চিত্রকেতু কথা - ড. রীতা দে
চিত্রকেতু কথা - ড. রীতা দে
সমুদ্র আর ঢেউ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর ঢেউয়ের সঙ্গে বালি।ঢেউ আসে যায় । ঢেউয়ের সঙ্গে বালি আসে যায় ।তরঙ্গের বেগে বালি ভেসে যায় ।পুনর্বার মেশে তরঙ্গের সংযোগে।তেমনই কালের খেয়ালে জন্ম মৃত্যু ঘুরে ফিরে আসে ।জন্মালে মরতে হবে, মরলে জন্মাতে হবে।কালের নিয়ম। রাজা চিত্রকেতু শোকে মুহ্যমান । তার একমাত্র ছেলের মৃত্যু হয়েছে ।
শূরসেন দেশে চিত্রকেতু নামে এক রাজা ছিলেন ।তার সহস্র ভার্য্যা। কিন্তু তাঁর একটাও সন্তান নেই।তিনি নিজেকে ধিক্কার দেন।তাঁর মনে হাজার প্রশ্ন- কে তার রাজ্য রক্ষা করবে?
বংশের মুখ রক্ষা করবে কে ?প্রজাদের তিনি ভালোভাবেই দেখাশোনা করেন।কিন্তু তাঁর নিজের মনে সুখ নেই ।একদিন ব্রহ্মার নন্দন অঙ্গিরা চিত্রকেতুর ভবনে এসে হাজির ।চিত্রকেতু পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে মুনির চরণ পূজো করলেন।কিন্তু রাজার মুখ বিষণ্ণ ।অঙ্গিরা মুনি তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে চিত্রকেতু বললেন যে, যে ক্ষুধার্ত তাকে যদি মালাচন্দন দেওয়া হয় তাহলে সে কি তুষ্ট হয়? তেমনি তার সহস্র স্ত্রী থাকলেও তার কোনো সন্তান নেই ।অঙ্গিরা মুনি তখন রাজাকে বললেন যে তিনি চরুপাক দিচ্ছেন যা রাজার প্রধান মহিষী কৃতদ্যুতিকে পান করতে হবে। চরুপাক পান করলে কৃতদ্যুতির সন্তান হয় ।রাজার আনন্দ আর ধরে না ।সারা রাজ্য আনন্দ উৎসবে মেতে উঠলো ।প্রধানা মহিষীর মান বেড়ে গেল ।অন্যান্য স্ত্রীরা প্রধানা মহিষীর দাসী হয়ে কাজ করতে লাগল ।প্রধানা মহিষীর মান সম্মান দেখে তারা হিংসায় জ্বলে পুড়ে গেল।তারা সকলে মিলে মন্ত্রণা করলো যে প্রধানা মহিষীর ছেলেকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলা হবে ।দুধের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে তারা কৃতদ্যুতির সন্তানকে খাইয়ে দিল। ছেলে মারা গেল। প্রধানা মহিষী কৃতদ্যুতি এসব জানে না।সে ধাত্রীকে ছেলেকে তার কাছে দিতে বলল।ধাত্রী ঘরে গিয়ে দেখল ছেলে বিছানায় মরে পড়ে আছে ।কৃতদ্যুতিকে এই সংবাদ দিতেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে । এই সংবাদ পেয়ে রাজাও অচেতন হয়ে পড়লেন।পুত্র শোকানলে দুজনেই অচেতন।এমন সময়ে নারদ ঋষি এবং অঙ্গিরা ছদ্নবেশে সেখানে উপস্থিত হলেন ।রাজা ও রানীর জ্ঞান ফিরে এলে তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন- শোক ত্যাগ করো।তোমরা শোক করছো কেন? কে তোমার মারা গেছে? তোমরা যাকে পুত্র বলে জেনেছো তাকে কি আগে কখনও দেখেছো না পরে তাকে দেখতে পাবে।এই ত্রিলোকে পিতা-পুত্র, পুত্র পিতা কেমন জানো -
'বালি যথা ভেসে যায় তরঙ্গের বেগে
পুনর্বার মেশে আসি তরঙ্গের সংযোগে।।
তার ন্যায় কালবশে জনম মরণ
মরণে জনম পুনঃ জনমে মরণ।'
এই দেহ পূর্বেতে ছিল না পরেও থাকবে না
কিছুকালেরজন্য কেবল পিতা-পুত্রের কল্পনা । রাজা ও রানী শোক ত্যাগ করে জানতে পারলো এঁরা অবধূত হয়ে এসেছেন ।জ্ঞানের আলোয় অন্ধকার দূর করার জন্য এসেছেন।মোহ অন্ধকার নাশ করার জন্যে এসেছেন ।তখন তাঁরা বললেন যে তিনি অঙ্গিরা আর উনি নারদ।রাজা ,তুমি হরি পরায়ন ।মায়ার বশবর্তী হয়ে শোক করছো।দারা পুত্র সব মিথ্যে ।আর যত স্নেহ ততই শোক।এই সংসার স্বপ্নের মত।কেবল শ্রীহরির চরণ-পদ্ম জীবনের সার।এখন থেকে হরির পদ চিন্তাই করো।
এরপর নারদ ঋষি রাজপুত্রের প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন ।
রাজপুত্র এমনভাবে জেগে উঠলো যেন সে এতক্ষণ টানা ঘুমিয়ে ছিল ।