ঘটনার ঘনঘটা
নন্দা মুখাৰ্জী রায় চৌধুরী
রাত তখন প্রায় তিনটে হবে | সুষমা দশ বছরের ছেলেটিকে নিয়ে বেশ বিপদেই পড়েছে | সন্ধ্যা থেকেই তার একটু একটু পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে | সুষমা ভেবেছিলো হয়তো গ্যাসের ব্যথা | এতো ফাষ্টফুড খায় বাবিন মাঝে মধ্যেই তার এই পেতে ব্যথা লেগেই আছে | বহুবার ছেলেকে নিষেধ করেও কোন ফল হয়নি | তাই মাঝে মধ্যে ব্যথা করলেই তাকে একটা এন্টাসিড দিয়ে দেয় | আজও রাতে মাছের ঝোল ভাত খাইয়ে তাকে একটা এন্টাসিড দিয়ে ঘুম পাড়িয়েছিলো | কিন্তু মাঝ রাত থেকেই তার আবারও ব্যথা বাড়ে | কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা | দুদিন আগেই ওর বাবা অনিমেষ ব্যানার্জি বিশেষ কাজে দিল্লী গেছেন | এতো বড় বাড়িতে মা আর ছেলে ছাড়া আছে সবসময়ের জন্য লতিকামাসি | বিয়ের অনেক আগে থাকতেই লতিকামসি এই বাড়িতে |
অনির বাবা, মা একবার মুর্শিদাবাদে ঘুরতে গিয়েছিলেন | অনির বয়স তখন বারো কি তের বছর | সেদিন ঘুরতে ঘুরতে একটু বেশিই রাত্রি হয়ে গেছিলো | টোটোতে করে যখন অন্ধকার রাস্তার ভিতর থেকে আসছিলেন তখন তারা খেয়াল করেন একটি মেয়েকে কিছু ছেলে উত্ত্যক্ত করছে | টোটোর আলোতে দেখতে পেয়ে তিনি ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলেন | ড্রাইভার প্রথমে রাজি হয়না | অনির বাবাকে বুঝাতে লাগে যেচে ঝামেলার মধ্যে না জড়াতে | কিন্তু নাছোড়বান্দা ডাক্তার সমরেশ ব্যানার্জি ড্রাইভারকে বাধ্য করেন ওদের সম্মুখে গাড়ি দাঁড় করাতে| মেয়েটির হাত ধরে তখন যুবক তিনটি টানাটানি করছে | সমরেশ বাবু এগিয়ে গিয়ে তখন তাদের বাধা দেওয়ায় বচসায় জড়িয়ে পড়েন | হঠাৎ একটি যুবক ছুরি বের করে সমরেশ বাবুকে সরে যেতে বলে না হলে পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেবে বলে শাসায় | এই ঝামেলার মধ্যে সেখানে আরও কিছু মানুষ হাজির হয়ে যায় | বেগতিক দেখে ছেলে তিনটি বাইক চেপে চম্পট দেয় | সমরেশবাবু মেয়েটির কাছে জানতে পারেন তার নাম লতিফা | মায়ের মৃত্যুর পর তার আব্বা আবার বিয়ে করেন | সৎ মা প্রথম থেকেই তাকে কুনজরে দেখতে শুরু করেন | সারাদিন বাড়ির কাজকর্ম করিয়েও দুবেলা পেট ভরে খেতে দেয়না | আজ কিছুদিন ধরে এই ছেলে তিনটিকে সে দেখেছে তার আম্মুর সাথে বাড়িতে প্রায়ই নিচু স্বরে কথা বলতে | আজ সন্ধ্যার কিছু পর তার আম্মু তাকে বলে দোকান থেকে আলু কিনে আনতে| সে যখন আলু কিনে বাড়ির উর্দ্দেশ্যে রওনা দেয় তখনই এই ফাঁকা জায়গায় ছেলেগুলি তার পথ আটকায় | লতিফার মুখে এটুকু শুনেই তিনি বাকিটা বুঝে যান | মেয়েটির কাছে জানতে চান সে এখন কোথায় যাবে কি করবে | ছেলেগুলির কাছ থেকে যে তার আম্মু টাকা খেয়ে এ কাজ তাদের দিয়ে করিয়েছে এবং পরবর্তীতে আবারও এ ঘটনা ঘটবে তা তাকে বুঝিয়ে বলেন | তখন লতিফা হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সমরেশবাবুর কাছেই জানতে চায় সে কি করবে |
সাথে করে নিয়ে আসেন তিনি লতিফাকে| লতিফা হয়ে ওঠে লতিকা | আস্তে আস্তে কবে যে লতিফা এ বাড়ির একজন মেম্বার হয়ে উঠেছে তা বোধকরি সে নিজেও জানেনা | সমরেশবাবু যথাসময়ে বিয়ে দিতেও চেয়েছিলেন তার কিন্তু সে রাজি হয়নি | সে একজন মুসলমান হিন্দুর পরিচয়ে দাদা তাকে রেখেছে | বিয়ে দিতে গেলে কোন ধর্মের মানুষকে সে বিয়ে করবে? হিন্দু পরিবারে বিয়ে হলে তাদের ঠকানো হবে আর মুসলিম পরিবারে বিয়ে হলে তার আশ্রয়দাতা দাদা সমাজের কাছে নিচু হবে এই চিন্তাধারা নিয়ে সে দাদাকে সাফ জানিয়ে দেয় এই বাড়ি ছেড়ে সে আর কোথাও যাবেনা | পুরো সংসারটা এখন লতিকার স্নেহের পরশে মুড়ে আছে | এতগুলো বছরে ভুলে গেছে সে তার পরিবার আর তার ধর্ম |
সুষমা অস্থির হয়ে লতিকার ঘরে গিয়ে তাকে ডেকে তোলে | লতিকা বাবিনের পেটে কিছুটা তেল মালিশ করে আইসব্যাগ এনে পেটের উপর ধরে থাকে | বাবিন তাতে কিছুটা আরাম পেয়ে চোখ বন্ধ করে | সুষমা হঠাৎ রান্নাঘরে কিসের একটা আওয়াজ পায় | লতিকা তাকে বাবিনের পাশে বসিয়ে রেখে নিজেই দেখতে যায় | কিছুক্ষণ পরেও লতিকা ফিরে আসছেনা দেখে সুষমা রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় | কিন্তু হঠাৎ করে তার সামনে হাজির হয় মুখ বাধা অবস্থায় দুজন মানুষ | এসেছিলো চুরি করতে রান্নাঘরের ফ্যানলাইটের রড ভেঙ্গে কিন্তু বাড়ির লোক জেগে আছে দেখে শুরু হল ডাকাতি কার্যকলাপ | একজন পিস্তল ধরে সুষমার কাছে আলমারির চাবি চায় | ভয়ে হাত পা কাঁপতে থাকে তার | বের করে দেয় আলমারির চাবি | অন্যজন তখন আলমারি খুলে সমস্ত গয়নাগাটি টাকাপয়সা একটা বড় ব্যাগে ভরতে থাকে | আর একজন সুষমার দিকে পিস্তল তাক করেই থাকে | হঠাৎ বাবিন পেট যন্ত্রণায় চিৎকার করে কেঁদে উঠে কাটা কইমাছের মত ছটফট করতে থাকে | সুষমা দৌড়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে গেলে তাক করে থাকা লোকটি বলে ওঠে " নড়লেই গুলি করবো " সুষমা হাত জোর করে কেঁদে উঠে বলে," আমার ছেলেটির সন্ধ্যা থেকে পেটে ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে আপনারা সবকিছু নিয়ে নিন কিন্তু আমাকে আমার ছেলের কাছে যেতে দিন|" যে ডাকাতটি আলমারির খুলে টাকাকড়ি বের করছিলো সে হঠাৎ সুষমার মুখের দিকে তাকিয়ে ওই ছেলেটিকে ইশারায় তাকে ছেড়ে দিতে বলে আর রান্নাঘরে গিয়ে মহিলার বাঁধন ও খুলে দিতে বলে | সুষমা ছেলের কাছে বসে কাঁদতে শুরু করে | বাবিন তখন যন্ত্রণায় ছটফট করছে | প্রথম ডাকাতটি আলমারির কাছ থেকে সরে এসে বাবিনের খাটের কাছে দাঁড়িয়ে বলে ," ম্যাডাম, আমাদের সাথে গাড়ি আছে যদি বিশ্বাস করেন আমরা আপনার ছেলেকে হাসপাতাল নিয়ে যেতে পারি ---"| গলার আওয়াজটা সুষমার চেনা মনেহল | কিন্তু এই মুহূর্তে বাবিনের সুস্থ্যতা ছাড়া অন্য কোন চিন্তা তার মাথায় ছিলোনা | সে লতিকামাসীর দিকে তাকালো | তারও সম্মতি আছে বুঝতে পেরে সে তাদের কথায় সায় দেয়| প্রথম ডাকাতটি বাবিনকে কোলে তুলে নিয়ে তার সঙ্গীকে ইশারায় এগোতে বলে | সঙ্গীটি তার গুরুর নির্দেশ মেনে নিলেও ঘটনার মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারলোনা | বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই গাড়ি দাঁড়ানো ছিল | তারা কাছাকাছি একটা নার্সিংহোম এসে পৌছালো | সেই ভোর রাতেই বাবিনের এপেন্ডিক্স অপারেশন হয় | ডাক্তার জানান বিন্দুমাত্র দেরি করলে খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারতো | নার্সিংহোমের ভিতর ঢোকার আগেই দুটি ডাকাতই তাদের মুখের কালো কাপড় সরিয়ে ফেলেছিলো যা সুষমা আগে ভালোভাবে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখার সুযোগই পায়নি |
ভোরবেলা ফোন করে বাবিনের বাবাকে যখন সব জানাচ্ছে তখন তারা তার পাশ থেকেই চলে যাচ্ছে দেখে ফোনটা তাড়াতাড়ি কেটে তাদের ডাক দেয় "একটু শুনুন ---" দুজনেই দাঁড়িয়ে পরে কিন্তু সামনে আসে একজন | অন্যজন তখন সুষমার দিকে পিছন দিয়ে দাঁড়িয়ে |সুষমা বলে ," উনাকে ডাকুন ---" ছেলেটি এগিয়ে গিয়ে তার গুরুকে ডাকে কিন্তু পিছন ফিরেই সে বলে ," দেরি হয়ে গেছে যেতে হবে ---" কিন্তু আপনার গলাটা আমার এতো চেনা লাগছে কেন ?" বলেই তার সামনে এসে দাঁড়ায় |
মুখের দিকে তাকিয়ে সুষমা বলে ওঠে ,
--- বিমল তুই? এ কি পরিণতি তোর ?
--- এটা পাবলিক পেলেস ম্যাডাম | আপনি আপনার ছেলেকে নিয়ে বিপদে পড়েছিলেন আমরা সাহায্য করেছি মাত্র আসি এবার | চলে আয় গুডলু"--- সঙ্গীকে ডাক দেয়| এগিয়ে যায় তারা সামনের দিকে কিছুটা | সুষমা দৌড়ে গিয়ে পথ আটকায় |
--- একটু দাঁড়া --- আমার ফোন নাম্বারটা দিয়ে দিচ্ছি যদি কোনদিন ইচ্ছা হয় আমায় ফোন করিস আমার যে অনেককিছু জানার বাকি আছে |
হাত বাড়িয়ে কাগজের টুকরোটা নিয়ে দ্রুত বেগে বেরিয়ে যায় বিমল --- তার সঙ্গীটি তাকে অনুসরণ করে |
সুষমার ছেলে এখন পুরো সুস্থ্য | স্বামীর কাছে সেদিনের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিলেও একজন যে তার পরিচিত ছিল এ কথা পুরোপুরি সে চেপে যায় | রোজই ভাবে বিমল ফোন করবে কিন্তু না ছমাস হয়ে গেলো বিমল কোন ফোন করেনি | এতো ভালো ছেলেটা কি করে এইরকম একটা খারাপ পথে চলে গেলো ভাবলে সুষমার দুচোখ জলে ভরে যায় | একদিন ছেলে স্কুল থেকে ফিরে বললো ,
--- মা আজ আমার এক বন্ধু আসবে সন্ধ্যার পর |
--- তোর আবার কোন বন্ধু সন্ধ্যার পর আসবে |
--- এই বন্ধুটাকে তুমি চেনোনা --- আমার থেকে অনেক বড় | বন্ধুকে আমি মামা বলেই ডাকি | অবশ্য বন্ধুই আমাকে ওই নামে ডাকতে বলেছে |
সুষমার সন্দেহ হল তবে কি বিমলের কথা বলছে? কি জানি দেখা যাক আসলেই বোঝা যাবে | তবুও সে রান্নাঘরে ঢুকে খুব ঝালঝাল করে আলুরদম রান্না করলো লতিকাকে বললো একটু ময়দা মেখে রাখতে | অধীর আগ্রহে ছেলের বন্ধু মামার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো | অনি বাড়িতে নেই বিশেষ কাজে আবার দুদিন ঘর ছাড়া | দুমাস তিনমাস অন্তর তাকে এভাবে বাড়ির বাইরে থাকতেই হয় | কলিংবেলের আওয়াজে সুষমা নিজেই গিয়ে দরজা খুললো, বাবিন বেলের আওয়াজ পেয়েই ছুটে এসেছে | সুষমা ঠিক যা ভেবেছিলো তাই --- বাবিনের বন্ধু মামা বিমলই |
কিছুক্ষণ বাবিনের সাথে গল্প , খেলা , গরম গরম লুচি , আলুরদম খাওয়া ---- সেই আগের মতই প্রাণোচ্ছল বিমলকে একমনে সুষমা দেখে যাচ্ছে চুপচাপ বসে থেকে | সুষমা এবার ছেলেকে বললো
--এবার তুমি পড়তে যাও --মামার সাথে আমি একটু কথা বলি |
লতিকা একটু অবাক হয় --- সেদিনের সেই ডাকাতটা আবার তাদের বাড়িতে কেন এসেছে --- তবে কি বৌমনি তাকে চেনে আগে থেকে? কিন্তু বৌমনি নিষেধ করেছে ওই ঘরে যেতে --- পরে সব বলবে বলেছে | এও বলেছে দাদাবাবু যেন জানতে না পারে সেদিনের ওই ডাকাতটি আবার বাড়িতে এসেছে |
বাবিন ঘরে চলে যাওয়ার পরে সুষমা বলে ,
--- বল এবার কিভাবে তুই এই পথে আসলি ?
বিমল হেসে পরে বলে ,
--- তোর রান্নার হাতটা কিন্তু সেই আগের মতই আছে | অনেকদিন পরে আলুরদমের পুরানো স্বাদ পেলাম রে | তুই কি করে বুঝলি যে আমিই আসবো আজ |
--- আজ সে সব কথা পরে হবে | তুই আগে আমাকে সব খুলে বল |
--- সেতো এক ইতিহাস রে | উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে আমি কলকাতায় এলাম পড়তে | একটা মেসে থাকতাম | আমার রুমে আরও চারটে ছেলে ছিল | কিন্তু ওদের সাথে আমার ঠিক বনতো না | এড়িয়েই চলতাম বলতে গেলে ওদের | কিন্তু পায়ে পা দিয়ে ওরা আমার সাথে ঝগড়া করতো | দাঁতে দাঁত দিয়ে থাকতাম | বাবা অনেক কষ্ট করে আমাকে মানুষ করার চেষ্টা করছেন | এভাবে দুবছর কোন প্রকারে কাটলো | তোর বিয়েতে মাসি বারবার করে যাওয়ার জন্য ফোন করতো -- তুই ও কয়েকবার আমায় বলেছিস কিন্তু ---
--- হ্যাঁ তখন তো তোর সেমিস্টার চলছিল
--- হ্যাঁ আর এই কারণেই আমি তোর বিয়েতে যেতে পারিনি তখন | পরীক্ষার পর ভাবলাম বাড়ি যাবো | ব্যাগ গুছিয়ে রাখলাম পরদিন বেরোবো | কিন্তু আমার রুমে আর যে চারজন ছিল তারা সেদিন সারারাত মেসে ফিরলোনা | ভোরের দিকে ছেলেগুলি ফিরেই খুব তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছাতে লাগলো | আমি একটু অবাক হলাম কিন্তু ওদের কাছে কিছুই জানতে চাইলামনা | ওরা তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়লো | কিছুক্ষণ বাদে আমিও ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি বিশাল এক পুলিশের জিপ | আর চারিপাশে পুলিশ গিজগিজ করছে | ওই চারটি ছেলে পুলিশ জিপে বসে আছে | আমাকে পুলিশ নানান ধরণের প্রশ্ন করতে লাগলো | আমি কিছুতেই তাদের বোঝাতে পারলামনা আমি ওদের সাথে ছিলামনা | ছেলেগুলিও মিথ্যা বলে আমায় ফাঁসিয়ে দিলো |
--- ওরা করেছিল কি সেই রাত্রে ?
--- একটা সতের বছর বয়সের মেয়েকে রেপ | হ্যাঁ আটকে উঠিসনা দিদি -- আর সেই কেসে ওরা আমাকে ফাঁসালো |
--- তারপর ?
-- বলবো সব বলবো -- বলার জন্যই তো এসেছি আজ |
--- মেয়েটি প্রথম অজ্ঞান অবস্থায় পনেরদিন ছিল | তারপর চলে যায় কোমায় | নিরাপরাধ প্রমান করার কোন উপায় ছিলোনা | বাবা মেসে এসে সবকিছু জেনে আমার সাথে জেলে দেখা করে বলে যান," আমি আজ থেকে জানবো আমার কোন ছেলে নেই|" বাবাকেও বুঝাতে পারলামনা এই ঘটনার সাথে আমি জড়িত ছিলামনা | বাড়িতে ফিরে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে বাবা হার্টফেল করেন | মা আর বোন অসহায় হয়ে পরে | পাড়াপ্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনের কাছে আমার এই ঘটনা চেপে যাওয়া হয় | সবাইকে বলা হলো আমি একবারে পড়া শেষ করে বাড়ি ফিরবো | মাস চারেক পরে মেয়েটি কোমা থেকে বেরোলো | তার স্বাক্ষীতে আমি জেলমুক্ত হলাম ঠিকই কিন্তু জীবনের পরীক্ষায় হেরে গেলাম | বাড়ি গেলাম আশ্রয় পেলামনা | মা বললেন ," তুই বাড়িতে থাকলে নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে ভবিষ্যতে বোনের বিয়ে দিতেও অসুবিধা হবে |" এ কথা শোনার পর আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট করিনি সেখানে | রাস্তা ফুটপাথের উপর শুয়ে না খেয়ে দিনরাত কাটিয়েছি | তারপর একদিন আস্তে আস্তে এই দলেই ভিড়ে গেলাম রে | না শুধু নিজের পেট নয় আমি মাঝে মধ্যেই বস্তি বা রেলস্টেশনে থাকা গরিব মানুষগুলোর এক দুবেলার অন্ন সংস্থানও করে থাকি | তাদের আশীর্বাদেই হয়তো আজও আমি ধরা পরিনি |
--- কিন্তু মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এটা সঠিক পথ নয় ভাই | তুই এই রাস্তা থেকে সরে আয়| আমি তোর দাদাকে বলে যেকোন একটা কাজ ঠিক জোগাড় করে দেবো|
--- এই রাস্তাটায় যত সহজে ঢোকা যায় বেরোনো ততটাই কঠিন দিদি |
--- সেসব আমি জানিনা | তোর জীবনটা এভাবে নষ্ট হতে আমি দিতে পারিনা - আগে বিন্দুবিসর্গ জানতামনা ঠিক আছে কিন্তু এখন যখন সব জেনেই গেছি এভাবে তোকে আমি শেষ হতে দেবোনা |
প্রয়োজনে তুই আমার বাড়িতে এসে থেকে প্রাইভেটে গ্রাজুয়েশনটা কর | তোর দাদা খুব ভালো মানুষ রে | আমি কথা দিচ্ছি তোর কোন অসুবিধা হবেনা |
--- স্বপ্ন দেখাচ্ছিস? স্বপ্ন দেখতে এখন ভয় পায় রে --- দুচোখ ভরে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম কিন্তু জীবনযুদ্ধে আমি হেরে গেছি দিদি |
--- বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত তোকে ভাইফোঁটা দিয়ে গেছি -- ভাই বলে একমাত্র তোকেই জানি, আমি কিছুতেই তোকে এভাবে শেষ হতে দেবোনা --
-- তোর কথাগুলো শুনে আবার নিজেকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করছে কিন্তু দিদি আমি যে সেই মনবল হারিয়ে ফেলেছি |
--- কিচ্ছু হারায়নি সব ঠিক হয়ে যাবে তুই শুধু এই পথটা ছেড়ে দিয়ে আমার কাছে চলে আয় ভাই ; দেখবি আবার মাথা তুলে তুই দাঁড়িয়েছিস| মাসি আর বোন আবার তোকে কাছে টেনে নেবে | মাঝে মাঝে আমরা জীবনে কঠিন সমস্যার মধ্যে পড়ি | হাল ছেড়ে দিলে হেরে যেতে হয় - তখন ভালোভাবে বাঁচার জন্য জীবনে অন্যকোন পথ খুঁজে নিতে হয় | আর আমি জানি তুই পারবি আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে | তোর কপালে ফোঁটা দেওয়া আমার ব্যর্থ হতে পারেনা |
--- তোর মত দিদি পাশে যখন আছে তখন আর একবার চেষ্টা করে দেখি --|
--- হ্যাঁ ভাই শুধু আমি একা না তোর দাদাও তোর পাশে থাকবে আমি কথা দিচ্ছি |
বিমল তার জীবনে নুতন সূর্যোদয়ের আশায় দিদিকে প্রণাম করে তার কাছে চলে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আজকের মত বিদায় নিলো আর ছমাস পরে সুষমার বুকের উপর থেকে ভারী পাথরটা নেমে গেলো |