চৌধুরী ভিলার সেই রাত
চৌধুরী ভিলার সেই রাত
হুন হুনা, হুন হুনা, হুন হুনা রে হুন হুনা..... ছয়টা কালো কুচকুচে তৈলাক্ত দেহ এক সুরে গলা মিলিয়ে ছুটে চলেছে। ওদের শরীরের বাঁধাধরা ছন্দে অল্প অল্প দুলছে কাঠের পালকি, দরজার ফাঁকে রেশম সুতোর কাজ করা ঝালর উড়ছে বাতাসে। পর্দার আড়ালে দেখা যাচ্ছে ভেতরে অবগুন্ঠনবতী এক সদ্য যুবতী। তার কৌতূহলী চোখও রেশম পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখে নিতে চাইছে বাইরের দৃশ্য। পালকী চলেছে মাঠ ঘাট বন বাদার পেরিয়ে দক্ষিণের পথে, গন্তব্য কালীঘাট। পালকির সামনে সাদা ঘোড়ায় চেপে গিলা করা ধাক্কা পার ধুতি আর রেশমের পাঞ্জাবি পরিহিত যে পুরুষ সে এই নারীর স্বামী। সামনেই দেখা যাচ্ছে স্বচ্ছ তোয়া আদি গঙ্গা। পুরুষের নির্দেশে পালকি শুদ্ধু বধূকে চুবিয়ে দেওয়া হল মাঝ নদীতে।
মুহূর্তের জন্য দম বন্ধ হয়ে এসেছিল কৌশানীর। জামাকাপড় ভিজে একসা, লাফ দিয়ে উঠে বসে বিছানায়। ঘেমে স্নান করে উঠেছে সে। এই নিয়ে আজ তৃতীয়বার দেখল ও স্বপ্নটা, এখনো জোরে শ্বাস টানছে সে। মনে হচ্ছে নাকে কানে জল ঢুকে গেছে। কাশির দমকে ফুলে ফুলে উঠছে শরীর। জল খেয়ে একটু ধাতস্থ হয় কৌশানী। পাশের খাটে ইলা ঘুমিয়ে কাঁদা। ও উঠে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, বাতাসে হেমন্তের ছোঁওয়া। সামনের চক্ররেলের স্টেশন ছাড়িয়ে চোখ চলে যায় ওপারে, কয়েকটা ভাঙাচোরা গুদাম ঘর পার করেই গঙ্গা। যদিও দেখা যায় না পরিষ্কার, কিন্তু ভেজা হাওয়া নদীর গন্ধ বয়ে আসে।
কৌশানীরা তিন মাস হল এই বাড়িটায় ভাড়া এসেছে। গঙ্গার ধারে একটা পুরানো বাড়ি ভেঙ্গে ফ্ল্যাট হয়েছে নতুন। কৌশানী ইংরেজি নিয়ে পড়ছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাড়িটা বাবার বন্ধুর। কৌশানী আর ওর বান্ধবী ইলা এখানে থাকছে পড়ার জন্য। দুজনের বাড়িই শিলিগুড়ি।
কলেজ যাওয়ার পথে একটা মোর ঘুরেই রোজ এই জরাজীর্ণ বাড়িটার সামনে থমকে দাঁড়ায় কৌশানী। ভাঙা শ্বেতপাথরের ফলকে চৌধুরী ভিলা নামটা ঝাপসা হয়ে এসেছে। তিন মহলা বাড়িটায় আজ আর কেউ থাকে না।বিসাল বড় বড় থাম তিন তলার ছাদ কে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে কত কাল! দেওয়াল ভেদ করে মাথা তুলেছে বট অশ্বত্থ গাছ। শৌখিন ঝুল বারান্দা ভেঙ্গে পড়ছে। রঙিন কাচের জানালা গুলো একটাও আস্ত নেই। উপর দিকের কোনো কোনো অংশেড় কারুকার্য এখনো যেন বলছে একসময় এই বাড়িটি যথেষ্ট সুন্দর ছিল। বাড়ির সদর দরজা ভেঙ্গে পড়েছে বহুকাল আগেই। নিচের টানা বারান্দার কোনে এক পাগলি সংসার পেতেছে। তার পাশেই দুটো ঠেলা আর একটা হাতে টানা রিক্সা রাখা থাকে। দেওয়ালের এক কোনে ঝুলছে সরকারী নোটিশ, সতর্কী করণ, বিপজ্জনক বাড়ি, ভেঙ্গে পড়তে পারে।
কলেজ যাতায়াতের পথে রোজ কৌশানী অবাক হয়ে দেখে বাড়িটা। উত্তর কোলকাতায় আহিরিটোলার কাছে এমন পুরানো অট্টালিকা বেশ কয়েকটি আছে। কিন্তু তবু কৌশানীকে কে যেন দাঁড় করিয়ে দেয় ঠিক এই চৌধুরী ভিলার সামনে। বাড়িটার ভেতর থেকে ও চাপা দীর্ঘশ্বাস শুনতে পায়। খুব ইচ্ছা করে একবার মাকড়শার ঝাল সরিয়ে ঢুকে দেখতে বাড়ির ভেতরটা। কিন্তু একদিন ঢুকতে যেতেই দুটো কুলি বাধা দিয়েছিল। বাড়িটা নাকি ভূতের বাড়ি, সাপ খোপের আস্তানা।
ইলা বলেছিল -''আসেপাশের সব পুরানো বাড়ির নিচে দেখ দোকান , গুদাম, অফিস এসব রয়েছে। অথচ এই বাড়িটায় কুকুর ও ঢোকে না। কি দরকার তোর এ সবে ঢুকে। ''
কিন্তু কি এক অদম্য আকর্ষণ কৌশানীকে বারবার টানে ঐ লাল বাড়িটার দিকে। মনে হই ঐ ভাঙ্গা জানালার পাশে কেউ দাঁড়িয়ে ওকে ডাকছে, ঐ ছাদে কেউ লুকিয়ে ওকে দেখছে!
সেদিন আকাশ ভার হয়েছিল বিকেল থেকেই, এস জের কাছে প্রাইভেট পড়ে মেট্রোয় বাড়ি ফিরছিল কৌশানী। ট্রেনের গণ্ডগোলে বেশ রাত হয়ে গেছিল। ট্রাম লাইন পেরিয়ে আহিরিটোলায় ঢুকতেই ঝুপ করে লাইট অফ হয়ে গেল। সামনেই বোধহয় অমাবস্যা, মেঘে ঢাকা আকাশ, ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত, থমকে দাঁড়িয়েছিল কৌশানী। হঠাৎ বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি নামতেই ও মাথা বাচাতে ছুটে যায় সামনের বাড়িটার বারান্দায়। পথে আজ কুকুর বিড়াল পর্যন্ত নেই। মোবাইলে দেখে রাত দশটা বেজে গেছে। সামনের মোড়টা পার হয়ে পাঁচ মিনিট হাঁটলে ওর বাড়ি। কিন্তু এই অন্ধকারে বৃষ্টিতে ভিজে ও ফিরবে কি করে। ইলা গেছে গড়িয়ায়, মামা বাড়িতে। ফিরবে না সেদিন। হঠাৎ করে বিদ্যুতের চমকে ও তাকিয়ে দেখে ও এসে দাঁড়িয়েছে সেই চৌধুরী বাড়ির পেছনের বারান্দায়। এদিকটা এখনো একটি শক্ত পোক্ত। সামনেই একটা এক পাল্লার দরজা। পুরানো বাড়িতে এগুলোকে খিড়কির দোর বলত। কৌশানী হাত দিয়ে চাপ দিতেই ক্যাঁচ করে মৃদু শব্দ তুলে খুলে যায় দরজাটা। ভেতরে ঢাকা বারান্দা। আরেকবার বিদ্যুৎ চমকাতেই বাড়ির ভেতরের অংশ স্পষ্ট হয়ে উঠল। উঠোনের এক ধারে কলঘর। ওধারের বারান্দার মাঝে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। টুপটাপ জল ঝরছে ভাঙা ছাদের ফাটল চুইয়ে। কে যেন হাতছানি দিচ্ছে কৌশানীকে। ভীষণ ইচ্ছা করছে বাড়িটা একবার ঘুরে দেখতে। অবশেষে ইচ্ছে ডানায় ভর করে কৌশানী উঠে আসে দোতলায়। বাড়িটা পরিত্যক্ত হলেও ভেতরের ঘরের দরজা গুলো অটুট। একটা ছোট লাঠি কুড়িয়ে ঝুল সরিয়ে কৌশানী এগিয়ে যায় উপরে। সারসার ঘর পেরিয়ে একটা বড় দরজায় সামনে দাঁড়ায়। এটা বোধহয় বৈঠকখানা ঘর, ভাঙা জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে হেলে পড়া ঝাড়বাতি, ছেড়া সোফা, দেওয়ালে কিছু পেন্টিং। বৃষ্টি কমে গেছে, মেঘের ফাঁকে আধ ফালি চাঁদ, দু একটা তারা জ্বলে উঠেছে। এক মায়াময় বিষণ্ণ আলো বাড়িটা জুরে। কৌশানীর মনটা হুঁহুঁ করে ওঠে হঠাৎ। এই বাড়িটা বড্ড চেনা মনে হয়।পশ্চিম কোনের ঐ বন্ধ ঘরটা ওকে ডাকছে ভীষণ ভাবে। কৌশানী পা আর ওর দখলে নেই। এক ঘোরের মধ্যে ও চলেছে। এটা লাইব্রেরী ঘর, সার সার পুরানো বই...আলমারিগুলো যেন ওর চেনা। ঐ কোনের আলমারিতে রয়েছে রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর, বঙ্কিম চন্দ্র সহ বেশ কিছু বই। তবে বেশির ভাগ ইংরেজি সাহিত্যর বই।
অন্ধকার ফিকে হয়ে আসে। মৃদু পায়ের আওয়াজে চট করে একটা বড় থামের আড়ালে চলে যায় কৌশানী। একটা অল্পবয়সী বৌ, পরনে ধনে খালি তাঁত, গায়ে গহনা এসে ঢোকে ঐ ঘরে।এ আবার কে? তখনি আলমারির ঐ পাশ থেকে এসে দাঁড়ায় এক সদ্য যুবক।
যুবক বলে -''বৌমনি, আমার বইগুলো ?''
বৌটি মৃদু হেসে একটা আলমারি খোলে, বঙ্কিম রচনা সমগ্ৰর পিছন থেকে বের করে আনে কয়েকটা কাগজে মোরা নিষিদ্ধ বই যাতে রয়েছে ইংরেজদের অত্যাচারের কথা। যুবকের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বইগুলো নিয়ে চলে যাচ্ছিল। বৌটি ডাকে -''ছোট ঠাকুরপো দাঁড়াও। ''
যুবক ঘুরে দাঁড়ায়। বৌটি নিজের গলার বড় হারটা খুলে দেয়। বলে -''টাকার জোগাড় করতে পারিনি ভাই, এটা রাখো তুমি। ''
-''বৌমনি!!'' যুবকের গলায় বিস্ময়।
-''তোমরা দেশের জন্য যা করছ ভাবলে গর্ব হয়.... কিছুই তো সাহায্য করতে পারি না ভাই। ''
হারটা নিয়ে যুবক ব
ৌদির পা ছুঁয়ে বলে -''তোমার মতো করে যদি বাংলার সব বৌ মায়েরা ভাবে দেশ স্বাধীন হবেই। আমি পরশু কিছু পোষ্টার দিয়ে যাবো বৌমনি, লুকিয়ে রেখো। আর সামনের মাসে যদি কিছু টাকা দিতে পারো ... ''
-''শোন, আমি যদি কিছু জোগাড় করতে পারি এই আলমারিতেই পাবে। হয়তো আমি আসবো না আর রাতের বেলায়। তোমার দাদা ফিরে আসছেন কয়েকদিনের ভেতর। আর তুমিও যা রাখার এখানে লুকিয়ে রেখে যেও। এই বাংলা বইয়ের আলমারিতে এ বাড়ির কেউ তেমন হাত দেয় না ভাই। ''
যুবক জানালা দিয়ে বাইরে চলে যায়, বৌটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা বই হাতে ফিরে যায়। কৌশানী ওর পেছন পেছন তিনতলায় উঠে আসে। এক ঝলক বৌটার মুখ দেখতে পায় এবার, চমকে ওঠে ও। সামনেই এক সরু পার ধুতি পরিহিতা পুরুষ। বৌটা ঘোমটা টেনে সরে দাঁড়ায়।
পুরুষ গম্ভীর কণ্ঠে বলে -''এতো রাতে কোথায় গেছিলে রাঙা বৌ? তোমার দিদি ঠিকই বলে তাহলে। অতীন বাইরে থাকে আর সেই সুযোগে তুমি....''
