Sukdeb Chattopadhyay

Comedy

5.0  

Sukdeb Chattopadhyay

Comedy

চরিত্রহীন

চরিত্রহীন

5 mins
950


ওই নব ডাক্তার যেন আর আমাকে দেখতে না আসে। অন্য কোন ডাক্তার পাওয়া যায় ভাল, না হলে আমার আর চিকিস্যের দরকার নেই। -- বেশ জোরের সঙ্গে ছেলেপিলেদের সামনে নিভাননি নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন।

কি এমন হল যে ডাক্তারবাবুর ওপর হঠাৎ মা এত চটে গেল। ছেলে বৌদের কাছে ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না।

বড়ছেলে বিনয় জিজ্ঞেস করে—কেন মা কি হল? নবারুন সান্যাল তো ভাল ডাক্তার, এলাকায় নাম আছে। এতদিন ধরে তোমায় দেখছেন। দেখতে দেখতে উনি তোমার ধাত বোঝেন, তাই চিকিৎসায় চটপট কাজও হয়।

-- তা তোমরা ওকে দিয়ে চিকিস্যে করাও না বাপু, আমি তো না করিনি। ওপরের জনটির তো নব ছাড়া চলবেই না। একটু জোরে পেট ডাকলেই বাবু ছুটবে নবর কাছে। তবে বলে রাখলাম, ওই মুখপোড়া ডাক্তার বাড়িতে এলেও আমার এদিকপানে যেন না আসে।

ছোট ছেলে বিজয় অধৈর্য হয়ে বলে—কি হয়েছে সেটা তো বলবে।

--এটুকু শুধু জেনে রাখ, লোকটার চরিত্তির ভাল নয়। কে ওকে এবাড়িতে এনেছে দেখতে হবে তো! তার পছন্দ কোনোদিন ভাল হয়েছে?



ইঙ্গিতটা নিজের কত্তা অর্থাৎ ‘ওপরের জনের’ দিকে। নিভাননিকেও যে সেই মানুষটাই একসময় পছন্দ করে এনেছে এ কথা বলার ধৃষ্টতা কেউ দেখাল না। নিজের স্বামীকে যে মাঝে মাঝেই ‘ওপরের জন” বলে নিভাননি উল্লেখ করেন তা কিন্তু কোন সম্মান দেখিয়ে নয়। নিভাননির যেখানে আস্তানা অর্থাৎ বিছানা পাতা তার ওপর তলায় ঠিক একই জায়গায় কত্তা সুরেনবাবু থাকেন। ওপরে থাকেন বলে ‘ওপরের জন’। এক ঘরে থাকার পাট বহুদিন চুকে গেছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন কারণে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতা বাড়ে। হয়ে ওঠে একে অপরের অবলম্বন। সুরেনবাবু আর নিভাননি দাম্পত্য জীবনে একটা সময়ের পর থেকে এই চেনা ছকে এগোতে পারেননি। বাড়িতে ছেলে আর বৌমারা থাকায় নির্ভরতা আর সাহচর্যের জন্য বিশেষ কারোর মুখাপেক্ষী হওয়ার প্রয়োজন নেই। ফলে একলা চলো রে।



রবীন্দ্রনাথের এই প্রসঙ্গে একটা পরামর্শ আছে-“লোকে ভুলে যায় দাম্পত্যটা একটা আর্ট, প্রতিদিন ওকে নতুন করে সৃষ্টি করা চাই”।

নিভাননি ভোলেননি। দাম্পত্য জীবনকে তাঁর মত করে প্রতিদিন  নতুন ভাবে (অনা)সৃষ্টি করেন। সম্পর্ক যে বরাবরই এমন তা নয়, ভাব ভালবাসা যে একসময় কিছুটা ছিল সন্তান সন্ততিরাই তার প্রমাণ। তবে এখন তা ফল্গু নদীর মত। বাইরে একেবারেই শুকিয়ে গেছে, খুঁড়লে ভেতরে তলানি কিছু থাকলেও থাকতে পারে। নিভাননির শরীরটা অনেকদিনই ভেঙে গেছে। একটু আধটু যা ঘোরাঘুরি করেন তা ঘরের মধ্যেই ধরে ধরে। অন্যদিকে সুরেন বাবু এই বয়সেও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। রোগঘোগ প্রায় নেই বললেই চলে। রোজ বাজারে যান। সান্ধ্য ভ্রমণেও নিত্য বেরোন। খানিক ঘোরাঘুরি করেন, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেন, মাঝে মাঝে লাইব্রেরিতে বই আনতে যান। শ্ত্রুর মুখে ছাই দিয়ে জীবনটাকে গুছিয়ে উপভোগ করছেন। রোগে ভুগে ভুগে আজকাল নিভাননির মেজাজটাও বেজায়  খিটখিটে হয়ে গেছে। নিজের সার্বিক অক্ষমতার মাঝে স্বামীর এ হেন ফুরফুরে জীবনযাত্রা হজম করা কঠিন। কত্তা বাইরে বেরোবার সময় নজরে পড়ে গেলে তাঁর উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করেন হৃদয় দহন করা নানান টিপ্পুনি। অধিকাংশ দিন সুরেন বাবু গায়ে না মেখে বেরিয়ে যান। এক এক দিন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, উনিও পাল্টা দেন। জমে যায় তরজা। বাড়ির লোকেদের কাছে এ বড় উপাদেয় বিনোদন।



কোন একটা পালা পার্বণের দিন ছিল। সুরেন বাবু সাজগোজ করে বেরতে যাচ্ছেন, নিভাননিও সেই সময় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে ঘরের সামনে একটা মোড়ায় বসেছেন।

একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে ছাড়লেন—চললেন বাবু ফুর্তি করতে। সাজ দেখ, যেন ছোকরা। চুলে আবার অ্যালবোট কাটা হয়েছে।

সুরেন বাবু সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ঘাড় ঘুরিয়ে আস্তে করে বললেন—স্নো পাউডার মেখে, সাজগোজ করে বেরলেই তো হয়। কেউ তো আর মানা করেনি। তবে সমস্যা একটাই, ইদানীং রাস্তায় বড় কুকুরের উপদ্রব হয়েছে, লোক বিশেষে তাড়া করছে।

আগুনে ঘি পড়ল। কত্তার চরিত্রের দোষ থেকে আরম্ভ করে চট জলদি যা যা কু কথা মনে পড়ল একবারে উগরে দিলেন। তবে টার্গেট ততক্ষণে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পৌঁছে গেছে।

 

ডাক্তার নবারুন বাবার বন্ধু স্থানীয়। কিন্তু সেটাই যদি মায়ের অপছন্দের কারণ হয় তাহলে তো অনেক আগেই তাঁকে বিদেয় করে দেওয়ার কথা। কিন্তু এতদিন তো কোন সমস্যা হয়নি। আর সমস্যা বলে সমস্যা, একেবারে চরিত্র নিয়ে টানাটানি। শেষবার যখন ডাক্তারবাবু নিভাননিকে দেখতে এসেছিলেন ছোট বৌ মালা ওই সময় সামনেই ছিল, ওরও তেমন অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি। মায়ের বয়স পঁচাত্তর পার হয়েছে আর ডাক্তারের আরো কয়েক বছর বেশি। মায়ের আড়ালে ছেলে আর বৌয়েরা তো হেসেই খুন। দুই বউয়ের ওপর ভার পড়ল মায়ের ডাক্তারের ওপর চটার আসল কারণটা জানার।

দুই বউমা একান্তে শাশুড়ির সাথে কথা বলে জানতে পারল যে ডাক্তার নাকি বার কয়েক তাঁর বুকে স্টেথো বসিয়ে পরীক্ষা করেছে। এতেই নাকি তাঁর শ্লীলতাহানি হয়েছে। বৌয়েরা হেসে কুল পায় না। বুড়িকে বোঝাবার চেষ্টা করে যে বুকে স্টেথো না বসালে চেস্ট কনজেশন আছে কিনা ডাক্তার বাবু বুঝবেন কি করে।

উত্তর আসে—কেন পিঠের দিক থেকে দেখলেই হত। আর মুখপোড়া এসেছিল তো আমার বারে বারে দাস্ত হচ্ছে তার চিকিস্যে করতে। তা পেট ছেড়ে বুকে ওঠার কি দরকার?

অকাট্য যুক্তি, বৌমারা আর কথা বাড়ায়নি।

ঘর থেকে বেরিয়ে মালা বড় জা তনিকে বলে—দিদি, আমার অন্য কিছু সন্দেহ হচ্ছে। ডাক্তার বাবুতো যখনই আসেন স্টেথো দিয়ে মার বুক পিঠ পরীক্ষা করেন। কোনোদিন তো এমন খেপতে দেখিনি। সেদিনও পরীক্ষা করার সময় মা দিব্য শুয়ে ছিল।

তনিও মালাকে সমর্থন করে বলে—ঠিকই বলেছিস, আমারও মনে হচ্ছে গণ্ডগোল অন্য কোথাও।

মায়ের এমন অভিনব অভিযোগের পর্দা ফাঁস হল কদিন বাদে বিকেল বেলায়।

নিভাননির ঘর থেকে ভেসে এল জোরাল গর্জন—তুই আমার মুখের ওপর চোপা করছিস। বারণ করেছে, নিকুচি করেছে তার বারণের।

বলাইয়ের আকুতি শোনা গেল—কাকিমাদের না বলে আমি আনতে পারব না।

-- ও তাই! আমি বাড়ির মালকিন। আমার কথার অমান্যি করলে দূর করে দেব।

বৌয়েরা পাশের ঘরে গল্প করছিল, কথোপকথন কানে যেতে গল্প থামিয়ে ও দিকেই মনোনিবেশ করল।

যার ওপর গালমন্দ বর্ষিত হচ্ছে সেই বলাই এ বাড়ির সারাদিনের কাজের লোক। ষোল সতের বছরের কিশোর। বাড়ির লোকের মতই হয়ে গেছে। নিভাননির খুব আস্থাভাজন এবং মূলত তাঁকেই দেখভাল করে। তাঁর অনেক নিষিদ্ধ এবং গোপন কাজকর্মের শরিক। কিছুদিন আগে ফুটের দোকান থেকে পিঁয়াজি এনে ঠাকুমাকে গোপনে ডেলিভারি করার আগে সিঁড়িতেই মালার কাছে ধরা পড়ে গিয়েছিল। আড়াল করে ঠিকঠাকই আনছিল কিন্তু গরম পিঁয়াজির গন্ধই কাল হল। না দিলে ঠকুমার কাছে ঝাড় খাবে এইসব বলে কেঁদে কেটে বলাই সেদিন অনেক কষ্টে রেহাই পেয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল যে এই কাজ তাকে মাঝে মাঝেই করতে হয়। কথা দিতে হয়েছিল যে ভবিষ্যতে বাড়ির কাউকে না জানিয়ে এমন কাজ করবে না।

সেদিন ডাক্তারবাবু পেটের সমস্যার জন্য ওষুধ লেখার আগে বাইরের কিছু খেয়েছেন কিনা জিজ্ঞেস করায় নিভাননি সামান্যতম চিন্তা না করেই না বলেছিলেন। মালা আড়ালে ডাক্তারবাবুকে পিঁয়াজির কথাটা বলে দিয়েছিল। তাতেই নব ডাক্তার খানিক বিরক্ত হয়ে বলেছিল—আমি জানি আপনি মাঝে মাঝে বাইরের এটা ওটা খান। এই বয়সে বাইরের খাবার একেবারে চলবে না।

এরপর নিভাননির সামনেই বৌমাদের এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। ডাক্তারের সামনে বুড়ি হাসিমুখে নিদান মেনে নিয়েছিলেন।

বলাই ঘরের বাইরে আসতেই জেরার মুখে পড়ল। জানা গেল পেটটা একটু সামলাতেই বুড়ির আবার কদিন থেকে নিষিদ্ধ বস্তুর জন্য মনটা ছটফট করছে। বলাইকে এর মধ্যে দু একবার চুপিসাড়ে আনতে বলাও হয়েছে, বলাই ভয়ে রাজি হয়নি। আজ আর কোন লুকোছাপা নেই, একেবারে হুকুম।

এতদিনে নব ডাক্তারের ওপর নিভাননির আক্রোশের কারণটা সকলের কাছে পরিষ্কার হল।

ডাক্তার বুড়ির বুকে নয় হাত দিয়েছে একেবারে ফান্ডামেন্টাল রাইটে। অধিকার হননের প্রতিশোধেই ডাক্তারের চরিত্র হনন।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy