HIMABANTA DUTTA

Abstract Horror Thriller

3  

HIMABANTA DUTTA

Abstract Horror Thriller

নরকের আগুন

নরকের আগুন

5 mins
662



কোথায় স্বর্গ আর কোথায় নরক আর সেখানে কি হয়, এটা ভাবতে ভাবতে ভাবতেই আমাদের গোটা জীবনটা কেটে যায়। কিন্তু আমরা বুঝে উঠতে পারিনা স্বর্গ এখানেই আছে, আমাদের পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি, তার সৌন্দর্য , চারপাশের মানুষ, পশু-পাখী এই সবকিছুই আসলে স্বর্গ, এই গ্রামের রাস্তা, প্রকৃতি, পাখিদের মন ভালো করে দেওয়া কোলাহল , অসাধারণ সুন্দর প্রকৃতি এই সবই স্বর্গের চেয়ে কম কি? কিন্তু নরক? সেটাও কি তাহলে এইভাবেই কোথাও........ 


হঠাৎ জোরালো শব্দে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল গাড়িটা আর তার সাথেই ছেদ পড়ল আমার চিন্তায়। প্রায় ২৫ বছর পর আমি গ্রামে ফিরছি। ফিরছি বলা ভূল, দিন সাতেকের জন্য ছুটি কাটাতে এসেছি শহরের ধূলো, বালি, pollution, অফিসের কাজের চাপের দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে বেরিয়ে একটু খোলা বাতাসে নিশ্বাস নেওয়ার জন্য। আমি সবসময়ই নিজের কাজের প্রতি প্রচন্ড দায়িত্ববান থাকার চেষ্টা করেছি, তাই অফিসে একের পর এক কাজ চাপিয়ে দেওয়া হয় আমার উপর। আমরা যখন এই গ্রাম থেকে চলে যাই, তখন আমার বয়স মাত্র পাঁচ। তাই ছোটবেলার কথা যেটুকু মনে আছে, সেটা খুবই কম। তবে এই পঁচিশ বছরে শহরের যতটা পরিবর্তন হয়েছে, সেই তুলনায় গ্রামের পরিবর্তন নিতান্তই নগণ্য। চোখে পড়ার মত যেটুকু হয়েছে সেটা হল এই পাকা রাস্তা আর ইলেকট্রিক পোস্ট। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে বুঝলাম টায়ার-টা গেছে, চেঞ্জ করতে আরো প্রায় বিশ-পঁচিশ মিনিট লাগবে। গাড়ী থেকে নেমে একটা সিগারেট ধরিয়ে বড় রাস্তা থেকে নেমে একটু হাঁটতে লাগলাম। চারদিক -টা কেমন অস্বাভাবিক রকমের নিস্তব্ধ। কোনও মানুষের অস্তিত্ব নেই সেটা বলাই বাহুল্য, এমনকি কোনো কুকুর বিড়াল -ও চোখে পড়ল না। ড্রাইভার-কে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম "আর কতক্ষণ? "

'আরো দশ মিনিট লাগবে' - উত্তরে জানালো সে। আমি মোবাইলটা বের করে কয়েকটা ছবি তুলতে লাগলাম এই অপরূপ মনোরম সুন্দর প্রকৃতির। পড়ন্ত বিকেলের লালচে আভা গায়ে মেখে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে পড়ল ছোটবেলার একটা কথা। গ্রামের প্রায় শেষ প্রান্তে একটা ভুতুড়ে পুরনো পোড়ো বাড়ি ছিল। ঐ বাড়ির কয়েক মাইলের মধ্যে কোনো জনবসতি ছিল না। কেউ কোনোদিন ঐ বাড়িতে বা তা ত্রি-সিমানায় যেতো না। যেতে ভয় পেতো।


কেনো ভয় পেত সেটা আর এখন মনে নেই। তবে আমাদের থেকে বয়সে বড় ডানপিটে দাদা দেরও ওদিকে যাওয়া কঠোর ভাবে বারণ ছিল। হঠাৎই মনে পড়ল সেই বাড়িটার কথা, এখনও কি আছে সেটা? গ্রামের লোকজন কি এখনও ওদিকটা এড়িয়ে যায়? সবেমাত্র সন্ধ্যা নামছে। গাড়ি স্টার্ট নিয়ে এগোতে থাকল আমার গন্তব্যের দিকে। কিংবা বলা ভালো অদৃষ্টের স্থির করে দেওয়া পথের দিকে। 


গ্রামে অন্ধকার নামে হঠাৎই, ঝুপ করে। আমাদের তখনও প্রায় ১ ঘন্টারও বেশি সময়ের পথ বাকি ছিল। মোটামুটি আন্দাজ করে গাড়ী থেকে বাঁদিকে তাকালাম, চাঁদের আলোতে ভেসে যাওয়া ফাঁকা ধূ ধূ প্রান্তর পেরিয়ে অনেকটা দূরে চোখে পড়ল সেই পোড়ো বাড়িটা। এখনও সেই একই রকম রহস্যময়, অলৌকিক , কেমন যেন একটা তাচ্ছিল্য ভরা চাহনি নিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।  


রোখ চেপে গেল মাথায়। এখন আমি তিরিশ বছরের পরিণত যুবক। আমাকে জানতেই হবে কি আছে ওখানে, যার জন্য কেউ ওখানে যাওয়ার সাহস করে না? বড় রাস্তা ছেড়ে নেমে গাড়ি ছুটতে থাকল সেই ফাঁকা ধানজমি, খোলা প্রান্তরে-র মধ্যে দিয়ে গ্রামের শেষ প্রান্তে সম্পূর্ণ ব্রাত্য হয়ে পড়ে থাকা সেই অচেনা অজানা মায়াবী বাড়ীটার উদ্দেশ্যে। 


'সাহাব এখানে অন্ধকারে ঢোকা রিস্কি হয়ে যাবে না? '


আমি বললাম - 'আরে চলো, মোবাইলের টর্চ আছে কোনো ভয় নেই। আর চোর ডাকাত থাকলেও কিছুই পাবেনা নেওয়ার মত। '


'যদি সাপ খোপ কিছু থাকে? ' - বলল ড্রাইভার যোগিন্দর। 


আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, ' মোবাইলে বিন বাজানোর মিউজিক আছে চালিয়ে দেবো, তারপর দুজন মিলে বসে নাগিন ডান্স দেখবো, এখন চলো। '



ভিতরে ঢুকে যতটা বুঝতে পারলাম, একটা বিশাল অট্টালিকা-র থেকে কিছু কম নয় এই পোড়ো বাড়িটা। একটা বড় হল ঘর মত, লম্বা ভাঙাচোরা কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে উপরের দিকে। দুদিকে দু'সারি ঘর আছে মনে হল। মোবাইলে টর্চ জ্বেলে প্রায় ৫ মিনিট চলার পর কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়ালাম। তারপর বেশ গর্বের সাথে বললাম, "ছোটবেলা থেকে সবাইকে দেখতাম এই বাড়িটাকে ভয় পেতো। কেউ এর ত্রি-সিমানায় আসতে ভয় পেতো। আর আজ দেখো সূর্যাস্তের পর অন্ধকারে একদম একা আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি। লোকজন কোনো কারণ ছাড়াই কেমন ভয় পায় ভাবো যোগিন্দর দা.......... যোগিন্দর দা......... যোগিন্দর দা............!!!!!!!

আমার গলার শব্দ ফাঁকা বাড়িতে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এল। আমার পাশে, সামনে বা পিছনে কোথাও যোগিন্দর দা-র কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রচন্ড ভয় পেয়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসতে গিয়ে কোনো কিছুতে পা আটকালো আর আমি ঘরের মেঝের মধ্যে পড়ে গেলাম। হাতের মোবাইল -টা ছিটকে কিছুটা দূরে পড়ে আলোটা নিভে গেল আর ঠিক তখনই দেখতে পেলাম যেখানে পড়ে গেছি, ঠিক তার পাশেই কাঠের মেঝের ফাঁক দিয়ে একটুকরো আলো দেখা যাচ্ছে। কাঠের আলগা তক্তা একটু চাপ দিতেই খুলে গেল, আর সেখানে আবিষ্কার করলাম নীচে নেমে যাওয়ার গোপন একটি রাস্তা। মন্ত্রমুগ্ধের মত চলতে থাকলাম আলোর উৎস লক্ষ্য করে। যত এগোচ্ছি ততই গরমটা বেড়ে চলেছে , আর আমার গতিপথ বরাবর লেগে রয়েছে টাটকা রক্তের রেখা। ঠিক যেন সবেমাত্র বঁড়শিতে গেঁথে কাউকে মেঝের উপর দিয়ে ঘষে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কতক্ষণ হাঁটছিলাম আমি জানিনা। হঠাৎ গরমের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। আর যা দেখলাম, তাতে আমার শিড়দাঁড়া বেয়ে একটা শিহরণ খেলে গেল। আমার থেকে কিছুটা দূরে আমার দিকে পিছন করে বসে আছে এক মুন্ডিত মস্তক সাধু। আর তার সামনে জ্বলছে বিশাল লেলিহান আগুনের শিখা। সেই শিখা কতদূর বিস্তৃত তা আমি জানিনা। তার কিছুটা পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একটা ভয়ংকর দানবাকৃতির জীব, যার হাতে ধরা আছে একটা বিশালাকৃতির খড়গ। আর তার ঠিক পায়ের কাছে পড়ে আছে যোগিন্দরের নিষ্প্রাণ দেহ।


সেই মুন্ডিত মস্তক সাধু কিছু দুর্বোধ্য মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে একটা ধারালো চকচকে ছুরি বের করে নিজের হাতের কিছুটা অংশ কেটে ফেলল। তারপর হাত থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্ত সেই লেলিহান শিখার উদ্দ্যেশ্যে অর্পণ করে আমার দিকে ঘুরে তাকালো। আগুনের শিখা রক্তের স্বাদ পেয়ে দ্বিগুণ ভয়ংকর রূপ ধারণ করল। এই অলৌকিক ক্রীয়াকলাপের ফলস্বরূপ সেই লেলিহান শিখার তীব্র ঝলসানিতে চোখ ঢাকা দিতে দেখতে পেলাম সেই সাধুর বিভৎস্য রূপ। মুখের বেশির ভাগ মাংস গরমে গলে গিয়ে খুবলে খুবলে পড়ে প্রায় কঙ্কাল বেরিয়ে আসার উপক্রম। আমার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বলল,


 '' নরকের অগ্নিকুণ্ডে স্বাগত। এই আগুনের তেজ সহ্য করার ক্ষমতা শয়তান ছাড়া আর কারোর নেই। আর তুই এখনও এই আগুনের সামনে জীবিত দাঁড়িয়ে আছিস। আজ থেকে তোর আনা প্রসাদে তান্ডব হবে। নারকীয় তান্ডব.....নারকীয় তান্ডব। '' - অট্টহাসি-তে ফেটে পড়তে পড়তে আমার কপালে রক্ত তিলক এঁকে দিল, আর সেই ভয়ংকর দানবের দিকে ফিরে কিছু ইশারা করল। সেই ভয়ংকর দানবাকৃতি জীবটির হাতে ধরা খড়গ টা সজোরে নেমে গেল যোগিন্দরের শরীর লক্ষ্য করে, আর কাটা মাথাটা গড়িয়ে এসে ঠেকল আমার পায়ে। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম।




এই ঘটনার পর প্রায় ২ বছর কেটে গেছে। পরের দিন সকালে আমাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল ঐ পোড়ো বাড়ির বাইরে। যোগিন্দর-কে এই ঘটনার পর আর কোনো দিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমিও আর শহরে ফিরে যাইনি, গ্রামের এই স্বর্গের মত অপরূপ সুন্দর পরিবেশেই থেকে গিয়েছি । শুধু মাঝে মাঝে রাত্রে একজন করে গ্রামবাসী-কে ছলে -বলে- কৌশলে নিয়ে যাই সেই পোড়ো বাড়িটায়, আর তাদেরও যোগিন্দরের মত সমর্পণ করা হয় নরকের আগুনে। আমার উপর যে প্রসাদ নিয়ে যাওয়ার ভার দেওয়া আছে। আর আমি প্রচন্ড দায়িত্ববান।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract