জননী সন্নিধানে কপিলের সাংখ্যযোগ বর্ণন - ড. রীতা দে
জননী সন্নিধানে কপিলের সাংখ্যযোগ বর্ণন - ড. রীতা দে
মা ও ছেলে গল্প করছে।মা দেবহূতি আর ছেলে কপিল । বাবা কর্দম মুনি কানন-মাঝারে গেছেন।এই অবসরে মা ও ছেলের মধ্যে কথা হচ্ছে ।গল্পের মধ্যে সাধারণ গল্প অর্থাৎ বন্ধুদের সঙ্গে সব দেখা হয়েছে তো? সবাই ভালো আছে তো? -এসবের প্রশ্ন নেই। বরঞ্চ মায়া কি ? আমি কে? আমিত্ব বোধ কোথা থেকে আসে- এই সব নিয়ে ছেলে ও মায়ের মধ্যে কথা হচ্ছে ।মায়ের ছেলের প্রতি অগাধ ভক্তি। সাধারণতঃ বলতে শোনা যায় মায়ের প্রতি ছেলের যা ভক্তি তা ভাবাই যায় না। এখানে আবার ছেলের প্রতি মায়ের অগাধ ভক্তি ।কারণ ছেলে হচ্ছে পুত্ররূপী জনার্দ্দন।তার অগাধ জ্ঞান, সে বেদপ্রতিপাদ্য।মা ভালোভাবেই জানেন যে অজ্ঞান তিমির নাশ করার জন্যেই সংসারে অবতাররূপে ছেলের জন্ম হয়েছে ।জগৎ তার জ্ঞানের আলোকেই উদ্ভাসিত হবে।মা ছেলেকে বলছে ছেলে যেন তাকে কৃপা করে।বাছাধন তাকে যেন মুক্তির উপায়- এর সন্ধান দেয়।ছেলে যেন তাকে সবকিছু এমনভাবে বুঝিয়ে দেয় যাতে জ্ঞান খড়্গ দিয়ে মায়ার বাঁধন ছিন্ন করতে পারে।মায়ের আরও প্রশ্ন সাংখ্যযোগ কি, ভক্তিযোগ কি, পুরুষ ও প্রকৃতি ভেদ কি ? ছেলে হেসে ফেলে । বল, তোমার কত কত প্রশ্ন । আরও বলে, তোমার মনটাই জ্ঞানতত্ত্বের দিকে চলে গেছে ।তোমার মনে এই প্রশ্নগুলো জেগেছে মানেই তুমি মায়ার বাঁধন কাটার জন্য উন্মুখ হয়ে আছ।তোমার অধীর আগ্রহ দেখে আমিই অবাক হয়ে যাচ্ছি ।আর হবে নাই বা কেন, তুমি যে আমারই মা । শুনবেই যখন তাহলে শোনো , দুটো কথা আগে বলে নিই । এক) স্থূল আর সূক্ষ্ম দেহে যার অভিমান অর্থাৎ আমি বুদ্ধি আছে,
দুই) নির্গুণ ব্রহ্মে নিষ্ঠালাভ করা দেহাভিমানী ব্যক্তির পক্ষে অতিশয় কষ্টকর ।
যোগ মানে সাধনার কৌশল।যোগবিত্তম মানে হচ্ছে সেই লোক সাধনায় যে সহজ পথটা নিতে পেরেছে ।
" কপিল মুনি বললেন, মা আচ্ছা তুমি বলোতো তুমি ভোর হলে কাঁখে কলশি নিয়ে যখন নদীতে জল আনতে যাও তখন তুমি কী নদীতে তোমার মুখখানা দেখেছ? দেখবে ঢেউয়ে ঢেউয়ে তোমার একটাই মূর্তি কত ছোট ছোট প্রতিমূর্তিতে ভেঙ্গে যায় ।কো
নো ঢেউটায় দেখবে তোমার মুখটা লম্বা, আরেকটা ঢেউয়ে দেখবে তোমার মুখটা চ্যাপ্টা হয়ে গেছে ।শুধু কি তাই ঢেউ গড়ছে আর ভাঙ্গছে ।মনে করো ঢেউয়ে প্রতিফলিত তোমার মূর্তিগুলো সবাই জ্যান্ত হয়ে উঠলো, তাহলে যেই একটা ঢেউ ভেঙ্গে গেল একটা প্রতিচ্ছবি মরে গেল।তার জন্য কী তুমি হাউ হাউ করে কাঁদবে? আসলে মানুষ নদী , গাছ -পালা এমনকি প্রতিটি ধূলোকনা যাকে তুমি দেখতে পাচ্ছ না সেও চিরকাল ছিল- আছে-থাকবে।সে কোন সময়ে বাঁধা নয়। সে কোন দেশের বাসিন্দা নয়।তার কোন অভাব নেই ।তার কোন ইচ্ছে নেই ।এরা সবাই পুরুষ, এদের গণনা কেউ করতে পারে না ।এরা জড় প্রকৃতির উপরে নিজেদের মুখের ছবি যখন দেখে , তখন ভাবে আমরা আসলে ছবি।প্রকৃতি নদীর মতো ।তো সে সব সময় ছুটছে তার ঢেউ গড়ছে আর ভাঙছে।আর সঙ্গে সঙ্গে ফুলের ছবি, পাখির ছবি, হাতির ছবি , মানুষের ছবি জন্মাচ্ছে আর মরছে, কাছে আসছে আবার দূরে সরে যাচ্ছে ।প্রকৃতিই বলো, আরশিই বলো আর নদীই বলোতার ওপরে আমরা যখন আমাদের মুখ দেখি আর ভাবি আরে ঐ মুখটাই তো আমি , তখনই অহঙ্কারের জন্ম হয় । তার আগে তো আমি জানতাম না যে আমি আছি।আমার প্রতিচ্ছবি দেখে যেই ভাবলাম ওটা আমি , তখনই আমার আমা জ্ঞান বা অহংকার এল।আর এই অহংকার থেকে একে একে বুদ্ধি,মন,চিত্ত, শরীরের পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় - চোখ,কান, নাক ,মুখ, ত্বক তৈরি হল। কারণ আমার অহংকার থেকে আমি ঐ নদী ঐ প্রকৃতিকে জানতে চাই যে, আর জ্ঞান এলে জ্ঞান তো নিষ্ক্রিয় থাকে না, তাই কাজ দরকার হয় ।সেই জন্য শরীরের পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়ের উৎপত্তি হল - হাত, পা, মুখ এই সব।আমার চোখ আছে চোখ না দেখে পারে না, তাই দেখার উপকরণ আলো তৈরি হল, আমার কান আছে সে শব্দ না শুনে পারে না , তাই শব্দের মাধ্যম আকাশ তৈরি হল। এইভাবে ক্ষিতি,অপ্, তেজস, মরুৎ,ব্যোম এই পঞ্চভূত নিয়ে আমাদের পৃথিবী আমাদের জগৎ।পঞ্চভূত সূক্ষ্ম অবস্থায় পঞ্চতন্মাত্র ছিল।তারা হল শব্দ, স্পর্শ, ঘ্রাণ, রূপ আর রস।শব্দের প্রয়োজনেই আকাশ আর কান। রূপের প্রয়োজনেই আলো আর চোখ।" ( পুরাণের গল্প, সগর রাজার উপাখ্যান, পাতা ,একষট্টি, ড. রমেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়) ।
ছেলে কপিল মা দেবহূতিকে এই উপদেশ দিয়ে কুটীর ছেড়ে বনের পথ ধরে তপস্যা করতে কোথায় চলে গেলেন ।