Rita De

Abstract Others

3  

Rita De

Abstract Others

ধ্রুব উপাখ্যান- ড .রীতা দে

ধ্রুব উপাখ্যান- ড .রীতা দে

5 mins
1.0K



     তুলো ভারী না পাথর ভারী ? অবশ্যই পাথর ভারী।তুলো খুব সহজেই বয়ে নিয়ে যাওয়া যায় কিন্তু পাথর বইতে গেলে বেশ কষ্ট হয় ।এখানে ভারী বস্তু আর হাল্কা বস্তুর কথা।স্থূল মানে ভারী , মোটা আর সূক্ষ্ম মানে হাল্কা, পাতলা।স্থূল আর হাল্কা বস্তুর কথা যখন এসেই পড়লো তখন আমরা এই দেহটার কথা বলি। দেহটা হচ্ছে স্থূল আর দেহের মধ্যে যে জীবাত্মা আছে তা সূক্ষ্ম আর তারও ভেতরে যে পরমাত্মা আরও সূক্ষ্ম ।

      এখানে পাঁচ বছরের ধ্রুব তার স্থূল শরীরে চলেছে হরির খোঁজে, পরমাত্মার খোঁজে। ধ্রুব রাজার ছেলে । কিছু দুয়োরানির ছেলে ।

   রাজা উত্তানপাদের দুই রানী - সুরুচি আর সুনীতি। রাজা দুজনকেই ভালবাসেন।কিন্তু সুরুচিকে একটু বেশী ।সুরুচি একদিন রাজাকে বলে যে সে সুনীতির সঙ্গে থাকতে পারবে না ।সুনীতিকে নির্বাসন দিতে হবে ।যদি রাজা তা না করেন তো সুরুচি রাজাকে ছেড়ে চলে যাবে। রাজা সুরুচি রানীর কথা ফেলতে পারলেন না।

সুরুচির অভিমানকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সুনীতিকে নির্বাসন দিলেন। সুনীতিকে তাঁরই রাজ্যের প্রান্তসীমায় এক পর্ণকুটিরে থাকতে দিলেন।সুনীতি ত্যাগের মধ্যে দিয়ে প্রকৃতপক্ষে   তিনি নীতি থেকে চ্যুত হলেন। সুনীতি নামের মধ্যেই তা নিহিত আছে।আর সুরুচি রাজার রুচি, নীতি নয়।

    এদিকে দিন যায় মাস যায় বছর যায় সুনীতির দুর্দশার আর শেষ নেই ।বসন মাত্র একটা, খাওয়া বলতে বনের ফলমূল। সুনীতি মনে মনে আক্ষেপ করেন যে পদ্মপলাশলোচন-কে ঠিকমতো স্মরণ না করার ফলে তার এত দুর্দশা ।

এদিকে একদিন দৈবক্রমে রাজা উত্তানপাদ পথভুলে সুনীতির পর্ণকুটিরে উপস্থিত হন। রাজা সুনীতিকে চিনতে পারেন।সুনীতির দুঃখে রাজা কাতর হলেও তাঁর কিচ্ছু করার নেই।কারণ সুরুচির কাছে কথা দেওয়া আছে।সুনীতিকে রাজগৃহে আনা যাবে না ।সেই রাতে তিনি সুনীতির পর্ণকুটিরে কাটিয়ে পরের দিন সকালে তিনি রাজপ্রাসাদে ফিরে যান।এরপরই ধ্রুবর জন্ম হয় । ধ্রুব পর্ণকুটিরেই থাকে। কিন্তু রাজা উত্তানপাদ সেখানে না থাকায় ধ্রুব নিজের

বাবাকে চেনে না । পর্নকুটিরের আশেপাশে থাকা শিশুদের সঙ্গে সে খেলতে থাকে। একদিন খেলতে খেলতেই শিশুরা ধ্রুবকে জিজ্ঞেস করলো যে ধ্রুবর বাবা কে ? ধ্রুব উত্তর দেয় যে মা তাকে বলেছেন এই রাজ্যের রাজা তার বাবা।

তখন বন্ধুরা মিলে রাজা উত্তানপাদের প্রাসাদে আসে।রাজা উত্তানপাদ ধ্রুবকে চিনতে পেরে কোলে নিতে গেলে রানী সুরুচির নির্দেশে ধ্রুবকে কোলে নিতে পারেন না ।ধ্রুবর খুব অভিমান হয়।সে কাঁদতে কাঁদতে বন্ধুদের সঙ্গে ফিরে আসে মায়ের কাছে।ক্রন্দনরত ধ্রুবকে কোলে তুলে নিয়ে মা তার কান্নার কারণ জানতে চাইলে বন্ধুরা সবিস্তারে ঘটনার বিবরণ দেয়। সব শুনে মা বলেন- সবই তাদের ভাগ্যের দোষ। একমাত্র 'পদ্মপলাশলোচন' ই তাদের দুঃখ দূর করতে পারে।ধ্রুব যেই একবার পদ্মপলাশলোচনের নাম শুনেছে আর জেনেছে তিনি মধুবনে থাকেন তখন কালবিলম্ব না করে পদ্মপলাশলোচনের খোঁজে বেরিয়ে পড়লো।

 পাঁচ বছরের শিশু ।পদ্মপলাশলোচন ছাড়া তার মাথায় মনে আর কিছুই নেই ।কিন্তু কোথায় পাবে তাকে ? গভীর বন, সূর্যের আলো ঢোকে না বললেই চলে।পদ্মপলাশলোচন মধুবনে বাস করেন ।ধ্রুব পদ্মপলাশলোচনের নাম অর্থাৎ হরিনাম করেই চলেছে।সেই হরিনাম শুনে বাঘ সিংহ হিংস্র জন্তু জানোয়ার তাকে আক্রমণ করা দূরে থাক তারা তাদের হিংসা ভুলে তাকে সঙ্গ দিতে লাগল।কি মধুর স্বর ! হরিনাম অহিংসা প্রচার করে সে পশুকূলে হোক আর মনুষ্যকূলে হোক।হরি চঞ্চল হয়ে পড়লেন।তাঁর নাম যেই নেয় তিনিই তার ভক্ত হয়ে যান।লক্ষ্মীদেবীও না থাকতে পেরে বিষ্ণুর কাছে আবেদন করেন যে তিনি ধ্রুবকে কোলে তুলে নিয়ে বৈকুন্ঠে আনবে।বিষ্ণু বললেন যে ধ্রুবকে বৈকুন্ঠে আনা যাবে না।কারণ তার দীক্ষা হয় নি ।দেবর্ষি নারদকে পাঠালেন ধ্রুবকে দীক্ষা দেওয়ার জন্যে । নারদ ধ্রুবর সামনে উপস্থিত হল। নারদকে দেখে ধ্রুব মনে করলো - ইনিই পদ্মপলাশলোচন। নারদ অবাক হল ধ্রুবর হরিভক্তি দেখে। এটুকু বাচ্চা কি হরিপ্রেম ! সে জানেই না কে হরি ।নারদ ধ্রুবর ভুল ভাঙ্গিয়ে দিলেন। না, আমি হরি না। 

তখন নারদ শ্রীহরির বর্ণনা দেন- 'কটিতটে পীতাম্বর আছে পরিধান ... /শিখিপুচ্ছ -চূড়া শিরে অতীব সুন্দর ... শঙ্খ- চক্র-গদা-পদ্ম করে শোভা পায়'। নারদ শ্রীহরির যা বর্ণনা দিলেন তার অধিক ধ্রুব অন্তরে দর্শন কর শ্রীহরির রূপ- " ধ্বজ- বজ্রাঙ্কুশচিহ্ন শোভিছে চরণে/ শ্রবনে শোভিছে কিবা মকর-কুণ্ডল/ হেরিয়া অন্তর মম হতেছে শীতল ।।"

ধ্রুব বলল - তাহলে তুমি মধুবনে বাস করছো কেন? মা বলেছেন- মধুবনে পদ্মপলাশলোচন বাস করেন। 'না বাছা না।আমি দেবর্ষি নারদ ।আমি তোমায় কৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষা দেব যাতে তুমি হরির দর্শন পাও। ' ধ্রুবকে কৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষা দেয়।


