চতুস্কোণ প্রেম ও খুন
চতুস্কোণ প্রেম ও খুন
রমিত ও রমিতা ছোটবেলা থেকে একই সাথে পড়াশোনা করে। যদিও ওদের স্কুলগুলো ছিল আলাদা আলাদা কেননা রমিতা পড়তো একটি গার্লস স্কুলে। এখন ওরা একই কলেজে একই ক্লাসে দুই বছর ধরে পড়ছে।
ওদের দুজনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক খুব গাঢ়। কলেজে সবাই ওদের সম্পর্ক নিয়ে রসিকতা করে মানিকজোড় বলে, অনেক রকম গালগল্প ছড়ায়। সে সব কথাই অবশ্য ওরা সেভাবে কর্ণপাত করে না। নিজেদের বন্ধুত্বের নির্মল বিশ্বাসে ভর করে ওদের কলেজ জীবন বেশ ভালোই কেটে যায়।
রমিতের স্কুল জীবনের বন্ধু সুমিত বসু। যদিও বয়সে ও রমিতের থেকে দুই তিন বছরের বড়। সুমিত এখন আর পড়াশোনা করে না। মাধ্যমিক পাশ করার পরেই পৈত্রিক ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে। যুক্ত হয়েছে বললে ভুল হবে ওর বাবা জোর করে যুক্ত করেছে। কেননা, ছোট থেকে কোন রকমে ঠেলেগুজে সুমিত পাশ করছে। দুই একবার ফেল করেছে।
হঠাৎ করে সুমিত একদিন রমিতের কলেজে আসে বেড়াতে। কলেজের পরিবেশ ও এখানে ছাত্র ছাত্রীদের জীবন ওর খুব ভালো লাগে। চিন্তা ভাবনাহীন ভাবে মনের সুখে প্রায় সবাই জোড়ায় জোড়ায় রঙ বেরঙের পোশাক পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে সব ছেলেদের মোটরবাইক আছে তাদের তো আলাদা একটা কদর সবার কাছে রয়েছে।
সুমিতের মোটরবাইক তো কোন ছাড় ও নিজে চার চাকা গাড়ি ড্রাইভ করে শহরে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু কোথাও এতো কদর তো পায় না।
রমিতাকে সুমিতের বেশ পছন্দ হয়েছে। কিন্তু,রমিতা ওকে খুব গুরুত্ব দিল বলে মনে হলো না। রমিতের বন্ধু বলে একটা জাস্ট ক্যাজুয়াল ভাবে ওর সাথে কথা বলে চলে গেল। রমিত ওকে টাটা জানিয়ে আবার আসিস বলে রমিতার সাথে চলে গেল। সুমিত বাধ্য হয়ে সেদিন বাড়ি ফিরে গেল।
সুমিতের মনে হল রমিত ইচ্ছা করে ওর বাবা কতো বড়ো ব্যবসায়ী সেটা রমিতাকে বলেনি। রমিতা জানলে এতটা অবজ্ঞা করতে পারতো না। তাই সুমিত ওদের সম্পত্তি, এই শহরে ওদের প্রতিপত্তি রমিতা কে দেখানোর জন্য ওর জন্মদিনে রমিত কে নিয়ন্ত্রন করলো এবং সঙ্গে রমিতা কে নিয়ে আসতে বলে।
--রমিত বলে এই তো রমিতা আছে। তুই নিজেই নিমন্ত্রণ কর বন্ধু। এই বলে ফোনটা রমিতাকে দেয়।
-- আমার জন্মদিনে আসলে আনন্দিত হবো। আপনি বললে আমি ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়ি আপনার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবো।
-- ধন্যবাদ, আপনাকে। আমি ও রমিত টোটো করে চলে যাবো।
-- সুমিত এতে বেশ অপমানিত বোধ করলো। এত অহংকার যে আমার গাড়ি পাঠানোর অফার গ্রহন করলো না।
রমিত নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে এখনো ওকে কিছু বলে নি। যদি রমিতা হাতছাড়া হয়ে যায় সেই ভয়ে রমিত ওকে আমার সম্বন্ধে কিছু বলতে চায় না।
-- জন্মদিনে এসেও রমিতা যতটুকু না করলেই নয় ততটুকুই করে। বাড়ি গাড়ি দেখে,জন্মদিনের আতিশয্য দেখে সুমিত কে অতিরিক্ত কোন গুরুত্ব দেয়না। রমিতের সাথে খাওয়া দাওয়া গল্প গুজব করতে থাকে।
-- জন্মদিনের পার্টি চলাকালীন সুমিত অপমানে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। রমিতের প্রতি শোধ নিতে চায়।
-- আরে কোথায় আনলে কোল্ডড্রিঙ্কস?
-- তুমি খাবে? বলে রমিতের জন্য কোল্ড ড্রিঙ্কস আনতে ইভেন্ট বয় দের কাছে যায় রমিতা।
-- ইভেন্ট বয়ের কাছ থাকে ড্রিঙ্কস নিয়ে এসে রমিত কে দেয়।
-- কোল্ড ড্রিঙ্কস নিয়ে রমিত খেতে থাকে।
-- কোল্ডড্রিঙ্কস খাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যে মাথা একটু ঝিমঝিম করতে থাকে। রমিত তাতে গুরুত্ব না দিয়ে আনন্দে মেতে থাকে।
-- রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে রমিত ও রমিতা অন্যদের মতোই বেশ আনন্দ করে বাড়ি ফিরে যায়।
-- সকালবেলায় খবর পাওয়া যায় রমিত বিছানায় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে।
-- বাড়ির লোক তাড়াতাড়ি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
-- হাসপাতালে ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেন রমিত গতরাতেই মারা গেছে।
-- ঘটনার আকস্মিকতায় রমিতা ঘাবড়ে যায়। নিজে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরে।
-- পোস্টমর্টেম করে জানা যায় রমিত বিষক্রিয়ায় মারা গেছে।
-- পুলিশ কেস হয়। পুলিশ ইনভেস্টিগেট করতে সুমিত দের বাড়ি যায়। ওখান থেকে সিসি টিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে।
সিসিটিভি ফুটেজ থেকে পুলিশ প্রাথমিকভাবে সন্দেহ করে যে রমিতার দেওয়া কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়ার পরে রমিতের আচার ব্যবহারে যথেষ্ট পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। তাই মনে হয় ওই ড্রিঙ্কসে কিছু ছিল।
-- পুলিশ রমিতা কে সন্দেহ করতে থাকে এবং মনে করে যে রমিতার দেওয়া কোল্ড ড্রিংকসে বিষ মেশানো ছিল। আর সেটা খেয়েই বিষ ক্রিয়ায় রমিতের মৃত্যু হয়েছে।
-- রমিতের বাড়ির লোকেরা পুলিশের কাছে এই খবর পেয়ে তারাও রমিতা কে সন্দেহ করে এবং তার নামে এফ আই আর করে।
-- আসড়ে নামে সুমিত। ফোনে যোগাযোগ করে রমিতা দের বাড়ি গিয়ে সহানুভূতি দেখাতে থাকে। নানাভাবে আশ্বাস দিতে থাকে যে সুমিত কোনোভাবেই রমিতার ক্ষতি হতে দেবে না।
-- রমিতা নিজে বুঝতে পারে না কিভাবে রমিত কে খেতে দেওয়া ড্রিঙ্কসে বিষ এলো।
-- রমিতার পিসতুতো দাদা শুভাশীষ একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা। রমিতা ওকে পুরো ঘটনা খুলে বলে। আর ওকে এই বদনাম থেকে মুক্ত করতে বলে।
-- শুভাশিস বাবু প্রথমে থানার ওসির সঙ্গে কথা বলেন। জানতে চান রমিতা যদি খুন করে তাহলে খুনের মোটিভ কি হতে পারে? রমিতা প্রেগন্যান্ট নয় বা এর আগে কোনভাবে কারো কাছে রমিতের নামে যৌন উৎপীড়নের অভিযোগ করেনি। তাহলে কেন রমিতা এই খুন করতে যাবে?
-- পুলিশের মাধ্যমে প্রাইভেট গোয়েন্দা নিয়োগের খবর সুমিতের কাছে পৌঁছে যায়।
-- আর সেদিন থেকেই রমিতার কাছে হুমকি ফোন আসতে থাকে। বিভিন্ন নম্বর থেকে কেউ একজন ফোন করে বলে প্রাইভেট গোয়েন্দা নিয়োগ করে অন্য কাউকে খুনি হিসেবে ফাঁসাতে গেলে ওকেও খুন হতে হবে।
-- রমিতা সমস্ত ফোন কলগুলি রেকর্ড করে রেখে শুভাশিস এর হাতে তুলে দেয়।
-- ফোন কলগুলি বিশ্লেষণ করে শুভাশিস বাবু দেখেন সমস্ত ফোনই আসছে এই শহরের বিভিন্ন প্রান্তের কল সেন্টার থেকে। অর্থাৎ খুনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি এই শহরের বাসিন্দা এবং এখনো এই শহরেই আছে।
-- শুভাশিস বাবু টেলিফোন অফিসের সাহায্যে এই সমস্ত কল সেন্টারের ঠিকানা জোগাড় করে ওই সময়ে কে ওখানে ফোন করতে এসেছিল তা জানার চেষ্টা করেন।
-- দেখা যায় ওই সময়ে বিভিন্ন কল সেন্টার থেকে একটি মানুষ রীতিমতো মুখ ঢেকে এই ফোনগুলো করে, যাতে করে ওকে কেউ চিনতে না পারে।
-- কলসেন্টার থেকে জানা যায় যে ফোন করছে সে একজন মহিলা। কিন্তু,ফোনে তো পুরুষের কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। শুভাশীষ বাবুর কাছে সব শুনে পুলিশের ইনভেস্টিগেশন টিম ধন্দে পড়ে যায়।
-- বিভিন্ন কল সেন্টারের মালিকের কাছে ওই মহিলার বিবরণ শুনে একজন শিল্পীকে দিয়ে তার ছবি আঁকার ব্যবস্থা করেন শুভাশীষ বাবু।
-- শিল্পীর আঁকা ছবি রমিতা কে দেখানো হলে সে চিনতে পেরে বলে এটা আমার ছোটবেলার বান্ধবী প্রমীলা।
-- শুভাশিস বাবু পুলিশকে সমস্ত ঘটনা জানায়। পুলিশ প্রমীলার বাড়ি গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
--- পুলিশি জেলার মুখে প্রমিলা স্বীকার করে যে সে রমিতের ড্রিঙ্কসে বিষ মিশিয়ে ছিল।
-- ছোটবেলা থেকে রমিত,রমিতা ও প্রমিলা একজায়গায় টিউশন পড়তো। রমিত যেমন পড়াশোনায় ভালো ছিল তেমনি দেখতেও খুব সুন্দর ছিল। তাই ছোট থেকে প্রমিলা অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসাবে রমিত কে চাইতো। কিন্তু বলার কোন সুযোগ ও পায়নি।
-- কলেজে পড়তে গিয়ে রমিতার সাথে জড়িয়ে পরে রমিত। এটা কোন ভাবেই সহ্য করতে পারে না প্রমিলা। সুযোগের আশায় ও দিন গুনতে থাকে। তাই সুমিতের জন্মদিনের পার্টি কে সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করে।
-- সুমিত ও রমিত ছোট থেকে একই স্কুলে পড়াশোনা করেছে। তাই প্রমিলা ওদের কমন বন্ধু। সেই অর্থে প্রমিলার এখানে নিমন্ত্রণ।
-- সুমিত যখন মনে মনে ভাবছে রমিতের কোল্ড ড্রিঙ্কসে বিষ মিশিয়ে দিয়ে রমিত কে পৃথিবী সরিয়ে দিল তবেই রমিতা ওকে গুরুত্ব দেবে ঠিক তখন ও দেখতে পায় প্রমিলা লুকিয়ে কোল্ড ড্রিঙ্কসের একটা গ্লাসে কিছু মেশাচ্ছে। আর সেই গ্লাসটাই বয় কিছুক্ষণ পরে রমিতার হাতে তুলে দেয়। সুমিত এটাই চাইছিল। তাই সে পুরো ঘটনা চেপে যায়।
-- সুমিত জানতো পুলিশি ব্যাপারটা টাকা দিয়ে সামলে নেবে। কিন্তু যতো গোল বাঁধলো রমিতা শুভাশীষ বাবুকে নিয়োগ করে দেওয়ায়।
-- প্রমিলা কে ডেকে সুমিত প্রাইভেট গোয়েন্দা নিয়োগের কথা জানায়। তখন দুজনে মিলে পরামর্শ করে রমিতা ভয় দেখাবার চেষ্টা করে।
-- প্রমিলা ওর পরিচিত যে ছেলেটিকে দিয়ে বিষ নিয়ে এসেছিল তাকে দিয়েই ভয় দেখানোর কথা গুলো বলায় এবং ভয়েস রেকর্ড করে। কল সেন্টারে ঢুকে রিসিভারের কাছে সেই কলরেকর্ড চালিয়ে দেয়।
-- প্রমিলা ও সুমিত দুজনকেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
