Sukdeb Chattopadhyay

Classics

3.6  

Sukdeb Chattopadhyay

Classics

পয়া-অপয়া।

পয়া-অপয়া।

7 mins
587


কিছু কিছু লোককে অনেক সময় পরিচিতজনেরা সন্তর্পণে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। সব সময় না হলেও বিশেষ কিছু সময়ে তো বটেই। এই মানুষটা যে খারাপ তা হয়ত আদপেই নয় বরং অনেক সময় যারা এড়িয়ে যাচ্ছে তাদের অনেকের থেকেই ভাল। তবু কেন জানিনা পরিচিত জনের কাছে এরা অপয়া। কাকতালীয় ভাবে হয়ত কোন সময় কোথাও এদের আসার পর কোন অঘটন ঘটেছে। একবার অপয়া ছাপ পড়ে গেলে সকলেই একটু সমঝে চলে। সব পাড়াতেই উঁকি মারলে এমন এক আধ পিস পাওয়া যাবে।

এক ঠাকুমার এখন তখন অবস্থা। ডাক্তার মাসখানেক আগেই জবাব দিয়ে গেছে। প্রস্থান বিন্দুতে দাঁড়িয়ে কেটে যাচ্ছে একটার পর একটা দিন। খবর পেয়ে কানুদা মাসিকে একবার দেখতে এসেছে। ঘরে ঢুকে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই প্রায় কোমায় থাকা বৃদ্ধা অস্ফুট স্বরে একবার ‘কানু” বলে ডেকেই নেতিয়ে পড়লেন। বৃদ্ধা যন্ত্রণা থেকে চিরতরে মুক্তি পেলেন, বাড়ির লোকেরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।যা হল তা ভালই হল। কিন্তু খবরটা কানে কানে চারিদিকে ছড়িয়ে যেতে রুগী আছে এমন বাড়িতে কানুদার ‘নোএন্ট্রি’ হয়ে গেল। অবশ্যএর পরেও তাঁর উপস্থিতিতে ঘটেছে নানান বিচিত্র ঘটনা।

কমল তার এক বন্ধুর সাথে ট্রামে চেপে অফিস যাচ্ছে। দুজনেরই অফিস বিবাদী বাগে। ট্রাম যখন বৌবাজার পার হচ্ছে ওরা দেখল যে কানুদাও ওই একই ট্রামে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অভিজ্ঞ বন্ধুটি বার বার নিষেধ করা সত্ত্বেও কমল হাঁক দিল—কানুদা কেমন আছেন?

-- আরে কমল যে, কতদিন পর দেখা।

আর কথা এগোয়নি। কলেজ স্ট্রিট ক্রসিংটা পার হয়েই নিজের পথ হেলায় ত্যাগ করে ট্রামের ফার্স্ট ক্লাস ততক্ষণে ফুটপাথে উঠে গেছে। অগত্যা নিষেধ অমান্য করার জন্য বন্ধুর গালমন্দ শুনতে শুনতে বাকি পথটা কমলকে হেঁটেই অফিস যেতে হল।

ঘটনার ধারাবাহিকতা দীর্ঘদিন বজায় থাকায় এ ব্যাপারে কানুদার কৌলীন্য সর্বজন স্বীকৃত।

হরিদারও এ ব্যাপারেবেশ নাম আছে। মানুষ হিসেবে কানুদার থেকে ঢের ভাল তবু ছোট, বড়, মাঝারি, নানা ঘটনার পরম্পরায় তাঁকেও অনেকে একটু অন্য চোখে দেখে।

মানুষটা খেলা ভালবাসে। স্থানীয় ক্লাব রহড়া সংঘের ফুটবল বা ক্রিকেট যে খেলাই থাক না কেন খুব কাজ না থাকলে মাঠে চলে যান। কয়েক বার এমন হয়েছে যে উনি মাঠে ঢোকা মাত্র রহড়া সংঘ গোল খেলবা ক্রিকেট হলে উইকেট পড়ল। অত দর্শকের মধ্যে কে কখন আসছে যাচ্ছে নজরে পড়ার কথাই নয়। হরিদার দুর্ভাগ্য তা কারো কারো নজরে পড়েছে। উনি খেলা দেখলে যে রহড়া সংঘ কখনো জেতে না এমনটা নয়, তবু উনি মাঠে ঢুকলেই একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বাজারে একবার নাম ফাটলে তা কোন বিশেষ ক্ষেত্রে আবদ্ধ থাকে না, অচিরেই সর্বব্যাপী হয়ে যায়। ফলে পরে কেবল আর খেলার মাঠ নয়, যে কোন দরকারি কাজে যাওয়ার সময় হরিদা সামনে পড়ে গেলে অনেকেরই কপালে ভাঁজ পড়ে।

মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রথম দিন। মুনি বাবার সাথে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। গাড়ি আসছে কিনা দেখতে গিয়ে মুনির বাবা দেখে হরিদা আসছে, আর ওদের দিকেই। হয়ে গেল। লোকটা আর সময় পেল না, একেবারে প্রথম দিনেই। মেজাজটা খিঁচরে গেল। কাছে এসে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে শুনে মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে অনেক শুভেচ্ছা জানিয়ে গেল। মেয়ে অবশ্য হরিদার নাম যশের ব্যাপারে কিছু জানে না, তা না হলে বিপদ বাড়ত। অনেক দুশ্চিন্তা নিয়ে ভদ্রলোক মেয়েকে পরীক্ষার সেন্টারে দিয়ে এলেন। বিকেলে মেয়েকে স্কুল থেকে হাসিমুখে বেরোতে দেখে পিতৃদেব নিশ্চিন্ত হলেন। অন্তত একজনের মন থেকে দূর হল এক নিরীহ ভাল মানুষ সম্পর্কে গড়ে ওঠা কিছু বিচিত্র ধারণা। মজার ব্যাপার, পরীক্ষার পরের কদিন মুনির বাবা রওনা হবার আগে মনে মনে একবার হরিদাকে দেখতে চাইতেন।

পাড়ায় কেউ মারা গেলে আর কেউ যাক বা না যাক হরিদাকে পাওয়া যাবেই। শুধু যাওয়াই নয়, যাওয়া থেকে ফেরা পর্যন্ত সব কাজ সামলে দেবেন। তখন কাঠের চুল্লী, শবদাহের কাজও নিজের হাতেই করতেন আর এই ব্যাপারে শ্মশান কর্মীরাও ওঁকে গুরু মানত। অন্য সময় লোকে পাশ কাটালেও এই সময় অবশ্য হরিদার মত মানুষ হয় না।

‘বুড়ো’ ঘটি বাড়ির ছেলে কিন্তু চরিত্রে বিভীষণ, ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক। সেবার মোহনবাগানের সাথে খেলাটা ক্লাবে বসেই দেখছিল। খেলা শুরু হওয়ার একটু পরে ঢুকেছে। তখনো কোন গোল হয়নি। ঢোকামাত্র ইস্টবেঙ্গল একটা গোল খেল। তারপর ব্যবধান বাড়তে থাকল। ইস্টবেঙ্গল সেদিন তিন –পাঁচ গোলে হেরেছিল। বুড়োকে ওর ইস্টবেঙ্গল সমর্থক বন্ধুরা বাধ্য করেছিল টিভির সামনে থেকে চলে যেতে। অবশ্য বুড়ো চলে যাওয়ার পরেও ইস্টবেঙ্গল এক গোল খেয়েছিল। চুড়ান্ত বাজে খেলল ইস্টবেঙ্গল আর অপয়া তকমা লাগল বুড়োর গায়ে।

কেবল ব্যক্তি নয় অনেক সময় বিশেষ কোন সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও পয়া- অপয়া বা শুভ অশুভর বাচবিচার করা হয়। কাম্য না হলেও ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যাপারটায় সাধারণত অল্পস্বল্প মজা থাকে কিন্তু গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে তা আসে ঘৃণা থেকে। যেমন পৈতেরঅব্যবহিত পরে কিছু সময় শূদ্রের মুখদর্শন অশুভ, তাই নিষিদ্ধ।খুঁজলে এমন আরো অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে। আমাদের এই অঞ্চলে এই নিষেধ( যদিও এখানে আজকাল শুভবুদ্ধি সম্পন্নঅধিকাংশ মানুষই এই ধরণের নিষেধে আমল দেন না) সাময়িক কিন্তু ভারতবর্ষের অনেক অন্ধকার বলয়ে এই সব বিধি নিষেধ সদা বলবৎ থাকে। বহু মানুষের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় এই বিষ বৃক্ষের ডালপালা কিছুটা ছাঁটা গেলেও গাছটাকে উপড়ে ফেলা সম্ভব হয়নি। এর শিকড় এখনও সমাজের অনেক গভীরে।

সম্প্রদায় কেন্দ্রিক কিছু শুভ ধারনাও আছে। এমনিতে তাদের নিয়ে যত সমস্যাই থাকুক না কেন, কাজে বেরিয়ে পথে হিজরে দর্শন হলে তা সৌভাগ্যের ইঙ্গিত বলে মনে করা হত। অবশ্য এখন কি ট্রেনে কি বাসে সর্বত্রই তাঁরা ছেয়ে থাকেন, ফলে রাস্তায় বেরোলে দর্শন হবেই।

দুর্গা পুজোর মত শুভ কাজে বেশ্যাদ্বারের মাটি লাগে। মানুষের লালসাকে নিজ দেহে ধারণ করে সমাজকে নির্মল রাখার জন্যই হয়ত তাঁদের প্রতি এই সম্মান।

এই শুভ অশুভ বা পয়া অপয়ার চাঁদমারি শুধু যে মানুষ তা কিন্তু নয়। ইহ জগতের যে কোন জিনিসই এর আওতায় আসতে পারে। গুরত্ব দেবে কি দেবে না তা ব্যক্তি বিশেষের ওপর নির্ভর করে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে বা বাড়ি থেকে কাজে বেরিয়ে দু শালিক দেখলাম, মনটা আনন্দে ভরে গেল। কিন্তু এক শালিক দেখলেই সব মাটি। একই জীব, সংখ্যার ভিন্নতায় ইষ্ট থেকে অনিষ্ট হয়ে গেল।

স্থানের ক্ষেত্রে দেবস্থান শুভ তাই পথে চোখে পড়লেই হাতটা আপনা আপনিই ললাট স্পর্শ করে। বারে কারো কম কারো বেশি, কারো একহাত তো কারো দু হাত। আবার অনেক সময় কোন কোন জায়গা দেখবনা বলে মুখ ঘুরিয়ে নেই। জায়গার ক্ষেত্রে অশুভর মজার উদাহরণ আমাদের পশ্চিমবঙ্গেই আছে। সেই জায়গার নাম উচ্চারন করলে নাকি ভাত জোটে না। কার কবে এমনটা হয়েছিল তা অবশ্য কারো জানা নেই। তবু কেউ ঝুঁকি নিতে চায় না। নিজেদের দেওয়া বিকল্প নামেই ডাকে। হাওড়া বর্ধমান কর্ড লাইনের এই স্টেশনের নাম ‘বেলমুড়ি’। স্থানীয় যাত্রীরা এই স্টেশনের নাম মুখেই আনে না। টিকিট কাউন্টারে বেলমুড়ির বদলে ‘মাঝের গ্রাম’ বা ‘মাঝের গাঁ’ এর টিকিট চান। রেল কর্মীরাও ওই নাম শুনলে বেলমুড়ির টিকিট দেন।

যে জায়গার নাম উচ্চারণ করলেই বিপদ সেখানে তো মানুষের থাকারই কথা নয়। কিন্তু আছে, হাজারে হাজারে আছে, বহাল তবিয়তে আছে।



শুভ অশুভ খাবারেও আছে। কোন শুভ অনুষ্ঠানে ডিম চলে না অথচ যে মুরগী ওটি পাড়ছে তা চলে। ছেলে মেয়েদের পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় তো ডিম চরম ভাবে নিষিদ্ধ। আবার উল্টোটা হল দই। পরীক্ষার সময় সন্তানকে শুধু দই খাইয়েই নয় কপালে বড়সড় একটা ফোঁটা দিয়ে তবে মায়েদের শান্তি।অধিকাংশ মানুষের মনে কুসংস্কার( superstition) অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকে। এই সংস্কার কখনো তাৎক্ষণিক হয় কখনো চিরন্তন। কখনো প্রকাশ্য আবার কখনো প্রচ্ছন্ন। একেবারে সংস্কারমুক্ত মানুষ খুব কমই হয়। অনেক আপাত মুক্তমনা মানুষও কোন দুর্বল বা অসহায় মুহূর্তে সংস্কারের বশবর্তী হয়ে পড়েন। এই superstitionই সকল পয়া অপয়ার আধার।


Superstition এমন এক বিশ্বাস বা অভ্যাস যা যুক্তি বা বিচার বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হয় না। এই বিশ্বাস বা অভ্যাসের অধিকাংশই প্রচলিত ধারণা ( যেমন বেড়াল সামনে দিয়ে রাস্তা পার হলে গাড়ি দাঁড় করান, তের সংখ্যা অপয়া ইত্যাদি) থেকে আসে আবার অনেক সময় ব্যক্তির দিন যাপনের মধ্যে থেকে গজিয়ে ওঠে বিচিত্র কিছু ভাবনা। বিশেষ পোশাক, বিশেষ ঘটনা বা এই জাতীয় বিশেষ কিছুকে কখন কখন মানুষ বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের প্রতিক হিসাবে মনে করে।


অশিক্ষার সাথে অন্ধ বিশ্বাসের গভীর হৃদ্যতা সর্বজনবিদিত। শিক্ষা যে অঞ্চলে যত কম কুসংস্কারের প্রকোপ সেখানে তত বেশি। শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে মানুষ বুঝতে শেখে প্রচলিত সব উদ্ভট বিশ্বাসের অসারতা। সংস্কারের বেড়াজাল কেটে চেষ্টা করে ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের আলোয় অবগাহন করতে। অনেকটাই হয় তবে তলানি কিছু থেকে যায়। অন্তত ইতিহাস তাই বলে। দেশ বিদেশের নামী দামী লোকের ব্যক্তিগত ভাবনা চিন্তার কুটুরিতে উঁকি মারলে দেখতে পাব যে জ্ঞানের শক্তিশালী আলোও তার অন্দরের সবটা আলোকিত করতে পারেনি। অন্ধকারের কিছু কোণা রয়েই গেছে। রানী প্রথম এলিজাবেথ তাঁর রাজকার্য পরিচালনায় সাহায্য করার জন্য একজন জাদুকর রেখেছিলেন। সেই জাদুকরের একটি ম্যাজিক পাথর, যা আজও ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা আছে, প্রভাবিত করত রানীর ভাবনাকে। 

নেপোলিয়ন মাদাম নরম্যান্ড নামে এক অলোকদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তির পরামর্শ শুনে চলতেন। এ ছাড়া প্রতিদিনের অনেক স্বাভাবিক ঘটনার (যেমন, ঘোড়া হোঁচট খেল, বেড়াল রাস্তা কাটল) মধ্যে খুঁজে পেতেন অশুভের ইঙ্গিত। ওয়াটারলুর যুদ্ধের আগে স্বপ্নে কালো বেড়াল দেখে ছিলেন এবং সেটাই নাকি ছিল তাঁর পরাজয়ের আগাম ইঙ্গিত। মেদিনী কাঁপানো একনায়ক হিটলারের জীবনে কুসংস্কার একেবারে মাখামাখি হয়ে ছিল। তাঁর শুভ সংখ্যা ছিল সাত। প্রতিটি পদক্ষেপ নিতেন জ্যোতিষীর পরামর্শ নিয়ে। তাঁর নাৎসি দলের প্রতীক ছিল প্রাচিন কাল থেকে পরিচিত সংকেত স্বস্তিক। তিনি মনে করতেন এই প্রতীক অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন। খেলার জগতেও ছেয়ে আছে নানান তুকতাক আর বিচিত্র সব অভ্যাস যা কোন যুক্তি তর্কের ধার ধারে না। ইতিহাসের পাটা ওল্টালে দেশে বিদেশে এমন অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাবে। এগুলো অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। ব্যক্তিগত এই সব বিশ্বাসের মধ্যে আছে মজা, কিছুটা ছেলেমানুষিও। অধিকাংশ মানুষ কি বিখ্যাত কি অখ্যাত, কি শিক্ষিত কি অশিক্ষিত, দৈনন্দিন জীবনে গোচরে বা অগোচরে, বিশেষ কিছু সময়ে ঈপ্সিত ফললাভের আশায় নিজস্ব কিছু বিশ্বাস বা অভ্যাসকে আঁকড়ে ধরে। এই ব্যক্তিগত অভ্যাসগুলো যতক্ষণ ব্যক্তিগত পর্যায়ে আছে ততক্ষণ সমস্যা যদি কিছু হয়ও তা একান্তই সেই ব্যক্তির। রাজনৈতিক বা সামাজিক অবস্থান এবং ক্ষমতাকে ব্যবহার করে এগুলোকে যদি কখনো সমষ্ঠির ওপর চাপাবার চেষ্টা করা হয়, তা সে নিজের বাড়িই হোক বা সমাজ বা দেশ, তখনই শুরু হয় সমস্যা। শিক্ষাই তখন যোগায় প্রতিবাদের ভাষা আর প্রতিরোধের শক্তি।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics