজের চাপে আমাদের দশা খুবই শোচনীয়।
April- এর শেষের দিকে কাজের চাপ একটু কম হওয়ায় অর্ঘ্য একদিন আমাকে এসে বলল, "এই weekend -এ কি করছিস?"
আমি বললাম ,"তেমন কিছু না। কেন?"
অর্ঘ্য বলল, "বড্ড দমবন্ধ লাগছে বুঝলি । দুটো দিন কাছাকাছি কোথাও ঘুরে আসলে হয়।"
আমি বললাম ,"তা কোথায় যাবি ভেবেছিস কিছু?"
অর্ঘ্য বলল," দুদিনের জন্য দীঘা, মন্দারমণি বা তাজপুর একদম পার্ফেক্ট হবে। কি বলিস?"
আমারও দুদিনের ছুটি আর একটু ফ্রেশ এয়ারের দরকার ছিল। তাই শেষ পর্যন্ত ভীড় এড়িয়ে থাকার জন্য তাজপুর যাওয়াই final হল।
অর্ঘ্যর গাড়িতে কলকাতা থেকে তাজপুর পৌঁছাতে সময় লাগল প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা। তাজপুরের নাম বললে যে জিনিসটার কথা না বললেই নয়, সেটা হল এখানকার লাল কাঁকড়া। সন্ধ্যার পর এবং ভোর বেলায় সমুদ্রের ধারে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়ার দল ভীড় জমায়, অন্যসময় এরা বালির মধ্যে লুকিয়ে পড়ে।
আমাদের কটেজ থেকে সি-বিচের দূরত্ব ছিল মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। পরদিন সানরাইজ দেখার জন্য বেশ ভোরেই সি-বিচে চলে গেলাম দুজন, ঠান্ডা বাতাস , অনেকটা দূর থেকে ভেসে আসা সমুদ্রের ঢেউ-এর গর্জন আর পূব আকাশে আলো আঁধারের খেলা পরিবেশকে মায়াবী করে তুলেছিল, আর তার সাথে যোগ হয়েছিল আমাদের পায়ের শব্দে সারি সারি লাল কাঁকড়ার এদিক ওদিক দৌড়। আমরা ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছিলাম। হঠাৎই অর্ঘ্য কিছু একটা দেখতে পেয়ে এগিয়ে গিয়ে বালিতে নিচু হয়ে বসল। ওকে অনুসরণ করে আমিও এগিয়ে গেলাম।
"এই কাঁকড়াটার রং দেখ, লাল নয় কিন্তু। গোলাপী।" - বলল অর্ঘ্য
আমি বললাম , "হয়ত জেনেটিক্যাল ডিসঅর্ডারের জন্য এরকম হয়েছে।"
এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছুটা দূরে পড়ে থাকা একটা প্লাস্টিকের জার কুড়িয়ে নিয়ে এল অর্ঘ্য। অদ্ভুত ব্যাপার যেটা লক্ষ্য করলাম, অন্য লাল কাঁকড়াগুলোর মত এই গোলাপী কাঁকড়াটা পালিয়ে গিয়ে বালির মধ্যে না ঢুকে এক জায়গার স্থির ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকল।
অর্ঘ্য-কে জিজ্ঞেস করলাম," এই প্লাস্টিকের জারটা দিয়ে কি করবি?"
অর্ঘ্য সেই গোলাপী কাঁকড়াটা কে তুলে প্লাস্টিকের জারে ভরতে ভরতে বলল, "এটা কে বাড়ি নিয়ে যাবো।"
তাজপুর থেকে ফেরার পর প্রায় দু'সপ্তাহ কেটে গেলেও অর্ঘ্য অফিসে আসেনি, তাই অফিস থেকে বেরিয়ে একবার ওর ফ্ল্যাটে ঘুরে আসতেই হবে, ব্যাপারটা ঠিক সুবিধার ঠেকছে না।
কলিংবেলের আওয়াজে দরজা খুলল অর্ঘ্য। খুলে আমাকে দেখে বলল ,"ও তুই, ভেতরে আয়।"
ঢুকেই আমার চোখ পড়ল বাঁদিকে রাখা অ্যাকোয়েরিয়ামটার দিকে। সেখানে কোনো মাছ নেই। কিছুটা অংশে অল্প একটু জল আর বাকি অংশ বালি দিয়ে ভর্তি করা। আর সেই বালির উপর একদম নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে একটা গোলাপি রঙের কাঁকড়া, যার স্থির দৃষ্টি আমার দিকেই ।
অর্ঘ্য চা নিয়ে এসে টেবিলে রাখার সময় হঠাৎ -ই চোখ পড়ল ওর হাতের তালুর দিকে, সেখানে একটা বড় দংশন চিহ্ন। জিজ্ঞেস করতে বলল, " সেরকম কিছু না, ওই কাঁকড়াটা কামড়ে দিয়েছিল। শরীরটা কদিন একটু খারাপ আছে বুঝলি , তাই অফিস যাচ্ছি না। "
আমি খুব ভালো ভাবে হাতের তালুটা দেখলাম, দংশন চিহ্ন-টার পাশে বেশ কিছুটা অংশ গোলাপী আকার ধারণ করেছে। ়একরাশ ভয় আর উৎকন্ঠা নিয়ে ওকে বললাম ,"এ কি অবস্থা হয়েছে! তুই এখন-ই ডাক্তারের কাছে চল। "
উত্তরে অর্ঘ্য জানাল,"কিচ্ছু হয়নি আমার। আর কটা দিন যাক, সব ঠিক হয়ে যাবে। "
দিন দশেক পর-ও যখন অফিসে অর্ঘ্যকে দেখতে পাওয়া গেল না, আমি একজন ডাক্তার-কে সঙ্গে নিয়ে ওর বাড়িতে পৌঁছালাম। সেই গোলাপী রংটা এখন কনুই এবং হাত ছাড়িয়ে গলা পর্যন্ত পৌঁছেছে। আর হাতের আঙ্গুলগুলো অদ্ভুতভাবে শক্ত খোলশের মত আকার ধারণ করেছে। ঠিক যেন অনেকটা কোনো কাঁকড়ার দাঁড়া!
আমাকে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলে উঠল ,"আমাকে সমুদ্রে নিয়ে যাবি? আবার একবার?"
ডাক্তারবাবু লক্ষণ দেখে কোনো রোগ চিহ্নিত করতে পারলেন না। ভালো কোনো ডাক্তার বা বড় নার্সিংহোমের সাথে যোগাযোগ করতে বলে উনি পালিয়ে বাঁচলেন। আমি বন্ধুর অনেক অনুনয়- বিনয়- অনুরোধের পর অবশেষে পরদিন সকালেই অর্ঘ্যকে নিয়ে আবার তাজপুরের উদ্দেশ্যেই রওনা দেওয়ার জন্য স্থির করলাম।
আরো একবার আমি আর অর্ঘ্য তাজপুর পৌঁছালাম ,সেই গোলাপী কাঁকড়াটা নিয়ে। কাঁকড়াটাকে সি- বীচে ছেড়ে দিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে অর্ঘ্য তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়ল। আমি ল্যাপটপে ওর এই লক্ষণ গুলো নিয়ে একটু নেট ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে হঠাৎই নজরে পড়ল Pink Crab -এর কথা। দক্ষিণ আফ্রিকার সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দা এই গোলাপী কাঁকড়া। এটা লাল কাঁকড়ার কোনো জেনেটিক্যাল ডিসঅর্ডার নয়। প্রধানত দক্ষিণ নামিবিয়া এবং কেপ আগুলহাস অঞ্চলেই এই প্রকার কাঁকড়া দেখা যায়। এর বাইরে আর অন্য কোথাও এই কাঁকড়া পাওয়া যায়না। আর এই কাঁকড়ার দেওয়া বর্ণনার সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে অর্ঘ্যর নিয়ে যাওয়া এই গোলাপী কাঁকড়াটার দেহের গঠন। কিভাবে একটা গোলাপী কাঁকড়া সূদূর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এতদূরে এল, বা এই একটা মাত্র কাঁকড়াই এখানে আছে না কি আরো অনেক এরকম কাঁকড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, এসব ভাবতে ভাবতেই চোখটা লেগে গেল।
ভোর রাতে যখন ঘুমটা ভাঙল , তখন দেখলাম বিছানায় অর্ঘ্য নেই, ঘরের দরজা খোলা। দরজা থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক দেখে ছুটতে লাগলাম সি-বীচের দিকে।অনেকটা দূর থেকেই দেখতে পেলাম অর্ঘ্যকে, দুহাতে পাগলের মত সমুদ্রের ধারের বালি খুঁড়ে চলেছে। ততক্ষণে অনেকটাই খুঁড়ে ফেলেছে। আমি দৌড়তে লাগলাম ওর দিকে লক্ষ্য করে। আমাকে দৌড়তে দেখে একঝলক আমার দিকে তাকালো আর তার পরেই ওর খুঁড়ে ফেলা সেই বালির গর্তের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মূহুর্তে-র মধ্যেই বালির গর্ত বুজে গেল , আর অর্ঘ্য বালির নীচে লুকিয়ে পড়ল , ঠিক যেমন কাঁকড়া গুলো লুকিয়ে পড়ে।
আশপাশের বেশ কিছু লোকজন অনেকটা খোঁড়াখুঁড়ি-র পরেও কিছু পাওয়া যায়নি। একটা আস্ত মানুষ হঠাৎই চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল!
পুলিশের কাছে সবটা বলার পর আমাকে পাগল ভেবেছে কিনা জানিনা। আমাকে গত এক মাসে এই নিয়ে চতুর্থবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়েছে। ও.সি মিস্টার দাসের লাঞ্চ করে আসতে আরো ২০ মিনিট লাগবে। ততক্ষণ নিউজপেপার -টায় একটু চোখ বুলিয়ে নিতে গিয়ে একটা ছোট্ট খবরে চোখ আটকালো আর শিড়দাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল,
"দক্ষিণ আফ্রিকার সমুদ্র উপকূলের কিছু জায়গায় একটা অদ্ভুত প্রাণীর দেখা পাওয়া গেছে। গায়ের রং গোলাপী। দেখতে অনেকটা মানুষের মত হলেও অনেক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কাঁকড়ার সাথেও মেলে।"