চিঠি
চিঠি
রেনু চিঠির খামটা টেবিলে রেখে বেশ কিছুক্ষন জানলায় দাঁড়িয়ে থাকে। দোল পূর্ণিমার গোল চাঁদের রূপ যেনো ফেটে পড়ছে। এইরকম কত রাত রমেন আর ও ছাদে বসে জোৎস্না ভরা রাত কাটিয়েছে গল্প করে। রমেনের লোমশ বুকে হাত বোলাতে বোলাতে কখনো রেনু বলে উঠেছে "বাব্বা, কি লোম তোমার বুকে, সব ছেলের তো থাকে না"। রমেন দু হাত দিয়ে সপাটে জাপটে ধরে রানুর দু ঠোঁটে এক গভীর চুম্বন এঁকে উত্তর দিয়েছে "তুমি ক'টা পুরুষ দেখেছো, আমাকে ছাড়া, আর মেয়েরা ছেলেদের বুকের লোম থাকা পছন্দ করে এটা আমি জানি"। রেনু সাথে সাথে মুখ বেঁকিয়ে বলে উঠেছে "যে পছন্দ করে করুক আমার একটুও ভালো লাগে না"। রমেন এর উত্তর মুখে না দিয়ে, রেনুর নরম শরীরটাকে আদরে আদরে ভরিয়ে তুলতো। রেনু মুখে "অ্যাই কী হচ্ছে, ছাদে কেউ চলে আসবে" বললেও এক বিন্দুও সরে আসার চেষ্টা করতো না। সারা শরীর অবশ হয়ে যেত তার। এইসব চিন্তা করতে করতে অনেকটা সময় কেটে গেলো। ঘড়ি ঢং ঢং করে জানিয়ে দিল রাত ন'টা বাজে। রেনু আবার টেবিলের কাছে এসে চিঠিটা হাতে নিল। এই চিঠির ভেতর কি লেখা আছে সেটা না খুলেও রেনু বলে দিতে পারে অনায়াসে। রমেন এই কয়েক মাস ধরে অনবরত মুখে যা বলেছে তার একটা সারমর্ম লেখা আছে ওই চিঠিতে। রেনু তো এই সম্পর্ক শেষ করে দিতে চায় নি, না হোক তারা স্বামী স্ত্রী, টানা বছর দুই এই ফ্ল্যাটে তাদের সংসার কোনো স্বামী স্ত্রীর চেয়ে কম কিসে। এছাড়াও আর এক মাস পরেই রেজিস্ট্রেশন এর দিন ঠিক হয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা রমেন নিজেই উদ্যোগ নিয়ে সব কিছু করেছে। এমনকি রিসেপশন হল পর্যন্ত রমেন দেখিয়ে এনেছে রেনুকে। কিন্তু রমেনের মা কিছুতেই রাজি হলো না এই বিয়েতে। আসলে একমাত্র ছেলের বউ হিসাবে ঠিক রেনুকে পছন্দ হয় নি শোভার। রমেন রাজি করানোর চেষ্টা করে নি তা নয়, কিন্তু সম্ভব হয় নি। শেষে রেনুকেই বোঝাতে চেষ্টা করেছে মায়ের অমতে তাদের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা কঠিন বা বলা যেতে পারে অসম্ভব। রেনু তার ভালোবাসার মানুষটির বুকে মাথা রেখে হাউ হাউ করে কেঁদেছে কিন্তু রমেন তাকে আগের মত আর জড়িয়ে ধরে বলে নি "কাঁদছো কেনো, আমি তো আছি"। আস্তে আস্তে দুজনের সম্পর্কের গেরোটা আলগা হতে শুরু করে। রমেন সপ্তাহে একটা দিন আসে রেনুর কাছে। তার সেই উত্তাপ যেনো ক্রমশই বরফ হতে শুরু করে। এমন একদিন এলো রমেন রেনুর কাছে বিদায় চাইলো। কোনো ক্ষমা প্রার্থনা নয়, কোনো অনুশোচনা নয়, সরাসরি বলে উঠলো "আমি আর তোমার কাছে আসতে পারবো না, এই ফ্ল্যাট সামনের মাসে ছেড়ে দিও, আমার বিয়েও ঠিক হয়েছে সামনের মাসেই, তোমাকে চিঠিতে বাকি কথা জানাবো"। রেনুর মুখে শুকনো হাসি খেলে গেলো "তুমি মুখে না বললেও আমি জানি, তাই চিঠিতে জানানোর দরকার নেই"। রমেনের দৃষ্টি ছুঁয়ে গেলো রেনুর মুখ, বললো "তোমাকে আমার কিছু বলার আছে, সেটা চিঠিতে জানাবো"। রেণুর ফ্যাকাসে দৃষ্টি স্থির হয়ে থাকে রমেনের যাওয়ার পথে। প্রায় দিন কুড়ির মধ্যেই এসে গেলো সেই না বলা কথা লেখা চিঠি। রেনু চিঠিটা খুলে চিয়ারে বসে। একটা সাদা কাগজের প্রথমে কোনো সম্বোধন ছাড়াই চিঠি শুরু। লেখা "আমি তোমার থেকে ছুটি চেয়েছিলাম অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করে সুখে সংসার করার জন্য নয়, ছুটি নিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি দেওয়ার জন্য। বিশ্বাস করো বাড়ির সাথে যুদ্ধ করে যখন খান্ত, তখনই এই সিদ্ধান্ত নেই, তোমাকে ছাড়া যেমন আমি অপূর্ণ, তেমন আমার মাও আমার কাছে বাঁচার রসদ। তোমাদের একজন কাউকে ছেড়ে আমার বেঁচে থাকাটা মূল্যহীন। তোমাকে একটা স্বপ্নের সংসার উপহার দিতে পারলাম না, ক্ষমা কোরো।" চিঠিটা হাতে নিয়ে পাথরের মূর্তির মত বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকে রেনু। দু চোখ বেয়ে অশ্রুর ফোঁটা পড়ে হতে ধরা চিঠির ওপর। রেনু চিঠিটা বুকের মধ্যে চেপে ধরে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে "আমি ভুল বুঝেছিলাম, ক্ষমা কোরো রমেন"।
