Sayandipa সায়নদীপা

Abstract Children Stories

3  

Sayandipa সায়নদীপা

Abstract Children Stories

ঘেঁটুর বন্ধু

ঘেঁটুর বন্ধু

10 mins
846


মাঝরাত্রিরে খামার ঘরের টিনের ছাউনিটায় ধুপধাপ শব্দ হতেই ঘুম ভেঙে গেল ঘেঁটুর। গরমের হাত থেকে খানিক রেহাই পেতে দোতলার টানা বারান্দায় একটা মাদুর বিছিয়ে শুয়েছিল সে। গরমকাল হলেই এখানটাতেই রাতে ঘাঁটি পাড়ত সে আর তার দাদু, কিন্তু এই বছরটা তো অন্যরকম। পাশে তাকাতেই বুকটা হুহু করে উঠল তার, আজ চারমাস হল দাদু তাদের সকলকে ছেড়ে যাত্রা করেছেন অমৃতলোকে। তাই আজ ঘেঁটু একা। আস্তে করে উঠে বসল সে। সারা শরীর চটচট করছে ঘামে। বাইরেও আজ একফোঁটা বাতাস নেই। সামনের দিকে তাকাতেই আধো অন্ধকারে মনে হল এক বিশাল দৈত্য যেন দাঁড়িয়ে আছে খামারে। ঘেঁটু জানে ওটা আসলে দাদুর প্রিয় আমগাছটা। একটু আগে ওটার থেকেই আম পড়ে শব্দটা হয়েছে নিশ্চয়। আচ্ছা বাড়ির আর কেউ কি শব্দটা শুনেছে! না শুনলেই মঙ্গল, নয়তো কাল সকালে উঠেই কাকিমা এটা সেটা বলবে। দাদু মারা যাওয়ার পর থেকে হয়েছে ওই এক জ্বালা, রাতের বেলা কিছু একটু শব্দ হলেই কাকিমা পরের দিন সকালে উঠে হুলুস্থুলুস কান্ড বাধায়। বলে দাদুর ভুত নাকি এসে ওইসব উপদ্রব করছে। এসব কথা শুনতে বড় খারাপ লাগে ঘেঁটুর, দাদুর হাসি মুখটা মনে পড়লে কষ্ট হয়। ভাবে যে মানুষটা বেঁচে থাকতে তাদের সবাইকে এতো ভালবাসতো, সবার বিপদে আপদে ছুটে যেত সাহায্য করতে, সেই মানুষটা কি মৃত্যুর পর কোনোরকম উপদ্রব করতে পারেন! কিন্তু এসব কথা কাকিমাকে কে বোঝায়! দাদু বলতেন, “বুঝলি ঘেঁটু আমরা বলি মানুষ মরলে ভুত হয়, ওসব স্রেফ মিছে কথা। মানুষ মরলে মানুষের আত্মা গিয়ে পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যায়।” এসব আত্মা পরমাত্মার কথা ঘেঁটু ঠিক বুঝতো না, সে শুধু জানতে চাইতো ভুত বলে আদৌ কিছু আছে কিনা। দাদু তখন ওর চুল গুলো ঘেঁটে দিয়ে বলতেন, “আছে রে আছে। তবে আমরা তাদের যেমন করে ভাবি তেমন করে নয়। তারা আছে, আমাদেরই চারপাশে, নিজেদের স্বকীয় অস্তিত্ব নিয়ে, নিজেদের মতো করে।” এর বেশি দাদু আর কোনোদিনও কিছু বলতেননা। ঘেঁটুর বড় ইচ্ছে করে একবার ভুতগুলোকে দেখতে--- কেমন দেখতে তারা! কেমন তাদের আচার বিচার! তাদেরও কি মন আছে মানুষের মত!


                   ★★★★★


  আজ ইস্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরতে একটু দেরী হয়ে গেল ঘেঁটুর। আসলে আজ বাবা গিয়েছেন বড় পিসিমণির বাড়ি আর কাকুর ফিরতে ফিরতে তো রোজই প্রায় রাত ন'টা হয়ে যায়, কাজেই আজ বকুনি দেওয়ার মত কেউ নেই। তাই আজ অনেকক্ষণ ক্রিকেট খেলেছে বন্ধুদের সঙ্গে। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর অন্ধকার না নামা অবধি খেলা থামায়নি তারা। কিন্তু এখন ব্যাপারটা কি হল! বাড়ি ঢুকতেই মনে হল কাকিমার মুখটা কেমন যেন থমথমে। ঘেঁটুর সাইকেল রাখার আওয়াজে ভেতর থেকে মা বেরিয়ে এলেন, চোখ লাল করে ঘেঁটুর দিকে তাকিয়ে বললেন, "এতক্ষণে ফেরার সময় হল? কোথায় ছিলে এতক্ষণ?"

এই রে মা "তুমি" করে কথা বলছে! তারমানে ভয়ঙ্কর রেগে গেছেন। একটা ঢোঁক গিলল ঘেঁটু, "আসলে মা…"

 "থাক আর তোকে কিছু বলতে হবেনা। বাড়িতে কি হয়ে গেছে সে খেয়াল আছে?" কথাগুলো বলতে বলতে এগিয়ে এলেন কাকিমা।

 "কি হয়েছে?" উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল ঘেঁটু।

"ঠাকুমার শরীরটা দুপুরের পর থেকে খুব খারাপ করছে। এদিকে কেউ নেই যে ডাক্তারের কাছে পাঠাই। তুইও এতো দেরি করে ফিরছিস…" মায়ের কথাগুলো শুনে চমকে উঠল ঘেঁটু। ঠাকুমার শরীর খারাপ! মাত্র চারমাস আগে দাদু চলে গিয়েছেন। এখন যদি ঠাকুমার কিছু হয়ে যায়…! না না ঠাকুমার কিছু হবেনা। সাইকেলে আবার চড়ে বসে প্যাডেলে চাপ দিলো ঘেঁটু। পাশের গ্রামেই থাকেন অবনী ডাক্তার, সবাই বলেন সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী তিনি, যে করে হোক তাঁকেই ধরে আনতে হবে।


  ঘেঁটুর ভাগ্যটা ভালো ছিল বলেই আজ যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবনী ডাক্তারের দেখা পেয়ে গেল সে। সেই সবে একটা ভিজিট করে এসে এক কাঁসা মুড়ি নিয়ে খেতে বসেছিলেন তিনি। ঘেঁটুর তাড়ায় তড়িঘড়ি খাওয়া শেষ করে নিজের ডাক্তারীর ব্যাগটা নিয়ে ঘেঁটুর সাইকেলে চড়ে বসলেন। ডাক্তারবাবুর দশাসই চেহারার চাপে ঘেঁটুর সাইকেলের পেছনের চাকাটা যেন নড়তে চাইছিল না। কোনোক্রমে যখন ঘেঁটু যখন বাড়ি পৌঁছাল ততক্ষণে সবার বাড়ির ছেলেমেয়েরা সন্ধ্যার পড়া শুরু করে দিয়েছে, বেশিরভাগ বাড়িরই রাতের রান্নাও চেপে গিয়েছে, মম করে খাবারের গন্ধ ছড়াচ্ছে চারিদিকে। ঘেঁটুর পেটটা গন্ধ পেয়ে গর্জন করে উঠল। মা বললেন ডাক্তারবাবু ঠাকুমাকে দেখতে দেখতে দুটি কিছু খেয়ে নিতে। আপত্তি করলোনা ঘেঁটু। এদিকে ঠাকুমাকে দেখে আশ্বস্ত করলেন ডাক্তারবাবু, "ভয়ের কিছু নেই। ওষুধ দিচ্ছি এগুলো খাইয়ে যাও আজকে তারপর পরশু জানাবে কেমন রইল।" ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন ঘেঁটুর মা আর কাকিমা। ডাক্তারবাবুকে বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে আসার জন্য বেরোবার সময় কাকিমা ঘেঁটুর কানে ফিসফিস করে বললেন, "বুড়ো বটতলা দিয়ে এ সময় ফিরিসনা ঘেঁটু।"

 "কেন?"

"জানিস না এ সময় ওখানে তেনারা সব থাকেন!"

ভ্রু কুঁচকে বাড়ির থেকে বেরিয়ে গেল ঘেঁটু। আবার ডাক্তারবাবুর ভারে সেই ক্লান্তিকর যাত্রা, তবে এখন পেটে দুটি দানাপানি পড়েছে বলে আগের মত কষ্টটা আর হচ্ছেনা।


  ডাক্তারবাবুকে নামিয়ে দিয়ে যখন বাড়ি ফেরার পথ ধরল ঘেঁটু তখন বাইরের অন্ধকারটা যেন আরও জমাট বেঁধেছে। দু'হাত দূরে কি আছে তা ঠাহর করা মুশকিল। ক'দিন আগেই পূর্ণিমা গিয়েছে এতো অন্ধকার হওয়ার তো কথা নয়! আকাশের দিকে একবার তাকাল ঘেঁটু, চাঁদটাকে দেখা যাচ্ছেনা কোথাও। অদ্ভুত ব্যাপার, আকাশে মেঘ আছে বলেও তো মনে হচ্ছেনা, তাহলে! সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে একহাতে টর্চ নিয়ে প্যাডেলে চাপ দিলো ঘেঁটু। আসার সময় কাকিমা বলে দিয়েছিলেন বুড়ো বটতলা দিয়ে না ফিরতে কিন্তু ঘুরপথে যেতে গেলে আরও রাত হয়ে যাবে তো। তারচেয়ে বুড়ো বটতলা দিয়েই ফেরা যাক, কি আর হবে! যেমন ভাবা তেমন কাজ, সাইকেলটা বুড়ো বটতলার দিকে ঘোরালো ঘেঁটু। কিন্তু বুড়ো বটের কাছাকাছি আসতেই আচমকা টর্চটা গেল নিভে। সাইকেল থেকে নেমে সুইচটা টিপে দেখলো বার কয়েক, কিন্তু নাহ তার জ্বলার কোনো লক্ষণই নেই, হাতের তালুতে কয়েকবার ঠুঁকেও দেখলো টর্চটা কিন্তু যেই কে সেই। আশ্চর্য, ঘেঁটুর স্পষ্ট মনে আছে বাবা পরশুদিনই ব্যাটারি পাল্টে ছিলেন! তাহলে কি হল কে জানে! আশেপাশে একবার তাকিয়ে দেখল ঘেঁটু, চারিদিকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। একটা ঢোঁক গিলল ঘেঁটু, এমন অন্ধকারে এগোবে কিভাবে! আচমকা ঘেঁটুর মনে হল কোথাও যেন এক চিলতে সবুজ আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল। পরমুহূর্তেই ভালো করে চারিদিকে তাকিয়েও কোনো হদিশ করতে পারলোনা সে আলোর। কিন্তু তখনই ঘেঁটুর মনে হল কোথাও থেকে যেন ক্ষীণ কিন্তু একটানা একটা শব্দ ভেসে আসছে। কান পেতে ভালো করে শোনার চেষ্টা করতেই কেমন যেন নেশা লেগে গেল ঘেঁটুর। অদ্ভুত সুন্দর সে শব্দ, ঘেঁটু সাইকেল ছেড়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে গেল সামনের দিকে, বুড়ো বট যেখানে তার ঝুরি মেলে দাঁড়িয়ে আছে। যত কাছে যাচ্ছিল শব্দটার তীব্রতাও যেন আরও বাড়ছিল। নিছক কৌতূহলে নাকি অন্য কোনো কারণে সে এগিয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পারলোনা ঘেঁটু, সে শুধু টের পেল আওয়াজটা যেন তাকে আকর্ষণ করছে। এ আকর্ষণকে উপেক্ষা করার সাধ্য নেই তার। একটু একটু করে এগিয়ে গিয়ে একেবারে বুড়ো বটের সামনে দাঁড়াল ঘেঁটু। সে স্পষ্ট টের পাচ্ছে আওয়াজটা আসছে ঠিক অপর প্রান্ত থেকে। একটা ঢোঁক গিলল ঘেঁটু, তারপর সাহস করে পা'টা বাড়িয়েই দিলো। অবশ্য না বাড়িয়েও উপায় ছিলনা, ঘেঁটু অনুভব করতে পারছে পেছন ফিরে চলে যাওয়ার শক্তি তার নেই। অপ্রান্তে যেতেই ঘেঁটু দেখতে পেলো তাকে--- একটা অদ্ভুত দর্শন যানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। যানটা থেকে যে আলো ছড়াচ্ছে তাতেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাকে- লম্বা লাউয়ের মত মুখ, তাতে দুটো আলুর মত ড্যাবা ড্যাবা চোখ, নাকটা আবার ঝিঙের মত লম্বা, ঠোঁট দুটো দেখে মনে হল যেন একটা পটল আধাআধি কেটে ওপর নীচে বসানো রয়েছে। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার তো হল ওর মাথাটা, ঠিক যেন একটা আস্ত কুমড়ো। দেহের বাকি অংশটা অবশ্য মানুষের মতোই কিন্তু তাও আবার ঠিক যেন মানুষ নয়। ভয় পাওয়ার ছেলে ঘেঁটু কোনোদিনই নয় তাই ওকে দেখেই ফিক করে হেসে ফেলল সে। 

ঘেঁটু হাসা মাত্রই ওই প্রাণীটার কাছ থেকে অদ্ভুত সব শব্দ ভেসে আসতে শুরু করল। এবার খানিকটা ঘাবড়ে গেল ঘেঁটু, একটা ঢোঁক গিলল সে। এটা কি ধরণের প্রাণী কিছুতেই ঠাহর করতে পারছে না সে। এমনি নির্ভীক প্রকৃতির হলেও এখন কেন কে জানে এই মজাদার প্রাণীটাকে দেখে আর মোটেও মজা লাগছে না ঘেঁটুর, বরং একটু যেন ভয় ভয়ই করছে। কথা বলতে গিয়ে গলাটা কেঁপে গেল ঘেঁটুর, কোনোক্রমে বলল, "ক্ক… কে তুমি?" 

আবার কয়েকটা উদ্ভট আওয়াজ ভেসে আসার পর ঘেঁটু এবার পরিষ্কার বাংলায় শুনতে পেল, "নমস্কার পৃথিবীবাসী বন্ধু, আমি আসছি মিলিপপ্লি গ্রহ থেকে।"

মিলিপপ্লি গ্রহ! এমন নাম তো জীবনে শোনেনি ঘেঁটু। কিন্তু এ সেই গ্রহ থেকে এসেছে মানে… এলিয়েন! মুহূর্তের মধ্যে ঘেঁটুর কানে বেজে উঠল সোমবারের বাংলা ক্লাস, দিদিমণি পড়াচ্ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের "বঙ্কুবাবুর বন্ধু"। তাতেও তো ঠিক এভাবেই বঙ্কুবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল অ্যাং এর। সে যেন কোন গ্রহ থেকে এসেছিল! এই মুহূর্তে মনে পড়ল না ঘেঁটুর। তবে অ্যাং যখন বঙ্কুবাবুর বন্ধু ছিল তেমন এই এলিয়েনটাও নিশ্চয় ঘেঁটুর বন্ধু হবে। ঘেঁটুর মনের ভয়টা একটু যেন কাটল; সে এবার একগাল হেসে জিজ্ঞেস করল, "আমার নাম অভিনন্দন পাল, তোমার নাম কি?"

 "আমার নাম গং।" পরিষ্কার বাংলায় জবাব দিলো এলিয়েনটা। 

ঘেঁটু বলল, "বাহ্ বাহ্ বেশ সুন্দর নাম তো। তা বলছি তুমি কি অ্যাং এর কেউ হও?"

"অ্যাং কে?"

"হেঁ হেঁ কেউ না কেউ না। বলছি তোমার নিশ্চয় মেশিনটা খারাপ হয়ে গেছে তাই এখানে এসে পড়েছো, তাই না।"

এবার আর সঙ্গে সঙ্গে কোনো জবাব দিলো না গং, ঘেঁটু দেখলো ওর আলুর মত চোখগুলো বনবন করে ঘুরতে আরম্ভ করল- প্রথমে সবুজ, তারপর হলুদ, তারপর লাল হয়ে থামল অবশেষে; এবং গং এর কাছ থেকে আওয়াজ ভেসে এলো, "কোনো খারাপ নয়... সব ভালো… সব ভালো… আমি একটা দায়িত্ব নিয়ে এসেছি।"

 "কি দায়িত্ব গো?"

"নমুনা নিয়ে যেতে হবে আমায়।"

 "কি নমুনা?"

"পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের।"

 "সর্বনাশ! মানুষের নমুনা নিয়ে যাবে মানেটা কি?"

"আমরা তোমাদের গ্রহের চেয়ে অনেক উন্নত শরীরের গঠন আর বুদ্ধির দিক থেকে…" 

গং এর কথাটা শুনে ফিক করে হেসে ফেলল ঘেঁটু, এই চেহারা নিয়ে বলে কিনা মানুষের চেয়ে উন্নত গঠন! ঘেঁটুর হাসি বোধহয় খেয়াল করলোনা গং, সে বলে গেল গড়গড় করে, " কিন্তু আমাদের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন পৃথিবীর মানুষের মধ্যে আবেগ বলে একটা জিনিস আছে, সেটা আবার সব মানুষের মধ্যে সমান নয়। তাই আমরা কয়েকজন মানুষকে আমাদের গ্রহে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করতে চাই।"

গং এর কথা শেষ হতেই চোখ দুটো গোল্লা গোল্লা হয়ে গেল ঘেঁটুর। বলে কি এলিয়েনটা, মানুষ ধরে নিজেদের গ্রহে নিয়ে যাবে! আবার আবেগ নিয়ে পরীক্ষা করবে! ঘেঁটুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গং বলল, "আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছে তোমার বয়সী কাউকে নিয়ে যাওয়ার, চলো যাওয়া যাক।"

  "মানেটা কি? আমি তোমার সঙ্গে যাব কেন! আমার বয়েই গেছে। বাড়িতে বলে আমার মা এতক্ষণে কত চিন্তা করছে।"

  "যেতে তো তোমায় হবেই বন্ধু। আমি তোমার অনুমতি চাইছি না, তোমাকে জানাচ্ছি।"

  "আমি কিছুতেই যাবোনা। ইয়ার্কি নাকি… যেতে বললেই যেতে হবে? আমি চললাম, টাটা বাই বাই।" গং এর দিকে হাত নেড়ে পেছন ঘুরতে গেল ঘেঁটু। কিন্তু একি! তার পা দুটো যেন মাটির সাথে আটকে গেছে। প্রবল শক্তিতে ঘুরতে গেল ঘেঁটু কিন্তু পা দুটো তো মাটি ছেড়ে নড়তেই চাইছে না। ঘেঁটুর অবস্থা দেখে খুকখুক করে কিছুক্ষণ হাসল গং। তারপর কৌতুকের স্বরে বলল, "বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই, তোমার পা দুটো এখন বাঁধা। আমার একটা গান শুনে সম্মোহিত হয়ে তুমি এগিয়ে এসেছিলে আর এখন আমার আরেকটা গান তোমার পায়ের স্নায়ুগুলোকে অকেজো করে দিয়েছে, তাই তুমি আর হাঁটতে পারবে না।" কথাগুলো বলতে বলতে ঘেঁটুর দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসতে লাগলো গং, আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল ঘেঁটু…


   আচমকাই কোথাও যেন একটা ধাতব শব্দ হল জোরে, আর সঙ্গে সঙ্গে যে যান্ত্রিক শব্দটা ভেসে আসছিল সেটা বন্ধ হয়ে গেল। চমকে উঠে পেছন ফিরল গং, তারপর ছুটল তার স্পেসশিপের দিকে। ঘেঁটু অনুভব করতে পারল ওর পায়ের বাঁধনটা যেন আর নেই। ছুটে পালাতে গেল ঘেঁটু, কিন্তু পারলোনা, ধুপ করে পড়ে গেল। বাঁধন না থাকলেও পা দুটো ভীষণ দুর্বল হয়ে আছে। গং এর স্পেসশিপের দিকে উঁকি মেরেই চমকে উঠল ঘেঁটু। দেখলো দুটো একই রকম দেখতে বাচ্চা ছেলে সেখানে, একজন গং এর স্পেশশীপের মাথার ওপর দাঁড়িয়ে নাচ করছে আর একজন স্পেসশিপটার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। গং প্রথমে ওদের দেখে খানিক হতভম্ব হয়ে গেল বোধহয়। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে হাতে লাগানো ঘড়ির মত যন্ত্রটার সুইচ টিপল, আর সঙ্গে সঙ্গে লেজার রে'র মত একটা সবুজ আলো ছুটে গেল বাচ্চাটার দিকে, আতঙ্কে চিৎকার করে চোখ বন্ধ করে ফেলল ঘেঁটু। মুহূর্তের মধ্যে একটা আর্ত চিৎকার ভেসে এলো ওর কানে। ঘেঁটু ভয়ে ভয়ে চোখটা খুলেই চমকে গেল, দেখলো বাচ্চাটা বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে খিকখিক করে হাসছে কিন্তু গং এর ওই কুমড়োর মত মাথাটায় চিড়িকবিড়িক করে আগুন জ্বলছে, আর গং চিৎকার করতে করতে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে যাচ্ছ সমানে। স্পেসশিপের মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাটাও একলাফে নেমে পড়ল নীচে। তারপর বাচ্চাদুটো একে অন্যের হাত ধরে গাইতে আর নাচতে লাগল, "দুস্টু পালা পালা… দুস্টু পালা…"

কিন্তু গংও এতো সহজে ছাড়ার পাত্র নয়, আগুনটা আয়ত্তে আসতেই সে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে লেজার রে ছুঁড়ল আর ঘেঁটু অবাক হয়ে দেখল রে'টা বাচ্চাদুটোর গায়ে লেগে আবার প্রতিফলিত হয়ে এসে পড়ল গং এর গায়ে, আবার চিড়িকবিড়িক করে আগুন জ্বলে উঠল। এবার একটা বাচ্চা তার হাতটা ইলাস্টিকের মত লম্বা করে গং এর হাত থেকে খুলে নিল ওই ঘড়ির মত যন্ত্রটা। গং হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আরেকটা বাচ্চা তখন তার হাতদুটো ইলাস্টিকের মত লম্বা করে গং এর মাথাটা ধরে ফেলল, "বাহ্ বেশ নরম তো, এটাকে খাওয়া যাবে!"

 "খেয়ে দেখতে পারিস, তবে বোয়াল মাছের মত টেস্টি বোধহয় হবেনা!"

 "আচ্ছা খেয়েই দেখা যাক না।"

বাচ্চাটার কথা শোনা মাত্রই অদ্ভুত ভাষায় চিৎকার করে উঠল গং; ঘেঁটুর মনে হল গং যেন নিজের মাতৃভাষায় না বলতে চাইছে।

"এটা কি বলছে রে!"

 "বুঝতে পারছিনা ঠিক।"

বাচ্চাদুটোর অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে লাফিয়ে উঠল গং, তারপর সোজা স্পেসশিপে ঢুকে দরজাটা দিলো আটকে…


  গং এর স্পেসশিপটা মহাকাশে মিলিয়ে যেতেই আবার দেখা মিলল চাঁদের। ঘেঁটু আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল বাচ্চাদুটোর দিকে, "আজ তোমরা না থাকলে… তোমাদের কি বলে যে ধন্যবাদ দেবো!"

 "আরে বাবা ধন্যবাদ দিতে হবেনা, এই দুস্টুটা এসে বড্ড জ্বালাচ্ছিল শব্দ করে করে তাই তো আমরা ওকে শায়েস্তা করতে এসেছিলাম।"

 "ওহ, তোমরা থাকো কোথায়? আর তোমাদের হাত দুটো অভাবে লম্বা করছিলে কি করে গো?"

 "আমরা তো বুড়ো বটে থাকি, আর হাত তো আমরা এমনিই এমনিই লম্বা করতে পারি।"

 "ধুরর বুড়ো বটে কেউ থাকে নাকি! আর কই আমি তো হাত তোমাদের মত লম্বা করতে পারিনা!"

 "পারোনা কারণ তুমি মানুষ।"

"মানে? আর তোমরা কি?"

 "আমরা তো ভুতুম ছানা, খটকাই আর পটকাই।"

"ভ… ভুত!"

 "আরে ধুরর বাবা, মানুষদের এই এক জ্বালা ভুতের নাম শুনলেই ভিরমি খায়, তা বলি আমরা তোমাদের কোন পাকা ধানে মইটা দিই শুনি। তোমরা মানুষ তোমাদের মত থাকো আর আমাদের মত, এতে ভয় পাওয়ার কি আছে?"

 "নাহ ভয় পাচ্ছিনা, মানে বলছি তোমরা এতো কচি বয়েসে মারা গেলে কি করে!"

  "উফফ আরেক জ্বালা! তোমরা মানুষরা এতো আত্মকেন্দ্রিক কেন বলতো? সব কিছুতেই নিজেদের কথা ভাবা! মানুষ মরলে ভুত হয় কে বলেছে বলো দিকি তোমাদের? তোমরা যেমন মানুষ আমরা তেমন ভুত। কারুর সাথে কারুর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তুমি চাইলে এখন থেকে বন্ধু হতে পারি আমরা।"

 বন্ধু! ভুতের ছানাদের সাথে বন্ধুত্ব! অবশ্য মন্দটাই বা কি! বঙ্কু বাবুর মত তার তো এলিয়েন বন্ধু হলনা, তারচেয়ে বরং ভুত বন্ধুই বানানো যাক। এই ভেবে একগাল হেসে ডান হাতটা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিল ঘেঁটু…


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract