চোখের মধ্যে আলো জ্বালো
চোখের মধ্যে আলো জ্বালো
শ্রীরামকৃষ্ণদেবের উপদেশ
১) গ্যাসের আলো নানা স্থানে নানা ভাবে জ্বলছে, কিন্তু এক আঁধার হতেই আসছে
নানা দেশের নানা জাতির ধার্মিক লোক সেই এক পরমেশ্বর হতেই আসছে
২) লুকোচুরি খেলায় বুড়ী ছুলেই আর চোর হয় না।
সেইরকম ঈশ্বর ছুলেই আর সংসারে বদ্ধ হয় না।
যে বুড়ী ছুঁয়েছে,, সে যেখানে ইচ্ছা যেতে পারে, তাকে আর চোর করার যো নেই।
যিনি ঈশ্বরকে ছুঁয়েছেন, সংসারের সকল অবস্থাতেই তিনি নিরাপদ থাকে,,, কিছুতেই তাকে আর বদ্ধ করা যায় না।
৩) লোহা যদি স্পর্শমণি ছুঁয়ে সোনা হয়, তাকে মাটির ভেতরেই রাখ বা আস্তাকুড়েই ফেলে রাখ,, সে সোনা হয়েই থাকবে,,,, লোহা হবে না।
যিনি ঈশ্বরলাভ করেছেন তাঁর অবস্থা সেরকমই। তিনি সংসারেই থাকুন কি বনে,, ওনার গায়ে আর কিছুতেই দাগ লাগে না।
৪) সমুদ্রের ভেতরে লুকোনো চুম্বক পাথর যেমন হঠাত জাহাজের লোহার পেরেক খুলে ফেলে, তাকে খন্ড খন্ড করে ডুবিয়ে দেয়
সেই রকম জ্ঞানচৈতন্য উদয় হলে,, অহংকার ও স্বার্থপূর্ণ জীবনকে মুহুর্তের মধ্যে খন্ড খন্ড করে ঈশ্বরের প্রেম-সাগরে ডুবে যায়।
৫) দুধে জলে একসঙ্গে রাখলে মিশে যায়,, কিন্তু, দুধকে মাখন করতে গেলে মেশে না।
ঈশ্বরকে লাভ করতে পারলে হাজার হাজার সংসারী বদ্ধজীবের সাথে থাকলেও আর বদ্ধ করতে পারে না।
৬) রাতে আকাশে কত তারা দেখা যায়, সূর্য উঠলে দেখতে পাওনা বলে কি দিনের বেলা আকাশে তারা থাকে না,,, সেইরকম অজ্ঞান অবস্থায় ঈশ্বরকে দেখতে পাওনা বলে কি বলবে ঈশ্বর নেই?
৭) জলকে যেমন কেউ পানি বলে, কেউ ওয়াটার বলে, তেমনই এক সচ্চিদানন্দকে ভিন্ন ভিন্ন দেশে,, কেউ আল্লাহ বলে, কেউ গড বলে, কেউ ব্রহ্ম বলে, কেউ হরি বলে।
৮) সিদ্ধ হলে কিরূপ অবস্থা হয়?
যেমন আলু, বেগুন সিদ্ধ হলে নরম হয়ে যায়,,, সেইরকম, মানুষ সিদ্ধ হলে নরম হয়ে যায়,, তাহার অহংকার কেটে যায় ।
৯) লাউ গাছে, কুমড়ো গাছে, যেমন আগে ফুল হয়,, তারপর ফল হয়,,, ঠিক তেমনই, মানুষ আগে সিদ্ধ হয়,, তারপর সাধনা করে।
১০) হাট হতে দূরে থাকলে,, কেবল হাটের হো হো শব্দ পাওয়া যায়,, কিন্তু হাটের ভেতরে ঢুকলে সেই শব্দ শুনতে পাওয়া যায় না। ঈশ্বর হতে দূরে থাকলে কেবল তর্ক যুক্তি মীমাংসা গোলমালের মধ্যে পড়ে থাকতে হয়,, কিন্তু তাঁর কাছে যেতে পারলে তর্ক থাকে না, তখন সবকিছুই স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারা যায়।
১১) যাহারা ধ্যানে বসলেই ভগবানের ভাবে বিভোর হয়ে যায়,, তাঁদের ধ্যান-সিদ্ধ বলে।
১২) ঈশ্বরকে অনন্ত নাম ও অনন্ত ভাবে,, যাঁর যে নামে, যেভাবে তাঁকে ডাকতে ভাল লাগে সেই নামে, সেই ভাবে ডাকলেই,, তাঁর ঈশ্বর লাভ হয়।
১৩) পানায় ঢাকা পুকুরের সামনে দাঁড়িয়ে তোমরা বলছ, পুকুরে জল নাই। যদি জল দেখতে চাও তবে পানা সরিয়ে ফেল।
মায়ার ঢাকা চোখ নিয়ে বলছ,, ঈশ্বরকে আমরা দেখতে পাই না কেন? যদি ঈশ্বরকে দেখতে চাও,, তবে মায়াকে সরিয়ে ফেল।
১৪) তর্ক কোর না। তুমি তোমার মতের ওপর যেমন নির্ভর কর,, অন্যকেও তাঁর মতের ওপর সেই রকম নির্ভর করতে দাও। মিছে তর্কে কাকেও তাঁর ভুল বোঝাতে পারবে না। ঈশ্বরের কৃপা হলেই,, সকলে আপন আপন ভুল বুঝতে পারবে।
১৫) কচ্ছপ জলে চরে বেড়ায়, কিন্তু তার মন কোথায় পড়ে আছে জান?—আড়ায় পড়ে আছে,, যেখানে তার ডিমগুলি আছে। সংসারের সব কর্ম করবে, কিন্তু ঈশ্বরে মন ফেলে রাখবে। ঈশ্বরের ভক্তিলাভ না করে যদি সংসার করতে যাও, তাহলে আরও জড়িয়ে পড়বে। বিপদ, শােক, তাপ এসবে অধৈর্য হয়ে যাবে। আর যত বিষয়-চিন্তা করবে, ততই আসক্তি বাড়বে।
১৬) চিনি আর বালি একসঙ্গে মিশিয়ে পিঁপড়ের কাছে রাখো। পিঁপড়ে ঠিক চিনি বেছে নেবে। একজন পবিত্র ও ধর্মপ্রাণ মানুষও খারাপ থেকে ভালো বেছে নেয় ।
১৭) যখন তুমি ইশ্বরের কৃপা দৃষ্টি পাবে, সেই দৃষ্টি দিয়ে সবাইকে সমান মনে হবে। তখন ভালো-মন্দ আর উঁচ- নিচুর তফাৎ মুছে যাবে।
১৮) তেল হাতে মেখে তবে কাঠাল ভাঙতে হয়। তা না হলে হাতে আঠা জড়িয়ে যায়। ঈশ্বরে ভক্তিরূপ তেল লাভ করে তবে সংসারের কাজে হাত দিতে হয়।
১৯) মলয়-বাতাস বইলে যে গাছে সার আছে,, সে গাছে চন্দন হয়,,, কিন্তু, পেপে গাছ, বাঁশ গাছ, কলা গাছে কিছু হয় না।
ভগবৎ কৃপা হলে, যাদের সার আছে, তারাই মুহুর্তের মধ্যে বদলে গিয়ে,,, ঈশ্বরের ভাবে পূর্ণ হয়।
কিন্তু,, আসার বিষয়াসক্ত মানুষের কিছু হয় না।
২০) মেঘেতে যেমন সূর্যকে ঢেকে রাখে,, মায়াতে তেমন ঈশ্বরকে ঢেকে রেখেছে। মেঘ সরে গেলেই যেমন সূর্যকে দেখা যায়,,, মায়া দূর হলে,, তেমনই ঈশ্বরকে দেখা যায়।
২১) যে সকল মানুষ উপাসনা করলে ঠাট্টা করে, ধর্ম ও ধার্মিকদের নিন্দা করে,,, সাধনার সময় একেবারে তাদের থেকে, দূরে থাকবে।
২২) সাধু মহাজনদের নিকটস্থ আত্মীয় লোকেরা অগ্রাহ্য করে,,, দূরস্থ লোকেদের নিকট তাঁদের আদর হয়। এর কারণ কি?
বাজীকরের বাজী তাদের আত্মীয়ের লোকেরা দেখে না,, দূরের লোক দেখে অবাক হয়ে যায়।
লন্ঠনের নীচে অন্ধকার থাকে,, দূরে আলো পড়ে। সেইরকম মহাপুরুষদের কাছের লোকেরা বুঝতে পারে না,,, দূরের লোকেরা তাঁদের ভাবে মুগ্ধ হয়।
২৩) সমুদ্রের জল দূর থেকে কাল দেখায়,, কিন্তু কাছে গেলে তা নয়,,, স্বচ্ছ নির্মল ।
কৃষ্ণের রূপ দূর থেকে কাল দেখায়,, কাছে গেলে, তা নয়,, স্বচ্ছ নির্মল।
২৪) সব কাজ করবে, কিন্তু মন ঈশ্বরেতে রাখবে। স্ত্রী, পুত্র, বাপ, মা সকলকে নিয়ে থাকবে ও সেবা করবে। যেন কত আপনার লােক,,, কিন্তু মনে জানবে যে, তারা তােমার কেউ নয়। বড় মানুষের বাড়ির দাসী সব কাজ কচ্ছে, কিন্তু দেশে নিজের বাড়ির দিকে মন পড়ে আছে। আবার সে মনিবের ছেলেদের আপনার ছেলের মতাে মানুষ করে। বলে ‘আমার রাম’, ‘আমার হরি’—কিন্তু মনে বেশ জানে—এরা আমার কেউ নয়। যেমন জবাব দিলে ব্যস, আর কোনাে সম্পর্ক নাই।
জন্মালে মৃত্যু হবেই। অমর হয়ে থাকতে পারব না।মৃত্যু হয়ে গেলেই আর বলতে পারব না আমি কে। আমার দেহ তখন পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। তারপর আমি হয়ে যাব ছবি। এখান থেকেই বোঝা যায়, আমাদের দেহটা পর্যন্ত আমাদের নয়। আর বাকি সব মায়া জাল। মায়া যদি কাটাতে না পারি মন থেকে, ঈশ্বরের দর্শন পাওয়া অসম্ভব।