সৌরদীপ সৌমিত্র চৌধুরী "চন্দ্রচূড়"

Horror Thriller Action

4.4  

সৌরদীপ সৌমিত্র চৌধুরী "চন্দ্রচূড়"

Horror Thriller Action

গুঙ্গারিয়ার বিভীষিকা

গুঙ্গারিয়ার বিভীষিকা

9 mins
685


- "ফুলদাদু....ও ফুলদাদু!" সমস্বরে চিৎকার করে উঠল কচিকাঁচার দল, "একটা গল্প বলো না।"
- "হ্যাঁ রে," অরুণ বাবু নিশ্চিন্ত মনে একটা পান মুখে চালান করতে-করতে বললেন, "শীতের রাত, তার উপরে বাইরে আবার ঝুপঝুপ বৃষ্টি। গল্পের আসর বসালে মন্দ হয়না। তো কেমন গল্প শুনবি তোরা?"
- "ভূতের গল্প!!" লাফিয়ে উঠল তাতান।

বনবিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধিকারী অরুণ চক্রবর্তী। প্রায় উনিশ বছর আগে চাকরি থেকে নিবৃত্ত হয়েছেন। শীতের ছুটিতে তাঁর দুই ছেলে আর দুই মেয়ে এখন বাড়িতে এসেছে। এবং তাদের সাথে প্রায় হাফডজন দস্যি ডাকাতের দলও হানা দিয়েছে এই চক্রবর্তী ভিলায়। এইমুহূর্তে অরুণ বাবু তাদেরই সমবেত আক্রমণে জর্জরিত।

ডিসেম্বরের নরম ঠাণ্ডা রাত, তার সাথে আজ আবার সকাল থেকেই একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। ঠাণ্ডাটা যেন চতুর্গুণ বেড়ে গেছে। সকাল থেকে লাইট'টাও নেই। আলোয়ানটা ভালভাবে জড়িয়ে নিয়ে অরুণ বাবু বললেন-
- "একেই রাতের বেলা এমন লোডশেডিং....তার মধ্যে আবার ভূতের গল্প? বলছি ভয়-টয় পাবিনা তো?"
- "না ফুলদাদু, আমরা কাউকে ভয় পাইনা।" সাহসে টগবগ করে উঠল পাঁচ বছরের জোজো, "তুমি আজ একটা সত্যি ভূতের গল্প বলো।"
- "ভয় পাবিনা বলছিস জোজোবুড়ি?" ফুলদাদু ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন, "আচ্ছা বেশ, শোন তবে।"

একটু গলাখাঁকারি দিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন অরুণ বাবু:-

"সালটা ছিল ১৯৬৪। তখন আমি সবেমাত্র ফরেস্ট অফিসারের চাকরি নিয়ে জয়েন করেছি। পঁচিশ বছরের তরতাজা যুবক আমি, ভয়ডর কাকে বলে জানিনা। তোরা তো জানিস, বনবিভাগের চাকরির সুবাদে আমি অনেক গ্রামে-গঞ্জে, অনেক বনেবাদাড়ে ঘুরে বেরিয়েছি। তো সেইবার পোস্টিং পেলাম সুদূর বিহারের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। নাম গুঙ্গারিয়া। চাকরিটা ভাল, আমিও ওই বয়সে আবার একটু অ্যাডভেঞ্চার করতে আর চ্যালেঞ্জ-ট্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসতাম। তাই দূরত্ব কে তোয়াক্কা না করে চাকরিটা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

কলকাতা থেকে ট্রেনে পাটনা অবধি এসে বাকিটা রাস্তা বাসে যেতে হয়। পাটনার থেকে গুঙ্গারিয়া প্রায় দেড়শো কিলোমিটার মতো। তখনকার দিনে বাসে ছয়-সাত ঘণ্টা মতো সময় লাগত। বিকেল চারটের বাসটা ধরলাম। ভাবলাম দিব্যি এগারোটার মধ্যে গুঙ্গারিয়া পৌঁছে যাব। কিন্তু বিধিবাম! পথে বাসের টায়ার ফাটল। সেই টায়ার চেঞ্জ করে বাস রওনা করতে অনেক সময় লেগে গেল। শেষমেশ যখন আমাদের বাস গুঙ্গারিয়ার নিঝুম ডিপোতে এসে পৌঁছল, তখন আমার হাতঘড়ির কাঁটা প্রায় একের ঘর ছুঁইছুঁই।

ছোট্ট বাস স্টেশনটা আলকাতরা মাখানো অন্ধকারে ডুবে আছে। সেদিন সম্ভবতঃ অমাবস্যা ছিল....আকাশে একফালি চাঁদের দেখাও মিলল না। আকাশের মেঘাচ্ছন্ন মূর্তি দেখে বুঝলাম, যখন-তখন হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামতে পারে। ভেবেছিলাম একে-ওকে জিজ্ঞাসা করে ফরেস্ট অফিসের ডাকবাংলোটা খুঁজে বের করতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না। কিন্তু এখন এই জনমানবহীন বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আমি মনে-মনে প্রমাদ গুনলাম।

এখানে আমার সাথে আরও দুজন লোক নামল। কিন্তু বাস থেকে নেমেই তারা দুজনে হনহন করে হেঁটে কোনদিকে যে অদৃশ্য হয়ে গেল, ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না। মনে হয় স্থানীয় লোক, কাছেই বাড়িঘর হবে হয়তো। তাই সময় নষ্ট না করে যে যার রাস্তায় দৌড় দিয়েছে!

বাসটাও যেন আমার অসহায়তার প্রতি উপহাস জানিয়ে একরাশ কালো ধোঁয়া উড়িয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল। আমি বোকার মতো একা দাঁড়িয়ে রইলাম ওই জনশূন্য প্রান্তরে। অন্ধকারে চোখদুটো সয়ে যেতেই চারিদিক ভালভাবে নিরীক্ষণ করে দেখলাম। নাহ্....একটা চায়ের দোকান পর্যন্ত খোলা নেই। কয়েকটা গুমটি জাতীয় চোখে পড়ল বটে, কিন্তু প্রতিটার ঝাঁপই বন্ধ। ধুত্তোর! গুঙ্গারিয়া একটা গ্রামাঞ্চল সেটা জানতাম। তবে এমনধারা অজ পাড়াগাঁ জানলে কখনওই চাকরিটা নিতাম না। এখন কোনওমতে বাংলোয় পৌঁছতে পারলে বাঁচি!

একদিকে লাইন দিয়ে কয়েকটা পাথরের বেঞ্চ পাতা ছিল। বেশ বুঝতে পারছিলাম যে আজ এখানেই নিশিযাপন করতে হবে। তাই বেশি সাত-পাঁচ না ভেবে, একটা সিগারেট ধরিয়ে বেশ গুছিয়ে একখান বেঞ্চ দখল করে বসলাম। আয়েশ করে সবেমাত্র প্রথম সুখটান'টা দিতে যাব, হঠাৎ কোত্থেকে একটুকরো আলো ঠিকরে চোখে এসে লাগল। সঙ্গে-সঙ্গে নড়েচড়ে বসলাম।

দূর থেকে বাসের জোরালো আলো দেখা যাচ্ছে। হ্যাঁ, একটা বাস এদিকেই আসছে। বাহ্...! এইবার এই বাসের কোনও এক যাত্রীর কাছ থেকে বনবিভাগের ডাকবাংলোর ঠিকানাটা জেনে নেওয়া যাবে। উত্তেজিত পায়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলাম। কিন্তু বাসটা আরেকটু কাছে আসতেই দুটো অদ্ভুত জিনিস আমার চোখে ধরা পড়ল। প্রথম, বাসটা দেখতে কেমন হালকা কুয়াশার মতো লাগছে....ঠিক যেন পারদর্শী সাদা ধোঁয়া দিয়ে তৈরি এক আবছা অবয়ব। দ্বিতীয়, বাসের চাকাগুলো মাটি স্পর্শ করছে না। বাসটা যেন মাটির দুই-তিন ইঞ্চি উপর দিয়ে ভেসে-ভেসে এগিয়ে চলেছে। বুকটা ধড়াস করে উঠল। কিন্তু ওই সময় আমার মাথায় অন্য চিন্তা, তাই বেশি আকাশকুসুম চিন্তা না করে সেদিকে অগ্রসর হলাম। বাসটা ডিপোয় এসে থামতেই চারজন যাত্রী নিচে নামলেন। তাঁদের মুখোমুখি দাঁড়াতেই আমার সর্বাঙ্গে আতঙ্কের বিদ্যুৎ খেলে গেল।

সবকটা লোকের মুখই এক আদলের। মুণ্ডিতমস্তক, গায়ের রং ফ্যাকফেকে সাদা। ঠিক যেন কোনও রক্তচোষা বাদুড় তাঁদের দেহ থেকে রক্তের শেষ বিন্দুটুকু শুষে নিয়েছে। সবার গলায় অদ্ভুত ধরণের কণ্ঠী জাতীয় কিছু একটা নজরে পড়ল। ওঁদের চোখে অস্বস্তিকর এক নির্লিপ্ত চাহনি; মণিদুটো মরা ছাগলের মতো ঘোলাটে। প্রতিটি যাত্রীর দীর্ঘ শরীর রক্তলাল বর্ণের এক লম্বা জোব্বায় আবৃত। চকিতে লক্ষ্য করলাম, বাসের ভিতরকার সবকটা যাত্রীর ওই একই মূর্তি....মাথা ন্যাড়া, ওই ফ্যাকাসে সাদা মুখ, ওই ভাবলেশহীন ঘোলাটে দৃষ্টি। এমনকি তাঁদের পোশাকগুলো পর্যন্ত একই ধরণের। অন্ধকারে লাইটার জ্বালিয়ে মুখগুলো ভাল করে দেখার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু হঠাৎ তাঁদের মধ্যে একজন হিংস্র ভাবে তেড়ে এসে আমার হাত থেকে লাইটারটা ছুঁড়ে ফেলে দিল।

ঘটনার আকস্মিকতায় ক্ষণিকের জন্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিলাম। অতিকষ্টে নিজেকে সামলে ওই যাত্রীদের মধ্যে একজন কে জিজ্ঞাসা করলাম-
- "আপনি কি জানেন, বন বিভাগের ডাকবাংলোটা ঠিক কোনদিকে? আমি এখানকার নতুন অফিসার, আজই এসেছি। রাস্তাঘাট কিছুই চিনিনা। পথটা একটু দেখিয়ে দিলে উপকৃত হব।"

আমার কথা শেষ হওয়া মাত্রই ওই চারজন মূর্তি একই সঙ্গে কোনও এক দিকে তাঁদের কঙ্কালসার শীর্ণ অঙ্গুলি তুলে ইশারা করলেন। কিন্তু ঠিক কোন দিশায় যে তাঁরা ইঙ্গিত দেখালেন, রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না।

ওই চারজন কে নামিয়ে দিয়ে বাসটা আবার রওনা দিয়েছে। তবে কিছুটা এগিয়ে একটা বাঁক ঘুরতেই হঠাৎ আকাশ থেকে আলোর এক শিখা নেমে এল বাসটার উপর। আলোর বিচ্ছুরণে আমার চোখদুটো ধাঁধিয়ে গেল। 'দড়াম' করে প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণ....সেই শব্দে আমার কানে যেন তালা লেগে গেল। মাটিটা সামান্য দুলে উঠল সেই ধ্বনির অমানুষিক কম্পনে। আমি ছিটকে পড়লাম হাত পাঁচেক দূরে।

কোনওমতে টলমলে পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেখি, আমার চোখের সামনে বাসটা দাউদাউ করে জ্বলছে। আগুনের লেলিহান শিখার তাপে আকাশটা লাল হয়ে উঠেছে। টায়ার আর চামড়া পোড়ার মিশ্রিত উৎকট গন্ধে ভরে উঠেছে বাতাসটা। আমার শ্বাসকষ্ট হতে লাগল। তাড়াতাড়ি নাকে রুমাল চাপা দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালাম। দগ্ধ বাসের অবস্থা দেখে বুঝলাম যে তার মধ্যেকার একটাও যাত্রী এখন আর জীবিত নেই। বিস্ফোরণের ধাক্কায় ছিটকে পড়ার দরুণ আমার হাতে-পায়ে অসংখ্য কাটাছেঁড়া হয়ে গেছে। কনুই বেয়ে দরদর করে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখছি, আমার চোখের সামনে আস্ত বাসটা একটু-একটু করে পুড়ে ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে।

কতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় ওইভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম মনে নেই। কানে হঠাৎ হরিধ্বনি ভেসে আসতেই আমার চমক ভাঙল। যেখানে বাসটা দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়েছিল, আওয়াজটা সেদিক থেকেই আসছে। ক্রমশঃ আওয়াজটা স্পষ্টতর হয়ে উঠল। দেখলাম চারজন লোক একটা মড়ার খাট বয়ে আনছে। তার সাথে একনাগাড়ে যান্ত্রিক সুরে দিয়ে চলেছে হরিধ্বনি। শববাহী'রা এই পথে যাচ্ছে কেন? তার মানে কাছেই কি কোনও শ্মশান আছে?

সেই চারজন শবদেহটা নিয়ে রাতের অন্ধকারে দ্রুত মিলিয়ে গেল। কিন্তু একি! আবার হরিধ্বনি উঠছে কেন? আরেকটা মড়া আসছে নাকি এইদিকে? ঠিক তাই। আরও চারজন লোক মড়ার খাট বয়ে এদিকেই আসছে। তবে এখানেই শেষ নয়। ওরা চলে যেতেই আরেক দল মড়া নিয়ে এল। তারপর আরেক দল....তারপর আরও এক দল। কী কাণ্ড! শবযাত্রীদের মিছিল বেরিয়েছে বুঝি?

শবদেহের মুখটা ভাল করে লক্ষ্য করার চেষ্টা করলাম। পুড়ন্ত বাসের নিভু-নিভু আলোয় মড়ার যে মুখ দেখলাম, তাতে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে এক ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। আরে! এ যে সেই দুর্ঘটনাগ্রস্ত বাসের নিহত সব যাত্রীদের শবদেহ। কিন্তু তাঁদের মুখগুলো এখন আর আগের মতো ফ্যাকাসে সাদা নেই। প্রচণ্ড উত্তাপে পুড়ে একেবারে কালো হয়ে গেছে। মুখের চামড়া কুঁচকে এক বীভৎস আকৃতি ধারণ করেছে। দেহ থেকে উঠে আসছে গা-গুলানো এক বিশ্রী চামড়াপোড়া গন্ধ।

হঠাৎ একজন শববাহক আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। মুখটা অন্ধকার; যেন মুখজুড়ে একপোঁচ কালি মাখানো রয়েছে। চোখ-নাক-মুখ সবেরই অস্তিত্ব আছে, কিন্তু আলাদা করে কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা। লোকটা নীরবে হাতছানি দিয়ে আমাকে ডাকল। আমিও বশীভূতের মতো তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম।

অনেকক্ষণ ধরে ওদের পিছনে হেঁটে চললাম। জলা, দিঘি, মাঠ, বন....সব একে-একে পার হয়ে গেল, কিন্তু হাঁটা যেন আর ফুরায় না। হাঁটতে-হাঁটতে বোধহয় একটু পিছিয়ে পড়েছিলাম। চকিতে তাকাতেই দেখি আমার সামনে ওই শববাহী দলটা আর নেই। আমি একাই একটা ধূ-ধূ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছি। চারিদিকে শুধু আধপোড়া কাঠ, ছাইয়ের স্তূপ আর ভাঙা কলসি। যত্রতত্র কিছু মড়ার খুলি পড়ে আছে মাটিতে। আশেপাশে শ্যাওড়া গাছের ঘন বন। এ আমি কোথায় এসে পড়লাম? এ কি....এ কি তবে শ্মশান?

হঠাৎ এক নারকীয় হাসিতে আকাশ-বাতাস ভরে উঠল। আমার ঠিক সামনে একটা আধপোড়া চিতায় দপ্ করে জ্বলে উঠল আগুন। সেই আগুনের লকলকে শিখার থেকে জন্ম নিয়ে দলে দলে বেরিয়ে আসতে লাগল এক-একটা আস্ত নরকঙ্কাল। খটখটে সাদা হাড়গুলো আঁধারে ঝকঝক করছে। ওরা হাসছে....খলখল করে হাসছে। কী বিশ্রী সেই ধ্বনি! যেন নরকের কোনও গভীর গুহামুখ থেকে বেরিয়ে আসছে আদিম যুগের সেই নৃশংস অট্টহাসি।

আমাকে ঘিরে এক পৈশাচিক নৃত্যে মেতে উঠেছে ওরা। কী তীব্র তাদের জিঘাংসা, কী প্রচণ্ড তাদের রক্তপিপাসা! একটু-একটু করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে ওরা। আমার পা'দুটো যেন মাটিতে আটকে গেছে; এক চুলও নড়তে পারলাম না। হে ভগবান! এ আমি কোন ভৌতিক চক্রান্তে জড়িয়ে পড়েছি?

একখানা অস্থিময় হাত এগিয়ে এসে সজোরে ধাক্কা মারল আমার কাঁধে। কাটা গাছের মতো হুমড়ি খেয়ে মাটিতে আছড়ে পড়লাম। একটা নরকঙ্কাল এসে এবার আমার গলার উপর নিজের পা'টা রাখল। ভয়ানক চাপে আমার দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম। গায়ের সমস্ত জোর খাটিয়েও ওই লিকলিকে পা সরাতে পারলাম না। চোখের সামনে অন্ধকার দেখছি....জ্ঞান হারাবার আগের মুহূর্তেও আমার কানে ভেসে আসছিল অতৃপ্ত আত্মাদের সেই রক্ত জল করা তীক্ষ্ণ অট্টহাসি।

চোখেমুখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা খেয়ে আমার সম্বিত ফিরল। দিনের আলো জানালা দিয়ে আমার গায়ে এসে পড়ছে। একটা খাটে শুয়ে আছি আমি। আমাকে ঘিরে বেশকিছু লোকের ভীড়....সবাই উৎসুক চোখে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। ওই ভীড়ের মধ্যে থেকে একজন মাঝবয়সী রাশভারী গোছের লোক বেরিয়ে এলেন। আমাকে নমস্কার করে ভাঙাচোরা বাংলায় বললেন-
- "ম্যায় বিনায়ক মাহাতো, গুঙ্গারিয়া কা গ্রাম-প্রধান। কোই ডর নেহি। আপনি এখন আমার বাড়িতেই আছেন।"
- "কাল রাতে কী হয়েছিল?" আমি ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, "আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না।"
- "উহাঁ কেয়া হুয়া থা ও তো আপনি বলবেন! আজ ভোরে আপনাকে কুছু লোক শ্মশান কে পাস্ কাদার মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেখে। খবর পেয়ে আমিও আসি। উসকে বাদ আপকে পকেট সে আপকা আইডেনটিটি কার্ড মিলা। উহাঁ থেকেই জানা গেল যে আপনি এখানকার বনবিভাগের বড়বাবু বটে। তা বাবু, উতনা রাত কো শ্মশান মে কৌন-সা বাহাদুরি দেখাতে গেছিলেন?"

একটু ধাতস্থ হয়ে আমি ভদ্রলোক কে সংক্ষেপে সব ঘটনাগুলো খুলে বললাম....শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। পুরোটা শুনে তো ওখানে উপস্থিত সকলের মাথায় হাত। একজন বৃদ্ধ বলে উঠলেন-
- "কেয়া বোলতে হো সাহেব? আপনে উন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী লোগ কো দেখা থা? রাম রাম রাম! আজ তো আঠাইস্ আগস্ট বটে। অ্যায়সে মানহুস্ তারিখ কো আপনি রাত কে দেড় বজে ওই ভুতিয়া বাস স্ট্যান্ডে এসেছিলেন কোন আক্কেলে? এক-দো দিন বাদ এলে কী নুকসান হয়ে যেত শুনি?"
- "কেন?" আমি খানিকটা অবাক হলাম, "আঠাশে আগস্ট আবার কী দোষ করল?"
বৃদ্ধ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, বিনায়ক মাহাতো তাঁকে মাঝপথেই থামিয়ে দিলেন।
- "ইসকে পিছে একটা কাহানী আছে। আপনি কলকত্তা কা পড়ালিখা আদমী বটে....আপনার কাছে ইয়ে সব বাত হাম গাঁইয়া লোগ কা ফালতু অন্ধ্ বিশোয়াস বলে মনে হতেই পারে। লেকিন গুঙ্গারিয়া কা বাচ্চা-বাচ্চা জানতা হ্যায়, ইস ঘটনা মে কিতনা সাচ্চাই হ্যায়।"
- "আমি আপনার কাহিনী শুনতে চাই। আপনি নির্দ্বিধায় সবটা খুলে বলুন প্রধানমশাই।"

তারপর বিনায়ক মাহাতো যা শোনালেন, তার সারমর্ম হল এই:-

বছর পাঁচেক আগেকার কথা। লুম্বিনী থেকে একদল বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বাসে করে বোধগয়া যাচ্ছিলেন। গুঙ্গারিয়া বাস স্ট্যান্ডের কাছেই ওঁদের বাসটা দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়। বাজ পড়ে বাসটা পুড়ে একদম ছারখার হয়ে গেছিল। একজন লামাকেও প্রাণে বাঁচানো যায়নি। গ্রামবাসীদের মধ্যে কেউ বৌদ্ধ পদ্ধতিতে শেষকৃত্য করতে জানত না, তাই স্থানীয়রা মিলে কাছের শ্মশানে তাঁদের শেষকৃত্য সমাধা করে আসে। দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল আঠাশে আগস্ট, রাত দেড়টার সময়। তারপর থেকে প্রতি বছর এই তারিখে রাত দেড়টার সময় গুঙ্গারিয়া বাস ডিপোয় সেই অ্যাক্সিডেন্টের দৃশ্যগুলির পুনরাবৃত্তি ঘটে। আমি বাদেও অনেক পথচারী নাকি ওই অলৌকিক কাণ্ডের সাক্ষী হয়েছে। বছরের এই একটা দিন ওঁরা আজও আসে, নেমে আসে এই পৃথিবির বুকে। যেই ভয়ঙ্কর শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করে ওঁরা মরেছিল, সেই ঘটনাগুলিই যেন অতীত আর বর্তমানের যোগাযোগ-পথ দিয়ে নেমে এসে উপনীত হয় আমাদের মতো সাধারণ মানুষের চোখের সামনে; বছরের এই একটা মাহেন্দ্রক্ষণে....আঠাশে আগস্ট, রাত দেড়টা। প্রধানমশাই আরও বললেন, বজরংবলীর অশেষ কৃপা যে আমার বড়সড় কোনও ক্ষতি হয়নি। কারণ এই দৃশ্য দেখার পর কেউ নাকি কয়েক ঘণ্টার বেশি বাঁচেনি। কিছু সময়ের মধ্যেই মুখে রক্ত উঠে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে। এই জন্যেই তো কাল রাতে বাস-স্ট্যান্ডের আশেপাশে সব দোকানপাট তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে গেছিল। গ্রামের কেউ ওইদিন বাস ডিপোর কাছাকাছিও ঘেঁষে না।"

একটানা বলার পর অরুণ বাবু একটু থামলেন। বুবাই অধীর আগ্রহে খোঁচা দিল-
- "থামলে কেন ফুলদাদু? তারপর কী হল?"

অরুণবাবু আরেকটা পান মুখে পুরে আবার বলা শুরু করলেন-
- "তারপর সুস্থ হয়ে আমি ফরেস্ট অফিসে বদলির আর্জি জানিয়ে চিঠি লিখলাম। মনে-মনে ঠিক করেছিলাম, ট্রান্সফার না পেলে কাজের থেকে ইস্তফা দিয়ে দেব। তবে কিছুতেই ওই ভুতুড়ে জায়গায় আর থাকব না। মনে হয় বনবিভাগ ওই জায়গার দুর্নাম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল, তাই বিনা কোনও অজুহাতেই আমার আর্জি মেনে নিয়ে আমাকে ছাপরায় পোস্টিং দিয়ে দেওয়া হল। তারপর ছাপরায় দীর্ঘ পাঁচ বছর ছিলাম। ওখানেও অনেক কাণ্ড ঘটিয়েছি....সেসব নাহয় পরে একদিন বলব তোদের।"

গল্প শেষ করে ফুলদাদু আড়চোখে চেয়ে দেখলেন, সবকটা 'ভয়-না-পাওয়া' বীর দস্যিগুলো আতঙ্কে গুটিসুটি মেরে তাঁর কাছে সরে বসেছে।

**** সমাপ্ত ****


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror