আমরা করব জয় নিশ্চয়
আমরা করব জয় নিশ্চয়
বড়ই দুঃসময়। এই দুঃসময় কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দেশের নয়, সারা পৃথিবীর মানুষের। উন্নত, উন্নয়নশীল, অনুন্নত, সকলেই সংকটে। কেউ একটু কম, কেউ বেশী। নিষ্ক্রমণের পথ এখনও অজানা।
এখন সকলেই সকলের কাছে অস্পৃশ্য। এক ব্যাধি এসে আমাদের দেশের আর এক সামাজিক ব্যাধিকে সর্বজনীন করে দিয়েছে। কেবল অস্পৃশ্যই নয়, আমরা বেশ শুচিবায়ুগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। ডাক্তার বাবুদের নির্দেশে, বাঁচার তাগিদে, ঠেকায় পড়ে হতে হয়েছে। জলপান করা ছাড়া জলের সাথে তেমন একটা লেনাদেনা ছিল না এমন মানুষও ক্ষণে ক্ষণে হাত ধুচ্ছে, তাও আবার সাবান দিয়ে।
অধিকাংশ দিনই এখন ঘরবন্দি। অনেকটা সময় কাটে ছাতে আর দোতলায় রাস্তার ধারের একফালি বারান্দায়। বাইরে না বেরিয়েও ওখান থেকে বাইরের জগতটা চাখা যায়।
বাইরের পুরো চালচিত্রটাই পাল্টে গেছে। যে রাস্তায় সারাক্ষণ ট্র্যাফিক জ্যাম, গাড়ির হর্নের আওয়াজে কান ঝালাফালা হয়ে যায়, সেই রাস্তা প্রায় যানবাহন শূন্য। দূষণ মুক্ত পরিবেশ। আমার বাড়ি বাজারের পাশে, তাই সকালের দিকে রাস্তায় লোকজন থাকে। স্বাভাবিক সময়ের মত না হলেও ভালই থাকে। রোগের ভয়েই হোক বা ধমকের ভয়ে, মাস্ক প্রায় সকলের মুখেই লেপ্টে আছে। নানা রঙের নানা আকৃতির মাস্ক। কেউ কেউ ওটাকে থুতনির নিচে গুঁজে দিয়ে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে। যাতায়াতের মাঝে পরিচিত জনের মধ্যে কুশল বিনিময় হচ্ছে, তবে গায়ে পড়ে নয়, গা বাঁচিয়ে। এই অস্বাভাবিক সময়ে কিছু স্বাভাবিক জিনিসও অত্যন্ত গোপনে ভয়ে ভয়ে নিঃশব্দে সারতে হচ্ছে। লোকে যেন টের না পায়। নরেন সর্দি কাশিতে মাঝে মাঝেই ভোগে। দীর্ঘদিনের সম্পদ, অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সেদিন বাজারে যাওয়ার সময় আমাকে দেখতে পেয়ে নিচে থেকে প্রভাতী শুভেচ্ছা জানাল। ওইটুকু কথার মধ্যে দু একবার খুক খুক করে কাশল। বুঝলাম আবার ওর ঠান্ডা লেগেছে। কাশিকে অচিরেই অনুসরণ করল হাঁচি। প্রথমটা নাক টিপে কোনরকমে নিঃশব্দে বার করলেও পরের দুটোকে আর ঠেকাতে পারল না। আশে পাশের লোকজনের চাঊনি পাল্টে গেল। ও বেচারাও আসামীর মত মাথা নিচু করে দ্রুত প্রস্থান করল।
বাজারে যাওয়ার রাস্তার মুখে পুলিস আর মিউনিসিপ্যালিটির কিছু যুবক বাহন সমেত যাতে কেউ বাজারের দিকে না যেতে পারে তা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। বাহন ঢুকতে না দেওয়ায় বাজার অঞ্চলটা অনেক ফাঁকা থাকে। আমার পাশে এক প্রৌঢ় সাইকেলে চেপে বাজার যাচ্ছিলেন। তাঁকে যথারীতি সাইকেল রেখে বাজারে যেতে বলা হল। তিনি জানালেন যে সাইকেল তাঁর অবলম্বন, কিছু না ধরে তিনি হাঁটতে পারেন না। ছেলেগুলি নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকায় প্রৌঢ় সামনে দাঁড়ান ছেলেটির দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, “সাইকেল যখন নিয়ে যেতে দেবে না তখন তুমি বাবা আমার সাথে একটু চল। তোমাকে ধরে ধরে চট করে বাজারটা করেনি”। এরপর আর সাইকেল নিয়ে যেতে ভদ্রলোকের কোন সমস্যা হয়নি।
দু একজন যুবক তাদের অ্যপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে গল্পগুজব করে। কথাবার্তা কিছু কিছু কানে আসে, উপভোগ করি। ওদের মধ্যে একজন বেশ রসিক। একদিন সকালে ওই রসিক জনের গলা পেলাম, “দাদা কবে নামলেন?’। বিচিত্র প্রশ্ন শুনে ঘুরে তাকালাম। যার উদ্দ্যেশে প্রশ্ন সেই মধ্য বয়সী লোকটি প্রথমটায় ঠিক ধরতে পারেননি। পরে হেসে বললেন, “না নেমে উপায় নেই ভাই। যা স্টকে ছিল সব ফুরিয়ে গেছে। একবার বাজারে না গেলেই নয়”।
--টানা কদিন ওপরে থেকে দাদা কিন্তু বেশ ফরসা হয়ে গেছেন।
একটু হেসে ভদ্রলোক সন্তর্পণে গা বাঁচিয়ে ধীরে ধীরে বাজারের দিকে এগোলেন।
ভদ্রলোক ওই অ্যপার্টমেন্টের চার তলায় থাকেন। সাবধানী মানুষ, টানা দশদিন ফ্ল্যাটের মধ্যে অন্তরীণ ছিলেন। ঠেকায় পড়ে নামতে হয়েছে।
সন্তানেরা সব চাকরির কারণে বাইরে থাকে। ফলে অন্নের সন্ধানে আমাকেই দোকানপাটে যেতে হয়। ভালই লাগে, বেশ উপভোগ করি। আমি নিত্য বাজারে যাওয়ার লোক। এখন কিছুটা ভয়ে আর বেশিটা ছেলে মেয়েদের কড়া নির্দেশের ফলে দু একদিন অন্তর যাই।
সেদিন মাছের বাজারে গিয়েছি। আমাদের মাছের বাজারে জায়গা প্রশস্ত নয়। মাছ কেনা হয়ে গেছে। কেটে রেডি করছে, পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি।
“অসভ্য লোক, আপনি আমার শরীরে হাত দিলেন?” ঘটনাটা আমার পাশেই ঘটেছে। না কোন শ্লীলতাহানির ব্যাপার নয়, কারণ বক্তাটি পুরুষ। ভদলোকের কাছেই জানলাম যে অভিযুক্ত ব্যক্তির পা ওনার গায়ে লাগাতে ব্যক্তিটি সরি বলেন আর সরি বলার সময় স্বাভাবিক নিয়মেই ওনাকে একটু স্পর্শ করে ফেলেন। “কেমন বাজে লোক দেখেছেন! একবার পা দিয়ে ছুঁল, একবার হাত দিয়ে ছুঁল”।
নিজেকে ভাল রাখতে কে না চায়! তার জন্য অর্থ, স্বার্থ, স্পর্শ, সব কিছু বাঁচাতে আমরা উদগ্রীব। কিন্তু অন্যকে ভাল রাখার কথা ক’জন ভাবে! ভাবে, সংখ্যায় কম হলেও ভাবে। না হলে এই দুঃসময়ে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোর যন্ত্রণা শতগুণে বেড়ে যেত। বিপদভঞ্জন মধুসূদনরূপী এই ভাল মানুষেরা সব এলাকাতেই কমবেশি আছে। বিপদের সময় এরা সাধ্যমত চেষ্টা করে মানুষের পাশে থাকার এবং সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থে।
‘রহড়া আন্তরিক’, আমাদের এলাকায় একটি পরিচিত নাম। বহু বছর ধরে এরা গ্রামের গরিব ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানে সব রকমের সহযোগিতা করে। খালিপেটে লেখাপড়া হয় না। দেড়মাস যাবৎ প্রতিষ্ঠানে নথিভুক্ত দুঃস্থ ছেলেমেয়ে এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করছে ‘আন্তরিক’।
শতবর্ষ অতিক্রান্ত ক্লাব ‘রহড়া সংঘ’। কেবল রহড়াতেই নয়, পশ্চিমবঙ্গে অতি পরিচিত নাম। পরিচিতিটা মূলত খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে। তবে শুধু খেলাধুলাই নয়, প্রায় ৩৪ বছর ধরে পুজোর আগে দুঃস্থ বাচ্চাদের জামাকাপড় দেওয়া হচ্ছে, এতেই প্রমাণ হয় ক্লাব সমাজসেবাতেও পিছিয়ে নেই। এই লকডাউনের সময় ক্লাব থেকে এখন পর্যন্ত ভাগে ভাগে প্রায় ৮০০টি পরিবারকে খাদ্য সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। আগামী দিনেও দেওয়া হবে।
রহড়াতে এমন আরও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যাদের ব্যাপারে আমি ব্যক্তিগতভাবে অবহিত নই, তারাও তাদের সাধ্যমত দুর্যোগের মোকাবিলায় এগিয়ে এসেছে।
এবার বলি ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার কথা। অর্ণব পাল, আমার সন্তানবৎ এক তরুণ। ওরা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে মেতে আছে এক অবিশ্বাস্য কর্মযজ্ঞে। লকডাউনের প্রথম পর্ব থেকে খড়দহ থানার সহযোগিতায় প্রতিদিন ওরা রাঁধা খাবার কয়েকশ লোকের হাতে তুলে দিচ্ছে। থানা ওদের একটা ঘর ছেড়ে দিয়েছে, সেখানেই ত্রাণের কাঁচা মাল রাখা থাকে। প্রতিদিন থানাতেই রান্না হয় আর পুলিশের ভ্যানে করে বরানগর থেকে টিটাগড় পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এক এক দিন এক এক জায়গায় গিয়ে বিতরণ করে আসে। এই দেড়মাসে একদিনও এর অন্যথা হয়নি। এর পরেও ওদের মনে একটু দুঃখ ছিল। সকালে তো বিভিন্ন জায়গা থেকে খাবার আসে কিন্তু রাতে তো খাবার আসে না। রাতে ওদের খাওয়া হয় না। থানার কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে দশ বার দিন হল রাতেও খাবার পরিবেষণ করছে। এই কর্মকাণ্ডের বিপুল অর্থ নিজেরাই পরিচিত জনেদের কাছ থেকে জোগাড় করছে।
পুত্রবৎ আর একজনের কথা বলে শেষ করি। নীলাদ্রি চ্যাটার্জী, কর্মসূত্রে নরওয়েতে থাকে। বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অর্থ সংগ্রহ করে পাঠিয়েছে দেশের মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য। প্রাপকদের মধ্যে আমাদের রহড়ার কিছু প্রতিষ্ঠানও আছে।
কোন ধন্যবাদই এদের জন্য যথেষ্ট নয়।
স্থানীয় পুলিশ এবং প্রশাসনের ভূমিকাও ধন্যবাদার্হ।
কোন দুর্যোগ বা বিপর্যয় চিরস্থায়ী হয় না। আশা রাখি অচিরেই দূর হবে এই দুঃসময়, ফিরে পাব সুস্থ, সুন্দর পৃথিবী। ততদিন সকলে সাবধানে থাকুন, ভাল থাকুন।