-''ছিঃ দাদা। আমি লাইব্রেরী তে গেছিলাম। হাতের একটা বই তুলে ধরে বৌটি। ওদের গলার স্বরে পাশের ঘর থেকে এক মহিলা বেরিয়ে এসেছে । ওধারের ঘর থেকেও আরেকজন পুরুষ বেরিয়ে এসেছে।
-''কপালকুণ্ডলা... এসব বই তুমি পড়ো ? বাবাকে বলেছিলাম চৌধুরী বাড়ির কোনো বৌ স্কুল যায়নি কখনো। জানিনা বাবার কি ভীমরতি হয়েছিল যে তোমার মত পাশ দেওয়া মেয়েকে বৌ করে আনলেন।'' পুরুষটি ঢুকে যায় পাশের ঘরে।
-''ছিঃ রাঙা, বটঠাকুরের মুখে মুখে কথা কইতেও শিকেচিস! '' মহিলা শ্লেষ মিশ্রিত কটু বাক্য ছুড়ে স্বামীর পেছন পেছন ঘরে ঢুকে গেলো। পাশের ঘরের পুরুষটির জ্বলন্ত দৃষ্টি অগ্ৰাহ্য করে যুবতি দ্রুত পায়ে কোনের ঘরে চলে যায়।
বিষণ্ণ মনে কৌশানী নিচে নেমে আসে। এরা কারা? এসব কি হচ্ছে এখানে!!
বড় হল ঘরে তিনজন পুরুষ ও এক বৃদ্ধ, ওধারে অবগুণ্ঠনে ঢাকা দুই নারী, আলোচনা সভা চলছে।আবার থমকে দাঁড়ায় কৌশানী।
-''বাবা রাঙা বৌ যা করছে তাতে পরিবারের সম্মান ধুলোয় লুটোচ্ছে। এর আগে আপনার ছোট ছেলের খোঁজে দু বার পুলিশ এসেছে। এবার না বাড়ির বৌকে থানায় টেনে নিয়ে যায়। ''
আরাম কেদারায় আধশোয়া বৃদ্ধর হাতে তামাকের নল। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বৃদ্ধ বলেন -''ছোট খোকা কোথায় কেউ জানো তোমরা ?''
-''না, বাবা। তবে রাঙার সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে।'' বড় বৌটি ধীরে ধীরে বলে।
-''আপনার ছোট পুত্রের জন্য আপনি রাজা উপাধি পাচ্ছেন না জানেন তো ? ও স্বদেশী করে, ওর নামে হুলিয়া জারি হয়েছে। " আরেক ভাই বলে ওঠে।
-''ওকে আমি ত্যাজ্য পুত্র ঘোষণা করবো। তা অতীন কবে ফিরছে? '' বৃদ্ধ প্রশ্ন করে।
-''পরশু ফেরার কথা। ''
-''রাঙা বৌকে কালীঘাটে গঙ্গা স্নান আর পূজায় পাঠাও অতীন ফিরলে। হিরালালকে সব বুঝিয়ে বলে দিচ্ছি।'' বৃদ্ধ উঠে পড়লেন, সভা ভঙ্গ হল।
কৌশানীর পা মাটির সঙ্গে গেঁথে দিয়েছে কেউ। একে একে অনেক ঘটনা স্পষ্ট হচ্ছে ওর সামনে। আবার পায়ের নূপুরের শব্দে ও সরে দাঁড়ায় আড়ালে। রাঙা বৌ দ্রুত পায়ে চলেছে লাইব্রেরীর দিকে, আজ গায়ে গহনা নেই। হাতে শুধুই শাখা পলা নোয়া। কানে এক কুচি দুল। গলায় সরু চেন। কিন্তু লাইব্রেরীতে আজ তালা। পাশের বড় জানালা চাপ দিতেই খুলে যায়। বৌটি গরাদ বিহীন জানালা দিয়ে প্রবেশ করে। একটা আলমারিতে নিচের তাকে বইয়ের আড়ালে এক গুপ্ত কুঠুরিতে রেখে দেয় একটা পুটুলি। বই সাজিয়ে আবার জানালা গলে ফিরে আসে। উঠে যায় তিনতলায়। কৌশানী গরাদ বিহীন পথে ঢুকে আসে লাইব্রেরীতে। গুপ্ত কুঠুরি থেকে লাল পুটুলিটা বার করে। বেশ কিছু গহনা..…। আবার জোরে বিদ্যুৎ চমকায়। ভোর হয়ে এসেছে বোধহয়। আকাশ পরিষ্কার হচ্ছে এবার। অবাক হয়ে কৌশানী দেখে এক নোংরা পরিত্যক্ত ঘরের মেঝেতে বসে রয়েছে সে, কিছু পুরানো ভাঙা আলমারি ঘর জুরে। কয়েকটায় এখনো রয়েছে কিছু বই। তবে সব পোকায় কাটা। চামচিকে আর বাদুড়ের গন্ধে বাতাস ভারি। ধরমরিয়ে উঠতে যায় কৌশানী, বিবর্ণ লাল শালু কাপড়ে মোরা পুটুলি ছিটকে পড়ে, বেশ কিছু সোনার গহনা ছড়িয়ে পড়ে ধুলার উপর।এসব কি? চমকে ওঠে কৌশানী।
হুন হনা, হুন হুনা… ভোরের বাতাসে পালকির গান মিলিয়ে যাচ্ছে বহু দূরে। বাইরে একটা গুলির আওয়াজ যেন, ছোটাছুটির শব্দ আসছে বাইরে থেকে। কৌশানী ছুটে যায় জানালায়, ভোরের কুয়শাতে সব ধোঁয়া ধোঁয়া, কেমন যেন ঘোলাটে। আস্তে আস্তে পুটুলি বুকে জড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে কৌশানী। শহর কলকাতা জেগে উঠছে ধীরে ধীরে। ঝমঝম শব্দে প্রথম ট্রেন বেরিয়ে গেল গঙ্গার গা ঘেঁষে। চায়ের দোকান থেকে কচুরি ভাজার গন্ধ ভেসে আসছে। কুলিরা রাস্তার কলে স্নান করছে, দূর রাস্তায় ট্রামের টুংটাং আওয়াজ ভেসে আসছে। এ শহর কৌশানীর চেনা কলকাতা। তবে এতক্ষণ কোথায় হারিয়ে গেছিল সে !! মাকড়শার ঝাল সরিয়ে ভগ্ন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে ও। ফাঁকা ঘরগুলোর দেওয়াল থেকে ইট বেরিয়ে আছে, দরজা জানালা উধাও। গাছ গজিয়ে উঠেছে চারপাশে। বড় বড় ফোকরে পোকামাকড়ের বাস। শিকড় বাকড় জড়িয়ে ধরেছে দেওয়ালগুলো।উঠোন তো নয়, আবর্জনার স্তূপ। ভাঙা সিং দরজার বাইরে পাগলীটা বসে বিড়বিড় করছে। ওকে দেখে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। দ্রুত পায়ে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা লাগায় কৌশানী। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে, হাতে এখনো সেই পুটুলি। যা চৌধুরী বাড়ির রাঙা বৌ রেখেছিল ছোট দেওরের জন্য, দেশের জন্য দান করেছিল নিজের স্ত্রীধন। কিন্তু পরিবারের সম্মান বাঁচাতে পালকি শুদ্ধু সাঁতার না জানা রাঙা বৌকে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল আদি গঙ্গায়। আর দেশপ্রেমিক দেওরের ভাগ্যে লেখা ছিল পুলিশের গুলি।
কৌশানীর ধীরে ধীরে মনে পড়ছে অনেক কথা। গহনাগুলো দেখে ফিরছে অনেক ছোট ছোট স্মৃতি।আস্তে আস্তে চৌধুরীরা শেষ হয়ে গেছিল এরপর। শরীকী ঝামেলায় মামলা লড়তে গিয়ে সব দ্রুত শেষ। হয়তো কারোর দীর্ঘশ্বাস লেগেছিল... অথবা ভগবানের অভিশাপ।
একটু পরেই হন্তদন্ত হয়ে ইলা এসে ঢোকে, বলে -''শুনেছিস একটু আগের ঘটনা? ঐ পোড়ো চৌধুরী বাড়ি আজ ভেঙ্গে পড়েছে। কালকের বৃষ্টিটাই বোধহয় দায়ী। বাড়িটা তো ধ্বংসস্তূপ হয়েইছিল। ভাগ্যিস কেউ মারা যায়নি। ''
কৌশানী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু। একশো বছর ধরে ঐ বাড়িটা টিকে ছিল রাঙাবৌয়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়নি বলে। গহনাগুলোর হদিশ যে কেউ পায়নি। গুপ্ত কুঠুরিতে অযত্নে পড়েছিল রাঙাবৌ এর শেষ ইচ্ছাগুলো। আজ কৌশানী এই গহনার পুটুলি উদ্ধার করায় বাড়িটা শাপমুক্তি হল। এবার এই গহনা ও ভারত সেবা শ্রমে দান করে দেবে ভেবেছে। আগের জন্মের অসমাপ্ত কাজ এজন্মে অবশ্যই শেষ করবে। আপাতত ছোট ঠাকুরপোর আত্মার শান্তির জন্য একটু পুজো দিতে হবে কোথাও। ইতিহাসের বইতে নাম না থাকলেও ছেলেটা ছিল সত্যিকারের দেশপ্রেমিক।