বৃদ্ধাশ্রম
বৃদ্ধাশ্রম


দীপঙ্কর বাবু মারা যাওয়ার সময় স্ত্রী মনোরমাকে বলে গেলেন ‘চিন্তা কোরোনা বাবু তো রইল তোমাকে ওই দেখবে। এরকম ছেলে কজনের হয়। তারপর বৌমাও তো আছে।’ বরাবরের মত মনোরমা ও স্বামীর কথার ওপর বিশ্বাস করে ছেলে ও বৌয়ের সাথে থেকে দীপঙ্কর বাবুর মৃত্যুর পর স্বামী হারানোর দুঃখটা ভোলার চেষ্টা করছিলেন। ঠিক এইসময় একদিন রাতে জল খেতে উঠে শুনতে পেলেন তার ছেলে বাবু ও ছেলের বৌ সোমার মধ্যে কথোপকথন। সোমা বলছে ‘বাবাই বড় হচ্ছে ওর তো একটা আলাদা ঘর দরকার, তোমার মাকে কোন একটা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসলেই হয়, তোমার বাবার পেনশনের টাকা টা তো আছেই, ওটা আমাদের দরকার নেই আর তোমার মায়ের খরচার জন্য ওটাই যথেষ্ট। কমসেকম একটু হাত পা ছড়িয়ে তো থাকতে পারব।’ বাবু বলল ‘সোমা মাকে একথা বলব কি করে?’ সোমা বলল তোমাকে কিছু বলতে হবে না, যা বলার আমিই বলব।’ বাবুও বৌয়ের কথায় সম্মতি জানালো।
কথাগুলি শোনার পর মনোরমার দুচোখে জল এল আর মনে পড়ে গেল যে এই ছেলের পড়াশুনার জন্যই কত কষ্ট করে এই বাড়ীটা করা হয়েছিল। ভাড়া বাড়ীর একটা ঘরে যে বাবুর কষ্ট হচ্ছিল। বাবুর বাবা সরকারী চাকরী করলেও তখন মাইনে এত ভালো ছিলনা তাই তাঁর যেটুকু সোনা গয়না ছিল সেটুকুও এই বাড়ীটা করতে বিক্রী করতে হয়েছিল। তবুও তাঁর একটাই শান্তি ছিল যে ছেলেটাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে পেরেছেন। আজকে যদিও তিনি বুঝতে পারলেন যে ছেলে লেখাপড়াটাই শিখেছে কিন্তু মানুষ হয়নি। নিজের ঘরে গিয়ে বাড়ী ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।
পরের দিন সকালে সারা বাড়ী ও চেনা পরিচিত জায়গাগুলি খুঁজেও কোন সন্ধান পাওয়া গেলনা মনোরমার। বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন এল, নানারকম উপদেশ দিল বাবুকে কিন্তু তার বৌ সোমা বলল ‘যা হয়েছে ভালোই হয়েছে, নিজের থেকেই চলে গেছে, কেউ তো বলতে পারবেনা যে আমরা তাড়িয়ে দিয়েছি। কদিন গেলে সবাই সব ভুলে যাবে। আর খুঁজতে হবে না।’
এই পরিস্থিতিটাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বাবু তার ছেলে ও বৌকে নিয়ে কয়েকদিনের জন্য শহরের বাইরে ঘুরতে চলে গেল।
মনোরমার নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনায় যাদের মনে একটু আধটু দুঃখ ছিল তারাও সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সেই দুঃখ ভুলে গেল। সময় নিজের গতিতেই বয়ে যায় তাই দিন দশেকের মধ্যেই সব প্রায় আগের মতোই হয়ে গেল। বাবুও সপরিবার ছুটি কাটিয়ে ফিরে এল। ফিরে এসে লেটার বক্স থেকে বিগত কদিনের জমে থাকা খামগুলিকে নিয়ে বাড়ীর ভেতর ঢুকল। সোফায় বসে চিঠিগুলি পড়তে শুরু করল। একটা চিঠি খুলে পড়তে গিয়ে দেখল তাতে লেখা —
স্নেহের বাবু,
চিঠির প্রথমেই তুমি ও বৌমা আমার ভালোবাসা ও আশীর্বাদ নিও। দাদুভাইয়ের জন্য রইল অনেক স্নেহচুম্বন। আশাকরি সকলে সুস্থ শরীরে আছ। তোমাদের না জানিয়েই বাড়ী থেকে চলে এলাম, জানালে তো আসতে দিতে না তাই। আমার নামে কোন ‘নিরুদ্দেশ’ এর বিজ্ঞাপন দিও না। আমি একটা বৃদ্ধাশ্রমে আছি আর এটাই আমার শেষ ঠিকানা। তবে ঠিকানাটা তোমাকে জানিয়ে অযথা বিরক্ত করতে চাই না। আর একটা কথা আমি আসার সময় বাড়ীর দলিলটা নিয়ে এসেছিলাম, ভেবেছিলাম তোমার নামে করে দেব কিন্তু ভেবে দেখলাম তোমার থেকে ওটার দরকার আমার মত অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধার তাই আমি বাড়ীটা বৃদ্ধাশ্রমকে উপহার দিলাম। তবে তুমি ও বৌমা চিন্তা কোরোনা। দাদুভাইয়ের একুশ বছর পর্যন্ত তোমাদের কেউ ওখান থেকে বের করে দেবেনা। আমি এদের সাথে এই কথাও বলে নিয়েছি বৃদ্ধ বয়সে তোমরা চাইলে ওখানে যে বৃদ্ধাশ্রমটি তৈরি হবে তাতে আমরণ থাকতে পারবে। তোমাদের যাতে শেষ বয়সে অন্য কোথাও থাকতে না হয় তাই তোমাদের নিজেদের বাড়ীতেই বৃদ্ধাশ্রমটি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভালো থেকো।
ইতি
মনোরমা(মা)
চিঠিটা পড়ে বাবু মনোরমার বাড়ী ছাড়ার কারণ অনুমান করতে পারল। বৌ কে ডেকে বলল ‘একটা বাড়ীর ব্যবস্থা করতে হবে তোমার বাজে খরচাগুলি একটু কমাও।’