ধ্রুব মাসের পর মাস উপবাসে থেকেও কৃষ্ণের দেখা না পেয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে একপদে ঊর্দ্ধবাহু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ।দেবতাদের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার দাখিল ।তাঁরা ধ্রুবর সাধনা ভাঙ্গার জন্য নানাভাবে ধ্রুবকে ভয় দেখাতে থাকলেন।বাঘের গর্জন সিংহের গর্জন শোনাতে লাগল ।এমনকি তার কানে এই কথাও বলে যে তার মা পর্ণকুটিরে মারা গেছে ।তাতেও তাকে তারা টলাতে পারেনি । তখন শচীপতির নির্দেশে মেনকা আর উর্ব্বশী ধ্রুবর তপস্যা ভাঙ্গার জন্যে ধ্রুব- র কাছে আসে-'ঠমকে ঠমকে দোঁহে করয়ে গমন/ চলিল চপলা যেন চৌদিক ব্যাপিয়া ' ।তারা দুজনে ধ্রুব- র সামনে নৃত্য করতে লাগল ।


কিছুক্ষণ পর তাদের মনে হল যে তারা কার সামনে নাচছে! এক দুগ্ধপোষ্য পাঁচ বছরের শিশুর সামনে! যার নরনারী জ্ঞানই নেই। 'রয়েছে ধ্রুবের হৃদে নিজেই শ্রীহরি/ মোরা কি করিব হায় মোরা হই নারী ।।' উল্টে তারাই ধ্রুবর হরিনাম শুনে পাল্টে গেল।তাদের লাস্যময়ী ভাব আর রইল না।তারা বলল যে তাদের যদি কিছুমাত্র পুন্য থাকে তো তা তারা ধ্রুবকে দিল।আর তুমি যে গদাধরকে খুঁজছো তাকে যেন শীঘ্রই পেয়ে যাও।আমরা তোমার মা জননী ।

হরিনাম- এর কি গুণ। বাঘ সিংহ সাপ হিংসে ভুলে গেল।মেনকা ঊর্ব্বশী মা জননীর রূপ নিতে চাইল।


তখন দেবতারা সব ভয় পেয়ে গেল ।ধ্রুব যেহেতু শ্বাস রোধ করে আছে সেহেতু তাদের শ্বাস রুদ্ধ হতে লাগল।উদর স্ফীত হতে লাগল। তখন ইন্দ্র দেবাদিগণ আলোচনা করে ঠিক করলেন - ধ্রুবকে কোলে করে তুলে নিয়ে আসতে হবে অথবা জলের ভেতর ডুবিয়ে দিতে হবে। এই কথায় সবাই সম্মত হলেন । তখন বলিষ্ঠ দেবগন ধ্রুবকে মাটি থেকে প্রচুর চেষ্টা করলেন কিন্তু ব্যর্থ হলেন। অবশেষে ইন্দ্র নিজে গেলেন ধ্রুবকে কোলে তুলতে কিন্তু পারলেন না । তখন ইন্দ্রের কথায় সকলে একসঙ্গে মিলে ধ্রুবকে তুলে আনতে চেষ্টা করবেন কিন্তু ব্যর্থ হলেন।

দেবতাগণ আশ্চর্য হলেন - পঞ্চমবর্ষীয় শিশুর দেহে এত ভার কিসের? 

তখন সুত বললেন - 

" পঞ্চমবর্ষীয় বটে ধ্রুব মতিমান।

 কেন এত ভার হয় শুন হে সন্ধান ।।

 এই বসুমতী হয় এক ব্রহ্ম-অণ্ড ।

 যাঁর রোমকূপে রহে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড ।।

 সেই কৃষ্ণ বিরাজিত ধ্রুবহৃদি'পরে।

 এই হেতু দেবগণ তুলিতে না পারে ।।"

 যে আত্মা , যে পরমাত্মা গোটা ব্রহ্মাণ্ডকে ধরে আছে সে ইচ্ছে করলে এত ভারী হয়ে যায় যে তাকে তোলাই যায় না ।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract