হুড়াল
হুড়াল


ঝাড়খণ্ডের পালামৌয়ের অপরূপ সুদৃশ্য ডালটনগঞ্জের কাছেই নিমিয়া গ্রাম। দিগন্তরেখায় ধূম্র নন্দী পাহাড়,পাশ দিয়ে নৃত্যরতা যুবতীর মতো বয়ে চলেছে কোয়েল নদী। কাছেই লোধা জলপ্রপাত। চারদিকে যতোদূর চোখ যায়,শুধু সবুজ আর সবুজ। সকালে পাখিদের কূজনে দূর হয়ে যায় মনের সব বেদনা। মনে হয় পৃথিবীতে একচিলতে স্বর্গ যেন নেমে এসেছে। কিন্তু একটা কথাই আছে,সুন্দরতম স্থানেই ভয়ঙ্করতম ঘটনা ঘটে থাকে।
নিমিয়া গ্রামের পাশেই জঙ্গল।শাল,সেগুন,মহুয়া বিভিন্ন পর্ণমোচী উদ্ভিদের। এই জঙ্গল গিয়েই মিশেছে বেতলা ফরেস্টে। কিন্তু বেশ কয়েকদিন থেকেই নিমিয়া গ্রামের মানুষ আতঙ্কে আছে। ঘটনার সূত্রপাত,বনের গভীরে এক কাঠুরে কাঠ কাটতে গিয়ে হুড়ালের আক্রমণে প্রাণ হারায়। এরপর প্রাণ হারাতে থাকে একের পর এক গ্রামবাসী। ধূসর রোমের হুড়ালটাকে গ্রামের অনেকেই দেখেছে। কিন্তু সেটা ভয়াবহ,সাধারণ ছোটনাগপুরের হুড়াল থেকে আকারে অনেকটাই বড়ো। সবুজ জ্বলন্ত দুই চোখে জগতের সমস্ত নিষ্ঠুরতা প্রতিভাত। একবার সেটার সামনে পড়লে মৃত্যু সুনিশ্চিত। সেটা কোথা থেকে আসে আর কোথায় যায়,কেউই জানে না। গাঁয়ের মানুষ মনে করছে ,গ্রামের পাশে যে গহন অরণ্য,সেখানেই তার নিবাস।
কিন্তু গ্রামের মানুষ একসঙ্গে মিলে ওটাকে অনেক খুঁজেছে। কিন্তু জঙ্গলের কোণাকোণা সন্ধান করেও ওটাকে পাওয়া যায় নি। ওটা একমাত্র তখনিই আবির্ভূত হয়,যখন কোনো মানুষের নিয়তিতে মৃত্যু লেখা থাকে। কে জানে,হয়তো ওটাই স্বয়ং কাল।মুণ্ডা পুরোহিত বলছেন অদ্ভুত এক কথা। তাঁর মতে ওটা কোনো সাধারণ হুড়াল নয়,ওটা মায়াবী। অন্য সময় সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশ নিয়ে থাকে,গ্রামের মানুষ যাতে চিনতে না পারে। কিন্তু রক্তের তৃষ্ণা মাথায় চাপলেই ধারণ করে নিজরূপ। তখন ওর সামনে যে আসবে,তার মৃত্যু অবধারিত। একমাত্র রূপোর ফলা বাঁধানো কাঠের শূলই বধ করতে পারে ওকে। কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব!
খবর গেছে সরকারী বনদপ্তরে। পাঠানো হয়েছে শিকারী বিক্রম সিংহকে,হুড়ালটাকে মারতে নয়,সেটাকে ট্রাঙ্কুইলাইজার বন্দুক দিয়ে নিঝুম করে খাঁচায় বন্দি করে বনে নিয়ে যেতে। যাই হোক,বিক্রম যখন নিমিয়া বাসস্ট্যান্ডে নামলেন তখন শনিবারের বারবেলা। দিগন্তে পাহাড়ের কোলে রক্তিম সূর্য অস্ত যাব যাব করছে।এক মনোরম পরিবেশ। কিন্তু কয়েকদিন নিমিয়া গ্রামে থেকেও সুদক্ষ মুণ্ডা যুবকদের নিয়ে গ্রামে অনেক অনুসন্ধান চালিয়েও হুড়ালটার খোঁজ পেলেন না। গ্রামবাসীরাও অবাক,হুড়ালটা কি বেমালুম অদৃশ্য হয়ে গেল। দুসপ্তাহ কাটালেন বিক্রম। এরমধ্যেই তিনি মুণ্ডারী ভাষা রপ্ত করেছেন, প্রেমে পড়েছেন গ্রামের যুবতী রিমিলের,ঠিক হয়েছে আজই চাঁদনি রাতে শালবনের মধ্যে রিমিলকে নিজের প্রেম নিবেদন করবেন। কেন না,দুদিন পরেই তিনি শহরে ফিরে যাচ্ছেন।রিমিলও রাজি হয়ে যায় অভিসারের প্রস্তাবে।
আকাশে গোল পূর্ণচন্দ্র। বিস্ময়ভরা চোখে বিক্রম দেখছিলেন চাঁদের আলোয় রিমিলের শরীরের অপার্থিব পরিবর্তন। দেহ আয়তনে বাড়ছে ও বেঁকে যাচ্ছে,শরীর ক্রমশ রোমশ হচ্ছে,কান লম্বা ও সূঁচালো হচ্ছে,লম্বাটে হয়ে যাওয়া মুখের চোয়াল থেকে বেরিয়ে আসছে ধারালো শ্বদন্ত,চোখে ভালোবাসার বদলে ফুটে উঠছে এক অপার্থিব হিংস্রতা। অবশেষে বিক্রম দেখতে পেলেন এতোদিন তিনি যাকে খুঁজছিলেন,সেই অপার্থিব নারকীয় বিশাল হুড়াল। পরের দিন সকালে বিক্রমের ক্ষতবিক্ষত দেহ জঙ্গলে খুঁজে পেল গ্রামবাসীরা।হুড়াল আবার শিকার করেছে।