দ্বেষ
দ্বেষ
১
মাঝরাতে বুকের ওপর অসম্ভব একটা চাপ লাগতেই ঘুমটা ভেঙে গেল তিমিরের। গরমও লাগছে বীভৎস। রিমোট নিয়ে এসিটা অন করতে গিয়ে দেখলো সেটা চলছেনা, ধুত্তোর বলে রিমোটটা ছুঁড়ে দিলো খাটের একপাশে। ফ্যানটা ফুল স্পিডেই চলছিল তাও কিসের যেন আশায় রেগুলেটরটা ধরে নাড়ানাড়ি করল বার কতক, নাহ ফ্যানের গতির কোনো পরিবর্তন হলোনা। গায়ের স্যান্ডো গেঞ্জিটাকে খুলে দিয়ে গুম হয়ে বসে রইল বেশ খানিকক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে তাক থেকে ডায়াভলটা পেড়ে গলায় ঢেলে নিলো দু’ছিপি। সে নিশ্চিত আজকের পাঞ্জাবী ধাবার ঘিয়ে ভাজা আলুর পরোটা আর আচারেরই কারসাজি এসব।
২
বাড়িটায় ঢুকতেই একটা উৎকট গন্ধ এসে ঝাপটা মারলো ত্রিলোকেশের নাকে, এ গন্ধ তাঁর চেনা। বার কয়েক জোরে জোরে শ্বাস টেনে গন্ধটা ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করলেন ত্রিলোকেশ। নাহ লোকটা তবে ঠিকই বলেছিল, এই বাড়িতে কিছু একটা সত্যিই আছে।
গতকাল একটু বেলার দিকে আচমকাই ত্রিলোকেশের বাড়িতে হানা দেয় লোকটা। ওর এই কঙ্কালসার চেহারা, ভেতর দিকে ঢুকে যাওয়া গোল, কোটরাগত চোখ আর তার নীচে অসম্ভব রকমের পুরু কালির আস্তরণ দেখে তো রীতিমতো ঘাবড়ে যায় ত্রিলোকেশের নাতনি রাই। নাতনির ব্যস্ত ডাকে ত্রিলোকেশ বাইরের ঘরে আসতেই লোকটা কোনো ভূমিকা ছাড়াই বলে ওঠে তার বাড়িতে নাকি অশরীরী উপদ্রব শুরু হয়েছে, ত্রিলোকেশকে সেই উৎপাত বন্ধ করতে হবে। লোকটার কথা বলার মধ্যে এক অদ্ভুত ঔদ্ধত্য ছিল যা দেখে অবাক হয় ত্রিলোকেশ; তাই স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে তিনি কোনো ওঝা বা তান্ত্রিক নন, তাঁর পক্ষে এসব বন্ধ করা সম্ভব না। লোকটা কিছু বলতে গিয়েও যেন আটকে যায়, কয়েক সেকেন্ড এক দৃষ্টিতে ত্রিলোকেশের দিকে তাকিয়ে থেকে শুকনো গলায় বলে, “আপনার সম্বন্ধে তাহলে ভুল শুনেছিলাম। সরি টু ডিস্টার্ব ইউ। চলি।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে সাহেবী কেতায় কর্মরদনের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয় লোকটা। ত্রিলোকেশ লোকটার হাত স্পর্শ করতেই চমকে ওঠেন, তাঁর মাথার মধ্যে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি শুরু হয়। চট করে হাতটা ছেড়ে দিয়ে কয়েকবার জোরে জোরে নিশ্বাস নেন তিনি। তাঁর স্পষ্ট মনে হয় লোকটার মধ্যে কিছু একটা অস্বাভাবিকত্ব নিশ্চয় আছে যা তাঁর অচেনা। লোকটা বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ত্রিলোকেশ তাঁকে ডেকে ওঠেন, “আপনি আমার কথা কোথার থেকে জেনেছেন?”
“ডাঃ অম্বরিশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেনেন?”
“হ্যাঁ, ওর দাদা তো আমার গুরুভাই ছিলো।”
“ওহ। অম্বরিশ বাবুই আমাকে আপনার কাছে আসতে বললেন।”
“অম্বরিশ বলেছে! আগে বলবেন তো। আসুন বসুন।”
লোকটা আপত্তি না করে বসে পড়ে সোফায়। ত্রিলোকেশ জানতে পারেন লোকটার নাম তিমিরবরণ সরকার। বয়েস বলে বছর তিরিশেক, যদিও ওর বর্তমান চোখ মুখ দেখে বয়েস আন্দাজ করা খুব শক্ত। লোকটা খুব কম কথা বলে, তাই কথা বলে বিশেষ সুবিধা করতে না পেরেই আজ ত্রিলোকেশের এই বাড়িতে আগমন।
“আপনি বাড়িতে একাই থাকেন?”
“হুমম।”
“আপনার স্ত্রী…?”
“বিয়ে করিনি।”
“ওহ।”
ত্রিলোকেশ খেয়াল করে এই তিমিরবরণ লোকটা কেমন যেন, অদ্ভুত একটা ঔদ্ধত্য আছে ওর মধ্যে। নেহাত অম্বরিশ ওকে পাঠিয়েছে আর তাছাড়া ওকে স্পর্শ করতে যে অনুভূতিটা হয়েছিলো সেটার সম্বন্ধে বিশদে জানার লোভটাও ত্রিলোকেশ সামলাতে পারেননি কিছুতেই, কিন্তু লোকটার আচরণ তাঁর মোটেই ভালো লাগছে না।
“ডাক্তাররা বলছেন সব নাকি আমার মানসিক রোগ।” আচমকা বলে উঠল লোকটা।
ত্রিলোকেশ গম্ভীর ভাবে উত্তর দিলেন, “বোধহয় না। আমি যতদূর বুঝেছি বাড়িতে অশুভ ছায়া নিশ্চয় আছে।”
তিমিরের সাথে ছাদসহ পরপর সব কটা ঘর ঘুরে দেখলেন ত্রিলোকেশ। বড় বড় চারটে রুম, বাথরুম, রান্নাঘর আর ডাইনিং। বেশিরভাগ আসবাবই একতলার ঘরে, দোতলার ঘরগুলো প্রায় ফাঁকা বললেই চলে। ছাদের উপর একটাই ঘর, তিমিরকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল সেটা গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তিমির জানতে চাইল গোডাউনটা খুলবে কিনা, ত্রিলোকেশ মাথা নেড়ে না বললেন কেননা যত ওপরের দিকে যাচ্ছিলেন সেই অদ্ভুত আঁশটে গন্ধটা ততই কমে যাচ্ছিল। একতলার ঘরগুলো আরেকবার ভালো করে দেখতে চাইলেন ত্রিলোকেশ, দক্ষিণ দিকটায় ঘরটায় এসে টের পেলেন এই ঘরে গন্ধটা সবচাইতে বেশি তীব্র।
“এই ঘরটা কোন কাজে ব্যবহার করা হয়?”
“আগে আমার মা থাকতেন, তারপর থেকে কোনো গেস্ট এলে…”
“হুমম। রিসেন্ট কোনো গেস্ট এসেছিলেন কি?
কি হলো তিমির? চুপ করে গেল কেন?”
“এসেছিল।”
“কে?”
“বলাটা কি খুব দরকার?”
“হ্যাঁ। কারণ আমার ধারণা গন্ডগোলটা আসল উৎস এই ঘরেই কোথাও লুকিয়ে আছে।”
ত্রিলোকেশের কথায় চমকে উঠলো তিমির। তারপরেই জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে ধপ করে বসে পড়ল খাটে, খাটের স্ট্যান্ডটা শক্ত করে ধরে নিয়ে অস্ফুটে বলে উঠলো, “মাই গড!”
“তিমির কোনো কথা গোপন কোরো না। আমার মনে হচ্ছে কিছু ব্যাপার নিশ্চয় আছে যা তুমিও বুঝতে পারছো। বলো সব। কে এসেছিল বাড়িতে?”
“আমার মায়ের বড় ছেলে।”
“মায়ের বড় ছেলে! মানে তোমার দাদা?”
“নাহ সে আমার দাদা নয়। আমার মায়ের ছেলে। আমার মায়ের প্রথম বিয়ের সন্তান।”
“ওহ আই সি।”
“তা তিনি কি প্রায়ই আসেন নাকি আচমকাই এসেছিলেন?”
“আচমকাই।
আমি জানি ও এসব কেন করছে।”
“কেন?”
“সম্পত্তির লোভে। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর বাবার সব সম্পত্তি মা পায়। তখন থেকেই ও মায়ের পেছনে লেগেছিল।”
“উনি কোথায় থাকেন? কি করেন?”
“কোথায় থাকে জানিনা তবে পেশাটা শুনলে চমকে উঠবেন।”
“তাই নাকি?”
“হুমম। সে তান্ত্রিক।”
“সেকি এ কথা তুমি আগে বলোনি কেন আমায়?”
“মাথায় আসেনি যে এসবের সাথে ওর যোগ থাকতে পারে।”
তিমিরকে কোনো উত্তর না দিয়েই ঘরটা আবার তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলেন ত্রিলোকেশ। কিন্তু সব চেষ্টাই বৃথা, কোথাও কিছু পেলেন না বিশেষ।
“আচ্ছা তিমির উনি যাওয়ার পর এই ঘর থেকে কোনো কিছু কি পেয়েছিলে যা তোমার নয়। খুব তুচ্ছ কোনো জিনিস হলেও বলো।”
“মনে পড়ছে না সেরকম কিছু।”
“ভালো করে মনে করো।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। ঘরের কোণে একটা চাঁপা ফুল পেয়েছিলাম। যেহেতু আমাদের আশেপাশে কোনো চাঁপা গাছ নেই তাই ব্যাপারটা অদ্ভুত লেগেছিল।”
“সর্বনাশ। সেই ফুলটা কোথায়?”
“সুন্দর গন্ধ ছড়াচ্ছিল বলে কদিন আমার বেডরুমের তাকে রেখেছিলাম তারপর শুকিয়ে যেতে ফেলে দিই।”
“কোথায় ফেলেছো?”
“এমনি ঘর ঝাঁট দেওয়ার সময় ফেলি। একদম শুকিয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছিল…”
“নিশ্চয় ওর থেকেই সব গন্ডগোলের সূত্রপাত। ওকে বিদায় না করতে পারলে… তোমার দাদা কোথায় থাকে?”
“জানিনা।”
“ওনাকে পাওয়া গেলে কিছু একটা ভাবা যেত। ওনার নাম কি?”
কয়েক সেকেন্ড কি যেন ভেবে নিয়ে তিমির কেটে কেটে উত্তর দিলো, “জটিলেশ্বর নাথ।
মেসোমশায় এখন কি হবে? অন্ধকার নামলেই যে এখন বুক ঢিপঢিপ করে।”
“ভয় পেয়ো না। তবে আমায় ভাবতে সময় দাও, এমন ঘটনার সাথে আমার পরিচয় বিশেষ নেই।
তুমি এক কাজ করো এই যে একমুখী রুদ্রাক্ষের মালাটা দিচ্ছি এটা গলায় পরে নাও। আশা করি এটা তোমায় রক্ষা করবে আজ রাতে।”
৩
ঘুমটা বরাবরই পাতলা ত্রিলোকেশের, একটুতেই ভেঙে যায়। আজ তখন রাত আন্দাজ আড়াইটা হবে, আচমকাই ঘুম ভেঙে গেল তাঁর। বুকের ওপর কেমন যেন একটা চাপ অনুভূত হচ্ছে। চোখ মেলে চারদিকে তাকালেন তিনি, নাইট ল্যাম্পের মৃদু আলোয় দেখলেন কোথাও কেউ নেই। কিন্তু বুকের চাপটা ক্রমশ বাড়ছে, যেন কেউ একটা চেপে বসেছে বুকে। নিঃশ্বাস নিতও কষ্ট হচ্ছে যেন, তিমির কি ঠিক এই ধরণের চাপের কথাই বলেছিল! কথাটা মনে হতেই চমকে উঠলেন ত্রিলোকেশ। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তাঁর, কিন্তু তাও অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে গুরুদেবের মন্ত্র পড়তে লাগলেন তিনি। প্রায় ঘন্টা খানেক একটানা মন্ত্রোচ্চারণের পর মনে হল যেন চাপটা উধাও হয়েছে অবশেষে। খাটে উঠে বসলেন ত্রিলোকেশ, জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ছে তাঁর। এমন কিছু ঘটতে পারে তাঁর কল্পনাতেও আসেনি। তিমিরকে দাদার তন্ত্র এতো শক্তিশালী! নাকি এর পেছনে আছে আরও গভীর রহস্য!
অনেকক্ষণ বসে থাকার পর আবার চোখ দুটো লেগে এসেছিল ত্রিলোকেশের, কিন্তু আচমকাই ফোনটা আর্তনাদ করে উঠলো। ভ্রু কুঁচকে গেল তাঁর, এই মাস ছয়েক হয়েছে এই যন্ত্রটা সুনন্দ গুঁজে দিয়েছে তাঁর হাতে কিন্তু এখনো তিনি এটার ব্যবহারে ঠিকমতন সড়গড় হতে পারেননি; আর তাই প্রায়শঃই ওটা এখানে সেখানে রেখে ভুলে যান। কিন্তু এতো ভোরে কে ফোন করতে পারে! ভাবতে গিয়েই হঠাৎ খেয়াল পড়ল কাল তিমিরকে তাঁর নাম্বারটা দিয়ে বলে এসেছিলেন প্রয়োজনে ফোন করতে, সেই নয় তো! চটজলদি এদিক সেদিক তাকিয়ে ফোনের বাজনাটার উৎস সন্ধান করতে গিয়ে ত্রিলোকেশের খেয়াল হল কাল তিমিরের বাড়ির থেকে ফেরার পর পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোনটা তো বেরই করেননি। আলনায় ঝুলছিল পাঞ্জাবিটা, পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোনটা বের করতে যেতেই চমকে গেলেন ত্রিলোকেশ। এ কি! তাঁর পকেটে এরকম শুকনো মাটি এলো কোথা থেকে! ফোনটাও একবার কেটে গিয়ে আবার বাজতে শুরু করেছে। কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে ফোনটা ধরলেন ত্রিলোকেশ। যা ভেবেছিলেন তাই, অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো তিমিরের গলা, যে গলায় মিশে আছে একরাশ ভয়, “মে… মেসোমশাই আমাকে বাঁচান…”
“কি হয়েছে তিমির?”
“কাল আবার ও এসেছিল আর আপনার দেওয়া মালাটা…”
“কি হয়েছে কি?”
“আপনার দেওয়া মালাটার জায়গায় দেখি এক দলা মাটি।”
“কি! মালাটা তোমার গলায় ছিলো না?”
“না… মানে শুতে অস্বস্তি করছিল তাই…”
“উফফ… এমন মারাত্মক ভুল কেউ করে?”
“মেসোমশাই আপনি প্লিজ আসুন, আমার খুব ভয় করছে।”
“আসছি, তবে এখন গিয়ে কতটা লাভ হবে জানিনা।”
ফোনটা রেখে একটা পাঞ্জাবী গলিয়ে বেরিয়ে এলেন ত্রিলোকেশ। গোটা বাড়িটা এখনও নিস্তব্ধ, ছাদের ওপর এই সবে ভোরের পাখিদের গান শুরু হয়েছে। উঠোনে নামতেই দেখতে পেলেন সার্থক এক্সারসাইজ করতে ব্যস্ত। তাঁকে দেখতে পেয়েই একগাল হেসে সে বলল, “গুড মর্নিং দাদু, কোথায় চললে সকাল সকাল?”
“একটা কাজে রে।”
“এতো সকালে! তুমি ভুলে যাচ্ছ তোমার বয়েস হচ্ছে!”
“আরে সেই জন্যই তো, আর কটা দিনই বা বাঁচবো! যতদিন বাঁচি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে থাকি।”
“উফফ দাদু তোমার সঙ্গে পারব না।”
মুচকি হেসে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন ত্রিলোকেশ, হঠাৎ কি মনে হতে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “একটা কাজ করে দিতে পারবে দাদা?”
“কি কাজ?”
“একজনের খোঁজ করার চেষ্টা করতে হবে।”
৪
সন্ধ্যের অন্ধকারটা নামতে তখনও মুহূর্ত কয়েক বাকি। কয়েকটা পাখি ডানা ঝটপটিয়ে বাসায় ফিরতে ব্যস্ত, তাদের দিকে ক্ষনিকের জন্য তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ত্রিলোকেশ। তারপর শরীরটাকে খানিক টেনে নিয়ে এসে দাঁড়ালেন বাড়িটার দরজায়, চোখ বন্ধ করে কিছু যেন টের পাওয়ার চেষ্টা করলেন খানিকক্ষণ, দিয়ে আস্তে আস্তে চোখ খুলে চাপ দিলেন কলিংবেলে। মিনিট খানেকের মধ্যেই খুলে গেল দরজা। ত্রিলোকেশকে দেখে চমকে উঠলো তিমির, “মেসোমশাই এ কি অবস্থা হয়েছে আপনার! শরীর খারাপ নাকি?”
