শোক-আহ্লাদ
শোক-আহ্লাদ
গত শতাব্দীর আশির দশক পর্যন্ত পাড়ায় পাড়ায় ফুটবল খেলার বেশ চল ছিল। ক্রিকেট, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, এগুলোও হত তবে ফুটবল ছিল অনেক বেশি জনপ্রিয়। বিকেল হলেই বাচ্চারা বল নিয়ে মাঠে নেমে পড়ত। মাঠ বলতে খানিকটা ফাঁকা জমি হলেই হল। সেখানেই চলত বল নিয়ে খানিক হুড়োহুড়ি। খেলতে গিয়ে লাগত, কাটত, ছড়ত, কিন্তু তেমন বড় ধরণের কিছু না হলে বাচ্চা বা তার মা বাবা কেউই তাতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ত না। আজকাল প্রোমোটিং এর কল্যাণে কোন ফাঁকা জমি পড়ে থাকার উপায় নেই। আর মা বাবারাও সন্তানদের মাঠের থেকে পাঠে ব্যস্ত রাখতেই বেশি আগ্রহী। মাঠও নেই, বাবা মায়েদের আগ্রহও নেই, তাই আগের সেই ছবি অনেকটাই হারিয়ে গেছে। এখন বাচ্চারা মাঠে গিয়ে দৌড়োদৌড়ি করে গেম খেলে না, গেম খেলে ঘরে বসে যন্ত্রের বোতাম টিপে।
সেই সময়, যখন খেলাধুলা দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ ছিল, সারা বছর পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় ছোট বড় মাঝারি নানা ধরণের ফুটবল টুর্নামেন্ট হত। বহরমপুরের হুইলার শিল্ডের মত একটু বড় আকারের টুর্নামেন্টগুলোয় বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে অনেক নামী দামী খেলোয়াড়েরা খেলত। আমাদের রহড়া সম্মিলনী ক্লাবও প্রতি বছরই কোন না কোন নামী টুর্নামেন্টে নাম দিত। বেশ কিছু ওজনদার খেলোয়াড় থাকার সুবাদে ক্লাবের ঘরে ট্রফিও আসত। খেলার দিনগুলোয় টিমের সাথে প্লেয়ার ছাড়াও অনেক সমর্থক মাঠে যেত। সমর্থকদের মধ্যে কয়েকজন ছিল যারা আমাদের প্রায় প্রতিটি খেলায় মাঠে থাকত। মন্টুদা ছিল ওইরকমই একজন একনিষ্ঠ সমর্থক। মন্টুদা আমাদের ক্লাবের সভ্য ছিল না, তবু ফুটবল খেলা আর ক্লাবকে ভালবাসত বলে নিয়মিত মাঠে হাজির থাকত। খেলার দিনে পিকনিকের মেজাজে ট্রেনে চেপে সকলে মিলে হৈ হুল্লোড় করতে করতে যেতাম। বহরমপুর বা কাটোয়ার মত দূরে কোথাও খেলা থাকলে খেলার আগের দিন যাওয়া হত। সেবারে শান্তিপুরে একটা টুর্নামেন্টে রহড়া সম্মিলনী ফাইনালে উঠেছে। টিমের সাথে যথারীতি আমাদের বহু লোক মাঠে গেছে। তখন আমাদের একেবারে চাবুক টিম। মাঠে গিয়ে দেখি অপোনেন্টে হাওড়ার টিমও খুব ভাল। যথা সময়ে খেলা শুরু হল। আক্রমণ আর প্রতি আক্রমণে খেলা জমে উঠল। প্রথমার্ধে দু পক্ষই গোল করার মত কয়েকটা সুযোগ তৈরি করলেও কেউই জালে বল ঢোকাতে পারেনি। দ্বিতীয়ার্ধে আমাদের খেলায় ঝাঁঝ অনেক বেশি ছিল। খেলা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা গোল করে এগিয়ে গেলাম। কয়েকটা সহজ সুযোগ নষ্ট না করলে ব্যবধান আরো বেড়ে যেত। কপাল খারাপ, খেলা ঠিক শেষ হওয়ার মুখে কর্নার ফ্ল্যাগের কাছ থেকে আসা ওদের একটা নিরীহ সেন্টার আমাদের স্টপারের গায়ে লেগে গোলে ঢুকে গেল। গোল হওয়া মাত্রই রেফারী ফাইনাল হুইসল বাজিয়ে দিল। এক্সট্রা টাইমে কোন গোল হল না। ম্যাচ গড়াল টাইব্রেকারে। আমাদের গোলকিপার ভাল, কোলকাতার একটা বড় দলে খেলে। তবু টাইব্রেকার সব সময়েই একটা টেনশনের ব্যাপার। আমাদের প্রথম শট পোষ্টে লেগে ফিরে এল। দ্বিতীয় শট ওদের গোলকিপার বাঁচিয়ে দিল। অন্যদিকে হাওড়ার টিম প্রথম দুটো শটেই গোল করে দিল। দুই শূন্যয় পিছিয়ে পড়ায় পরাজয় নিশ্চিত জেনে আমাদের কেউ কেউ মাঠ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু ওদের পরের তিনটে শট আমাদের গোলরক্ষক অসাধারণ দক্ষতায় বাঁচিয়ে দেয় আর আমরা তিনটে শটেই গোল করি। চার/ তিন গোলে ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়ান হয়ে গেলাম। জেতার পর মাঠে সবাই যখন আনন্দ করছি মন্টুদাকে আশেপাশে কোথাও দেখতে পেলাম না।
আধ ঘন্টা পরে একটা ডাউন শান্তিপুর লোকাল আছে তাই একে একে শান্তিপুর স্টেশনের দিকে এগোতে শুরু করলাম। স্টেশনে ঢুকে দেখি এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের সামনের দিকে একটা জটলা হয়ে রয়েছে। কৌতুহলবশত জটলার কাছে গিয়ে দেখি মন্টুদা প্ল্যাটফর্মে পা ছড়িয়ে বসে হাউ হাউ করে কাঁদছে। সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “মন্টুদা, অমনভাবে কাঁদছ কেন?”।
চেনা মুখ দেখে কান্নার দমক আরো বেড়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতেই আমার দিকে চেয়ে বলল, “এত ভাল খেলেও টিমটা আমার হেরে গেল রে!”।
পাশে দাঁড়ান মাঠ ফেরতা একজন আমাদের হাওড়ার টিমের সমর্থক ভেবে মন্টুদাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল—আপনাদের কপাল খারাপ, এগিয়ে থেকেও হেরে গেলেন। খেলায় তো হার জিত থাকবেই, অত ভেঙে পড়বেন না।
টিম জিতেছে একথা মন্টুদাকে জানাতে করুণ সুরে বলে উঠল— আমাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিস না রে। টাইব্রেকারের শুরুতেই তো খেলা শেষ হয়ে গেল।
জড়িয়ে জড়িয়ে অস্পষ্ট ভাবে কষ্ট করে কথাগুলো বলল। মন্টুদা যেমন খেলা পাগল ছিল তেমনই ছিল সুরা পাগল। অনুমান করলাম, টাইব্রেকারে আমাদের প্রথম দুটো শটে গোল না হওয়ায় পরাজয় নিশ্চিত জেনে মন্টুদা তখনই মাঠ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। শোকে একটু শান্তির জল দিতে আশ্রয় নিয়েছিল আশেপাশের কোন শুঁড়িখানায়। তারপর ষ্টেশনে এসে ভূলুণ্ঠিত হয়ে হা হুতাশ করতে করতে শান্তিপুর লোকালের জন্য অপেক্ষা করছিল।
অল্প সময়ের মধ্যেই ট্রফি নিয়ে হৈ হুল্লোড় করতে করতে আমাদের বাকি লোকেরা ষ্টেশনে এসে গেল। চেনা লোকগুলোকে ট্রফি হাতে দেখে মন্টুদার কান্না থেমে গেল। আমার হাত ধরে শরীরে নানারকম ঢেউ তুলে কোনরকমে উঠে দাঁড়িয়েই ‘টিচার্স ফর’ বলে বাক্য সম্পূর্ণ করার জন্য আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। বুঝলাম জলের প্রভাবে ‘থ্রি চিয়ার্স’ টা পরিচিত ব্র্যান্ড ‘টিচার্স’ হয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। আর ওইটুকু বলে থেমে যাওয়ার কারণ হল ক্লাবের নামটা জলের তোড়ে মাথা থেকে সাময়িক ভাবে ধুয়ে গেছে। তাই আমি ‘রহড়া সম্মিলনী” বলে শেষটুকু ধরিয়ে দিতেই মন্টুদা মহোৎসাহে হেঁকে উঠল, ‘টিচার্স ফ অ র র অ অ অ ড়া স অ মি ল অ নি’। আমাদের সমবেত হিপ হিপ হুররে ধ্বনির মাঝেই এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে ঢুকল শান্তিপুর লোকাল।
ট্রফি আর মন্টুদা, আমাদের পরিতোষের যুগল উৎসকে আগলে নিয়ে আমরা সকলে ফেরার ট্রেনে উঠে বসলাম।