চারভি
চারভি
( ' #কালচক্র '-র কোনো শেষ হয়না। তবে শুরু একটা থাকেই। তাই সেই শুরুর কিছু কথা....)
যীশুখ্রিস্টের জন্মেরও প্রায় ৪০-৫০ বছর আগের কথা, আজকের অন্ধ্রপ্রদেশের এক অজানা জায়গায় চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি। কাণ্ব বংশের রাজত্ব তখন। রাজা সুসর্মন যে কোনো প্রকারে সাতবাহন রাজ সিমুকের আক্রমণ প্রতিহত করতে বদ্ধপরিকর। সেনাবাহিনী-তে যে কয়েকজন বীর যোদ্ধা আছে, তাদের মধ্যে চন্দ্রশেখর অন্যতম। তার স্ত্রী আম্রপালি অন্তঃসত্বা। যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং পরিণাম কিছুটা আঁচ করতে পেরে কয়েকজন মহিলা সহ আম্রপালি-কে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস, খাবার, অস্ত্র ও কিছু পুঁথি-পত্র সহ জঙ্গলের কিছুটা গভীরে একটা নিরাপদ স্হানে রেখে দিয়ে ফিরে গেল চন্দ্রশেখর। এই যুদ্ধ টা তাকে লড়তে হবে নিজের পরিবারের জন্য, সন্তানের জন্য, নিজের রাজ্যের জন্য। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ করেও শেষ পর্যন্ত হার মানতে হ'ল। শেষ হ'ল ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের, অবসান হল কাণ্ব বংশের। চন্দ্রশেখর সহ আরও কয়েকজন বড় যোদ্ধার মাথা কেটে প্রধান ফটকের সামনে ঝুলিয়ে দিয়ে শুরু হ'ল যুদ্ধজয়ের পৈশাচিক উল্লাস।
প্রায় তিনদিন পরে আম্রপালি ও তার সঙ্গীরা জানতে পারল এই পরাজয়ের কথা। শুরু হ'ল প্রতিশোধের আগুন নিয়ে গভীর জঙ্গলে কয়েকজন মহিলা-র অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পথ চলার। "বাকি লড়াই-টা আমাদের একার। " - বলল আম্রপালি।
উত্তরের দিকে প্রায় দু'দিন চলার পর জঙ্গল পাহাড় পেরিয়ে তারা পৌঁছাল একটা নদীর ধারে। ইতি মধ্যে ভাল্লুকের আক্রমণে হারাতে হয়েছে দলের একজনকে। আম্রপালি-র পক্ষে আর চলা সম্ভব হচ্ছিল না। এরকম অবস্হায় দুটো পথ খোলা ছিল, হয় এখানেই কোথাও থাকার মত একটা জায়গা খুঁজতে হবে, আর নয়তো আম্রপালি-কে ফেলে রেখে এগিয়ে যেতে হবে বাকিদের। শেষ পর্যন্ত অনেক খোঁজাখুঁজি-র পর আবিষ্কার হ'ল জঙ্গলে প্রায় ঢাকা পড়ে যাওয়া একটা গুহার মুখ। কিছুটা হলেও একটা নিশ্চিত আশ্রয় এই বারো জন মহিলার জন্য এই।অজানা অচেনা গভীর জঙ্গলে। পাঁচদিন পরে এক অমাবস্যার রাতে চারদিক আলো করে আম্রপালি জন্ম দিল এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের। সুদর্শনা এই কন্যার আদর করে নাম রাখা হ'ল চারভি।
গুহাজীবনের সাথে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল সবাই, বেড়ে উঠছিল চারভি, আর তার সাথে চলছিল এই কয়েকজন নারীর প্রতিশোধের প্রস্তুতি। অস্ত্রশিক্ষা নিজেদের মত করে, সাতবাহন সাম্রাজ্যের উপর আঘাত হানার এক অলীক স্বপ্ন বুকে নিয়ে এগিয়ে চলা। এভাবেই কেটে গেছে প্রায় ৬ বছর। গুহার ভিতরটাও এই ক'বছরে বেশ প্রশস্ত করে ফেলেছে সবাই মিলে। এখন অনেকটা ভিতর পর্যন্ত যাওয়া যায়। চারভি ইতিমধ্যেই বেশ বড় হয়ে উঠেছে। এই বয়সেই তার মধ্যে তৈরি হয়েছে একটা প্রতিশোধস্পৃহা, ক্রূঢ়তা।
গুহার আয়তন যত প্রশস্ত হয়েছে, সেখানে পাওয়া গেছে বেশ কিছু অদ্ভুত জিনিস, কিছু পুরনো পাত্র, পাথরের অস্ত্র, পাথরে খোদাই করা কিছু দুর্বোধ্য লিপি আর....... কিছু নরকঙ্কাল! হয়ত বহুযুগ আগে এখানে এভাবেই কেউ পথ হারিয়ে এসে পড়েছিল! বা হয়ত আদিম গুহা মানবের বাস ছিল কোনো সময়।
এইভাবেই একদিন গুহার প্রায় শেষ প্রান্ত খননের সময় বেশ কিছু বড় পাথরের খাঁজ থেকে উঁকি দিল পাথরের দেওয়ালে খোদাই করা অদ্ভুত দর্শন এক নারীমূর্তি। উচ্চতায় প্রায় ২০ ফুট এই বিকট দর্শন মূর্তির চোখের জায়গায় দুটি বড় গহ্বর, প্রায় একহাত বেরিয়ে আসা লম্বা জিভ- এর ডগা-টা একটু বাঁকা, ঠিক যেমন কিছু চেটে খাওয়ার পর আমাদের জিভটা ভাঁজ হয়, কানে বড় বড় দুল, গলায় মাকড়ি। নামমাত্র পোষাক পরা এই মূর্তির মোট সাতটি হাত। পাঁচটি মুঠো করা, একটি হাতে ধরা তরোয়াল আর আরেক হাতে একটি পাত্র। পায়ের নীচে একটি মুন্ড হীন পুরুষের মূর্তি। চারভি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল ঐ বিকটদর্শন মূর্তির দিকে।
আম্রপালি পাগলের মত ছুটে এসে ঈগলের শিকার ধরার ক্ষিপ্রতায় সরিয়ে নিল মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা চারভি-কে। ঘটনায় কিছুটা অবাক হয়ে গেল বাকিরা। চারভি মাঝেমধ্যেই সেই মূর্তির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কখনও দিনে কখনও রাতে, আবার কখনও ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে, একা। এভাবে কেটে গেলো আরও দু'টো বছর। আম্রপালি দিনের পর দিন অসুস্হ হয়ে পড়তে থাকল। সমস্ত জড়ি-বুটি যখন তাকে সুস্হ করতে ব্যর্থ , তখন একদিন চারভি-কে কাছে ডাকল আম্রপালি। চন্দ্রশেখরের কিছু পুঁথি-পত্র সযত্নে রাখা ছিল তার কাছে, সেগুলো চারভি-কে দিয়ে আম্রপালি বলল, " আমার মৃত্যুর পর ঐ মূর্তির কাছে তুমি আর কখনো যাবে না। এই পুঁথিগুলো পারলে পড়ার পর পুড়িয়ে ফেলবে। "
চারভি বলল, "কিন্তু আমি যে ঘুমের মধ্যেও ঐ মূর্তিটা দেখতে পাই মা! "
আম্রপালি-র কথা বলার ক্ষমতা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দু'দিনের মধ্যেই মারা গেল আম্রপালি। এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। একদিন রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর চারভি সেই পুরনো পুঁথি-পত্র গুলো খুলে বসল।
বহু পুরনো এই পুঁথির বেশীরভাগটাই ঝাপসা। তন্ত্র মন্ত্রের কিছু বর্ণনা আছে কয়েকটি পাতায়, একটি মূর্তির উল্লেখ আছে। তারপর কয়েকটি পাতা নেই। শেষের কয়েকটি পাতায় দেওয়া আছে পৃথিবীতে আধিপত্য বিস্তারের হদিশ!!! এই মূর্তিটি কোনো নির্দিষ্ট পুরুষের কাছে মাতৃসম, এবং একজন নির্দিষ্ট সময়ে জন্মানো কন্যার জন্য তার পৃথিবীর সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রাপ্তির আধার।
নির্দিষ্ট মন্ত্রে, নির্দিষ্ট দিনে ১০ জনের রক্তাহুতি-তে এই মূর্তিকে আবার জাগিয়ে তোলা সম্ভব। একদম শেষ পৃষ্ঠায় মূর্তির ছবিটা দেখে চারভি-র চোখে মুখে এক পৈশাচিক উল্লাস খেলে গেলো। সেই সাতটা হাত, জিভ, পায়ের নিচে মুন্ডহীন দেহ....... গুহার দেওয়ালে যেন হিসহিস করে প্রতিফলিত হল একটা তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর...... চারভি........।
পরেরদিন সকাল থেকেই চারভি কিছুটা চুপচাপ আর অনেকটা অন্যমনস্ক থাকতে শুরু করল। বেশিরভাগ সময়ই তার কাটত নদীর ধারে। এরকমই একদিন নদীর ধারে এদিক ওদিক ঘোরার সময় আচমকাই কিছু একটা তার হাত ঘেঁষে চলে গেল। হাত থেকে রক্ত পড়তে দেখে বুঝতে বাকি থাকল না জিনিস- টা কি! একটা তীর। নদীর দিকে তাকাতেই সে দেখতে পেল, একটা বেশ বড় পালতোলা নৌকা, আর সেখান থেকেই উড়ে এসেছে তীরটা। কেউ যেন ফিসফিস করে চারভি-কে বলল "পালাও চারভি। " গুহার দিকে দৌড়তে লাগল উর্ধশ্বাসে, আর কোনো এক অদ্ভুত অশরীরী ক্ষমতাবলে তার নাগাল পেল না পিছন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসা তীর গুলো।
প্রায় ২ কিলোমিটার একনাগাড়ে ছুটে ক্লান্ত চারভি পৌঁছাল সেই গুহার কাছে। সমস্ত ঘটনা শুনে প্রমাদ গণলো বাকি মহিলা-রা। "বিপদ আসন্ন, আমাদের তৈরি হতে হবে।" -বলল রুথিকা।ইতিমধ্যে সেই পালতোলা নৌকা এসে নোঙর ফেলেছে নদীর তীরে। দশ জনের সৈন্যদল তীর-ধনুক, তরোয়াল, বল্লম নিয়ে এগোতে লাগল চারভি-র পথ অনুসরণ করে।
চারভি-কে একটা বড় পাথরের পিছনে লুকিয়ে রেখে বাকিরা তৈরি হয়ে নিল, সম্ভবতঃ জীবনের শেষ লড়াই-এর জন্য। এতদিনের অস্ত্রশিক্ষার পরীক্ষা আজ হয়ত সামনে। মেঘ ঘনিয়ে এল আকাশে, সাথে দমকা হাওয়া। দূর থেকে এগিয়ে আসছে দশজনের একটা ছোটখাটো সৈন্যদল। "আমরা আগে আক্রমণ করব না। হতে পারে ওরা পথ হারিয়ে ফেলেছে তাই সাহায্যের জন্য...... "- রুথিকার কথা শেষ হওয়ার আগেই একঝাঁক তীর উড়ে এলো। কয়েকটা সামনে পড়ল, কয়েকটা গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল, আর কয়েকটা পাশে দাঁড়ানো সঙ্গীর শরীর ভেদ করে আটকে গেল। সাতবাহন পতাকা উড়িয়ে আরো কাছে এসে গেল সৈন্য দল। উভয় পক্ষই সমান ভাবে লড়ল। এই গভীর জঙ্গলে অজানা কোনো গুহার দেওয়ালের প্রতিটা কোণা সাক্ষী থাকল দশজন মহিলার বীরত্বের। শেষজন হিসাবে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে রুথিকা দেখল তার সঙ্গীদের মধ্যে আর কেউই বেঁচে নেই। আর সেই সৈন্যদলের- ও সবাই আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে। মুখে একটা তৃপ্তির হাসি নিয়ে রুথিকা-র এত বছরের যুদ্ধ শেষ হ'ল।
সন্ধ্যা নামতে আর কিছু সময় বাকি। চারভি বেরিয়ে এল পাথরের পিছন থেকে। রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে পাথর ছুঁড়তে লাগল আহত সৈনিক দের উপর যতক্ষণ না জ্ঞান হারায়। তারপর একটা তরোয়াল তুলে নিল হাতে। একটা চাপা হাসি, দীর্ঘশ্বাস আর অদ্ভুত ফিসফিসানি ঘুরে বেড়ালো গুহার দেওয়ালে। চারভি প্রত্যেকের বুকে একবার করে কোপ মারল তরোয়ালের, ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল রক্ত।
আজ অমাবস্যা। সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ এই জঙ্গলে এক অন্ধকার গুহাতে একটা একা বছর দশেকের মেয়ে আর তার চারদিকে পড়ে আছে একুশটি মৃতদেহ। ডুকরে কেঁদে উঠেও নিজেকে সামলে নিল চারভি। এগারো জন মহিলার দেহ সাজিয়ে রাখল একদিকে...... আর এক এক করে দশজন মৃত সৈনিকের দেহ টেনে নিয়ে চলল গুহার শেষ প্রান্তে কোনো এক অদ্ভুত পৈশাচিক ক্ষমতাবলে।
দু'টো মশাল জ্বালিয়ে আটকে দিল দেওয়ালের গায়ে। তারপর স্নান করে কিছু সিঁদুর, ফুল আর একটা তরোয়াল নিয়ে আবার ফিরে এল মূর্তির সামনে। তরোয়ালের কোপে এক এক করে আলাদা করে ফেলল দশটি সৈনিকের মাথা। তারপর মূর্তির পাঁচটি মুঠো করা খালি হাতে কোনোরকমে পাথরের উপর উঠে ঝুলিয়ে দিল পাঁচটি মাথা। আর বাকি পাঁচটা মাথা দিয়ে বানালো নিজের আসন। মূর্তির এক হাতে ধরা তরোয়াল টা পরিবর্তন করে দিল আর আরেক হাতে ধরা পাত্রে ভর্তি করে দিল সৈনিকদের রক্ত। এরপর নিজের হাত কেটে সেই রক্ত দিয়ে ভেজানো ফুল, মূর্তির পায়ে অর্পণ করতে করতে পুঁথির সেই দূর্বোধ্য মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকল..... বলা ভালো তাকে দিয়ে করিয়ে নেওয়া হল। একবার..... দু'বার...... তিনবার..... চারবার....
কতক্ষণ, কতদিন.... বা বলা ভালো কতবছর এরকম চলেছে তা জানা নেই। একঝলক ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা আর অদ্ভুত গন্ধে চোখ খুলল চারভি। হালকা লাল আলোতে ভরে গেছে গুহার ভিতরটা। মূর্তির চোখের গহ্বর লাল টকটকে, জিভ থেকে গড়িয়ে পড়ছে সদ্য চেখে নেওয়া রক্তের ফোঁটা আর মুখে অদ্ভুত তৃপ্তির হাসি। উঠে দাঁড়াল চারভি, আর তার সবকটা ইন্দ্রিয় জানান দিল , সে অন্তত দশ বছর কাটিয়ে ফেলেছে এটুকু সময়ে! অবাক হয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখল সেই সৈনিকরা কঙ্কাল হ'য়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। তার মানে তার ধারণাই সত্যি!
তীক্ষ্ণ ফিসফিসানি-তে মহিলা কন্ঠ ভেসে এল, "আমাকে আবার জাগতে সাহায্য করার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমি সন্তুষ্ট। তুই আমার মেয়ে হয়ে থাকবি। বল কি চাস তুই? "
চারভি বসে পড়ল হাঁটু মুড়ে। হাত জোড় করে প্রতিশোধের কথা বলতে গিয়েও হঠাৎ তার মনে পড়ল পুঁথিতে লেখা পৃথিবী শাসনের কথা, সবচেয়ে শক্তিশালী হওয়ার কথা, অমরত্বের কথা। লোভে চকচক করে উঠল চারভি-র চোখ, শান্ত গলায় বলল, " সর্বোচ্চ শক্তির অধিকারীনি হতে চাই মা। "
একটা খিলখিল হাসির শব্দ প্রতিফলিত হ'ল চারদিকে তারপর শোনা গেল, "প্রত্যেক অমাবস্যার রাতে একজন করে নতুন যুবকের রক্ত দিয়ে আমার পূজা করবি। এইভাবে একশত পঞ্চাশ অমাবস্যার পর তুই শক্তিশালী হয়ে উঠবি। কিন্তু এর মধ্যে যদি কোনো পুরুষের রক্তে আমি তৃপ্ত হই তাহলে সে মরবে না, আর তোর গনণা আবার প্রথম থেকে শুরু হবে। তবে ততদিনে তোর অর্জিত শক্তি তোর- ই থাকবে "
হালকা আলোটা নিভে গেল।এরপর প্রতি অমাবস্যার রাতেই চারভি তার শিকার খুঁজে আনতে থাকল আর একটু একটু করে শক্তিশালী হতে থাকল, যতদিন না পর্যন্ত সে তূর্যবর্মণ- এর মুখোমুখি হ'ল।
---------------------------------------------------------------------------