মান্তাবুড়ি
মান্তাবুড়ি
আমি যখন খুব ছোটো, তখন একটা বুড়ি প্রতি রবিবার সকালে আমাদের গ্রামের বাড়িতে আসত এটা, ওটা নিয়ে। কখনও ফল, শাক-সব্জি, ডিম নিয়ে, আবার কখনও অপটু হাতে বানানো পুতুল, হাতি, হাঁস এইসব নিয়ে।
ওর নাম ছিল মানদা। আমি ছোট ছিলাম, উচ্চারণ করতে পারতাম না তাই মান্তা বলতাম।
মান্তাবুড়ি অনেক গল্প বলত, অনেক কিছু..... আর আমাকে খুব আদর করত। আমাকে একবার একটা পুতুল দিয়েছিল হাতে সেলাই করা ,উস্কোখুস্কো চুল-ওয়ালা । আমার মোটেই ওটা পছন্দ ছিল না। কি বাজে! কিন্তু মান্তাবুড়ি-কে আমিও খুব পছন্দ করতাম। রবিবার সকাল হলেই অপেক্ষায় থাকতাম কখন ঐ ডাকটা শুনব, "ও বেটি, আছো না কি? "
ফোনের অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। সূর্যের হালকা রোদটা জানলা দিয়ে ঘরে এসে পড়েছে। প্রায় ১৫ বছর হ'ল আমরা গ্রামের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি। আজ হঠাৎই মান্তাবুড়ির কথা মনে পড়তে অনেক স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠল। বেশ লাগছিল। কত বছর হয়ে গেল দেখতে দেখতে ! বুড়ি এখন কেমন আছে বা আদৌ বেঁচে আছে কি না এইসব চিন্তা করতে করতেই কি মনে করে ছাদের স্টোর রুমে চলে গেলাম। সব পুরনো জিনিসের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে সেই বিচ্ছিরি দেখতে পুতুল-টা ও আবিষ্কার করলাম। মন-টা বেশ ভালো হয়ে গেল। সযত্নে পুতুল-টা পরিষ্কার করে শো-কেসে রেখেদিলাম। সেই ছোট্টবেলার স্মৃতি!!
>
রাত তখন ক'টা হবে, ২টো কি তার একটু বেশি, মনে হ'ল কারোর গলার শব্দ, খুব আস্তে। ঘুমটা ভেঙে গেল। কিন্তু আর কিছু শুনতে পেলাম না। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক দেখে আবার চোখ বুজলাম। আবার সেই একই ঘটনা। জানলায় একটা ছায়া, আর এটা গাছের ছায়া নয়! তাহলে? চোর? এই চারতলার ফ্ল্যাটে চোর কি করে উঠবে, তাও কার্নিশ বেয়ে? এসব ভাবতে ভাবতেই কাঁপা কাঁপা হাতে পর্দাটা সরালাম।
একধাক্কায় আমার হৃদস্পন্দন হয়ত দ্বিগুণ হয়ে গেল! জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ওটা কে! আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় তখন জানান দিচ্ছে অনেক কিছুর, প্রতিটা রোমকূপ খাড়া। মান্তাবুড়ি!!!! নিস্তব্ধতা ভেঙে খিলখিল করে হেসে উঠল, ঠিক যেন বহুদিন পরে কিছু ফিরে পাওয়ার হাসি, আর হাতে ধরা আমার আজ সকালে-র খুঁজে পাওয়া সেই পুতুল-টা!!! আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। কি ঠান্ডা সেই চাহনি!!!! ফিসফিস করে বলল, "এতদিন পর মনে পড়ল বুড়ির কথা? তোকে কত্ত ভালোবাসি বলত সোনা মা! আমি আসব রোজ রাতে, তোর সাথে দেখা করতে।" ...... খিলখিল করে হাসি-টা মিলিয়ে গেল। ঘামতে ঘামতে ধরফর করে উঠে বসলাম। ওহ্ স্বপ্ন দেখছিলাম!!! উঠে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আস্তে করে জানলার পর্দা-টা সরিয়ে দিলাম। দূরে কোথাও কর্কশ গলায় একটা নিশাচর পাখী ডেকে উঠল। অল্প আলোয় দেখলাম আমার সকালের খুঁজে পাওয়া মান্তাবুড়ির সেই পুতুল-টা জানলার গ্রিলে ঝুলছে।