ধলভূমগড়ের সেই রাত
ধলভূমগড়ের সেই রাত
"উফ,জায়গাটা কি সুন্দর। সত্যিই আদর্শ হানিমুন স্পট। " প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখে একরাশ উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ল রক্তিমার গলায়। "থ্যাঙ্কস ডিয়ার,কে চয়েস করেছে,তা তো দেখতে হবে। " বলে উঠল শুভম,রক্তিমার দীর্ঘদিনের প্রেমিক ও সদ্য হয়ে ওঠা স্বামী। "সত্যিই,এমন সুন্দর জায়গায়,পাহাড়ের বুক চিরে এমন সূর্যাস্তের দৃশ্য,মন মাতাল করে বয়ে চলা ফুরফুরে হাওয়া,সত্যিই আমার ফটোগ্রাফির জন্য এক আদর্শ ল্যান্ডস্কেপ। এককথায়,সুপার্ব।" বলল রক্তিমা।
কলেজের মিষ্টি প্রেমের পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে শুভম আর রক্তিমা। হানিমুন ডেস্টিনেশন হিসাবে উটি,মুন্নার,হিমাচল আর দেবভূমির বদলে বেছে নিয়েছে এই অখ্যাত ধলভূমগড়কে।কোলকাতা থেকে মাত্র দুশো কিলোমিটার দূরত্ব। ছোটনাগপুরের কোলে অবস্থিত আদিবাসী অধ্যুষিত এই স্থানের সৌন্দর্য যে কোনো ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশনকে হার মানায়। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। মাইলের পর মাইল বিস্তৃত শাল-সেগুনের জঙ্গল মনের মধ্যে কবিসত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলে। দিগন্তরেখায় ধূসর পাহাড়শ্রেণীকে ধোঁয়াটে বলে মনে হয়। প্রকৃতি যেন কোনো সুন্দরী নারী। পাথুরে প্রকৃতির বুক চিরে পাহাড়ী নদী ও মাঝে মাঝে সুন্দরী পাহাড়ী ঝরণা জায়গাটার সৌন্দর্য আরোও বাড়িয়ে তুলেছে। শাল গাছে ফুল ধরেছে,থোকা থোকা সাদা সাদা ফুল,প্রকৃতিতে ভাসে নেশা ধরানো মহুয়ার গন্ধ,রাতে বনের গভীর থেকে ভেসে আসে মাদলের বাজনা।এককথায় চিরাচরিত সভ্য জগতের বাইরে কোনো অজানা জগতে প্রবেশ করেছে তারা। আর এখানেই তাদের সম্পর্ক পেয়েছে নতুন স্বাদ,নতুন রঙ। প্রকৃতির সৌন্দর্য যতো তীব্র হয়,মানুষের মনের আবেগ আর অনুভূতিও ততো তীব্র হয়ে ওঠে। শুভমের কবিতা লেখা আর রক্তিমার ফটোগ্রাফির প্যাশন তো আগেও ছিল,আর এখানে এসে ওরা আরোও ভালো করে চিনেছে একে অপরকে। শুভমের জীবনে উষা জাগে রক্তিমার চুম্বনে,সন্ধ্যা নামে রক্তিমার আলিঙ্গনে। কিন্তু,এইসব অনুপম সুন্দর স্থানগুলিতেই মাঝে মাঝে কিছু আদিভৌতিক ঘটনা ঘটে থাকে। উত্তরদিকে বাবলাতলায় টাঁড়,মুণ্ডাদের সাসানডিরি।পড়ন্ত বিকেলবেলায় ফুরফুরে হাওয়ার মধ্যে গেস্টহাউসের ছাদে দাঁড়িয়ে গা শিরশির করে ওঠে রক্তিমার।
বিকেলের দিকে রক্তিম গোধূলিতে মাঝে মাঝে শুভম আর রক্তিমা জঙ্গলের পথ ধরে হাত ধরাধরি করে ফুরফুরে হাওয়া মহুয়ার গন্ধ নিয়ে,যখন কানের কাছে ফিসফিস করে প্রেমের কথা শোনায়-তখন সেই রক্তিম গোধূলিতে একসাথে হাঁটতে বেরোয় শুভম আর রক্তিমা। তবে,এইবিষয়ে গেস্টহাউসের ম্যানেজার প্রমিত পাল আগে থেকেই সাবধান করে দিয়েছেন যে,দিনের আলো পড়ার আগেই গেস্টহাউসে ফিরে আসতে হবে। এই অঞ্চলে অনেক ভয়াল ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে থাকে।
প্রমিত পালের কথায়,"জানেন তো,অনেক বছর আগে এই অঞ্চলে এক তান্ত্রিকা ছিল। কথিত আছে, কালোশক্তি নাকি তার আয়ত্তে ছিল। তার উপাস্য দেবতা ছিল স্বয়ং শয়তান। প্রতি পূর্ণিমারাতে সুন্দরী মোহময়ী রমণী সেজে কোনো না কোনো কামার্ত পুরুষকে বশ করে তাদের আত্মাকে শয়তানের কাছে উৎসর্গ করত সেই তান্ত্রিকা। এর পরিবর্তে সে হয়ে উঠছিল অনন্ত শক্তির অধিকারিণী।" শুভম আর রক্তিমা বলে উঠেছিল- "তারপর!"
"তান্ত্রিকা হয়তো অনন্ত যৌবন আর অমরত্ব আয়ত্ত করেই এনেছিল। জানেন তো,এই এলাকার ওপর রঙ্কিনী মাতার কৃপা আছে। যিনি শক্তি,তিনিই কালী,তিনিই রঙ্কিনী। মাও হয় তো চান নি,শয়তানীর কবলে পড়ে তাঁর সন্তানরা কষ্ট পায়। তাই তো একদিন বর্ষাবাদলের পূর্ণিমারাতে জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যায় সেই তান্ত্রিকা।" স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শুভম বলল-"তাহলে তো বাঁচা গেল!"
প্রমিত পাল বললেন -"সে আর কোথায়! আজও প্রতি রাতে এলাকার মানুষ বাঘডুম্বার আতঙ্কে কাঁপে। তান্ত্রিকার আত্মা মুক্তি পায় নি,বস্তির মুণ্ডাদের মতে সেই এখন বাঘডুম্বায় পরিণত হয়েছে। আর এই বাঘডুম্বা এলাকার মানুষদের কাছে জলজ্যান্ত আতঙ্ক।"
কৌতুহলমিশ্রিত ভীত কন্ঠে রক্তিমা জানতে চাইল,"কিন্তু বাঘডুম্বাটা কি জিনিস। মানুষ না অন্য কিছু।" উত্তরে প্রমিত পাল যা বললেন,চমকে উঠল দুজনেই। "ধরুন তো চাঁদের আলোয় কোনো যুবকের সামনে একজন মোহময়ী রমণী যদি হঠাৎই হিংস্র বাঘিনীতে পরিণত হয় ,তাহলে কেমন হবে! এই হল বাঘডুম্বা। আধা নারী,আধা বাঘিনী। এই অঞ্চলের মানুষদের কাছে এক বিভীষিকা। আর আপনারা আমার কথায় অবিশ্বাস করতে পারেন,মুণ্ডা বস্তিতে গিয়ে খোঁজ নিন-এর কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীও আছে। রঙ্কিনী মায়ের কৃপায় বাঘডুম্বার হাত থেকে বেঁচে গেছে।"
"রোজ রাতেই নাকি বাঘডুম্বা বেরোয়,তবে আতঙ্ক সবচেয়ে বেশি থাকে পূর্ণিমারাতে। পূর্ণিমারাতে কোনো না কোনো হতভাগ্য বাঘডুম্বার শিকার হয়েই থাকে।"
শুভমের মনে পড়ল,আগামী কাল শনিবার। তায় পূর্ণিমা। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল শুভমের।
পরের দিন শনিবার। পাহাড়ের বুক চিরে চতুর্দিকে রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিবাকর অস্তাচলে যাচ্ছেন । পুবাকাশে গোলাকার পূর্ণচন্দ্র। চারদিকে মহুয়ার তীব্র গন্ধ প্রকৃতিতে নেশা ধরাচ্ছে। একটু পরেই সাঁওতালদের মাদল শুরু হবে। আজ গেস্টহাউসে ফেরার কোনো ইচ্ছা নেই শুভমের,রক্তিমার হাত ধরে অরণ্যের মধ্যে হারিয়ে যেতে চায় সে। অরণ্যের মধ্যেই,মুক্ত আকাশের তলায়,চাঁদের রূপোলী আলোয় সুস্তনী রক্তিমাকে করে নিতে চায় আপন,একান্তই আপন। প্রমিত পালের কথায় সে আর রক্তিমা কেউই বিশ্বাস করে নি,হাসাহাসি করেছে, মুণ্ডাদের জগতে কতোই না গালগল্প চলে,প্রমিত পালের মতো শিক্ষিত রুচিবান মানুষ এসবে বিশ্বাস করছেন-এটা ভেবেই অবাক লাগছে।
রোজই বিকালের হলুদ আলোয় তারা বনের মধ্যে দিয়ে লাল সুরকি বিছানো পাথুরে পথে হাঁটতে বেরোয়,কিন্তু আজ আর গেস্টহাউসে ফেরার কোনো ইচ্ছা নেই। আজ এই মন মাতাল করা ফুরফুরে বাতাসে,রূপোলী চন্দ্রালোকে,নক্ষত্রখচিত আকাশের নীচে রক্তিমার সাথে রাত কাটাতে চায় সে। আজ রক্তিমার চাহনি তার মনে কামনার বহ্নিশিখা জাগিয়ে তুলছে,রক্তিমার হাতের নরম স্পর্শ তাকে পাগল করে দিচ্ছে,মনে হচ্ছে গাঢ় আলিঙ্গনে চুম্বনে রক্তিমার রক্তাভ ওষ্ঠাধরের সমস্ত রস শুষে নেবার,তার বুকের প্রতিটি হৃদস্পন্দন অনুভব করার,সবুজ বনানীকে সাক্ষী রেখে রক্তিমাকে আপন করে নেবার। মাথার ওপর পূর্ণচন্দ্র যেন প্রেমের সঙ্গীত গাইছে।
মোহভঙ্গ হল সেলফোনের রিং এর শব্দে।রক্তিমার গলা,"শুভম তুমি কোথায়,মনে নেই প্রমিতবাবুর কথা,আরে বাবা বাঘডুম্বা না থাকুক,নেকড়ে কিংবা হায়না তো থাকতে পারে। আজ তো আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম,তুমি তো আমাকে ছাড়াই বেরিয়ে গেলে!"
কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল শুভম ,"কিন্তু তুমি।" ওপার থেকে রক্তিমার মনে হল,"আরে,তুমি যখন প্রমিতবাবুর সাথে কথা বলছিলে,তখন আমি ছাদে গেছিলাম খাওয়া দাওয়ার পর। আশ্চর্যের ব্যাপার হল,ওখানেই কেমন যেন তন্দ্রাভাব চলে এল। কোনোদিন এরকম হয় না। নীচে এসেই দেখি,তুমি বেরিয়ে গেছ।"
"কিন্তু!"
"কোনো কিন্তু নয়,প্রমিতবাবু খুব টেনশন করছেন,আমারও মন কেমন কু-ডাক ডাকছে আজ। প্লিজ,তাড়াতাড়ি ফিরে এস।"
ফোন ছেড়ে দিল রক্তিমা। শুভমের ভয়ে হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হবার উপক্রম। যে ফোন করেছে সে যদি রক্তিমা হয়,তাহলে হুবহু রক্তিমার রূপ ধরে এতক্ষণ যে তাকে সিডিউস করে এতোটা পথ ভুলিয়ে নিয়ে এসেছে,সে কে! আদৌ মানুষ ,না অন্য কিছু! পৃথিবীর বুকে অন্ধকার নেমে এসেছে,চাঁদের আলোয় বিশ্বচরাচরকে অপার্থিব লাগছে,কাছাকাছি কোথা থেকে শকুনি ডেকে উঠল।
আরে,তার সাথে রক্তিমার রূপ ধরে এতক্ষণ যে মোহময়ী নারী ছিল,সে এরকম বদলে যাচ্ছে কেন। চেহারা আয়তনে বাড়ছে,চোয়ালের গোড়া থেকে ঝিলিক মারছে একজোড়া ধারালো শ্বদন্ত,হাত পায়ের আঙুলগুলো লম্বা হয়ে বেঁকে যাচ্ছে আর তাতে গজিয়ে উঠছে ধারালো নখর,কান লম্বাটে ও সূঁচালো হয়ে যাচ্ছে,পোষাক ছিঁড়ে যাচ্ছে আর রোমযুক্ত শরীরে গজিয়ে উঠছে হলদেটে কালো ডোরা। এতক্ষণে যে ভয়টা বুকের মধ্যে চেপে বসে ছিল,সেটাই আর্তনাদ হয়ে বেরিয়ে এল শুভমের মুখ থেকে।
অভিশপ্ত উত্তর-পশ্চিমের পাহাড়তলি থেকে বাঘডুম্বার রক্ত জল করা বিভীষিকাময় হিংস্র গর্জন শুনে কেঁপে উঠল রক্তিমা। অভিজ্ঞ প্রমিত পালের বুঝতে বিলম্ব হল না,চাঁদনি রাতে বাঘডুম্বা আবার নিজের হতভাগ্য শিকারকে খুঁজে পেয়েছে।