STORYMIRROR

Rashmita Das

Horror Crime Thriller

4  

Rashmita Das

Horror Crime Thriller

বন্ধ ঘরের আর্তধ্বনি

বন্ধ ঘরের আর্তধ্বনি

68 mins
328

বন্ধ ঘরের আর্তধ্বনি


মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় চাকরি করতে এসে থাকবার ব্যবস্হা হিসেবে যে কোয়ার্টারে আমায় থাকতে দেওয়া হল,সেটা এতটাই নোংরা আর অস্বাস্থ্যকর ছিল,যে থাকবার জন্য গোয়ালঘরও বোধ করি তার চাইতে ভালো।আমি কোনোমতে প্রথম দিনটা সেখানে রাতটুকু কাটিয়ে নিয়ে পরদিনই একটা ঠিকঠাক পছন্দসই ঘরের খোঁজ করা শুরু করে দিলাম।আর প্রায় সাথে সাথেই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পেয়েও গেলাম একটা পছন্দসই ঘর ভাড়া হিসেবে।একটু বড় হওয়ার পর থেকেই আমি একটা বড় ঘরে একা থেকে অভ্যস্ত।সেই হিসেবে যে ঘরটা ভাড়া পাওয়া গিয়েছে সেটা মন্দ নয়।এই একটা ঘরেই তিন বা চারজনের একটা গোটা পরিবার অনায়াসে থেকে যেতে পারে।উত্তর দক্ষিণে খোলা জানলা রয়েছে...আর রয়েছে বাথরুমসহ অন্যান্য যাবতীয় সুযোগ সুবিধা।ঘরভাড়া একটু বেশি হলেও আমি আর দরাদরির মধ্যে গেলাম না।ঘরের ভিতরে সেগুন কাঠের খাট,সোফা,টেবিল চেয়ার,বড় কাঠের আলমারি এমনকি বইএর তাক পর্যন্ত রয়েছে যেগুলি ভাড়া থাকাকালীন ব্যবহার করবার অনুমতি আমি পেয়েছি।অফিস থেকে যে কোয়ার্টারে আমার থাকার ব্যবস্হা হয়েছিল তার তুলনায় এ তো মেঘ না চাইতেই জল!আমি তাড়াতাড়ি সমস্ত কথাবার্তা বলে আমার থাকার ব্যবস্হা পাকা করে নিয়ে আমার জিনিসপত্র নিয়ে চলে এলাম।অফিস থেকে এই ভাড়াঘর পর্যন্ত যাতায়াত করাও সুবিধাজনক।বাড়িওয়ালার বয়স খুবই কম।বয়স বড়জোর পঁচিশ কি ছাব্বিশ হবে।তার সাথে আমার আলাপচারিতার পর এই ব্যাপারে অন্তত নিশ্চিত হওয়া গেল যে বাড়িওয়ালা ভাড়াটের গতানুগতিক তিক্ততার সম্পর্কের কোনো ঝামেলা এ ক্ষেত্রে অন্তত আমায় পোহাতে হবে না।ছেলেটি যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ এবং মিশুকে।যাই হোক...আমি আর দেরী করলাম না।আমার সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে এই ঘরের ভিতর এনে আমার মতো করে সাজিয়ে নিলাম।মনে মনে এমন রাজকীয় একটা ঘর থাকবার জন্য পেয়ে আমি তো মনে মনে যারপরনাই খুশি হলাম।এখান থেকে পায়ে হেঁটে অফিসে যেতে মাত্র মিনিট দশেক লাগে ।আর খাওয়াদাওয়ার জন্যও ব্যবস্হাটা বেশ ভালোই হয়েছে।এই বাড়ির পুরোনো বৃদ্ধ চাকর দীনবন্ধুকে প্রতি দিনের বাজার আর মাস গেলে কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দিলেই সে-ই আমার প্রতিদিনের রান্নাবান্না করে রাখবে এমন কথাই হয়ে রয়েছে।বেশ ভালোভাবেই চলছিল সবকিছু।সমস্যাটা আঁচ করা শুরু করলাম মোটামুটি দুই তিনদিন পর থেকেই।এমনিতে ভূতেটুতে আমার বিশ্বাস বা ভয় কোনোটাই নেই।আর সত্যি বলতে কি...একটা ভাড়াবাড়িতে দিন কাটাচ্ছি...এটা এক মূহুর্তের জন্যও আমার মনে হয়নি।এমন নির্ঝঞ্ঝাট দিনযাপন বোধহয় নিজের বাড়িতেই সম্ভব।কাজেই এইসব টুকিটাকি খটকা বা মাঝরাতে ঘুমের ভিতরে শুনতে পাওয়া কিছু অদ্ভুত কিছু শব্দের উৎস বা তার ব্যাখ্যা কোনো সময়েই আমার কাছে গুরুত্ব পায়নি।কিছুদিনের মাথায় জানতে পারি,এই এলাকায় দুজন মানুষ রাতারাতি নিখোঁজ হয়ে গিয়েছে।এখানকার অনেকেই মনে করেন,এই বাড়ির সঙ্গে ওই নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাগুলির একটা কোনো যোগসূত্র রয়েছে।তবে সত্যি বলতে কি...এইসব উড়ো খবরে আমি তেমন পাত্তাই দিইনি।থাকবার মতো অমন চমৎকার ঘর খুঁজলেও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ...কাজেই এসব কথায় প্রভাবিত হলে আমারই লোকসান।কাজেই কোনোকিছুকেই তেমন গুরুত্ব না দিয়ে আমি আমার মনের শান্তি আর তৃপ্তি নিয়ে দিনযাপন করতে থাকলাম।ঘটনাটা ঘটল এই সেদিনই।গভীর রাত।খাটে এপাশ ওপাশ করছিলাম...হঠাৎই যেন মেঝে থেকে উঠে এল আওয়াজটা...।আমি ধড়মড় করে ঘুম থেকে জেগে উঠে পড়লাম।দুইহাতে চোখ কচলে নিয়ে ভালো করে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম নিকষ অন্ধকারে বাতাসে ভেসে আসা ক্ষীণ শব্দ।অন্যান্য দিন ঠিক যেভাবে কানে শব্দ আসে এ তার থেকে বোধহয় খানিক তীক্ষ্ণ ও তীব্র।আমি ভালোভাবে কান খাড়া করে শোনবার চেষ্টা করলাম।একটা তীক্ষ্ণ অথচ চাপা আর্তধ্বনি ভেসে আসছে।"কে আছ...আমাকে বাঁচাও...।"

আমি শব্দের উৎস বোঝার জন্য এবার ভালো করে কান পাতলাম...।না।আমার কোনো ভুল হয়নি।শব্দটা ঘরের মেঝের তলা থেকেই আসছে।আরো স্পষ্টভাবে কান পেতে শোনবার পর আমার মন বলছে,এ শব্দ আসছে আমারই বিছানার তলা থেকে।যে সেগুন কাঠের পোক্ত খাটটি আমার শোবার জন্য দেওয়া হয়েছে,সেটা বিশাল বড়।ওই খাটের তলায় কি আছে সেটা দেখবার প্রয়োজন আমার কোনোদিনই হয়নি।কিন্তু প্রতিদিনকার মতো আজ ওই শব্দ শুনে যখন বুঝতে পারলাম,ওই শব্দের উৎস খাটের তলাতেই নিমজ্জিত রয়েছে,তখন আর কালবিলম্ব না করে আমি বেডকভারের কিনারা খাটের ওপরে তুলে সেখানে টর্চ ফেলে ভালো করে নিরীক্ষণ করতে শুরু করে দিলাম।ধূলার আস্তরণ হাত দিয়ে মুঠো মুঠো করে অন্য জায়গায় ফেলে ফেলে আমি ওই সুবিশাল শয্যার তলায় আবিষ্কার করলাম একটি গোপন সুড়ঙ্গের দরজা।একটি চৌকোনা সুড়ঙ্গের ওপর পাতা রয়েছে একটি কাঠের পাটাতন।অদ্ভুত!এতদিন রয়েছি এই ঘরে...ঘরের ভিতর এমন আজব ব্যবস্হা রয়েছে এটা জানতেই পারিনি।আর পারবই বা কি করে...এই মাঠের মতো বিশাল রাজকীয় শয্যায় পাতা রয়েছে দামি মখমলি বেডকভার যা মেঝে পর্যন্ত লুটিয়ে থাকে সবসময়।বেডকভার তুলে খাটের তলা দেখবার প্রয়োজন তো কখনো হয়নি।কিন্তু আজ যা দেখছি...তাতে বিস্ময় আর কৌতূহলে আমার বুকের ভিতর ঢিপঢিপ শব্দটা ক্রমেই যেন বেড়ে চলেছে।কারণ আমার শ্রবণশক্তি যদি আমায় ভুল ইঙ্গিত না দেয়...তাহ‌লে রাতদুপুরে এই তীক্ষ্ণ আর্তধ্বনির উৎস হল এই কাঠের পাটাতনের নীচেই রয়েছে।এই মাঘ মাসের মধ্যরাতে আমার কপালে জমতে থাকল বিন্দু বিন্দু ঘাম।তবু আমি এক অদম্য কৌতূহল নিয়ে একবুক সাহস সঞ্চয় করে আমার দুই কম্পমান হাত দিয়ে একটু একটু করে সরাতে থাকলাম কাঠের ভারী পাটাতনের ঢাকনাখানি।

আমার কম্পমান হাতের অপটুতাতেই হোক...কি পাটাতনটির প্রচন্ড ওজনের জন্যই হোক...আমার হাতটা কেঁপে গেল।কিন্তু আমি সাবধানতা অবলম্বনে এতটাই সচেতন ছিলাম যে আমার হাত থেকে পাটাতনটি পড়ে যাওয়া থেকে ঠিকই আটকাতে পেরেছিলাম।কিন্তু আমার অজান্তে আমার পায়ের ধাক্কা লেগে খাটের পাশে রাখা ছোট টেবিলটা দুলে উঠল আর ওর ওপরে রাখা কারুকার্যখচিত পিতলের ফুলদানীটা সশব্দে নীচে পড়ে একেবারে গড়াগড়ি খেতে শুরু করল।ফুলদানি মাটিতে পড়ার ঝনঝন শব্দ পেয়ে বাড়ির চাকর দীনবন্ধু জেগে উঠল।আমার ঘরের কাছাকাছিই মাদুর পেতে ও ঘুমোয়।বাড়ির নতুন ভাড়াটের জন্য রাখা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার মধ্যে এটাও একটা।রাতে কোনো দরকার হলে যাতে আমায় কোনো অসুবিধায় পড়তে না হয়,তাই এই ব্যবস্হা।বাড়ির মালিক সত্যিই খুবই খোলা হৃদয়ের মানুষ।এমন মানুষের এমন একটি রাজকীয় বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবেও থাকার সুযোগ পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার।কিন্তু এসব কথা এতক্ষণ আগে পর্যন্ত আমার মনে হলেও এখন ধীরে ধীরে সমস্তকিছুর মধ্যে আমি একটা আঁশটে গন্ধ পাচ্ছি।

ইতিমধ্যেই বাড়ির চাকর দীনবন্ধু টেবিল হতে পিতলের ফুলদানি মেঝেতে পড়ার শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে ছুটে এসে বাইরে থেকে দরজায় ধাক্কা দিয়ে চ্যাঁচাচ্ছে।


"কি হল বাবু আপনার?কোথাও ধাক্কা লেগে পড়েটড়ে গিয়েছেন?একটিবার দরজাটা খুলুন...।


দীনবন্ধুর কন্ঠে আমার জন্য দুশ্চিন্তাকে ছাপিয়ে ভীষণভাবে ফুটে উঠছে তীব্র দুশ্চিন্তা আর ভীতি।যেন এই মূহুর্তে ওকে দরজা না খুলে দিলে পৃথিবী এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাবে।

আমি তাড়াতাড়ি করে কাঠের পাটাতনটা ঠিকভাবে রেখে খাটের তলা থেকে বেরিয়ে এসে বেডকভারটা একেবারে আগের মতো করে পেতে একেবারে ঠিকঠাক করে দিলাম।তারপর দরজাটা খুলে দিলাম।ও মা...দরজা খুলতেই দেখি অদ্ভুত কান্ড।বাড়ির চাকর দীনবন্ধুকে আমি যে কদিন দেখেছি...তাতে শুধু আমি কেন...যে কেউ এই বছর সত্তরের বৃদ্ধকে দেখলে বলবে...নিতান্ত ধীরস্থির শান্ত স্বভাবের লোক দীনবন্ধু।অথচ ঘরের দরজার ছিটকিনি খোলার সাথে সাথে সে সশব্দে এবং বেশ জোরে হনহনিয়ে হেঁটে একেবারে বিছানার কাছে চলে এল।কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে কিছু একটা বুঝে নিল।তারপর সে দম নিল।তারপর যথারীতি ধীরকন্ঠে আমায় ভালো মানুষের কন্ঠে শুধাল..."আপনার কিছু সমস্যা হয়েছে দাদাবাবু...ভয়টয় পেয়েছেন?চিন্তা করেন কেন...আমি তো রয়েছি আশেপাশেই...।আপনি যদি বলেন তো রাত্তিরে এবার থেকে আপনার বিছানার কাছেই এবার থেকে মাদুর পেতে শুয়ে যাই?"


দীনবন্ধু এই কথাটা বলল যথেষ্ট দৃঢ়তা আর আত্মবিশ্বাসের সাথেই।ও ধরেই নিয়েছে আমি সাংঘাতিক ভীত হয়ে পড়েছি।কিন্তু ওর এই আত্মবিশ্বাসের সুরে আমি পুরোপুরি জল ঢেলে দিয়ে বললাম...


"আরে না না...ভয়টয় আমার ধাতেই নেই।আসলে ঘুমের ঘোরে জলতেষ্টা পেয়েছিল তো...হাতটা বাড়িয়ে গ্লাসে করে জলটা নিতে গিয়ে টেবিলে ধাক্কা লেগে ফুলদানি

টা পড়ে গিয়েছে।তুমি বরং এক কাজ করো।ফুলদানিটা সরিয়ে রেখে জায়গাটা মুছে পরিষ্কার করে চলে যাও।আমায় এখন ঘুমোতে হবে।


এই কথা শুনে দীনবন্ধু শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠল...


"আরে না না বাবু...তা হয় নাকি...রাতবিরেতে আপনি ভয় পেলেন...আর আমি আপনারে একা ঘরে রেখে দিয়ে চলে যাব!ছি ছি ছি ছি!"


দুইকানে হাত ছুইয়ে জিভ কাটল দীনবন্ধু।তারপর বলে উঠল...


"আপনি বরং এখন ঘুমোন।আমি জায়গাটা মুছে পরিষ্কার করে দিয়ে এইখানেই মাদুর পেতে শুয়ে যাই গে।"


এই বলে সে নিজের কাঁধ থেকে গামছা তুলে ফুলদানি পড়া জায়গাটা পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে এগোতে গেল।

আমি ওকে ধমকের সুরে বাধা দিয়ে বলে উঠলাম..."তুমি বাংলা ভাষা বোঝো না?তোমাকে তো বললাম,আমি ভয়টয় পাইনি।হাতে ধাক্কা লেগে পড়ে গেছে ফুলদানিটা।তোমার এই ঘরে শোবার কোনো প্রয়োজন নেই।আমি নিজের ঘরে একা শুতে পছন্দ করি।তাড়াতাড়ি জায়গাটা পরিষ্কার করে দিয়ে এখান থেকে যাও।আমাকে ঘুমোতে হবে।"

আমার কথা শুনে দীনবন্ধু যতটা না থমকে গেল...তার থেকেও বেশি আশাহত হয়েছে বলে মনে হল।কিন্তু আমার বলা কথাগুলোর ভিতর এমন একটা দৃঢ়তা ছিল,যে দীনবন্ধু আর ইনিয়েবিনিয়েও কোনো কথা বলবার জায়গা পেল না।চুপচাপ জায়গাটা পরিষ্কার করে মুছে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।আর আমিও সাথে সাথে ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলাম।এই ঘরের ভিতরে একটা কোনো রহস্য রয়েছে সেটা আমি এখন আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভব করছি।কিন্তু কি সেই রহস্য?আমার হাতের রোমগুলো যেন মূহুর্তের মধ্যে খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়াল।যে কোনোরকম "যদি-তবে-কিন্তু" রা এখন আর কোনো জায়গাই পেল না আমার সামনে।আমার হাতদুটি প্রবল উত্তেজনায় মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে উঠল।এই ঘরের রহস্যের উপর থেকে সমস্ত ধোঁয়াশার আস্তরণ সরানোর জন্য মনে মনে প্রস্তুত হতে শুরু করলাম ঠিক তখন থেকেই।

এই কদিন ধরে আর কোনোকিছুতেই ঠিক মন বসাতে পারছি না।এই পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় এসে থেকে একটা ছোট চাকরি করার কোনো প্রয়োজনই ছিল না আমার।যার স্ত্রী নেই...ঘর সংসার নেই...কোনো বন্ধন বা দায়দায়িত্ব কোনোকিছুই নেই...সেই বাপ মা মরা একা একটা মানুষের ছোট্ট একটা জীবনের জন্য আর নিজের ঘরদোর ছেড়ে এতদূরে চাকরি করতে আসার দরকারটা কি! আমার পাঁচ বছর আগে ফেলে আসা একটা অভিশপ্ত অতীতের হাত থেকে মুক্তির পথ খোঁজার এই যে তীব্র প্রচেষ্টা...তা আর কেউ জানুক না জানুক...আমি আমার নিজের ভিতরে ফুলেফেঁপে ওঠা ঘায়ের যন্ত্রনাকে বরফ দিয়ে ঠান্ডা রাখার মতোই চেপে রেখে দিয়েছি আমার একান্ত গোপনীয়তার গহিন কোণে।পাপবোধ আজও অলিতে গলিতে...বড় রাস্তার মোড়ে...চায়ের দোকানে কি অফিসের জরুরি মিটিংএ...আমায় তাড়া করে ফেরে।কলকাতায় আসার পরে কয়েকটা দিন নিজেকে কাজের মধ্যে ব্যস্ত রেখে যদিও কিছুটা ভুলে থাকতে পেরেছিলাম যন্ত্রনাটাকে...কিন্তু যেদিন প্রথম বন্ধ ঘরের ভিতর হতে ওই আর্তধ্বনি আমার কানে আসে...আমার সমস্ত অতীত যেন এক ধাক্কায় হুড়মুড়িয়ে আছড়ে পড়ে আমার সামনে।যে মল্লিকাকে আমি নিজে হাতে বিসর্জন দিয়ে এসেছিলাম নিশ্চিত মৃত্যুর অতল গহ্বরে...দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ফের আজ সেই মল্লিকার গলা আমি আবার কেন শুনতে পাই প্রতি রাতে?আমার এই শোবার ঘরের শয্যার তলায় এমন চৌকোণা ডালার দরজার উপস্থিতি কিসের জন্য?আর সবথেকে আশ্চর্যের কথা... ওই দরজার ওপার থেকে...আমার বিছানার নীচের কোনো এক অতল গহ্বর থেকে আমি আমার মৃতা স্ত্রীর আর্তধ্বনি কেন শুনতে পাই!আমি তো আগে কোনোদিন কলকাতায় আসিনি...।আর মল্লিকাও তো মুর্শিদাবাদের বাইরে যায়নি কোনোদিন।আমি তো ওকে মৃত্যুর হাতে সঁপে দিয়ে চলে এসেছিলাম যে জায়গায়,তার সঙ্গে কলকাতা শহরের কোনোরকম কোনো সংযোগই নেই।তাহলে!একটা অজানা আতঙ্ক ক্রমশই চেপে বসছে আমার বুকের ভিতরে।এমনিতে আমার ভয়ডর একটু কম হলেও আজ এই কলকাতায় বসে আমার এই ভাড়া ঘরের শয্যার নীচে অবস্থান করা একটা রহস্যময় গর্তের ভিতর হতে দীর্ঘ পাঁচ বছর বাদে যখন মল্লিকার সেই চিরপরিচিত কন্ঠস্বরে একটা চাপা আতঙ্ক মেশানো আকুতি...এখানে থেকো না...যাও...যাও...চলে যাও এখান থেকে"...এমন আর্তি একবার...দুইবার...বারংবার শুনি...তখন একটা চাপা আতঙ্ক কয়েক মণ ভারী পাথরের হয়ে বসে আমার ভিতরে দিশাহারা হয়ে টালমাটাল করে...।কলকাতা শহরে একটু খুঁজলে এমন রাজকীয় ঘর না হলেও...ঠিকভাবে থাকবার মতো ঘর নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।কিন্তু তা সত্ত্বেও...এই ঘরটা আমায় কোনো একটা অমোঘ টানে আমাকে পুরোপুরি বেঁধে রেখেছে।বিছানার নীচের গর্তের ঢাকনাস্বরূপ ওই ডালাখানি উঠিয়ে নিয়ে ভিতরে কি আছে সেটা দেখবার জন্য আমার প্রাণ আকুলিবিকুলি করলেও ওই ডালাটা সরানোর জন্য হাত দিতে গেলে আমার হাত ভীষণভাবে কাঁপতে থাকে প্রতিবার।একটা ভয়ংকর টানাপোড়েনের দড়ি টানাটানি খেলার মাঝে পড়ে গিয়ে প্রতি মূহুর্তে আমি ভিতরে ভিতরে দগ্ধ আর ক্ষতবিক্ষত হয়ে চলেছি।চেহারায় ক্রমশ পড়ছে দুশ্চিন্তার ছাপ।অফিসের কলিগরা যতই ঠাট্টা তামাশা করুন এই বলে...'কি দাদা...বিদেশ বিঁভুইতে আছেন একা একা...আপনারআ সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক।একটা বিয়ে করে ফেলুন তো...তাহলেই কোনো চিন্তা থাকবে না"...আমার মন হালকা হয় না কোনোকিছুতেই।একটা অপরাধবোধ মিশ্রিত ত্রাসের আতঙ্ক আমায় যেন ক্রমশ গিলে খাচ্ছে।

না চাইতেও মনটা বারে বারে ফিরে চলে যাচ্ছে পাঁচ বছর আগের সেই যন্ত্রনাময় অতীতে।যে সময়টাতে আমি ছিলাম আর পাঁচটা বিবাহিত পুরুষের মতোই হিসাবী আর সংসারী।মুর্শিদাবাদের ছেলে আমি।একটা গ্রাম্য অঞ্চলে একটা নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়িতে আমার জন্ম।গ্রামের নাড়ি আঁকড়ে থাকা ছেলে আমি।ঘরের কাছাকাছিই স্কুল কলেজের পর্ব শেষ করে একটা কাপড়ের দোকানে হিসেব লেখার কাজ করতাম চেহারায় ছিল একটা বোকাসোকা লাজুক ভাব।একটা ছোট গন্ডির ভিতরে স্বল্পসংখ্যক কিছু চেনাপরিচিত...এইটুকু পরিসরের ভিতরেই আমি একটা ছাপোষা ডালপান্তা জীবন কাটাচ্ছিলাম।বাবা মাকে হারানোর যন্ত্রনার সম্মুখীন আমাকে যথেষ্ট কম বয়সেই হতে হয়েছে।তাঁরা আমায় ছেড়ে...এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পর জীবনটাই বড়ো অর্থহীন মনে হত।শুধুই মনে হত...কিসের জন্য বেঁচে রয়েছি আর কার জন্যই বা বেঁচে রয়েছি!এই সময়েই আমার শুষ্ক মরূর মতো জীবনে আকস্মিক সতেজ ঝোড়ো বাতাসের ঝাপটার মতোই আগমন ঘটেছিল মল্লিকার।আমি যে দোকানে কাজ করতাম সেই দোকানেই ওর বাবার সাথে এসেছিল যখন,আমার মতো নির্ভেজাল পেঁপেসেদ্ধ ধরণের ছেলের বুকের ভিতরেও শুরু হয়েছিল অল্প ঢিপঢিপ নিঃশব্দ ধ্বনি। খাতা কলম হাতে ব্যস্ততার একটা ভানএর মুখোশ সামনে ঝুলিয়ে কোনোমতে আটকেছিলাম আমার জীবনের প্রথম হৃদস্পন্দনের বেপরোয়া গতিবেগটাকে।মল্লিকার চোখও যে সেদিন সকলের চোখের আড়ালে একটা অজানা বেসামাল হাওয়ায় গা ভাসিয়েছিল,সেটা স্পষ্ট হতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি।অল্পদিনের মাথাতেই সেই দামাল কালবৈশাখীর মতো একরাশ দীর্ঘকেশের চাদরে আচ্ছাদিত হয়ে,ওই চঞ্চলা হরিণীর মতো চপলা নারী মল্লিকার ক্রোড়দেশে পরম সোহাগে আমার শয়নকক্ষের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছিলাম। আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতে শুরু করেছিল মল্লিকা।আমি মোটামুটি সাধারণ পরিবার...আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে।মল্লিকা একটা বড়ো ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে।সমাজের মাথাদের সাথে ওদের প্রতিনিয়ত ওঠাবসা আর ওদের উচ্চবিত্ত পরিবারের সামনে আমি পুরোপুরি চুনোপুঁটি।ফলপ্রসূ যেটা হবার ছিল সেটাই হল।ওর পরিবার কোনোভাবেই আমাকে নিজেদের পরিবারের মেয়ের পাশে আমাকে মেনে নেয়নি।কিন্তু তাতে দমে যায়নি মল্লিকা।ওর ভিতরে তখন উঠেছিল এক উথালপাথাল দামাল ঝড়।ও সমাজ সংসার

...এমনকি নিজের পরিবারকে পর্যন্ত অগ্রাহ্য করে এক কাপড়ে এসে দাঁড়িয়েছিল আমার এই একচালা ছোট্ট ঘরের দরজায়।আমার সামনে মত্ত প্রেমের ডালি নিয়ে একমুখ আকুতির সাথে, সিঁদুরের খোলা কৌটো হাতে নিয়ে যখন দাঁড়িয়েছিল,আমিও তখন কোনোকিছুর পরোয়া না করে ওর হাত ধরে ওকে টেনে নিয়েছিলাম নিজের ঘরে।স্হান দিয়েছিলাম নিজের বুকের বামপাশে।আমি ভালোভাবে জানতাম যে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।ওর পরিবার আমাকে মেনে নিতে পারেনি।এখন তাদের পরিবারের মেয়েকে যখন সবাই আমার দেওয়া সিঁদুর মাথায় নিয়ে ঘুরতে দেখবে...সেটার ফল যে কিভাবে আমার দিকে ঘুরে আসবে সেই সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট দুশ্চিন্তা ছিল।কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার...দিন যায়...মাস যায়... আমাদের উপর বা বলা ভালো আমার ওপর এই ভয়াবহ দুঃসাহস প্রদর্শনের ফলসরূপ কোনো নেতিবাচক প্রভাবই পড়েনি।বরং সময়টা বছর ঘোরার দিকে মোড় নিতে না নিতেই ধীরে ধীরে মল্লিকার সাথে ওর বাপের বাড়ির সকলে ধীরে ধীরে যোগাযোগ করা শুরু করল।এরপর আস্তে আস্তে মল্লিকা আর ওর পরিবারের মধ্যে সবকিছু সহজ হয়ে গেল।আমাকেও ওরা জামাই হিসেবে মেনে নিল।আমার যাবতীয় দুশ্চিন্তাকে ভুল প্রমাণ করে আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আমায় স্বীকার করে নিল সহজভাবেই।আমাকে কোনোরকম প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতেই হয়নি।দিন কাটছিল স্বাভাবিক ছন্দেই।কিন্তু ক্রমেই একটা বিরাট ছন্দপতনের নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি আমি ধীরে ধীরে টের পেতে শুরু করলাম।

মল্লিকার চেনা মুখ...চেনা হাসি...চেনা চাহনির ভিতরে আমি ক্রমশ একটা অন্য মল্লিকার অস্তিত্ব টের পেতে শুরু করলাম যে প্রতিনিয়ত আমার সঙ্গে অভিনয় করে চলেছে চাতুরীর সঙ্গে। আমার দিকে ওর তাকানোর ওই দৃষ্টির মধ্যে 

কোনো ভালোবাসার অস্তিত্ব তো নেইই...বরং দিনকে দিন সেখানে যেন জড়ো হয়ে চলেছে গোছা গোছা সন্দেহ।কিন্তু কখনোই মুখে কোনোকিছু নিয়ে কোনো রা নেই।সবকিছুই একদম ঠিক চলছে অথচ আমি প্রতিমূহুর্তেই তীব্রভাবে অনুভব করছি বিরাট এক ছন্দপতনের অশনিসংকেত। ক্রমেই মল্লিকার ভিতর হতে এক ছলনাময়ী বিশ্বাসঘাতিনীর চেহারা স্পষ্ট হতে শুরু করল ধীরে ধীরে...আর সেটা আমি স্পষ্টই বুঝতে শুরু করলাম।আর সবথেকে অসহনীয় ব্যাপার যেটা,সেটা হল মল্লিকার চাতুরী।ও নিজের চরিত্রের দোষ ঢাকতে উল্টে সম্পূর্ণ বিনা যুক্তিতে আমার চরিত্রের দিকে আঙুল তোলা আরম্ভ করে দিল।আমি চিরকালের চুপচাপ আর শান্তশিষ্ট স্বভাবের ছেলে।মেয়েদের চোখে চোখ রেখে কথা বলা বরাবরই আমার কাছে স্বপ্নাতীত।আমার সাথে প্রেম আর বৈবাহিক সম্পর্কে জড়িয়ে,প্রায় বছরখানেক ঘর করার পরেও আমার স্বভাব চরিত্র বুঝতে ওর পুরোটাই বাকি রয়ে গিয়েছে এটা কোনোমতেই ধোপে টেকার মতো কথা নয়।বরং বিয়ের পর পর শুরু শুরুর দিকে ওর মুখেই লোকজনের কাছে আমি আমার ধীর স্হির শান্ত ও চুপচাপ স্বভাবের জন্য ওর নিশ্চিন্তি প্রকাশ আর প্রসংশা শুনেছি।আমাদের সম্পর্কটায় ছিল সমস্তরকম জটিলতামুক্ত একটা সহজ সরল মিষ্টি রোজনামচার সুখ।কিন্তু যত দিন যাচ্ছিল...ধীরে ধীরে আমি হতভম্বের মতো হয়ে দেখতে থাকলাম সমস্ত চেনা সমীকরণ যেন তার ছক ওলটাতে শুরু করেছে একেবারে চোখের সামনে।আমি এসবের মাথামুন্ডু কিছুই উদ্ধার করতে পারতাম না প্রথম প্রথম।পরে আমি ক্রমশই বুঝতে পারি...ওর বাপের বাড়ির লোকেরা ওকে আমার বিরুদ্ধে উসকাতে শুরু করেছে।আমাদের দুজনের দাম্পত্য জীবনের প্রতি নিজেদের ঝুটো মঙ্গলকামনার প্রলেপ দিয়ে তার তলে তলে আমার সম্বন্ধে কুকথা বলে কান ভারী করে চলেছে মল্লিকার।শুধু তাই নয়...নিজেদের যাবতীয় মিথ্যাকে সত্যি প্রমাণ করার জন্য টাকাপয়সা খরচ থেকে আরম্ভ করে আমার সম্বন্ধে মল্লিকার কাছে দুর্নাম করার জন্য চেনা মানুষগুলোকেও টাকা দিয়ে কিনতে শুরু করল ওরা।এভাবেই বেশ অল্প সময়ের মধ্যেই মল্লিকার মনে স্হির বিশ্বাস জন্মে গেল যে আমি ওকে ঠকাচ্ছি।এই সমস্তকিছুর একটাই উদ্দেশ্য ছিল।মল্লিকাকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে,আমাদের বিবাহ বিচ্ছেদ করিয়ে ফের মল্লিকার বিয়ে দেওয়া।যেভাবে ওর কান ভারী করার আয়োজন শুরু হয়েছিল চতুর্দিক জুড়ে,তাতে সম্পর্ক ও জীবনের সমস্ত সূতো ধীরে ধীরে আমার হাত থেকে আলগা হয়ে উড়ান নিতে শুরু করল অন্য পথে।জীবনে কোনোদিন...কোনো পরিস্থিতিতেই নিজেকে এতটা অসহায় লাগেনি।মল্লিকা ছিল আমার জীবনের ছেঁড়া তানপুরাতে সপ্তসুরের মূর্ছনা।আমার প্রাণ।শত সহস্র চেষ্টা করেও মল্লিকাকে আমি কোনোকিছুই বোঝাতে পারিনি।ওর মনের ভিতরের যাবতীয় ভ্রান্ত ধারণাগুলো ক্রমেই দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হতে থাকল।আমি বুঝতে পারলাম...না তো মল্লিকা আর আমাকে আগের মতো ভালবাসবে

আর না আমার সাথে আগের মতো সংসার করবে।শরীরে না হলেও মনেপ্রাণে ও যেভাবে আমার থেকে...এ সংসারের সমস্তকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তাতে করে আমার মনে হতে শুরু করল,এ মিথ্যে সংসারের বোঝা বওয়ার যন্ত্রনা হতে এবার মল্লিকাকে চিরতরে মুক্তি দিয়ে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ঘনিয়ে আসা এমন পরিস্থিতিতে আমার মনের ভিতরে বাসা বাঁধতে শুরু করেছে ভীষণ রকম অবসাদ।জীবনটাই অর্থহীন হয়ে পড়ছিল ক্রমশ।মল্লিকার আঁচলখানি ফের এই সংসারের চাবির সাথে বেঁধে দেওয়া কি আদৌ কোনোদিন সম্ভব হবে!এখন কি জন্য বাঁচব...আর কার জন্যই বা বাঁচব...এই চিন্তাই আমার ভিতরটা কুরে কুরে খেত।দিনগুলো পার হচ্ছিল সময়ের নিয়মেই।কিন্তু আমি ধীরে ধীরে বেশ স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম যে মল্লিকা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে।এবং এতে ওর বাপের বাড়ির লোকেদের প্রত্যক্ষ মদত রয়েছে।আমার সাথে ওর বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নিজেদের পরিবারের একমাত্র মেয়েকে সমান বিত্তসম্পন্ন কোনো পরিবার দেখে সেখানে বিয়ে দেওয়াটাই যে তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য এটা বুঝতে আর কোনো বাকি থাকার কথাই নেই।পরিস্থিতি যেদিকে মোড় নিয়েছে,তাতে কোনোকিছুই আর আমার হাতে নেই এটাও বুঝতে আমার বাকি ছিল না।পরিস্থিতি যেদিকে মোড় নিয়েছে,তাতে যে জোর করে মল্লিকাকে নিজের কাছে বেঁধে রাখা আর হাতের কোঁচড়ে একমুঠো বালি নিয়ে তাকে মুঠোয় পুরে রাখবার চেষ্টা যে এক ব্যাপার এটা আমার মস্তিষ্ক বুঝলেও মন কোনোমতেই মানতে চায়নি।আমি জানি...মল্লিকার কানভারি করার জন্য চারপাশে হাজারটা লোক রয়েছে।আমার সম্পর্কে যে ঠিক কি বলা হয়েছে সেই সম্বন্ধে কোনো ধারণা আমার না থাকলেও এটা পরিষ্কার...মল্লিকা নিজের মন ও আত্মা থেকে আমাকে পুরোপুরি ত্যাজ্য করেছে।সে আমায় তীব্রভাবে ঘৃণা করে।আমার মতো ছেলের সাথে ওর কোনোদিন পরিচয় পর্যন্ত ছিল এইটাই ওর কাছে এখন আপশোষের বিষয় এবার নিজেকে গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে ও আমার সংস্রব থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে চায়...এই কথা সে আমায় স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল।কিন্তু আমি ক্রোধান্বিত চোখে আমার প্রতি তীব্র বিদ্বেষের আগুন ঝরতে দেখেও কিছুতেই ওকে সেদিন যেতে দিতে পারিনি।সে আমার ওপর রাগ করুক...ভুল বুঝুক...আর আমাকে ঘৃণাই করুক...সে তো আখেরে আমার স্ত্রী।ওর ওপর আমার সাত জন্মের সমস্ত অধিকার বোধকে এক জায়গায় জড়ো করে এনে ফেলে এই প্রথম আমি ওর উপরে ভীষণভাবে জোর খাটালাম।ওর হাতদুটো নিজের হাতের বজ্রমুষ্ঠির ভিতরে পুরে চোখ রাঙিয়ে বললাম..."আমি তোমার স্বামী।আমার কথা শুনতে বাধ্য তুমি।আমার অনুমতি ছাড়া এই ঘরের বাইরে পা রাখা বন্ধ তোমার।তোমার সব বিত্তবান বাপ দাদারা কে কি করতে পারে সেটা দেখব আমি।" প্রচন্ড উত্তেজিত কন্ঠে রাগগুলো এক নাগাড়ে ঝেড়ে দিয়েই ঘরের ভিতরে ওকে আছড়ে ফেলে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম আমি।আমার অমন মূর্তি দেখে সাময়িকভাবে মল্লিকাও রীতিমতো স্তম্ভিত ও ভীত হয়ে পড়েছিল।ওকে ঘরের ভিতরে আটকে দিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তালা আটকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম আমি।আমি মনে মনে তখন একটাই কথা জানি বউ আমার।কিভাবে তাকে আমি আমার কাছে ধরে রাখব...আর কিভাবেই বা তাকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে তার সমস্ত মান ভাঙাব সেটা আমি বুঝব।দুনিয়ার কাউকে পরোয়া করার দরকার নেই আমার।কিন্তু হায়...বনের দিকে তাকিয়ে যে পাখি একবার ওড়বার জন্য ডানা ঝাপটায়...তাকে ধরে রাখা কখনোই যায় না...এটা বুঝতে আমার যতটা সময় লেগে গিয়েছিল,ততদিনে পরিস্থিতি এমন দিকে মোড় নিয়েছে যে জীবনের সমস্ত দিশা আর বেঁচে থাকার সমস্ত অর্থ শেষ পর্যন্ত আমার দিকে তাকিয়ে উচ্চৈস্বরে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে অট্টহাস্য শুরু করে দিয়েছে।

মল্লিকাকে নিজের কাছে ধরে রাখবার সমস্ত প্রচেষ্টাই আমার ব্যর্থ হয়।যে ঘরের ভিতরে ওকে আমি আটকে রাখি,তার জানলার গরাদে গরম ছুরি বসিয়ে নিজের পালানোর রাস্তা করে নেয় মরিয়া মল্লিকা।এইভাবে অবশেষে আমার উজাড় করা ভালোবাসার ডালি দুইপায়ে ঘৃণা ভরে দলে নিজের মতো করে একটা সুখের দিগন্ত খুঁজে নিয়ে সেইদিকেই সেদিন ফড়ফড় করে ডানা মেলে উড়ে গিয়েছিল মল্লিকা।আর সেই ভাঙ্গা খাঁচাখানি বুকের ভিতরে আগলে একাকী আমার সেই মর্মবিদারক ক্রন্দন শোনবার জন্য সেইদিন কেউ ছিল না।পরে লোকজনে অবশ্য ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে বলতে ছাড়েনি...সোনার পাখিকে এনে ভরে রেখেছিল জং ধরা লোহার খাঁচায়।এমন মূর্খের জন্য এটা যোগ্য শাস্তিই হয়েছে।আমি লোকজনের কথা আগেও কোনোদিন গায়ে মাখিনি...আর আজও সেইসব ব্যঙ্গবিদ্রুপ আমায় স্পর্শ করতে পারেনি।আমি শুধু আমার জীবনের এই অপার শুন্যতা নিয়ে এতটাই দিশাহারা হয়ে পড়েছিলাম যে বেঁচে থাকাটাই আমার কাছে শাস্তি মনে হত।একা একাই জীবনটা কুলির মতো টেনে নিয়ে চলছিলাম আর শুধুই মল্লিকাকে খুঁজে চলেছিলাম।এইভাবে খুঁজতে খুঁজতে ওর খোঁজ পেয়েও গিয়েছিলাম।ওর বাড়ির লোকের মদতে আমাকে মাদক খাইয়ে আচ্ছন্ন করে বিবাহবিচ্ছেদের কাগজে আমার সই নিয়ে আমার সাথে সমস্ত বন্ধন আইনীভাবে ছিন্ন করেছে সে অনেক আগেই।এবার যখন আমার কানে এল,ওর পরিবারের লোকেরা এক অভিজাত ও প্রভূত ঐশ্বর্য ও প্রতিপত্তিসম্পন্ন পরিবারের ছেলের সাথে মল্লিকার পুনর্বিবাহ সম্পন্ন করে দিয়েছে।এখন তারা হনিমুন করতে সিকিমে গিয়েছে।এটা শোনা পর্যন্ত আমার মাথার ভিতরে যেন আগুন জ্বলে উঠেছিল।পৃথিবী যেন এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গিয়েছিল।পায়ের তলায় যেন দুলে উঠেছিল মাটি।মনে হচ্ছিল আকাশ যেন আমার মাথায় আছড়ে ভেঙ্গে পড়বে এক্ষুনি। আমার ভিতরে তখন যেটুকু সহ্যক্ষমতা আর সংযম অবশিষ্ট ছিল এক লহমায় তা একেবারে ধূলিসাৎ হয়ে গেল।আমি আমার বর্তমান কাজ কারবার...ঘরদোরের রক্ষণাবেক্ষণের চিন্তা সমস্তকিছু শিকেয় তুলে দিয়ে তৎক্ষণাৎ নিজের জন্য সিকিমের একটা টিকিট করলাম আর নিজের যা কিছু জমানো পুঁজি সমস্তটা সাথে করে নিয়ে আর কালবিলম্ব না করে রওনা দিলাম।আমার শেষ রক্তবিন্দু বিসর্জন দিয়ে হলেও মল্লিকাকে নিজের কাছে ফিরিয়ে আনবই...এই ছিল আমার ধনুক ভাঙ্গা পণ।যদিও আইনীভাবে কোনো পুরুষের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ একটি নারীকে আর কোনোরকম প্রচেষ্টা অথবা বলপ্রয়োগের দ্বারাই প্রাক্তন স্বামী হয়ে আমার পক্ষে সম্ভব নয়...এটা মাথায় করার মতো পরিস্থিতিতে আমি ছিলাম না।আমি আগে থেকেই অতি কৌশলে খোঁজখবর লাগিয়ে, সিকিমে মল্লিকা ওর স্বামীর সাথে কোথায় গিয়ে উঠবে,সেই বিষয়ে একটা ধারণা তৈরি করে নিয়েছিলাম।সিকিমে পৌঁছোনোর পর নিজের থাকবার মতো যা হোক একটা জায়গার বন্দোবস্ত করার পর্ব কোনোমতে চুকিয়ে একটুখানি থিতু হয়েই,ওই শ্রান্ত ও বিদ্ধস্ত শরীর নিয়ে কোনোরকম বিশ্রামের বালাই না রেখেই মল্লিকার খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম।যেহেতু আগে থেকে এই বিষয়ে সামান্য হলেও ধারণা নিয়েই এসেছিলাম...কাজেই বেশ অল্প সময়ের মধ্যেই মল্লিকার খোঁজ পেয়ে গেলাম।এবার আমি নাওয়া খাওয়া ভুলে শুধুই ওকে পিছন থেকে অনুসরণ করতে শুরু করি।একবার কোনোভাবে যদি ওকে একা পেয়ে যাই...তাহলে ঠিক ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমি নিজের কাছে ফিরিয়ে আনবই...এই ছিল আমার একমাত্র লক্ষ্য।আজ বুঝি আমার এইসমস্ত প্রচেষ্টাগুলি কতখানি নিষ্ফল ও হাস্যকর ছিল।এইভাবে ওকে ক্রমাগত অনুসরণ করতে করতে একটা সময়ে আসে আমার বহু প্রতীক্ষিত সেই সময়টি।মল্লিকাকে আমি পুরোপুরি একা পেয়ে যাই।সিকিমে মল্লিকা আর ওর স্বামী যে কোনো হোটেলে ওঠেনি এ খবর আমি এই কদিন ওকে অনুসরণ করতে গিয়েই বুঝেছিলাম।পরে একটু খোঁজখবর করে জানতে পারি,ওরা যে বাংলোটিতে উঠেছে,সেটির মালিক মল্লিকার বর্তমান স্বামীর এক নিকটাত্মীয়।তিনি ওদের দুজনকে হনিমুনের জন্য নিজের বাংলোখানি সপ্তাহখানেকের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন।আর বর্তমানে সেখানেই রয়েছে মল্লিকা আর ওর স্বামী।আমি ওই বাংলোটিকে অবশেষে পাখির চোখ বানিয়ে ফেলি।দিনরাত্রি ভুলে সেখানে সমর্পণ করে ফেলি নিজের সমস্ত ধৈর্য,সহ্য আর প্রতীক্ষা।আর তার ফলও পেয়ে যাই বেশ অল্প সময়ের মধ্যে।একদিন সকালের দিকে বাংলো থেকে ওর স্বামীকে কোনো দরকারে একাই বেরিয়ে যেতে দেখি।ভিতরে যে মল্লিকা একা রয়েছে এটা বুঝতে আমার কোনো অসুবিধা হয় না।দরজার বাইরে নক করার শব্দ শুনে মল্লিকা ওর স্বামী ভেবেই দরজা খুলে দেয় অনায়াসে।কিন্তু দরজাটা একটু ফাঁকা করা মাত্রই যেই আমার মুখটা ওর নজরে আসে...সাথে সাথেই ও রীতিমতো ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে এবং সজোরে দরজাটা বন্ধ করতে যায়।কিন্তু আমার ভিতরে তখন রোখ চেপে গিয়েছে।মল্লিকার দরজা বন্ধ করতে উদ্যত ওই হাতদুখানি প্রায় সাথে সাথে একটা হ্যাঁচকা টানের সাথে।

মল্লিকাকে নিজের কাছে ধরে রাখবার সমস্ত প্রচেষ্টাই আমার ব্যর্থ হয়।যে ঘরের ভিতরে ওকে আমি আটকে রাখি,তার জানলার গরাদে গরম ছুরি বসিয়ে নিজের পালানোর রাস্তা করে নেয় মরিয়া মল্লিকা।এইভাবে অবশেষে আমার উজাড় করা ভালোবাসার ডালি দুইপায়ে ঘৃণা ভরে দলে নিজের মতো করে একটা সুখের দিগন্ত খুঁজে নিয়ে সেইদিকেই সেদিন ফড়ফড় করে ডানা মেলে উড়ে গিয়েছিল মল্লিকা।আর সেই ভাঙ্গা খাঁচাখানি বুকের ভিতরে আগলে একাকী আমার সেই মর্মবিদারক ক্রন্দন শোনবার জন্য সেইদিন কেউ ছিল না।পরে লোকজনে অবশ্য ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে বলতে ছাড়েনি...সোনার পাখিকে এনে ভরে রেখেছিল জং ধরা লোহার খাঁচায়।এমন মূর্খের জন্য এটা যোগ্য শাস্তিই হয়েছে।আমি লোকজনের কথা আগেও কোনোদিন গায়ে মাখিনি...আর আজও সেইসব ব্যঙ্গবিদ্রুপ আমায় স্পর্শ করতে পারেনি।আমি শুধু আমার জীবনের এই অপার শুন্যতা নিয়ে এতটাই দিশাহারা হয়ে পড়েছিলাম যে বেঁচে থাকাটাই আমার কাছে শাস্তি মনে হত।একা একাই জীবনটা কুলির মতো টেনে নিয়ে চলছিলাম আর শুধুই মল্লিকাকে খুঁজে চলেছিলাম।এইভাবে খুঁজতে খুঁজতে ওর খোঁজ পেয়েও গিয়েছিলাম।ওর বাড়ির লোকের মদতে আমাকে মাদক খাইয়ে আচ্ছন্ন করে বিবাহবিচ্ছেদের কাগজে আমার সই নিয়ে আমার সাথে সমস্ত বন্ধন আইনীভাবে ছিন্ন করেছে সে অনেক আগেই।এবার যখন আমার কানে এল,ওর পরিবারের লোকেরা এক অভিজাত ও প্রভূত ঐশ্বর্য ও প্রতিপত্তিসম্পন্ন পরিবারের ছেলের সাথে মল্লিকার পুনর্বিবাহ সম্পন্ন করে দিয়েছে।এখন তারা হনিমুন করতে সিকিমে গিয়েছে।এটা শোনা পর্যন্ত আমার মাথার ভিতরে যেন আগুন জ্বলে উঠেছিল।পৃথিবী যেন এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গিয়েছিল।পায়ের তলায় যেন দুলে উঠেছিল মাটি।মনে হচ্ছিল আকাশ যেন আমার মাথায় আছড়ে ভেঙ্গে পড়বে এক্ষুনি। আমার ভিতরে তখন যেটুকু সহ্যক্ষমতা আর সংযম অবশিষ্ট ছিল এক লহমায় তা একেবারে ধূলিসাৎ হয়ে গেল।আমি আমার বর্তমান কাজ কারবার...ঘরদোরের রক্ষণাবেক্ষণের চিন্তা সমস্তকিছু শিকেয় তুলে দিয়ে তৎক্ষণাৎ নিজের জন্য সিকিমের একটা টিকিট করলাম আর নিজের যা কিছু জমানো পুঁজি সমস্তটা সাথে করে নিয়ে আর কালবিলম্ব না করে রওনা দিলাম।আমার শেষ রক্তবিন্দু বিসর্জন দিয়ে হলেও মল্লিকাকে নিজের কাছে ফিরিয়ে আনবই...এই ছিল আমার ধনুক ভাঙ্গা পণ।যদিও আইনীভাবে কোনো পুরুষের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ একটি নারীকে আর কোনোরকম প্রচেষ্টা অথবা বলপ্রয়োগের দ্বারাই প্রাক্তন স্বামী হয়ে আমার পক্ষে সম্ভব নয়...এটা মাথায় করার মতো পরিস্থিতিতে আমি ছিলাম না।আমি আগে থেকেই অতি কৌশলে খোঁজখবর লাগিয়ে, সিকিমে মল্লিকা ওর স্বামীর সাথে কোথায় গিয়ে উঠবে,সেই বিষয়ে একটা ধারণা তৈরি করে নিয়েছিলাম।সিকিমে পৌঁছোনোর পর নিজের থাকবার মতো যা হোক একটা জায়গার বন্দোবস্ত করার পর্ব কোনোমতে চুকিয়ে একটুখানি থিতু হয়েই,ওই শ্রান্ত ও বিদ্ধস্ত শরীর নিয়ে কোনোরকম বিশ্রামের বালাই না রেখেই মল্লিকার খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম।যেহেতু আগে থেকে এই বিষয়ে সামান্য হলেও ধারণা নিয়েই এসেছিলাম...কাজেই বেশ অল্প সময়ের মধ্যেই মল্লিকার খোঁজ পেয়ে গেলাম।এবার আমি নাওয়া খাওয়া ভুলে শুধুই ওকে পিছন থেকে অনুসরণ করতে শুরু করি।একবার কোনোভাবে যদি ওকে একা পেয়ে যাই...তাহলে ঠিক ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমি নিজের কাছে ফিরিয়ে আনবই...এই ছিল আমার একমাত্র লক্ষ্য।আজ বুঝি আমার এইসমস্ত প্রচেষ্টাগুলি কতখানি নিষ্ফল ও হাস্যকর ছিল।এইভাবে ওকে ক্রমাগত অনুসরণ করতে করতে একটা সময়ে আসে আমার বহু প্রতীক্ষিত সেই সময়টি।মল্লিকাকে আমি পুরোপুরি একা পেয়ে যাই।সিকিমে মল্লিকা আর ওর স্বামী যে কোনো হোটেলে ওঠেনি এ খবর আমি এই কদিন ওকে অনুসরণ করতে গিয়েই বুঝেছিলাম।পরে একটু খোঁজখবর করে জানতে পারি,ওরা যে বাংলোটিতে উঠেছে,সেটির মালিক মল্লিকার বর্তমান স্বামীর এক নিকটাত্মীয়।তিনি ওদের দুজনকে হনিমুনের জন্য নিজের বাংলোখানি সপ্তাহখানেকের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন।আর বর্তমানে সেখানেই রয়েছে মল্লিকা আর ওর স্বামী।আমি ওই বাংলোটিকে অবশেষে পাখির চোখ বানিয়ে ফেলি।দিনরাত্রি ভুলে সেখানে সমর্পণ করে ফেলি নিজের সমস্ত ধৈর্য,সহ্য আর প্রতীক্ষা।আর তার ফলও পেয়ে যাই বেশ অল্প সময়ের মধ্যে।একদিন সকালের দিকে বাংলো থেকে ওর স্বামীকে কোনো দরকারে একাই বেরিয়ে যেতে দেখি।ভিতরে যে মল্লিকা একা রয়েছে এটা বুঝতে আমার কোনো অসুবিধা হয় না।দরজার বাইরে নক করার শব্দ শুনে মল্লিকা ওর স্বামী ভেবেই দরজা খুলে দেয় অনায়াসে।কিন্তু দরজাটা একটু ফাঁকা করা মাত্রই যেই আমার মুখটা ওর নজরে আসে...সাথে সাথেই ও রীতিমতো ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে এবং সজোরে দরজাটা বন্ধ করতে যায়।কিন্তু আমার ভিতরে তখন রোখ চেপে গিয়েছে।মল্লিকার দরজা বন্ধ করতে উদ্যত ওই হাতদুখানি প্রায় সাথে সাথে একটা হ্যাঁচকা টানের সাথে নিজের বুকের ভিতরে টেনে নিয়ে চকিতে ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। সজোরে হাত দিয়ে চেপে দিলাম মল্লিকার মুখ।

মল্লিকা ভয়ে বিস্ময়ে শুধু চাপা একটা গোঁ গোঁ শব্দ করতে লাগল।আমি চাপা গলায় ফিসফিস করে কড়া গলায় বললাম... "চলে এসো আমার সঙ্গে...এক্ষুনি...।"

এবার আমার এই কথা শুনে মল্লিকার মুখের নক্সাই পালটে গেল।ওর মুখ থেকে সমস্ত ভয়ডর মিলিয়ে গিয়ে সেখানে ফুটে উঠল তীব্র ক্রোধের প্রতিফলন।নিজের শরীর ও মুখ থেকে এক ঝটকায় আমার হাত সরিয়ে দিয়ে নিজেকে আমার বাহুবন্ধন হতে মুক্ত করে নিল।তারপর ওর উত্তেজিত কন্ঠে এক পৃথিবী ঘৃণা ভরে নিয়ে বলে উঠল..."আমার পিছু ধাওয়া করে করে তুই এই পর্যন্ত পৌঁছে গেছিস!তোর সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।বাবা ঠিকই বলে...গরীব গুর্বোগুলোর ভালো জামাকাপড়ের সাথে সাথে লাজলজ্জারও বালাই থাকে না।এতদিন এতগুলো মেয়ের সাথে স্ফূর্তি করে আশ মেটেনি তোর!ফের তুই আমার কাছে জিভ লকলক করতে করতে চলে এসেছিস!ভালো কথা বলছি...এখান থেকে চলে যা...।আমার স্বামী যদি তোকে দেখে না...এখান থেকে জ্যান্ত বেরোতে পারবি না এই বলে দিলাম।"

ভিতরকার বহুদিনের বর্জ্য ঘৃণাভরে সজোরে নিক্ষেপ করার মতোই আমার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিয়ে হাঁপাতে লাগল মল্লিকা।আমি বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম...কি বলছে মল্লিকা...!আমি মেয়েদের সঙ্গে স্ফূর্তি করে বেড়াই...ছি ছি...এইসব কথা শুনে আমার নিজের কানেই নিজের আঙুল চাপা দিতে ইচ্ছা করছে।সাথে এও বুঝতে পারলাম...ওর বাপের বাড়ির লোকেরা ঠিক কিভাবে ওর কানে আমার বিরুদ্ধে বিষ ঢেলেছে।আমি কোনোরকম ভয়ডর বা ওর স্বামীর কাছে নগ্নহাতে ধরা পড়ে যাওয়ার তোয়াক্কা না করে ওকে প্রাণপণে বোঝানোর চেষ্টা করে যেতে লাগলাম।কিন্তু ওর আর আমার মাঝে ভুল বোঝাবুঝির যে কংক্রিটের দেওয়াল এই কদিনে তারা তুলে দিয়েছে সেটা একচুলও ক্ষয় করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হলাম আমি।আমার সম্বন্ধে খারাপ কথা বলে ওরা যে মল্লিকার কান বিষিয়ে তুলছে সেটা আমি জানতাম।কিন্তু আমাদের সম্পর্কটাকে জ্যান্ত সমাধিস্থ করার উদ্দেশ্যে ওরা যে এতখানি নীচে নামতে পারে...আমার চরিত্র সম্পর্কে এতটা কদর্য গল্প তৈরি করে সেটা দিয়ে মল্লিকার মনে ভরে দিতে পারে তাল তাল গরল...শুধুমাত্র আমার থেকে নিজেদের পরিবারকে মেয়েকে আলাদা করার জন্য...এটা ভাবতেও আমার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করছিল।টাকা আর সমাজের বুকে প্রতিপত্তি মানুষকে এমনভাবেই ভুলিয়ে দেয় নিজের সমস্ত গন্ডি...যে তারা পাপপুন্যের হিসেবনিকেষেরও পুরোপুরি উর্দ্ধে উঠে যায়।এভাবে আরো বেশ কিছুক্ষণ আমাদের মধ্যে তুমুল তর্কাতর্কি চলল।মল্লিকার বাপের বাড়ির লোকেরা সব ভাড়া করা সাক্ষীসাবুদ নিয়ে এসে মেয়ের সামনে এমন এক ভ্রমের মহল তুলে দিয়েছে যে এর বাইরে সামান্য উঁকি দিয়ে দেখবার জায়গাটুকুও পাচ্ছে না।ও কোনোমতেই আমার কোনো কথা বিশ্বাস করল না।আজ বুঝলাম...ওর আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ কোনো পরপুরুষের প্রতি আসক্তি নয়...।স্রেফ আমার প্রতি তীব্র অবিশ্বাস।আর তার জেরেই ও নিজের বাপের বাড়ির পছন্দ করা ছেলের সাথে নিজেকে এক করে দিতে দুবার ভাবেনি।আমার কাছ থেকে বিচ্ছেদ নিয়ে সে তাকে বিয়ে করেছে শুধুমাত্র আমার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাওয়ার জন্য।আমার স্ত্রী আমায় ভুল বুঝে না হয় একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে না হয় আমার থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে।আমি তার জন্য অপেক্ষা করতাম দশ বছর...বিশ বছর...পঞ্চাশ বছর...।একদিন তার ভুল ভাঙবেই এটা আমার থেকে ভালো কারোর জানার কথা নয়।কিন্তু এক্ষেত্রে ওর এই ভ্রম থেকে বেরিয়ে আসার কোনো রাস্তাই আর এ জীবনে অন্তত খোলার সম্ভবনা নেই...এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।সামাজিক প্রতিপত্তিশালী ওর পরিবার কোনোদিনই ওকে আর আমাকে একসাথে দেখতে পারবে না।এই ভ্রমের মহল তৈরি করেছে যারা...বাকি জীবনটা তাঁরাই এটাকে জিইয়ে রাখবে।একটা সময় পরে হয়তো ওর আর আমার দুজনেরই বয়স হয়ে যাবে আর তখন এই পরিস্থিতি আর থাকবে না...কিন্তু তখন লোকলজ্জার ভয়ে ও কোনোদিনই আমার মুখোমুখি পর্যন্ত হওয়ার সাহস পাবে না।আভিজাত্যের ওই ঘেরাটোপের ভিতরে ও পুরোপুরি আটকা পড়ে যাবে যেটা অতিক্রম করার ক্ষমতা আমারও কোনোদিনই হবে না।কাজেই এ জন্মে যে আর মল্লিকাকে আমি পাব না...এটা আমি পাকাপাকিভাবে বুঝে গেলাম।আমার মাথায় যেন খুন চেপে গেল।মল্লিকাকে ছাড়া জীবন যে মৃত্যুযন্ত্রনার চাইতেও যন্ত্রনাময়...।আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।গোটা পৃথিবীটা যেন চোখের সামনে ফুটিফাটা হয়ে যেতে শুরু করল।একটা জিনিস ততক্ষণে আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল...আমি যদি মল্লিকাকে নিয়ে এখান থেকে বেরোতে পারি,তাহলেই জীবনের মানে রয়েছে।আর তা যদি সম্ভব না হয়...তাহলে আমার বা মল্লিকার কারোরই জীবনের কোনো অর্থই নেই।আমি আমার ভিতরের যত যন্ত্রনা...যত আকুতি ছিল সমস্তটাকে এক জায়গায় জড়ো করে এনে মল্লিকাকে চেপে ধরে শেষবারের মতো চাপা অথচ ভয়ঙ্কর রকমের দৃঢ়স্বরে শুধোলাম...সে আমার সাথে যেতে চায় কি না...।সে উত্তরে ঘৃণাভরে আমায় জানিয়ে দিল...প্রাণ থাকতে সে আর নিজেকে এভাবে অপবিত্র করতে পারবে না।আমি দাঁতে দাঁত ঘষে হিসহিসে কন্ঠে বলে উঠলাম...তবে মরো...।

আমার চোখ চলে গেল রান্নাঘরের একপাশে রাখা কেরোসিনের বোতলটার দিকে।আমি উন্মাদের মতো ছুটে গিয়ে প্রথমে চারপাশে সমস্ত দরজা জানলা বন্ধ করে  ফেললাম।মল্লিকা আমার এমন রোখ চেপে বসা মূর্তি দেখে সাময়িকভাবে একটু হতভম্ব হয়ে গেল।সমস্ত দরজা জানলা বন্ধ করে ফেলে আমি কেরোসিনের বোতলের ঢাকনাটা এক ঝটকায় খুলে ফেললাম।মল্লিকা কিছু বুঝে ওঠবার আগেই আমি হরহর করে সারাঘরে কেরোসিন ঢালতে শুরু করলাম।মল্লিকা এবার পুরো পরিষ্কার বুঝে গেল...কি হতে চলেছে।ও চিৎকার করে ওঠবার আগেই আমি ফস্ করে দেশলাইটা ধরিয়ে নিয়ে সেটা ফেলে দিলাম মেঝেতে।তারপর বহুদিনের শ্রান্তি আর জীবন নামের এই বোঝা কাঁধ থেকে নেমে যাওয়ার প্রশান্তিতে একবুক স্বস্তির শ্বাস ফেলে মৃত্যুর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে গোটা দুনিয়া জগতকে এক লহমায় একপাশে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নিস্পৃহ আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম মৃত্যুর অপেক্ষায়।কিন্তু মৃত্যুও যেন আমার প্রতি বড়ো নিষ্ঠুর।সেও আমার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল।আমার মুক্তি হল না।বন্ধ ঘরের ভিতর তীব্র ধোঁয়ার দাপটে যখন আমি জ্ঞান হারাতে শুরু করি...ঠিক তখনই চারপাশে দরজা জানালায় প্রচন্ড ধাক্কাধাক্কির শব্দ আরম্ভ হয়।তারপর আর কিছুই মনে নেই আমার।যখন আমার জ্ঞান ফেরে,তখন চোখ মেলে দেখি আমি হাসপাতালের বেডএ শুয়ে।আমার শরীরের অনেক জায়গাতেই পুড়ে গিয়েছে।পরে জানলাম বাংলোয় আগুন ধরেছে,এটা স্হানীয় কিছু লোকজনের চোখে পড়ে যায়।তারাই চটজলদি আরো কিছু লোকজন জড়ো করে বাংলোর দরজা জানলা ভেঙ্গে ঢুকে উদ্ধার করে আমাদের দুজনকে।আমি উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করি...মল্লিকা কেমন আছে?

তাদের কাছে সেদিন মল্লিকার মৃত্যুসংবাদ শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।অদৃষ্ট আমায় এ কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করাল...!মল্লিকার সাথে তো আমিও মরতে গিয়েছিলাম।দুজনে একসাথে বাঁচার যখন আর কোনো উপায়ই বাকি ছিল না...তখন সেই মূহুর্তের অশান্ত উচাটন মন আমায় এই পথই বাতলে দিয়েছিল।কিন্তু আজ আমার জন্য অকালে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল মল্লিকা...আর সেই পাপের বোঝা নিয়ে আমায় এখন বাকি জীবনটা পার করতে হবে...এটা ভাবতেই আমার যেন পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল।আমার মনে হল...এ জীবন রাখার কোনো মানে হয় না।বাকি জীবন বিবেকের দংশনে তিল তিল করে মৃত্যুর যে ভয়াবহ যন্ত্রনা...তার থেকে এক মূহুর্তের মধ্যে রেহাই পাওয়ার জন্য আমার মনটা আকূল হয়ে উঠল।হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেই যে আমি পাকাপাকিভাবে পৃথিবীর সাথে সমস্ত সংযোগ ছিন্ন করে মল্লিকার কাছে চলে যাব...এ বিষয়ে মনে মনে প্রস্তুত হয়ে গেলাম।যথা সময়ে হাসপাতাল থেকে আমার ডিসচার্জ হয়ে গেল আর আমি সিকিমের পর্ব চুকিয়ে দিয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঘরে ফেরার ট্রেন ধরলাম।সবাই ধরে নিয়েছে ওই বাংলোয় কোনোভাবে দুর্ঘটনাবশত আগুন লেগে এমন ঘটনা ঘটেছে।ফাঁকা বাংলোতে মল্লিকার সাথে আমি কি করছিলাম সেটা নিয়ে কানাঘুষো হয়েছে প্রচুর।তবে মল্লিকার স্বামীও নাকি আর ব্যাপারটাকে বেশি বাড়তে না দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই সিকিম থেকে ফেরার ট্রেন ধরে নিয়েছিল।এই ব্যাপারটা আমায় বেশ একটু ধাঁধায় ফেলেছিল ঠিকই...কিন্তু আর এ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাইনি।জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটার সাথে নিজের ঘরের চেনা বাতাস...চেনা গন্ধটা জড়িয়ে নেব...এই চিন্তা নিয়েই রওনা দিলাম মুর্শিদাবাদের অভিমুখে নিজের ঘরের টানে।কিন্তু প্রতিবারের মতোই এবারও অদৃষ্ট আমার সাথে উল্টো ছকে খেলা আরম্ভ করল।ঠিক যেভাবে লেলিহান অগ্নিশিখার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মুক্তির জন্য বুভুক্ষু একজন মানুষকে ফের ঠেলে দিল যন্ত্রনাময় জীবনের মুখে...ঠিক সেভাবেই ফের চিরমুক্তির শান্তি আমার সাথে লুকোচুরি খেলে আমায় ফাঁকি দিয়ে চলে গেল।অন্তিম শ্বাস ফেলে মুক্তিলাভ করার সৌভাগ্য আমার হল না।ঘরে পৌঁছোতেই আমার হাতে এল একটা লম্বা চিঠি।হাতের লেখা চেনা চেনা ঠেকল।হ্যাঁ।আমার অতি পরিচিত একটি মানুষের হাতের লেখা এটি।আমার আপন কাকা দীর্ঘ বছর পরে আমায় মনে করে লিখছেন...উনি সস্ত্রীক ব্যাঙ্গালোরে চলে যাচ্ছেন ভালো চাকরি পেয়ে।সেখানে গিয়ে নতুন জীবন গুছিয়ে নেওয়া...ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তির ঝামেলা...আর সর্বোপরি সেখানে কতগুলি কর্মব্যস্ত মানুষের মাঝখানে তার বৃদ্ধা মায়ের কোনো ভূমিকাই নেই।গ্রামের বাড়িটাও কাকা একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে বিক্রীটিক্রী করে ইতিমধ্যেই কাগজে কলমে হাতবদল করে দিয়েছেন।এখন বৃদ্ধা মায়ের দায়িত্ব আর তিনি নিতেই চাইছেন না।এখন তিনি ওনার সমস্ত দায়িত্ব আমার হাতে তুলে দিয়ে হাত ঝেড়ে নিতে চাইছেন।কাকার স্বার্থপরতা আর নীচতা এক নিমেষেই স্পষ্ট হয়ে গেল আমার কাছে।আর এটাও পরিষ্কারভাবেই বুঝতে পারলাম...এখন আমিও যদি ওই অশীতিপর বৃদ্ধার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিই...তাহ‌লে এখন ওনার স্হান হবে হয় রাস্তায়...নয় বৃদ্ধাশ্রমে।চিঠিটা পড়বার পর সেটা ভাঁজ করতে করতে বুঝলাম...এত সহজে মুক্তি আমার কপালে নেই।এখন একটা মানুষের শেষ জীবনের দায়িত্ব চলে এসেছে আমার কাঁধে।অতএব কি আর করা...আমার নিজের সমস্ত শূন্যতা আর যন্ত্রনা একপাশে চাপা রেখে দিয়ে ফের ব্যাগপত্র গোছাতে শুরু করলাম ঠাকুরমাকে আনতে যাওয়ার জন্য।

আমার এই ছোট্ট একচালার ঘরটাতে ঠাকুরমাকে নিয়ে একটা নতুন সংসার শুরু হল।এই বয়সে বৃদ্ধা ঠাকুরমা পুরোপুরিই অথর্ব হয়ে গিয়েছেন।ওনাকে খাওয়ানো থেকে ওনার প্রাকৃতিক কার্যাদির দায়দায়িত্বও এখন অন্যকে নিতে হয় এমনই অবস্হা।কাকা আর কাকিমা এমন অবস্হায় তো নিজের মাকে কারোর একটা হাতে গুছিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে তাদের সংসার সন্তান নিয়ে ব্যাঙ্গালোরে পাড়ি দিয়েছেন।আর এখানে আমি একদিকে আমার কাজ আর অপরদিকে এই বৃদ্ধা মানুষটার দেখভালের দায়িত্ব নিয়ে পুরো হিমশিম খাচ্ছি।তার ওপর আমি যা বুঝলাম...ঠাকুরমার শরীরে একটা বড়সড় রোগ বাসা বেঁধে বসে আছে।ডাক্তার দেখাতে তিনি পরামর্শ দিলেন...ঠাকুরমাকে বাঁচাতে চাইলে তাঁর শহরে গিয়ে একটা ভালো চিকিৎসার প্রয়োজন।আর এর জন্য টাকা দরকার প্রচুর।আমি পড়লাম ভীষণ রকম বিপদে।এক তো ঠাকুরমাকে এই অবস্হায় ঘরে রেখে দুটো পয়সা রোজগারের জন্য আমায় ঘর থেকে বেরিয়ে কাজ করতে যেতে হচ্ছে।তার ওপরে এই পরিস্থিতিতে এককালীন এত টাকা আমি পাব কোথায়!আমার মাথায় তখন একটাই উপায় এল।আমার এক বন্ধুকে বলে ওর সোর্সকে কাজে লাগিয়ে কলকাতায় একটা চাকরির ব্যবস্হা করলাম।আর অল্পদিনের মধ্যেই ঘরে চব্বিশ ঘন্টার একটা আয়া রেখে আমি তল্পিতল্পা গুটিয়ে কলকাতায় চলে আসলাম চাকরি করতে।একটা অসহায় বৃদ্ধা মানুষ বেঁচে রয়েছে শুধুমাত্র আমারই ওপর নির্ভর করে।এই বৃদ্ধা মানুষটা যাতে শেষ জীবনে আর না কষ্ট পায়...সেটা দেখাই এখন আমার দায়িত্ব আর কর্তব্য।তাঁকে আয়ার দায়িত্বে রেখে দূরপাল্লার ট্রেনে চেপে চলে এলাম টাকা রোজগারের জন্য...কলকাতা মহানগরীর বুকে।আমার নিজের ব্যক্তিগত। জীবন...তার সমস্ত কথা...যন্ত্রনা বড় শীঘ্রই আমার কাছে ঝাপসা হয়ে আসছিল।কলকাতায় এসে থাকবার একটা ব্যবস্হা করে থিতু হতে আমার বেশ কিছুটা সময় লাগে।মুর্শিদাবাদের পাড়াগাঁয়ের ছেলে আমি।হঠাৎ রাতারাতি এই ব্যস্ত শহরের জীবনযুদ্ধে নেমে আমার চোখ রীতিমতো ধাঁধিয়ে যায়।কর্মব্যস্ত এই শহরের বুকে কিছু টাকা রোজগারের জন্য এসে আমি আমার ফেলে আসা অতীত ও জীবন যন্ত্রনা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম।আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি যে মুর্শিদাবাদ হতে কলকাতায় চাকরি করতে এসে এইভাবে আমার ফেলে আসা অতীতের মুখোমুখি হতে হবে আমাকে।আমি এই ঘরে ভাড়া থাকি।আমি ইচ্ছে করলেই একটু খোঁজখবর করে আমার থাকার অন্যত্র একটা ব্যবস্হা করে নিয়ে এই ঘর ছেড়ে দিতে পারি।কিন্তু একটা কোনো অমোঘ বাঁধনে আমি যেন আপাদমস্তক আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়ে গিয়েছি বিছানার তলায় সকলের দৃষ্টির অগোচরে থাকা ওই চৌকোনা গর্তের বন্ধ ডালাখানি প্রতিরাতে যেন ঘাড় ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে আমায় নিয়ে আসে নিজের কাছে।ওই ডালাতে আটকানো তালাটাও...এই নির্জন নিরিবিলি একতলার ঘরে থেকে আমার পক্ষে কোনো একটা কৌশলে খোলাটা হয়তো পুরোপুরি অসম্ভব নয়।কিন্তু ওরকম কোনো চেষ্টা করার কথা ভাবলেই আমার যেন রক্তহিম হয়ে আসে।একটা ভয়...আতঙ্ক...এবং আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে একটা ভয়ংকর বিবেক দংশন আমায় তাড়িয়ে নিয়ে আসে সেখানে।আমি শুধু প্রতিরাতে আমার বিছানার তলায় ওই তালাবন্ধ ডালার ওপরে কান রেখে শুনি মল্লিকার আর্তধ্বনি।মরার সময়টাতেও যে কন্ঠস্বরে আমার জন্য শুধুমাত্র তীব্র ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই ছিল না...আজ সেই কন্ঠস্বরেই আমাকে উদ্দেশ্য করে ভেসে আসে কাতর আকুতি।"এখানে থেকো না...চলে যাও...চলে যাও এখান থেকে...।"আমি কোনোকিছুর তল খুঁজে পাই না।আবার এই ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলেও যেতে পারি না।আজকাল কাজেও মন বসাতে পারি না ঠিকভাবে।ওর বিদেহী আত্মা বোধহয় কিছু বলতে চায় আমাকে।আমাকে ওর কথা শুনতে হবে।ওর আত্মা এই ঘরে...এই বন্ধ ডালার নীচে কি করে বন্ধ হল এটা আমাকে জানতেই হবে।এই বাড়ির ভিতরের পরিবেশটাও আমার কাছে আজকাল বড় অদ্ভুত ঠেকে।আতিথেয়তা ও বিনয়ী প্রতিমূর্তির আবরণধারী বাড়ির মালিকের চোখের চাহনিটা যেন মাঝে মাঝে শিকারের ফাঁদ পেতে বসে থাকা নেকড়ের মতো মনে হয়।আর বাড়ির চাকর দীনবন্ধুর আচার আচরণেও আমি প্রচুর অসংগতি দেখতে পাই।এই বাড়ির ভিতরে একটা রহস্য আছে।মল্লিকার আর্তধ্বনির মর্মার্থ উদ্ধার করতেই হবে আমাকে।এই বাড়ির প্রতিটি দেওয়ালে...প্রতিটি ইঁটের পাঁজরে লুকিয়ে থাকা গহিন রহস্যের উদঘাটন করাই এখন আমার পাথেয়।

ভীড়ের মাঝে থেকেও খোলা জানালায় নীল আকাশের অসীমতার ঢেউএ হারিয়ে যায় আমার চোখের দৃষ্টি।এমন অন্যমনস্কতার জন্য উপরতলা হতে তিরস্কৃতও হই আজকাল মাঝে মাঝে।সত্যি বলতে কি...আমার জীবন সম্বন্ধে এখানে কেউই বিশেষ কিছু জানে না বা আমিই কাউকে নিজের সম্বন্ধে পরিষ্কার করে কিছু বলিনি।সবাই এটাই জানে...আমি অবিবাহিত।তায় আজকাল আমায় এমন আনমনা হতে দেখে সকলেই আমায় নিয়ে বিভিন্ন হাসি তামাশায় মেতে ওঠে।তবে এই সবকিছুর উর্দ্ধে উঠে গিয়ে আমার মন শুধু উচাটন হয়ে খোলা আকাশের বুকে ছুটে যায় বারে বারে।কানে যেন বেজে ওঠে মল্লিকার সেই মর্মভেদী কাতর আকুতি...

"এখানে থেকো না...যাও...যাও...চলে যাও এখান থেকে...।"আমি শুধু তীব্রভাবে অনুভব করার চেষ্টায় ব্যাকুল হয়ে উঠি ওর অন্তরের অমন উন্মাদ ব্যাকুলতাকে।ওর কথা মেনে নিয়ে এখান থেকে চলে যাওয়াটা তো আমার পক্ষে সম্ভব নয় কোনোমতেই।প্রতি রাতে আমি খাটের নীচের ওই তালাবন্ধ চৌকোনা ডালাটার উপর আপাদমস্তক ঝুঁকে পড়ে শুধু মল্লিকার আর্তচিৎকার শুনি আর তার মর্মার্থ উদ্ধার করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠি।তবে...যত দিন যায়...আমার বিস্ময় যেন তত বাড়তে থাকে।কারণ আজকাল ডালাবন্ধ। ওই কুঠুরি হতে শুধুই যে মল্লিকার কন্ঠ শুনতে পাই তা নয়...ধীরে ধীরে আমার কানে স্পষ্ট ভেসে ওঠে মল্লিকার নারীকণ্ঠসহ আরো কিছু পুরুষকন্ঠের একই ব্যাকুল আর্তচিৎকার।"বাঁচতে যদি চাও...পালাও এখান থেকে।এবার আমি দৃঢ়ভাবে অনুভব করলাম...নাঃ...এতদিন ধরে পড়ে থাকা এই বন্ধ ঘরের এই অন্ধ কুঠুরির দরজাটা খোলার বা ভাঙার মতো মনের জোর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার ভিতরে আনতে হবে।তবে এ দরজার যা কলেবর...তাতে এটা ভাঙাটা যে একেবারেই সহজ কাজ হবে না সেটা স্পষ্ট।আর যদিও বা ভাঙার চেষ্টা করা হয়...শব্দ হওয়াটা তো আর আটকানো যাবে না...।ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে যে আমার জন্য কোনো ভয়ঙ্কর বিপদ ওৎ পেতে থাকবে সেটা আমি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারছি।অতএব কাকপক্ষীতে যাতে টের না পায়...এমনভাবে এ দরজা আমাকে খুলতে হবে।কিভাবে এটা সম্ভব করব সে বিষয়ে বিভিন্ন চিন্তাভাবনা করতে গিয়ে হঠাৎ আমার এ বাড়ির বৃদ্ধ চাকর দীনবন্ধুর কথা মাথায় এল...।ওকে দেখলে যথেষ্ট গরীব বলেই মনে হয়।এই বাড়ির কাজে সে ঢুকেছে,তা বেশিদিন হয়নি।এই বাড়ির প্রতি ওর যথেষ্ট অনুগত্য থাকলেও অমন উস্কোখুস্কো চুল আর ছেঁড়া পোশাক পরা ঘর্মাক্ত চেহারার দীনবন্ধুর হাতে যদি অল্প কিছু কাঁচা টাকা ধরিয়ে দেওয়া হয়...তাহ‌লে সেই লোভ ও কতখানি সংবরণ করতে পারবে...তাতে ঘোরতর সন্দেহ আছে।কাজেই...আর দেরি না করে আসল কাজটা এবার কিভাবে করব,সেটা নিয়েই মোটামুুটি একটা পরিকল্পনা আমি সেরে নিলাম।সেদিন রাতে আর দীনবন্ধুকে দিয়ে আমার রান্না করালাম না।বাইরে থেকে মাংস কষা আর রুটি কিনে আনলাম রাতে খাবার জন্য।খাওয়াটা একটু তাড়াতাড়ির মধ্যে সেরে নিয়ে আমি দীনবন্ধুকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠালাম।এই সময়টায় ও আমার রাতের রান্নার যোগাড় নিয়ে ব্যস্ত থাকে।সেদিন সেই কাজ থেকে ছুটি পাওয়াতে ওই সময়টাতে ও একটু আরাম করে বসে রেডিও শুনছিল।আমি তখন একটা জিনিস মনে মনে বেশ গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলাম...কলকাতার বুকে যে কটাদিন বাস করছি...তাতে চারপাশে যেমন দেখি...এখানে বাড়িওয়ালা আর ভাড়াটের মধ্যেকার সম্পর্ক যে কোনোকালেই মধুর নয়...সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।একটু ঠিকমতো বাঁচার জন্য নূন্যতম কিছু সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য বাড়িওয়ালার সাথে প্রতিনিয়ত ঝামেলা ঝগড়া করে চলতে হয় ভাড়াটেদের।আর আমার এমনই সোনায় বাঁধানো কপাল...যে উত্তর কলকাতার এই পুরোনো রাজকীয় সুবিশাল বাড়িটিতে আমায় রীতিমতো জামাই আদর করেই রাখা হয়েছে বলা চলে।বাড়ির নীচের তলার সবথেকে বড়,সুন্দর আর প্রায় রাজকীয় একখানি ঘর বাড়িওয়ালা নিজে বরাদ্দ করেছেন আমরা জন্য।সাথে নিজের খাস চাকর দীনবন্ধুকে দায়িত্ব দিয়েছেন...আমার যাতে কোনোকিছুতে কোনো অসুবিধা না হয়...সেদিকে লক্ষ্য রাখার,আর সাথে আমার জন্য সকালের জলখাবার আর রাতের খাবার তৈরি করে রাখার দায়িত্বও দিয়ে রেখেছেন।আর দীনবন্ধুও বেশ যত্ন আর নিপুণতার সাথেই পালন করে চলেছে সেই কর্তব্য।এতদিন তো ওর দায়িত্ব ছিল শুধুমাত্র এই বাড়ির কর্তার ফাইফরমাশ খাটা আর তাঁর দেখভাল করা...আর এখন ঘরে একজন বাড়তি লোকের দায়িত্ব হঠাৎ করে ওর ঘাড়ে এসে পড়ায় ও এতটুকু অসন্তুষ্ট তো নয়ই...উপরন্তু আমার উপরে যথেষ্টই যত্নশীল।কলকাতায় পা রাখা ইস্তক একটা থাকবার জায়গার জন্য বিস্তর ঝামেলা পোহানোর পর মেঘ না চাইতে জলের মতোই এভাবে এমন সুযোগ সুবিধা পেয়ে যাওয়ায় আমার মাথা থেকে অনেকখানি বোঝা নেমে গিয়েছিল আর আমিও আমার কাজে মন বসাতে শুরু করেছিলাম ভালোভাবে।আলাদা করে কোনোকিছু নিয়েই আর মাথা ঘামাইনি।তবে এই পাড়ার ভিতরে কানাঘুষোয় রাতারাতি কিছু মানুষের রাতারাতি নিখোঁজ হওয়ার ফিসফাস টুকরো খবর আমার কানে এসেছে এবং বেশ কিছু মানুষের সন্দেহের তীর যে এই বাড়ির মালিকের প্রতি...সেটা আমার অজানা ছিল না।তবে বাতাসে ভেসে আসা এসব উড়ো গুঞ্জনে আমি আর কান দিইনি।কিন্তু পরের দিকে এই বাড়ির মালিকের সাথে সাথে আর তার এই বৃদ্ধ চাকর দীনবন্ধুর আচার আচরণে যে আমিও কিছু সন্দেহজনক ইঙ্গিত পাইনি...সেটা বললে ভুল হবে।ওর ভিতরে কোনোকিছু প্রাণপণে চেপে রাখার একটা নিদারুণ ভীতি সবসময় যে কাজ করে সেটা আমি কোনোভাবে যেন বুঝতে পারি।ওর সাথে একটু মোলায়েমভাবে আর একটু চাতুরীর সাথে কথা বলে হয়তো কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাবে।আর সেই সাথে কিছু টাকার লোভ দেখিয়ে একবার যদি মেঝের ওই বন্ধ কুঠুরির দরজার চাবিটা হাতে করতে পারি...তাহলে তো আর কথাই নেই!আমি আস্তে করে রান্নাঘরের দরজার পাশে গিয়ে চাপাস্বরে ডাকলাম..."দীনবন্ধু...দীনবন্ধু...!"

রান্নাঘর থেকে ক্ষীণকন্ঠে সাড়া এল।"আজ্ঞে যাই দাদাবাবু..."


এরপর হাত কচলাতে কচলাতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে দীনবন্ধু চিন্তিত স্বরে বলল...আজ্ঞে দাদাবাবু...হঠাৎ এই সময়ে...কোনো সমস্যা হয়েছে?আমাকে বলুন...আপনার কোনো চিন্তা নেই।"


আমি হেসে বললাম..."না না দীনবন্ধু...কোনো সমস্যা হয়নি।তোমার বাবু বুঝি আমার দেখভাল ঠিকভাবে না হলে তোমার গর্দান নিয়ে নেবেন!"


আমার মুখে এমন কথা শুনে বেশ খানিক নিশ্চিন্ত হয়ে...তারপর ফিক করে হেসে দীনবন্ধু বলল..."আজ্ঞে না দাদাবাবু...তা নয়।আপনি তো এই বাড়ির অতিথি...আর অতিথি তো নারায়ণ।তাই আপনার যাতে কোনো অসুবিধা না হয়...সেইটা দেখা তো আমার কর্তব্য।"


জল যে আসলেই কতখানি গভীর...সেটা আমি যতটা সম্ভব অনুধাবন করবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মুখের অভিব্যক্তিতে একটা স্মিত হাসি রেখে বললাম..."তুমি আমার অনেক দেখভাল করো...বিনিময়ে আমি তোমায় আজ পর্যন্ত কিছুই দিইনি।তাই আজ তোমায় কিছু বখশিশ দেব।"

এই বলে পকেট থেকে কিছু টাকার নোট বার করে দীনবন্ধুর দিকে এগিয়ে ধরলাম।টাকার পরিমাণটা যেরকম ছিল...তাতে করে, দীনবন্ধুর মতো হতদরিদ্র মানুষের আপাদমস্তক চেহারা...চালচলন আর পোশাকআশাক দেখার পরে...আমার মনে হয়েছিল...কোনোরকম বাক্য খরচ করার প্রয়োজনীয়তা না রেখেই ও খপাৎ করে আমার হাত থেকে লুফে নেবে সেগুলো।কিন্তু না...ওরকম কিছুই হল না।বরং দীনবন্ধুর অভিব্যক্তির মধ্যে দেখলাম...একটা তাচ্ছিল্যপূর্ণ ঔদাসীন্য।সে বলল...ও টাকা আপনি নিজের কাছে রাখুন দাদাবাবু...কলকাতা শহরে থাকতে গেলে টাকা পয়সার প্রয়োজন হয়।আর আমি বুড়ো হয়ে মরতে বসেছি...এখন আর টাকা নিয়ে কি করব!আমি বরং আপনার বিছানাটা করে দিয়ে আসি গে।রাত অনেক হল।"

দীনবন্ধুুর এমন কথা আর এমন আচরণ বেশ অবাক করল আমায়।আমি এবার দীনবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করে করলাম..."তুমি এই বাড়িতে কাজ করে যা মাইনে পাও...তাতে চলে তোমার?"

এবার দীনবন্ধু উত্তরে যা বলল,সেটা শুনে আমি তো আরো অবাক।দীনবন্ধু বলল...আজ্ঞে দাদাবাবু...আমি তো এ বাড়িতে কাজ করার জন্য টাকাপয়সা কিছু নিই না...আমি বুড়ো মানুষ...তিনকূলে কেউ নেই।এই বাবু যে আমায় নিজের বাড়িতে কাজটাজ দিয়ে খেতে পরতে দিচ্ছেন...এটাই আমার কাছে অনেক।"

আমি মহা ঝামেলায় পড়লাম...একে তো টাকাপয়সার লোভ দেখিয়ে কোনো লাভ নেই।তাহলে আমার কাজ হাসিল করার বিকল্প উপায় কি হতে পারে!দীনবন্ধু আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছে।আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসে গেল।বরং আমার বিছানাটা করে দেওয়ার জন্য দীনবন্ধুকে সরাসরি আমার ঘরে আসতে বলে নিজের ঘরের দিকে এগোলাম।সেও বিনাবাক্যব্যয়ে হুকুম তামিল করার জন্য আমার সাথে চলল।ঘরে ঢুকে যখন দীনবন্ধু যখন আমার বিছানায় টান টান করে চাদর পাততে ব্যস্ত...তখন আমি নিঃশব্দে গিয়ে দরজায় ছিটকিনি তুলে দিলাম।ছিটকিনির শব্দ পেয়ে দীনবন্ধু একটু চমকে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।আমি আর ভনিতা না করে সরাসরি তাকে বললাম...আমার বিছানার নীচে যে একটা বন্ধ কুঠুরির দরজা রয়েছে...সেটা আমি টের পেয়েছি এবং দেখেওছি।ওই কুঠুরির দরজা খোলার চাবিটা যদি তোমার মালিককে লুকিয়ে আমাকে দাও...তাহ‌লে আমি তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকব।এই বলে আমার গলা থেকে সোনার চেনখানা খুলে ওর দিকে এগিয়ে ধরলাম।হঠাৎ দেখলাম...দীনবন্ধুর মুখচোখের নক্সাই পুরোপুরি পালটে গেছে।ওর ওই ছাপোষা নিরীহ চেহারার ভিতরে যেন একটা নেকড়ে তেড়েফুঁড়ে ফুঁসে উঠেছে। ওর দুচোখে জ্বলে উঠেছে আগুন।আমি বিস্ময়টা সামলে ওঠার আগেই দীনবন্ধুর তেল মশলা আর কালিঝুলি মাখা ওই দুইহাত হঠাৎ প্রবলভাবে চেপে ধরল আমার গলা।আমার দমবন্ধ হয়ে আসবার উপক্রম হল।গলা দিয়ে শব্দ বার হওয়ার রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ।এই প্রথমবার বুঝলাম...দীনবন্ধুর এই হাতের কব্জিতে যা জোর...তাতে তাবড় তাবড় পালোয়ানও ঘোল খেয়ে যাবে।জিভ বার হয়ে পড়ল আমার।প্রাণটা একেবারে বার হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে যখন...তার মধ্যেও যা চোখের সামনে দেখলাম...তাতে এবার সত্যিই আমার হার্টফেল হয়ে আসার উপক্রম হল।দীনবন্ধু প্রবল জোরে আমার গলা চেপে ধরার সময়ে এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছে...যে প্রায় কাঁপছে থরথর করে।নিজেকে নিজের ভিতরে ধরে রাখতে পারছে না যেন।কোনো এক অজ্ঞাত নগ্নতা ঢেকে রাখার কাপড় হঠাৎ সরে যাওয়াতেই যে তার ভিতর হতে এই রূপ বেরিয়ে এসেছে...সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম আমি।এরপর আমাকে বিছানার মধ্যে জোরে ফেলে দিয়ে আমার দুইকাঁধ ঝাঁকিয়ে ক্রোধান্বিত স্বরে শুধালো সে..."ওই কুঠুরির ব্যাপারে কি জেনেছিস তুই...বলে ফ্যাল ভালোয় ভালোয়...!"

আমি অবাক হয়ে দেখতে থাকলাম...প্রবল ঝাঁকুনির ফলপ্রসূ দীনবন্ধুর মুখ থেকে খসে অল্প ঝুলে পড়েছে ওর নকল কাঁচাপাকা গোফদাঁড়ি...!"

আমি তখন পরিষ্কার দেখলাম...বৃদ্ধ দীনবন্ধুর চির পরিচিত বয়সে জর্জরিত ভগ্ন বার্ধক্যের অবয়বের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক বছর ত্রিশের প্রবল বলশালী এক যুবকের এক রক্তপিপাসু হিংস্র চেহারাখানি।সে তখন দুইহাতে সবলে আমার কন্ঠরোধ করে থরথর করে কাঁপছে প্রবল ক্রোধে।আর এই ক্রোধ যে ভয় থেকেই জন্ম নিয়েছে...সেটা আর বুঝতে আমার বাকি রইল না।তবে আমি যে কি বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি...সেটাও আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল সাথে সাথেই। আর যাই হোক...এই সাংঘাতিক শক্তির সাথে পেরে ওঠা আমার পক্ষে কোনোমতেই সম্ভব নয়।আর হলও তাই।দীনবন্ধু আমাকে ওর প্রবল বলশালী দুই বাহু দ্বারা আমাকে কব্জা করে ধরে একটা শক্ত দড়ি দিয়ে আমার হাত পা একেবারে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল অল্প সময়ের মধ্যেই।তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ঘরে যিনি চলে এলেন...তিনি হলেন বাড়িওয়ালা।এই বাড়ির মালিক।উনি দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই দীনবন্ধু চিন্তিত কন্ঠে বলে উঠল..."একে তাহলে এখনই ভিতরে ঢুকিয়ে দিই...কি বলিস...এখন এ ছাড়া তো আর কোনো রাস্তা নেই।

মনিবের সামনে হাত কচলানো চাকর মনিবকে তুইতোকারি করে সম্বোধন করে কথা বলছে দেখেও আমি আর অবাক হলাম না।পরিস্থিতি এমন জায়গায় মোড় নিয়েছে,এখন সবকিছুই সম্ভব।বাড়িওয়ালা ছেলেটি ঘর্মাক্ত আর ভয়ার্ত কন্ঠে বলল..."তোকে বার বার বলেছি...শেষ বলিটা আর কয়েকটা দিন দেরী করে দিলেও অসুবিধা নেই।আমার কথা তো আর তুই শুনবি না...তোর কথামতো সবকিছু করলাম...এখন একটা গড়বড় হয়ে গেলে পুলিশ তো এসে আমায় ধরবে!"


---আরে এত চাপ নিচ্ছিস কেন রে ভাই...!এ তো আজ নয় কাল নিখোঁজ হতই।এর খোঁজ করতে যাতে এখানে কেউ না আসে...তার ব্যবস্হাটা করা নেই বলেই তো চিন্তা তোর!আমি থাকতে তুই নিশ্চিন্ত থাক।ওর চাকরি ছাড়ার দরখাস্তে ওর সই আজকেই যোগাড় করে নিচ্ছি আমি।বলির দিন আসতে একমাস মতো বাকি বলে ভাবিস না...ততদিন ও এই কুঠুরির ভিতরেই বন্ধ থাকবে।তারপর অমাবস্যার রাতটা এলেই মায়ের পায়ে এক কোপে ফেলে দেব এর মাথা।ব্যস...আর কোনো চিন্তা থাকবে না আমাদের।যা...এখন চটপট এই খাট সরিয়ে কুঠুরির দরজার তালা খোলার ব্যবস্হা কর গিয়ে।"

বাড়িওয়ালা ছেলেটি চিন্তিত ও ভীত মুখে বিনা বাক্যব্যয়ে নিঃশব্দে দীনবন্ধুর আদেশ পালন করতে ব্যস্ত হল।

কি হচ্ছে...কেন হচ্ছে...এসব কোনোকিছুরই কোনো মাথামুন্ডু খুঁজে পেলাম না আমি।শুধু আমার বুকের ভিতরে দ্রুতগতিতে হাতুড়ি পেটার মতো ঢিপ ঢিপ শব্দ যেন আমার নিজের কানে এসে বাজতে শুরু করছিল।আমি এতটুকু পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছিলাম...আমার আর আস্ত থাকার কোনো আশাই নেই!আমি পুরো শেষ!"

নকল সমস্ত বেশভূষা এবার দীনবন্ধু খুলে ফেলে কুঠুরির দরজার তালা খোলার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।ছেঁড়া জামা খুলে ফেলার পর ওর হাট্টাকাট্টা চেহারা দেখে ভয়ে আমার হাত পা একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেল।আমি আমার নিজের নির্মম পরিণতির ভবিতব্য যেন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছিলাম। আমি ধীরে ধীরে সংজ্ঞা হারাতে থাকলাম।

কতক্ষণ পরে আমার জ্ঞান ফিরেছিল জানি না।কিন্তু আস্তে আস্তে যখন চোখটা মেলতে শুরু করলাম...চোখের সামনে শুধুমাত্র নিকষ কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই ছিল না।নতুন করে আমার আর ভয় পাওয়ার কিছু বাকি নেই।বরং আমি এর থেকেও আরো ভয়ঙ্কর কিছুর জন্যই মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম।তাই আর গলা দিয়ে কোনো আর্ত চিৎকার বা শব্দ আর বার হল না।বরং আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম,ঠিক কোন জায়গায় এখন আমাকে রাখা হয়েছে।হাত পা সব একেবারে শক্ত করে পিছমোড়া করে বাঁধা।এতটুকু নড়াচড়ার কোনো উপায় নেই।অদৃষ্টের হাতে নিজেকে এবার পুরোপুরি সঁপে দিয়ে এখন শুধু একটা জায়গায় বসে রইলাম চোখ বুঁজে।আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম,আমাকে সেই বন্ধ কুঠুরির ভিতরেই রাখা হয়েছে,যেখান থেকে প্রতিরাতে ভেসে আসত মল্লিকার কাতর আর্তধ্বনি।ও বার বার আমাকে সাবধান করত।"বলত..."বাঁচতে চাও তো চলে যাও এখান থেকে...চলে যাও...।"

আমি এতযুগ পরে আমার হারানো মল্লিকার গলা শুনে নিজেকে আর স্হির রাখতে পারিনি।সে শব্দ আকাশ...পাতাল যেখান থেকেই আসুক না কেন...এর উৎস খুঁজে বার করার জন্য আমি মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম।আর এমনিতেই আমার জীবনের প্রতি আর কোনো মায়া বা টান কোনোকিছুই আর অবশিষ্ট নেই...।এখন বেঁচে আছি শুধু একটা দায়িত্ব পালন করার জন্যই।কিন্তু আমার কাঙ্ক্ষিত মৃত্যু যে এতটা ভয়াবহভাবে আসতে চলেছে...তা আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।শেষ পর্যন্ত আমি এই বন্ধ কুঠুরির ভিতরে ঠিকই ঢুকতে পারলাম।কিন্তু এখন আমি পুরোপুরি অন্যের হাতের শিকার।আর এই বদ্ধ গুমোট অন্ধকার কুঠুরির ভিতরে আমি পুরোপুরি একা পড়ে রয়েছি।এই নিস্তব্ধ কুঠুরির ভিতরে এখন তো আর কোনো শব্দই আমার কানে আসছে না...।আমি মনে মনে চিন্তা করলাম৷এইটাই হয়তো উপরওয়ালার সঠিক বিচার।মল্লিকা কম যন্ত্রনা পেয়ে মরেনি।আর ওর সেই যন্ত্রনার অকাল মৃত্যু হয়েছে আমারই হঠকারী হাতে অতএব কোনো সহজ মৃত্যু আমার জন্য বরাদ্দ করেননি ওপরওয়ালা।আমার পরিণতি যাই হোক...সেটাকে মাথা পেতে নেবার জন্য আমি মনে মনে প্রস্তুত হতে থাকলাম।

কুঠুরির ভিতরটা শুধু বদ্ধই নয়।এর ভিতরে কেমন একটা অদ্ভুত ধরণের আঁশটে গন্ধ।গন্ধটা যে ঠিক কিরকম...সেটা ঠাহর করার চেষ্টা করলাম এক মনে।হঠাৎ আমার মাথায় বিদ্যুত চমকের মতো একটা ভয়াল অশনিসংকেত ভেসে উঠল।এ রক্তের গন্ধ।বহুদিন ধরে এই বদ্ধ কুঠুরির ভিতরে ভ্যাপসা হয়ে আসা রক্তেরই গন্ধ।

বদ্ধ কুঠুরির এই প্রচন্ড দমবন্ধ করা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের ভিতরে শ্বাস নেওয়াটাই যথেষ্ট কষ্টকর।সেই যে আমাকে পিছমোড়া করে বেঁধে এখানে ফেলে দিয়ে কুঠুরির ডালাখানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে,তারপর হতে যেন পার্থিব জগৎ সংসারের সঙ্গে আমার সমস্ত লেনাদেনা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।কুঠুরির দরজার ওপরে যে ঘরটায় আমি থাকতাম,সেটা তো সবসময়ই বন্ধ থাকে...আর আমি এই ঘরে থাকতে আসার আগে যে সে ঘর বহুকাল যাবৎ ব্যবহারই হয়নি...সেটা আর আমার বুঝতে বাকি ছিল না।কাজেই এমন এক পরিত্যক্ত ঘরের মেঝের তলায় অন্তর্নিহিত কুঠুরির ভিতরে বাইরের জগতের কোনো শব্দই প্রবেশ করার জায়গা না পাওয়ায় এই নৈঃশব্দ্য যেন আমায় গিলে খেতে শুরু করল।চোখের সামনেও শুধুমাত্র নিকষ অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই।কেবলমাত্র নিজের বুকের ঢিপঢিপ হৃদস্পন্দনটাই যেন দামামার মতো বাজতে থাকল আমার ভিতরে।এইভাবে তিল তিল করে মরার চাইতে যদি দীনবন্ধু আমার গলায় সত্যিই চালিয়ে দিত কাটারি...সেও যেন ভালো ছিল।প্রচন্ড অসহায় বোধ করতে শুরু করলাম।হাত পা সব ভয়ংকর শক্ত করে বাঁধা।আমি চোখ কান বুঁজে শুধুমাত্র আমার আসন্ন মৃত্যুর জন্য কাতরভাবে অপেক্ষা করতে শুরু করলাম।এইভাবে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম...খেয়ালই ছিল না।ধরে যাওয়া ঘুমটা ভাঙল একটা রোমশ আর বলিষ্ঠ হাতের রুক্ষ স্পর্শে।আমি টের পেলাম,আমার হাত পায়ের বাঁধন খোলা হচ্ছে।আস্তে আস্তে করে চোখ মেলে এই প্রথমবার আমি এই কুঠুরির ভিতরটা চাক্ষুষ করলাম।আর তাতে আমার বুকটা রীতিমতো ছ্যাঁৎ করে উঠল।একটা নিভু নিভু প্রদীপের আলো বসানো রয়েছে এই এই সুবিশাল পাতালকক্ষের একেবারে মাঝখানে...যার ম্রিয়মান শিখা আলোকিত করে রয়েছে এক ভয়ালদর্শন দেবীমূর্তি ও তার চারপাশে আয়োজিত পূজার সাজসরঞ্জামসমেত একটি যজ্ঞকুণ্ডকে।এই ম্রিয়মান ছোট্ট একখানি প্রদীপের নিভু নিভু আলো ছড়িয়ে পড়েছে এই বিশাল কুঠুরির প্রতিটি কোণায়...আর তার ওই ক্ষীণ আলোতেও রীতিমতো যেন ঝলসে উঠছে যজ্ঞকুণ্ডের অদূরে বহু পাপের রক্তে স্নান করা একটি হাঁড়িকাঠ।আর তার চারপাশ জুড়ে রক্তের হোলিখেলার নিশানাগুলি আমার প্রতিটি রন্ধ্র রন্ধ্রে যেন শিহরণ তুলে ফিসফিস করে বলে চলেছে...ইষ্টনাম জপ কর।তোমার মেয়াদ আর বেশিক্ষণের জন্য নয়।"

আমি বুঝতে পারলাম,আমার হাত পায়ের বাঁধন খোলা হচ্ছে।আমার একেবারে সামনে একটা ধারালো কাটারি হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে দীনবন্ধু।দীনবন্ধুর সাজপোশাক দেখে আজ আমি আর অবাক হলাম না।কপালে রক্ততিলক আঁকা তান্ত্রিকের সাজে সজ্জিত পেশীবহুল দীনবন্ধুর নির্মম ওই চাহনি আর নতুন করে আমার ভিতর কোনো ভীতিও সৃষ্টি করল না।এই ভয়াল দেবীর আরাধনা করে তাঁর পিপাসা মেটানোর জন্য যে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই যে ওই হাঁড়িকাঠে আমার শিরশ্ছেদ করা হবে...এই ভবিতব্য এখন আমার কাছে পুরোপুরি জলের মতো স্বচ্ছ। এতক্ষণে আমার কাছে আরো অনেক কিছুই পরিষ্কার হতে শুরু করল।এলাকার মানুষজনের,আমার এই বাড়িতে ভাড়া থাকার ব্যাপারে বারংবার নিষেধ করা...আমার মতো একটা সাধারণ কেরাণীর চাকুরিজীবী একজন পাতি মানুষকে এত অল্প টাকায় এই বাড়ির সব চাইতে সেরা রাজকীয় ঘরখানা আমার জন্য ছেড়ে দেওয়া...আমার প্রতিদিনের খাওয়াদাওয়ার জন্য এত যত্ন...এমন আয়োজন...এইসমস্ত কিছুর পিছনে এদের এমন পৈশাচিক অভিসন্ধির এতটুকুও আঁচ পাবার মতো কোনো পরিস্থিতি ছিল না।বরং আমার মনে হতো...সজ্জন মানুষদের হিংসা করার জন্য মানুষের অভাব হয় না।অতএব লোকজনের কথা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বার করে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।উত্তর কলকাতার এমন একটা পুরোনো বাড়ি...আর তার চারপাশে যে পরিবারগুলির বাস...তারাও এখানে কম পুরোনো নন।আমি আর কটাদিন এখানে এসেছি!নরকসম জায়গায় থাকা হতে রেহাই পেয়ে এক্কেবারে রাজকীয় আপ্যায়নে থাকবার এমন সুবন্দোবস্ত রাতারাতি পেয়ে গিয়ে আমি এতটাই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম...যে এইসব সাবধানবাণীগুলো একটু যাচাই করে দেখবার প্রয়োজনীয়তাটুকুও আমি কখনোই অনুভব করিনি।যদি করতাম...তাহলে অনেক আগে থেকেই আমি ঠিকভাবে সাবধানতা অবলম্বন করতে পারতাম...এমনভাবে এই নরপিশাচগুলোর হাতের শিকার হয়তো হয়ে যেতাম না।আমি যখন থেকে এই কুঠুরির ভিতরে আটকা পড়েছি...তখন থেকে এখানে কোনো মানুষের আর্তধ্বনি তো আমার শ্রুতিগোচর হয়নি...অথচ এতদিন ধরে এই কুঠুরির বন্ধ দরজার ভিতর থেকেই মল্লিকার চাপা আর্তধ্বনি আমি শুনেছি প্রতিরাতে।ও শুধু আমায় বলত..."বাঁচতে চাও...তো পালাও এখান থেকে।"

এখন আমি ওর এই সাবধানবাণীর অর্থ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছি।কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে একটাই প্রশ্ন শুধু আমায় বিস্মিত করছে।মল্লিকার বিদেহী আত্মা এই বন্ধ কুঠুরির ভিতরে কেন বাঁধা পড়ে রয়েছে?এই বাড়ির সঙ্গে মল্লিকার যোগসূত্র কোথায়?

মৃত্যু একেবারে আমার শিয়রের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে...সেটা আমার বুঝতে বাকি নেই।জীবনের অন্তিম লগ্ন এইভাবে ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা সত্ত্বেও আমার মনের ভিতরে যেন আকুলিবিকুলি করে দলা পাকিয়ে উথলে উঠতে থাকল হাজারো প্রশ্নের আনাগোনা।আমার হাত পায়ের বাঁধন খোলা শেষ হওয়ার পরেই কুঠুরির ভিতরে যে প্রবেশ করল সে হল এই বাড়ির মালিক।তাকে দেখে আমার মনে হল...এ আদৌ ঠিকঠাক বোধবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ নয়।অন্যের দ্বারা চালিত হতে থাকা একটি ভেড়া মাত্র।সে এই কুঠুরির ভিতরে ঢুকে আসতেই কড়া গলায় দীনবন্ধু তাকে হুকুম করল..."ডালা আটকে দে ভালো করে।কোনো আওয়াজ যেন বাইরে না পৌঁছোয়।"

সে নিঃশব্দে যন্ত্রের মতো ঘড়ঘড় করে টেনে দিল কুঠুরির ডালা।আমি বুঝলাম...এ জীবনের মতো বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে আমার দেওয়া নেওয়া শেষ। কেউ কোনোদিন জানতেও পারবে না...লোকচক্ষুর অন্তরালে কি পৈশাচিক হত্যালীলা ঘটে গেল নির্দিধায়।মল্লিকার মৃত্যুর জন্যও দায়ী আমি ছিলাম।অতএব আমার কপালে ঈশ্বর সহজ নিষ্কৃতি নয়....এমন যন্ত্রনার শাস্তি বরাদ্দ করে রাখবেন...এমনটাই তো সঠিক বিচার তাই না!আমি নিজের মনকে ধরেবেঁধে ওই রক্তমাখা হাঁড়িকাঠের ধারালো শানিত ঘায়ের জন্য প্রস্তুত করা শুরু করে দিলাম।আর দীনবন্ধুও এবার নিজে গিয়ে কুঠুরির দরজা ভালোভাবে টেনে বন্ধ করে দিয়ে দেবীমূর্তির সামনে অবস্হিত প্রকান্ড যজ্ঞকুণ্ডে অগ্নিসংযোগ ঘটিয়ে কুঠুরির ভিতরের বাতাস কাঁপিয়ে রুক্ষ আর নির্মম কন্ঠে উচ্চারণ করতে শুরু করল দুর্বোধ্য মন্ত্র।আর ওর পাশে নিরীহ ছাগলের মতো একটা কোণায় দুইহাতে দুইচোখ চেপে ধরে যে থরথর করে কাঁপতে থাকল...তার সাথে এহ বাড়িতে ভাড়া হিসেবে থাকবার জন্য প্রথম যেদিন কথা বলেছিলাম...বা এরপর থেকে ঘরে থাকার সুবিধা অসুবিধা...কুশল বিনিময় ইত্যাদি সময়গুলোতে তার ব্যক্তিত্ব বা বাচনভঙ্গিতে কোনোমতেই বোঝবার সুযোগ হয়নি...যে এই লোকটি আসলেই একটি মেরুদন্ডহীন কাপুরুষ।শুধু কি তাই!ওই মলিন ছিন্ন বসনে থাকা...কথায় কথায় আমার বা তার সামনে হাত কচলানো...ফাইফরমাশ খাটবার বৃদ্ধ চাকরের বেশে থাকা এই হতদরিদ্র কাঁচুমাচু লোকটির এমন হাট্টাকাট্টা পেশীবহুল খুনির মতো চাহনি যত দেখছি ততই যেন আমার চিন্তাবুদ্ধি খেই হারিয়ে ফেলছে।এমন সব নিপাট অভিনেতাদের রঙ্গমঞ্চে এতদিন ধরে এক ছাদের নীচে আমি বাস করে গেলাম!

কার্য কারণ কোনোটাই এতটুকুও অনুধাবন করতে না পারলেও আর কিছুক্ষণের মধ্যেই যে আমার ইহলীলা সাঙ্গ হতে চলেছে এই ব্যাপারে অন্তত আমার আর সন্দেহের কোনো অবকাশই রইল না।অদূরে কোণায় বসে এই বাড়ির মালিকের ভয়ে আতঙ্কে দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে এটাও স্পষ্ট বুঝলাম।বাতাসের প্রতিটি কণা দীনবন্ধুর দুর্বোধ্য মন্ত্রোচ্চারণের বজ্রনিনাদে যখন রীতিমতো কোণঠাসা...তখন আমি আমার মন মস্তিষ্ককে এ জীবনের মতো পুরোপুরি ছুটি দিয়ে...ঠাকুরমার কাছে মনে মনে ক্ষমা চেয়ে নিলাম।আমি যে এতখানি বিপদে পড়ে যাব এমন আভাসটুকুও যদি আগে পেতাম...তাহলে ওনাকে একটা খবর নিশ্চয়ই পাঠাতাম।এই একটি দায়িত্বের জন্যই আমি আমার জীবনের কাছে দায়বদ্ধ ছিলাম।আজ আমার এই নৃশংস মৃত্যুর কোনো খবর শুধু উনি কেন!পৃথিবীর কেউই পাবে না।আর আজকের পর অনাহারে মরা ছাড়া ওনার সামনেও আর কোনো ভবিতব্যই নেই।আর কি করা...কপালের লিখন খন্ডাবে কার সাধ্য!আমি আমার দুইচোখ বন্ধ করে নিজেকে পুরোপুরিই মৃত্যুর হাতে সঁপে দিতে থাকলাম।যজ্ঞকুণ্ডের সামনে বসে দীনবন্ধু দেবীর আরাধনার কার্য সম্পাদনা করে নিয়ে ভূমি ছেড়ে উঠে দাঁড়াল আর আমার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করল।আমি ইহজীবনকে এইবার পুরোপুরি বিদায় জানিয়ে আসন্ন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হলাম।আমার হাত ও পায়ের বাঁধন পুরোপুরি খুলে মেঝেয় আছড়াতে আছড়াতে ও আমায় হাঁড়িকাঠের দিকে নিয়ে যেতে থাকল।তবে এই কাজটা করতে গিয়ে ওকে আর খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি আর খুব একটা বলপ্রয়োগও করতে হয়নি।আমি আমার আসন্ন ভবিতব্যের জন্য সম্পূর্ণরূপেই প্রস্তুত ছিলাম আর শিরশ্ছেদের মাধ্যমে আমার অন্তিম মূহুর্তের প্রতীক্ষা করছিলাম।দীনবন্ধু আমাকে টেনে একেবারে হাঁড়িকঠের সামনে এনে ফেলে নিজের দুইহাতে তুলে নিল রক্তমাখা একটি ধারালো কাটারি।ঠিক এই সময়েই এমন একটি ঘটনা ঘটে গেল যেটার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না।

মূহুর্তের ভিতরে বন্ধ কুঠুরির ভিতরে যেন উঠল ধরিত্রী কাঁপানো এক উথালপাথাল ঝড়।শো শো শব্দে মত্ত দামাল হয়ে উঠল ভিতরকার বাতাস।যেন বহুদিনের জমে থাকা চাপা ক্ষোভ আর ক্রোধ একত্রিত হয়ে জ্বালাময়ী হয়ে উঠেছে।দপ করে নিভে গেল দেবী প্রতিমার সামনে রাখা জ্বলন্ত প্রদীপ শিখা আর একটি নিকষ অন্ধকার গোটা কুঠুরিটাকি পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলল।আর দীনবন্ধুর কন্ঠ হতে বেরিয়ে আসল এক চাপা গোঙানি মিশ্রিত আর্তনাদ।আর তার কাছেপিঠেই শোনা গেল আরেকটি ভয়মিশ্রিত পুরুষ কন্ঠের ছটফটানি।এই সমস্তকিছু ঘটতে শুধুমাত্র এক সেকেন্ড মাত্র সময় লেগেছিল।আমি কোনোকিছু বুঝে ওঠবার আগেই হঠাৎ আমার ডানহাতখানি সজোরে চেপে ধরল একখানি শীতল কোমল হাত।এই স্পর্শ যে আমার ভীষণ...ভীষণ চেনা...।ওই নিকষ অন্ধকারের চোরাস্রোতে যখন বেঁচে ওঠার ক্ষীণ আশা আর পাশাপাশি জীবনের চরম অনিশ্চয়তার চোরাস্রোতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যখন আমি পুরোপুরি দিশাহারা...ঠিক তখনই এক নারীকন্ঠ কুঠুরির ভিতরের বাতাস কাঁপিয়ে বলে উঠল..."আর এক মূহুর্তও দেরী না করে এসো আমার সাথে।

আমি সাংঘাতিকভাবে চমকে উঠলাম।এই কন্ঠ যে আমার শুধু চেনাই নয়...এই কন্ঠস্বর শোনার সাথে সাথে আমার সমস্ত অতীত যেন ওই আঁধার কুঠুরির ভিতরে এক লহমায় আমার সামনে প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল।এ কন্ঠ আমার স্ত্রী মল্লিকার।এক অনির্বাচনীয় শিহরণে আমার যেন সমস্ত রোমকূপ যেন জেগে উঠল।আমি উদ্বেলিত কন্ঠে বললাম,"তুমি কোথায় ছিলে এতদিন?আর এখানেই বা এলে কেমন করে?আমায় কেন দেখা দাও না তুমি?সামনে কেন আসো না?বলো...উত্তর দাও...!"

কথাগুলো একনাগাড়ে আমার ভিতর থেকে বেরিয়ে গিয়ে যেন বাতাসের মধ্যেই মিশে গেল।মল্লিকার শ্রুতিগোচর আদৌ হল না।ও বরং আরো দশগুণ জোরে চেপে ধরল আমার হাত।তারপর হিড়হিড় করে কুঠুরির দরজার দিকে টানতে টানতে সেখানকার বাতাস কাঁপিয়ে বলে উঠল..."কোনো প্রশ্ন নয়।যেখানে নিয়ে যাচ্ছি চুপচাপ সেইদিকে চলো।"

এই বলে সে সবলে আমার হাতখানি ধরে যেভাবে টানতে টানতে কুঠুরির দরজার মুখে নিয়ে যেতে থাকল,তাতে আমার আর কোনো সংশয় অথবা প্রশ্নের যে আর কোনো প্রশ্রয়ই নেই সেটা আমি পরিষ্কারভাবে বুঝে নিয়ে নির্বিবাদে সেইদিকেই চালিত হতে থাকলাম যেইদিকে মল্লিকার শীতল আর লৌহকঠিন হাত সবলে আমায় নিয়ে যেতে থাকল।যেভাবে একটি অবুঝ শিশুর জননী তার আপন শিশুটিকে টেনে হিঁচড়ে বিপদের মুখ থেকে সরিয়ে ফেলতে উদ্যত হয়,মল্লিকার বজ্রমুষ্ঠী যেন সেইভাবেই সবলে আমায় টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে ফেলতে বদ্ধপরিপক ওই রক্ত আর পাপের কালিমায় কালিমালিপ্ত জায়গার সংস্পর্শ হতে নিরাপদ দূরত্বে।যেখানে নিশ্চিত মৃত্যু একেবারে শিয়রের কাছে এসে নিঃশ্বাস ফেলছিল...সেখানে সম্পূর্ণরূপে অপ্রত্যাশিতভাবে ওই রক্তমাখা কাটারির হিংস্র কোপের জবাই হতে মুক্তি পেয়ে আর মল্লিকার ওই শীতল এবং কঠোর বজ্রমুষ্ঠির ছোঁয়ায় সেই চেনা শাসন আর প্রেমের গন্ধ পেয়ে আমি পুরোপুরি অন্ধের মতোই চলতে শুরু করলাম যেইদিকে ও আমায় হাত টেনে ধরে এগিয়ে যেতে থাকল।নিকষ অন্ধকারে চারদিক একেবারে ঢাকা।কোনোকিছুই আমার দৃষ্টিগোচর না হলেও আমি এতটুকু বুঝতে পারছিলাম,মল্লিকা আমাকে কুঠুরির বাইরে বার করে নিয়ে যাচ্ছে।এইভাবে চলতে গিয়ে হঠাৎ একটা প্রবল তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব আমায় ঘিরে ধরল ভীষণভাবে।কয়েক মূহুর্তের ভিতরেই আমার দুচোখ জুড়ে এক নেমে আসতে শুরু করল এক পৃথিবী ক্লান্তি।আমি ধীরে ধীরে নুয়ে পড়তে লাগলাম সুখনিদ্রার কোলে।

ঘুমের ঘোর কেটে গিয়ে আস্তে আস্তে করে আমার দু চোখের পাতা উন্মোচিত হতে থাকল...আমার দৃশ্যপটে আবছা ভেসে উঠতে থাকল পারিপার্শ্বিক সমস্ত কিছু।আমি বুঝতে পারছিলাম...আকাশও তার অন্ধকার মুছে আলোকিত হচ্ছে ধীরে ধীরে।ভোরের স্নিগ্ধ আলোর স্পর্শ সারা গায়ে মেখে আমি একটা শান্তির দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি।আমি উপলব্ধি করতে শুরু করলাম...এই স্নিগ্ধ আলোর স্পর্শ দ্বারাই আমার জীবনের সমস্ত অন্ধকার...ঝড়ঝঞ্ঝা এবার স্তব্ধ হয়েছে।আমি প্রাণে বেঁচে গিয়েছি।পাকা সড়কের পাশে একটা ফুটপাতে শুয়ে রয়েছি আমি।চারপাশে শুরু তখনো শুরু হয়নি নতুন দিনের কোনো উদযাপন।শহরের ঘুম পুরোপুরি তখনো ভাঙেনি।আমি যে শেষ পর্যন্ত প্রাণে বেঁচে যাব...এটা তো পুরোপুরিই অপ্রত্যাশিত ছিল।হঠাৎ আমার মনে হল...আচ্ছা...এটা কোনো স্বপ্ন নয় তো!আমি সত্যিই বেঁচে আছি তো!আমি সাথে সাথে নিজের বাম হাতে জোরে একটা চিমটি কেটে সাথে সাথে নিজেই ব্যথায় ছটফটিয়ে উঠলাম।

এরপর আর কোনো দ্বন্দ রইল না।আমি দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগত চলতে থাকা আতঙ্কের সমস্ত জের এক লহমায় ঝেড়ে ফেলে চারদিকে তাকালাম।রাস্তাঘাট শুনশান ফাঁকা।সামনে একটা চায়ের দোকান শুধু খোলা রয়েছে।আর অল্প কিছু লোকজনের আনাগোনা আরম্ভ হয়েছে।আমি যে গোটা রাত্রিটা এই ফুটপাতেই ঘুমিয়ে কাটিয়েছি...সেটা তো আর এখন বলার অপেক্ষা রাখে না...এখন প্রশ্ন হল...ওই মানুষরূপী পিশাচগুলোর হাত থেকে আমি কিভা‌বে এতদূরে এই রাস্তার ধারে এসে পড়লাম!যে পথ দিয়ে আমি প্রতিদিন অফিসে যাই সেখানে এইভাবে এসে পড়া...আর তার সাথে সাথে হাজারো প্রশ্নের জট আমার মাথার ভিতরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করল।আমার মনটা ভীষণ চা চা করতে লাগল।যে কুর্তাটা পরে রয়েছি...সেটার পকেট হাতড়ে কিছু কয়েন পেলাম।আর কিছু না ভেবে আমি সামনের চায়ের দোকানের দিকেই এগোতে শুরু করলাম।কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরের আবছা আলোতে দেখতে পেলাম...চায়ের দোকানের ভিতরে বসে যারা চা খাচ্ছে...তারা আমার পরিচিত।আমার অফিসের কলিগ।আমার ভিতরটা ছটফটিয়ে উঠল।এই কটাদিন যে বিনা নোটিশে অফিস কামাই হল...বস নিশ্চয়ই আমার ওপর নিদারুণ খচে রয়েছেন...!ওদের সঙ্গে কথা বলার জন্য আমি এগোতে যাব...সেই সময়ে দেখি...ওরাই আমাকে দেখে বেশ একটা বিস্ময়সূচক দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে তারপর নিজেরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।

আমি দ্রুতপায়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম।ওরা আমার দিকে প্রচন্ড অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকাল...আমিও ওদের এমন আচরণ দেখে কি বলে কথা শুরু করব...হঠাৎ করে ভেবে পেলাম না।নীরবতা ভঙ্গ করে ওরাই বলে উঠল...কি ভাই...তুমি তো দুইদিন আগে চাকরিতে রিজাইন দিয়ে তোমার গ্রামে ফিরে গিয়েছিলে না...?এখন মাঝ রাস্তায় এইভাবে ভবঘুরের মতো..."

আমি আর ওদের কথা শেষ করতে না দিয়ে প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলাম..."এখন ওসব কথা রাখো...সব পরে বুঝতে পারবে।আগে আমার সঙ্গে চলো তো...তোমাদের সঙ্গে জরুরী কথা আছে।"

ওরাও আর কোনো কথা না বলে আমার সাথে সাথে এগোতে থাকল।গন্ডগোল যে একটা বড় রকমেরই রয়েছে...এটা ওরা আঁচ করতে সক্ষম হল।আর এই দুইদিন আমি ওই বন্ধ কুঠুরির ভিতরে বন্দী থাকা সত্ত্বেও কি করে অফিসে বসের কাছে গিয়ে রিজাইন দিয়ে এলাম...সেই রহস্যের কিনারাও বোধহয় আমি করতে পারছি।সমস্ত ধোঁয়াশার মূল শিকড় যেখানে...সেইদিকেই এখন তিনজনে হাঁটা শুরু করলাম।আমার অফিসের কলিগ সৃজন আর শান্তনুও এক মন প্রশ্ন নিয়ে আমাকে অনুসরণ করে চলছিল বটে...তবে ওদের সাথে আমার এই অল্পদিনের বন্ধুত্বটাও যথেষ্ট গাঢ় হয়ে ওঠায় ওরা চেনে আমাকে।আমি যে কাউকে ভাঁওতা দেবার লোক নই...বা নিজের সুবিধা গোছানোর জন্য সস্তার মিথ্যে বলে কাজ চালিয়ে নেবার লোক নই...এটা ওরা বোঝে।কাজেই একটা বড় কোনো গন্ডগোল আর উপর্যুপরি আমার কোনো একটা বিপদের অশনিসংকেত ওরা পেয়ে গিয়েছিল।ওরা আমাকে আর কোনো প্রশ্ন না করে আমার সাথে সাথে চলতে থাকল।শান্তনু আমার কাঁধে হাত রেখে চোখের ইশারায় বোঝাল..."তুমি কোনো চিন্তা কোরো না।আমরা তোমার সাথে আছি সবরকম পরিস্থিতিতেই।" সত্যিই আমার মনোবল যথেষ্ট বৃদ্ধি পেল।আমি আরো দ্রুতবেগে হাঁটতে থাকলাম।একেবারে সেখানে গিয়ে থামলাম...যেখানে এতগুলো দিন ধরে ক্রমাগত মনে জমা হতে থেকেছে হাজারো প্রশ্ন।আজ সবকিছুর উত্তর বার করতে হবে আমাকে।সামনে আনতে হবে কিছু নগ্ন সত্যকে...যা সাধারণ মানুষের সামনে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে।ওই বাড়িতে থাকতে সৃজন আর শান্তনুও বারবার বারণ করেছিল আমাকে।কিন্তু হঠাৎ মেঘ না চাইতে জলের মতোই অমন সুন্দর একখানা থাকবার বন্দোবস্ত হাতে পেয়ে একেবারে লুফে নিয়েছিলাম আমি।চারপাশের মানুষজনের ওই বাড়ির অন্দরমহল নিয়ে ভয়ভীতি আর সন্দেহ যে অমূলক নয়...সেটা যত দিন গিয়েছে তত একটু একটু করে আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি।ক্রমে নিজের বড় কোনো বিপদের গন্ধ পাওয়া সত্ত্বেও ওই বাড়ি আমি ছাড়িনি কারণ এখানে এসেই দীর্ঘ দিন বাদে প্রথম আমি মল্লিকার কন্ঠস্বর শুনতে পাই।বন্ধ ঘরের ভিতরে মল্লিকার ওই আর্তধ্বনি শোনার পর শত বিপদের আশংকাতেও ওই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা এক মূহুর্তের জন্যও আমার মাথায় আসেনি।বরং রহস্য ভেদ করার রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি পৌঁছে গিয়েছি নিজের মৃত্যুর একেবারে কিনারায়।নিশ্চিত মৃত্যুর হাঁয়ের থেকে আমি এখন জীবিত অবস্থায় রয়েছি এবং নিরাপদ দূরত্বে অবস্হান করছি।এবার ওদের সবকটাকে হাতেনাতে ধরতে হবে যেভাবেই হোক।আমরা সবাই বেশ জোরে পা চালিয়ে পৌঁছে গেলাম ওই বাড়ির দোরগোড়ায়।আমার সঙ্গে আসবার পথেই অবশ্য সৃজন আর শান্তনু আন্দাজ করে নিয়েছিল আমাদের গন্তব্য এখন ঠিক কোথায়...।শান্তনু বলে উঠল...আমি বলি কি...পুলিশে খবর দিলে হয় না...!তুই আমাদের এখনো পর্যন্ত কিছু না বললেও আমরা আন্দাজ করতে পারছি বিপদটা ঠিক কিরকম।

শ্...শ্...শ্...শ্......কথা বলিস না এখন।আমাকে পরিস্থিতিটা একটু বুঝতে দে।

পুরো বাড়িটাই একেবারে শুনশান...নিস্তব্ধ।বাড়ির মেনগেটটা সারারাত খোলাই ছিল।আমরা দরজার সামনে আসলাম পা টিপে টিপে।সৃজন সন্তর্পণে দরজায় ওর হাতটা ছোঁয়াতে দরজাটা ক্যাঁঅ্যাঅ্যাচ শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল।দরজাটা খুলতেই সামনে যে দৃশ্য আমরা দেখলাম...তাতে আমাদের তিনজনেরই একেবারে রক্তহিম হয়ে গেল।অদূরেই একখানা ফুটবলের মতোই পড়ে রয়েছে এই বাড়ির মালিকের ধড়হীন কাটা মুন্ডু।আর সারা ঘরে বয়ে চলেছে রক্তের বন্যা।ওই দৃশ্য চাক্ষুষ করার পরে আমরা একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।এর অদূরেই যাকে দেখলাম...সে আমার খুবই চেনা।সে এখন পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতোই মেঝেয় পড়ে ছটফট করে চলেছে।সে আর কেউ নয়।দীনবন্ধু।ওর হাতের কাছেই গড়াগড়ি খাচ্ছে রক্তমাখা কাটারিখানা।আমরা ভয়ে আর বিস্ময়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।দীনবন্ধুর এখন যা অবস্থা...তাতে ও যে পালিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় নেই...এটা বুঝতে আমাদের আর বাকি রইল না।ঘোর কাটিয়ে সৃজন বলে উঠল..."এক্ষুনি পুলিশকে খবর দিতে হবে।দেরি করা ঠিক নয়।তোরা এখানে ওয়েট কর...আমি একটা ব্যবস্হা করছি।আজকেই সামনে আসবে সব।"

হনহন করে বেরিয়ে গেল সৃজন।আমি দেখলাম...দীনবন্ধু একেবারে কাটা ছাগলের মতো ছটফট করে চলেছে।ওর চোখদুটো যেন চোখের কোটরের বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।কোনোরকমে গলা দিয়ে একটা বিকৃত ধরণের ফ্যাঁসফ্যাঁস শব্দ করে যেটা বোঝাতে চাইল আমাদের...সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না আমাদের।ব্যাটা জল চাইছে।গত রাতেই যে দুইহাত দিয়ে কাটারি ধরে কসাইএর মতো আমার গলায় কোপ বসাতে উদ্যত হয়েছিল দীনবন্ধু...এখন সূর্যাস্তের পর ও সেই দুইহাতই ভীখারির মতো জোড় করে আমার কাছে জল চাইছে।আমার সর্বাঙ্গ রি রি করে উঠল রাগে।কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল...এখন মাথা গরম করার সময় নয়।সমস্ত ব্যাপারটা জানতে হবে।আমি পাশে রাখা কুঁজো হতে একটা গ্লাসে জল ঢেলে ধরলাম দীনবন্ধুর মুখের সামনে।দেখলাম...ওর দুটি হাতই কাঁপছে থরথর করে।হাতে করে গ্লাস ধরে জল খাওয়াটা যে এখন ওর পক্ষে নিতান্তই অসম্ভব...এটা আমি বুঝতে পারলাম।কি আর করা...এক হাতে ওর মাথা ধরে অপর হাতে জলভর্তি গ্লাস ওর ঠোঁটের সামনে ধরলাম।দেখলাম...একযুগ পিপাসার্ত থাকা চাতকের মতো চোঁ চোঁ করে সবটা জল শেষ করল নিমেষের মধ্যে।যখন আমরা ঘরের ভিতরে ঢুকেছিলাম...তখন ওর হাতদুখানি ঠিকই ছিল।কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যেই ওর দুটি হাতেও পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে এটা আমি আর শান্তনু দুজনেই লক্ষ্য করলাম।দুইহাতে কাঁপুনিটা ক্রমেই বাড়ছে আর ক্রমশ বাঁকতে শুরু করেছে।ওর পা দুখানির মতো যে ওর দুটি হাতও আমাদের চোখের সামনেই ক্রমশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার পথে যাচ্ছে এটা আমরা দুজনেই চাক্ষুষ করলাম।জল খেয়ে একটু দম নিল দীনবন্ধু।একটু জোর পেল বোধহয়।ওর গলায় ফুটে উঠল একটা ক্লিষ্ট ক্ষীণ কন্ঠস্বর।দীনবন্ধুর চাহনিতে একটা অনুতাপের আকুতি স্পষ্ট হয়ে উঠল।ধীরে ধীরে ও যা বলতে শুরু করল...সেটা শোনামাত্র আমি রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠলাম।

ক্ষীণকন্ঠে ও বলছিল..."আমাকে ক্ষমা করে দাও মল্লিকা...আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি।আজ তোমার কথা শুনিনি বলেই আজ আমার এই দশা...তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও..."

দেখলাম...ওর হাত দুখানি জড়ো করার প্রবল চেষ্টার পরতে পরতে মিশে থাকা তীব্র অনুতাপের আত্মদহন।ওর দুচোখ দিয়ে অঝোরে ঝরে পড়ছে জল।

মল্লিকার সঙ্গে ওর পরিচয় কিভাবে হল!আর ওদের দুজনের সম্পর্কটাই বা ঠিক কি!কর্মফলের ধিক্কারে ঝরতে থাকা ওর অঝোর অশ্রুধারা দেখে আমি যে ইঙ্গিত পেলাম...সেটাই কি তাহ‌লে সত্যি!আমি উত্তেজিত হয়ে দীনবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম..."মল্লিকা কে হয় তোমার?"

ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে দীনবন্ধু বলল..."আমার স্ত্রী।"

কথাটা শোনামাত্র আমার শরীরের রক্তের প্রতিটি কণা যেন ফুঁসে উঠল।আমি প্রবল ক্রোধে অন্ধ হয়ে দীনবন্ধুর ক্লিষ্ট শরীরের ওপর বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর কন্ঠনালী চেপে ধরলাম।রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কম্পিত কন্ঠে বললাম..."আমার মল্লিকাকে তাহলে তুইই ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছিলি!আমার এত বড় সর্বনাশের জন্য তাহলে তুইই দায়ী!তোর তো বেঁচে থাকারই কোনো অধিকার নেই।ভগবান তোকে তোর উপযুক্ত শাস্তিই দিচ্ছেন।কিন্তু আমার অত ধৈর্য নেই।ওনার আগে আমি মারব তোকে।"

আমি দীনবন্ধুর কন্ঠনালী ভীষণ জোরে চেপে ধরলাম।ওর হাত পা ধীরে ধীরে যে বাঁকতে শুরু করে দিয়েছে সেটা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম।কিন্তু ওর মুখ থেকে ওই কথা শোনার পর আমি আর নিজেকে নিজের মধ্যে রাখতে পারলাম না।এতদিন ধরে নিজের ভিতরে জমতে থাকা যন্ত্রনাগুলো যেন নিমেষের মধ্যে আগুনের আস্ফালন হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইল।আছড়ে পড়ে শেষ করতে উদ্যত হল দীনবন্ধুকে।দীনবন্ধু সেই অবস্হাতেই ক্ষীণ এবং আর্তকন্ঠে বলে উঠল..."আমি অপরাধ করেছি।শাস্তি তো আমার প্রাপ্য।তবে দয়া করে আমার শেষ স্বীকারোক্তিটুকু শুনুন...যে পাপ আমি করেছি...তার দায় আমার একার।আমার পরিবার পরিজনেরা...আমার স্ত্রী মল্লিকা...ওরা আমারই পাপের ফল ভোগ করছে।তারা কোনো পাপ করেনি।আমাকে মারবার আগে দয়া করে তাঁদের মুক্তির একটা ব্যবস্হা যদি করে দেন...আমি আপনার কাছে ঋণী হয়ে মরব।"

দীনবন্ধুর চোখেমুখে আকুতি স্পষ্ট।মল্লিকার কথা শোনামাত্র আমি খানিকটা শান্ত হলাম।ওর কন্ঠনালী হতে সরিয়ে নিলাম হাত।দেখলাম...দীনবন্ধু মৃত্যুযন্ত্রনায় রীতিমতো কাতরাচ্ছে।ওর সময় যে ফুরিয়ে এসেছে...সেটা আর বুঝতে বাকি নেই।আমি রূঢ়কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম..."মল্লিকার সাথে তুই কি করেছিস!ও কেন এখনো পর্যন্ত এই বন্ধ কুঠুরির ভিতরে ছটফট করে!কি যন্ত্রনা দিয়েছিস তুই ওকে যার জন্য এখনো ওর আত্মা পচে মরছে এইখানে!বল...স্বীকার কর!"

আমার আগ্রাসী বজ্রমুষ্ঠি হতে ছাড়া পেয়ে একটু যেন হাঁপ ছাড়ল দীনবন্ধু।রাগে তখনো আমি কাঁপছিল।দীনবন্ধু ক্ষীণকন্ঠে বলতে শুরু করল।

"আর কেউ নয়...মল্লিকাকে আমিই মেরেছি নিজের হাতে।এই বন্ধকুঠুরির ভিতরের গোপন মন্দিরের দেবীকে জাগ্রত করার জন্য নিজের হাতে মল্লিকার শিরশ্ছেদ করে আমি দেবীর পায়ে ওকে বলি দিয়েছি।"

কথাটা শোনামাত্র আমি একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম।এ বলে কি!

মল্লিকা যে আমার হাতেই মরেছিল...এ একমাত্র আমি আর ঈশ্বর ভিন্ন কারোর জানবার কথা নয় সেটা আমি জানি।কিন্তু ওর মৃত্যু যেখানে আমার হাত দিয়ে ঘটেছিল...তাকে দীনবন্ধু এই কলকাতায় ধরে এনে মায়ের পায়ে বলি দেয় কিভাবে!"

রাগে উত্তেজনায় আমি থরথর করে কাঁপতে থাকলাম।বললাম..."কি বলছিস তুই আহাম্মক!মল্লিকা তো সিকিমে মারা গিয়েছিল গায়ে আগুন লেগে।আর ওকে যে মেরেছিল সে আর কেউ নয়...আমি।তুই ওকে এই বন্ধ কুঠুরির ভিতরে কিভাবে বলি দিয়েছিস!সত্যি কথা বল...।"

দীনবন্ধুকে চেপে ধরলাম আমি।ও এখন জানে...ওর অন্তিম সময় উপস্থিত।ও আমার অমন উথালপাথাল অবস্থা দেখে বিচলিত না হয়ে ফের গড়গড় করে বলতে আরম্ভ করল।

"আপনি কলকাতায় আসবার আগে পর্যন্ত আমি আপনাকে দেখিনি।শুধু মল্লিকার প্রাক্তন স্বামী হিসেবে আপনার নামটুকু শুনেছিলাম।সিকিমে ঘটে যাওয়া ওই অগ্নিকাণ্ড যে কোনো নিখাদ দুর্ঘটনা ছিল না...এটা আমি আন্দাজ করতে পেরেছিলাম আর আমার আন্দাজ দৃঢ় হল তখনই...যখন ওই অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী হিসেবে আপনার নাম শুনলাম।আমি পুরো ব্যাপারটা সেখানেই চেপে দিতে চেয়েছিলাম।খামোখা থানা পুলিশ করে আর ঝামেলা বাড়াতে চাইনি।আর আপনার সাথে সাথে মল্লিকাও যে সুস্থ হয়ে উঠেছে...এটা চেপে যাওয়ার জন্য এমন ব্যবস্হা করেছিলাম,যাতে মল্লিকার মিথ্যা মৃত্যুসংবাদ আপনার কানে গিয়ে পৌঁছোয়।আর জীবনেও যাতে মল্লিকার খোঁজ না করেন...সেই ব্যবস্হায় শিলমোহর লাগিয়ে মল্লিকাকে নিয়ে আমি সোজা কলকাতায় চলে আসি।কারণ আমার উদ্দেশ্যই ছিল মল্লিকাকে এখানে এনে মায়ের পায়ে উৎসর্গ করা।"

এতখানি বলে একটু দম নিল সে।আমি ওর কথাগুলো শুনে একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম।মান অভিমান আর তার সূত্র ধরে জন্ম নেওয়া ক্ষোভ এবং ক্রোধ এতটাই মাথায় চড়ে গিয়েছিল দুজনের...যে ওই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও যখন কোনোমতে আমরা এক হওয়ার একটা সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলাম...সেটুকুকেও অনর্থক জেদাজেদি আর রেষারেষির দরুণ ওইরকম মর্মান্তিকভাবে খুইয়ে বসলাম।আমি ফিরে এসেছিলাম একা...আর মল্লিকা জবাই হওয়ার জন্য পাড়ি দিয়েছিল এই কলকাতা শহরে।

একটু দম নিয়ে সে ফের বলতে শুরু করল।

"দীনবন্ধু আমার আসল নাম নয়।এটা আমার এখানকার ছদ্মনাম।আমার আসল নাম জগমোহন ওরফে জগাই।মুর্শিদাবাদের কুখ্যাত মাস্তান।অভিজাত বংশের রক্ত আমার শরীরে বইলেও শিশুকাল হতেই আমার খুনে গুন্ডাদের মতো হিংস্র স্বভাব চরিত্রের জন্য...এক মা ছাড়া আমার পরিবারের কেউই আমাকে পছন্দ করত না।শিশুকালেই আমার সঙ্গে খেলতে গিয়ে যখন ছোট ছোট ছেলেরা আহত আর রক্তারক্তি অবস্থায় ঘরে ফিরত...তখন থেকেই আমার সাথে মানুষজনের মেলামেশা কমতে থাকছিল।যখন প্রাপ্তবয়স্ক হলাম...আমার ভাইএরা আর আমার চারপাশে আমার সাথে বড় হওয়া ছেলেদের কেউ চাকরি করতে গেল...কেউ ব্যবসায় নামল...জীবন অতিবাহিত করার জন্য আরো বিভিন্ন রুজিরোজগারের পথে পা বাড়াতে শুরু করল...সেই সময় আমি নাম লেখালাম গুন্ডা মাস্তানের দলে।আমার ভিতরে দয়ামায়ার চিলতে কণার অস্তিত্বও যে নেই এটা যখন সেখানকার সবাই বুঝে গেল...আমার কদর ততই বাড়তে থাকল।কিন্তু আমি নিজের পরিবারের কাছেই পুরোপুরি চক্ষুশূল হয়ে উঠলাম।ওরা প্রায় আমাকে ত্যজ্য করার পথেই পা রেখেছে...এটা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম।পরিবারের প্রতি আমার কোনোরকম টান আমার ছিল না।আমি শুধুমাত্র সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার জন্যও বড় বিচলিত হয়ে উঠলাম।

মুর্শিদাবাদের অভিজাত বংশে জন্ম আমার।বংশমর্যাদা আর প্রভাব প্রতিপত্তির সুবাদে সেখানে আমার পরিবারের যথেষ্ট সুনাম ছিল।আমার কারণে সেই সুনাম ধূলিসাৎ হতে চলেছে...এই বদনাম আমি বহুদিন ধরেই শুনে আসছি।সম্পত্তির লোভে আমি সাময়িকভাবে ওদের মতো হয়ে চলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টাও করেছিলাম।কিন্তু আমার ভিতরের কসাইটাকে কোনোমতেই ধীরস্থির ঠান্ডা জীবনযাপনের ভিতরে সাময়িকভাবে বন্দী করতেও সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হলাম আমি।এহেন পরিস্থিতিতে আমার বাবার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু কন্যা মল্লিকার বিয়ের জন্য দেখাশোনা আরম্ভ হয়েছে...এমন একটি খবর আমার কানে এসে পৌঁছোয়।মল্লিকা যে এমন একটি ছেলেকে বিয়ে করেছে ওদের অমতে...যার না আছে বংশের কোনো আভিজাত্য...আর না আছে কোনো প্রভাব প্রতিপত্তি।জামাই হিসেবে তাকে সমাজের সামনে পরিচয় দেওয়াটাই ওদের পক্ষে বিরাট লজ্জার বিষয় হয়ে পড়েছে।মেয়ে ওই ছেলের ঘরনী হওয়ায় নিজেদের পরিবারের দরজা না চাইতেও ওর জন্য বন্ধ রাখতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে।মল্লিকা ওই ছেলেটির সঙ্গেই সুখে শান্তিতে সুন্দর ঘর করলেও সমাজের সামনে মেয়েকে আগের মতো আর গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।অতএব মল্লিকার পরিবারের লোকেরা এমন একটা বুদ্ধি বার করল...যাতে সাপও মরে আর লাঠিও না ভাঙে।মেয়ে জামাইকে মেনে নেওয়ার অছিলায় তাই মেয়ের ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করে আর ধীরে ধীরে ওদের মধুর সম্পর্কে ভাঙন ধরাতে শুরু করে নিজেদের মেয়েকে ওর স্বামীর বিরুদ্ধে বিষিয়ে দিয়ে।আমার পরিবার এই পুরো ব্যাপারটা জানত এবং মল্লিকার পরিবারকে পুরোপুরি সমর্থন করত।মল্লিকা আর ওর স্বামীর ভিতরে ভুল বোঝাবুঝির দরুণ অশান্তি যখন চরমে...ওই সময়ে যেনতেন প্রকারেন ওর বিয়ে ভেঙ্গে ওর পুনর্বিবাহ দেওয়ার জন্য ওর আর আমার দুই পরিবারই একেবারে উঠেপড়ে লেগেছিল।আমার পরিবারে আমিই ছিলাম একমাত্র অবিবাহিত ছেলে।কিন্তু আমার মতো ছেলের পক্ষে যে বিয়ে করে সংসারী হওয়া কোনোমতেই সম্ভব নয়...সেটা তো একেবারেই বলার অপেক্ষা রাখে না।সেটা যদি সম্ভব হত...তাহলেও আমার বাবা মা বড়ো শান্তি পেতেন।ওই সময়ে আমি বিভিন্ন এলাকায় লুঠতরাজ আর মাস্তানি করে করে বেশ ভালোই টাকাপয়সা করতে শুরু করে দিয়েছিলাম।আমার নেটওয়ার্ক মুর্শিদাবাদ ছাড়িয়েছিল অনেকদিন আগেই।কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় আমার গতিবিধি বাড়তে শুরু করেছিল।ওই সময়ে কলকাতার এক বনেদী পরিবারের ছেলের সাথে আমার পরিচয় হয়...এবং পরিচয় বেশ ঘনিষ্ঠতার দিকেই এগোয়।নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তার এক পরিচিতকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য সে আমাকে সুপারি কিলার হিসেবে কাজ করতে সুপারিশ দেয়।আমিও সেই কাজের সুপারিশ নিই।সেই সূত্রেই আমার তার সাথে পরিচয় এবং কলকাতায় তাঁর এই বাড়িতে আমার আসা।এই বাড়িটা এখন যেমন দেখছেন...কিছু বছর আগে একেবারেই তেমনটা ছিল না।একটা যৌথ পরিবার যেমন সবসময় গমগম করে...এই বাড়িটাও ঠিক তেমনটাই ছিল।এই বাড়ির বাকি মানুষগুলোও ছিল ভারি আন্তরিক আর মিশুকে।এই বাড়ির মালিক হিসেবে আপনি যাকে চাক্ষুষ করেছেন...সে হল আসলে তারই ছোট ভাই যার কাছ থেকে আমি খুনের সুপারি নিয়েছিলাম।কলকাতায় এসে থাকতে যখন শুরু করেছি...তার পরেকার ঘটনা।একদিন দরকারে একটু বেরিয়েছিলাম।খুব বৃষ্টি হচ্ছিল।আমি রাস্তা পার হতে যাব...এমন সময়ে একটা দ্রুতগামী গাড়ি এসে আমার পুরো পোশাকটাই ভিজিয়ে দিল।আমার প্রচন্ড রাগ উঠে গিয়েছিল তখন।কিন্তু রাগটা ঠান্ডা হল তখনই যখন গাড়ির মালিক আমায় ওই রাস্তারই লাগোয়া এই বাড়ির ভিতরে ঢুকে ভিজে পোশাক ছেড়ে সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার প্রস্তাব দিল।আমিও মানা করলাম না।সেই প্রথম আমি এই বাড়ির ভিতরে পা রাখি...এই বাড়ির বর্তমান যে মালিককে আপনি দেখেছেন...তাঁর সাথে।আমি যাঁর কাছ থেকে খুনের সুপারি নিয়েছিলাম...সে যে তাঁর ছোটভাই এটা আমি খুব অল্প সময়ের ভিতরেই বুঝতে পারি।ঘরের ভিতরে ঢুকে তার সাথে বিভিন্ন কথা বলতে বলতে আমি বুঝতে পারি...এই লোকটা আদপে একটা মাথামোটা নির্বোধ মানুষ।এর সাথেই কথায় কথায় জানতে পারি...এই বাড়িটার একটা গোপন পারিবারিক ইতিহাস আছে।যেটা একমাত্র ওর বৃদ্ধ দাদু জানেন...যিনি বার্ধক্যের ভারে জর্জরিত হয়ে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছিলেন।তিনি থাকতেন এই বাড়ির একেবারে উপরের তলার সুসজ্জিত কামরায়।সারাটা দিন ওনার শুধু বিছানায় শুয়ে শুয়েই কাটত।বোধজ্ঞানও ক্রমে পুরোপুরি লোপ পাচ্ছিল।ক্রমে যত দিন গেছে... নিজের ঘরের লোকদেরই চিনতে পারতেন না।তার সাথে যত কথা বলছিলাম...আমার কৌতূহলের পারদ ততই বাড়তে শুরু করে দিল।

যার সাথে এই বাড়ির ভিতরে ঢুকেছি...সে শুধু সরলই নয়।বড্ড বোকাসোকা...এটা বুঝতে আমার খুব বেশি সময় লাগেনি।কলকাতায় সদ্য এসে সবে প্রথম একখানা কাজের সুপারি পেয়েছিলাম।এছাড়া হাতে কাজ বিশেষ না থাকায় সময় কাটানোর জন্য আমি এর সাথে বেশ বকবক জুড়ে দিয়েছিলাম।আর সেও আমাকে তার পরিবারের সকলের সাথে আলাপ তো করালই...ঘরের এক্কেবারে উপরের কামরায় ওর বৃদ্ধ দাদুর সঙ্গে আলাপ করানোর জন্য নিয়ে গেল।ওর বৃদ্ধ দাদুকে দেখেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম...ওনার মৃত্যু একেবারে আসন্ন।তার ওপর উনি ওনার চোখের দৃষ্টি প্রায় খুইয়ে বসেছেন।উনি আমাকে দেখে একটা সাংঘাতিক ভুল করে বসলেন।উনি ভাবলেন...আমিই নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া বড়ছেলে...যার প্রতীক্ষায় তিনি তাঁর বুকের কঙ্কালসার পাঁজরের ভিতরের হৃদপিন্ডের কম্পনটিকে ঠেকিয়ে রেখেছেন কোনোমতে।আমাকে দেখে তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র ভ্রমে আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমার দুইহাত চেপে ধরে কেঁদে ফেললেন ঝরঝর করে।তাঁর হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া জ্যেষ্ঠপুত্রকা একটিবার চোখের দেখা দেখে নিয়ে মরবেন...এইই যে ওনার শেষ ইচ্ছা সেটা আমার আর বুঝতে বাকি রইল না।মৃতপ্রায় মানুষটি যেন বেশ জোর পেয়ে গেলেন এক লহমায়।অল্প অল্প করে থেমে থেমে তিনি ভালোই কথা বলতে শুরু করলেন।ওনার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া জ্যেষ্ঠপুত্রের জায়গায় বসে ওনার আবেগে উচ্ছ্বসিত কথাগুলোর উত্তরে আমার হু হা ছাড়া আর কিছুই বেরোচ্ছিল না।এই মানুষটা আজ নয় কাল এমনিই মরবেন।একটা কিছু নিয়ে যখন তিনি খুশিতে আপ্লুত হয়ে পড়েছেন...তখন আর কেউই ওনার ভুল ভাঙাতে গেল না।একটা সময় পরে হঠাৎ বৃদ্ধ সবাইকে বললেন...উনি আমার সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চান।আমাকে আর ওনাকে যেন কিছুক্ষণের জন্য একলা ছেড়ে দেওয়া হয়।

বাড়ির গিন্নিমা বললেন..."বুড়ো এখন চাঙ্গা হয়ে প্রলাপ শোনানোর জন্য ক্ষেপে গিয়েছে।"

তা শুনে আমার হঠাৎ পাতানো বন্ধুটি বলল..."দাদুর সম্বন্ধে এইভাবে কেন কথা বলছ জ্যেঠিমা!আর তাছাড়া এতদিন বাদে দাদু যাহোক কথাটথা বলছেন...হাসছেন...এতে সমস্যা কি আছে!কিছুক্ষণ বলুক কথা...তাতে ওনার শরীর মন দুইই ভালো হবে।"

এই কথার পর সে আমার দিকে ফিরে বলল..."আপনি কিছু মনে করবেন না দাদা।বুঝতেই তো পারছেন...ওনার বয়স হয়েছে...বাইরে বৃষ্টি এখনো তো থামেনি।এখানে আরাম করে বসে ওনার কথা যদি শোনেন আপনার কি সময় নষ্ট হবে?"

সত্যি বলতে কি...একটা বৃদ্ধ মানুষের অর্থহীন বকবক শোনবার ইচ্ছা বা ধৈর্য কোনোটাই যে আমার থাকবে না এইটাই ছিল স্বাভাবিক...কিন্তু আমাকে কাছে পেয়ে নিজের জ্যেষ্ঠপুত্র ভ্রমে যেভাবে ওনার চোখ চকচক করে উঠেছিল...আর যেভাবে উনি আমার সাথে কথা বলছিলেন...তাতে আমার ভিতরে ভিতরে একটা প্রচন্ড কৌতূহল চেপে বসেছিল।ওই কৌতূহলবশতই ওই বৃদ্ধের শয্যায় বসে একান্তে ওনার কথা শুনতে আমার কোনো আপত্তি হল না।বরং আমি বললাম..."আরে না না...ওনার কথা শুনতে আমার ভালোই লাগছে।বৃষ্টি যতক্ষণ না থামছে...আমি এইখানেই বসছি।অসুবিধা নেই।"

খুশি হয়ে সে বলল...বেশ...খুব ভালো কথা।আমি তাহলে আপনার জন্য এক গরম কিছু পাঠিয়ে দিই...তা কি খাবেন...চা না কফি?"

আমি কিছু বলবার আগেই বৃদ্ধ প্রায় হাঁ হাঁ করে বলে উঠলেন..."একদম না...যতক্ষণ না আমাদের কথা শেষ না হয়...কেউ আমাদের বিরক্ত করবে না।আর ঘর থেকে যখন বেরোবে তখন দরজাটা বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিয়ে যাবে।বুঝেছ?"

শীর্ণকায় বৃদ্ধের ভিতরে হঠাৎ অমন তেজ আর দাপট দেখে বোধ করি সে বেশ খানিকটা হতভম্ব হয়ে গেল।তারপর আর কোনো কথা না বাড়িয়ে নিশ্চুপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।আর বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিতে ভুলল না।এরপর ওই ঘরে শুধুমাত্র বৃদ্ধ আর আমি।কয়েক মূহুর্তের পিন পড়া নৈঃশব্দ্য আমায় যেন কানে কানে বলে গেল...এই সাক্ষাৎ আমার জীবনে একটা নতুন মোড় নিয়ে আসবে।

বৃদ্ধ আমার হাতদুটি ধরে নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন।ওনার কথাগুলোর সারমর্ম এই...ওনার যিনি জ্যেষ্ঠপুত্র ছিলেন...তিনি মোটেই সংসারী ছিলেন না।বিভিন্ন দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ানোটাই ছিল ওনার নেশা।এই কারণে পরিবারের কেউ তাঁকে পছন্দ করে না।এমনকি ওনার ভাগের সম্পত্তিও নিজেরা ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য সবাই মরিয়া হয়ে উঠেছিল।তাই বৃদ্ধ ওনাকে ওনার ভাগের সম্পত্তি পুরোটাই উইল করে দিয়েছিলেন অনেক আগেই ছেলেকে নিজের কাছে টেনে রাখবার জন্য।ছেলেও খুব ভালোবাসত বাবাকে...কিন্তু কোনোমতেই তিনি ঘর সংসারের গতানুগতিক জীবনে আটকে থাকতে পারেননি।তিনি দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াতেন আর মাঝেমধ্যে বাবার সাথে দেখা করতে আসতেন।আপনি এতদিন যে ঘরে ভাড়া ছিলেন...ওই ঘরখানা ওনারই ছিল।কোনো একটি দ্বীপে তিনি পা রাখেন।সেখানকার আদিম জনজাতির অসভ্য বর্বর মানুষদের সাথে তিনি ভাব জমিয়ে ফেলেন।বেশ দীর্ঘদিন তাদের সঙ্গে থেকে তিনি ওদেরই একজন হয়ে যান।তাদের কাছ থেকেই তিনি শেখেন কিছু গুপ্ত কালোজাদু।প্রাচীন কিছু উপাস্য দেবীর কথা তিনি ওদের কাছ থেকে জেনেছিলেন।তিনি ওদের মুখে শুনেছিলেন...ওই দেবীকে ঠিকভাবে জাগ্রত করতে পারলে...তিনি মানুষের যেকোনো মনোবাসনা পূরণ করার ক্ষমতা রাখেন।তিনি শেষ যখন এসেছিলেন এই বাড়িতে...তখন তিনি গোপনে ওই দেবীর প্রতিষ্ঠা করেন নিজের ঘরের ভিতরে এমনভাবে...যাতে কাকপক্ষীও টের না পায় আর সকলের অজ্ঞাতে এই বাড়ির একটি ঘরের মাটির তলায় প্রতিষ্ঠিত হয় এক ভয়াল দেবীর গুপ্ত মন্দির।

ওই দেবীকে জাগানোর জন্য প্রয়োজন নির্ভুল তিথি নক্ষত্রের কৌশিকী অমাবস্যার রাতে জন্মগ্রহণ করা একটি পঁচিশ বছরের মেয়েসহ আরো পঁচিশটি কাটা মুন্ডের রক্ত।তাহলেই মাটির তলায় প্রতিষ্ঠিত এই দেবীমূর্তি জাগ্রত হয়ে উঠবেন।আর যার হাতে তিনি জাগ্রত হবেন...তার কোনো মনোবাসনা তিনি অপূর্ণ রাখবেন না।বৃদ্ধের সামনে ওনার হারানো জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে আমি অপার বিস্ময় নিয়ে মন দিয়ে ওনার কথা শুনে যাচ্ছিলাম...বৃদ্ধ পই পই করে আমায় নিষেধ করে চলেছেন...ওই ভয়াল দেবীর আসল কাহিনী যেন আমি কাউকে না বলি এবং ওই দেবীকে জাগ্রত করার উপায় যেন ঘুণাক্ষরেও কাউকে না জানাই।তাহলে বাঁচার আর কোনো রাস্তা থাকবে না।নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে ওনার সন্তানেরা যে ভাইয়ের রক্ত বইয়ে দিতেও কসুর করবে না...এই ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই বৃদ্ধের,সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পারলাম।বন্ধ দরজার ভিতরে শুধুমাত্র ভ্রমে আচ্ছন্ন একজন বৃদ্ধের সঙ্গে একা বসে বসে আমি ক্রমশ খুব দৃঢ়ভাবে আমার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিটা আরেকবার ভালোভাবে আমার চোখের সামনে ভাসতে শুরু করল।আমার বাবা মা থেকে আরম্ভ করে আমার গোটা পরিবার আমার উপরে যারপরনাই অসন্তুষ্ট এবং ক্ষুদ্ধ।আমি যে আমার পৈতৃক সম্পত্তির কানাকড়িও পাব না...এই ব্যাপারে আমি ষোলো আনা নিশ্চিত ছিলাম।কাজেই হাতে টাকাকড়ির অভাব না থাকলেও আমার পায়ের তলার মাটিটাই যে নেই...এই অনুভূতিটা আমাকে খুবই যন্ত্রনা দিত।আমার বাবা মা আমাকে মল্লিকাকে বিয়ে করার অনুরোধ করায় আমি তা শোনামাত্র প্রত্যাখ্যান করি কিন্তু এ মেয়ের জন্মের গ্রহ নক্ষত্র সমস্তকিছুর সাথেই যে আশাতীত সাদৃশ্য আমি পেলাম...তাতে আর ওই মেয়েকে বিয়ে করতে আপত্তি করার আর কোনো কারণই যে অবশিষ্ট থাকে না!এই বাড়ির ভিতরে কিছুক্ষণ থেকে এখানকার মানুষজনদের সাথে কথা বলে আমার যা মনে হল...তাতে এই ব্যাপারটায় আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেলাম...আমার কাজ হাসিল করতে আমার খুব বেশি বেগ পেতে হবে না।আর যার হাত ধরে আমি এই বাড়ির ভিতরে আসলাম...তাকেই আমি অতি সহজেই আমার সুবিধা মতো আমার কাজে ব্যবহার করতে পারব।বৃদ্ধের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের সঙ্গে নিজে পুরো পরিকল্পনাটা ছকে ফেললাম।ওই বাড়ির ভিতরে আমি ঢুকব...এবং তারপর কৌশলে ওই দেবীকে জাগ্রত করে আমি আমার মনোবাসনা পূরণ করব।আর তারপর আমার পৈতৃক সম্পত্তির ওপরে রাজ করব আমি একা।এর জন্য নিজের বাবা মা পরিবারের রক্ত দিয়ে নিজের হাত রাঙাতে আমার কোনো সংকোচ ছিল না।কিন্তু এরপরে ওই সম্পত্তির ওপরে আমার একার কতৃত্ব আর মালিকানা নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাটে রাজ করতে পারতাম না।চারপাশে সকলের মনেই একটা সন্দেহ তৈরি হত যেটা আমার জন্য একেবারেই সুখকর হত না।আমি আর সাতপাঁচ না ভেবে এই বাড়ি সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে শুরু করলাম।ওই বাড়ির ভিতরে সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে অশান্তি শুরু হয়েছে...আর এখন যাকে খুনের সুপারি আমার হাতে রয়েছে...ওই হত্যা এই বাড়ির অভ্যন্তরীন ষড়যন্ত্রেরই ফলশ্রুতি।এক ভাইএর কাছ থেকে সুপারি নিয়ে আরেক ভাইকে হত্যা করার জন্য যা টাকা পাব...আমার সমস্ত পরিকল্পনা ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে এতেই আমি ঠিকভাবে লাভবান হতে পারব।আমি আর দেরি করলাম না।আমি এই বাড়ির সম্বন্ধে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি...আমি যার হাত ধরে এই বাড়ির ভিতরে আসি...সে হল এই বাড়ির ছোট ছেলে রঞ্জন।আর যার কাছ থেকে খুনের সুপারি পাই...সে এ বাড়ির মেজো ছেলে।আমি রঞ্জনকেই বানাই আমার তুরুপের তাস।ওকে নিজের মতো করে বুঝিয়ে নিয়ে ওর সাথে গোপনে বন্ধুত্ব পাতাই আর এই বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ি সকলের অলক্ষ্যে।ওই অন্ধকার কুঠুরির ভিতরে আমি আত্মগোপন করে থেকে যাই সকলের অগোচরে...আর রঞ্জনের সাহায্যে সবার প্রথমে এই বাড়ির মেজো ছেলেকেই শিকার বানাই।প্রথমে ওকে...আর তারপর এক এক করে শেষ করলাম। এই বাড়ির প্রতিটি সদস্যকে।বাকি রয়ে গেল একমাত্র রঞ্জন...যার কাছ থেকে এই বাড়ির এ ঘরখানি আপনি যার কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছেন সেই হল এই রঞ্জন।সকলের সন্দেহের তীর অবধারিতভাবেই ওর দিকে এসে পড়েছে আর প্রতিবারই শুধুমাত্র প্রমাণের অভাবে ও বেকসুর খালাস হয়ে গিয়েছে।ক্রমশই এই এতবড় বাড়ির ভিতরে রঞ্জন পুরোপুরি একা হয়ে পড়ে যে এই গোটা পরিবারের এবং বংশের একমাত্র ওয়ারিশ।ওকে আমি পুরোপুরি আমার কব্জায় আনি এবং আমি নিজে দীনবন্ধু নামের এক দরিদ্র ও বৃদ্ধ চাকরের বেশে রয়ে যাই এই বাড়ির ভিতরে।ইতিমধ্যে আমি জানতে পারি...মল্লিকা নামের যে মেয়েটির সাথে আমার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে...ওই মেয়ের জন্মের তিথি নক্ষত্রেরই কোনো মেয়ের খোঁজে আমার আর রঞ্জন দুজনেরই এখন রীতিমতো মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়।তখন বুঝলাম...এহেন বিয়ের প্রস্তাব যে মেঘ না চাইতেই জল!যদিও পরিবারের কথা রাখতে আমি একটা বিয়ে করে নিলেই আমার প্রতি কারোর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হত না যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি খুনখারাপি পুরোপুরি ছেড়েছুড়ে নিপাট সংসারী হয়ে যাই...।এই কারণেই এতদিন ধরে সে বিয়েতে আমি আপত্তি করে এসেছিলাম।শুধুমাত্র দুটি বলিই বাকি ছিল।আর তার মধ্যে একটিই হল উপযুক্ত তিথি নক্ষত্রে জন্মগ্রহণ করা সেই বিশেষ জাতিকা।আমি আর কালবিলম্ব না করে রওনা দিলাম মুর্শিদাবাদ।দীনবন্ধু তার মালিকের কাছ থেকে মাস তিনেকের ছুটি নিল...আর জগাই নিজের পরিবারের কাছে ফিরে এসে সকলের কাছে নিজের পরিবর্তন সম্বন্ধে আশ্বস্ত করল এবং মল্লিকাকে বিয়ে করে ওর সাথে সংসারী জীবনযাপন করবার প্রতিশ্রুতি দিল।ব্যস...আর শুভকাজে দেরী হল না।বেশ ধুমধাম করে মল্লিকার সাথে আমার বিবাহ সম্পন্ন হল আর তার পরেই আমরা হনিমুনে সিকিম গেলাম।আর সেখান থেকেই গোপনে মল্লিকাকে নিয়ে চলে এলাম এই বাড়ির ভিতরে।ব্যস...তারপর থেকে আর কেউই জগাইএর কোনো খোঁজ পায়নি।আর উত্তর কলকাতার এই বাড়িতে ফাইফরমাশ খেটে পেটের ভাত জোগাড় করা বৃদ্ধ চাকর দীনবন্ধুকা দেখেও কারোর কোনোদিন এতটুকুও সন্দেহ হয়নি।উপযুক্ত সময় দেখে এক অমাবস্যার রাতে আমি নিজের হাতে মল্লিকার শিরশ্ছেদ করে দেবীর পায়ে বলি দিই।এরপরে শুধু আর একখানিই বলি দেবার প্রয়োজন ছিল।আমি আর রঞ্জন এর জন্য জোরকদমেই খোঁজ শুরু করে দিয়েছিলাম।ইতিমধ্যেই ভাড়া থাকবার জন্য আপনি এই বাড়ির দরজায় এসে পৌঁছোলেন।তখন আর দুটি বলি দেওয়া বাকি ছিল।পঁচিশটি নরবলি দিতে গিয়ে এই এত বড় প্রাসাদতুল্য বাড়িখানি এক এক করে খালি হয়ে পড়ে।এমনকি চারপাশের কিছু মানুষের হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার রহস্যও যে এই বাড়ির ভিতরেই কোথাও অন্তর্নিহিত রয়েছে...এই সত্যটা কারোর সন্দেহের বাইরে থাকেনি।চব্বিশ নম্বর বলি দেওয়া শেষ করবার পরের টার্গেট হত এই রঞ্জন।আমি আমার সমস্ত পরিকল্পনা এইভাবেই ছকে নিয়েছিলাম আর এই বাড়ির নতুন ভাড়াটেকে যত্নআত্তি করে থাকবার ব্যবস্হা করে আড়ালে আমি বলি দেওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করে তারই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে দিয়েছিলাম।কিন্তু আপনি শিকার হওয়ার অনেক আগেই অনেক কিছু বুঝতে শুরু করে দিয়েছিলেন...তাই বলির জন্য নির্দিষ্ট দিনক্ষণ তারিখ আসবার আগেই আপনাকে ধরেবেঁধে কুঠুরির ভিতরে আটকে রাখতে হয়।

কিন্তু আমার পাপের ঘড়া পূর্ণ হওয়ার সময় হয়ে এসেছিল।আমার নবপরিণীতা স্ত্রীকে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে কলকাতায় এনে ওকে নৃশংসভাবে হত্যা করলাম।ওর আত্মার অভিশাপ যে আমার ওপরে লাগবে এইটাই তো হওয়ার ছিল।আমি ওর সঙ্গে অল্প হলেও যে কদিন ছিলাম,সে কদিনে বুঝেছিলাম...মল্লিকা আসলেই কি ভীষণ উন্মাদের মতো ভালোবাসত ওর প্রথম স্বামীকে।ওর সমস্ত রাগ...অভিমানকে ছাপিয়ে আছড়ে পড়ত ওর সীমাহীন ভালোবাসা।কিন্তু আমার লোভী মন তখন পার্থিব চাওয়া পাওয়া...হিসেব নিকেষের বাইরে আর কিছুই বোঝেনি।আমি শুধু দেবীর পায়ে বলি দিয়ে আমার উদ্দেশ্য পূরণের সিঁড়ি হিসেবে ওকে ব্যবহার করেছিলাম।তবে মরার আগে ও আমায় একটা কথা বলেছিল..."মরতে আমার ভয় নেই...শুধু মরার আগে শেষবারের মতো ও ওর প্রথম স্বামীকে একবার চোখের দেখা দেখতে চেয়েছিল।আমি ওর ওই কাতর অনুরোধে কর্ণপাত পর্যন্ত করিনি।কাটারির এক কোপে ধড় থেকে ওর মাথাটা কেটে ফেলে মেতে উঠি মহা উল্লাসে।আমি বুঝতে পারিনি...কত বড় সর্বনাশ আমি ডেকে এনেছি।মল্লিকার আত্মা ওর ভালোবাসার মানুষটিকে একটিবার চোখের দেখা দেখবার জন্য কতখানি তৃষ্ণার্ত ছিল...!এই কারণেই ওর অতৃপ্ত আত্মা এখনো গুমরে মরছে ওই বন্ধ কুঠুরির ভিতরে।এমনকি এই বন্ধ কুঠুরির ভিতরে শুধু যে এই পরিবারের লোকেদের বলি দিয়েছি...তা নয়।এই বন্ধ কুঠুরির ভিতরে বলি হয়েছে আমার নিজের বাবা মা পর্যন্ত।দীর্ঘদিন আমায় কাছে না পেয়ে আমার মা উতলা হয়ে যখন আমার খোঁজ পাওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠলেন আর বাবা আমায় খবর পাঠালেন...আমি তখন বলির নির্দিষ্ট কোটা কিভাবে শেষ করে উঠব...সেই চিন্তায় অস্হির ছিলাম।এহেন সময় যখন বাবা যখন আমার খোঁজ নিতে শুরু করলেন...আমি তখন ওনাদেরকেই আমার টার্গেট বানিয়ে নিলাম।ওনাদের কলকাতায় আসতে বলে একটা নির্জন জায়গায় আসতে বলে...তারপর মুখে কাপড় বেঁধে ওই দুইজন নির্বল মানুষকে কুপোকাত করে লোকচক্ষুর আড়ালে ওনাদের অচৈতন্য শরীর দুটি কৌশলে এই কুঠুরির ভিতরে টেনে আনার কাজটা রঞ্জনের সাহায্য নিয়ে বেশ সহজেই করে ফেলেছিলাম।সম্পত্তির লোভে নিজের জন্মদাতা পিতা...এমনকি দশমাস দশদিন আমায় গর্ভে ধারণ করেছেন যিনি...সেই মায়ের কাতর আকুতিকেও শেষমেশ রক্তের ছিটায় পরিপূর্ণতা দিতে আমার তখন এতটুকুও হাত কাঁপেনি।এই বন্ধ কুঠুরির ভিতরের দেবীর পায়ে বলি দেবার আগে একটা যজ্ঞে বসার নিয়ম রয়েছে।আর ওই যজ্ঞের পরে কোনো কারণে যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বলি দেওয়া সম্ভব না হয়...তাহলে ওই রক্তখাকী দেবীর হাত থেকে স্বয়ং পূজারীরও নিস্তার নেই।মল্লিকার বিদেহী আত্মাই আপনাকে ওইভাবে আমার কোপ থেকে বাঁচিয়ে টেনে হিঁচড়ে ওই পাতাল কুঠুরির বাইরে বার করে এবং মৃত্যুর ছায়া পর্যন্ত যাতে আপনাকে স্পর্শ না করতে পারে...তার জন্য এখান থেকে আপনাকে সরিয়ে নিয়ে যায় অনেকটা দূরে যাতে কোনোমতে আমি আপনার নাগাল না পেতে পারি।মল্লিকার বিদেহী আত্মা মুক্তির আশায় ছটফট করছে এবং আমার ওপর বিষম ক্রোধে ফুঁসছে...এটা আমি বুঝতে পারতাম।কিন্তু আমার ধারালো কাটারির কোপ আপনাকে স্পর্শ করবার ঠিক আগের মূহুর্তেই সে ওইভাবে আপনাকে বাঁচিয়ে নেবে...আর এতদূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে যে আমি চট করে আপনার নাগাল পর্যন্ত পাব না এটা আমি ভাবতেই পারিনি।কিন্তু বলি দেওয়ার নির্দিষ্ট সময় যত এগোতে থাকল...ততই আমার ভয় ধরতে শুরু করল।কারণ যজ্ঞের পর দেবী নির্দিষ্ট সময়ে জেগে উঠেই রক্তপান করতে চাইবেন।আর আমি যদি তা না দিতে পারি...তাহলে দেবীর রক্ততৃষ্ণা যে আমাকেই মেটাতে হবে এটা আমি ভালোভাবেই জানতাম।আমি যখনই বুঝতে পারলাম শিকার আমার হাতের সম্পূর্ণ বাইরে চলে গিয়েছে... তখন এই মাঘের ভোররাতেও আমার সারা শরীরে ঘাম ছুটে গিয়েছিল।শিকারকে কোনোমতে আর হাতে পাওয়া সম্ভব নয় যখন বুঝলাম...তখন আসন্ন বিপদের অশনিসংকেত আমি পেয়ে গিয়েছিলাম সাথে সাথেই।দেবীর রক্তক্ষুধার প্রকোপ হতে বাঁচতে আমি আর দেরি না করে রঞ্জনের ঘাড়ে কাটারি চালিয়ে দিই।এতে আমি দেবীর রক্তক্ষুধার প্রকোপ হতে বেঁচে গেলেও আমি এটা বুঝতে পারি...বলির সময় পেরিয়ে গিয়েছে বেশ খানিক আগেই।তাই দেবীর প্রকোপ থেকে তখনকার মতো যদিও আমি বেঁচে গিয়েছিলাম...কিন্তু দেবীর ক্রোধের হাত থেকে শেষ পর্যন্ত আমি আর বাঁচলাম না।আমার হাত...পা...মেরুদন্ড বাঁকতে শুরু করে দিল দ্রুতগতিতে এতক্ষণে আমার সারা শরীর অকেজো হয়ে পড়েছে।আমার জীবনের মেয়াদ যে ফুরিয়ে এসেছে...এটা আমি এখন আমার সর্বাঙ্গে ঘিরে বসা অমানুষিক যন্ত্রনা দিয়ে মর্মে মর্মে টের পাচ্ছি।আমি আর বেশিক্ষণ বাঁচব না।আমার মতো পাপীর বোধহয় এইটাই উপযুক্ত শাস্তি ছিল।মরবার মূহুর্ত যত কাছে আসছে...ততই আমার জীবনে করা সমস্ত পাপ যেন আমায় শ্বাপদের মতো গিলে খেতে আসছে।আপনার কাছে আমার শুধু এইটুকুই অনুরোধ...আমার বাবা মা কোনো দোষ করেননি...এই পরিবারের মানুষেরাও কোনো দোষ করেননি।মল্লিকাও সম্পূর্ণ নিষ্পাপ।এঁদের আত্মা এখনো এই বন্ধ কুঠুরির ভিতরে গুমরে মরছে।এঁদের মুক্তির ব্যবস্হা যদি আপনি করেন...তাহলে আমি মরেও শান্তি পাই...।আমার জন্য না হোক...এতজন নিরপরাধ মানুষের জন্য এইটুকু অন্তত করুন...আমি আপনার কাছে হাতজোড় করছি।

দীনবন্ধুর কন্ঠে কাতরতা স্পষ্ট।যদিও হাত দুখানি সামনে এনে জড়ো করবার মতো অবস্হাতেই এখন আর ও নেই...কিন্তু অমন এক নৃশংস কসাইএর চোখের কোল বেয়ে আমি একফোঁটা জল বার হতে দেখলাম।

পুরো ঘটনাটা শুনে আমি বিস্ময়ে এতটাই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম,যে দীনবন্ধুর প্রতি আমার ক্রোধের লেলিহান অগ্নিশিখা কখন যে শান্ত হয়ে পড়ল আমি নিজেই টের পাইনি।এখন দীনবন্ধু ওরফে জগাইকে দেখে আমার করুণা ছাড়া আর কিছুর উদ্রেক হল না।আমি শুধু অবাক হয়ে ভাবতে থাকলাম...আমার শুধুমাত্র পারিবারিক প্রভাব প্রতিপত্তি বা টাকাপয়সার জোর নেই বলেই মল্লিকার বাপের বাড়ির লোকজনেরা মল্লিকার সুখের সংসারটাতে ওইভাবে আগুন জ্বালল আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা বলে বলে ওকে বিষিয়ে তুলে।আর তারপর টাকা পয়সার জোর আর প্রভাব প্রতিপত্তি আছে এমন পরিবারের সাথে মেয়ের বৈবাহিক সম্পর্ক স্হাপন করতে জগাইএর একটা ছেলের সাথে ওর বিয়ে দিল।শুধু টাকার জোর আর পারিবারিক প্রভাব প্রতিপত্তি আছে দেখে ওরা আর ছেলেটার সম্বন্ধে কোনো খোঁজখবর নেওয়ারই প্রয়োজন বোধ করেনি।আর তারই মূল্য নিজের জীবন দিয়ে চোকাতে হল মল্লিকাকে।আমি একটা সহজ সাধারণ ছেলে...যে কোনোদিন কারোর সাতেও ছিলাম না...পাঁচেও ছিলাম।না।আমার জীবনটা বিনা অপরাধে এইভাবে শ্মশান হয়ে গেল।আজ যদি মল্লিকার বাপের বাড়ির লোকেরা টাকাপয়সা প্রভাব প্রতিপত্তি...এইসব চুলচেরা হিসেবনিকেশের বাইরে গিয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা করত...মেয়ের সুখটা আসলে কোথায়...তাহলে সবকিছুই আজ অন্যরকম হত।আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ থাকলাম কিছুক্ষণ।জগাই ফের বলতে শুরু করল।ওর কন্ঠ ক্রমশ বড় ক্ষীণ হয়ে আসছে।ও যে আর বেশিক্ষণ বাঁচবে না...এটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম।জগাই বলল...কুঠুরির ভিতরে যে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে...তিনি আসলেই এক অপদেবী।এই পৃথিবী থেকে তাঁর অস্তিত্ব মুছে দেওয়াতেই সবদিক হতে মঙ্গল।আর এতেই মুক্তি পাবে কুঠুরির ভিতরে ছটফট করতে থাকা সমস্ত মৃত মানুষদের আত্মা।আপনি কুঠুরির ভিতরে ঢুকে ওই দেবীর মূর্তিটাকে উঠিয়ে এনে যদি তা পুড়িয়ে ফেলেন...তাহলেই তা সম্ভব হবে।আপনি দয়া করে যান...আর দেরী করবেন না...।আমার আয়ূ আর বেশিক্ষণ নেই।মরার আগে যদি এঁদের মুক্তির ব্যবস্হা হতে দেখে যাই...তবে আমি একটু শান্তি পাই...।আমি আর কথা বাড়ালাম না।জগাইকে ওর আসন্ন ভবিতব্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে আমি উঠে এলাম...আর কুঠুরির ভিতরে প্রবেশ করলাম।মোবাইলের আলোটা জ্বেলে নিলাম।এই প্রথম আমি ভালোভাবে কুঠুরির ভিতরটা দেখলাম।চারদিকে শুধুই রক্তের ছিটা।যেন রক্ত নিয়ে এখানে কেউ হোলি খেলেছে।পাশেই পড়ে রয়েছে রক্তমাখা কাটারি।দিনের পর দিন এই বন্ধ কুঠুরির ভিতরে যে কত পাপ জমা হয়েছে...সেটা ভাবতেই আমার যেন সারা শরীর অবশ হয়ে আসল।এখান থেকেই ভেসে আসত মল্লিকার কাতর আর্তধ্বনি।ও বারে বারে আমাকে শুধু এখান থেকে চলে যেতে বলত।আজ সমস্তটা আমার কাছে এখন দিনের আলোর মত পরিষ্কার।আমি ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে ওই বিকটদর্শন ভয়াল অপদেবীর মূর্তিখানি হাতে তুলে নিলাম।আর তারপর কুঠুরির বাইরে বেরিয়ে এলাম।তারপর মূর্তিখানি হাতে নিয়ে চলে এলাম বাড়ির সামনের বাগানটাতে।চারপাশে দেখলাম...সকাল হয়ে গিয়েছে।ঝলমলে সূর্যের আলো নতুন দিনকে স্বাগত জানানোর জন্য সেজে উঠেছে।আমি চারপাশ থেকে কিছু আগাছা আর গাছের ডাল জড়ো করে রাখলাম মূর্তিটির ওপরে।তারপর ওতে আগুন জ্বালিয়ে দিলাম।দেখলাম...একটু একটু করে মূর্তিটি ভস্মে পরিণত হচ্ছে।যখন মূর্তিটি পুরোপুরি মাটির সাথে মিশে গেল...তখন দেখলাম...শান্তনু আর সৃজন পুলিশ নিয়ে এসেছে।পুলিশের অনেক আগে থেকেই এই বাড়ির প্রতি গাঢ় সন্দেহ ছিল।কিন্তু কোনোমতেই প্রমাণ সমেত কাউকে ধরা যাচ্ছিল না।এখন তারা এই বাড়ির ভিতরে ঢুকে অফিসিয়ালি পুরো ব্যাপারটা ইনভিস্টিগেট করতে এল।ছদ্মবেশী দীনবন্ধুর কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই।সারা শরীরে মৃত্যুর যন্ত্রনা নিয়ে পুলিশের সামনে যে এখন কাতরাচ্ছে...সে জগাই।যার খোঁজে এতদিন হন্যে হয়ে রীতিমতো নাকানিচোবানি খেয়েছে পুলিশ।আজ সে একেবারে সশরীরে পুলিশের সামনে।তখনো ওর শরীরে প্রাণ অবশিষ্ট ছিল।পুলিশকে আসল ঘটনার জবানবন্দি দিয়ে সমস্ত সত্য স্বীকার করতে করতে পুলিশের সামনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে জগাই।সমস্ত চিত্রটা পরিষ্কার হয় পুলিশের কাছেও।দিনের পর দিন পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বৃদ্ধ চাকরের ছদ্মবেশ ধারণ করে...বাড়ির বোকাহাবা আধপাগল ছেলেকে ভুল বুঝিয়ে নিজের কাজে ব্যবহার করে যেভাবে এতবড় হত্যালীলা চালিয়ে গিয়েছে জগাই...তার পুরো বৃত্তান্ত শুনে পুলিশের পর্যন্ত চোখ কপালে উঠেছে।এতবড় বাড়িটা এখন পুরোপুরি প্রাণশুন্য।ওই বাড়ির একজন ওয়ারিশও আর বেঁচে নেই।নেই আর একজনও বংশধরের অস্তিত্ব।ওই বাড়ি যে সরকারের সম্পত্তি হতে চলেছে সেটা আর বোঝার বাকি থাকে না।আমি শুধু একবুক শুন্যতা নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব কলকাতার চাকরি ছেড়ে ফিরে আসলাম আমার গ্রামে।সেখানে এসে শুনলাম...আমার বৃদ্ধা ঠাকুরমা আর বেঁচে নেই।পাড়া প্রতিবেশীরাই ওনার দেহ সৎকার করে দিয়েছেন।এই এত বড় পৃথিবীর বুকে আমি একেবারে একা হয়ে গেলাম।বেঁচে থাকবার আর কোনো ইচ্ছাই আর আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই।ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ঘরে ঢুকে একমন অনিচ্ছা নিয়ে কোনোমতে দুটো চালডাল ফুটিয়ে নিলাম।এই এত বড় একখানি শুন্য জীবন টেনে নিয়ে যাবার কোনো অর্থই আর আমার কাছে নেই।কোনোমতে পেটে দুটো খাবার ঢুকিয়ে নিলাম।

রাত গভীর।জানলার বাইরের সুন্দর জ্যোৎস্নার আলো জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে ঘরের ভিতরের পরিবেশটাকে মায়াবী করে তুলেছে।আমার বালিশে শুয়ে সেইদিকেই মগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আর মল্লিকার কথা ভাবছি।আস্তে আস্তে হাতে তুলে নিলাম বালিশের তলায় রাখা ফল কাটার ধারালো ছুরিখানা।তারপর সেটা নিজের বুকে বসাতে যাব...তখনই কোনো এক শীতল স্পর্শ রুখে দিল আমার হাত।আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলল...আমি তো আছি গো তোমার সাথে...তুমি যতদিন বাঁচবে...আমি এভাবেই থাকব তোমার সঙ্গে।এই স্পর্শ আর কন্ঠস্বর যে আমার ভীষণ চেনা...!আমি আনন্দে আকূল হয়ে ওই স্পর্শ আর ওই কন্ঠস্বর অনুসরণ করে ওই আঁধার ঘরে নিজের বুকের ভিতরে জড়িয়ে নিতে উতলা হয়ে উঠলাম।ওর বায়বীয় অস্তিত্বকে দুইহাতে আঁকড়ে ধরার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠলাম।কিন্তু তাতে কোনো লাভ হল না।কিন্তু আমার হাতে ধরা ওই ধারালো ছুরিখানা আমার হাত থেকে একটা প্রবল শক্তি সজোরে ফেলে দিল মাটিতে।আমি বুঝতে পারলাম মল্লিকা আমায় কি বলতে চাইছে।আমি বলে উঠলাম..."তুমি যা চাইছ তাই হবে।শুধু তুমি এইভাবেই প্রতিরাতে আমার কাছে এসো...আসবে তো?"

কানের কাছে মল্লিকার অপার্থিব কন্ঠ দৃঢ়ভাবে আমায় আশ্বাস দিয়ে বলে উঠল..."থাকব।"


সমাপ্ত



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror