ঘনাদা রহস্য উন্মোচন পর্ব চার
ঘনাদা রহস্য উন্মোচন পর্ব চার
খোকন আর বাপি খবরটা শুনে তো ধেই ধেই করে খানিক নেচে নিলো। তারপর আবার গলায় অবিশ্বাস নিয়ে বলল , বল বাবলু শীতলা মায়ের কিরা ?
আমি ওদের একটা মুড নিয়ে বললাম , আমার বেরোতে হবে তাই ওসব পিয়াঁজি না করে তৈরি হয়ে যা । অবশ্য যদি যেতে চাস।
খোকন বলল , মা আসুক আজকেই সব গুছিয়ে নেবো । কদিন থাকব রে আমরা ?
আমি বললাম , বেশি কথায় কাজ নেই। মলি যাবে আমাদের সাথে একমাত্র লেডিস। তার টেক কেয়ার আবার আমাকেই করতে হবে ।
বাপি কুনুই দিয়ে খোকনকে গুতো দিতে দিতে হাসতে লাগলো।
আমি সিরিয়াস হয়ে বললাম , আজ আয় সন্ধ্যায় বুঝলি । দাদা সব বুঝিয়ে দেবে । ঘনাদা আবার বেশি পাকামো পছন্দ করে না । চিত্রকূট যাবি শুধু বেড়াতে না , আমাদের একটা রহস্য উন্মোচন করতে হবে । যদিও বিষয়টা আমার কাছেও এখনো পরিষ্কার না ।
বাপি বলল , তোর আসলে ইন্টারেস্ট যত্ ওই মলিকে নিয়ে । ভাবছস যে আমি কিছু বুঝি না ।
ঘনাদা না আর কোনদিন নিয়ে যাবে না যদি দেখে তোমার এই নাক টিপলে দুধ বেরোবার বয়সে প্রেম জেগেছে ।
মাথাটা গরম হয়ে গেল । মুড দেখিয়ে বললাম , বেশি ঝাট জ্বালানো কথার প্রয়োজন নেই । কাল রওনা দিতে হবে । তো তেমন ভাবেই যেন তৈরি হওয়া হয় ।
আর বেশি বোচকা বাঁধার চেষ্টা করবি না । ব্যাটা ছেলে দুটো সেট জামাতে হয়ে যায় । দুজন ভাই তাই চার সেট পোশাক ছাড়া বেশি কিছু নেবার দরকার নেই ।
বাবলু আর বাপি ফিচেল হেসে বলল , জো হুকুম মেরে আকা ...
আমি বেরিয়ে এলাম বাড়ির দিকে । ঘনাদার নির্দেশ ওদের দিয়ে দিলেও নিজে মোটেও জেরম কাপকা জেরমের প্যাকিং শুরু করিনি । আবার সবাইকে শাসন করতে গিয়ে নিজের না দেরি হয়ে যায় ।
বাড়ি এসে মাকে বললাম , মা আমার জন্য চার পাঁচ সেট ভালো জমা প্যাক করে দাও। সাথে সেন্ট আর ভালো একটা টুপি ।
নিজের উপর নিজেরই হাসি পাচ্ছে । ওদের বলে এলাম বেশি লাগেজ করবি না । আর এদিকে নিজে এত কিছু নেবো । তবে নিতে তো হবেই । আমি মলিকে এই তালে ইমপ্রেস করবো । এটাই মোক্ষম সুযোগ।
ঘনাদা সন্ধ্যায় অফিসে বসে । আমি বাপি আর খোকন আসতেই এসে বসলাম ওদের সাথে । মলি ও এলো ওর বাবার সাথে ।
নীহার আঙ্কেল বসলেন ঘনাদার সামনাসামনি । ঘনাদা মাকে ডাক দিলো চায়ের জন্য ।
মলিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে বেশ আগ্রহী এই যাত্রার জন্য ।
ঘনাদা মলির বাবাকে বলল , নীহার তোর মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি । সব দায় দায়িত্ব আমার । কোন চিন্তা নেই । আমি দেখে রাখবো ওকে । এই তালে একটু বাড়ানো হবে।
নীহার আঙ্কেল বললেন , তুই থাকলে দেবাশীষ আমার কোন ভয় নেই । তুই নিয়ে যা মলিকে । তবে দেখিস লেডি শার্লক হোমস যেন না হয় মলি । আমার ইচ্ছা মেয়ে ডাক্তার হোক ।
মা ইতিমধ্যে ঘোমটা টেনে এসে দাঁড়ালো পাশে কাজের মাসীর হাতে চায়ের ট্রে ।
মা নীহার আঙ্কেলকে বললেন , সেই তো নীহার । দেখো আমার ছেলে বাবলু , সে ভাবে দাদার মত গোয়েন্দা হবে । আরে ওকে কে বোঝায় বলো তো যে দাদা একজন ইঞ্জনিয়ার । শখে এখন গোয়েন্দা হয়েছে । ওকে একটু বোঝাও তোমরা , ও যেন কালদিন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়র হয় । বাপ ঠাকুরদার তেলকল যেন ওকে চালাতে না হয় ।
ঘনাদা বলল , আহ কাকিমা তুমি না ছেলেটাকে পাগল করে দেবে । বাবলু যেটা ভালো বুঝবে সেটাই করবে । নাও তোমার তোফা চায়ের কাপ তুলে দাও আমাদের হাতে । খেয়ে প্রাণ জুরাই।
মা দাদা আর নীহার আঙ্কেলকে চায়ের কাপ তুলে দিলো । সাথে আছে ধোঁয়া ওঠা বেগুনি । আর আমাদের ছেলের দলের জন্য বনভিটা মিল্ক শেক ।
মলি আমাকে আঙ্গুলে ধরে খোঁচা দিয়ে ওর দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো ।
আমি তাকাতেই ফিসফিস করে বলল , এই বাবলু দুপুরে মা খেতে বলেছিল খেলি না কেন ? বড় ঘ্যাম না তোর ?
বাপি বলল , আমাদের মাঝে মাঝে ডাকতে পারিস মলি ?
মলি : সে একদিন ডাকব খন । চল আগে ঘুরে তো আসি । এই বাবলু ঘনাদা কি বন্দুক নিয়ে যাচ্ছে ? আর বোম ?
ঘনাদা আমাদের কথা গুলো শুনে ফেলেছে । ঘনাদা মলিকে বলল , আমরা বেড়াবার জন্য যাচ্ছি । এমনটাই সব দিক দিয়ে যেন মনে হয় । বুদ্ধি দিয়ে বাজিমাৎ করতে হবে আমাদের । তার জন্য বন্দুক লাগবে না । লাগলে তখন দেখা যাবে । তবে ওখানে গিয়ে তোমরা একদম স্বাভাবিক আচরন করবে । যেমন এখন করছ । সেই কারণেই তোমাদের নিয়ে যাওয়া ।
ট্রেনে চড়ে বসেছি আমি , খোকন , বাপি , মলি আর ঘনাদা। পিঠে একটি করে ব্যাগ তাতে দুটি করে জামা আর সাথে ফোন । ঘনাদা অবশ্য একটা লাগেজ ব্যাগ নিয়েছে । স্লিপার কোচে চেপে খোকন তারাতারি চেপে গেল একেবারে উপরের বার্থে। আমরা সবাই বসে রইলাম নিচের সিটে। সময় বিকাল পাঁচটা এখন । ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে স্টেশন থেকে । মলির মা শুকনো মুখে মেয়েকে বিদায় দিয়েছে । বাবলু আর খোকনের মা আসতে পারেননি স্টেশন । আর আমার অভিভাবক তো সঙ্গেই যাচ্ছে , ঘনাদা । বাপি আমাকে বলল , এই বাবলু আমি ওয়াক ম্যান এনেছি রে । চল দুজন মিলে শুনি গান ।
আমি আগ্রহ দেখাতাম অন্য সময় হলে কিন্তু এখন মলি আছে পাশে । তাকে ছাড়া গান শোনা অপরাধ । ঘনাদা নিজের এন্ড্রোয়েড ফোন নিয়ে কিসব দেখছে একমনে । আমাদের সবার কাছে বোতাম ফোন । আর এই করুন দশার জন্য দায়ী আমার সামনে বসে থাকা এই লোকটা । হ্যাঁ ঘনাদা আমাদের সবার এন্ড্রোয়েড ফোন এই বোতাম ফোনে পরিবর্তন করেছে । লক ডাউনের সময় মোটামুটি খেদি , পেচি , গলু , মলু সবার কাছেই পড়াশোনার বায়নাতে দামী মুঠোফোন এসেছিল । পড়া কম আর গেম বেশি চলছিল । তারপর ঘনাদা পাড়াতে সেদিন রবীন্দ্র জন্মদিন পালনের দিন মাইকে এত জমিয়ে বক্তৃতা দিলো আমাদের ফোন দেবার কুফল নিয়ে । তারপর আর কি বেশিরভাগ বাপ মা ওই ঘনাদার বুদ্ধি মেনে নিয়ে তাদের ছেলেপিলের হাতে বোতাম ফোন ধরিয়ে দিলো। প্রতিবাদ করে লাভ নেই কারণ অফলাইন ক্লাস শেষ হয়ে গেছে । স্কুল যেতে হচ্ছে আবার । তো এখন বাপ মায়ের কি দায় লেগেছে আমাদের দামী ফোন দেবে , বড় বড় রিচার্জ করে দেবে ।
বাপি ওর বাবার আগের একটা ওয়াকম্যান খুঁজে বের করে ওটাতে সেই মান্ধাতা আমলের ক্যাসেট প্লেয়ার দিয়ে গান শুনছে ।
আমি মলির সাথে যেচে বেশি কথা বলতে পারছি না । ঘনাদা কি ভাববে আবার ।
মলি একটা অরণ্যে দেব কমিক্স বই পড়ছে ।
ঘনাদা বলল সাতটার মধ্যে রেল থেকে ডিনার দিয়ে দেবে । তো সেটা খেয়ে শুতে হবে । আমাদের গন্তব্য স্থলে পৌঁছাতে ভোর রাত ।
খোকন উপর থেকে ঝুঁকে পড়ে শুনতে চেষ্টা করলো ডিনারে কি আসছে । তবে সে নিয়ে ঘনাদা কিছুই বলল না ।
আমি ঘনাদাকে জিজ্ঞাসা করলাম , ও দাদা ওই শ্যামাপদ ব্যানার্জি যাবে নাকি ? কেসটা তো ওনারই ।
ঘনাদা বলল , উনি আমি ডাকতে তবেই আসবেন । আর আমরা মাস্টার আর ছাত্র দল সেজে বেড়ানোর অছিলায় রহস্য উন্মোচন করার চেষ্টা করবো ।
মন্দির থেকে যে মূর্তি চুরি গেছে সেটা উদ্ধার করা দরকার । আর এটাও জানতে হবে কেন প্রতি পঞ্চাশ বছর অন্তর এই ঘটনা বারবার ঘটে । কেন মূর্তি চুরি হবার পর পর খুন হয় এই ব্যানার্জী পরিবারের মানুষ । আর মূর্তি এর আগের বার ও চুরি যাবার পরেও খুনের পর সেটা স্বস্থানে কেনই বা পাওয়া যায়?
এখন বুঝতে হবে আগের তিন বারের সাথে এবারের কোন পার্থক্য আছে কিনা । বা বারবার যে মূর্তি চুরি হয়েও ফিরে এসেছে প্রতিবার একই মূর্তি ফিরেছে কিনা । আশা করছি শ্যামাপদ ব্যানার্জির কোন ক্ষতি হবার আগেই রহস্য উন্মোচন হবে ।
কথার মাঝেই খাবার চলে এলো । ঘনাদা বলল খেয়ে তারপর কথা হবে । দাদা টয়লেটের দিকে এগিয়ে গেল । আমি জানি দাদা ফুঁকতে গেল ।
খোকন দা খোক্কস তারাতারি নেমে এলো খাবারের প্যাকেট দেখে । লাল লাল খাপ খাপ ট্রে আর তাতে ফয়েল দেওয়া । আমি একটা ট্রে মলির হাতে তুলে দিলাম । মলি ব্যাগ থেকে স্যানিটাইজার বের করে নিজে নিলো আর সবাইকে নিতে বলল ।
আমরা চারজন দাদার জন্য অপেক্ষা করছি খাবার ট্রে হাতে। দাদা ফিরে এলো। দাদার গা থেকে ভুরভুর করে সিগারেটের গন্ধ।
সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা পড়ে আছে দাদা । আর আমাদের হাফ প্যান্ট , গেঞ্জি । এতেও দাদার হাত আছে । বলল এতে নাকি আমরা আরাম পাবো আর দেখতেও বাচ্চা লাগবে । মলি অবশ্য চুড়িদার পড়ে আছে ।
প্যাকেট খুলতেই আমাদের চোখে পড়লো ওতে আছে রুটি , একটা তরকারি , রাজমা , সরু চালের ভাত আর পনির ।
খোকন বলল , দুর বাবা পনির ! আমি ভাবলাম মাংস ।
ঘনাদা : রেলের খাবারের মান আজকাল বড় খারাপ। এখন যা পাচ্ছ খেয়ে নাও । ওখানে পৌঁছে ভালো ভালো খাবে । চিকেন খাবে সেটা বড় কথা না । আসলে খাবার যদি বাসী হয় বা ঠিক করে সেদ্ধ না হয় তাতে পেট খারাপ করবে । আর কারো শরীর খারাপ হলেই নিশ্চিত আমরা আমাদের কাজটা সফল ভাবে করতে পারবো না ।
আমরা সবাই খেয়ে হাত ধুয়ে এলাম। ঘনাদা মলিকে বলল সেকেন্ড বার্থে শুয়ে পড়তে আর নিচে ঘনাদা রইল । খোকন আগেই তিন নম্বর দখল করেছে । আমি আর বাপি এদিকের বার্থে শুয়ে পড়লাম ।
ঘনাদা বলেছিল বাকি কথা খেয়ে হবে কিন্তু কেন জানিনা ওদিকের একটা প্যাসেঞ্জার উঠতেই ঘনাদা কেমন চুপ মেরে গেল । লোকটা সাইড বার্থে শুয়ে পড়ল উঠেই । মুখটা দেখতে পাইনি টুপির জন্য ।
