লটারির শহর --( শারদ সংখ্যা )
লটারির শহর --( শারদ সংখ্যা )
ভাল থাকতে কে না চায়। কেউ যদি একটু ভাল থেকেও থাকে তবু আর একটু ভাল থাকতে পারলে মন্দ লাগার কথা নয়। এই আর একটু ভাল থাকতে গেলে লাগে বিদ্যা, বুদ্ধি, একাগ্রতার মত কিছু চারিত্রিক গুণাবলির সাথে কিছুটা ভাগ্য। আবার শুধুমাত্র ভাগ্যের জোরেই কেউ কেউ পেয়ে গেছে অনেক কিছু। তাই ভাগ্যের গোড়ায় সার দিতে মানুষ আদিকাল থেকেই সচেষ্ট। পাশা খেলা থেকে লটারি সবেতেই মানুষ মেতেছে চট জলদি ভাগ্য ফেরাবার তাগিদে।
এ তো গেল ব্যক্তির কথা। কিন্তু একটা গোটা শহরের অবস্থাও কি লটারি ফেরাতে পারে? আলবৎ পারে। পারে কেন, পেরেছে। আপনি কোলকাতার বাসিন্দা হলে জানবেন আপনার পাড়ার সামনের, পাশের বা একটু এগিয়ে ডানদিকের বা বাঁ দিকের বড় রাস্তার কোনটা না কোনটা লটারির দান। কি বললেন, কোলকাতায় থকেন না? তাতে কি হয়েছে, অফিস তো কোলকাতায়। বাসে, ট্রামে বা গাড়ি করে যে রাস্তা দিয়ে রোজ যাতায়াত করেন তার কোন একটি বা কয়েকটিতে লটারির ছোঁয়া লেগে আছে। এমনকি মিটিং বা সমাবেশের জন্য মাঝে মাঝে যেখানে জড় হন সেই স্কয়ারটাও লটারির দাক্ষিণ্যে তৈরি। আমাদের প্রাণের শহর কোলকাতার অনেকটাই গড়ে উঠেছে, পুষ্ট হয়েছে বা মসৃণ হয়েছে লটারির মাধ্যমে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকে উনবিংশ শতাব্দীর তিনের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত লাটারিই ছিল শহরের বৃদ্ধি এবং উন্নয়নের প্রধান অবলম্বন। সে কথায় পরে আসা যাবে, চলুন তার আগে বরং একটু দেখা যাক কয়েক শতাব্দী আগে কেমন ছিল জায়গাটা।
ভাগীরথী নদীর ধারে চারিদিকে জলা জংলার মাঝে ইতি উতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু গ্রাম—এই ছিল আজকের মহানগরের আদি রূপ। মূলত সবর, কিরাত আর ধিবররাই বাস করত এই সব গ্রামগুলিতে। কোলকাতা শহর হিসাবে অর্বাচীন কিন্তু গ্রাম হিদাবে প্রাচীন। বিপ্রদাসের ‘মনাসামঙ্গল’( ১৪৯৬ ) ও কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীকাব্য’ তে (রচনা ১৫৭৭ থেকে ১৫৯৭) পুণ্য তীর্থ কালী ক্ষেত্রের নিকটবর্তী পল্লীগ্রাম হিসাবে কলিকাতার উল্লেখ পাওয়া যায়। আবুল ফজলের ‘আইন-ই- আকবরি’তেও(রচনা ১৫৯০) ‘সাতগাঁ’র বা অধুনা সপ্তগ্রামের একটি মহল হিসেবে কলিকাতার উল্লেখ আছে।
ত্বরায় চলিল তরী তিলেক না রয়
চিৎপুর-সালিখা এড়াইয়া যায়।
বেতড়েতে উত্তরিল বেণিয়ার বালা,
কলিকাতা এড়াইল অবসান বেলা। --কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম।
সপ্তগ্রাম এক সময়ে এতদাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল। বাসুদেবপুর, বাঁসবেরিয়া, খামারপাড়া, দেবানন্দপুর, শিবপুর, কৃষ্ণপুর ও ত্রিশবিঘা, এই সাতটি গ্রাম নিয়ে একত্রে বলা হত সপ্তগ্রাম। সরস্বতী নদীর তীরে, ভাগীরথী এবং সরস্বতীর সঙ্গমস্থলের অনতিদূরে ত্রিবেণীর কাছে গড়ে উঠেছিল এই বন্দর। ‘সাতগাঁ’র বন্দরকে পর্তুগীজরা বলত ‘porto piqueno’ অর্থাৎ ছোট বন্দর আর ‘চাটগাঁ’র বন্দরকে বলত ‘porto grande’ অর্থাৎ বড় বন্দর। সরস্বতী নদী ধীরে ধীরে মজে যাওয়ার কারণে ষোড়শ শতাব্দীর শেষে সপ্তগ্রাম বন্দর-শহর হিসেবে তার গুরুত্ব হারায়। ইতিমধ্যে ওইখানকার বণিক সমাজের অনেকেই জীবিকার সন্ধানে হুগলীর আশেপাশে চলে আসেন। পরবর্তী সময়ে হুগলী হয়ে ওঠে ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র। ইতিমধ্যেই ইউরোপের নানা দেশ থেকে বাণিজ্যের আশায় মানুষজনের আসা যাওয়া শুরু হয়ে গেছে। কেবল যাওয়া আসাই নয়, এক একটি দেশের লোক সুবিধা মত এক একটি জায়গা বেছে স্থায়ীভাবে বাস করতেও শুরু করেছে। পর্তুগিজরা প্রথমে সপ্তগ্রাম(১৫৩৫) পরে হুগলী ও ব্যান্ডেল অঞ্চলে, ওলন্দাজরা চিনসুরায়(১৬৫৫), ফরাসীরা চন্দননগরে(১৬৯৭), দিনেমাররা শ্রীরামপুর(১৭৫৫), সকলেই কিন্তু আস্তানা গেড়েছে হুগলী নদীর পশ্চিম পারে। কারণ ঐ সময় পূর্বের তুলনায় নদীর পশ্চিম দিক অনেক বেশি উন্নত ছিল। ইংরেজরাও প্রথমদিকে নদীর পশ্চিম পারেই তাদের বাসা বাঁধে। প্রথমে উলুবেড়িয়া এবং পরে ঠিকানা পাল্টে হয় হুগলী। শিবপুরের ‘বেতর’ সেই সময় একটি উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। সারা বছর দেশি ও বিদেশি বণিকে বেতর গমগম করত। স্থানীয়রা বেচা কেনা সেরে দু চারদিন একটু বিশ্রাম নিয়ে মা চণ্ডীর পুজো দিয়ে তারপর রওনা হত নিজের নিজের আস্তানায়। অধিকাংশ ব্যবসাদার হুগলীতে চলে এলেও কালিদাস বসাক, বড়পতি বসাক, বাসুদেব বসাক, করুণাময় (মতান্তরে শিবদাস) বসাক আর মুকুন্দরাম শ্রেষ্ঠী(শেঠ) এইরকম কয়েকজন হুগলীর পরিবর্তে বেতরের বাণিজ্যিক আকর্ষণে আকৃষ্ট হয়ে হুগলী নদীর পূর্ব পারে ‘গোবিন্দপুর’ এ চলে আসেন(কটন ১৯০৯)। জঙ্গল কেটে জায়গাটাকে সাফ করে, ঘর বাড়ি তৈরি করে, পাকাপাকি ভাবে বাস করতে শুরু করেন। ঐ সময় ওই দিকে কালী মন্দির ছাড়া উল্লেখযোগ্য আর তেমন কিছু ছিল না। বড় রাস্তা বলতে মাত্র দুটো। একটা রাস্তা ছিল চিৎপুর থেকে চৌরঙ্গীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কালিঘাট পর্যন্ত। কাঁচা রাস্তা, বর্ষাকালে চলাচল করা দুষ্কর হয়ে যেত। তখন কালীঘাটের তীর্থ যাত্রীরা ডাকাত আর ঠ্যাঙাড়ের ভয়ে একসাথে দল বেঁধে যাতায়াত করত। হুতোমের লেখায় আমরা জানতে পারি যে চিৎপুর রোডের এই বেহাল অবস্থা বহুদিন পর্যন্ত ছিল। আর একটা রাস্তা ছিল বৈঠকখানা থেকে গঙ্গার ধার পর্যন্ত। ইংরেজরা আসার পর গোবিন্দপুর অঞ্চলে দুর্গ নির্মাণের উদ্যোগ নিলে শেঠ বসাকরা সুতানুটি হাট (বড়বাজার) অঞ্চলে চলে আসেন। পরবর্তীকালে সামাজিক প্রয়োজনে তাঁরা উদ্যোগী হয়ে কয়েক ঘর ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্যকে নিজেদের এলাকায় সংস্থাপিত করেন। ইংরেজরা আসার পর শেঠ ও বসাক পরিবারের দ্রুত সমৃদ্ধি হতে থাকে। জনার্দন শেঠ ও শোভারাম বসাক যাদের মধ্যে অগ্রগন্য।
কোলকাতার কথা বলতে গেলে জব চার্ণকের নাম আসবেই, তা আমরা তাকে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও। একটা সময় পর্যন্ত মনে করা হত জব চার্ণকই কোলকাতার প্রতিষ্ঠাতা। কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে ২৪ অগস্ট ১৬৮৬তে একটি কারখানা নির্মাণের উদ্দেশ্যে চার্ণক প্রথমবার সুতানুটিতে আসেন। ওই সময় টেক্সটাইল শিল্পে সুতানুটি বেশ নাম করেছে। প্রথম বার স্থানীয় মাথাদের বিরোধিতায় উদ্দেশ্য সফল না হলেও তৃতীয়বারের প্রয়াসে মোগল সম্রাটের সাথে সমঝোতার ফলে ১৬৯০ সালে সুতানুটিতে পাকাপাকি ভাবে বাস এবং ব্যবসা বাণিজ্য করতে শুরু করেন। সম্রাট জাহঙ্গিরের কাছ থেকে সাবর্ণ রায়চৌধুরিরা কলিকাতা এবং সন্নিহিত অঞ্চলের ( বরিশা থেকে হালিশহর ) জমিদারি সত্ত্ব পেয়েছিলেন। আওরঙ্গজেবের পৌত্র বাংলা বিহার উড়িষ্যার সুবাহদার আজিম-উস- শান ওরফে মুহম্মদ আজিমুদ্দীনের শাসনকালে ইংরেজ বণিকরা তাঁর কাছে সুতানুটি, ডিহি কোলকাতা এবং গোবিন্দপুরের জমিদারি সত্ত্বের জন্য আবেদন করে তা লাভ করে। সাবর্ণ রায়চৌধুরিরা এই সত্ত্ব কত টাকার বিনিময়ে ইংরেজদের দিয়েছিলেন তা নিয়ে ভিন্নমত আছে। ১৭১৭ সালে মুঘল সম্রাট ফারুক শিয়র ইংরেজদের ভারতের মাটিতে বাণিজ্য করার অধিকার প্রদান করেন।
চার্ণকের নামার দিনটিকেই ধরা হত কোলকাতার জন্মদিন। ওই দিনটিকে ধরেই সাড়ম্বরে পালিত হয়েছিল কোলকাতার ৩০০ বছর পূর্তির উৎসব। এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়, এমনকি কোর্ট কাছারিও হয়। সাবর্ণ চৌধুরীদের পরিবার এবং আরো কিছু বিশিষ্ট মানুষ কোলকাতা হাইকোর্টে এই দাবীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। বিভিন্ন গুণীজনদের নিয়ে একটি কমিটি তৈরি হয়। ওই কমিটির রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে ১৬মে ২০০৩ সালে কোর্ট রায় দেয় যে জব চার্ণক কোলকাতার স্রষ্টা নন।
কবি রুডইয়ার্ড কিপলিং কোলকাতা শহরটাকে নিয়ে লিখেছিলেন—
Thus the midday halt of Charnock–more’s the pity!
Grew a City.
As the fungus sprouts chaotic from its bed,
So it spread–
Chance-directed, chance-erected, laid and built
On the silt–
Palace, byre, hovel–poverty and pride–
Side by side;
And, above the packed and pestilential town,
Death looked down.
পড়লেই বোঝা যায় যে কোলকাতা তাঁর পছন্দের জায়গা ছিল না। কবিতাটির ছত্রে ছত্রে সে বিদ্রূপ ফুটে উঠেছে। একথা সত্য নয় যে কোলকাতার ভিত্তিভূমিটি নির্ধারিত হয়েছিল জব চার্ণকের এক মধ্য দিনের বিশ্রাম স্থলটিকে কেন্দ্র করে। আর শহরটিও ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠেনি। কোলকাতা হঠাৎ গজান, সহসা নির্মিত, পলিমাটির উপর স্থিত ও উত্তোলিত কোন শহর নয়। তবে দারিদ্র আর ঐশ্বর্যের অহংকার এই শহরে পাশাপাশি ছিল এ কথা সর্বৈব সত্য।
কলকাতা জনপদের প্রতিষ্ঠাতার স্বীকৃতি দেওয়া না গেলেও চার্ণকের হাত ধরে এই অঞ্চলে ইংরেজদের আগমনের ফলেই যে আজকের এই মহানগরের সম্ভাবনা অঙ্কুরিত হয়েছিল তা অস্বীকার করার জায়গা নেই।
১৭০৫ থেকে ১৭০৭ পর্যন্ত জরিপ করে দেখা যায় এই অঞ্চলের মোট এলাকা আনুমানিক ১৬৭৮.২ একর যার মধ্যে বাজার কলকাতা ১৬১.৫ একর, গোবিন্দপুর ৩৮৯.৪ একর, শহর কলকাতা ৫৬৭.৮ একর এবং সুতানুটি ৫৫৯.৫ একর।
স্থানীয় জমিদারদের উদ্যোগে হওয়া সন্নিহিত অঞ্চলের আর একটি সার্ভেতে দেখা যায় মোট ৫০৭৩ বিঘা জমির মধ্যে ১৬.% ছিল বাস্তু জমি, ৩০% ধানি জমি, ৯% বন জঙ্গল, ৫% কলার ক্ষেত, ৪% তামাক চাষ , ৩% তরিতরকারি চাষ , ৬% স্থানীয় বাসিন্দাদের পৈত্রিক জমিজমা, ৩% কতিপয় উচ্চবিত্তের, ২% রাস্তা, নালা ইত্যাদি এব অবশিষ্ট ২২% ছিল পতিত জমি।
ওয়াল্টার হ্যামিল্টনের লেখায় দেখতে পাই যে ১৭১৭ সালে অঞ্চলটি নদীয়া জেলার অংশ ছিল। চাঁদপাল ঘাটের দক্ষিণ দিকে জঙ্গল ছিল। খিদিরপুর এবং এই জঙ্গলের মাঝে দুটি ছোট গ্রাম ছিল যার বাসিন্দারা শেঠদের সাথে নিজভূমি ছেড়ে এখানে এসে নতুনভাবে বসতি স্থাপন করেছিল। তাই শহর গড়ে ওঠার এই পর্বে শেঠেদের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
স্থায়ীভাবে বাস করার এবং বাণিজ্য করার অধিকার পাওয়ার পর সাহেবরা শহরটাকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নিজেদের বাসযোগ্য করতে লেগে পড়ল। সেই সময়ে রাস্তা খুব কম ছিল। যে কটি ছিল সেগুলোরও খুবই ভগ্নদশা। নর্দমা, পানীয় জল, আলো, একটু সুন্দরভাবে, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের যা প্রয়োজন তার কোনটাই প্রায় ছিল না। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে স্বাভাবিকভাবেই অকালমৃত্যুর হার ছিল অত্যধিক বেশি।
প্রথম পর্যায়ে শহরটার সামগ্রিক বিকাশের দিকে সাহেবদের তেমন একটা আগ্রহ ছিল না। ফলে নগরায়নের কোন সুষ্ঠ পরিকল্পনা ছিল না। নিজেদের প্রয়োজন মোতাবেক বাড়ি ঘর তৈরি হতে লাগল। বর্তমান ফেয়ারলি প্লেস, কাস্টমস হাউস, কোলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট এবং জিপিও অঞ্চল নিয়ে গঙ্গার ধারে তৈরি হল কেল্লা। তখন গঙ্গা পূর্বদিকে বর্তমান স্ট্র্যান্ড রোড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কেল্লা সংলগ্ন ছিল ঘাট, কেল্লাঘাট। কেল্লার দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে একটি রাস্তা এই ঘাটে এসে শেষ হত। রাস্তাটির নাম ছিল কেল্লাঘাট রোড, যা আজকের কয়লাঘাট রোড। এই কেল্লার ভিতরে ছিল ব্রিটিশদের প্রথম উপাসনা গৃহ, সেন্ট অ্যানস গির্জা। গভর্নমেন্ট হাউস ও ফ্যাক্টরিও ছিল এই কেল্লার মধ্যে। সিরাজউদ্দৌলা ১৯৫৬ সালে ধ্বংস করার আগে পর্যন্ত এই কেল্লাই ছিল সেই সময়ের কোলকাতায় ব্রিটিশদের সরকারী কাজকর্মের কেন্দ্রস্থল। শহরটা অনেকদিন পর্যন্ত দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। যেদিকে সাহেবরা থাকত সেটি ছিল হোয়াইট টাউন, আর স্থানীয়দের বসতিকে বলা হত ব্ল্যাক টাউন। স্যার উইলিয়াম জোন্স এর লেখায় জানতে পারি যে হোয়াইট টাউন ছিল পরিকল্পিত এবং প্রশস্ত। এখানকার বাড়িগুলোও ছিল শক্তপোক্ত এবং বড়, বেশ কয়েকটি তো প্রায় প্রাসাদপমো। বর্তমান বিবাদী বাগ অঞ্চল ছিল হোউয়াইট টাউনের নিউক্লিয়াস। স্থানীয়দের কাছে এটি পরিচিত ছিল লালদীঘি নামে আর সাহেবরা বলত ট্যাঙ্ক স্কয়ার। পরবর্তীকালে গভর্নর জেনারেল ডালহৌসির নামে এর নাম দেওয়া হয় ডালহৌসি স্কয়ার। ট্যাঙ্ক স্কয়ার থেকে এসপ্ল্যানেড ও চৌরঙ্গীর সন্নিহিত অঞ্চলে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল শহরের হোয়াইট টাউন। নাতিদীর্ঘ এই অঞ্চলে প্রচ্ছন্ন ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শক্তি, বিত্ত এবং গরিমা।
শহরের উত্তর দিকে ছিল স্থানীয়দের বাস অর্থাৎ ব্ল্যাক টাউন। কেবল উত্তরই নয় শহরের পূর্ব দিকেও অনেকটা জায়গা জুড়ে স্থানীয় লোকেরা থাকত। ব্ল্যাক টাউনের পরিবেশ, পরিস্থিতি, ভাল ছিল না। ডঃ রোনাল্ড মার্টিনের পর্যবেক্ষণে ভারতের সব শহরের সব ত্রুটিগুলো এখানে জড়ো হয়েছে। এই অঞ্চল সম্বন্ধে প্রাইসের লেখায় দেখি চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, খানা, ডোবা, গলি, জঞ্জাল আর অপরিকল্পিত ঘরবাড়ি। যেমন বাড়ি তেমন বাসিন্দা, তেমনই পরিবেশ। চারিপাশে কাঁচা খোলা নর্দমা। নর্দমায় পচছে জন্তু জানোয়ার, এমনকি মরা মানুষ। টেরিটি বাজারে থাকতেন গ্যাঁপ্রি সাহেব। তিনি লিখেছেন যে রোগে এবং অ্যাকসিডেন্টে অনেক লোক রাস্তায় মারা যেত। তাঁর বাড়ির দরজার সামনে এমনই একটা মৃতদেহ নাকি দুদিন পড়ে ছিল। ব্ল্যাক টাউনে অসংখ্য মরা মানুষের কথা লেখা আছে হিকির স্মৃতি কথায়। অবশ্য তাঁর সেই সময়টা কোন স্বাভাবিক সময় ছিল না। সময়টা ছিল ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ বা ১১৭৬ বঙ্গাব্দ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ভয়াবহ সময়। স্বাভাবিক সময়ে অবস্থা নিশ্চয় এতটা করুণ ছিল না। সর্বোপরি হোয়াইট টাঊনের স্তুতি আর ব্ল্যাক টাউনের ভীতি, দুটোই পরিবেষণ করেছেন ব্রিটিশ লেখকরা। সাম্রাজ্যবাদীদের চোখে পরিস্থিতির পর্যালোচনায় কিছুটা পক্ষপাতের সম্ভাবনা থেকেই যায়।
ব্ল্যাক টাউনের পরিবেশ সুখকর ছিল না এটা নিয়ে কোন দ্বিমত নেই তবে সামগ্রিকভাবে পুরো এলাকার পরিবেশ ও পরিস্থিতি একরকম ছিল না। ব্ল্যাক টাউন সবটাই কালো ছিল না। এখানেও কিছু ঘরে আলো ছিল, যে সে আলো নয়, ঝাড়বাতির আলো। সাধারণ মানুষের সমস্যা সঙ্কুল জীবনের ছোঁয়াটুকু এখানে লাগত না। এই মানুষগুলোকে সাহেবরা সম্বোধন করতেন “বাবু” বলে। ভোগ আর বিলাসে সদা তরঙ্গায়িত ছিল এদের জীবন। শ্রাদ্ধই হোক বা বিয়ে, যে কোন অনুষ্ঠানেই নিজেদের মধ্যে ঐশ্বর্যের প্রদর্শনী আর প্রতিযোগিতা লেগে থাকত। কেউ কারো থেকে কম নয়। যাদের তোষামোদ করে বাবুদের এই বিত্ত বৈভব সেই সাহেবরাও এতটা ভাবতে পারত না।
ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকে(১৭২০) কোলকাতার জন্য একজন জমিদার থাকত। দিশী নয় ইংল্যান্ড থেকে নিয়োগ করা সাহেব জমিদার। মাইনে ছিল ২০০০/-টাকা,সেই সময়ের হিসেবে টাকার পরিমানটা ভালই। জমিদার বলে কথা, ভাল ত হতেই হবে। এই জমিদার ছিল তখনকার কোলকাতার সর্বময় কর্তা। ট্যাক্স আরোপ থেকে শুরু করে হিসাব রাখা, বিবাদ মেটান, বিচার, দন্ড, সব কিছুই এই একটি মানুষের অঙ্গুলি হেলনে চলত। কিন্তু একজন ইংল্যান্ড থেকে আসা সাহেবের পক্ষে স্থানীয় মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখা কঠিন, তাই এনার একজন স্থানীয় ডেপুটি বা চ্যালা থাকত। বলা হত ব্ল্যাক জমিদার। ৩০/-টাকা মাইনেতে ব্ল্যাক জমিদার হলেন গোবিন্দরাম মিত্র।। পরে মাইনে বেড়ে হয়েছিল ৫০/- টাকা। কোলকাতার সাহেব জমিদার নানা কারণে মাঝে মাঝেই বদল হত, কিন্তু ব্ল্যাক জমিদার অনেকদিন একই রয়ে গিয়েছিলেন। সুযোগ কাজে লাগিয়ে মাত্র ৫০/-টাকা মাইনেতেই গোবিন্দরাম একসময় ধনকুবের হয়ে উঠে ছিলেন। “বাবু” দের অনেকেই ইংরেজদের মোসাহেবি করে গোবিন্দরামের পথে বিপুল অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই ব্ল্যাক মানে কেবল অন্ধকার নয়, ইতি উতি আলোর ঝলকানিও ছিল।
এই ব্ল্যাক টাউন আর হোয়াইট টাউনের মাঝে ছিল আর একটি টাউন, গ্রে টাউন। আজকের বড়বাজার, বৌবাজার, লেনিন সরণির সন্নিহিত অঞ্চল নিয়ে ছিল এই গ্রে টাউন। এখানে থাকতেন আর্মেনীয়, ইহুদি, পর্তুগিজ, চীনা, গ্রিক ও মিশ্র রক্তের মানুষজন। এদের জীবনধারা এবং সংস্কৃতি ভিন্ন ছিল। যার কিছু চিহ্ন এখনও শহরের বুকে রয়ে গেছে।
আগেই উল্লেখ করেছি যে প্রথম দিকে শহরের সকল অধিবাসীদের সুখ স্বাচ্ছন্দের প্রতি ব্রিটিশদের তেমন একটা নজর ছিল না, তাই কোন পৌর প্রতিষ্ঠানও ছিল না। কেবলমাত্র বিচার বিভাগীয় কাজকর্মের জন্য ১৭২৬ সালে রয়্যাল চার্টারের মাধ্যমে চালু হায়েছিল ‘মেয়রস্ কোর্ট’। এই দপ্তরই পৌর কাজকর্মও দেখাশুনো করত। নবাবের সাথে বিবাদ চিরতরে নির্মূল হওয়ার আগে পর্যন্ত শহরটা অনেকদিন স্ট্যগন্যান্ট অবস্থায় ছিল। সাহেবদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা কেল্লা কেন্দ্রিক হোয়াইট সিটির স্বল্প পরিসরেই আবদ্ধ হয়ে ছিল। ক্লাইভ(১৭৫৭-১৭৬০ এবং ১৭৬৫-১৭৬৭), ভ্যান্সিটার্ট( ১৭৫৯-১৭৬৪) , ভেরেলস্ট(১৭৬৭-১৭৬৯), কার্টিয়ার(১৯৬৯-১৭৭২), এদের পুরো অধ্যায়টা ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্থিতিশীলতা কায়েম করতেই কেটে গেছে। এ কে রায়ের লেখায় জানতে পারি যে ১৭৮০ সালেও শহরের অনেকটাই জলাভূমি ও জঙ্গলের কারণে বাসের অযোগ্য ছিল। “Calcutta at this time(1780) was little better than an undrained swamp, in the immediate vicinity of a malarious jungle,’the ditch surrounding it was, as it had been for thirty years previously, an open cloaca, and its river banks were strewn with the dead bodies of men and animals,”
কোলকাতা শহর নিয়ে নতুন চিন্তা ভাবনা শুরু হয় ওয়ারেন হেস্টিন্স(১৭৭৪-১৭৮৫) এবং কর্নওয়ালিসের(১৭৮৬-১৭৯৩) আমলে। গড়ে উঠতে থাকে স্থাপত্যের নানা নিদর্শন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১২ই অগস্ট ১৭৬৫তে বাংলার দেওয়ানি সনদ পেল। বিচার ও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব বর্তাল কোম্পানির উপর। এর ফলে নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের কিছুটা মানবিক দায় কোম্পানির উপর এসে পড়ল। ১৭৭৩ সালে কোলকাতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী হওয়ার পর পৌর প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভূত হল। কোলকাতার বেতনভুক জমিদার এবং তার পারিষদেরা শহরের রক্ষণাবেক্ষণে ব্যর্থ ও অসমর্থ প্রতিপন্ন হয়। ১৭৯৪ সালে শহরের প্রশাসনিক দায়িত্ব কালেক্টারের হাত থেকে ‘জাস্টিস অফ দ্য পিস ফর দ্য টাউন’ এর হাতে তুলে দেওয়া হয়। মূল্যায়ন বিভাগ দেখাশোনার দায়িত্বে একজন কালেক্টর এবং কার্যনির্বাহী বিভাগে রাস্তাঘাট রক্ষণাবেক্ষণে তদারকির জন্য একজন ইঞ্জিনিয়ার থাকত। এর চেয়ারম্যান পৌরসভার কার্যনির্বাহী বিভাগ, মূল্যায়ন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং পুলিস, এই সব বিভাগেরই মাথা ছিলেন।
জাস্টিস অফ পিসের তদারকিতে শহরের নিয়মিত মুল্যায়ন আরম্ভ হয়। ১৭৯৫ সালে প্রথম মূল্যায়ন হয় মিঃ ম্যাকলের তত্ত্ববধানে। তৎপরতার সঙ্গে শুরু হয় শহর সংস্কারের কাজকর্ম, যার প্রথমেই ছিল সার্কুলার রোডকে পাকা করার উদ্যোগ। এই ব্যাপারে বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর, ১৭৯৯ ক্যালকাটা গেজেটে এই নোটিশটি দেওয়া হয়—
“Notice is hereby given that His Majesty's Justices of the Peace will receive proposals of contract, which must be delivered sealed to their first clerk, Mr.John Miller, within one week from this date, for leveling, dressing and making in pucker,within the least possible time, the road forming the eastern boundary of the town, commonly called the. Bytockunah Road, and commencing from the Russapugla Road at the comer of Chowringhee and terminating at Chitpur Bridge.”
উপরিউক্ত নোটিশ ছাড়াও এই সময় শহরের রক্ষণাবেক্ষণের দিকে যে বিশেষভাবে নজর দেওয়া হয়েছিল তার প্রমাণ পাই আর একটি টেন্ডারে, যা ডাকা হয় ১৭ই ডিসেম্বর ১৮০১সালে। ওই টেন্ডারে রাস্তাঘাট এবং নর্দমা পরিষ্কার করার পর সাফাইওয়ালাদের জমা করা ময়লা গাড়ি করে নিয়ে গিয়ে ফেলে আসার জন্য ৮৫ জোড়া শক্তপোক্ত বলদ এবং সেই অনুপাতে গাড়োয়ান চাওয়া হয়েছিল। এই সময় নিয়মিত রাজস্ব আদায় করা হত এবং সেই টাকা রাস্তাঘাট, নালা, নর্দমা, ইত্যাদির রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কারে ব্যবহৃত হত। কিন্তু সেই সময় শহরের হাল এতই বেহাল ছিল যে সুস্থ স্বাভাবিক বসবাসের পরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই কাজ অপ্রতুল ছিল।
এই সময়ে কোলকাতার গভর্নর জেনারেলের দায়িত্বে আসেন লর্ড ওয়েলেসলি(১৭৯৮-১৮০৫)। তাঁর আমলেই কোলকাতাকে একটি রাজকীয় শহরে উন্নীত করার স্বপ্ন ডানা মেলে। শহরের আধুনিকীকরণ নিয়ে তাঁর অনেক পরিকল্পনা ছিল এবং সেগুলি বাস্তবে পরিণত করতে কোনও বাধাই তিনি মানেননি। অনেক সময়েই ডিরেক্টরদের না জানিয়ে, খরচাপাতি করে সেই কাজ শেষ করেছেন। যদিও এই সব কিছুই তিনি করেছেন ব্যবসা এবং ঔপনিবেশিক স্বার্থকে সুরক্ষিত করতে। তবু উপজাত হিসেবে কোলকাতা পেয়েছিল অনেক কিছু। অনেকেই তাঁর শহর উন্নয়নের পরিকল্পনার মধ্যে ‘Baroque’ এবং ‘neo-classical’ ধারণার ছায়া দেখতে পান। ১৮০৩ সালে কলকাতায় বানালেন বিরাট প্রাসাদ— ‘ক্যালকাটা গভর্নমেন্ট হাউস’, আজকের ‘রাজভবন’। ১৮০০ সাল থেকে ব্যারাকপুরে গঙ্গার ধারে তৈরি করা শুরু করলেন এক মনোরম উদ্যান— ‘ব্যারাকপুর পার্ক’। তিন বছরের মধ্যেই সেই পার্কের আয়তন গিয়ে দাঁড়াল ১০০৬ বিঘা। সেই পার্ককে এখন আমরা ‘লাটবাগান’ বা ‘মঙ্গল পান্ডে উদ্যান’ নামে জানি। পার্কে আর এক প্রাসাদ তৈরির কাজ যখন চলছে, তখন অস্থায়ী ভাবে থাকার জন্য গঙ্গার তীর ঘেঁষে বানালেন একটি বড় দোতলা বাড়ি। প্রাসাদ আর শেষ হয়নি, ক্রমে ওই দোতলা বাড়িটিই হয়ে উঠল ‘ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট হাউস’, সব গভর্নর জেনারেল আর ভাইসরয়দের প্রিয় ‘কান্ট্রি হাউস’। এই বাড়িতেই ছিল পুলিশ হাসপাতাল। ক্যালকাটা গভর্নমেন্ট হাউস থেকে ব্যারাকপুর পার্কে পর্যন্ত সহজে যাতায়াতের জন্য ওয়েলেসলি বানিয়ে ফেললেন শ্যামবাজার থেকে ব্যারাকপুর পর্যন্ত টানা এক রাস্তা, এখন যার নাম বি টি রোড। ইংরেজ কর্মচারীদের স্থানীয় ভাষা শেখানোর জন্য ১৮০০ সালে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে চালু করলেন ‘ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ’।
গভর্নমেন্ট হাউস তৈরি করতে বিশাল খরচ হয়। ১৮০৩ সালে সমসাময়িক পর্যটক লর্ড ভ্যালেন্সিয়ার এই ব্যাপারে লিখেছেন-
‘The sums expended upon it have been considered as extravagant by those who carry European ideas and European economy in to Asia, but they ought to remember that lndia is a country of splendour, of outward appearance: the Head of a mighty Empire ought to conform himself to the prejudices of the country he rules over. In short I wish lndia to be ruled from a palace not from a country house. with the Ideas of a Prince, not with those of a retail- dealer in muslins and indigo.”
তখন রাস্তা, পয়ঃপ্রণালি ছাড়াও বাজার, বসত বাড়ি, কশাইখানা, কবরস্থান ইত্যাদিও ছিল অসংগঠিত ও বিশৃঙ্খল অবস্থায়। জল নিকাশি ব্যবস্থা খুবই নিম্নমানের ছিল। নদীর জল বাড়লে বা অধিক বৃষ্টি হলে শহর জলমগ্ন হয়ে যেত। লর্ড কর্নওয়ালিস(১৭৮৬-৯৩)এর সময় থেকে শহরে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বড় ধরণের পরিবর্তন এসেছিল। স্থানীয় ব্যবসায়িদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। ১৭৯৭ থেকে ১৮০১ সালের মধ্যে স্থানীয়দের সার্কুলেটিং ক্যাপিটাল ১৬ কোটি স্পর্শ করে। স্থানীয় ব্যাঙ্কার, ব্যবসায়ী, দালাল ইত্যাদির ধন সম্পদ ক্রমশ বাড়তে থাকে, সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে সুস্থ, সুন্দর পরিবেশে পাকা বাড়ির চাহিদা। এ ছাড়া শহরের লোকসংখ্যাও বাড়তে শুরু করেছে, রুজি রুটির সন্ধানে বহু মানুষ তখন কোলকাতার দিকে পা বাড়াচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল শহরের পুরো পরিকাঠামো ঢেলে সাজানোর। কোলকাতা শহরের সামগ্রিক উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে বিখ্যাত হয়ে আছে ১৮০৩ সালে ওয়েলেসলির মিনিটস--
'The Increasing extent and population of Calcutta, the capital of the British empire in India, and the Seat of Supreme authority, require the serious attention of Government. It is now become absolutely necessary to provide permanent means of promoting the health, the comfort, and the convenience of the numerous Inhabitants of this great town'.
'The defects of the climate of Calcutta, during the latter part of the rainy season, may indeed be ascribed in a great measure to the state of the drains and water-courses, and to the stagnant water remaining In the town and its vicinity'.
'The health of the town would certainly be considerably improved by an Improvement of the mode of draining and cleansing the streets, roads, and esplanade. An opinion is generally entertained, that an original error has been committed in draining the town towards the river Hooghly: It IS believed that the level of the country inclines towards the salt-water lake ' 'Other points connected with the preservation of the health of the lnhabltants of this capital appear also to require immediate notice No general regulations at present exist with respect to the situation of the public markets, or of the places appropriated to the slaughter of cattle, the- exposure of meat or the burlal of the dead; places destined to these purposes must necessarily Increase in number with the increasing population of Calcutta. They must be nuisances wherever they may be situated, and it becomes an important branch of the polim to confine all such nuisances to the situations wherein they may prove least injurious, and least offensive'
'In those quarters of the town occupied principally by the native inhabitants, the houses have been built without order or regularity, and the streets and lanes have been formed without attention to the health, convenience, or safety of the inhabitants. The frequency of fires [by which many valuable lives have been annually lost, and property to a great extent destroyed] must be chiefly ascribed to this cause'
'It is a primary duty of Government to provide for the health, safety and convenience of the inhabitants of this great town, by establishing a comprehensive system for the improvement of the roads, streets, public drains, and water courses, and by flxing permanent rules for the construction and distribution of the houses and publlc edifices, and for the regulation of nuisances of every descrlptlon'
'The appearance and beauty of the town are inseparably connected with the health, safety and convenience of lhe lnhabitants, and every Improvement whlch shall Introduce a great degree of order, symmetry, and magnlflcence In the streets roads, ghauts and wharfs, public ediflces and prlvate inhabltations will tend to meliorate the cllmate and to secure and promote every object of a just and salutary system of police'
ওয়েলেসলি দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে শহরের রাস্তাঘাট, যানবাহন, জনস্বাস্থ্য, আইন শৃঙ্খলা, ইত্যাদির পরিবর্ধন এবং পরিমার্জন বিনা সুচারু রূপে রাজ্যপাট সামলান সম্ভব নয়।
স্টেন নেলসন লিখেছেন—
‘like everything else in Wellesly’s policy, would seem to have been drawn up to strengthen the position of Calcutta. The improvements were intended to help make Calcutta a more worthy centre for the future of empire.’
মিনিটস মোতাবেক ওয়েলেসলি শহর উন্নয়ন কমিটি গঠন করেন। উন্নয়ন কমিটি শহরের সমস্যাগুলি চিহ্নিত করে তা নিরসনে সচেষ্ট হয়। শহরকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খলরূপে গড়ে তোলার অভিপ্রায়ে নানান পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য বিশাল অর্থের প্রয়োজন ছিল। সরকারী তহবিল থেকে বরাদ্দ অর্থ এর জন্য যথেষ্ট ছিল না। ইংল্যান্ডে অনেকদিন থেকেই লটারি খুব জনপ্রিয়। সেখানে ১১ই জানুয়ারি, ১৫৬৭ সালে রানী প্রথম এলিজাবেথ এর সময় প্রথম লটারি হয় জাহাজ ও বন্দর নির্মাণের জন্য অর্থের প্রয়োজনে। এরপর সেখানে সরকারী, বেসরকারি, নানা স্তরে, নানা কারণে, লটারি হতে থাকে। এখানকার কর্তাব্যক্তিরাও বড় প্রকল্প রুপায়নের জন্য অর্থ জোগাড় করতে নিজেদের দেশের পরিচিত পথটাই বেছে নিয়েছিলেন। প্রথম দিকে বিভিন্ন লটারি কমিশনার লটারিগুলোর দেখভাল করত। ১৮০৯ থকে ১৮১৭ সালের মধ্যে ১৭টি লটারিতে আনুমানিক বার লাখ টাকা আয় হয় যার ১১.৫১ লাখ টাকা শহর উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। কিছু সময় পরে ফ্রান্সিস হেস্টিংসের আমলে ১৮১৭ সালের ২১ অক্টোবর তৈরি হল লটারি কমিটি আর উন্নয়ন কমিটি তাতে লীন হয়ে গেল। আগের কমিটির সমস্ত টাকা নতুন কমিটির খাতায় জমা করে দেওয়া হয়। লটারির সাথে কোলকাতার মানুষের পরিচয় কয়েক যুগ আগেই হয়ে গেছে। হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের ‘কলকাতা সেকালের ও একালের’ বইয়ে দেখতে পাই যে ১৭৮৪ সাল থেকে কলকাতায় লটারির প্রচলন হয়। ১৭৮৯ সালে ‘এক্সচেঞ্জ’ গৃহটি তৈরি করার সমস্ত খরচ লটারির মাধ্যমে তোলা হয়। ১৭৯২ সালে কোলকাতায় একটি সাধারণ সমিতি গৃহ নির্মাণের জন্য লটারি করা হয়। কোলকাতার প্রথম উল্লেখযোগ্য লটারি হয় ১৭৮৮ সালে। এই লটারিতে টেরিটি বাজারকে একটা প্রাইজ হিসেবে ধরা হয়। বাজারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ভিনিশের এডওয়ার্ড টিরেটো। ১৭৮৮ সালের ১১ই ডিসেম্বর ক্যালকাটা গেজেটে এর বিজ্ঞাপন ছাপা হয়।
Thursday, December 11th, 1788
Lottery
Plan of a Lottery submitted to the Public, consisting of six valuable Prizes. Tickets will be issued, entitled ‘Tiretta’s Lottery’, each signed by Mr. Tiretta, and countersigned by the Bengal Bank, where they are now ready to be delivered.
1st Prize: The large and spacious Pucka Bazar or market belonging to Mr. Tiretta, situated in the most central part of the town of Calcutta, which occupies a space of nine biggahs and eight cottahs of ground formed in two squares, with convenient shops, surrounded with a colonnade veranda, and the whole area of the square is divided into commodious streets with pucka stalls valued at Sicca Rupees ---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------196000
2nd Prize: A Piece of ground known by the name of Hurring Berry, immediately adjoining the north of the Bazar in front of the Public Road leading to Chitpoor, comprehending four biggahs and thirteen cottahs fo ground, on which there are thirty pucka Godowns erected on the east side for a General Grain Market valued at-------------------------------39000
3rd Prize: That convenient Upper-roomed House, situated to the south of the Bazar, and directly opposite to the house formerly inhabited by Mr. Le’Blanc, standing upon one biggah of ground, together with the adjoining piece of ground to the east, consisting of four biggahs and six cottahs, bounded to the north by the pucka wall of the Bazar, on which there are pucka sheds 200 feet long and 32 feet broad, valued at-------------------------------------------------------------------------------------------------------36000
4th Prize: That large house formerly inhabited by Le’Blanc, standing upon one biggah of ground, consisting on the ground floor of six rooms, four closets, one hall, one large veranda in columns, and one back veranda in arches, and on the upper story, of two rooms, and a veranda with a circular stair case, with convenient offices, valued at-------------------------------------------------------------------------------------------------------------25000
5th Prize: A piece of Ground of four biggahs to the south of the Meat Bazars, and close to the range of packa sheds mentioned in the Third Prize, valued at---------------------------------------------------------------------------------16000
6th Prize: A Lower-roomed House, consisting of four rooms, one hall, and one closed veranda, with convenient offices, standing upon ten cottahs of ground, situated to the south of the Upper-roomed House mentioned in the Third Prize, valued at--------------------------------------------8000
…………….
Sicca Rupees 320000
……………
By the present low term of rent at which Mt. Tiretta lets the Bazar shops and Stalls now occupied, the property allotted for the First Prize will produce a regular Monthly Revenue of Sicca Rupees 3500, and with proper attention and management, is capable of yielding a much larger monthly income.
The Lottery to consist of 3200 Tickets, at one Hundred Sicca Rupees each Ticket, amounting to Sicca Rupees 320000.
The money to be paid into the Bengal Bank, and when the Subscription shall be closed, a General Meeting of the Subscribers resident in Calcutta will be convened, who shall appoint a Committee to direct and superintend the drawing of this Lottery.
The Bank to be answerable for the amount paid in, should any accident prevent the Lottery from being drawn.
Vide Setonker’s Selections from Calcutta Gazettee pp 191-93
সেই সময় বাজারের আয় ছিল মাসে ৩৫০০ টাকা। ৯ বিঘা ৮ কাঠা জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই বাজার। এর দাম ধার্য করা হয়েছিল ১ লক্ষ ৯৬ হাজার টাকা। লটারিতে চার্লস ওয়েস্টন নামে এক ফিরিঙ্গী এই বাজারের মালিক হন। ওয়েস্টন মানুষটি ভাল ছিলেন, বাজারের আয়ের অর্ধেকটাই গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। বৌবাজারে তাঁর নামে ওয়েস্টন লেন রয়েছে।
ওই সময় ইংল্যান্ডের মত কোলকাতাতেও যে কোন উপলক্ষেই লটারির চল শুরু হল। দাতব্য, বিজ্ঞান, শিক্ষা, শহর সংস্কার, যে কোন প্রকল্পেই লটারি sine qua non হয়ে উঠল। চারিদিকে তখন লটারির ছড়াছড়ি আর তাতে সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষের হুড়োহুড়ি। সমকালীন যাজকদের চোখেও এই ফাটকা খেলা নিন্দনীয় ছিল না।
কোলকাতায় গুছিয়ে বসার পর সাহেবরা একটা জিনিসের খুব অভাব বোধ করতে লাগল, তা হল একটা পাবলিক হল। তখন হোয়াইট টাউনে রাইট’স নিউ ট্যাভার্ন, মুর’স অ্যাসেম্বলি রুমস, হারমোনিক ট্যাভার্ন এর মত কিছু বিনোদন গৃহ ছিল তবে তা নেহাৎই ছোট। বড় ধরণের কোন সভা বা বিনোদনের জন্য তা যথেষ্ট নয়। ওল্ড কোর্ট হাউসকে এই কাজে ব্যবহার করা হত কিন্তু পুরনো দুর্বল বাড়ি হওয়ার কারণে সরকারি আদেশে ১৭৯২ সালে সেটি ভেঙে ফেলা হয়। একটা হল যে না হলেই নয়। ১৭৯২ সালের ৩১ ডিসেম্বর, লা গ্যালাইজ ট্যাভার্নে শহরের মাতব্বরেরা মিলিত হয়ে একটি পাবলিক হল নির্মাণের জন্য অর্থ সংগ্রহের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। এর মাঝে কর্নওয়ালিস এবং ওয়েলেসলির মার্বেল স্ট্যাচু কোলকাতায় এসে পৌঁছোয়। স্ট্যাচু দুটি স্থাপিত না করে বেশিদিন ফেলে রেখে দেওয়াটা কাম্য নয়। আর স্থাপিত করার পর অনুষ্ঠান করে উদ্বোধন করতে হবে। যে সে অনুষ্ঠান হলে চলবে না, ওজনদার লোক, অনুষ্ঠানও ওজনদার হতে হবে। হল গড়ার পরিকল্পনা ত্বরান্বিত হল। ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৮০৪এ একটি পাবলিক মিটিং এ টাউন হল গড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল। হল তো হবে কিন্তু এত টাকা আসবে কোথা থেকে? ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই খাতে কোন অর্থ দেবে না। ব্যক্তিগত অনুদানে এত বড় প্রকল্প সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয়। অগত্যা সেই লটারি।
টাউন হল নির্মাণের জন্য চারবার লটারি করা হয়। প্রথমবার ৫০০০ টিকিট ছাপা হয়। টিকিটের মূল্য ছিল ৬০ সিক্কা টাকা। ৫০০০ টিকিটে ১৩৩১টি প্রাইজ ছিল আর বাকি ৩৬৯৯ টিকিটে কোন প্রাইজ ছিল না। দ্বিতীয় লটারি হয় ১৮০৫ সালে। লটারি হয়েছিল পাঁচ লাখ সিক্কা টাকার। ১০০০ প্রাইজ ছিল আর বাকি চার হাজার টিকিটে কোন প্রাইজ ছিল না। যেহেতু যা লাভ হয়েছিল তা প্রস্তাবিত গৃহ নির্মাণের জন্য যথেষ্ট ছিল না তাই ঠিক হয় যে যতদিন না প্রয়োজনীয় অর্থের জোগাড় হবে ততদিন এই একই অনুমোদন এবং তত্ত্বাবধানে প্রতি বছর একবার করে লটারি হবে। তৃতীয় লটারি হয় ১৮০৭ সালের ২৬ জানুয়ারি। কমিশনার ছিলেন জর্জ ডাউডসওয়েল।
চতুর্থ লটারির বিজ্ঞপ্তিও ১৮০৭ সালে দেওয়া হয়। লটারি হয় ৭৫০০০০.০০ সিক্কা টাকার যার মধ্যে ৬৬০০০০.০০ টাকার প্রাইজ দেওয়া হয়। খরচা বাবদ ১৫০০০.০০ বাদ দিয়ে ৭৫০০০.০০ টাউন হল নির্মাণের জন্য দেওয়া হয়।
টাউন হল লটারির ব্যাঙ্কার ছিল ‘ব্যাঙ্ক অফ ক্যালকাটা’। টাউন হলের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন লর্ড মিন্টো। হলের কাজ শেষ হয় ১৮১৩ সালে আর উদ্বোধন হয় ২২শে মার্চ, ১৮১৬। হল তৈরি হতে খরচ হল সাত লাখ, প্রায় তাজমহলের মত।
শহরের পরিসেবার উন্নতিকল্পে ২রা ফেব্রুয়ারি, ১৮০৯ সালে ক্যালকাটা গেজেটে একটি লটারির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। পুরষ্কারের অঙ্কও বেশ ভারী ছিল। প্রথম পুরস্কার এক লাখ, দ্বিতীয় পুরস্কার পঞ্চাশ হাজার, এইভাবে মোট তিন লাখ টাকার পুরস্কার ছিল। ২৩২৮০০ টিকিটে কোন পুরস্কার ছিল না। লটারির উদ্বৃত্ত রাস্তা মেরামত, শহর সংরক্ষণ, পার্ক (স্কয়ার) নির্মাণ, সরকারী গৃহ নির্মাণ ইত্যাদিতে ব্যয় করা হয়।
এই প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবে মনে উঁকি দিতে পারে। পর পর যে এত লটারির হত তার টিকিট কারা কিনত? সময়ের হিসেবে টিকিটের দাম তো নেহাত কম ছিল না। স্থানীয় বাসিন্দাদের অধিকাংশই খেটে খাওয়া গরিব মানুষ। ভাবছেন, শুধু কি সাহেবরাই এত লটারির টিকিট কিনত! না স্যার, অনুমান ঠিক নয়। এটা ঠিক যে সাহেবরা অনেক টিকিট কিনত, কিন্তু শুধুমাত্র তাদের ভরসাতেই এতগুলো লটারি উৎরে যায়নি। স্থানীয় মানুষদেরও এই কর্মকাণ্ডে অনেক অবদান আছে। বিত্তবান বাবুরা মর্যাদা প্রতিপত্তি প্রদর্শন করতে বা শখ পূরণ যে করতে লক্ষ লক্ষ টাকা ওড়াত তার নজির হুদো হুদো পাওয়া যাবে। বাবুদের বাবু অর্থাৎ সাহেবদের লটারিকেও নিজ স্বার্থের কারণে আমাদের বাবুরা বিমুখ করেনি। শুধু তাই নয়, অসংখ্য দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ লোভে পড়ে ভাগ্য ফেরাবার বাসনায় লটারিতে গুঁজে দিয়েছে তার আয়ের সিংহভাগ টাকা।
লটারি কমিটি কোলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণে তৈরি করে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট, ওয়েলিংটন স্ট্রিট, উড স্ট্রিট। গঙ্গার গা ঘেঁসে তৈরি হয় স্ট্র্যান্ড ব্যাঙ্ক রোড। ধীরে ধীরে তৈরি হয় কর্নওয়ালিস স্কয়ার, কলেজ স্কয়ার, ওয়েলিংটন স্কয়ার, ওয়েলেসলি স্কয়ার।
১৮১৭ থেকে ১৮৩৬ এর মধ্যে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, কিড স্ট্রিট, কলুটোলা স্ট্রিট, আমহারস্ট স্ট্রিট, মির্জাপুর স্ট্রিট, ক্যানাল স্ট্রিট, ময়রা স্ট্রিট, হ্যাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিট, লাউডন স্ট্রিট, রডন স্ট্রিট, হেস্টিন্স স্ট্রিট, হেয়ার স্ট্রিট, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট(কসাই টোলা), ম্যাঙ্গো লেনের এর মত বহু রাস্তা তৈরি হয়েছে, চওড়া হয়েছে বা মসৃণ হয়েছে।
১৮৩৬ সাল পর্যন্ত লটারি কমিটি চালু থাকে। ১৮২৫ থেকে ১৮৩৬ সালের মধ্যে লটারি কমিটি ১০ লাখের কিছু অধিক আয় করে, যার দুই তৃতীয়াংশ শহরের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। W Goode এর লেখায় জানা যায় যে ১৮০৫ থেকে ১৮৩৬ সালের মধ্যে লটারি থেকে অর্জিত প্রায় ২৫ লাখ টাকা পৌর উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়।
লটারি একটা সময় লাগাম ছাড়া অবস্থায় চলে গিয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে বহু বিত্তবান মানুষ নিজের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রির উদ্দেশ্যে স্ব উদ্যোগে লটারির আয়োজন করতে শুরু করে। ব্যাপারটায় রাশ ধরার জন্য তদানীন্তন ভারত সরকারের পাবলিক ডিপার্টমেন্ট থেকে ২০ মে, ১৮০০ সালে এই নির্দেশটি দেওয়া হয়—
“Notice is hereby given that the Right Honourable the Governer-General in Council has been pleased to prohibit the establishment of any lotteries, the prizes in which are to be made payable in money, without the express permission of His Lordship in Council.”
১৮৩৬ সালে সরকারি নির্দেশে বন্ধ হয়ে যায় লটারি কমিটি। কেন বন্ধ হল তা নিয়ে নানা জনের নানা অভিমত আছে। কারো মতে নৈতিকতার কারণে এটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। । ইংল্যান্ডে যে সময় লটারি অত্যন্ত জনপ্রিয় তখন সেই দেশের শাসকরাই এদেশের নেটিভদের নৈতিকতা নিয়ে চিন্তিত বা বিচলিত হবে এই মতটা তেমন একটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। কেউ বলেন শেষের দিকে লটারিতে লোকসান হচ্ছিল তাই আর চালান সম্ভব হয়নি। তথ্য এই যুক্তিকে সমর্থন করে না। আর একটি মত হল এই সময় লটারির ব্যবস্থাপকদের কিছু দুর্নীতি স্বদেশের বড় কর্তাদের কানে যাওয়াতেই এর ঝাঁপ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কারণ যাই হোক না কেন লটারি কমিটি বন্ধ হওয়ার পর শহরের উন্নয়ন বেশ কিছুটা সময়ের জন্য থমকে গিয়েছিল। ১৮৭৬ সালে কোলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশন স্থাপিত হওয়ার পর শহর নিয়ে আবার ভাবনা চিন্তা শুরু হয়।
শুরুর কথার পুনরাবৃত্তি করে বলি, লটারির কল্যাণে পাল্টে গিয়েছিল একটা গোটা শহরের চেহারা। আমাদের প্রাণের শহর কোলকাতার অনেকটাই গড়ে উঠেছে, পুষ্ট হয়েছে বা মসৃণ হয়েছে লটারির হাত ধরে। ইতিহাস তাই বলে।ঔপনিবেশিক স্বার্থ অবশ্যই ছিল, তবু উপজাত হিসেবে শহর পেয়েছিল ভবিষ্যতের মহানগরের বুনিয়াদ।
(তথ্যসূত্র :
The Town Hall of Calcutta—Basudeb Chattopadhyay, Birth of colonial city--Ranjit Sen, Awakening--Subrata Das Gupta, Glimpses on the history of Calcutta, 1600-1800—Rama Deb Roy, কলকাতা—শ্রী পান্থ
সচিত্র কলিকাতার কথা—রায় বাহাদুর শ্রী প্রমথনাথ মল্লিক ও শ্রী প্রবোধ কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
কালে কালে কলকাতা—কাজল মিত্র
অন্য কলকাতা—বিশ্বনাথ জোয়ারদার।
কলিকাতা কল্পলতা—রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
কলিকাতা সেকালের ও একালের—হরিসাধন মুখোপাধ্যায়।)