Dola Bhattacharyya

Abstract

4  

Dola Bhattacharyya

Abstract

হারিয়ে খুঁজি

হারিয়ে খুঁজি

5 mins
49



জীবনে বেশ কয়েকবার এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে আমার সাথে, যার ব্যাখ্যা আজও পাইনি। একটা ঘটনার কথা শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে ।বিশ্বাস করা, বা না করা তোমাদের ওপর নির্ভর করছে। আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে, সিকিম গিয়েছিলাম। বেড়ানো আমাদের নেশা। প্রতি বছরই কোনো না কোনো দিকে বেরিয়ে পড়ি তল্পিতল্পা গুটিয়ে ।আমাদের ছোট্ট মেয়েটাও পথের কষ্টকে পাত্তা না দিয়ে মেতে ওঠে ভ্রমণের আনন্দে। 

দূর্গা পূজার পর একাদশীর দিন যাত্রা। গন্তব্য সিকিম। পরদিন সকালে পৌঁছে গেলাম নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে জোড়থাং। জোড়থাং এ একরাত্রি কাটিয়ে পরদিন দুপুরে রিনচেঙপংএর দিকে রওনা দিলাম । ওখানে আমাদের ঘর বুক করাই ছিল ।বিকেল পাঁচটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম। রুমটা মন্দ নয়। ঘরে ঢোকার পর থেকেই বিছানা টা টানছিল। সেই ডাক উপেক্ষা করে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। কনকনে ঠান্ডায় হাড় পর্যন্ত কেঁপে উঠল। গায়ে শালটা জড়িয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলাম। আমার সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে তুষারমুকুট পরা কাঞ্চনজঙ্ঘা। অবাক বিস্ময়ে সেদিকেই তাকিয়েছিলাম । মনে হচ্ছিল, যেন কত কাছে রয়েছে সে। হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যাবে তাকে। রাতের বেলায় চন্দ্রালোকে তার অন্য আর এক রূপ দেখলাম। লক্ষ্মী পুজোর আগের রাত। জ্যোৎস্নার জলে স্নান করে অপরূপ সাজে সেজেছে সে। প্রাণ ভরে পান করলাম সে রূপের সুধা। পরদিন রিনচেঙপং ছেড়ে চললাম উৎরের দিকে। নিউ জলপাইগুড়ি থেকেই গাড়ি রয়েছে সঙ্গে। তবুও পথের কষ্ট এড়ানো মুশকিল। বাচ্চা মেয়েটা বমি করছে। জন্ম থেকেই পাহাড়ে ঘুরছে। তবু বমি আটকানো যায় না। সমতলে অবশ্য এই সমস্যা নেই। তবু পাহাড়ের টান এড়ানো কঠিন। ওই টুকু মেয়েটাও জানে সেটা। 

উৎরেতে একটা রিসর্টে আমাদের জন্য ঘর বুক করা ছিল। সাড়ে তিনটে নাগাদ পৌঁছে, রিসর্টের আশপাশটা ঘুরে দেখছিলাম। বিশাল জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে এই রিসর্ট। পাহাড় ঘেরা ছোট একটা গ্রাম। সৌন্দর্য অপার। সময় কাটছে দ্রুত। গাছপালার ফাঁক দিয়ে অস্তগামী সূর্যের রশ্মি এসে লুটিয়ে পড়েছে পায়ের কাছে। একসময়ে সূর্য টা টুপ করে ডুবে গেল পাহাড় গুলোর পেছনে। ঘন হয়ে এল ছায়ার মিছিল। পুবদিকে দেখি মস্ত বড় থালার মতো উঁকি দিচ্ছে কোজাগরীর চাঁদ। মায়াময় পরিবেশ। কনকনে ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে ঘরের দিকে হাঁটা লাগালাম। 

সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতেই ছবি টা আমার নজরে পড়ল। লম্বা করিডোরের মাঝামাঝি টাঙানো রয়েছে দেওয়ালে। এক নেপালী বৃদ্ধের ছবি। কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টি লোকটার চোখ দুটো তে। দেখেই কেমন যেন গা টা শিরশিরিয়ে উঠছিল। 

পোর্টার ছেলেটা ওর নিজস্ব ভাষায় যা বলছিল, তা'তে বুঝলাম, এই রিসর্টের মালিকের বাবা জং বাহাদুরের ছবি এটা । লোকটা নাকি অনেকদিন ধরেই নিখোঁজ। অনেক দূরের পাহাড়ে কি যেন খুঁজতে গিয়েছিল কয়েকজন মিলে। তারপর আর ফেরেনি। তাও নাকি বছর চল্লিশ হয়ে গেছে।

জিজ্ঞেস করলাম, "কোন পাহাড়ে? কি খুঁজতে গিয়েছিল?"

পোর্টার বলল, "শাংগ্রি লা"।

চমকে উঠলাম, শাংগ্রি লা! "

" হ্যাঁ ।নাম শুনেছো? "

ঘাড় নাড়লাম,শুনেছি । শাংগ্রি লা। মনে পড়ে যাচ্ছে জেমস হিলটনের লস্ট হরাইজন উপন্যাসের কথা। কয়েকজন মানুষ প্লেন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তিব্বতের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলের একটা উপত্যকায় এসে পড়ে। সেখানে তারা খুঁজে পায় অমূল্য সম্পদের ভান্ডার। বিশাল একটা লাইব্রেরিতে সঞ্চিত রয়েছে পৃথিবীর সমস্ত যুগের সমস্ত বিষয়ের অগাধ জ্ঞানের ভান্ডার। ওখানে যারা থাকে,তাদের জরা নেই, মরণ নেই। কোনও দুঃখ, শোক, হিংসা, বিদ্বেষ কিছু নেই তাদের। কেবলই সুখ আর সুখ। পৃথিবীর মানুষের চোখে অদৃশ্য এই উপত্যকা, বড় রহস্যময় । কেউ পৌঁছতে পারে না এখানে। লেখকের বর্ননায় এই উপত্যকা পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু আর সুন্দর স্থান মাউন্ট কারাকাল এর কোলে অবস্থিত। সুউন্নত পর্বত দ্বারা বেষ্টিত এই স্থান পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। পোর্টারের কন্ঠস্বরে হুঁশ ফিরল আমার। শুনতে পেলাম, সে বলছে, "দলবল নিয়ে ছাঙ্গুলেক হয়ে নাথুলা পাস পার হয়ে তিব্বতের দিকে চলে গিয়েছিল ওরা। আর ফিরে আসেনি।

কোথায়, কোন পাহাড়ের খাঁজের মধ্যে হিম ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে আছে সে, কে জানে!" 

ছেলেটা বলছিল , ,ছবিটা নাকি খুব রহস্যময়। 

জিজ্ঞেস করলাম, "কিসের রহস্য" ? 

চারদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বললো ছেলেটা, "চাঁদনী রাতে ছবিটা মাঝে মাঝে জ্যান্ত হয়ে ওঠে। সবাই যদিও সেই দৃশ্য দেখতে পায় না। কিন্তু যে দেখতে পায়, তার জীবন থেকে অমূল্য কিছু জিনিস হারিয়ে যায়।" ওর কথাটা হেসে উড়িয়ে দিলাম। "হাসবেন না ম্যাডাম। সব কিছু হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।" 

তবে ছবিটার মধ্যে আমি কোনো রহস্যের চিহ্ন পাইনি। শুধু মনে হয়েছিল, চোখদুটো যেন ভীষণ জীবন্ত।


ঘরের ভেতর ফায়ার প্লেসের মৃদু আগুন, মিষ্টি ওম ছড়িয়ে দিচ্ছে। বাইরে চাঁদের আলোর বান ডেকেছে। তার সাথে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা। 

আমায় যেন চাঁদে পেয়েছে আজ। এই অপূর্ব জ্যোৎস্না ধীরে ধীরে যেন আচ্ছন্ন করে ফেলেছে আমায় । বিছানার পাশেই কাঁচের জানালা। পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঝিমঝিম করে ঘুম নেমে এল দুচোখের পাতায়। একসময়ে ঢলে পড়লাম বিছানায় ।

মাঝরাতের দিকে ঘুমটা ভেঙে গেল। বেশ ঠান্ডা লাগছে। পর্দা সরিয়ে বন্ধ কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। দূরে দেখা যাচ্ছে পাইন বনের সারি। মাথা তুলে রয়েছে পাহাড়ের পর পাহাড় । সুউচ্চ চূড়ায় তাদের বরফের মুকুট, চন্দ্রকিরণে ঝকঝক করে উঠছে। উত্তাল হয়ে উঠেছে পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীটার জল। কি নাম এই নদীর! জানা হয়নি তো! হঠাৎ কি যেন দেখে চমকে উঠলাম। একী! কারা ওরা! পাহাড়ের পাকদন্ডীপথ পথ বেয়ে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে! অবয়বে মনে হচ্ছে ওদের একজন নারী, পাশের জন তার পুরুষ সঙ্গী। একে অপরের হাত ধরে একমনে পাহাড়ী পাকদন্ডি পথ বেয়ে চলেছে! গায়ে শাল টা ভালো করে জড়িয়ে বিছানা থেকে নামলাম।বাইনোকুলার টা নিয়ে দরজা খুলে বাইরে পা রাখতেই টের পেলাম ঠান্ডার দাপট । কনকনে ঠান্ডা বাতাসে কেঁপে উঠলাম ।উঃ! কি ভীষণ ঠান্ডা! সামনের করিডোরে জনপ্রাণী নেই। আছে শুধু সেই ছবিটা, নেপালি জং বাহাদুরের ছবি।


    

   বাইনোকুলার টা চোখে লাগানোর আগে চোখ পড়ল ছবিটার দিকে। কেউ যেন জোর করে ওদিকে তাকাতে বাধ্য করল আমায়। একী!ছবির চোখদুটো এই মুহূর্তে কী ভীষণ বাঙ্ময় ! যেন এখনি কথা বলে উঠবে। স্পষ্ট দেখলাম, ছবির দুচোখে নিষেধ। নাঃ। ওর নিষেধ আমি মানব না। মানতে আমি বাধ্য নই। কে ও! এক মৃত মানুষ বৈ তো নয়। মনটাকে শক্ত করে চোখ রাখলাম বাইনোকুলারে। এ কী! এ কী দেখছি আমি! ওই যে নারী মূর্তি, মধ্যরজনীর হিমেল হাওয়ায় যার দুধসাদা বসনাঞ্চল উড়ছে, ও তো আমি। ওই মূর্তি যে আমারই যৌবনের প্রতিরূপ। আর পাশের ওই পুরুষ মূর্তি! ও যে আমার ভীষণ চেনা এক মানুষ! ও যে আমার ভালোবাসা! চোখ থেকে বাইনোকুলার নামলাম। এ কী দেখলাম আমি! এও কি সম্ভব! বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে আবার ভালো করে দেখলাম। ওই তো। ভালোবাসার মানুষটার হাত ধরে এগিয়ে চলেছি আমি। বাতাসে উড়ছে আমার দুধসাদা আঁচল। আজকের আমির সাথে ওই আমিটার যে অনেক তফাৎ। ঘরের বিছানায় গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন ওই মানুষটাকে এই মুহুর্তে চিনতে পারছি না ! কে ও ! কোথায় আমার সেই ভালোবাসার মানুষ! কোথায় গেল সে ! কোথায় এখন খুঁজবো তাকে আমি! পাগলের মতো ছুটে ঘরে চলে এলাম। হাহাক্কারে ভেঙে পড়লাম নিজের শয্যায় । সুদূর অতীতের অন্ধকারে সহসা প্রবেশ করেছে বর্তমানের আলো। আর সেই আলোয় খুঁজে পেয়েছি নিজেকে, খুঁজে পেয়েছি আমার গত জন্মের ভালোবাসা। বর্তমানে তার কি কোনো অস্তিত্ব আছে! কোথায় পাবো তাকে আমি! হারিয়ে ফেলেছি আমার বর্তমানেরও কিছুটা সময়। 


  বুক ভরা হতাশা নিয়ে ফিরলাম সিকিম থেকে। কোনো এক অধরা মাধুরীর মতো হারিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে, অমূল্য কিছু সময়। আর কি কোনোদিন খুঁজে পাব তাকে!




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract