Sayandipa সায়নদীপা

Abstract Children Stories

3  

Sayandipa সায়নদীপা

Abstract Children Stories

দৈত্যের গুহায়

দৈত্যের গুহায়

12 mins
679



বৃষ্টি শেষে ঝুল বারান্দায় একফালি রোদ এসে পড়তেই সেখানে ছুটে এলো রাজন্যা। আকাশের দিকে ইতিউতি তাকিয়ে রামধনুটাকে খোঁজার চেষ্টা করলো, কিন্তু সব চেষ্টাই বৃথা। রামধনু ওঠেনি। মনটা খারাপ হয়ে গেল রাজন্যার, সে মনে মনে ভাবল তার জীবনের মতোই রামধনুরও কি সব রং হারিয়ে গেছে!


  রাজ্যটার নাম কুন্দনগড়। পাহাড় আর নদী দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একটা শান্ত সবুজ রাজ্য। রাজন্যার বাবা অজাতশত্রু ছিলেন এই রাজ্যের রাজা। তাঁর মতন ভালো রাজা পাওয়া ভার--- যুদ্ধবিগ্রহ ওনার কোনোদিনই পছন্দ নয়, শান্তি পূর্ণ ভাবেই থাকতে ভালোবাসতেন উনি। প্রজাদের দুঃখ কষ্টের দিকে ছিল ওনার সদাই নজর, শুধু তাই নয় রাজ্যের প্রতিটি পশু পাখির প্রতিও তিনি ছিলেন সদাই যত্নবান। শিকার করা ছিল এই রাজ্যে মানা। সব মিলিয়ে কুন্দনগড়ের মানুষরা বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছিল। কিন্তু তারপর আচমকা একদিন বিপদের অশনি সংকেত এসে ঘিরে ধরল রাজ্যের আকাশ - ক’দিন ধরেই মাথা ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছিলেন রাজা মশাই, বদ্যি মশাই অনেক পথ্য দিয়েও রাজমশাইয়ের মাথা ব্যাথা আর দূর করতে পারছিলেন না কিছুতেই। যত দিন যাচ্ছিল মাথা ব্যাথা ততই বাড়ছিল, তারপর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত একদিন সকালে উঠে রাজামশাই বললেন তিনি চোখের সামনে রঙিন রঙিন ধোঁয়া ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছেননা। আসল সমস্যার সূত্রপাত এইবারেই হল। মাথার যন্ত্রনা আর চোখের সামনে ধোঁয়া রাজামশাইকে একেবারে পাগল করে তুলল, রাজ্য চালানোর কাজে অক্ষম হয়ে পড়লেন তিনি। সেই সুযোগে রাজমশাইয়ের বকলমে সিংহাসনে বসলেন মন্ত্রী মশাই। রাজমশাইয়ের নাম করে রাজ্য শাসন করতে লাগলেন উনি। কোথায় ছিলেন প্রজাহিতৈষী রাজা অজাতশত্রু, তাঁর জায়গায় এলো দুষ্ট স্বেচ্ছাচারী মন্ত্রী। মন্ত্রীর অত্যাচার আর স্বেচ্ছাচারিতায় প্রজাদের জীবন এখন চরম সংকটের সম্মুখীন। তাদের রাজ্যেও যে এমন খাজনার জন্য অত্যাচার করা হতে পারে, কারণে অকারণে কারাগারে নিক্ষেপ করা হতে পারে, এ সবই ছিল তাদের কল্পনার অতীত। রাজন্যা আর ওর মাও যেন কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন দিনকে দিন। এখন মন্ত্রিমশাইয়ের স্ত্রী প্রসাধন করে, গা ভর্তি গহনা নিয়ে রানীর মত থাকেন। সবসময় কুড়ি জন দাসী তাঁর সেবা করে যায়। এদিকে আসল রানিমা ঘুমন্ত রাজমশাইয়ের শিওরে বসে নীরবে চোখের জল ফেলেন; রাজা মশাই জেগে উঠলেই আবার চোখ মুছে তাঁকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর এই সবই মুখ বুজে দেখে যেতে হচ্ছে রাজন্যাকে। মনে মনে ভেতরটা তার ছটফট করতে থাকে সবসময়। নাহ, তার সুখ স্বাচ্ছন্দ্য চলে গেছে বলে যতটা না দুঃখ তার চেয়েও বেশি কষ্ট হয় বাবাকে দেখলে, এমন ভালো মানুষটার এ কি অবস্থা! আর মা…! অমন সুন্দর পরীর মত মুখটা দিনদিন কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে, রোগা হয়ে যাচ্ছে শরীর, চোখের তলায় জমেছে কালি।


  “রাজন্যা মা, এখানে কি করছো? ঠান্ডা বাতাস লাগলে সর্দি করবে যে।”

আচমকা কথাগুলো শুনতে পেয়ে ঘুরে তাকালো রাজন্যা। দেখল ঝোলা কাঁধে দাঁড়িয়ে আছেন বদ্যি মশাই। ওনাকে দেখে মৃদু হাসার চেষ্টা করল সে; তারপর বলল, “বাবাকে কেমন দেখলেন?”

মুখে কিছু না বলে মাথা নীচু করে দুদিকে ঘাড় নাড়লেন বদ্যি মশাই। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রাজন্যার বুক থেকে। বদ্যিমশাই বললেন, “ওনার চোখ দুটো আস্তে আস্তে বোধহয় অন্ধ হয়ে যাবে। আমার যা চেষ্টা করার ছিল সবই করেছি কিন্তু… তাও চেষ্টা করছি ওনার মাথা ব্যাথাটাকে যদি কমানো যায়, নয়তো মানুষটা তো এভাবে পাগল হয়ে যাবেন!”

  “আর কি কোনো উপায় নেই? বদ্যিমশাই বলুন না, কিছু তো একটা উপায় নিশ্চয় থাকবে। আমার বাবা এভাবে…” বাকি কথাগুলো আর বলতে পারলোনা রাজন্যা, গলাটা ধরে এলো ওর। বদ্যিমশাই কি যেন ভেবে নিয়ে বললেন, “আমার গুরু একবার আমাকে অন্ধত্বের চিকিৎসার ওষুধ তৈরির জন্য এক রকম ফুলের কথা বলেছিলেন কিন্তু সেই ফুল বহুদিন হলো আমাদের রাজ্যে আর পাওয়া যায়না। আশেপাশের রাজ্যেও আর সেই ফুলের গাছ নেই, আমি খোঁজ নিয়েছি। ওটা পাওয়া গেলে একবার শেষ চেষ্টা করা যেত।”

  “এ কেমন কথা! কোনো একটা জায়গা তো নিশ্চয় থাকবে যেখানে এই ফুল ফোটে।”

  “নাহ মা, কোথাও নেই সে ফুল। আমি লোক লাগিয়ে খোঁজ নিয়েছি। তবে…”

  “তবে কি?”

  “আমার ধারণা কুন্দ পাহাড়ের ওপর যে জঙ্গল আছে সেখানে ওই ফুল এখনও মিললেও মিলতে পারে।”

  “তবে আপনি কাউকে পাঠিয়ে আনাচ্ছেন না কেন?”

  “কে যাবে ওই দৈত্যের মুখে?”

  “দৈত্য!”

  “তুমি কি তাহলে জানোনা রাজন্যা মা? ওই পাহাড়ের ওপরে গুহায় তো কয়েকটা দৈত্যের বাস। তারা লোকালয়ে কখনও এসে কারুর ক্ষতি করেনি বলে রাজামশাইও ওদের তাড়াতে চেষ্টা করেননি। কিন্তু কে বলতে পারে ওদের গুহার কাছে গেলে ওরা গিলে খাবে না! আমার ছেলে চন্দ্রই তো প্রথম ওদের দেখে। সে তো কোনোমতে প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফিরেছিল। তারপর দূর থেকে অনেকেই দেখেছে তাদের।”


  বদ্যিমশাই চলে যাওয়ার পর নিজের ঘরে ফিরে এলো রাজন্যা। চন্দ্র দাদার কাছে দৈত্যদের একটা গল্প শুনেছিল বটে কিন্তু সে ভেবেছিল চন্দ্র দাদা মজা করে তাকে ভয় দেখাতে বলছে এসব গল্প। কিন্তু এখন তো শুনছে পাহাড়ে দৈত্য সত্যিই আছে! আর ওই দৈত্যদের জন্য বাবার ওষুধ আনতে যেতে পারছেনা কেউ! কথাটা মনে হতেই উত্তেজিত হয়ে উঠল রাজন্যা। বাবা ওই দৈত্যদের পাহাড়ে আশ্রয় দিয়েছেন, তার বিনিময়ে কি ওরা বাবার জন্য ওই ফুলটা দেবে না! 


  সন্ধ্যে নামছে আস্তে আস্তে। গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে সবার অলক্ষ্যে বদ্যিমশায়ের বাড়িতে পৌঁছে গেলো রাজন্যা। ওকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন বদ্যিমশাই, “রাজন্যা মা তুমি এখানে! কি ব্যাপার সব ঠিক আছে তো?”

“সব ঠিক আছে বদ্যিমশাই। কিন্তু আমি আসলে একটা আব্দার নিয়ে এসেছি আপনার কাছে।”

  “আব্দার! কিসের আব্দার?”

 রাজন্যা এবার আব্দার করে বসল একবার ওকে ওই ফুলটা কেমন দেখতে সেটা বলতে। ভ্রু কুঁচকে গেলো বদ্যিমশাইয়ের, “সে কথা জেনে তুমি কি করবে রাজন্যা মা?”

“আমি একবার শুধু জানতে চাই। দয়া করে আমায় বলুন।”

“আচ্ছা আচ্ছা…” এই বলে বদ্যি মশাই একটা তালপাতার পুঁথি বের করে আনলেন। রাজন্যা দেখল সেই তালপাতার ওপর আঁকা একটা বেগুনি রঙের ফুলের ছবি। অবাক করা সৌন্দর্য তার। মনে মনে ফুলের ছবিটা নিজের মাথায় গেঁথে নিলো রাজন্যা, তারপর ফিরে এলো মহলে। 


  গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমে অচেতন তখন নিজের কক্ষের একটা গোপন স্থান থেকে রাজন্যা বের করে আনলো একটা অস্ত্র, গেল বছর তার জন্মদিনে এই অস্ত্রটা উপহার দিয়েছিল চন্দ্র দাদা। রাজন্যা ঠোঁট ফুলিয়ে অনুযোগ করেছিল, “আমি অস্ত্র নিয়ে কি করব?”

চন্দ্র হেসে বলেছিল, “প্রয়োজন বিশেষে আত্মরক্ষার জন্য এটা খুব কাজে লাগবে।” 

রাজন্যা বলেছিল, “হুহ আমাকে রক্ষা করার জন্য কত্ত সেপাই আছে।”

চন্দ্র জবাব দিয়েছিল, “যদি কোনদিনও একা কোনো বিপদের সম্মুখে পড় তখন কি হবে!”

উপহারটা খুব একটা পছন্দ না হলেও রেখে দিয়েছিল রাজন্যা। আজ সে উপলব্ধি করতে পারলো চন্দ্র দাদার কথার গুরুত্ব ছিল কতটা। অস্ত্রটা কোমরে গুঁজে নিলো রাজন্যা। তারপর একটা আলো নিয়ে চুপিসারে বেরিয়ে পড়লো প্রাসাদ ছেড়ে। কথায় বলে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। অন্যদের মতো সেতো আর দৈত্যদের ভয়ে ঘরে বসে থাকতে পারবে না। বাবার জন্য তাকে এই ঝুঁকি নিতেই হবে। রাজন্যার বিশ্বাস সে ঠিক পারবে বাবার জন্য ওই ফুলটা আনতে।


  কুন্দ পাহাড় অনেকটা পথ পেরিয়ে যেতে হবে, কিন্তু যে করেই হোক আজ রাতের মধ্যে পাহাড়ের নীচ অবধি পৌঁছে যেতে হবে তাকে। নয়তো কোনো রাজ্যবাসী তাকে দেখে নিলেই মুশকিল। আকাশ মেঘলা বলে একটাও তারা নেই আজ তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। হনহন করে হাঁটা লাগালো রাজন্যা। দুপুরে বৃষ্টি হওয়ায় জন্য একটা ঠান্ডা বাতাস এসে কাঁপিয়ে দিচ্ছে তার শরীর। রাস্তার মাঝে একটা কুকুর ডেকে উঠল আচমকা। বুকটা কেঁপে উঠল রাজন্যার, কিন্তু বাবার মুখটা মনে পড়তেই সে বুকের বল ফিরে পেলো সঙ্গে সঙ্গে। ভোরের আলো ফোটার মুখে সত্যি সত্যিই রাজন্যা পৌঁছে গেলো কুন্দ পাহাড়ের গায়ে। শরীরটা আর যেন টানছেনা। ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল সে। দেখল পা দুটো ফুলে ঢোল। খিদেও পেয়েছে জোর। আঁচলের খুঁট থেকে দুটো আপেল বের করে খেতে শুরু করলো রাজন্যা। মনে মনে ভাবলো ভাগ্যিস বুদ্ধি করে সঙ্গে এনেছিল এ দুটো। আপেল খাওয়ার শেষে কাছের পুকুর থেকে আঁজলা ভরে জল খেয়ে নিলো খানিকটা। কিন্তু তারপর আবার পাহাড়ে উঠতে যেতেই কেঁপে উঠলো পা দুটো। জীবনে প্রথমবার এতো ধকল নিচ্ছে তার এই নরম পা জোড়া, তাই তারা প্রতিবাদ করে আরও বিশ্রাম চাইল। কিন্তু রাজন্যা জানে বিশ্রাম করার সময় নেই তার। চোখ দুটো আস্তে আস্তে বন্ধ করে ফেলল সে; বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠল মা বাবার ছবি- হাসছেন তাঁরা। রাজন্যা মনে মনে বললে, “আশীর্বাদ করো মা বাবা যাতে তোমাদের এই মুখের হাসি আবার ফিরিয়ে দিতে পারি। তোমাদের প্রিয় প্রজাদের জীবনে আবার শান্তি আনতে পারি।” এই বলে মা বাবার উদ্দেশে মনে মনে প্রণাম করলো সে। মা নিশ্চয় এতক্ষণে তাকে দেখতে না পেয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, খুব কষ্ট পাচ্ছেন নিশ্চয়। এভাবে না বলে বাড়ির থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মনে মনে মায়ের কাছে ক্ষমা চাইল রাজন্যা আর নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করল কিছুতেই সে ব্যর্থ হয়ে ফিরবে না। 


  এবার নতুন উদ্যমে আবার যাত্রা শুরু করলো রাজন্যা। কিন্তু যেতে যেতে পাথুরে জমিতে পা কেটে রক্ত বেরিয়ে এলো, কাঁটা গাছের খোঁচায় জামা ছিঁড়ে গা ছড়ে গেলো, শরীরটা ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে যেন ঢলে পড়ে যেতে চাইল মাটিতে। তাও থামতে পারলোনা রাজন্যা। এরপর একটা সময় এলো যখন খিদে তেষ্টায় তার স্বাভাবিক চিন্তা শক্তিও লোপ পেয়ে গেলো, শুধু যন্ত্রের মত এগিয়ে যেতে থাকল সে। যতই এগোতে থাকল জঙ্গলটা ততই ঘন হতে লাগলো, সূর্যের আলোটাও আর ভালোভাবে দেখা গেলো না আকাশে। আর সেই আলো আঁধারীতে সামনেই পড়ে থাকা একটা পাথরকে খেয়াল করতে পারলোনা রাজন্যা, হোঁচট খেয়ে গড়িয়ে পড়ল নীচে। গড়িয়ে পড়তে পড়তে কোনো এক গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা খেয়ে সে আটকে গেলো ঠিকই কিন্তু ততক্ষণে গোটা শরীর জুড়ে শুরু হয়েছে এক তীব্র যন্ত্রনা। আর নিজেকে আটকে রাখা শক্ত, ক্লান্ত অবসন্ন চোখের পাতা দুটো বুজে এলো অচিরেই।


  চোখ খুলতেই চমকে উঠল রাজন্যা। এ কোথায় শুয়ে আছে সে! এটা কেমন জায়গা! সে দেখল একটা গোলাকার কক্ষে সে শুয়ে, বিছানাটাও কেমন শক্ত আর অদ্ভুত রকমের সরু, তার পালঙ্কের তিনভাগের একভাগ হবে হয়তো বড়জোর। ঘরময় ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন অদ্ভুত রকমের যন্ত্রপাতি। এরকম যন্ত্রপাতি কস্মিনকালেও দেখেনি রাজন্যা। মুহূর্তে ওর বুকটা কেঁপে উঠলো, এটা সেই দৈত্যদের গুহা নয়তো! কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজন্যা দেখতে পেলো ঘরটার দেওয়ালটা এক জায়গায় ফাঁকা হয়ে গেলো আর সেখান থেকে বেরিয়ে এলো একটা মিষ্টি মেয়ে। কিন্তু মেয়েটার মুখটা মিষ্টি হলেও ওর পোশাক দেখে ভিরমি খাওয়ার জোগাড় হলো রাজন্যার। এ কেমন রুপোলি রঙের গায়ের সাথে সেঁটে থাকা পোশাক পরে আছে মেয়েটা! মেয়েটা ওর দিকেই এগিয়ে আসছে দেখে ভয় পেয়ে পেছাতে গেলো রাজন্যা কিন্তু সরু খাটটা থেকে টাল সামলাতে না পেরে দুম করে পড়ে গেল নীচে। মেয়েটা ছুটে এসে ধরলো ওকে, “তুমি এতো ভয় পাচ্ছ কেন? আমি কি কোনো দৈত্য নাকি?”

মেয়েটার মিষ্টি গলার স্বর শুনে এবার একটা ঢোঁক গিললো রাজন্যা। সত্যিই তো এই মেয়েটা আর যাই হোক দৈত্য হতে পারেনা। উঠে বসে তাই সাহস করে সে জানতে চাইলো, “তুমি কে? তুমি এরকম অদ্ভুত পোশাক পরে আছো কেন?”

মেয়েটার মিষ্টি হাসিটা মুহূর্তে মিলিয়ে গেলো। সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে সে রাজন্যকে তুলে খাটটায় আবার বসিয়ে দিলো। তারপর বলল, “তোমার কোথাও ব্যাথা করছে নাকি?”

রাজন্যা এতক্ষণে খেয়াল করল ওর কাটা জায়গাগুলোয় কিছু একটা ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে মেয়েটা। শরীরে ব্যাথা করলেও জ্বালা যন্ত্রনাগুলো তাই অনেকটাই জুড়িয়ে এসেছে তাই। দুদিকে ঘাড় নাড়াল রাজন্যা। মেয়েটা মৃদু হেসে এবার জিজ্ঞেস করলো, “এখানে তুমি কেন এসেছিল এভাবে একা একা? এদিকে তো কেউ খুব একটা আসেনা।”

মেয়েটার কথা শুনে মুহূর্তে রাজন্যার মনে পড়ে গেলো ওর বাবার কথা, চোখ ফেটে জল আসতে চাইল ওর। মেয়েটা কি মনে করে আবার বলল, “তুমি আমাকে নির্ভয়ে সব বলতে পারো।” 

মেয়েটার গলার স্বরে এমন কিছু ছিলো যাতে সত্যিই অনেকটা আশ্বস্ত হলো রাজন্যা, তারপর আস্তে আস্তে সব কথা খুলে বললো মেয়েটাকে। মেয়েটা সব শুনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো ওর। আর তক্ষুণি আবার ঘরের দেওয়ালটা ফাঁক হয়ে গেল। রাজন্যা দেখল একজন বয়স্ক লোক আর আরেকজন যুবক ঢুকছে সেই ফাঁক দিয়ে। বয়স্ক লোকটি ঢুকে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলেন, “সব ঠিক আছে?”

মেয়েটা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। তারপর বলল, “স্যার এই মেয়েটা একটা বিপদে পড়েছে।” 

বয়স্ক লোকটি আর সঙ্গের ছেলেটি দুজনেই জানতে চাইলো “কি বিপদ?”

মেয়েটি তখন রাজন্যার সব কথা বলল ওদের। মেয়েটির কথা শেষ হতেই রাজন্যা ওদের জিজ্ঞেস করে উঠল, “কিন্তু আপনারা কারা? আমি তো শুনেছিলাম এখানে একটা দৈত্যদের গুহা আছে…”

  “দৈত্য…! হাঃ হাঃ হাঃ…” হাসিতে ফেটে পড়লেন বয়স্ক লোকটি। তারপর হাসি থামিয়ে হতাশ গলায় বললেন, “আমরাও তোমার মতোই মানুষ রাজন্যা। কোনো দৈত্য নয়। আর আমরাও তোমার মতোই মস্ত বড় বিপদে পড়েছি। কোনদিনও এ বিপদ থেকে মুক্তি পাবো কিনা জানা নেই।” শেষ কথাগুলো বলতে বলতে হতাশা ঝরে পড়ল মানুষটার গলায়।

 “বিপদ! কেমন বিপদ?” অবাক হয়ে জানতে চাইল রাজন্যা।

এবার ছেলেটা জবাব দিলো, “ইনি হলেন আমাদের স্যার, মানে শিক্ষক। আমাদের স্যার একজন বৈজ্ঞানিক। উনি একটি আবিষ্কার করেছিলেন যাতে এক যুগ থেকে অন্য যুগে যাওয়া যায়।”

  “মানে?”

  “মানে রাজন্যা আমরা তোমাদের সময়ের মানুষ নই, আমরা ভবিষ্যৎ থেকে এসেছি।” মেয়েটা বলে ওঠে। ওর কথা শুনে চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল রাজন্যার। বয়স্ক লোকটি এবার বললেন, “আমার যন্ত্রের সাহায্যে আমরা তোমাদের সময়ে এসে পড়েছিলাম। তারপর যন্ত্র থেকে নেমে আমরা একটু আশপাশটা ঘুরে দেখছিলাম তখনই একটা ছেলে এসে আমাদের এই যন্ত্র থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নিয়ে পালিয়ে যায়। কিছুদূর ধাওয়া করেও ছেলেটার হদিশ করতে পারিনি, এদিকে লোকালয়ে যেতেও ঠিক সাহস হয়নি। আর সেই যন্ত্রটা চুরি গেছে বলেই আমরা আটকে পড়েছি এখানে। ওটা ছাড়া আমাদের সময়ে ফিরে যাওয়া অসম্ভব।”

ভদ্রলোকের কথা শেষ হতেই উত্তেজিত হয়ে উঠল রাজন্যা, “আমার বাবার রাজ্যে এমন অনাচার! চিন্তা করবেন না আমি ফিরে গিয়ে ঠিক খুঁজে বের করবোই কে আপনাদের জিনিস চুরি করেছে। প্রতিজ্ঞা করলাম আমি।”

  “সত্যি বলছো? তুমি পারবে?” রাজন্যার হাত দুটো ধরে নেয় মেয়েটা। রাজন্যা তাকে আশ্বস্ত করে, “পারব কিন্তু তার আগে বলো তোমাদের যন্ত্রটা দেখতে কেমন?”

ছেলেটা এবার এগিয়ে গেলো দেওয়ালে আটকানো একটা বাক্সের মত জিনিসের দিকে, তারপর সেটার মধ্যে থাকা একটা লম্বা ছুরির মত জিনিস দেখিয়ে বলে, “ঠিক এই রকমই আরেকটা ছিল।”

জিনিসটার দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে গেল রাজন্যা। তারপর আস্তে আস্তে কাঁপা কাঁপা হাতে ওর কোমরের ভাঁজ থেকে বের করে আনলো চন্দ্রদার দেওয়া অস্ত্রটা। ওটা দেখা মাত্রই ঘরে উপস্থিত বাকি তিনজন চমকে উঠল। কিছুক্ষণের জন্য কারুর মুখ দিয়ে কোনো কথা সরলো না। তারপরেই বয়স্ক ভদ্রলোক আচমকা হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন। তাঁর দেখাদেখি মেয়েটা আর ছেলেটার চোখেও জল চলে এলো। রাজন্যা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা কাঁদছো কেন?”

মেয়েটা বলে, “এ আনন্দের কান্না রাজন্যা, তুমি বুঝবে না। আজ কতদিন পর আমরা বাড়ি ফিরতে পারব। বাড়িতে আমার মা, বাবা, দাদা সবাই প্রতীক্ষায় আছে।”

ছেলেটা বলে ওঠে, “আমারও মা আর বাবা নিশ্চয় আমার পথ চেয়ে বসে আছেন।” 

“আর আমার মেয়েটা একা একা কেমন আছে কে জানে…!” ঝাপসা চোখে কথাগুলো বললেন বয়স্ক লোকটি। রাজন্যা ওনার দিকে যন্ত্রটি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ক্ষমা করবেন আমায়। আমার এক দাদা আপনাদের দৈত্য ভেবে এই জিনিসটা হয়তো খুলে নিয়েছিল, তাই আপনাদের এতো কষ্ট হল।”

  “আমাদের সব কষ্ট জুড়িয়ে যাবে ররাজন্যা যদি আমরা ঠিকঠাক বাড়ি পৌঁছাতে পারি।” বলে উঠল মেয়েটা। রাজন্যা ওর হাত দুটো ধরে বলল, “ঠিক পারবেন।”

  “তবে তার আগে একটা কাজ আছে।” এই বলে বয়স্ক ভদ্রলোক দেওয়াল ফাঁক করে অন্য একটা ঘরে চলে গেলেন। তারপর ফিরে এলেন যখন তখন তাঁর হাতে ধরা একটা অদ্ভুত জিনিস, গোল চাকতির মতো কিন্তু কেমন অদ্ভুত অন্য রকম। লোকটা জিনিসটা রাজন্যাকে দেখিয়ে বললেন, “এই জিনিসটাকে বলে চশমা। তোমার বাবার চোখে এই ভাবে পরিয়ে দিও। আমার বিশ্বাস তিনি আবার সব দেখতে পাবেন, মাথা ব্যাথাও সেরে যাবে।”

  “সত্যি বলছেন আপনি?”

  “একদম সত্যি।”



  কুন্দনগড়ের প্রাসাদে পা দিয়েই চোখে জল চলে এলো রাজন্যার। মিথিলা দিদিরা মানে ওই ভবিষ্যৎ থেকে আসা মানুষগুলো ওকে দুদিন বিশ্রাম নিতে বলেছিল ওদের সেই যন্ত্রটার ভেতর। সত্যি বলতে রাজন্যারও ক্ষমতা ছিলো না এতটা পথ পাড়ি দিয়ে ফেরার। সারা শরীর জুড়ে ছিল প্রচন্ড ব্যাথা। এই দুদিনে ওরা নিজেদের যন্ত্রটিকে সারিয়েছে, তারপর কাল রাতেই ওরা রাজন্যার চোখের সামনে দিয়ে মিলিয়ে গেছে বাতাসে। রাজন্যা মনে মনে প্রার্থনা করেছে ওরা যেন সুস্থ ভাবে বাড়ি পৌঁছে যায়। ওরা চলে যাওয়ার পরেই রাজন্যা বেরিয়ে পড়েছিল কুন্দনগড়ের উদ্দেশ্যে। এখন ওকে দেখতে পেয়েই ছুটে এলো ওর এক সহচরী। আনন্দে ওকে জড়িয়ে ধরল সে, তারপরেই চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে শুরু করলো, রাজন্যার কোনো বারণ শুনলো না। সে ডাক শুনে ছুটে এলেন রাণীমা। রাজন্যাকে দেখতে পেয়েই তিনিও এসে জড়িয়ে ধরলেন ওকে, তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। মাকে দেখে আবারও কান্না পেয়ে গেল রাজন্যার। তবুও কোনোমতে কান্না চেপে ও জানতে চাইল, “বাবা কোথায় মা?”

  “ঘরে, ঘুমোচ্ছেন”, কান্না ভেজা গলায় উত্তর দিলেন রাণীমা।

মাকে ছেড়ে গুটিগুটি পায়ে বাবার ঘরে এলো সে। নরম গলায় ডেকে উঠল, “বাবা...বাবা…।”

“হুঁ!” পাশ ফিরলেন রাজামশাই। রাজন্যা বলল, “বাবা, আমি তোমার রাজন্যা। একবার ওঠো।” 

মেয়ের ডাকে উঠে বসার চেষ্টা করলেন রাজামশাই, রাজন্যা সাহায্য করলো বাবাকে। তারপর বাবার চোখে ওই চশমা বলে জিনিসটা পরিয়ে দিয়ে দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে থাকলো ফলাফলের। রাণীমা কিছুই বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন ওদের দিকে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আচমকাই রাজামশাই তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলেন, তারপর তাঁর আদরের রাজন্যাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠলেন, “পাচ্ছি পাচ্ছি সব দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট…”




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract