হ্যালিউসিনেশন
হ্যালিউসিনেশন


অনেকদিন থেকেই কথা চলছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওলজি বিভাগে,ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এক্সকারশনে যাবার কিন্তু জায়গা নির্বাচনে প্রফেসরদের মধ্যে দ্বিমত হওয়ায় একটু দেরী হল। পুজোর ছুটিতে যাবার কথা ছিল তা গড়িয়ে নভেম্বর মাসে গিয়ে দাঁড়াল। একদিকে ভালই হল,একটু হালকা ঠাণ্ডার আমেজে ঘুরতে মন্দ লাগবে না।
ঠিক হল মধ্যপ্রদেশের ভূপালে যে বিখ্যাত বৌদ্ধবিহারটি রয়েছে সেইটা দেখতেই নিয়ে যাওয়া হবে ছাত্রছাত্রীদের।
নির্দিষ্ট দিনে সকলে রওনা হল। দু'জন স্যার,একজন ম্যাডাম ও ১৪জন ছাত্রছাত্রী মিলে মোট ১৭জনের গ্রুপ। একসাথে বন্ধুরা মিলে এভাবে যাওয়ার জন্য জার্নিটা খুবই উপভোগ্য হয়েছিল। বাইরে বেরিয়ে স্যার ম্যামরাও ওদের সাথে বন্ধুর মত মেলামেশা করছিলেন। ট্রেনে সবার সঙ্গে লুডো খেলা,দাবা খেলা থেকে গলা মিলিয়ে গান গাওয়া সবেতেই ওনারা যোগ দিয়েছিলেন। অপরাজিতা,যে বরাবরই একটু চুপচাপ,সিরিয়াস টাইপের মেয়ে,সেও সবার পাল্লায় পড়ে খুব মজা করেছিল।
যেহেতু আগে থেকে সব ব্যবস্থা করা ছিল,তাই ট্রেন থেকে নেমেই গাড়ী করে সবাই গেস্ট হাউসে পৌঁছাল। ভোর ভোর পৌঁছে গিয়েছিল তাই সকলে স্নান সেরে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়ল বৌদ্ধবিহারের গঠনশৈলী ও ভিতরের কারুকাজ দেখতে।
এই বৌদ্ধবিহারটি আয়তনে বেশ বড় এবং বহু প্রাচীন তা বাইরে থেকে দেখলেই বোঝা যায়। চারপাশে বড় বড় গাছ,মনে হয় যেন জঙ্গলের মধ্যে এটির অবস্থান,গাছপালা থাকায় বেশ ছায়া সুশীতল আর শহর থেকে একটু দূরে একটু নির্জন জায়গায়। বাইরে থেকে দেখলে একটু যেন গা ছমছম করে। ওরা ভেতরে ঢুকে চারিদিকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো,মাঝে মাঝে স্যারেরা ও ম্যাম কিছু কিছু জিনিস বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। ভিতরে যে বুদ্ধিস্টরা রয়েছে সব চুপচাপ কলের পুতুলের মত। মাঝে বড় হলে বিশাল বড় বুদ্ধমূর্তি,সেখানে অনেক ধূপ জ্বলছে,গন্ধে হলঘর ম ম করছে। কিছু কিছু জায়গায় পালি ভাষায় কিছু লেখা রয়েছে যার পাঠোদ্ধার করা সম্ভব নয় স্যারেদের পক্ষে। ছাত্রছাত্রীরা তাদের ডায়েরীতে নোট নিচ্ছে,ফিরে গিয়ে যে প্রোজেক্ট জমা দিতে হবে।
ভিতরে সব দেখা হলে ওরা পিছনদিক দিয়ে বার হয় যেখানে দেখে যে যার কাজে ব্যস্ত। বড়রা কেউ কাঠ কাটছে টুকরো করে উনুন ধরাবার জন্য,ছোটদের কেউ তা গুছিয়ে রাখছে,কেউ বা মাটি কোপাচ্ছে গাছ বসানোর জন্য,কেউ গাছে জল দিচ্ছে কিন্তু কোনো শব্দ নেই,চুপচাপ নিজেদের কাজ করে চলেছে।
সব দেখেশুনে ওরা বেরিয়ে পড়ল,সবাই ক্লান্ত,সারাদিন ঘুরে ঘুরে খাবারদাবার সব হজম,ফেরার জন্য ব্যস্ত সবাই। যদিও নভেম্বর মাস,গরম বিশেষ নেই কিন্তু আগের রাতে ট্রেনে কারো ভালভাবে ঘুম হয়নি,তার ওপর সারাদিন ঘোরাফেরায় সবাই ক্লান্ত,শ্রান্ত। চারিদিকে ছায়াছায়া,বেলা তিনটেতেই মনে হচ্ছে বুঝি একটু পরেই সন্ধ্যে নামবে। যাই হোক সকলে ফিরে এলো গেস্ট হাউসে। বেলা পড়ে গেছে বলে আর ভাত না খেয়ে হেভি স্ন্যাক্স নিল সবাই,সঙ্গে চা কফি।
গেস্টহাউসের লনেই ওদের স্ন্যাক্স সার্ভ করা হল। ওখানেই আড্ডাটা বেশ জমে উঠল। গরম চা কফি সকলের ক্লান্তি খানিকটা দূর করে দিল। বেলা পড়ে এল,ওরা সকলে হলে ঢুকল। সবাই সোফায় গা এলিয়ে দিল,খানিকক্ষণ গল্পগুজব,টিভি,আরেক রাউন্ড চা এই করেই সন্ধ্যেটা কাটল।
রাত ৮টা নাগাদ ডিনার রেডি। সবার পেটে তখন আগুন,বাইরে হালকা ঠাণ্ডা। রুটি,চিকেন আর স্যালাড,বলাই বাহুল্য,সবাই গপগপ করে খেতে লাগল। খাবার পর সবাই গুড নাইট করে শুতে গেল। রাত ১০টার মধ্যে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। একেকটা ঘরে ৪জন করে,কোনোটায় ৫জন। অপরাজিতা যে ঘরে ছিল সেখানে ওরা ৪জন ছিল। অপরাজিতার বেডটা ছিল দেয়ালের দিকে। রাত ২টো নাগাদ অপরাজিতার ঘুমটা হাল্কা হয়ে গিয়েছিল,কেমন একটা অস্বস্তি অনুভব করছিল শরীরে। উসখুস করছিল আর শরীরটা আড়ষ্ট হয়ে উঠছিল। একটু পরেই ঘুমটা গেল ভেঙ্গে,দেখল ওর মাথার কাছে হাতে জ্বলন্ত প্রদীপ নিয়ে,সাদা কাপড় পরা,মাথায় ঘোমটা দেওয়া এক মহিলা। আরে,মা তো! কি বলছে মা? মুখ থেকে একটা গোঙানীর মত মা মা করে আওয়াজ,তারপর হঠাৎ জোরে চিৎকার করে মাআআআ করে। ওর চিৎকারে বাকী তিনজনের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ওর পাশের বেডে ছিল মানালি,ও মোবাইলে টর্চ জ্বালিয়ে দেয় আর মিনা সেই আলোয় উঠে গিয়ে ঘরের আলো জ্বালিয়ে দেয়। অপরাজিতা তখনও ঘোরের মধ্যে,এদিকওদিক তাকাচ্ছে,বলে "মা কোথায়?এক্ষুণি যে আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়েছিল?" সবাই জানে অপুর মা একবছর আগে মারা গেছেন আর সেই থেকে ও একটু বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে। খুব কষ্ট পায় মায়ের জন্য,ক্ষণেক্ষণে মাকে হারায়।
মানালি পাশের বেড থেকে উঠে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে,"স্বপ্ন দেখেছিস সোনা,একটু জল খা,চোখেমুখে জল দে"। ওকে জল খাইয়ে সঙ্গে করে নিয়ে গেল বাথরুমে। কিন্তু অপরাজিতার ঘোর কাটেনি,মিনা ও মিলিও একটু সিঁটিয়ে আছে। এরই মধ্যে হঠাৎ আলো নিভে গেল। সবাই ভয় পেয়ে গেলো। মানালি একটু বেশি সাহসী। আলো নিভে যাওয়ায় মানালি ব্যাপারটা ধরে ফেলল। ঘরের আলো নিভে গেলেও বাইরে আলো জ্বলছিল। মানালি আবিষ্কার করল অপরাজিতার পায়ের দিকে যে জানলা রয়েছে সেটা বন্ধ কিন্তু একজায়গায় একটু ফাঁক রয়েছে আর সেই ফাঁক দিয়ে বাইরে থেকে এক চিলতে সরু আলো এসে অপরাজিতার চোখে পড়ছিল আর ওর ঠিক পিছনে দেয়ালের হুকে টাঙানো ওর সাদা তোয়ালেতে গিয়ে পড়ছিল যেটা একটু ঘোমটার মত হয়েছিল আর ঘুমের ঘোরে সেটাই মনে হয়েছে ঘোমটাপরা কেউ প্রদীপ হাতে মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম রাতে সবাই এতই ক্লান্ত ছিল যে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর মাঝরাতে ঘুমটা একটু হালকা হওয়ায় আর চোখে আলো পড়ায়,তার ওপর বৌদ্ধবিহারে গিয়ে একটু গা ছমছম পরিবেশ লেগেছিল ,তাছাড়া মায়ের মৃত্যুটা স্মৃতিতে এখনও টাটকা,এইসব মিলিয়ে আধো ঘুমে ওর যেটা মনে হয়েছে সেটা হ্যালিউসিনেসন ছাড়া আর কিছু নয়।
অন্ধকারে ওরা ৪জন গায়ে গায়ে বসেছিল। কিছু পরে আলো এল,মানালি আবার আলো নিভিয়ে সবাইকে ব্যাপারটা বোঝালো ভাল করে,সবাই হেসে উঠল কিন্তু অপু একটু বিমর্ষ,মাকে যে বড্ড মনে পড়ছে। মানালির সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতা একটু বেশি তাই মানালি ওর মনের অবস্থা বুঝতে পারছে। ও অপুকে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল আর নিজের বেডটা টেনে ওর বেডের সঙ্গে লাগিয়ে ওর গায়ে হাত রেখে শুয়ে পড়ল। পরে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে উঠে এ গল্প করায় স্যারেরা রাগ করতে লাগলেন তাদের ডাকা হয়নি বলে। অপু বেশিরকম চুপ করে থাকায় ম্যাম ওকে অনেক আদর করলেন। পরদিন ওদের সাইট সিইং ছিল। সকলে মিলে আনন্দ করে ঘুরল সারাদিন। মানালি ও ম্যাম অপুর কাছাকাছিই থাকতে লাগলেন। অপু আস্তে আস্তে ঘোর কাটিয়ে নর্মাল হয়ে সবার সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠল।