মহান মানুষ
মহান মানুষ
ভারতবর্ষের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা সূর্য সেন। তার জন্ম ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন
১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারিতে ব্রিটিশরা তাকে ফাঁসি দেয়। কিন্তু তার আত্মত্যাগ ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সূর্য সেন চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুট করার পর একটি গ্রামে অবস্থান করেন।
কিন্তু তারই এক কর্মী নেত্র সেন বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটিশদের ঘোষিত ১০ হাজার টাকা পুরস্কারের লোভে তাকে ধরিয়ে দেন।
'রাত জেগে পড়তেন.' শীর্ষক প্রবন্ধে লেখা হয়েছে, মাস্টারদা সূর্য সেন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেও তিনি আমৃত্যু কৌমার্যব্রত পালন করেছিলেন। এর কারণ কৌমার্যব্রত পালন ছিল বিপ্লবীদের কঠোর অনুশাসন। বস্তুতপক্ষে বিয়ের সময় মাস্টারদা কিছুটা মানসিক দোলাচলের মধ্যে ছিলেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান না থাকায় মাস্টারদার উচ্চ শিক্ষার যাবতীয় খরচ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বহন করেছিলেন তার ভাবী শ্বশুরমশাই। মুর্শিদাবাদের কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বি এ পরীক্ষা দিয়ে মাস্টারদা দেশে ফিরে এলে অল্প কিছু দিনের মধ্যে আত্মীয়রা পুষ্পকুন্তলার সঙ্গে তার বিয়ের সমস্ত আয়োজন করে ফেলেছিলেন। তার আগেই মাস্টারদা দেশের স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বিপ্লবী দলে যোগদানে মনস্থির করে ফেলেন। কিন্তু ভাবী শ্বশুরের প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত এই বিয়েতে অস্বীকৃত হতে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত হন। যদিও বিয়ের রাতেই তিনি নববধূ পুষ্পকুন্তলাকে তার মনোবাসনার কথা জানান এবং পর দিনই চট্টেশ্বরী দেবীর মন্দিরে শপথ নিয়ে বিপ্লবী দলে যোগ দিয়ে সংসারত্যাগী হন।
ফাঁসির দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত মাস্টারদার উপর চট্টগ্রাম কারাগারে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ পরিবারের হাতে তুলে না দেওয়ায় এবং মৃতদেহের সত্কারের বিষয়ে ব্রিটিশ প্রশাসনের নীরবতার কারণে তার শেষ পরিণতি বিষয়ে কয়েক জন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের উপর নির্ভর করতে হয়। মাস্টারদার সহযোগী যোদ্ধা আনন্দ প্রসাদ গুপ্ত তার গ্রন্থে ('চট্টগ্রাম বিদ্রোহের নায়ক সূর্য সেন') বিবরণ দিয়েছেন ফাঁসির আগে কারাগারের কয়েক জন ব্রিটিশ পুলিশ মাস্টারদার উপর প্রচণ্ড শারীরিক নির্যাতন শুরু করে। চিত্কার শুনে পাশের কুঠুরিতে মাস্টারদার বিপ্লবী সহযোদ্ধা ফাঁসির দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত তারকেশ্বর দস্তিদার প্রবল প্রতিবাদ করলে তার উপরেও নেমে আসে নির্যাতনের কঠোর শাস্তি। মাস্টারদার প্রায় সমস্ত দাঁতই উপরে ফেলা হয়। শেষে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ফাঁসি দেওয়া হয় এই দুই মহান বিপ্লবীকে। কিন্তু তাদের মৃতদেহের পরিণতির বিষয়ে সঠিক কিছু জানা যায় না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সহ-অধ্যাপক হায়াত হুসেন মাস্টারদার ঘনিষ্ঠ কয়েক জন ব্যক্তির কাছ থেকে কিছু সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন আশির দশকে, যা তিনি বাংলাদেশে সূর্য সেন শতবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটি প্রকাশিত (১৯৯৩-৯৪) স্মারকগ্রন্থে উল্লেখ করেন। মৃত্যুর পর মাস্টারদার মৃতদেহের যে কী করুণ পরিণতি হয়, তার বর্ণনা পাওয়া যায় প্রত্যক্ষদর্শী ব্রজেন সেন ও পটিয়ার মাস্টারদার গ্রামের অধিবাসী নূর আহমেদের সাক্ষাত্কারে।
উভয়েই বলেছেন মাস্টারদার মৃতদেহ বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নূর ১৯২৮ সালে কনস্টেবল পদে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। সাক্ষাত্কারে তিনি জানান মাস্টারদার ফাঁসির দিন প্রায় পঞ্চাশ জন পুলিশ নিযুক্ত করা হয়েছিল কারাগারের ফটকের সামনে। ফাঁসির পরে একটি ট্রাকে করে সূর্য সেন ও তার বিপ্লবী সাথি তারকেশ্বর দস্তিদারের মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় চার নম্বর জেটির কাছে। সেখানে তখন একটি জলযান নিয়ে হাজির আরো কিছু সশস্ত্রবাহিনী ও অফিসারের দল। জলযানে তুলে দেহ দুইটি বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রা শুরু করলে কয়েক জন ব্রিটিশ মৃতদেহ দুইটিতে পদাঘাত করতে শুরু করে। এই অমানবিক দৃশ্যে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে ব্রিটিশরা নিবৃত্ত হয়।
দেহ দুইটিকে পৃথক ভাবে লোহার দড়ি দিয়ে বেঁধে ছুড়ে ফেলা হয় বঙ্গোপসাগরের অতলে।
হৃদয় কেঁপে ওঠে সকল বিপ্লবী মানুষদের কথা শুনলে।
✍ আত্রয়ী সরকার