দেওঘরের স্মৃতি
দেওঘরের স্মৃতি
আমার ছোটবেলায় ক্লাস ফোরে পড়ার সময়ই জেনেছিলাম বৈদ্যনাথ ধাম সম্পর্কে। কথিত আছে,এই জ্যোতির্লিঙ্গ একটা কারণেই অন্য জ্যোতির্লিঙ্গ গুলির তুলনায় অনন্য। কারণ এটা শিবের আত্মলিঙ্গ। কথিত আছে,রাবণের পরম ভক্তি আর চরম তপস্যায় খুশি হয়ে দেবাদিদেব মহাদেব রাবণকে এই আত্মলিঙ্গ দিয়েছিলেন। পরে সেটা পুষ্পকে করে লঙ্কায় নিয়ে যাবার সময় দেবতারা আতঙ্কিত হয়ে বিশ্বপালক শ্রীহরির কাছে এলে তিনি তাঁর সুদর্শন দিয়ে দিবাকরকে ঢেকে ফেলেন। এতে রাবণের মনে হয় পৃথিবীর বুকে সন্ধ্যা নেমেছে,এটা তার সান্ধ্যকালীন আরাধনার সময়। তিনি নিচে নেমে এসে স্থানীয় এক গোপালকের হাতে সেই পবিত্র আত্মলিঙ্গকে দিয়ে সন্ধ্যারতিতে মগ্ন হন। মহাদেবের আত্মলিঙ্গ,মাতা পার্বতী দ্বারা পূজিত,তার ভার সহ্য করার ক্ষমতা কারোর ছিল না,সেটাকে সেই ভোজপুরী গোপালক এই কারণেই ধারণ করতে পেরেছিলেন কারণ তিনি স্বয়ং সিদ্ধিদাতা গণেশ। এদিকে সুদর্শন সূর্যকে আর কতোক্ষণ ঢেকে রাখবে,প্রকৃতির নিয়ম যে ভঙ্গ হচ্ছে। দেবতারা চান,রাবণ যাতে আত্মলিঙ্গ নিয়ে লঙ্কায় না ফিরতে পারেন। এদিকে রাবণ স্বয়ং মহাদেবের আশীর্বাদপ্রাপ্ত,তাঁর বিরুদ্ধাচরণ মানে স্বয়ং মহাদেবের বিরুদ্ধাচরণ। এদিকে স্বয়ং পার্বতীও চান নি রাবণ আত্মলিঙ্গ নিয়ে লঙ্কায় যান,কারণ আত্মলিঙ্গ একবার লঙ্কার ভূমি ছুঁলে পার্বতী স্বয়ং স্বর্ণলঙ্কা ধ্বংসের যে অভিশাপ দিয়েছিলেন,সেই অভিশাপ থেকে লঙ্কার মুক্তি ঘটবে। মহাদেব রাবণের হাতে এই পবিত্র লিঙ্গকে তুলে দেওয়ায় তিনি মহাদেবের উপরও রুষ্টা হন। তিনি গণেশের কাছে এসে নিজের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। মাতৃভক্ত গণেশ সেই লিঙ্গকে তখন ভূমিতে স্থাপন করেন। এরপর সেখানে প্রকট হন স্বয়ং মহাদেব। গণেশ আর বিষ্ণুর উদ্যোগে স্বামী স্ত্রীর বৈরীভাব লয়প্রাপ্ত হয়,আবার জন্মায় প্রেম। শিব তখন আত্মলিঙ্গকে নিজের অনন্য জ্যোতি প্রদান করেন,তখন সেই লিঙ্গের নাম হয় বৈদ্যনাথ। এই বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ থেকেই শিবভক্তির একটি নতুন ধারার সূত্রপাত হয়,ভূতডামরতন্ত্র। যাই হোক,তখন আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। বাবা মায়ের সাথে দূর কোথাও বেড়াতে যাই নি। যাই হোক,ভালোই চলছিল। স্কুলে গরমের ছুটি পড়েছে,স্কুল বন্ধ। আমিও আগে থেকে কিছুই জানি না। শনিবার দিন,আমার কাছে শনিবার মানেই ভূতের সিরিয়াল দেখা। শনিবারের এক আলাদা মহিমা। যাই হোক,খেয়েদেয়ে ঘুমালাম। হাল্কা শীত শীত পড়ছে। শেষরাতে বাবা রীতিমতো জোর করে ডেকে তুললেন ঘুম থেকে। ব্যাপার কি,দেখি মাও রেডি। সুটকেস গোছানো। শুনলাম আমরা যাচ্ছি দেওঘর। আমি ভাবছি এতো সকালে হাওড়া যাবার গাড়ি এই নাটাগড় থেকে কোথায় পাব,পরে বাবা একটা অটো ভাড়া করলেন। হাওড়া না,আমরা যাচ্ছি খড়দহ। সেখান থেকে ধরব হাওড়া-মজঃফরপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার।যাই হোক,উষাকালে পুবদিক সবে ফর্সা হতে শুরু করেছে। স্টেশনে ট্রেন এসে থ
ামল। তখনকার দিনের সেই নব্বই দশকের লালরঙা ট্রেন। আমার এই ট্রেনগুলোয় চড়তে দারুণ লাগত,এক অন্যরকম ফিল হতো,কেমন যেন মনে হতো সুদূর আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমি সুদূরের পিয়াসী। যাই হোক,ট্রেনে ভালোই ভিড়। আসানসোল পেরনোর পর বসার জায়গা পেলাম। বেলা একটার দিকে নামলাম জসিডি,আমার বাবা চিরকালই ফটো তোলার পাগল। জসিডি স্টেশনেই বাবার ব্যাগ থেকে বেরিয়ে গেছে ক্যামেরা।যাই হোক,জসিডি থেকে কুঝিকঝিক ডিজেল ট্রেনে বৈদ্যনাথ ধাম স্টেশন। যাই হোক,প্রথম দিনেই আমরা দর্শন করলাম বৈদ্যনাথ মন্দির।তারপর আমার বাবার বেড়াতে যাওয়া মানেই সেখানে চিকেন চাইই চাই। আমরা যে ধর্মশালায় উঠেছি সেখানে আবার নন ভেজ চলবে না। পয়সাটাও নাকি কম নিচ্ছে না থাকার আর মন্দির দেখানোর। বাবা জড়িয়ে পড়লেন পাণ্ডাদের সাথে কথা কাটাকাটিতে,সে দেখা এক অপূর্ব মুহূর্ত। আর দেওঘরে এলে এখানকার গম্বূজঘড়ি টাও বিখ্যাত। পরের দিন আরোও উত্তেজনার মুহূর্ত। প্রথমবার চড়লাম ঘোড়ায় টানা এক্কা গাড়িতে।লাল মাটির পাথুরে রাস্তায় কি ঝাঁকুনি!
চারদিকে তদানীন্তন বিহার প্রদেশের সবুজ পাহাড় আর জঙ্গল।প্রথম গন্তব্য,নন্দন হিলটপ। বাবার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠলাম নন্দন পাহাড়ে সেখানে শিবমন্দিরের দৃশ্য,ফুরফুরে হাওয়ায় আশপাশের সবুজ ল্যান্ডস্কেপ,পাহাড়ের নিচে পরিখা-এসব দর্শনের স্মৃতি ভোলার নয়। প্রকৃতির বুকে যেন নেমে এসেছে একচিলতে স্বর্গ। নিচে দাঁড়ানো এক্কাগাড়ি আর গাড়োয়ানকে ছোট বিন্দুর ন্যায় দেখাচ্ছে।এটাই আমার প্রথম পাহাড়ে চড়ার স্মৃতি।ফুরফুরে হাওয়ার মধ্যে নীল আকাশের তলায় বাবা মায়ের সাথে কাটানো এই মুহূর্তগুলি আজও স্মৃতিপটে রঙিন হয়ে আছে।
যাই হোক,এ দিল মাঙ্গে মোর। দিগন্তে হাতছানি দিচ্ছে ধূম্র রহস্যময় সবুজে ঘেরা আরোও উঁচু,আরোও দুর্গম ত্রিকূট পাহাড়। এখানে নাকি প্রাচীনযুগে ঋষিদের তপোবন ছিল। আমি আর তখন এইযুগে নেই,ফিরে গেছি সেই রামায়ণ মহাভারতের যুগে। ভাবছি সত্যিই এবার দিব্যক্ষমতাসম্পন্ন ঋষিদর্শন হবে।
জোর বায়না ধরলাম,যাবই ত্রিকূট পাহাড়ে। মা সোজা নাকচ করল,না ,হবে না। কিন্তু বাবাও নাছোড়বান্দা। শেষমেষ বাবার হাত ধরে উঠলাম ক্রিকুট পাহাড়ে ।তখন রোপওয়ে হয় নি। চারদিকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতার পরিবেশ। সেই অখণ্ড নীরবতা পথিককে সাহায্য করে অরণ্যসঙ্গীত শ্রবণ করতে।
উঠতে উঠতেই রোদ পড়ে এল। তখনোও আমরা হিলটপে পৌঁছাইনি। আশ্রম দর্শনের সৌভাগ্য হয়েছিল। কিন্তু বাবার হাত ধরে ত্রিকুট পাহাড়ে দাঁড়িয়ে যে পাহাড় জঙ্গলের সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ প্রতিভাত হয়েছিল, তা এখনোও স্মৃতিপটে নতুন হয়ে রয়ে গেছে। সেদিন থেকেই আমি প্রকৃতিপ্রেমী!
এরপর বাবা মায়ের সাথে অনেক রঙিন মুহূর্ত কাটিয়েছি। কিন্তু দেওঘরের স্মৃতি সত্যিই অনন্য,সত্যিই সেরা।