সঙ্গী
সঙ্গী
সঙ্গী
শুকদেব চট্টোপাধ্যায়
পোস্ট অফিসে টাকাটা তুলতে একটু দেরী হয়ে গেল। কয়েক মাস হল অনুপ রিটায়ার করেছে। অফিস থেকে পাওয়া টাকার একটা বড় অংশ পোস্ট অফিসে এম আই এস এ রেখেছে। ওখানে ট্যাক্সের ঝামেলা একটু কম। মাসকাবারি সুদের টাকাটা তুলতে গিয়েছিল। ফেরার পথে অবনিবাবুর সাথে দেখা। আড্ডাবাজ লোক। দেখা হলে কথার শেষ নেই। দু এক কথায় সেরে অনুপ বাড়ির পথ ধরতেই অবনিবাবু থামালেন—এত তাড়া কিসের মশাই ?
অনুপ আমতা আমতা করে বলল—না আসলে বেলা হয়ে গেছে তো।
--দেখালেন বটে। অফিস থাকলে তবু একটা কথা ছিল। রিটায়ার করেছেন, ঝাড়া হাত পা। এখনও এত সময় ধরে চলেন! বুঝেছি, বাড়িতে অনুশাসনটা বেশ কড়া।
কি আর বলবে। সে না যাওয়া পর্যন্ত যে আর একজনের খাওয়া হবে না। অনুপ কথা বাড়াল না।
বাড়িতে ঢুকতেই রমলার মৃদু ধমক খেতে হল।
--দাদাবাবু, বড্ড দেরী করলে। বৌদির খেতে কত বেলা হয়ে গেল বল তো!
রমলা নিঃসন্তান বিধবা। বহুদিন হল এবাড়িতে কাজ করছে। বাড়ির লোকের মতই হয়ে গেছে। এখানেই থাকে, এটাই ওর ঘরবাড়ি। সেই জোরেই অনুপকে মাঝে সাঝে একটু বকাঝকা করে। অনুপও তাতে কিছু মনে করে না, বরং কিছুটা উপভোগই করে।
--পোস্ট অফিসে টাকাটা দিতে অনেক দেরী করল যে।
--তাড়াতাড়ি চান করে এসে খেয়ে নাও। আজকে তো আবার দিদির বাড়ী যেতে হবে।
অনুপ তখন কলেজের থার্ড ইয়ারে পড়ে। সামনের বাড়ির গৌতমদার বিয়েতে সেবার খুব মজা হয়েছিল। দুই বাড়ির সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ বলে কেনাকাটা থেকে আরম্ভ করে বিয়ের সমস্ত কাজে অনুপদের থাকতে হয়েছিল। ওর ছোটবোন রিনাতো দিন পনের ও বাড়িতেই কাটিয়েছে। বিয়েতে অনুপরা সকলেই গিয়েছিল। বরযাত্রীদের প্রথমে অভ্যর্থনা জানাল গোলাপের থালা হাতে কয়েকটি মেয়ে। সবকটিই সুশ্রী, তবু তার মধ্যে নীল শাড়ী পরা মেয়েটার একটা আলাদা চটক আছে। অনুপ মেয়েদের ব্যাপারে একটু নার্ভাস প্রকৃতির হলেও গোলাপ ফুলটা নীল শাড়ির কাছ থেকেই নিল। মেয়ে দেখলে হ্যাংলামো করাটা অনুপের কোনোদিনই আসে না। বন্ধু বান্ধবদের বরং এর জন্য সে অনেক সময় ধমক দিয়েছে। কিন্তু স্বপ্নাকে দেখা অবধি মনটা কিরকম যেন অস্থির হয়ে উঠেছে। নামটা রিনার কাছেই জেনেছে। থাকতে না পেরে লজ্জার মাথা খেয়ে রিনাকে মেয়েটির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিল। বয়স কম হলে কি হবে, রিনার স্বভাবটা একটু গিন্নি ধরনের।
চোখ পাকিয়ে দাদাকে বলেছিল—বাবাকে বলব ?
পরে অবশ্য মেয়েটির সব তথ্য যোগাড় তো করে দিয়েছিলই এমনকি দাদার হয়ে স্বপ্নার কাছে ওকালতিও করেছিল। স্বপ্না গৌতমের স্ত্রী মিলির মামাতো বোন। আসানসোলে থাকে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে সবে কলেজে ঢুকেছে।
বৌভাতের দিন নানান কাজের মাঝেও অনুপ অধীর আগ্রহে কন্যাযাত্রীদের আসার অপেক্ষায় ছিল। বাস আসতে একরকম প্রায় দৌড়েই সেখানে গিয়েছিল। তত্ত্বর থালা হাতে এক এক করে সবাই নামছে। আজ হয়ত গোলাপি শাড়ী পরবে। ফর্সা রং, বেশ লাগবে। ভাবনার মধ্যেই একজন গোলাপি শাড়ী নামল। কিন্তু না, সব আশায় জল ঢেলে নামল ও বাড়িরকাজের মাসি। সকলের নামা শেষ হলে খালাসী বাসের দরজা বন্ধ করে দিল।
রিনাই খবরটা দিয়ে গেল।
--জ্বর হয়েছে তাই আসতে পারেনি। কি আর করবি দাদা, একটু মানিয়ে নে। আহা রে বেচারা।
বলেই মুখে চুক চুক করতে করতে অতিথিদের মাঝে হারিয়ে গেল। অচেনা, অজানা, হঠাৎ দেখা একটা মেয়ের অনুপস্থিতি, অনুপের বিয়েবাড়ির আনন্দটাই মাটি করে দিল।
বি.এ. পাশ করার কিছুদিনের মধ্যেই অনুপ রেলে চাকরি পেয়ে গেল। অ্যাকাউন্টস ক্লার্ক, হেড অফিসে পোস্টিং। মাইনে বিরাট কিছু না হলেও পাশ, পিটিও আছে, প্রোমোশনের সুযোগ আছে আর সর্বোপরি চট করে বাইরে কোথাও বদলি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। মধ্যবিত্ত মেধা ও মানসিকতার বাঙালি ছেলের এর বেশি আর কি চাই ?
সোদপুরে অনুপের বাবা দু কাঠার মত জমি কিনে রেখেছিলেন। বাপ ব্যাটায় মিলে সেখানে মাথা গোঁজার মত একটা ব্যবস্থা করে শ্যামনগরের ভাড়া বাড়ী ছেড়ে চলে এল। ভাড়াটে হলেও ওখানে ওরা বহুদিন ছিল। ফলে জায়গাটার এবং ওখানকার পরিচিত জনের মায়া কাটিয়ে আসতে বেশ কষ্ট হয়েছিল। প্রথম প্রথম ছুটিছাটা হলেই অনুপ শ্যামনগরে ছুটে যেত অথবা গৌতমদের মত কাছের লোকেরা চলে আসত। সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে যাতায়াতটা অনেক কমে আসে। এর মাঝে রিনার বিয়ে হয়েছে। স্বনির্বাচন। ছেলেটি ভাল। সরকারি চাকুরে। সোদপুরেই থাকে। বিয়ের আগেই শাশুড়ি গত হয়েছেন। ফলে স্বভাবে গিন্নি রিনা বিয়ের পর থেকে বাস্তবেও গিন্নির দায়িত্ব পালন করছে।
এক রবিবার সকালে হঠাত সস্ত্রীক গৌতম হাজির। এ বাড়ির সকলেই গৌতমদেরভালবাসে। বৌটিও খুব হাসিখুশি।
--আরে গৌতম দা এস এস। বৌদি এস। কতদিন বাদে এলে বল তো!
--তুইও যেন কত যাস।
গলাটা চেনা চেনা ঠেকায় রান্নাঘর থেকে সরলা শুধালো—কে এল রে খোকা ?
--এসেই দেখে যাও না মা।
--ওমা তোমরা, থাক থাক, বস বাবা। তা আমার নাতিটিকে কেন আনলে না বৌমা?
--স্কুলের ছুটি পড়ে গেছে তো, তাই কদিন আগে ও মামার বাড়ী গেছে কাকিমা।
--শোন বাবা, দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে একেবারে সন্ধ্যের পর যাবে কিন্তু।
সে কাকিমা আপনি না বললেও আমরা না খেয়ে যাচ্ছি না।--গৌতম হেসে বলল।
--তোমরা বসে গল্প কর, আমি সরবত করে নিয়ে আসি।
--কাকুকে দেখছি না। কাকু কোথায় রে অনুপ ?
গৌতমের প্রশ্নের উত্তর অনুপকে দিতে হল না।
দু ব্যাগ বাজার নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে অমরেশ রসিকতা করে জিজ্ঞেস করল—এরা কারা ? এদের তো ঠিক চিনতে পারছি না।
নিজের রসিকতায় অমরেশ নিজেই হো হো করে হেসে উঠল।--কেমন আছ সব ? এদিকে আসা একেবারে বন্ধ করে দিলে বাবা।
মিলি কোনরকম ভনিতা না করেই বলল—আসবার কথা মাঝে মাঝেই ভাবি। কিন্তু আসলে কাকু ছুটির দিনে কোথাও বেরোতে ইচ্ছে করে না।
গৌতমের স্ত্রী মিলি স্থানীয় একটা প্রাইমারী স্কুলে পড়ায়।
সরলা সরবতের গ্লাসগুলো এগিয়ে দিয়ে বললেন—তোমরা আজকে এসেছ খুব ভাল হয়েছে। একটু বাদে রিনারাও আসবে।
তাহলে তো আড্ডা জোর জমবে—বলেই গৌতম অনুপের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল—আচ্ছা, রিনার বর কি এখনওআগের মতই শান্ত চুপচাপ?
--রিনার পাল্লায় পড়লে কেউ কি আর চুপচাপ থাকতে পারে ?
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। আধ ঘণ্টার মধ্যেই রাস্তা থেকে রিনার গলা পাওয়া গেল। ছেলেকে বকতে বকতে ঘরে ঢুকল।
--এত চ্যাঁচাচ্ছিস কেন রে ?
দাদার প্রশ্নের উত্তরে ছেলেকে দেখিয়ে বলল—হুনুমানটার চালচলন দেখতে পাচ্ছিস না!
--ছেলে মায়ের স্বভাবের কিছুটা তো পাবেই রে।
--দাদা ভাল হবে না বলছি......আরে ব্বাস বৌদি, গৌতম দা.....কতদিন বাদে তোমাদের সাথে দেখা হল..... তোমাদের দেখে যে কি আনন্দ হচ্ছে না.... কেমন আছ?.....শোন এখুনি যেন উঠি উঠি কোর না, সারাদিন জমিয়ে আড্ডা হবে....সন্ধ্যে বেলা আমি ফিরে যাওয়ার আগে তোমাদের যাওয়া হচ্ছে না... মা এক গ্লাস জল দাও।
অনেকগুলো কথা একসাথে বলে মায়ের এগিয়ে দেওয়া সরবতে চুমুক দিতে দিতে ধপাস করে সোফায় বসে পড়ল।
--এবার একটু রেস্ট নে। তুই সেই আগের মতই আছিস, একটুও পাল্টাসনি। তা তোর বর এল না ?
--ওর কথা বাদ দাও তো গৌতম দা। রাম কুঁড়ে, ছুটির দিনে কোথাও বেরতে চায় না।
দুপুরবেলা চুটিয়ে আড্ডার মাঝে মিলিই কথাটা পাড়ল।
--কাকিমা, অনুপের জন্য একটা সম্বন্ধ এনেছি। মেয়েটি দেখতে শুনতে ও স্বভাব চরিত্রে ভাল। একবার দেখতে পারেন।
--তুমি যখন বলছ তখন সে মেয়ে ভালই হবে। তা মেয়েটি কে ? থাকে কোথায় ?
--মেয়ে আমার মামাতো বোন স্বপ্না। মামা চাকরিসূত্রে আসানসোলে থাকেন। আমাদের বিয়েতে এসেছিল, জানি না খেয়াল করেছিলেন কিনা।
সরলাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রিনাই কেসটা নিয়ে নিল।
--খুব মনে আছে। বিয়ের দিন নীল রঙের শাড়ী পরেছিল। খুব সুন্দর লাগছিল। জ্বর হওয়ার জন্য বৌভাতের দিন আসতে পারেনি।
মুচকি হেসে অনুপকে জিজ্ঞেস করল—দাদা তোর কিছু মনে পড়ছে ?
অনুপ কাজের ছুতোয় ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
--তোমাদের যখন এতই পছন্দ তখন তো একবার দেখতে যেতেই হবে। তোমাদের কাকিমার আবার কবে সময় হয় দেখি।
--এই ঠেস দিয়ে কথা বলাটা তোমার খুব বাজে অভ্যাস। আমার জন্য এ বাড়ির কোন কাজটা কবে আটকেছে শুনি!
--আহা চটছ কেন ? বৌ এর সাথে একটু ঠাট্টা করতে পারব না।
মাসখানেকের মধ্যেই মেয়ে দেখতে যাওয়ার দিন ঠিক হল।
স্বপ্না। অনুপের জীবনে প্রথম হঠাত দেখে ভাল লাগা একটা মেয়ে। গৌতমের বৌভাতের দিন ও এলে হয়ত ভাল লাগাটা ভালবাসায় দানা বাঁধতে পারত। ভাল লাগার রেশটা বেশ কিছুদিন ছিল। মিলি বৌদিকে স্বপ্না কেমন আছে একথা দু একবার জিজ্ঞেস করেছিল বটে কিন্তু মনে ইচ্ছে থাকলেও এর বেশি আর কিছু জিজ্ঞেস করে উঠতে পারেনি। রিনার কাছে শুনেছিল যে দু একদিন বাদে ওরা আসানসোলে ফিরে গেছে। ফলে মনের মধুর ভাবনাগুলোর আর জায়গামত নিঃসরণ হল না। তারপর ধীরে ধীরে ব্যাপারটা সময়ের আস্তরণে চাপা পড়ে যায়। সেই স্বপ্নাকে মা-বাবা পুত্রবধূ করার জন্য দেখতে যাচ্ছেন। এখন তো সে পূর্ণ যুবতী। নিশ্চয় আরো আকর্ষণীয় হয়েছে তার চেহারা। মধুর ভাবনাগুলোয় মনটা পুলকিত হয়ে উঠল।
আসানসোল যেতে হয়নি। গৌতমদের বাড়িতেই মেয়ে দেখার ব্যবস্থা হয়েছিল। মেয়েকে সকলেরই খুব পছন্দ। অমরেশ ঐখানেই পাকা কথা দিয়ে দিল। মিলির মামার রিটায়ার করতে বেশি দেরী নেই। তাঁর ইচ্ছে চাকরি থাকতে থাকতেই একমাত্র মেয়ের বিয়েটা দিয়ে দেন। যোগাড় যন্তর, কেনা কাটা ইত্যাদির জন্য কয়েক মাস হাতে রেখে ডিসেম্বারের মাঝামাঝি বিয়ের দিন ঠিক হল। বাস না ট্রেন, বরযাত্রী কিসে যাবে এ নিয়ে একটু দ্বিমত ছিল। বাবা-মার ট্রেনে যাওয়ার প্রস্তাব একদম উড়িয়ে দিয়ে রিনা বলল—বাসে সকলে একসাথে নিজেদের মত করে নাচ গান হৈ হট্টগোল করতে করতে যাব। এ মজা ট্রেনে হবে ! ট্রেনে ও সব করলে ঘাড় ধরে নামিয়ে দেবে।
রিনার ওপর কারো কথা খাটল না।
স্বপ্নার বাবা অনুরোধ করেছিলেন—আপনারা বিয়ের দিন না এসে একদিন আগে আসুন। এতটা পথ এসে ক্লান্ত হয়ে পড়বেন, একটু বিশ্রামের দরকার।
বেরোতে বেরোতে প্রায় বেলা দশটা হয়ে গেল। সেদিনের আনন্দ কখনো ভোলা যাবে না। হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে দিয়ে অতটা পথ কিভাবে যে কেটে গেল তা বোঝাও গেল না। রিনার বর বাদল, যে দিনে কটা কথা বলে তা হাতে গোনা যায়, সেও রঙ্গ রসিকতায় সকলকে মাতিয়ে রাখল।
থাকতে না পেরে রিনা জিজ্ঞেস করে ফেলল—হ্যাঁগো, তোমার হলটা কি ? এতদিন ঘর করছি তোমার এই রূপ তো কখনো দেখিনি।
বাদল বেশ রসের সুরেই বলল—সুযোগটা আর দিলে কোথায়। বিয়ের পর থেকে তো শুধু শুনেই গেলাম, বলবটা কখন!
‘তবে রে’ বলে রিনা বরের পিঠে একটা কিল মারল।
আসানসোল পৌঁছোতে প্রায় পাঁচটা বেজে গেল। আর একটু আগে পৌছান যেত কিন্তু পথে দুপুরবেলার খাওয়া দাওয়ার জন্য অনেকটা সময় লেগেছে। স্বপ্নার বাবা বরযাত্রীদের আপ্যায়নে কোন ত্রুটি রাখেননি। থাকা, খাওয়া, বিয়ের অনুষ্ঠান, সব কিছুই মনে রাখার মত।
অনুপদের বাড়ির আয়োজনও বেশ ভালই হয়েছিল। নিমন্ত্রিত প্রায় চারশ জন মত ছিল। বাইরের দু চারজন ছাড়া প্রায় সকলেই এসেছিল। রান্না বান্না ভাল হওয়ায় অনেকেই বেশ গুছিয়ে টেনেছে। শেষ ব্যাচ উঠতে উঠতে প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেল। কনের প্রশংসায় সকলেই পঞ্চমুখ। যে মোহিত রায় নিন্দে ছাড়া সচরাচর ভাল বলে না সেও যাওয়ার সময় বলে গেল—বৌমাটি বেশ হয়েছে অমরেশ। তা তুমি আনলে না নিজেই এল।
ফুলশয্যার রাতে কিভাবে এগোবে সে ব্যাপারে রিনার টিপস এর ওপর নির্ভর করে অনুপ মনে মনে রিহার্সাল দিয়েছিল। কিন্তু যখন রাতে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল তখন কেমন যেন সব গুলিয়ে তালগোল পাকিয়ে গেল। ঘরটা ফুলদিয়ে ভারি সুন্দর করে সাজান হয়েছে। ফুলের সাজে ফুলের মাঝে রাজকুমারির মত বসে আছে স্বপ্না। অনুপ ধীরে ধীরে আড়ষ্ট ভাবে খাটে গিয়ে বসল। অনেক কিছুই বলতে আর করতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু কিছুই বলা বা করা হয়ে উঠছে না। একটু স্বাভাবিক হতে গিয়ে বলে ফেলল—তুমি ক্লান্ত। নিশ্চয় তোমার খুব ঘুম পেয়েছে, তাই না ?
বলেই বুঝতে পারল যে এর থেকে বোকার মত কথা এমন দিনে আর হয় না। স্বপ্না একটু হাসল। হয়ত অনুপের অবস্থাটা বুঝতে পেরেছিল। হঠাত অনুপ গালেতে নরম ঠোঁটের স্পর্শ পেল। স্বপ্নার আলিঙ্গনে দূর হয়ে গেল সব জড়তা। সম্মোহিত অনুপ বহু প্রতীক্ষিত, বহু আকাঙ্খিত সেই রূপ সাগরে ডুব দিল অজানা মনি মানিক্যের সন্ধানে।
সুন্দর মুখশ্রী, শান্ত নম্র আচরণ, পরকে সহজেই আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা, এইসব নানা কারণে সকলের কাছে কিছুদিনের মধ্যেই স্বপ্না অত্যন্ত প্রিয়জন হয়ে উঠল। গানের গলাটাও বেশ ভাল ছিল বলে মাঝে মাঝে সন্ধ্যাবেলা ঘরোয়া আসর বসত। অনুপ একসময় কিছুদিন তবলা শিখেছিল। ধুলো ঝেড়ে বাতিল হয়ে যাওয়া তবলা আবার নামিয়া এনে যতটা এলেমে কুলতো স্বপ্নার গানের সাথে ঠেকা দিত। বাড়ি তখন এক আনন্দ নিকেতন।
আনন্দের উৎস ওই মেয়েটিকে নিয়ে মাঝে মাঝে বাড়ির লোকেদের একটু মান অভিমানও হত।
স্বপ্নার বাবা একদিন দেখা করতে এসে একটু আক্ষেপ করেই বলল—বেয়াই মশাই, বিয়ের পর মেয়েটা আমাদের বোধহয় একেবারেই ভুলে গেছে।
স্বপ্না আদর করে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল- ওরকম করে বোলো না বাবা, আমার কষ্ট হয় না!
--বলবো না! বিয়ের পর সেই যে একবার জোড়ে গেলি, তারপর ছ মাসে একবার ও মুখো হলি না। কতবার বললাম ছুটিছাটা দেখে অনুপকে নিয়ে কটা দিন ঘুরে যা। আজ এটা কাল ওটা নানা কারণ দেখিয়ে এখনও একবারও যাওয়ার সময় করে উঠতে পারলি না।
--না এ ভারি অন্যায়। তোমার বাবা তো ঠিকই বলছেন বৌমা। তুমি ওনাদের একমাত্র মেয়ে, মাঝে মাঝে একটু দেখতে ইচ্ছে করে না!
একটু কপট শাসনের সুরে অমরেশ বলল।
কদিন বাদে স্বপ্না সত্যিই যখন অনুপের সাথে আসানসোল যাওয়ার আগে প্রণাম করতে এল, তখন ছলছল চোখে অমরেশ বলল—সাবধানে যেও। ফিরতে বেশি দেরী কোরো না মা। তুমি না থাকলে বাড়িটা বড্ড ফাঁকা লাগে।
কোনদিন কাজকর্ম সেরে বা শ্বশুর শাশুড়ির সাথে গল্প করে নিজের ঘরে ঢুকতে একটু বেশি রাত হয়ে গেলে অনুপের অভিমান—এতক্ষণ কি কর বল ত! আমার জন্য কি তোমার একটুও সময় নেই ?
কোন উত্তর না দিয়ে মিষ্টি হেসে দরজা বন্ধ করে বিছানায় এসে অনুপকে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিত। অভিমান ভুলে স্বপ্নার উষ্ণ শরীরে হাবুডুবু খেতে খেতে অনুপ হারিয়ে যেত এক চরম প্রাপ্তির জগতে। বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে স্বপ্না তার মায়া, মমতা, ভালবাসা দিয়ে বাড়িটাকে আগলে রেখেছিল। নিজের মিষ্টি ব্যবহারের গুণে কারো অভিমানকে কখনো অভিযোগ হয়ে উঠতে দেয়নি।
সেদিন অনুপ স্বপ্নাকে নিয়ে তার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিল। ফিরতে রাত হবে। অমরেশ ঘরে বসে কুট কুট করে টিভির চ্যানেল ঘোরাচ্ছিল। কোন চ্যানেলেই সেরকম মনোমত কিছু হচ্ছে না। টিভির সুইচটা বন্ধ করে বৌএর উদ্দেশ্যে হাঁক পাড়ল—শিগগির একবার এদিকে এস।
সরলা প্রায় ছুটেই ঘরে এল।
--কি সারাদিন রান্নাঘরে খুটখাট করছ। ফাঁকা বাড়ী, পাশে এসে একটু বস না। মনের প্রানের দুটো কথা বলি।
-- সত্যিই তুমি না..... আমি ভাবলাম কিনা কি হয়েছে। ওদিকে তরকারিটা বোধহয় পুড়ে গেল।
--আগে তো এরকম ছিলে না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বড় বেরসিক হয়ে যাচ্ছ।
যাকে বলা সে তখন রান্নাঘরে ফিরে গেছে। অমরেশ অগত্যা আবার টিভিতেই ফিরে গেল।
দুপুরে খেতে বসে অমরেশই কথাটা পাড়ল—হ্যাঁগো, ছেলের বিয়ে তো বছর ঘুরতে চলল। এবার তো একটা নাতি-নাতনি হলে হয়, নাকি ?
--আজকালকার ছেলে মেয়েরা বিয়ের সাথে সাথে বাপ মা হতে চায় না।
-- বাড়িতে একটা বাচ্চা থাকলে কত ভাল লাগবে বল তো। তুমি একবার বৌমাকে জিজ্ঞেস করে দেখ না।
--যত সব ছেলে মানুষের মত কথা। ওরকমভাবে কি জিজ্ঞেস করা যায়।
সরলা ঘুরিয়ে একসময় স্বপ্নার কাছে কথাটা তুলেছিল। স্বপ্না জানায় যে তারা এ ব্যাপারে মানসিক ভাবে প্রস্তুত। সরলা কর্তাকে জানিয়ে দিল যে খুব শিগগিরি তার ইচ্ছাপূরণ হতে চলেছে। কটা মাসের অপেক্ষা, তার পরেই বাড়িতে আসবে ছোট্ট নতুন অতিথি।
বেশ কয়েক মাস কাটার পরেও যখন স্বপ্না সন্তানসম্ভবা হল না তখন অনুপ স্থানীয় এক গাইনির কাছে স্ত্রীকে নিয়ে গেল। ডাক্তার স্বপ্নার সাথে সাথে অনুপকেও কিছু পরীক্ষা করাতে বললেন। রিপোর্ট এলে জানা গেল অনুপের কোন সমস্যা নেই। সমস্যা স্বপ্নার ওভারিতে। আবার কিছু পরীক্ষা। ডাক্তার খুব একটা আশা দিতে পারলেন না। স্থানীয় ডাক্তারের ওপর নির্ভর না করে কোলকাতায় বড় ডাক্তার দেখান হল। সবকিছু দেখে শুনে তিনি অপারেশনের পরামর্শ দিলেন। যদিও অপারেশন করালেই যে কনসিভ করতে পারবে এমন আশ্বাস দিতে পারলেন না। তবে এটা জানালেন যে অপারেশনটা করিয়ে নেওয়া জরুরি, না হলে ভবিষ্যতে অনেক বড় বিপদ হতে পারে। একটু বড় অপারেশন বলে ওটা করাবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সকলেই একটু দ্বিধায় ছিল। যেন যতদিন না হয় ততদিনই ভাল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই নানারকম শারীরিক সমস্যা দেখা দেওয়ায় আর দেরী করা গেল না। একজন বড় ডাক্তার অপারেশন করলেন। ভবিষ্যতের সতর্কতার জন্য ওভারিটা বাদ দিতে হল। ক্ষীণ আশাটুকুও আর রইল না।
স্বপ্নার চেহারা থেকে হাসিখুশি ভাবটাই চলে গেল। অধিকাংশ সময়ে চুপচাপ বসে থাকে। অনুপ তো বটেই ওর মা বাবাও দিনের পর দিন নানাভাবে বুঝিয়ে ধীরে ধীরে ওকে খানিকটা স্বাভাবিক করল। অনুপ একবার বাচ্চা অ্যাডপ্ট করার কথাও ভেবেছিল কিন্তু স্বপ্নার মত না থাকায় ও ব্যাপারে আর এগোয়নি। সময় সব ক্ষতেই প্রলেপ দেয়। মা হতে না পারার দুঃখ ভোলা না গেলেও দৈনন্দিন জীবনে তার প্রভাব, প্রতিফলন আস্তে আস্তে অনেকটাই কমে এল।
একটা মানসিক আঘাত সামলাতে না সামলাতেই বাড়িতে আবার ঘটল চরমদুর্ঘটনা। একটা নয় একসাথে দুটো। অমরেশ আর সরলা কাছাকাছি একটা বিয়ে বাড়িতে নেমন্তন্ন খেয়ে নিজেদের বাড়ি ফিরছিল। ঐ অঞ্চলে তখন লোডশেডিং। রাস্তার ধারের বাড়ি আর দোকান থেকে ইনভার্টার আর জেনারেটারের যে সামান্য আলো চুইয়ে বেরোচ্ছে তাতেই যতটুকু যা দেখা যাচ্ছে। তাও রাত হয়ে যাওয়ায় অনেক দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। চারিদিকটা বেশ অন্ধকার। ধারে কাছে কোন রিক্সাও নেই। কিছুটা এগোবার পর একটা রিক্সা পেল বটে কিন্তু সে মদ খেয়ে চুর হয়ে আছে। নিরুপায় হয়ে অনিচ্ছাতেই তারা রিক্সাটায় উঠল। মাতাল হলেও আবোল তাবোল কিছু বকা ছাড়া রিক্সাটা ভালই চালাচ্ছিল। বড় রাস্তার মোড়টা ঘোরার সময় একটা লরি স্পিডে এসে কাটাতে না পেরে রিক্সাটাকে একটু ছুঁয়ে দিয়ে চলে গেল। তিনজনেই ছিটকে গিয়ে রাস্তায় পড়ল। রিক্সা চালক ঘটনাস্থলেই মারা গেল। অমরেশ আর সরলাকে কাছাকাছি একটা নার্সিংহোমে ভর্তি করা হল। সরলা জ্ঞান হারালেও অমরেশের জ্ঞান ছিল। অনুপদের সাথে কথাও বলেছিল। কিন্তু রাত বাড়ার সাথে সাথে অমরেশের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ভোর হওয়ার আগেই সব শেষ। ইতিমধ্যে সরলার মাঝে মাঝে জ্ঞান আসছে। কিছু জানান হয়নি। অবশ্য কিছু বোঝার মত অবস্থাও তখন তার ছিল না। চার দিনের মাথায় সরলাও মারা গেল।
একসাথে এতটা শোক সামলাবার মত মানসিক ক্ষমতা ঈশ্বর অনুপকে দেননি। সে একেবারে বাক রুদ্ধ হয়ে গেল। পারলৌকিক কাজকর্ম মিটে যাওয়ার পরেও অফিস কামাই করে চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকত। শুধুই ভাবে। ওর বাবা-মাই এতদিন সংসারটা সামলেছে। মাঝে মধ্যে এক আধ দিন একটু আধটু বাজার করা ছাড়া সংসারের কোন কাজই কখনো করেনি। সংসারে অনুপের নিজেকে বড় অসহায় মনে হতে লাগল। কোথায় কখন কি করবে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। সেই চরম দুঃখের সময় স্বপ্না ছায়ার মত স্বামীকে সঙ্গ দিয়েছে। ওদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে স্বাভাবিক ভালবাসা, আকর্ষণ এগুলো প্রথম থেকেই ছিল, কিন্তু ঐ পারিবারিক বিপর্যয়ের সময় থেকে ওরা একে অপরকে ভীষণভাবে আঁকড়ে ধরল। অন্য কোথাও যাওয়া দূরে থাক, নিজের বাপের বাড়িতেও খুব প্রয়োজনে হয়ত এক আধবার গেছে। অফিসের দিনে অনুপের যত কাজই থাক বাড়ি ফিরতে দেরী করত না। আর কোন কারণে দেরী হলে, যত রাতই হোক, স্বপ্না টেবিলে খাবার ঢাকা দিয়ে অপেক্ষা করত। অনুপ বাড়ি ফিরলে একসাথে খেতে বসে শুরু হত নানান গল্প, নানান কথা। পরস্পরকে অবলম্বন করে ওরা পেয়েছিল ঐ চরম দুঃখ, হতাশা ও শূন্যতা থেকে বেরিয়ে আসার পথ। এতগুলো বছর কাটার পরেও এর কোন পরিবর্তন হয়নি বরং কোনদিন কোন কারণে এর অন্যথা হলে ওদের ভাল লাগত না।
স্বপ্না চিরকালই খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। মুখ হাত ধুয়ে জামাকাপড় পাল্টে প্রথমে ঠাকুর ঘরে যাওয়া চাই, তারপর অন্য সব কাজ। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, কখনই এর কোন নড়চড় হবে না। বিয়ের ঠিক পরের সেই রোমান্টিক দিনগুলোতেও অনুপ ভোর পাঁচটা সওয়া পাঁচটার পরে খুব কম দিনই স্বপ্নাকে নিজের কাছে আটকে রাখতে পেরেছে। এতে অনুপের একটু অভিমান হত বটে কিন্তু অন্য সময় স্বপ্না তা সুদে আসলে পুষিয়ে দিত। আগে ঠাকুর ঘরে গিয়ে সূর করে অনেক মন্ত্র টন্ত্র আওরাত। গানের গলাটা ভাল বলে শুনতেও খুব ভাল লাগত। অসুখটা বাড়ার পর থেকে অভ্যাস মত ঠাকুর ঘরে গিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে, রেকাবে বাতাসা সাজিয়ে চুপ করে খানিক বসে থাকে। কিছুক্ষণ বাদে উঠে চলে আসে। কিছুদিন হল তাও বন্ধ হয়ে গেছে।
প্রথমটায় ঠিক বোঝা যায়নি। ভুল তো সকলেরই হয় আর বয়স বাড়ার সাথে সাথে তা বাড়েও। কিন্তু স্বপ্নার ভুলটা ইদানীং একটু বেশি হচ্ছিল। অনুপ অফিস থেকে ফিরলে ওকে কোন ঘটনা বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলত। এতে ওর নিজেরও খুব অস্বস্তি হত। ভুল ভ্রান্তির মাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকায় অনুপ স্বপ্নাকে একদিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। সে বছর কয়েক আগের কথা। তখন স্বপ্নার বয়স তিপান্ন কি চুয়ান্ন হবে। ডাক্তারবাবু সবকিছু দেখে শুনে জানালেন যে অ্যালজাইমার্সের প্রথম পর্যায় চলছে। স্বপ্নাকে বাইরে বসতে বলে ডাক্তার খুব সহানুভূতির সঙ্গে অনুপকে বললেন- এই রোগ সারাবার মত কোন ওষুধ এখনও বাজারে আসেনি। রোগীর মানসিক এবং শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি হবে, যার শেষ মৃত্যুতে। এই পুরো ব্যাপারটা ঘটতে সাধারণত সাত বছর মত সময় লাগে। অবশ্য চোদ্দ বছর বেঁচে আছে এমন রুগীও মাঝে সাঝে দেখা যায়। পঁয়ষট্টি বছর বয়সের পরেই সাধারণত এই রোগ হয়। আপনার স্ত্রীর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অনেক আগেই হয়েছে। মন শক্ত করুন। আমি যা ওষুধ দেওয়ার দিচ্ছি কিন্তু আসল কাজ হল সাহচর্য আর পরিচর্যা। যতটা পারবেন স্ত্রীকে সঙ্গ দেবেন। তাতে কিছুটা হলেও রিলিফ হবে।
ডাক্তারের কথা শুনে অনুপের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। অ্যালজাইমার্স রোগের কথা সে আগেও শুনেছে তবে তার এমন ভয়ানক পরিণতির কথা জানা ছিল না। স্বপ্না কিছুটা আন্দাজ করেছিল। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরতেই অনুপকে জিজ্ঞেস করল—হ্যাঁগো, ডাক্তার বাবু কি বললেন ? ভয়ের কিছু!
-- আরে নানা । ওষুধ লিখে দিয়েছেন, বললেন কয়েক মাস খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।
ডাক্তারের কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল। ভুলে যাওয়ার মাত্রা ক্রমশই বাড়তে লাগল। পুরোনো ঘটনা একটু আধটু মনে থাকলেও এখনকার কিছুই মনে থাকছে না। ধীরে ধীরে লোক চিনতেও ভুল হতে লাগল। একজনের জায়গায় অন্যজনকে গুলিয়ে ফেলছিল। তারপর এখন তো সবই অচেনা। শুধুই তাকিয়ে থাকে। ডাক্তার সঙ্গ দিতে বলেছিল। রিটায়ারমেন্টের বেশি দেরী ছিল না, তাও অফিস কামাই করে সারাক্ষণ স্বপ্নার পাশে থাকল। তবু এত সঙ্গের পরেও এতদিনের সঙ্গী এখন তাকেও চিনতে পারে না। কখনো সখনো এক আধটা অসংলগ্ন কথা বলা ছাড়া সারাদিন কেবল চুপ করে বসে থাকে। খাওয়ানো থেকে শুরু করে দৈনন্দিন সব কাজকর্মই রমলা বা অনুপ করিয়ে দেয়।
খাওয়ার সময় কত কথা কত ঘটনা অনুপের মনে পড়ে। আগে সারা দিনে নানা ঘটনার কথা খাওয়ার টেবিলে বসে স্বপ্নাকে শোনাত। স্বপ্না সেগুলো অধীর আগ্রহে শুনত, মতামত দিত, আবার নিজেও অনেক গল্প করত। কতদিন খাওয়া শেষ হয়ে গেছে কিন্তু গল্প চলতেই থেকেছে। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে তখন খেয়াল হয়েছে রাত অনেক হল এবার উঠতে হবে।
এখনও তারা একসাথেই খেতে বসে। সেই এক টেবিল, একই জায়গা। তবে তা শুধুই খাওয়া। থাকে না কোন গল্প, হাসি, উচ্ছ্বাস, আবদার। মাঝে মাঝে অনুপের দিকে চেয়ে থাকে। কিন্তু সেই দৃষ্টিতে কি অসীম শূন্যতা। খাওয়া শেষ হলে “ বৌদি ওঠ “ বলে রমলা ধরে ধরে মুখ ধোয়াতে নিয়ে যায়।তবু কেমন নেশার মত হয়ে গেছে। আজও স্বপ্নাকে ছাড়া একা খেতে বসার কথা ভাবতেই পারে না। আসলে তার জীবনে সব হারিয়ে যাওয়ার মাঝে ওইটুকুই তো এখনও অবশিষ্ট আছে।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে রিনাদের বাড়ি যাওয়ার জন্য অনুপ তৈরি হল। যাওয়ার আগে রমলাকে স্বপ্নার ওষুধ থেকে আরম্ভ করে যাবতীয় ব্যাপারে নির্দেশ দিতে শুরু করল।
-- দাদা, আমি কি নতুন যে এত কথা বলছ। শান্তি মনে দিদিভাইয়ের বাড়িতে যাও দিকিনি। তবে হ্যাঁ, বেশি রাত কোরো না। বৌদিমনির খেতে দেরী হয়ে যাবে।
-- তুই আমাদের জন্য কত ভাবিস রমলা।
রিনার বাড়িতে গিয়ে পুজোর জামাকাপড়গুলো দিতেই রিনা হৈ হৈ করে উঠল—দাদা, তোকে কতবার বলেছি অনেকদিন তো হল এবার এগুলো বন্ধ কর।
-- জীবনে আনন্দের যতটুকু বাকি আছে তাও কেড়ে নিতে চাস!
দাদা কষ্ট পেয়েছে বুঝতে পেরে রিনা তাড়াতাড়ি জামা কাপড়গুলো বার করে খাটের ওপর রাখল।
সন্ধ্যাবেলা চা জলখাবার খেয়ে বাড়ি ফেরার জন্য উঠতেই ভাগ্নে বলল—মামা আর একটু বস না গল্প করি।
-- নারে সোনা, এখন না বেরলে তোর মামীর খেতে দেরী হয়ে যাবে।
-- দাদা এখনও তোরা রোজ একসাথে খেতে বসিস।
-- হ্যাঁ।
-- আগে খাওয়ার সময় অনেক গল্প মজা হত জানি। কিন্তু এখন বৌদির তো কিছুই মনে নেই রে। কথাও বলে না, চিনতেও পারে না। তাও তুই একসাথে বসে খাওয়ার জন্য এত ছটফট করিস কেন ?
-- এতদিনের অভ্যাস এই শেষ বেলায় এসে কি করে ছাড়ি বল?
রিনাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে লোডশেডিং এর অন্ধকারে ধীর পায়ে অনুপ এগোতে থাকল নিজের বাড়ির দিকে। দব দব করলেও ওখানেই এখনও জ্বলছে তার জীবনের শেষ আলো।