মৃদু হেসে ত্রিলোকেশ উত্তর দিলেন, “ওই আর কি। তা তিমির আজ রাতটা আশ্রয় দেবে তোমার বাড়িতে?”
“মানে?” অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল তিমির।
“আজ একটা হেস্তনেস্ত করতে চাই, তাই...”
“সত্যিই…! ভেতরে আসুন।” ত্রিলোকেশকে ভেতরে আনতে ব্যস্ত হল তিমির।
ভেতরে ঢুকে ত্রিলোকেশ ধীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “এই দুদিন কি সে এসেছিল?”
“কি?” ক্ষনিকের জন্য চমকে উঠল তিমির, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “না, আসেনি।”
“তাহলে তুমি সে খবর আমায় দিলে না কেন?” দৃঢ় গলায় জিজ্ঞেস করলেন ত্রিলোকেশ। আবার একবার চমকে উঠলো তিমির, তারপর আমতা আমতা করে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করল, “না মানে…”
“থাক আর কিছু বলার দরকার নেই।” তিমিরকে থামিয়ে দিলেন ত্রিলোকেশ, “আর সে যাতে না আসে সেই ব্যবস্থাই করব।”
ঘড়ির কাঁটা রাত দু’টা ছুঁই ছুঁই। দক্ষিণ দিকের ঘরটার খাটে টানটান হয়ে শুয়ে পড়লেন ত্রিলোকেশ। তিনি জানেন এবার সে আসবে, নিশ্চিত সে আসবে। বিগত তিনদিন ধরে এই সময়টাতেই তো আসে সে। এক… দুই… তিন… অপেক্ষার একেকটা প্রহর যেন মনে হচ্ছে এক এক যুগ। রুদ্ধশ্বাসে চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করছিলেন ত্রিলোকেশ; হঠাৎ কোথায় যেন একটা রাত পাখি কর্কশ স্বরে ডেকে উঠলো আর সঙ্গে সঙ্গে ত্রিলোকেশ নিজের বুকের ওপর এক অসম্ভব চাপ অনুভব করলেন, ঠিক যেন কেউ চেপে বসেছে বুকে। আস্তে আস্তে চোখের পাতা একটু ফাঁক করলেন তিনি, আলো আঁধারিতে দেখতে পেলেন বুকের ওপর চেপে বসেছে এক নারী অবয়ব। প্রচন্ড জিঘাংসা নিয়ে সে তাকিয়ে আছে ত্রিলোকেশের দিকে যেন আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে তার শরীর। ত্রিলোকেশের বিশ্বাস ছিলো এই বাড়িতে এলে তাকে চোখে দেখতে পাবেন, কেননা এই তো তার আস্তানা। প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিলেন তাই, বুকের ওপর প্রচন্ড কষ্টের মধ্যেই খাটে ছড়ানো বাম হাতটা একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে মুঠোর মধ্যে ধরে ফেললেন সেই জিনিসটা; তারপর এক ঝটকায় সেটাকে টেনে এনে ছুঁইয়ে দিলেন ওই অশরীরির গায়ে। প্রচন্ড আর্তনাদ করে সে ছিটকে পড়ল ত্রিলোকেশের শরীর থেকে তারপর ছটফট করতে করতে গলতে শুরু করলো সেই অবয়ব। আস্তে আস্তে একটা গাঢ় তরলের আকারে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল সেটা, তারপর মেঝের মধ্য মধ্য দিয়ে ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে নীচে ঢুকে যেতে লাগলো, যেন মেঝের মধ্যে কোনো ফাটল রয়েছে যার ভেতর দিয়ে সেটা প্রবেশ করল নিচে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোয় কয়েক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব করে দিলো ত্রিলোকেশকে। সম্বিৎ ফিরতেই খাট থেকে নামতে গেলেন তিনি আর তৎক্ষণাৎ বুকের ওপর এক অদ্ভুত যন্ত্রনা অনুভূত হলো। কঁকিয়ে উঠলেন ত্রিলোকেশ, তাঁর মনে হল কেউ যেন ধারালো ছুরি ঘোরাচ্ছে তাঁর বুকে। তাঁর গুরুদেবের তাবিজটা সুদ্ধ বাম হাত দিয়ে বুকটা চেপে ধরলেন ত্রিলোকেশ, তিনি জানেন এতে যন্ত্রণার পুরোপুরি উপশম না হলেও কিছুটা শান্তি পাবেন তিনি। দাঁতে দাঁত চিপে খাট থেকে নামলেন ত্রিলোকেশ, আর তৎক্ষণাৎ বুকের ব্যাথাটা উধাও হলো। দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি, এগিয়ে গেলেন তিমিরের ঘরের দিকে। কিন্তু ঘরের দরজায় আঘাত করার আগেই কেউ আচমকা আবার বল পূর্বক ছুরির সূঁচাল গোড়াটা যেন বসিয়ে দিলো তাঁর বুকে, অদৃশ্য আঘাতে আঁক করে একটা চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেলেন ত্রিলোকেশ। তাঁর মাথাটা গিয়ে ঠুঁকে গেল তিমিরের ঘরের দরজায়, সেই আঘাতে দরজাটা সশব্দে খুলে গিয়ে ধাক্কা খেলো দেওয়ালে। ত্রিলোকেশ অবাক হয়ে দেখলেন তিমিরের ঘরটা খাঁ খাঁ করছে, কেউ কোত্থাও নেই। হতবাক ত্রিলোকেশ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই টের পেলেন বুকের ব্যাথাটা আচমকা উধাও হলো আবার। টলোমলো পায়ে ঘরে ঢুকে হাতড়ে হাতড়ে সুইচ টিপলেন তিনি, গোটা ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। নাহ আবছায়াতে ভুল দেখেননি তিনি, সত্যিই ঘরে কেউ নেই। কিন্তু তাঁর বারবার মনে হচ্ছে যেন সেই অদৃশ্য আক্রমনকারী তাঁকে সর্বক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে চলেছে, এখন আক্রমণ থামিয়ে মজা নিচ্ছে মাত্র, আবারও যে কোনো মুহূর্তে আক্রমণ করে বসবে সে।
জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে আশেপাশে ভালো করে তাকালেন তিনি, কিন্তু বিশেষ কিছুই চোখে পড়ল না। আগের দিন যা দেখেছিলেন সেই সবই শুধু রয়েছে মাত্র। ঘর থেকে বেরিয়ে তিমিরকে খোঁজার চেষ্টা করবেন কিনা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কি মনে হতে মেঝেতে বসে পড়লেন ত্রিলোকেশ, তারপর ঝুঁকে পড়ে তিমিরের খাটের তলায় তাকাতেই হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল তাঁর। দেখলেন এক বিরাট অন্ধকার গর্ত যেন হাঁ করে কাউকে গিলে নিতে প্রস্তুত। ভ্রুটা কুঁচকে উঠলো ত্রিলোকেশের। পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছোট টর্চটা বের করে গর্তটায় আলো ফেললেন তিনি, মনে হলো যেন সিঁড়ির মত কিছু রয়েছে সেখানে। কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন ত্রিলোকেশ, মনে পড়ে গেল দিন তিনেক আগেই সার্থককে বলেছিলেন য’টা দিন বাঁচবেন, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে যাবেন। কথাটা মনে পড়তেই চরম সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললেন। যদি কিছু হয়ে যায় হোক, তাঁর তো কোনো পিছু টান নেই সুতরাং ঝুঁকি নিয়েই দেখা যাক না কি হয়। এই ভেবে অনেক কসরৎ করে শরীরটাকে গর্তে গলিয়ে দিলেন তিনি, ওপর থেকে ঠিকই দেখেছিলেন সার দিয়ে সিঁড়ি নেমে গেছে নীচে। সন্তর্পণে সিঁড়িতে পা ফেলতে লাগলেন ত্রিলোকেশ। শরীরটার ব্যাথা করতে শুরু করেছে রীতিমতো, ত্রিলোকেশ বুঝলেন বয়েস হচ্ছে।
জমাট অন্ধকারে সিঁড়ির ধাপ গুলো স্পষ্ট ভাবে দেখা দায়, ছোট টর্চটার শক্তিই বা আর কতটুকু। তাও ত্রিলোকেশের মনে হল হয়তো সিঁড়ির ধাপ শেষের মুখে, বুকটা হাপরের মত ওঠানামা করছে তার। কে জানে নীচে কি অপেক্ষা করছে তার জন্য! সেই সঙ্গে আবার সেই অদৃশ্য আঘাতের ভয়ও যেন কোথাও না কোথাও জড়িয়ে ধরেছে ত্রিলোকেশকে, সবসময় মনে হচ্ছে এই বুঝি আবার আঘাত এলো! টর্চের আলো ফেলে দেখলেন আর পাঁচটা ধাপ বাকি, একটা জোরে নিশ্বাস নিয়ে পরের ধাপের দিকে পা বাড়াতে যেতেই আবার কেউ যেন সজোরে আঘাত করলো তার বুকে, আগের দু’বারের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত, অনেক বেশি শক্তি দিয়ে। আর্তনাদ করে উঠলেন ত্রিলোকেশ, সেই সঙ্গে টাল সামলাতে না পেরে হুড়মুড়িয়ে পড়লেন সিঁড়ির ধাপে। পাথরের দেওয়ালে মাথা ঠুঁকে গেল তাঁর, জ্ঞান হারানোর আগে শুধু বুঝতে পারলেন একটা ঘরের মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন তিনি।
৫
হাতের উপর শীতল কিছু একটার স্পর্শ অনুভূত হতে কোনো মতে চোখ খোলার চেষ্টা করলেন ত্রিলোকেশ, সঙ্গে সঙ্গে একটা বোঁটকা গন্ধ এসে ঝাপটা মারল তাঁর নাকে। মাথাটা প্রচন্ড ভারী হয়ে আছে, তার ওপর বারবার আঘাতে বুকের ওপরেও একটা ব্যথার অনুভূতি তার ওপর আবার কটু গন্ধটা এসে লাগতেই শোওয়া অবস্থাতেই হড়হড় করে বমি করে ফেললে তিনি। আর সঙ্গে সঙ্গে সামনে কেউ যেন হিসহিস করে বলে উঠল, “ইশশ মহান তিব্বতী তন্ত্র সাধক ত্রিলোকেশ ওরফে… ওরফে প্রলয়নাথ মুখার্জির এ কি অবস্থা! এ কোন প্রলয়ের মুখে পড়লেন তিনি….! হাঃ হাঃ হাঃ…”
কোনোমতে ভালো করে চোখটা খুলে সামনে তাকাতেই ত্রিলোকেশ দেখতে পেলেন তাঁকে, কালো আলখাল্লা, মাথায় কালো ফেট্টি, কপালে কালচে তিলক পরে যে লোকটা সামনে দাঁড়িয়ে সে আর কেউ নয় স্বয়ং তিমিরবরণ সরকার। এই রূপে তাকে চেনাই দায়, কোথায় সেই অসহায় চেহারা, কোথায় সেই সাহায্যের আর্তি নিয়ে ত্রিলোকেশের বাড়িতে উপস্থিত হওয়া লোকটা! এ যেন এক শয়তানের প্রতিমূর্তি, প্রতিশোধের আগুন যার চোখ মুখ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে… “তিমির…” অস্ফুটে বলে উঠলেন ত্রিলোকেশ।
একটা বাঁকা হাসি হেসে আবার সেইরকম হিসহিস করে তিমির বলল, “হ্যাঁ আমি। তা ত্রিলোকেশ তোমার তো শুনেছিলাম অনেক ক্ষমতা, কই গেল সেসব?”
তিমিরের কথার উত্তর না দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করলেন ত্রিলোকেশ, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আবার বুকে সেই ছুরির আঘাত টের পেলেন তিনি। সামনে তাকিয়ে দেখলেন তাঁর দিকে তাকিয়ে এক পৈশাচিক হাসি হাসছে তিমির আর তার এক হাতে ধরা একটা অদ্ভুত পুতুল আর অন্যহাতে ছুরি। পুতুলটা দেখেই চমকে উঠলেন ত্রিলোকেশ। অসাধু তন্ত্র সাধকেরা তো এই ধরণের পুতুল ব্যবহার করে লোকের অনিষ্ট করে। কিন্তু এই পুতুলের প্রাণ প্রতিষ্ঠার জন্য তো যার ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে পুতুলটা তৈরি করা হয় তার শরীরের কোনো একটা অংশের প্রয়োজন হয়, কিন্তু তিমির এটা করল কিভাবে! তিমির যেন ত্রিলোকেশের মনের কথাটা পড়তে পেরেই প্রচন্ড জোরে হেসে উঠে বলল, “কি ভাবছো এই পুতুলটা পেলাম কোথায়! তুমিই তো দিয়ে গিয়েছিলে তোমার চুল… তোমার আদর করে দেওয়া রুদ্রাক্ষের মালায় জড়িয়ে ছিল… হাঃ হাঃ হাঃ… এমনিতে এসব করার ইচ্ছে আমার ছিল না কিন্তু তুমিই যখন সুযোগ দিলে তখন ভাবলাম একটু মজা করা যাক।”
তিমিরের বিদ্রুপের সামনে আবারও নিশ্চুপ রইলেন ত্রিলোকেশ। তাঁর দু’চোখ গোটা ঘরটায় একবার ঘুরে দেখে নিলো সব কিছু। কালো জাদু চর্চার ছক থেকে শুরু করে বাকি সমস্ত উপকরণই উপস্থিত সে ঘরে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ দুটো বন্ধ করলেন ত্রিলোকেশ, তারপর অস্ফুটে বলে উঠলেন, “কেন তিমির…?”
“আফসোস হচ্ছে? মনে হচ্ছে কেন আসতে গেলেন আমার বাড়ি… কেন নামতে গেলেন আমার এই পাতালপুরীতে! মনে হচ্ছে এসব?”
“আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি?”
“অম্বরিশ বন্দ্যোপাধ্যায়… লোকটা দিনরাত আমাকে খোঁটা দিতো। বলত তোমার মত নিষ্ঠাবান সাধক আর নাকি দুটি নেই পৃথিবীতে… তোমার অসাধ্য নাকি কিছুই নেই! আমিও তাই দেখতে চেয়েছিলাম কতো তোমার ক্ষমতা।” দাঁতে দাঁত চেপে শেষ কথাগুলো বলল তিমির।
“ কে আমার সম্পর্কে কি বলে তার দায় তো আমার নয়। আমি এসব কালো জাদুর চর্চাও করিনি কোনোদিন, আর করার ইচ্ছেও নেই। আমি সন্ন্যাসী মানুষ। সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম, পথে হঠাৎ আমার তিব্বতী গুরুদেবের সাথে আলাপ হয়, এরপর তাঁর সহচর্যেই আমার যেটুকু শিক্ষা। আমি কোনোদিনও সেই শিক্ষাকে নিজের কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করিনি, একমাত্র কেউ বিপদে পড়েছে দেখলেই আমার শিক্ষাকে ব্যবহারের চেষ্টা করেছি তার সাহায্যার্থে। এর অতিরিক্ত কিছু নয়।”
“চোপ… ওই অম্বরিশ…”
“অম্বরিশের দাদা আমায় স্নেহ করতেন তাই হয়তো ভাইয়ের কাছে আমার সম্পর্কে অতিরিক্ত কিছু বলে ফেলেছিলেন কিন্তু তিমির তুমি শুধুমাত্র হিংসার বশবর্তী হয়ে…!”
“উঁহু…শুধুমাত্র নয় ত্রিলোকেশ, একবারটি তোমার পাশটিতে তাকাও…”
তিমিরের কথা শুনে পাশে তাকাতেই কেঁপে উঠলেন ত্রিলোকেশ, দেখলেন একটা নগ্ন নারী শরীর পড়ে রয়েছে তাঁর পাশে, ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে তার রং। সেই শরীরে আবার অনেক কাটা ছেঁড়ার দাগ। মেয়েটার মুখটার দিকে তাকাতেই তাঁর মনে হল এই মেয়েটাই যেন এসেছিল আজ রাতে।
“এ কে!” চিৎকার করে উঠলেন ত্রিলোকেশ।
“আন্দাজ করো…” বিদ্রুপাত্মক স্বরে উত্তর দিলো তিমির।
মেয়েটার দিকে আরেকবার ঘুরে তাকাতেই শিউরে উঠলেন ত্রিলোকেশ, চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললেন সঙ্গে সঙ্গে। বুকের ভেতর কোথাও যেন একটা কান্নার রেশ দলা পাকিয়ে উঠে আসতে চাইলো, “তুমি এতটা ভয়ঙ্কর!” হতাশা ঝরে পড়ল তাঁর স্বরে।
“হাঃ হাঃ…” করে হেসে উঠে তিমির বলল, “খুব কষ্ট হচ্ছে না এই মেয়েটার জন্য?”
“কুমারী সাধনার জন্য একটা নিষ্পাপ মেয়ের প্রাণ নিয়েছো তুমি! এ কেমন সাধনা তিমির যার জন্য একটা নিষ্পাপ জীবনকে শেষ করতে হয়?” উষ্মা ঝরে পড়ল ত্রিলোকেশের গলায়।
“চোপ… ন্যাকামো করতে হবে না। ওকে না মারলে আমার সাধনা পূর্ণ হতো কি করে!
আর খুব কষ্ট হচ্ছে না ত্রিলোকেশ এই নিষ… পাপ মেয়েটার জন্য? হাঃ হাঃ … আর কিছুক্ষণের মধ্যেই যে এই নিষ্পাপ মেয়েটাই তোমার শরীরটা ছিন্নভিন্ন করবে ত্রিলোকেশ… তখন পারবে আটকাতে?” কেটে কেটে কথা গুলো বলল তিমির।
চমকে উঠলেন ত্রিলোকেশ, “মানে?”
“ভুল… একটু ভুলের জন্য এ আমার হাত ফস্কে যায়, প্রেতত্ম প্রাপ্তি হয়েছে ওর। রোজ রাত দু’টা বাজলেই ও জেগে ওঠে, শেষ করতে চায় আমাকে। কিন্তু ত্রিলোকেশ আমি তো তা হতে দিতে পারিনা। মনে পড়ে যেদিন তুমি প্রথম আমার বাড়ি এলে সেদিন ফিরে গিয়ে পাঞ্জাবির পকেটে কি পেয়েছিলে?”
“মাটি…!”
“ওটা যে সে মাটি ছিলো না, ওটা ছিলো এর পাঁজরের হাড়ের গুঁড়ো মেশানো মাটি। আমার তন্ত্রকে তুমি খুব খাটো করে দেখো তাই না? আমি আমার তন্ত্র দিয়েই ওর দৃষ্টি তোমার দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছি। এবার যতক্ষণ না তোমাকে ও শেষ করে ততক্ষণ ওর মুক্তি নেই। হাঃ হাঃ হাঃ… তুমি যে এতো মহান সাধক ত্রিলোকেশ, কেমন মাত দিলাম তোমায়?”
“এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চাইলে তিমির! মৃত্যুকে আমার ভয় নেই, কিন্তু এখনও আমি বলবো তোমার সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই, এই পথ তুমি ছেড়ে দাও তিমির। এ পথে কারুর ভালো হয়না… কারুর না।”
“বলতে থাকো এসব ত্রিলোকেশ, কিন্তু কোনো লাভ হবে না। আমি চললাম, তুমি নিজের প্রহর গোনো এই পাতালপুরীতে। আমি আবার নতুন করে শুরু করবো সাধনা… এবার আর কোনো ভুল হবে না…” কথাগুলো বলতে বলতেই পেছাতে লাগলো তিমির। ত্রিলোকেশ চিৎকার করে এগোতে যেতেই তিমির পুতুলটার একটা পা টেনে ধরল, পড়ে গেলেন ত্রিলোকেশ। যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে তিনি পাগলের মত ডাকতে লাগলেন, “তিমির… যেয়ো না… তিমির…”
ওপরে উঠে তার পাতালপুরীর দরজা চিরকালের মত বন্ধ করলো তিমির, ত্রিলোকেশের চিৎকারটাও আস্তে আস্তে অস্পষ্ট হতে হতে মিলিয়ে গেল বন্ধ দরজার ওপারে।
৬
ভারী হয়ে আসা চোখের পাতাগুলো মেলার চেষ্টা করলেন ত্রিলোকেশ। অস্পষ্ট ভাবে শুনতে পেলেন একটা মেয়েলি গলায় কেউ যেন চিৎকার করে বলছে, “স্যার আসুন পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে…” এরপর কয়েকটা পায়ের আওয়াজ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ত্রিলোকেশ দেখলেন তাঁকে ঘিরে ধরেছে সার্থক, রাই, সুনন্দ ও বৌমা। রাইয়ের চোখে জল। সে অভিমানী গলায় বলে উঠল, “কি দরকার ছিলো দাদু ওই লোকটার সঙ্গে যাওয়ার! আমি তো দেখেই বলেছিলাম লোকটা কেমন যেন…”
সুনন্দ মেয়েকে সমর্থন করে বলল, “সত্যিই কাকু তুমি কেন এমন করো!”
মৃদু হেসে ডান হাতটা তোলার চেষ্টা করলেন ত্রিলোকেশ কিন্তু পারলেন না। ডাক্তার বললেন, “ভয় পাবেন না। শরীর প্রচন্ড দুর্বল তাই এরকম হচ্ছে। এমনিতে ভয়ের কিছু নেই।” মাথা নেড়ে ত্রিলোকেশ সার্থকের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ গলায় বললেন, “থ্যাংক্স দাদা।” সার্থক এগিয়ে এসে ত্রিলোকেশের পাশে বসে পড়ে হাতটা ধরে নিলো তাঁর। তারপর ভেজা গলায় বলল, “ভাগ্যিস তুমি বলেছিলে সাড়ে তিনটার সময় তুমি ফোন না করলে আমি যেন পুলিশ নিয়ে গিয়ে হাজির হই ওখানে। লোকটা জানো কিছুতেই বলতে চায়নি তুমি কোথায়, ও বেমালুম অস্বীকার করে যাচ্ছিল যে তুমি সেদিন ওর বাড়ি গিয়েছিলে বলে…”
দাদু নাতির কথার মাঝেই হসপিটালের কেবিনে ঢুকলেন গেরুয়া বসন পরা একজন লোক। সার্থক চমকে উঠল, “জটিলেশ্বর বাবু আপনি…!”
“হ্যাঁ ভাই। আমার খুব চিন্তা হচ্ছিল মেসোমশায়ের জন্য তাই তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম, সেখানে গিয়েই তোমাদের কাজের লোকের কাছে জানতে পারলাম সব। উফফ তিমিরটা কি ভয়ঙ্কর… কি ভয়ঙ্কর! আমি মেসোমশায়কে সাবধান করেছিলাম কিন্তু উনি শুনলেন না।”
ত্রিলোকেশ আস্তে আস্তে বললেন, “আমি না গেলে যে চলত না, সার্থক তোমার সন্ধান পাওয়ার আগেই যে তিমির ওর মোক্ষম চালটা দিয়ে দিয়েছিল। আমি ওর বাড়ি না গেলেও মেয়েটির প্রেতাত্মা আমাকে ছাড়তো না।”
“উফফ মেসোমশায়… আমি জ্যোতিষী বটে, মাঝেমাঝে লোকের হাত দেখে একটু আধটু মিথ্যে বলি ঠিকই কিন্তু তিমিরের মত ওই পথ কখনও মাড়াইনি।”
“জানি জটিলেশ্বর, তোমার চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম তুমি একটু আধটু মিথ্যে বললেও এতবড় ব্যাপার চেপে যাওয়ার মত অভিনেতা নও।”
“হেঁ হেঁ তা যা বলেছেন মেসোমশায়।”
“দাদু তুমি কি বুঝতে পেরেছিলে ওই তিমির লোকটা যে গণ্ডগোলী?”
“পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও প্রথম দিন থেকেই একটা সন্দেহ তো হয়েইছিল।,”
“দাদু ওই প্রেতাত্মা তোমার আর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না তো?” জিজ্ঞেস করে উঠল রাই।
“না দিদিভাই। তিমির খুব চালাক ছিলো এটা সত্যি কিন্তু ওই যে বলে না অতি চালকের গলায় দড়ি। ও ওভার কনফিডেন্ট হয়ে একটা ভুল করে বসেছিল, সেটা হলো ওর গল্পে জটিলেশ্বরকে টেনে আনা। আমি জটিলেশ্বরের সাথে কথা না বললে তিমিরের ব্যাপারে জানতেই পারতাম না। জটিলেশ্বর ওর মায়ের কাছে শুনেছিল যে তাঁর সন্দেহ তিমির গোপনে তন্ত্র সাধনা করছে। এইটুকু তথ্যই আমাকে অনেকটা সাহায্য করে। তিমিরের পুরো প্ল্যানটা বুঝতে না পারলেও কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। তাই তো প্রস্তুতি নিয়েই সেদিন গিয়েছিলাম ওর বাড়ি।” এক টানা কথাগুলো বলে একটু দম নিয়ে ত্রিলোকেশ আবার বলতে শুরু করলেন, “তিমির দরজাটা লাগিয়ে দেওয়ার পর আমি আমার যাবতীয় কাজ সারি, প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল শরীরে তাও আমি বোধহয় সমর্থ হয়েছি ওই হতভাগ্য মেয়েটাকে মুক্তি দিতে।”
ত্রিলোকেশের কথা শেষ হতেই সার্থক বলল, “দাদু এখনও একটা কাজ তোমার বাকি?”
“কি কাজ দাদা?”
পকেট থেকে একটা ছোট্ট বাক্স বের করে সবার সামনে ঢাকনাটা খুলল সার্থক, ত্রিলোকেশ দেখলেন বাক্সের ভেতরে চুপচাপ শোয়ানো রয়েছে একটা পুতুল। ঠোঁটের কোণে একটা চাপা হাসি নিয়ে সার্থকের চোখে চোখ রাখলেন ত্রিলোকেশ, দাদু নাতির মধ্যে নীরব বার্তা বিনিময় হয়ে গেল সবার অলক্ষ্যে।
৭
সন্ধ্যার অন্ধকারে নীল রঙের একটা ঢোলা জামা পরে একটা বেঞ্চে বসেছিল তিমির। আজ কতদিন হয়ে গেল কে জানে সে এই এসাইলামে ভর্তি। ভালোই হয়েছিল তাকে ওরা পাগল ভেবে জেলে না ভরে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। তবে তিমির ভোলেনি কোনোকিছুই, একদিন না একদিন তো সে বেরোবেই বাইরে, দেখে নেবে ওই ত্রিলোকেশকে। ত্রিলোকেশ ছাড়াও আরও দুটো লোককে দেখে নেবে সে, অর্ণবীর মা বাবা। ফেসবুক থেকে প্রেমের জালে মেয়েটাকে ফাসিয়ে নিজের কাছে টেনে এনেছিল সে, তারপর কুমারী সাধনার জন্য বলি দিয়েছিল ওকে। অর্ণবীর মা বাবা ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায়নি কিছু। কিন্তু ওই ত্রিলোকেশ এসে সব গন্ডগোল করে দিল… অর্ণবীর মা বাবাকে তিমির কিছুই করতো না যদি না ভরা কোর্টে এসে ওর মা ওভাবে তিমিরকে জুতো ছুঁড়ে মারতো। তিমির ভোলেনি কিছুই...
এসব চিন্তার মাঝেই আচমকা এক দলা থুতু এসে পড়ল তিমিরের গালে, কোনো পাগলের কান্ড ভেবে হুঙ্কার ছেড়ে পাশে ঘুরে তাকালো তিমির। কিন্তু একি! এ কে দাঁড়িয়ে…? জমাট বাঁধা অন্ধকারের ভেতর থেকেও তিমির যেন স্পষ্ট দেখতে পেলো প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলতে থাকা সেই মুখটা…
“অর্ণবী…!” সন্ধ্যের নিস্তব্ধতা খানখান করে দিলো সেই চিৎকার…
শেষ।

