প্রহসন
প্রহসন
প্রহসন পূজোর ছুটি পড়বার আর খুব একটা বেশি দেরি নেই।আকাশ এখন বেশ পরিষ্কার।নীল আকাশের বুকে পেঁজা তুলোর মতো মেঘগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে মনের আনন্দে।জানলার কাছে পড়ার টেবিলে বসে চা খেতে খেতে একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে বিহান।ওর মনটা এখন বেশ চনমনে...খুশি খুশি।ওর হঠাৎ মনে হতে লাগল...আসন্ন পূজোর ছুটিতে...প্রতিবারের মতো প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে ঠাকুর দেখার পরিকল্পনা না করে...কিছু অন্যরকম করলে হয়...।যেমন ভাবা...সাথে সাথেই আপনা থেকেই ওর হাত চলে গেল মোবাইলের দিকে।ফোনটা হাতে নিয়েই সাথে সাথে ফোন দিল অঙ্কুশকে।ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল গলা... ---"হ্যাঁ রে বল ভাই...কি খবর তোর?" ---খবর ভালোই...শোন না...এ বছর পূজোয় কি প্ল্যান আছে রে তোর?" ---"পূজোর প্ল্যান বলতে আলাদা করে কিছু ভাবিনি...ওই... ঠাকুর দেখব আর প্রচুর সুখাদ্য ঠাসব পেটে...!" ---"শোন না...আমি একটা জিনিস ভাবছি...প্রতি বছরের মতো পূজো না কাটিয়ে...এ বছরটা একটু অন্যরকম করলে কেমন হয়?" ---"অন্যরকম?সেটা কিরকম?" ---"তোর মনে আছে...স্কুলে থাকতে...ক্লাস ইলেভেনে...একবার আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে প্ল্যান করেছিলাম...একটা বড় ছুটি আমরা ঘরে না থেকে... একটা অজানা জায়গায় ঘুরতে গিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করতে চেয়েছিলাম...!" লাফিয়ে উঠে অঙ্কুশ বলে উঠল..."মনে নেই আবার...আমাদের এই গ্রুপটায় সকলের মধ্যে যত আজগুবি ভাবনা আর প্ল্যান তো তোর মাথাতেই খেলত।তোর ওই পরিকল্পনার কথা শুনে আমরা সকলেই দারুণ লাফিয়ে উঠেছিলাম।কিন্তু ঘরে এসে বাবার সামনে কথাটা পাড়বার আগে তো আমার হৃৎপিন্ডটাই লাফিয়ে উঠছিল...যাহোক করে কোনোমতে বোনকে দিয়ে আবেদনটা পাঠিয়েছিলাম বাবার কাছে।তারপর এমন বিরাশি সিক্কার এক থাপ্পড় খেয়েছিলাম...সে জীবনে ভোলার নয়।" ---"ধুর...তোর মগজ ছিল গোবর দিয়ে ঠাসা।কাকিমার কাছে আগে থাকতেই রাজ্যের ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান করে...শেষ মূহুর্তে বাবার কাছে কথা পেশ করলে হবে?তোর বায়নার খবর নিশ্চয়ই কাকুর কাছে অনেক আগেই পৌঁছে গিয়েছিল...আর তারপর টুসকি যখন ফের নতুন কায়দায় ব্যাপারটা পেশ করতে গেল তখনই কাকু গেলেন ক্ষেপে!এ আমাদের আর বুঝতে বাকি নেই।" ---"হ্যাঁ...তা আমার মাথায় না হয় গোবর ছিল বলে আমি থাপ্পড় খেলুম...তা তোরা কোন বীরপুরুষ ছিলটি শুনি?রাতুল আর অর্নব তো সাহস করে কথাটা বলতেই পারল না।আর বাদবাকি তুই... মিনমিন করে কাকুর কাছে কথাটা পেড়েছিলি ঠিকই...কিন্তু তাতে লাভ কি কিছু হয়েছে?সেই তো তোকে শুনতে হয়েছে..."আগে স্কুল পেরোও...আরো বড় হও...তারপর যেখানে যাবার...যাবে।" তোরা একজনও কি পারমিশন আদায় করতে পেরেছিলি?" ---"হ্যাঁ রে...যা বলেছিস...স্কুল পেরিয়ে কলেজে উঠতে পড়াশোনার চাপ...তারপর চাকরি বাকরি...।জীবনটা একটু শ্বাস ফেলে বাঁচাই হল না...। ---"তা এখন তোর মাথায় কি পরিকল্পনা ঘুরপাক খাচ্ছে শুনি?" ---"শোন না...স্কুলে পড়ার সময়ে করা পরিকল্পনাটাকে যদি এখন আমরা বাস্তব রূপ দিই...এই আসছে পূজোর ছুটিতে?তাহলে কেমন হয়?" ---"হ্যাঁ রে...এটা তো একটা দারুণ আইডিয়া।অফিসে কাজের চাপে এখন জীবন একেবারে জেরবার।এই সময়ে যদি কদিনের ছুটিতে কোথাও একটা ঘুরে আসা যায়...তাহলে বেশ হয়।" ---"তাহলে শোন...বাকি তিনজনকে এই পরিকল্পনার কথাটা বলে দে এখনি।আজ রাত এগারোটা নাগাদ হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কনফারেন্সে বসে পাঁচজনে মিলে ঠিক করা যাবে...কোথায় যাওয়া যাবে...।" ---"হ্যাঁ একদম...তুই আপাতত ফোনটা রাখ...আমি এক্ষুনি বাকিদের খবরটা দিয়ে দিচ্ছি।তাহলে এগারোটা নাগাদ দেখা হচ্ছে...।রাখলাম রে...।" পাঁচ বন্ধু মিলে রাত্রি এগারোটা নাগাদ বেশ জম্পেশ করে বসে গেল হোয়াটসঅ্যাপের ট্যুর সংক্রান্ত জরুরী মিটিংএ।বিভিন্ন মতানৈক্য...সুবিধা অসুবিধার টালবাহানা...ঝগড়া...খুনসুটি ...আর দিলখোলা গল্পগাছার পরে অবশেষে পাঁচ বন্ধু মিলে মনস্হির করল...আসছে পূজোর ছুটিতে...ব্যাঙ্গালোর সংলগ্ন মাকালিদুর্গা পাহাড়ে যাবে।এতে ট্যুর আর অ্যাডভেঞ্চার দুইই হয়ে যাবে।রথ দেখা কলা বেচা দুইই হয়ে যাবে একসঙ্গে...! এই পাঁচ বন্ধুর গ্রুপটাকে অনেকেই রসিকতা বলে পঞ্চপাণ্ডব বলে আখ্যায়িত করত এককালে।এখন অবশ্য চিত্রটা অনেকখানিই পালটে গিয়েছে।পাঁচবন্ধু প্রত্যেকেই এখন যে যার জীবনে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।কিন্তু ওদের ভিতরকার সম্পর্কটা একদম এক ও আগের মতোই অটুট রয়েছে এমনই...মজবুত সিমেন্টের বিজ্ঞাপন বানানো যেতে পারে অনায়াসে...। বছর পঁচিশ বয়সে এসেও অবোধ বালকের মতোই কোনো ছেলেভুলোনো আনন্দে একাকার হয়ে যেতে পারে এরা এক নিমেষে।এই পাঁচজনের ভিতরে একজনও যদি বাদ পড়ে যায় কোনো কারণে...তাহলে ওদের চারজনকেই অসম্পূর্ণ মনে হবে রীতিমতো।একসঙ্গে স্কুলে পড়ে...খেলাধুলা করে ওদের বড় হওয়া।হঠাৎই এই পূজোর ছুটির আসন্ন চারদিনব্যাপী অবকাশটাকে উপলক্ষ্য করে...ওরা পাঁচজনেই যেন ফের হারিয়ে গেল ফেলে আসা সেই রঙিন শৈশবে। প্ল্যান পরিকল্পনা রেডি করে...তারপর সেইমতো সব ব্যবস্হাপনা সেরে ফেলতে সময় লাগল না মোটেই।ট্রেনের টিকিট বুকিং থেকে শুরু করে যাবতীয় ব্যবস্হাপনা করে উঠতে উঠতেই বেজে উঠল পূজোর বাদ্যি।ষষ্ঠির দিন সকাল সকাল পাঁচবন্ধু এসে মিট করল হাওড়া স্টেশনে। ট্রেন চলে আসল যথাসময়ে।সারা বছর ধরে অফিসের কাজের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা হওয়ার পরে চারদিনের জন্য হলেও...আসন্ন একটা এতখানি লং জার্নি র জন্য ওদের পাঁচজনের মেজাজই এখন ফুরফুরে।ওরা যেন ফিরে গেছে পাক্কা দশ বছর আগে।হৈ হৈ করে ট্রেনে উঠে পড়ল সবাই।পাঁচজনেরই যেন খুশি আর বাঁধ মানছে না।গল্পে...গানে...কথায়...সময় যেন তুড়িতেই ফুরিয়ে যাচ্ছে।ইশকাপনের টেক্কাটা যেই অঙ্কুশের তাসের সেটের পাশে গুঁজে দিল বিহান অমনি সঙ্গে সঙ্গে বাকিরা ফেটে পড়ল আনন্দ আর উল্লাসে। ব্যাজার মুখ করে অঙ্কুশ বিহানের উদ্দেশ্যে বলল..."ওরে শয়তান ছেলে...তোর পেটে পেটে এই ছিল তবে?দাঁড়া...এক মাঘে শীত যায় না...এরপরের টার্মে তোকে এক্কেবারে নাকানিচোবানি খাওয়াব।" রাতুল বলে উঠল..."আর তোকে পরের টার্ম খেলতে হবে না...পরের স্টেশনেই তো নামতে হবে আমাদের...!" সত্যিই...হাসি কথা আর জমাটি আড্ডায় কখন যে এতখানি সময় ফল্গুধারার মতো চোখের নিমেষে বয়ে চলে গেল...তা ওরা কেউই টের পায়নি।ব্যাগপত্র নিয়ে ওরা রেডি হল ট্রেন থেকে নামবার জন্য।হোটেল পর্যন্ত পৌঁছনোর রাস্তাটা বড় দীর্ঘ। ব্যাগপত্র নিয়ে হোটেল পর্যন্ত যাওয়ার জন্য...একটা কার বুক করে নিল ওরা।ধোঁয়া উড়িয়ে গাড়ি এগোতে শুরু করল ওদের গন্তব্য...হোটেলের পথের দিকে।হঠাৎ অঙ্কুশ বলে উঠল..."বড্ড চা তেষ্টা পেয়েছে রে....সামনের দোকানটায় একটু চা খেয়ে নিলে হয় না?" বিহান বলে উঠল...তা মন্দ বলিসনি।সকালে ট্রেন থেকে নামবার তাড়াহুড়োয় চা টা ঠিক করে খেতেই পারলাম না।ড্রাইভার...সামনেওয়ালা উস দুকানকি সামনে গাড়ি রোকো...!তুমভি কুছ চায়ে নাস্তা কর লো...হামারে সাথ...।" গরম গরম ধোসা আর সাথে ধোঁয়া ওঠা গরম চা বেশ তৃপ্তির সঙ্গেই খাচ্ছিল বিহান।অঙ্কুশ,দোকানের ভিতরে ধোসাটা খাওয়া শেষ করে...চা টা হাতে নিয়ে ওরা দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে আয়েশ করে তাতে চুমুক দিচ্ছিল।হঠাৎই ওদেরকে এবং আশেপাশে থাকা প্রতিটি মানুষকে প্রচন্ডভাবে চমকে দিয়ে...খুনখুনে এক বৃদ্ধা আক্রমণাত্মক এবং অমানুষিক হিংস্র মনোভাব নিয়ে রীতিমতো চড়াও হল ওদের সামনে।গাড়িতে করে আসবার পথে এই আলুথালু নোংরা শাড়ি পরা কুৎসিত দর্শন এই বৃদ্ধাটিকে ওরা স্টেশনের কাছাকাছি জায়গায় ঘোরাফেরা করতে দেখেছিল।আর ওরা এতটুকু পরিষ্কার বুঝতে পারছে...শুধুমাত্র গাড়ি না করলে পরে...এতটা রাস্তা পেরিয়ে এই পর্যন্ত আসাটা কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়।বৃদ্ধা এসেই সাথে সাথে বিহানের হাতে সজোরে ধাক্কা দিগে গরম চায়ের পাত্রটা ফেলে দিল মাটিতে।তারপর প্রবল ক্রোধের সঙ্গে বৃদ্ধা দুইহাতে চেপে ধরল বিহানের গলা!আচমকা এহেন আক্রমণের মুখে পড়ে বিহানের তো একেবারে নাকানিচোবানি খাওয়ার মতো দশা হল।বিহান তো বটেই...চারপাশের সকলেই এরকম একটা অপ্রত্যাশিত ব্যাপার দেখে প্রচন্ডভাবে ঘাবড়ে পুরোপুরি বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।ব্যাপারটা যে কি হচ্ছে আর কেনই বা হচ্ছে তার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝে পেল না কেউই।ওদিকে বিহানের গলায় তখন চা আটকে দম আটকে আসবার উপক্রম হয়েছে...আর বৃদ্ধা সমানে গগনভেদী চিৎকার করে বলে চলেছে..."এইবার মরবি...মরবি...সবকটা এইবার মরবি...কেউ রেহাই পাবি না আর!' কথাগুলো বলছে আর ক্রোধান্বিত...পৈশাচিক এক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে ওই বৃদ্ধা।চারপাশে সকলে...এমনকি বিহানের সাথে আসা ওর বাকি বন্ধুরাও বাকরুদ্ধ হয়ে গেল পুরোপুরি।কেউ কিছু বলবার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পেল না। বেশ খানিকক্ষণ পরে চারপাশে সকলেই সম্বিৎ ফিরে পেল হঠাৎ।সাথে সাথে ওরা ছুটে এল বৃদ্ধার কবল থেকে বিহানকে বাঁচাতে।বৃদ্ধার ওইরকম কঙ্কালসার চেহারা হলে হবে কি...!বৃদ্ধার প্যাঁকাটি শরীরের শক্তির কাছে এতগুলি লোকের রীতিমতো নাকের জলে চোখের জলে অবস্হা হল।যতক্ষণ না পর্যন্ত বৃদ্ধা নিজে বিহানের গলা থেকে আলগা করে নিল তার বজ্রমুষ্ঠি...ততক্ষণ পর্যন্ত বিহানের চারবন্ধু সহ চারপাশে উপস্থিত সকল লোকের কোনোরকম প্রচেষ্টা কোনো কাজেই আসল না।বিহানের গলা থেকে হাত আলগা করার পরক্ষণেই সাথে সাথে বৃদ্ধা চারপাশে তাকাল সভয়ে...ভিতরে এক তীব্র বিতৃষ্ণা আর ঘৃণাভরা চাহনি নিয়ে।যেন চারপাশের লোকগুলো বৃদ্ধার হাত থেকে বিহানকে বাঁচাতে নয়...বরং ওকে ফাঁসিতে ঝোলনোর যোগসাজশে মগ্ন সকলে...! এরপরে কাটল আরো কিছু নীরব মূহুর্ত।তারপর হঠাৎই বৃদ্ধা একেবারে পাঁইপাঁই করে...তাড়া খাওয়া হরিণের চেয়েও দ্রুতগতিতে দৌড় লাগাল।চোখের নিমেষে কিভাবে কোথায় সে পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেল তার খেই পেল না বিহানরা।ঘোর কাটবার পর...এবার বিহান নিজেকে খানিক সামলে নিয়ে...শার্টে পড়ে যাওয়া চা একটু ঝেড়েপুঁছে পরিষ্কার করে নিয়ে...এবার চারপাশের লোকেদের জিজ্ঞাসা করল..."এসবের মানে কি?কে এই বৃদ্ধা?' এই প্রশ্নটার সঠিক জবাব এখানে দিতে পারল না কেউই।এই বৃদ্ধাকে স্হানীয় লোকেরা প্রায় সকলেই চেনে।মানসিক ভারসাম্যহীন এই বৃদ্ধা...একটা পুরোনো বাংলোবাড়ির ধ্বংসস্তূপ আঁকড়ে পড়ে রয়েছে বছরের পর বছর ধরে।স্হানীয় লোকেরা তো বলে..."বদ্ধ উন্মাদ এই বৃদ্ধা যমেরও অরুচি।" চারপাশে লোক খোকা থেকে জোয়ান হচ্ছে...জোয়ান থেকে হচ্ছে বৃদ্ধ...তারপর সময় এলে পট করে মরেও যাচ্ছে...কিন্তু এই বৃদ্ধার যেন মরণই নেই।কত যে বয়স তার...বলা শক্ত।ওই ভগ্ন বাংলো বাড়ির আশেপাশেই ঘুরে ঘুরে বেড়ায় বৃদ্ধা এমনভাবে...যেন ওখানে তার প্রাণভোমরা লুকিয়ে রাখা রয়েছে অতি যত্নে...গোপনীয়তার সাথে।এমন একটা বন্ধনে সে আটকা পড়ে রয়েছে...যে মরণও যেন ওই জায়গা থেকে বৃদ্ধাকে টলাতে অপারগ!চারপাশে ঘুরে বেড়িয়ে...আর চারপাশের সব লোকজনকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেই কাটে তার দিন।মানুষ দেখলেই পাগল কুকুরের মতো খেঁকিয়ে উঠে শাপশপান্ত করাটাই বৃদ্ধার চিরাচরিত স্বভাব।তাই তাকে কেউই পাত্তাটাত্তা দেয় না বা বলা ভালো...ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না।কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনোদিন কেউ ওই বৃদ্ধাকে এইভাবে কারোর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেনি।আজ যেটা ঘটল...সেটা সকলের কাছেই পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত। প্রথম দিন একটা নতুন জায়গায় পা রাখামাত্রই এমন একখানি ঘটনায় পাঁচজনেই বেশ হতচকিত হয়ে গেল।চারপাশের সকলে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল...ওই বৃদ্ধাকে এতদিন ধরে এড়িয়ে চলা হয়েছে বটে...কিন্তু আজ যে কান্ডটা ঘটল...তারপর আর হাত পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকা আর উচিত নয়।ওই পাগলী বৃদ্ধার একটা কোনো ব্যবস্হ। না করলে...এরপরে বাইরে থেকে আসা পর্যটকদের সামনে আর মানসম্মান রক্ষা করে চলার জায়গা পাওয়া যাবে না। সবটা শুনল ওরা...পুরো ব্যাপারটা শুনে একটা বিস্ময় জাগল ওদের ভিতরে। সাথে জাগল একরাশ কৌতূহল।কে এই বৃদ্ধা?বছরের পর বছর ধরে একটা ভগ্ন বাংলোবাড়ি আঁকড়ে সে কেন পড়ে থাকে?আর মানুষজন দেখলেই কেন ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে যায়?কেউ কি কোনোদিন খোঁজ নিয়ে জানার চেষ্টা করেছে...এইসব প্রশ্নের উত্তর!বৃদ্ধার পরিচয়...তার অতীত জীবন নিয়ে কারোরই যে কোনো মাথাব্যথা নেই...এটা ভালোভাবেই বুঝতে পারছে ওরা। যাইহোক...ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে...ওরা গাড়িতে উঠে পড়ল ঝটপট করে।এতখানি ট্রেনজার্নি করে এসে এইবার হোটেলে পৌঁছে একটু ফ্রেশ হতে হবে। গাড়িতে ওঠার পর থেকেই বিহান কেমন যেন আনমনা হয়ে রইল। অঙ্কুশ সেটা খেয়াল করে বিহানের কাঁধে আলতো ঠেলা দিয়ে বলে উঠল..."কি রে...কোথায় হারিয়ে গেলি? অঙ্কুশের ঠেলা খেয়ে সম্বিৎ ফিরল বিহানের।বাকি তিনজন তখন নিজেদের মধ্যে আড্ডায় একেবারে মশগুল।বিহান এবার গলা খাঁকারি দিল বেশ জোরেই তারপর সবার উদ্দেশ্যে বলল..."তোদের সবাইকে আমার এখন একটা কথা বলার আছে।আমার প্রস্তাবটা তোদের পছন্দ হয় কিনা দেখ...!" বিহানের কথা শুনে বাকি সকলেই বেশ নড়ে চড়ে বসল আর ওর কথা শোনার জন্য মনোযোগী হল।কিন্তু বিহান যে প্রস্তাবটা দিল...সেটা হজম করতে ওদের প্রত্যেকেরই খানিকটা সময় লাগল। বিহান একরাশ উত্তেজনা মাখা কন্ঠে...সবাইকে শুধাল..."হ্যাঁ রে...হোটেলের রুম বুক করা হয়েছে...সেখানে না উঠে সকলে মিলে যদি ওঠা হয় ওই ভগ্ন বাংলোর ভিতরে...তা হলে কেমন হয়?" ঝাঁঝিয়ে উঠে অঙ্কুশ বলে উঠল..."তোর কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?ওই ঝোপ জঙ্গল আর আগাছায় ভরা ভগ্ন বাংলোয় আমরা কেন থাকতে যাব?আমরা কি বেড়াতে এসেছি নাকি আমরা শরণার্থী উদ্বাস্তু?" এইবার বিহান নড়েচড়ে বসল।তারপর বলল "আমি যেটা বলছি এখন...একবার তোরা শুধু ভালো করে ভাবনাচিন্তা করে দেখ...আমরা একটা ট্যুর কেন অর্গানাইজেশন করলাম?মনে পড়ে...ক্লাস ইলেভেনে পড়তে...আমরা এইরকমই একটা ট্যুর করব বলে ক্ষেপে উঠেছিলাম...কিন্তু বাড়ি থেকে অনুমতি মেলেনি...কিন্তু আমাদের কি আদৌ ট্যুর করার উদ্দেশ্য ছিল কি?আমাদের তো ছিল অন্য উদ্দেশ্য!" ---"অন্য উদ্দেশ্য...সেটা কিরকম?" বলে উঠল রাতুল। ---"আমাদের রক্ত টগবগ করে ফুটছিল অ্যাডভেঞ্চার করার জন্যই তো নাকি?একবার তোরা সবাই নিজেদের দশ বছর পিছনে নিয়ে যা...সেদিনকার সেই উত্তেজনার সঙ্গে আজকের সব সুর কি মিলিয়ে দেওয়া যায় না?কি বলিস তোরা? বিহানের কথা শুনে ওরা সকলেই এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। হঠাৎ অঙ্কুশ বলে উঠল..."ওকে ডান...তোর এই প্রস্তাবটা এক কথায় ফাটাফাটি।আমি প্রথমটায় বুঝতে পারিনি।ট্যুরে আনন্দের সাথে এতে অনায়াসেই যোগ হবে একটা থ্রিলিং অনুভূতি।আমি তো এ প্রস্তাব লুফে নিলাম।তোরা সবাই কি বলিস?" ---"হ্যাঁ রে...এখন আমারও মনে হচ্ছে...হোটেল টোটেল নয়।ট্যুরের আনন্দ পুরোদমে এনজয় করার জন্য এইটাই হচ্ছে বেস্ট পলিসি। লাফিয়ে উঠে বলে উঠল অর্নব। সেই তালে তাল মিলিয়ে এবার রাতুল আর আরবিরও বলে সমস্বরে বলে উঠল..."আমরাও তোদের পাথে একদম সহমত।" এরপর পাঁচ বন্ধুর গাড়ি টার্ন নিল পাহাড়ের কোলে রহস্যে ঘেরা...নির্জন জঙ্গলে আচ্ছাদিত এক ভগ্ন বাংলোর অভিমুখে।যদিও ওদের গাড়ির ড্রাইভার কিন্তু সেই পথে যেতে রাজি হয়নি একেবারেই।সে ওদের এমন একখানি সিদ্ধান্ত শোনা অব্দি তো ভীষণভাবে চমকে উঠেছিল।তারপর বলেছিল..."বাবু...আপলগোকা জান প্যারা হ্যায় তো উধার পে মত যাইয়ে।ইয়াহা পে ঘুমনেকে লিয়ে বহত আচ্ছে আচ্ছে জাগা হ্যায়।বিনা ওয়াজা কি মুসিবতমে মত যাইয়ে।" ---"মুসিবত?কিরকম মুসিবত?" খানিক হেসে বলে উঠেছিল বিহান। ---"উও যো বাংলে পে আপলোগ শিফট হোসনে কি বাত কর রাহা হ্যায়...ওয়াহাপর চুড়েল হ্যায়।আপলোগোকো জিন্দা খা যায়েগি।" ভয়ে ভয়ে বলে উঠেছিল ড্রাইভার। ---তা ভালোই হবে।আমাদের তবে সামনে থেকে পেত্নি দেখবার সুযোগ হয়ে যাবে...আর আমাদের খেয়ে সে হজম করতে পারবে না।আমরাই বরং সে পেত্নিকে ভালো করে খাইয়ে দেব।" হাসতে হাসতে বলে উঠেছিল বিহান। ড্রাইভার আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল...কিন্তু অঙ্কুশ অর্নব রাতুল আর আবির ড্রাইভারকে সমস্বরে থামিয়ে দিয়ে তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে ওই ভগ্ন বাংলোর দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি আরম্ভ করল। ড্রাইভার ব্যাপারটা মন থেকে মানতে না পারলেও কি আর করা...গাড়ি চালানোটাই তো ওর ব্যবসা...আর ব্যবসায় খদ্দের হল লক্ষ্মী আর ব্যবসায়ী হল পেঁচা।কাজেই ওদের কথা অমান্য করতে আর সে পারল না।কিন্তু সেইসাথে সে এই শর্ত দিল...ওই বাংলো সে দূর থেকে দেখিয়ে দিতে পারবে বড়জোর...কাছাকাছি যেতে পারবে না।পাঁচবন্ধু তাতেই রাজি।পাঁচজনেই বছর পঁচিশের হাট্টাকাট্টা যুবক।লাগেজ টাগেজ ঘাড়ে করে পাহাড়ী রাস্তা পেরিয়ে উপরে উঠে গন্তব্যে পৌঁছতে ঠিকই পারবে ওরা।কারোর সাহায্য ওদের লাগবে না। সেইমতো গাড়ি ঘুরিয়ে সেই রহস্যময় ভগ্ন বাংলোর পথ ধরে গাড়ি এগোচ্ছিল ঠিকই...তবে যাওয়ার পথে বারেবারে সাবধান করছিল সে...আর বলছিল...এখনো সময় আছে...রাস্তাটা বদলে নিলে পাঁচজনের প্রাণই এ যাত্রায় বেঁচে যাবে। ড্রাইভারের সাবধানবানি শুনে শুনে এবার তিতিবিরক্ত পাঁচজনেই। অঙ্কুশ বলে উঠল...এই জায়গাটা একেবারেই গ্রাম্য।আর সেইসাথে এখানকার মানুষজনের মগজ কুসংস্কারে এক্কেবারে ঠাসা।নয়তো এইসব আজগুবি গল্পকথায় কেউ বিশ্বাস করে বসে থাকে আজকের যুগে?" ---"হ্যাঁ রে ভাই...যা বলেছিস...মানসিক ভারসাম্যহীন আর সেইসাথে সহায় সম্বলহীন একজন বুড়ি মানুষকে কেউ নিজে থেকে দুটো খেতেও দেয় না আর আশ্রয়ও দেয় না।তো সে বেচারা আর কি করবে?মাথার ওপরে যাহোক একটা ছাদ জুটে যাবে এই আশাতেই সে ওই ভগ্ন বাংলো আঁকড়ে পড়ে থাকে।এ আর বুঝতে কোনো বাকি থাকে?আর এখানকার সব স্হানীয় লোকগুলো এই নিয়ে সব আজগুবি গালগপ্পো ফেঁদে বসে আছে।যতসব।" রাতুল আবির আর অর্নব ওদের কথায় সায় দিয়ে বলে উঠল..."একদম...যা বলেছিস ভাই।" যাওয়ার পথেই পড়ল ওদের আগে থেকে বুক করা সেই হোটেলখানি।সেখানে কিছুক্ষণের জন্য গাড়ি থামাল ওরা...তারপর হোটেলার রিসেপশনে গিয়ে বুকিংএর জন্য পাঠানো টাকাপয়সা বুঝে নিতে গেল। কথায় কথায় হোটেলের ম্যানেজার যখন জানতে পারলেন পাঁচবন্ধু লাগেজ নিয়ে শিফট করতে চলেছে ওই ভগ্ন বাংলোয়...স্রেফ অ্যাডভেঞ্চার করার লোভে...তখন ভীষণভাবে আঁতকে উঠলেন তিনি।তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় দক্ষিণী ভাষায় বলে উঠলেন..."ওই অভিশপ্ত বাংলোর ধারেপাশেও যাবেন না আপনারা।আমাদের হোটেলে নাই বা উঠলেন...কিন্তু আপনারা হলেন এখানকার অতিথি।আমরা কখনোই আপনাদের ক্ষতি চাইব না।অন্য যেকোনো হোটেলে উঠুন আপনারা...কোনো ক্ষতি নেই...কিন্তু দয়া করে ওই ভগ্ন বাংলোর সংস্পর্শে গেলে আপনারা একজনও আর বেঁচে ফিরতে পারবেন না।" স্যুট ব্যুট পরা হোটেল ম্যানেজারের মুখেও ওই একই কথা শুনে এইবার পাঁচবন্ধুর পুরোপুরি রোখ চেপে গেল।ওই ভগ্ন বাংলোর ধ্বংসস্তূপটাকে কি কারণে এখানকার লোকে এত ভয় পায়...এড়িয়ে চলে?একটা কোনো রহস্য নিশ্চয়ই রয়েছে।কি সেই রহস্য?ওদের জানতেই হবে।কৌতূহল এবার ওদের ভিতরে দ্বিগুণ হয়ে চেপে বসল।হোটেলের ম্যানেজারের সাথে কাজ মিটিয়ে নিয়ে এবার পাঁচবন্ধু গাড়িতে চেপে বসল।ড্রাইভারকে নির্দেশ দিল...বাংলোর ধ্বংসস্তূপের দিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাওয়ার জন্য...। পাহাড়ী রাস্তা ধরে গাড়ি এগিয়ে চলল।পাঁচ বন্ধু এখন ছুটি এবং অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দে একেবারে ডগমগ।ওদের উত্তেজনা এখন সপ্তমে চড়ে যেন টগবগ করে ফুটছে। পাহাড়ী রাস্তার ওপরে বেশ খানিকক্ষণ গাড়ি চলার পর হঠাৎ ড্রাইভার সজোরে ব্রেক কষল।চমকে উঠল পাঁচ বন্ধু।আবির বলে উঠল..."ক্যা হুয়া ভাইয়া?" ---"আব গাড়ি আগে নেহি যায়েগা সাব।আপলোগ ইয়েহিপে উতর যাইয়ে।ইধরসে সিধে জঙ্গলকে ওর যাইয়ে...উও টুটা মকান আপকো দিখাই দেগা।" ---"দিখাই দেগা বলে দিলেই হয়ে গেল নাকি?এতদূর যখন এসেছ তখন ওইটুকু যেতে তোমার কি অসুবিধা?" বলে উঠল আবির। ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে চুপচাপ বসে গেল।যেন ওর সামনে কেউ এক্ষুনি একটা লক্ষণরেখা টেনে দিয়ে চলে গেছে।এই সীমারেখার অতিক্রম করে এতটুকুও আর এগোতে পারবে না সে। আবিরকে থামিয়ে দিয়ে এবার রাতুল একটু নরম সুরে হিন্দিতে ড্রাইভারকে বোঝানোর চেষ্টা করল...বাংলো যদি বেশিদূরে না হয়...তাহলে ওইটুকু যেতে সমস্যার কিছু নেই। কিন্তু ড্রাইভার সেই যে গাড়ি থামিয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে গেল...ওকে যে আর এতটুকুও নড়ানো যাবে না...সেটা অচিরেই বুঝে গেল ওরা।ড্রাইভারও হিন্দিতে বলে দিল..."আপনারা যদি আমাকে এক পয়সাও না দেন তাও সই...কিন্তু এর পরে আর এগোনো তার পক্ষে সম্ভব নয়।" অগত্যা কি আর করা...লাগেজগুলো সব ধরাধরি করে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিলাম আমরা।ড্রাইভারকে ওর পাওনা টাকার সাথে কিছু বখশিশও দিয়ে দিলাম।টাকা আর বখশিশ হাতে পাওয়ার পরেও ড্রাইভারকে দেখলাম...সে কেমন উদাস হয়ে রয়েছে।টাকা নেওয়ার সময়ে সে ভয়মিশ্রিত শুকনো কন্ঠে আমাদের উদ্দেশ্যে বলল..."এখনো সময় আছে।ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যান।" বিহান একরাশ বিরক্তি নিয়ে চাপা স্বরে বলে উঠল..."যতসব গ্রাম্য কুসংস্কার!" আস্তে আস্তে খাড়াই পাহাড়ী জঙ্গলের ভিতরে ঢুকতে শুরু করল পাঁচ বন্ধু।যত এগোচ্ছে...জঙ্গল যেন ততই ঘন আর দুর্ভেদ্য হয়ে উঠছে।ক্রমে সূর্য ঢলতে শুরু করেছে পশ্চিমে।ক্রমশ দিনের আলো ঘোলাটে হতে শুরু করেছে আর ওই দুর্ভেদ্য পাহাড়ী জঙ্গল জুড়ে একটু একটু করে আধিপত্য বিস্তার করতে আরম্ভ করছে অন্ধকার! ক্রমশ ঘাড়ে মাথায় লাগেজ নিয়ে ওই পাহাড়ী জঙ্গল পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ক্রমে একটু একটু করে ওদের ভিতরে পুঞ্জীভূত হতে শুরু করেছে একরাশ বিরক্তি।এ তো মহাজ্বালা হল...পাহাড়ের নীচে যতক্ষণ ছিল ওরা...পাহাড়ের গায়ে একটা ভগ্ন বাংলোর ধ্বংসস্তূপের গল্প শুনে শুনে ওদের প্রত্যেকেরই কান একেবারে পচে গেছে।এত কথা...এত গল্প...এত ভয়ভীতি আর কুসংস্কার...এই সবকিছুই কি আসলে ভাঁওতা? পাহাড়ী জঙ্গল ঠেলে ঠেলে পার হতে হতে তিতিবিরক্ত হয়ে এবার অঙ্কুশ বলে উঠল..."বিহানের কথা শোনাটাই দেখতে পাচ্ছি ডাহা ভুল হয়েছে আমাদের।এতক্ষণ হোটেলের রুমে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে সুন্দর ঘুরতে বেরিয়ে পড়তাম...তা নয়...এখন এই জঙ্গল ঠেঙিয়ে ওই ভাঙ্গাবাড়ি খুঁজতে হচ্ছে।এরকম মাথামুন্ডুহীন অ্যাডভেঞ্চার করার কোনো দরকার ছিল আমাদের!" ---"ঠিক বলেছিস রে অঙ্কুশ...দশ বছর আগে আমরা নেহাত ছেলেমানুষ ছিলাম।কল্পনার ডানায় যেখানে খুশি উড়ে গিয়ে যা খুশি করায় কোনো বাধা ছিল না।কিন্তু এখন আমরা সবাই প্রাপ্তবয়স্ক।কচি খোকাটি আর নেই।ক্ষণিকের মোহ য় পড়ে কল্পনা আর বাস্তবকে গুলিয়ে ফেলে অ্যাডভেঞ্চারের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি।বিহানের মাথায় দুর্বুদ্ধি চেপেছে প্রথমে...আর সেই তালে তাল মিলিয়ে আমরাও কল্পনা আর বাস্তবকে একাকার করে ফেলেছি।ফল তো ভুগতেই হবে এখন...।" রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠল রাতুল। ---"উফ...ভারি মালপত্র হাতে নিয়ে কতক্ষণ হেঁটে চলেছি কে জানে...ড্রাইভার তো বলল সোজার দিকে একটু হাঁটলেই পৌঁছে যাব বাংলোর সামনে।তা এখন তো দেখছি সেই সোজা রাস্তা আর শেষ হবারই নাম নেই...।" বলে উঠল অর্নব। ---"আমি কিন্তু ভাই আর অল্প কিছুক্ষণ দেখব...তারপর তোরা যা ভালো বুঝিস কর...আমি কিন্তু সূর্য ডুবে যাওয়ার আগেই সবকটা ব্যাগপত্র হাতে নিয়ে ফের ফিরে যাব হোটেলে।" বলে উঠল রাতুল। ---"বললেই হল...কত বড় পালোয়ান এসেছেন রে...আমাদের এই এতগুলো লাগেজ তুই দুইহাতে বয়ে নীচে নামবি?তাহলে তো আমাদের সকলের নেক্সট গন্তব্য হবে লোকাল হাসপাতাল!ওরে গাধাদের দল সব...সামনের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখ...দেখ তো কিছু নজরে আসছে কিনা? " দুষ্টু হাসিমাখা মুখ নিয়ে বলে উঠল বিহান। বিহান যেইদিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে রয়েছে...সেইদিকে এবার তাকাল বাকি চারজন। সত্যিই তো...পাহাড়ী জঙ্গলের আড়ালে আবডালে যেন উঁকি দিচ্ছে একটা শতাধিক প্রাচীন একটা বাংলো বাড়ির ভগ্ন ধ্বংসস্তূপ!সবার মুখে এবার চওড়া হাসির রেখা ফুটে উঠল। "ইউরেকা...পেয়ে গেছি..." বলে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল অঙ্কুশ।রাতুল,অর্নব,আবির আর বিহান লাগেজগুলো একটু মাটিতে রেখে মুছে নিল ঘাম।সূর্য প্রায় ডোবার উপক্রম করছে।শান্তিতে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে...এবার পাঁচবন্ধু আরো দশগুণ উৎসাহ নিয়ে ফের লাগেজগুলো কাঁধে তুলে নিয়ে এগিয়ে চলল ভগ্ন বাংলোর অভিমুখে...। বাংলোর ভিতরে পা রাখার সাথে সাথেই...যেন ওদের প্রত্যেকের শিরায় শিরায়...বিদ্যুত প্রবাহ র মতোই...একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল। আর তার সাথে সাথে যেটা হল...সেটার জন্য ওরা পাঁচজনে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না।প্রায় একইসাথে...ওদের পাঁচজনের মোবাইল ফোনই বন্ধ হয়ে গেল।এই আঁধারঘেরা জঙ্গলের ভিতরের এ ভাঙ্গা বাংলোর ধ্বংসস্তূপের ভিতরেই এখন ওদের থাকতে হবে আর তার জন্য ভিতরে ঢুকে চারপাশটা একটু পরিষ্কার টরিষ্কার করে গুছিয়ে নেওয়া দরকার।কিন্তু এহেন নিকষ অন্ধকারের ভিতরে...একে অপরের মুখ দেখারই কোনো জো নেই ওদের...তো হাতে হাত মিলিয়ে ভিতরটা গোছগাছ করে থাকবার ব্যবস্হা করার চিন্তাভাবনা করা তো অনেক দূরের ব্যাপার।পাশ থেকে আবিরের গলা শুনতে পেল বিহান। "এইবার কি করা যায় বল তো?এখানে পা দিতেই আপনা হতে মোবাইল এক্কেবারে সুইচ অফ হয়ে গেল!এ কেমন করে সম্ভব হয় বল দিকি...এবার তো সামান্য আলোটুকুও জ্বালা যাচ্ছে না...তো থাকার বন্দোবস্ত হবে কি করে!" অঙ্কুশ বলে উঠল..."দাঁড়া দাঁড়া...আমায় একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে দে...একটা উপায় তো বার করতে হবে...। প্যান্টের পকেট হাতড়ে অঙ্কুশ বার করে ফেলল একখানা লাইটার।ফস করে জ্বালিয়ে নিল সেটা।আর সাথে সাথেই ওই সামান্য আলোতে চারপাশটা যেন আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল।বেশ কিছুক্ষণ গাঢ় অন্ধকারের ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ একটা সামান্য আলো জ্বলে ওঠার পরেই রীতিমতো স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল প্রত্যেকের।চারপাশে শুধু ধূলো ময়লা...শুকনো পাতার আবর্জনায় একেবারে ভর্তি।আর দেওয়াল...থামের গায়ে আঁট হয়ে রয়েছে বড় বড় মাকড়সার জাল।দামী দামী কিছু আসবাবপত্রের ভাঙ্গা ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চতুর্দিকে।দেওয়ালের গায়ে সেঁটে বসেছিল একটা ভাম বিড়াল।অন্ধকারে আচ্ছন্ন ঘরের ভিতরে হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠায় ভয় পেয়ে...ঘাবড়ে গিয়ে...দ্রুতবেগে সে ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল।একটা বুনো গন্ধ ওদের প্রত্যেকেরই নাকে আসছিল।আর এটা স্বাভাবিক ব্যাপার...পাহাড়ী জঙ্গলের ভিতরে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এইভাবে একটা ভগ্ন বাংলোর কঙ্কালসার অবশিষ্টাংশ পড়ে থাকতে থাকতে...তার ভিতরকার বাতাসের কণায় কণায় জঙ্গলের গুমোট...বুনো গন্ধযুক্ত বাতাসের আধিপত্য হবে সেইটাই স্বাভাবিক!প্রথমটায় পাঁচজনেই বেশ খানিকটা হতভম্ব হয়ে গেলেও খুব তাড়াতাড়িই স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এল সবাই।কটাদিন এইখানে থাকতে যদি হয় ...তাহলে ঘরটাকে একটু সাফসুতরো করা তো অবশ্যই দরকার।কিন্তু এই সামান্য লাইটারের আলোতে এই মূহুর্তে সেটা সম্ভব নয়।তার চাইতে এখন ব্যাগট্যাগ একটা জায়গায় গুছিয়ে রেখে তারপর নিজেরা একটা জায়গা বেছে বসাটাই আপাতত শ্রেয়।কোনোমতে রাতটুকু কাটুক...আকাশ ফর্সা হয়ে আসার পরে তো এখান থেকে বেরিয়ে খাবার দাবার...দরকারী সরঞ্জাম...দেশলাই,মোমবাতি যোগাড় করে আনাটা কোনো ব্যাপারই নয়! ঝটপট করে পাঁচবন্ধু একটা জায়গা বেছে নিয়ে সেইখানে ব্যাগপত্র রাখল...আর তারপর বাংলোর দরজার কাছটায়...যেখানে চাঁদের আলো মৃদু প্রবেশ করেছে...সেইখানে বসল গোল হয়ে।সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত এখন অনেকটাই গড়িয়ে গেছে।ওদের গাড়ি যখন পাহাড়ী রাস্তার কাছাকাছি চলে এসেছিল...তখন রাতুলের মাথাতেই এসেছিল...রাতের খাবারের কোনো ব্যবস্হা করাটা এরপরে বেশ কঠিন হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল কারণ পাহাড়ী রাস্তা আর জঙ্গলের ভিতরে কেই বা আর খাবারের দোকান দিয়ে বসবে...!তাই এই ব্যাপারটা মাথায় রেখে ওরা আগে থেকেই একটা দোকান থেকে রাতে খাবার জন্য নিয়ে রেখেছিল বেশ কিছু খাবারদাবার।এবার ওরা সেগুলো ব্যাগ থেকে বার করে রাখল মাঝখানে।এতটা রাস্তা গাড়িতে করে আসার পর এখন এই আলোআঁধারির ভিতরে বসে ওদের সকলেরই দুচোখ জুড়ে নেমে আসতে চাইল ঘুম। খাবারের প্যাকেট খুলে খেতে খেতে ওদের সকলেরই চোখ ঘুমে যেন জুড়িয়ে আসতে চাইল...। রাত গভীর।হঠাৎই একটা খট্ শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল বিহানের।ধড়ফড় করে উঠে বসে পড়ল ও।চারদিকে তাকাল।শব্দটা এল কোথা থেকে! যেরকম শব্দ ওর কানে এসেছে...তা যে কোনো ছোটখাটো প্রাণীর দ্বারা সৃষ্ট নয়...এটা ও পরিষ্কার বুঝতে পারছে।এখন প্রশ্ন হল...মানুষ অথবা কোনো বড় আকৃতির প্রাণী এই বাংলোর মেঝের ভিতর থেকে শব্দ কি করে করবে!তার মানে এই ভগ্ন বাংলোর ভিতরে কি রয়েছে কোনো হিংস্র প্রাণীর বাস! এই চিন্তাটা মনে আসা মাত্রই বুকটা একেবারে ছ্যাঁৎ করে উঠল বিহানের।কিন্তু পরক্ষণেই ওর মনে হল... যদি কোনো হিংস্র প্রাণী এখানে থাকত...তাহলে এতক্ষণে ওরা পাঁচজনেই সম্পূর্ণরূপে অক্ষত থাকত না।ব্যাপারটা বোধহয় অন্য কিছু।ক্রমশ বিহানের ভিতরে কৌতূহল চেপে বসতে শুরু করে দিল।ঘুমন্ত অঙ্কুশের পকেট থেকে নিঃশব্দে বার করে নিল লাইটারখানি।তারপর ফস করে সেটা জ্বেলে ফেলল।লাইটারের মৃদু আলোয় ও দেখল...অঙ্কুশ,আবির,রাতুলআর অর্নব ঘুমিয়ে এক্কেবারে কাদা।বিহান আর ওদের কাউকেই জাগাল না।হঠাৎ ওই শব্দ তীব্রভাবে কানে বেজে উঠল বিহানের।আর এবার ও বুঝতে পারল...ও যেটা শুনছে...সেটা শুধুমাত্র কোনো শব্দ নয়।এ যেন এক তীব্র জান্তব হুংকার!ওর মনে হল...যেন পৃথিবীর মাটি ফুঁড়ে উঠে আসতে উদ্যত হয়েছে কোনো রক্তখাকী পিশাচ!যে তৃষ্ণা নিবারণের জ্বালায় একেবারে তেড়েফুঁড়ে উঠতে শুরু করেছে।একটা ভীষণ কৌতূহল ওর ওপর চেপে বসল প্রচন্ডভাবে।নিজেকে আর স্হির রাখতে ও পারল না।ওই জান্তব হুংকারে যেন মিশ্রিত রয়েছে নেশাতুর কোনো মাদকতা...যা ওকে ক্রমাগত নিজের দিকে টেনে চলেছে প্রবলভাবে যাকে অগ্রাহ্য করার কোনো ক্ষমতাই ওর নেই।ও এক পা করে ওই হুংকার ধ্বনি অনুসরণ করে করে ভিতরের দিকে হাঁটতে আরম্ভ করল। ক্রমশ ওর মনে হতে লাগল...যেন কোনো অমোঘ স্পর্শে হঠাৎ জেগে উঠেছে এক ভয়াল পিশাচের দীর্ঘ বছরের উপোসি ক্ষুধা...যার নিবৃত্ত করার পিপাসা নিয়ে সে ক্রমে তেড়েফুঁড়ে উঠতে শুরু করেছে।এক পা এক পা করে ওই হুংকার অনুসরণ করে করে বিহান পৌঁছে গেল বাংলোর একেবারে মাঝখানে।ও সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই...হঠাৎ ওর দু পায়ের মাঝ বরাবর লম্বালম্বিভাবে মেঝের বুকে চিড় ধরতে শুরু করল।নিস্তব্ধ বাতাস কাঁপিয়ে...চিড়চিড় শব্দে ওই ফাটল দীর্ঘ হতে থাকল।বিহান এবার এতটাই হতভম্ব হয়ে গেল...যে ওর বোধবুদ্ধি...চেতনা সব লোপ পেতে শুরু করল।হঠাৎ একটা ভীষণ শব্দ করে ফাটলের দাগের দুইদিকে সরে গেল মাটি...আর হুড়মুড় করে বিহান পড়ে গেল অতল অন্ধকারের ক্রোড়ে।আর তার সাথে সাথেই ততোধিক জোরে শব্দ হয়ে ফের জুড়ে গেল মেঝে।ততক্ষণে বিহানের হাত থেকে লাইটারটাও যে ছিটকে গিয়ে কোথায় পড়ে গেছে...তার কোনো ইয়ত্তা নেই।মিশমিশে অন্ধকারের পেটের ভিতর এইভাবে বন্দী হয়ে যেতে হবে...এটা ও দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি।এখন এই ভয়ঙ্কর ফাঁদ থেকে বেরোনোর কোনো উপায় ওর জানা নেই...আর উপরে বন্ধুদেরকেও খবর দেওয়ার কোনো উপায় নেই।ঘুম থেকে উঠে ওরা যখন ওকে খোঁজাখুঁজি করতে শুরু করবে...তখন কি ওরা আদৌ বুঝতে পারবে...আসলেই কোথায় ফেঁসে রয়েছে বিহান...!প্রবল আতঙ্ক আর অকালমৃত্যুর ভয় ওকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলল।আর সেইসাথে শুরু হল এক প্রবল শ্বাসকষ্ট।চারপাশের বাতাসের প্রতিটি কণায় যেন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে একটা ভয়ঙ্কর রকমের দুর্গন্ধ।যেন পৃথিইীর সমস্ত অপবিত্র আর অশুচি সত্ত্বা ধীরে ধীরে একত্রিত হতে শুরু করেছে।দমবন্ধ লাগতে শুরু করল বিহানের।ও এটা পরিষ্কার বুঝতে পারল...এই অন্ধকুঠুরির ভিতরে পচে গলে মরাটাই এখন ওর একমাত্র ভবিতব্য...।পৃথিবীর কেউ জানতে পর্যন্ত পারবে না...হঠাৎ করে বিহান কখন কোথায় কিভাবে হারিয়ে গেল আর ওর পরিণতিই বা কি হল! গলা বুঁজে আসতে শুরু করল বিহানের...আর সেইসাথে শ্বাসকষ্টও ক্রমশ আরো...আরো তীব্র হতে শুরু করল।আর পারল না বিহান।মাথাখানি দুইহাত দিয়ে চেপে ধরে বসে পড়ল।তারপর ধীরে ধীরে চেতনা হারাতে শুরু করল। আকাশ ফর্সা হতে আরম্ভ করেছে।চারপাশে শুরু হয়ে গিয়েছে পাখির কুজন।আস্তে আস্তে চোখ মেলে জেগে উঠল বিহান।গভীর ঘুমের ঘোর থেকে চেতনা ফিরতে ওর বেশ খানিকটা সময় লাগল।চেতনা ফিরে আসার সাথে সাথেই বিহানের মনে পড়তে শুরু করল গতরাতের তীব্র আতঙ্কের ওই মূহুর্তগুলো।সাথে সাথে ধড়ফড় করে উঠে বসল বিহান।ওর মনে তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না...ও সত্যিই বেঁচে আছে! কিন্তু না...এখন তো মনে হচ্ছে...গতকাল মাঝরাত্রে যা যা হয়েছিল...সেগুলো সব আসলেই অলীক স্বপ্ন বৈ আর কিছুই নয়।ওর পাশে বসে রয়েছে রাতুল।বসে বসে মনের সুখে গুনগুন করে গান গাইছিল..."আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে...শাখে শাখে...পাখি ডাকে...কত শোভা চারিপাশে...।" বিহানকে জেগে উঠতে দেখেই হাস্যমুখে রাতুল বলে উঠল..."কি মিস্টার কুম্ভকর্ণ...!আপনার তাহলে এতক্ষণে ঘুম ভাঙল?" এই বলে পাশে রাখা একটা ঢাকনা চাপা দেওয়া প্লেট থেকে সে ঢাকাখানি খানিকটা তুলে ফের চাপা দিয়ে দিল।আর তার ফলে বিহান দেখতে পেল... বন্ধুরা...ওর ঘুম থেকে ওঠার আগে থেকেই ওর জন্য কোথা থেকে যোগাড় করে রেখেছে গরম গরম পুরি আর সাথে ধোঁয়া ওঠা আলুর তরকারি।ঢাকনাটা প্লেটের ওপর চাপা দিয়েই রাতুল বলে উঠল..."নে আর বেলা করিস না।চটপট হাতমুখ ধুয়ে নে...বাইরে টিনে জল রাখা আছে....মুখ হাত ধুয়ে চটপট খেয়ে নে।দূরে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করা হচ্ছে।" চারপাশটা দেখেশুনে বড়ো নিশ্চিন্ত হল বিহান।ও আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ঝটপট করে উঠে পড়ে বাংলোর দরজার বাইরে পা রাখল।আর বাইরে পা রাখতেই ও প্রচন্ডভাবে চমকে গেল।অঙ্কুশ অর্নব আর আবির তিনজনে মিলে একজনের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত।আর ওরা যার সাথে কথা বলতে ব্যস্ত এখন...তাকে চিনতে ওর বাকি নেই।এ তো সেই বৃদ্ধা...যে গতকাল ক্যান্টিনের বাইরে ওকে প্রচন্ডভাবে গলা চেপে ধরেছিল আর অভিশাপের বর্ষণ করে যাচ্ছিল ক্রমাগত। গ্রামের লোকেরা তাহলে ঠিকই বলেছে।এই ভগ্ন বাংলোর ধ্বংসস্তূপের আশেপাশেই ঘুরে বেড়ায় এই বৃদ্ধা।কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার...এখন অঙ্কুশ আবির আর অর্নব ওর সঙ্গে এখন কি আলোচনা করতে ব্যস্ত! গতকালের ঘটনার কথা কি এরা ইতিমধ্যেই ভুলে বসে আছে?আর এখন ওই বৃদ্ধার ভিতরেও তো কোনো হিংস্রতার লক্ষণ নেই...রীতিমতো ঠান্ডা মাথায় এখন সে ওদের তিনজনের সঙ্গে ব্যস্ত কোনো জরুরী আলোচনায়...।ব্যাপারটা কি হচ্ছে...দেখতে হবে তো...একরাশ রাগ আর কৌতূহল মিশ্রিত উদ্দীপনা নিয়ে বিহান দ্রুতপায়ে ওদের মাঝে পৌঁছে গেল। বিহানকে দেখামাত্র অঙ্কুশ বলে উঠল..."কি রে...তোর ঘুম ভাঙল অবশেষে?যাক গে...শোন...তোকে এখন একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই আয়।" এই বলে অঙ্কুশ বিহানের হাত ধরে টেনে ওকে বৃদ্ধার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল।তারপর বলল..."ইনি হলেন এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা।এক সময়ে এনার সঙ্গে একটা অমানুষিক অন্যায় হয়েছিল।এনার একমাত্র নাতিকে এখানকার যিনি মাথা...তিনি চুরির মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন।সেই মানসিক আঘাতটা নিতে পারেননি ইনি।তাই হঠাৎ হঠাৎ এনার মাথাটা খারাপ হয়ে যায়।ভুলভাল কথা বলেন...ভুলভাল কাজও করে বসেন...আর থাকেন এই আশেপাশেই।কি আর করবেন...এনার তো এই দুনিয়ায় কেউ নেই।আর স্হানীয় মানুষেরা প্রত্যেকেই এনাকে ভুল বোঝেন।এখন ঠান্ডা মাথায় এনার সব কথা শোনার পর এখন আমাদেরই এনার ওপর মায়া হচ্ছে রে...আর গতকাল ইনি তোর সাথে যে খারাপ ব্যবহারটা করেছিলেন তার জন্য এখন নিজে এসে ভুল স্বীকার করছেন।তুই এনাকে আর ভুল বুঝিস না রে ভাই।" এইবার বৃদ্ধা বিহানের সামনে এগিয়ে এসে জোড়হাত করে বলে উঠল..."বাবা...আমার তো বয়স হয়েছে...সবসময় মাথাখান ঠিক রাখতে পারি না।গতকাল সকালে আমার মাথা গন্ডগোল করে উঠেছিল...তোমায় সামনে পেয়ে কি না কি করেছি আর কি না কি বলেছি...ছি ছি ছি...তোমরা হলে এখানকার অতিথি...আর তোমাদের সাথেই কিনা আমি অমন যা তা ব্যবহার করলুম...তুমি সবটা বিচার বিবেচনা করে আমায় নিজগুণে ক্ষমা করে দিও বাছা...।" বৃদ্ধার ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে কথাগুলো শুনে এইবার বিহানের সত্যিই খুব খারাপ লাগতে শুরু করল।ও সাথে সাথে বৃদ্ধার জোড়া করা হাতদুটো নিজের দুইহাতে ধরে নিয়ে বলে উঠল..."এভাবে বলবেন না দিদিমা...আপনি বয়োজ্যষ্ঠ মানুষ...আর তাছাড়া...ভুল তো মানুষমাত্রেই হয়...আমি আপনার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি।আপনার প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই।" বিহানের মুখ থেকে কথাটা শোনার পর বোধহয় বৃদ্ধা খানিকটা আশ্বস্ত হল। পাশ থেকে অঙ্কুশ হঠাৎ বলে উঠল..."শোন না...দিদিমা কি বলছেন...যে কদিন আমরা থাকব এইখানে...সে কদিন ইনিই এখানে থেকে আমাদের রান্নাবান্না সব করে দেবেন।সাথে বাংলোর ভিতরটা পরিষ্কারও করে দেবেন।ইনি নাকি বাঙালি রান্নাটা ভালোই জানেন।আমাদের তাহলে আর কোনো চিন্তাই রইল না কি বলিস!এক কাজ কর...ঝটপট তৈরি হয়ে নে...নেমে গিয়ে এনাকে কিছু বাজার টাজার এনে দিই...তারপর ইনি এনার কাজ করবেন আর আমরা আমাদের বেড়ানোর পরিকল্পনা সারব...।" বিহান বলল..."ঠিক আছে...আমায় একটু সময় দে...আমি ঝটপট হাতমুখ ধুয়ে খাবারটা খেয়ে নিয়ে আসছি। ব্রাশ আর পেস্ট নিতে বাংলোর ভিতরে ঢুকতে যাবে বিহান...এমন সময়ে ও দেখল...রাতুল জিন্স আর টিশার্ট চেঞ্জ করে একদম ফুলবাবুটি হয়ে এগিয়ে আসছে আর বলছে..."তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে নে...খাবারটা তো ঠান্ডা পান্তা হয়ে গেল। বিহান বলল..."এক্ষুনি যাচ্ছি।" ভিতরে ঢুকে ব্যাগ হাতড়ে ব্রাশ আর পেস্ট বার করতে গিয়েই ও বুঝতে পারল...ওর সারা শরীর জুড়ে দ্রুতবেগে থাবা বসাতে শুরু করছে ধুম জ্বর।সারা শরীরে যেন জাঁকিয়ে বসতে আরম্ভ করেছে কাঁপুনি।এই তো কিছুক্ষণ আগেই দিব্যি কথা বলছিল বিহান...কই এরকম কিছুর পূর্বাভাসটুকুও তো পায়নি!অবাক বিস্ময়ে ও কেমন যেন ঘোরের ভিতরে চলে গেল।সারা শরীর জুড়ে কাঁপুনির সাথে যোগ হতে শুরু করেছে বিষম ব্যথা।নাঃ...খাওয়া দাওয়ার কোনো ইচ্ছাই আর নেই এখন ওর।আর ঘোরা বেড়ানোর তো কোনো প্রশ্নই আর নেই এখন।বন্ধুরা এখন ওর জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে।ওর হাতমুখ ধুয়ে খাওয়াদাওয়া সব সারা হলে...তারপর পাঁচ বন্ধু মিলে বাজারে যাওয়া হবে।এহেন পরিস্থিতিতে বিহান আর নিজের শারীরিক অবস্হার কথা বলে সবাইকে আর ব্যতিব্যস্ত করতে চাইল না।কোনোমতে মুখ হাত ধুয়ে নিয়ে তারপর বন্ধুদের সামনে এসে বলল..."এই শোন না...গতকালের জার্নির ধকলের পর আমার গা হাত পা একদম ধরে রয়েছে।এখন তোরা বরং বাজারে ঘুরে আয়...আমি ততক্ষণ এখানে বিশ্রাম নিয়ে আর একটু চাঙ্গা হয়ে নিই...তারপর একবারে ঘুরতে বেরোব।" বিহানের কথা শুনে বেশ চটেই গেল অঙ্কুশ।ও রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠল..."হতচ্ছাড়া ছেলে...এত বেলা অব্দি মোষের মতো ঘুমিয়ে থেকেও তোমার বিশ্রাম শেষ হয়নি...বলি...আর কত বিশ্রাম লাগে মানুষের শরীরে?নাকি আমরা সবাই লৌহমানব?" অঙ্কুশকে থামিয়ে অর্নব বলে উঠল..."আরে এত খরচে যাচ্ছিস কেন?আমাদের মধ্যে ওই তো সবচেয়ে বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছে অথচ ওই বরাবর কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়ে।নিশ্চয়ই ওর শরীর চাইছে বিশ্রাম...ও বরং বিশ্রাম নিক এখন আমরা ঘুরে আসি বাজার থেকে...চল চল...বেলা গড়িয়ে এল...! অর্নবের কথা শুনে রাতুল "ঠিক আছে...চল তাহলে...বাবু এখন বিশ্রাম নিক...আমরা ঘুরে আসি...।" বৃদ্ধা ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে বলে উঠল..."হ্যাঁ গো বাবারা...তোমরা নিশ্চিন্তে যাও গো...আমি ততক্ষণ বাংলোর ভিতরটা সাফসুতরো করে রাখব আর সেইসাথে বিহান দাদাবাবুর দেখভালও করব।" নির্জন জঙ্গলের ভিতরে...ভগ্ন বাংলোর ভিতরে...নিজেদের সাথে আনা খবরের কাগজ পেতে তার ওপরে একটু জুত করে শুল্ক বিহান।সারা শরীরে জ্বর একেবারে হু হু করে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে ওর।আর পারল না ও...ব্যাগ থেকে সাথে করে আনা বিছানার চাদরখানা বার করে সর্বাঙ্গে মুড়ে মমি হয়ে শুয়ে পড়ল।কিছুক্ষণ এইভাবে কাটার পরে হঠাৎ বিহান প্রকৃতির ডাক অনুভব করল।সুন্দর জুত করে ও শুয়েছিল...এখন ওঠার মতো কোনো ইচ্ছাই ওর নেই।কিন্তু কি আর করা...প্রকৃতির ডাকের কাছে তো মানুষ দাস।চাদরখানা সরিয়ে বিহান জ্বর গায়ে বাইরে গেল।কাজ মিটিয়ে যখন ঢুকল ঘরে...তখন ঘরের চারপাশটা দেখে বেশ অবাকই হয়ে গেল।এই অল্পক্ষণের মধ্যেই বৃদ্ধা কি সুন্দর চারপাশটা ঝাঁটপোছ করে একেবারে পরিষ্কার করে ফেলেছে।এখন ওর মনে হচ্ছে...হ্যাঁ...এই ঘরের ভিতরে মানুষের বাস হতে পারে অনায়াসেই...! এমনকি ও যেখানে শুয়েছিল এতক্ষণ...সেই জায়গাটাও এক্কেবারে সাফসুতরো করে ফেলেছে বৃদ্ধা।দেখে এবার বিহান মনে মনে বেশ সন্তুষ্ট হল...আর তার সাথে সাথে খানিকটা আত্মগ্লানিবোধও গ্রাস করল ওকে।ইস...এই মানুষটা গতকাল সকালে মাথা ঠিক না থাকায় ভুলভাল কিছু আচরণ না হয় করেই ফেলেছে...এর জন্য এই বুড়ি মানুষটার প্রতি এতটা ঘৃণা পোষণ করাটা বোধহয় উচিত হয়নি ওর।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে...বিহান দুর্বল শরীর নিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল শোবার জায়গাটার দিকে।হঠাৎ বৃদ্ধা খুনখুনে গলায় বলে উঠল..."হ্যাঁ গো দাদাবাবু...তখন থেকে শুয়ে রয়েছ...তোমার কি শরীর টরীর খারাপ?" ---"হ্যাঁ গো দিদিমা...বোধহয় জ্বরই এসেছে...সারা গা হাত পা বিষ ব্যথা...! বলতে বলতে বিহান ঝুপ করে ঢুকে গেল চাদরের তলায়। "কই দেখি..." বলে বৃদ্ধা দ্রুতবেগে এগিয়ে এল বিহানের কাছে।ওর কপালে হাত ছোঁয়াল।আর তারপরেই ঘটল চমকপ্রদ ঘটনাটি। বৃদ্ধার হাতের স্পর্শ পাওয়ার সাথে সাথেই...বিহানের জ্বর এক নিমেষেই পুরোপুরি গায়েব হয়ে গেল। একটা জলপূর্ণ থলি হঠাৎ ফেটে যাওয়ার ফলপ্রসূ যেভাবে ভিতরের সব জল এক নিমেষে বাইরে বেরিয়ে আসে...ঠিক সেভাবেই বিহানের শরীর থেকে সবটুকু জ্বরভাব ও অস্বস্তি এক নিমেষে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।পুরো ব্যাপারটা এক ঝটকায় এমনভাবে ঘটে গেল...যে বিহান রীতিমতো হতচকিত হয়ে গেল।ধড়ফড় করে উঠে বসল ও। ব্যাপারটা বিশ্বাস করে উঠতেই ওর রীতিমতো ঢোঁক গেলার উপক্রম হয়েছে।একরাশ বিস্ময় নিয়ে ও দেখল...একমন প্রশান্তি নিয়ে হাস্যমুখে ওর সামনে বসে রয়েছে বৃদ্ধা।কিন্তু এর পরক্ষণেই একটা গন্ধ এল বিহানের নাকে।আর সাথে সাথে ওর সারা শরীর ভীষণভাবে গুলিয়ে উঠল।এই গন্ধটা ওর ভীষণ চেনা।এইরকমই একটা বিষাক্ত পচা দুর্গন্ধযুক্ত বাতাসের সংস্পর্শে এসে বিষিয়ে উঠেছিল ওর সমস্ত শরীর...প্রায় পাঁচশো বছর পূর্বেকার কোনো এক পৈশাচিক সত্ত্বা...যেন প্রবলভাবে আর্তচিৎকার করে উঠেছিল ওর ভিতর থেকে...! বাতাসে ভাসমান আবছা আবছা স্মৃতির ওই টুকরোগুলি একটু একটু করে ভেসে উঠছে যেন বিহানের চোখের সামনে...আর ও সেগুলিকে ধরে ধরে জোড়বার চেষ্টায় মত্ত হয়ে উঠেছে।মাথাটা ভীষণভাবে ধরে আসছে যেন...বিহান দুইহাত দিয়ে নিজের মাথাখানি চেপে ধরল প্রবলভাবে।আর প্রায় সাথে সাথেই হুরহুর করে ওর মনে ভেসে উঠতে শুরু করল...গতরাতের সেই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের ছবি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার...এখন বিহানের মনে হচ্ছে...গতকাল রাতে ও যে পরিস্থিতির মধ্যে গিয়ে পড়েছিল...সেখানে যা যা দেখেছে...আর যা যা অনুভব করেছে...সেগুলো নিছকই স্বপ্ন ছিল না।এমনকি সেই নাড়ি উলটে আসার উপক্রম হওয়ার মতো দুর্গন্ধটাও যে কোনো অলীক স্বপ্নমিশ্রিত কল্পনা নয়...সেটাও এখন ও পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছে। এখন তো ওই দুর্গন্ধ ফের ওর নাকে আসতে শুরু করেছে।শুধু তাই নয়...ক্রমশই যেন ওই দুর্গন্ধ চারপাশের বাতাসের প্রতিটি কণায় কণায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।ক্রমশ যেন দম আটকে আসবার উপক্রম হয়েছে বিহানের।ওর সামনে বৃদ্ধা এখন চুপচাপ বসে রয়েছে একমুখ পরিতৃপ্তি নিয়ে।বৃদ্ধার শরীর থেকেই যে এই প্রকট দুর্গন্ধটা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে...এটা অচিরেই বুঝতে পারল বিহান।ওর কেমন একটা ঝিমুনি আসতে শুরু করল।দুর্গন্ধটাও সয়ে আসতে আরম্ভ করল।ক্রমশ ও একটা ঘোরের ভিতরে চলে যেতে শুরু করল...। বৃদ্ধা আস্তে আস্তে...চাপা স্বরে এবার কথা বলে উঠল।বিহানের মুখের একেবারে কাছে নিয়ে আসল নিজের মুখ।তারপর প্রায় ফিসফিস শব্দে বলে উঠল..."দাদাবাবু...একখান গল্প শুনবেন নাকি?" ঘোরমিশ্রিত কন্ঠে বিহান বলে উঠল..."বলো...।" বৃদ্ধা বলতে শুরু করল। সে অনেক কাল আগের কথা।তা প্রায় পাঁচশো বছর তো হবেই...!দক্ষিণ ভারতের গোয়াতে তখন পর্তুগীজরা ঘাঁটি গড়তে আরম্ভ করে।সেই পর্তুগীজদেরই একটা ছোট্ট অংশ আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে এই মাকালিদুর্গা গ্রামে।ওদের অত্যাচারে তখন এলাকার মানুষজনের বেঁচে থাকাটাই দায় হয়ে উঠেছিল।লুঠতরাজ...রাহাজানি লেগেই থাকত।সঙ্গে থাকত গরীবদের ওপর নিপীড়ন ও শোষণ।এমনকি ওদের অত্যাচার থেকে মহিলা আর শিশুরাও বাদ যেত না। লুঠতরাজের অর্থে তারা পাহাড়ের গায়ে গড়ে তোলে নিজেদের আমোদপ্রমোদ করার জন্য একখানি রাজকীয় বাংলো।সেইটা ক্রমেই হয়ে উঠল...ওদের পাপাচারের আঁতুড়ঘর।ওরা এতটাই নৃশংস ছিল...যে ওদের অন্যায় কাজকর্মের প্রতিবাদ যদি কেউ করত...এবং সে যদি হত দরিদ্র শ্রেণীর অন্তর্গত...তাহলে তার পরিণতি হত ভয়ঙ্কর।বাংলোর ভিতরের এক অন্ধকুঠুরির ভিতরে ধরে নিয়ে গিয়ে...নৃশংসভাবে হত্যা করত।নিজেদের পোষা হিংস্র এবং ক্ষুধার্ত লেপার্ডদের লেলিয়ে দিত সেই শিকারের দিকে।ওই হিংস্র লেপার্ডগুলো দড়ি দিয়ে আপাদমস্তক বেঁধে অন্ধকুঠুরির ভিতরে অভুক্ত অবস্হায় ফেলে রাখা...সারা শরীর জুড়ে দাগড়া দাগড়া কালশিটের দাগ বসে যাওয়া ওই যন্ত্রনাক্লিষ্ট মানুষটির দিকে একপেট ক্ষুধার আগুন নিয়ে নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ত। ওই বাংলোর দেখভাল করবার জন্য ওরা স্হানীয় এক মহিলা...নিত্যা কে কাজে রেখেছিল।ওই বাংলোর ভিতরে মানুষরূপী ওই পিশাচগুলো মদ আর স্ফূর্তি নিয়ে মত্ত থাকত...আর প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তালি বাজিয়ে ডেকে নিত নিত্যাকে...ফাইফরমাশ খাটবার জন্য।তবে বেতনের সাথে সাথে কথায় কথায় জুটত প্রচন্ড প্রহারও।কিন্তু নিত্যার ওই কাজ করা ব্যতীত দুটো পেট চালানোর আর কোনো উপায় ছিল না।ওই বাংলোর আশেপাশেই একটা ছোট্ট খড়ের ছাওয়া আর মাটির দালানের এক ভঙ্গুর কুঁড়েঘরে ছিল দুজনের বাস। একদিন নিত্যার নাতির এল ধুমজ্বর।মনে মনে বড় অসহায় বোধ করল নিত্যানন্দ।আজ বাবুদের কাজ থেকে ছুটি নিতে পারলে নাতিটাকে একটু দেখভাল করতে পারত নিত্যা।কিন্তু ও ভালোভাবেই জানত...ওই নরপিশাচগুলোর কাছে মানুষের দুঃখ কষ্টের কোনো দামই নেই।উপরন্তু এই কথা বলতে গেলে জুটে যাবে বেদম প্রহার।কাজেই কি আর করা...মনের উদ্বেগ মনে চেপে রেখে...নাতির কপালে জলপট্টি দিয়ে নিত্যা গেল বাবুদের বাংলোয়...কাজে।নিত্যা জানতেও পারেনি...জ্বরের ঘোরে কষ্ট পেতে পেতে...আর দিদিমাকে গলা চিরে ডেকে ডেকে কোনো সাড়া না পেয়ে...কখন নাতিটা চলে এসেছে বাংলোর একেবারে ভিতরে।বাবুদের হাতে মার খাওয়াটা তো নিত্যার প্রতিদিনের অভ্যাস ছিল।কিন্তু বাংলোর ভিতরে প্রবেশ করে...যখন সে দিদিমাকে নিগৃহীত হতে দেখল...তখন মূহুর্তের মধ্যে ওইটুকু বালকের ভিতরে যেন লেলিহান শিখায় আগুন জ্বলে উঠল। ---তারপর?তারপর কি হল? ঘোরে আচ্ছন্ন অবস্হায় জিজ্ঞাসা করে উঠল বিহান। ---"তারপর?ওইটুকু ছেলের ভিতরে তখন ক্রোধ এমনভাবে ফুঁসে উঠল...যে জ্বরের কষ্ট যন্ত্রনা...এইসমস্ত কিছুর উর্দ্ধে উঠে গেল সে এক নিমেষে।অতগুলি সবল পুরুষের সঙ্গে একটা শীর্ণ রোগক্লিষ্ট বালক হয়ে যুঝতে যাওয়াটা আদৌ কতটুকু বাস্তবসম্মত...সেই বোধ আর বিবেচনা ওর ধারেপাশেও ঘেঁষল না।ও অকাতরে দিদিমাকে মার খাওয়ার যন্ত্রনা ও অপমানের হাত থেকে রক্ষা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের ওপরে।ব্যাপারটা এতটাই অযাচিত আর অপ্রত্যাশিত ছিল...যে সাময়িকভাবে ওরা প্রত্যেকে স্তব্ধ হয়ে গেল।ওইটুকু ছেলে...শরীরের যন্ত্রনার কোনো তোয়াক্কা না করে ওর শীর্ণ হাত দিয়ে...উপড়ে ফেলতে উদ্যত হল প্রহারকারীর বাহু হতে তার হাতের তালু।নিষ্পলক কয়েক মূহুর্তের মধ্যেই ওরা সবাই সম্বিৎ ফিরে পেল আর তারপর নিত্যাকে সবলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল মাটিতে...আর শীর্ণকায় বালকটিকে নিজেদের বন্দী বানিয়ে ফেলল।আর চোখের পলকে তাকে দড়ি দিয়ে আপাদমস্তক বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে ফেলা হল ওই অন্ধকুঠুরির ভিতরে। এই দৃশ্য দেখে তো নিত্যার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।ও তো ভালোভাবেই জানত...কাউকে হাত পা বেঁধে কাউকে টানতে টানতে ওই অন্ধকুঠুরির ভিতরে নিয়ে যাওয়ার অর্থ কি!কি ভয়ঙ্কর পরিণতি অপেক্ষা করছে এখন ওর ছোট্ট নাতিটার জন্য! নিত্যা এবার মনিবদের পায়ে গিয়ে একেবারে লুটিয়ে পড়ল।কাতর স্বরে ওদের পায়ে মাথা ঠুকে ঠুকে মিনতি করতে লাগল..."বাবু গো...ও ছেলেমানুষ...না বুঝে অন্যায় কাজ করে ফেলেছে।আমি ওকে ঘরে গিয়ে উপযুক্ত শাসন করব।আপনারা দয়া করে ওকে ছেড়ে দিন বাবু...যা শাস্তি দেওয়ার আপনারা আমাকে দেন...বাপ মা মরা ছেলেটাকে একটু রেয়াত করুন...।" কিন্তু না...নিত্যার ওই কাতর ক্রন্দন আর মিনতি এতটুকুও নরম করতে পারল না ওই ঠান্ডা রক্তের নরপিশাচগুলোকে।ওদের চোখে তখন ফের চকচক করে জেগে উঠেছে মানুষ খুন করার নৃশংস উন্মাদনা!কচি ছেলেটার হাত পা দড়ি দিয়ে বাঁধতে বাঁধতে ওদের পোষা কর্মচারী বলে উঠেছিল..."বাবু...জ্বরে তো এ ছেলের গা একেবারে পুড়ে যাচ্ছে!" উল্লাসে ফেটে পড়ে ওরা তখন হাস্যমুখে বলে উঠেছিল..."তাই নাকি?তাহলে তো মজা আরো জমে যাবে!এক্ষুনি লেপার্ড গুলোকে আনা হোক...সকাল থেকে ওরা না খেয়েই আছে!" নিত্যা র চোখের সামনে দিয়ে হিড়হিড় করে টানতে টানতে ওর বাপ মা মরা নাতিটাকে নিয়ে গিয়ে ফেলা হল বাংলোর মাঝবরাবর।ওদের মধ্যে একজন হাঁটু গেড়ে বসে একটা দুর্বোধ্য মন্ত্র জপ করল...আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঝের ওপরে আড়াআড়িভাবে চিড় ধরতে আরম্ভ করল।আর তারপর হঠাৎ খড়াং করে একটা শব্দ হয়ে...ঘরের মেঝে দুইদিকে সরে গেল।আর তারপর ওকে মাটির সঙ্গে ঘষটাতে ঘষটাতে আনা হল ওই দরজার সামনে।তারপর হাত পা দড়ি দিয়ে বাঁধা অবস্হাতেই উপর থেকে সজোরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হল ওকে।আর সাথে সাথে ওদের ভিতরে একজন ভিতরে গলা বাড়িয়ে ভৃত্যকে হুকুম দিল..."এইবার জানোয়ারগুলোর বাঁধন খুলে ভিতরে ছেড়ে দাও।" আর ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ভৃত্যদের হুকুম দিল..."ওরে কে আছিস...আসন পেতে দিয়ে যা...।" সমস্ত হুকুম পালন করা হল অল্পক্ষণের মধ্যেই। মজা উপভোগ করার জন্য ওরা সবাই দরজার কাছটায় জুত করে বসে গেল কারুকার্যখচিত আসনের ওপরে।একজন ভৃত্য ওদেরকে প্লেটে করে দিয়ে গেল মাংস আর মদ। অচিরেই মেঝে ফুঁড়ে উঠে আসতে শুরু করল বছর বারোর এক বালকের মৃত্যুযন্ত্রনার দরুণ প্রবল যন্ত্রনাক্লিষ্ট আর্তচিৎকার! নিত্যার পায়ের তলার মাটি যেন দুলতে শুরু করল প্রবলভাবে। ওই সময়ে যে পাঁচজন বসে বসে মদ আর মাংস সহযোগে ওই নৃশংস মৃত্যুর দৃশ্য উপভোগ করে চলেছিল...তাদের একজন নিত্যকার দিকে একরাশ বিরক্তি মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল..."তুই এখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস!যা...নিজের কাজ কর গিয়ে!" না...একটা ফোঁটাও চোখের জল সেদিন পড়েনি নিত্যার।ও বরং আদেশ শুনে...মুখ বুজে আদেশ পালন করতে শুরু করল।কিন্তু ভিতরে ভিতরে সেদিন দাঁতে দাঁত ঘষে যে প্রতিজ্ঞা ও করেছিল...তার ভয়াবহতা সম্বন্ধে কোনো ধারণাই ওদের ছিল না। এরপরে অচিরেই চারদিকে রটে গেল...নিত্যার নাতি বাংলোর ভিতরে ঢুকে দামী জিনিস চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল...তাই সে পেয়েছে তার কৃতকর্মের শাস্তি...! যদিও একজন বছর বারোর ছেলে যদি পেটের দায়ে এমন গর্হিত কাজ যদি করেও থাকে...তার জন্য এমন ভয়াবহ শাস্তি আদৌ প্রযোজ্য কিনা...সে নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো দুঃসাহস আশেপাশের কোনো লোকেরই ছিল না। নিত্যা ---তারপর?ওই হতভাগ্য ছেলেটিকেও কি শেষমেষ হিংস্র লেপার্ডদের খাদ্যে পরিণত হতে হয়েছিল? নিত্যা সেদিন কাজ শেষ করে ফিরে এসেছিল ওর ভাঙ্গা কুঁড়েঘরে।সেই ঘরের সাথে ছোট্ট নাতিটার অস্তিত্ব তখনো যেন টাটকা!নিত্যা সারাটাদিন ধরে ভাবছিল...কখন ঘরে এসে নাতিটার একটু যত্ন করবে...নিজের হাতে দুটো ফুটিয়ে খাওয়াবে...।দিনশেষে সেই ভাঙ্গা কুটিরের ভিতরে সেদিন যেন প্রতিপলে গর্জে উঠছিল শ্মশানের নিস্তব্ধতা...! সেই সন্ধ্যায় আকাশ ভেঙ্গে নামল ঘোর বৃষ্টি।প্রকৃতি যেন এমন ঘোর অন্যায় মেনে নিতে পারছিল না কোনোমতে...!প্রবল রোষানলে সে যেন ফুঁসে উঠেছিল।সবকিছু তোলপাড় করার জন্য যেন সে হয়ে উঠেছে মরিয়া।নিত্যা জানে...নাতির অমন নৃশংস হত্যালীলা করে অনায়াসে ওই নরপিশাচেরা পার পেয়ে যাবে।হতদরিদ্র নিত্যার কথা শোনে...এমন কেউই যে নেই এই দুনিয়ায়...ওর নাতির ওপর হওয়া এমন জঘন্যতম অপরাধের সঠিক বিচার হওয়ার কথা ভাববে। ওই তুমুল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে...হঠাৎ ঘরের সব জানলা আর দরজা বন্ধ করে...ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল নিত্যা।দ্রুতপায়ে চলতে শুরু করল গভীর জঙ্গলের ভিতরের এক নির্জন মন্দিরে একাকী বসবাসরত এক তান্ত্রিকের কাছে...যিনি দিনকয়েকের জন্য এই গ্রামে নিজের আস্তানা করে নিয়েছেন।আর সপ্তাহখানেক পরেই তিনি গ্রাম থেকে বিদায় নেবেন।নিত্যা জানে...তিনি তন্ত্রবিদ্যায় সিদ্ধহস্ত! পরের দিন সকালে...নিত্যা ফের বাংলোয় গেল কাজে।বাবুরা যখন ভিতরে মজলিশ নিয়ে মত্ত...নিত্যা তখন সে ঘরে ঢুকেছিল ওদের এঁটো বাসনগুলো গুছিয়ে নিয়ে যাবার জন্য।খানাপিনা আর খোশগল্পের আসরে ঢুকে... মনিবদের এঁটো থালা আর মদের পাত্র কুড়োতে গিয়ে নিত্যা দেখল...একটা মদের পাত্রে তখনো রয়ে গেছে অনেকটা মদ।ও আর কালবিলম্ব না করে...ওই পাত্রখানা হাতে তুলে নিল।তারপর সজোরে ভিতরের সমস্ত মদ ছুঁড়ে দিল একজনের গায়ে।নিত্যার এমন দুঃসাহস দেখে ওরা প্রচন্ডভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। মনে মনে খুশি হয়ে উঠল নিত্যা।ও খুব ভালোভাবেই জানে...এর পরিণতি কি হতে চলেছে...!অচিরেই নিত্যার হাত পা দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলার হুকুম জারি হল।ব্যস...এইবার নিত্যা নিশ্চিন্ত।খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ওকে ছুঁড়ে ফেলা হবে অন্ধকুঠুরির ভিতরে... বুভুক্ষু লেপার্ডদের খাদ্য হিসেবে। যখন দড়ি দিয়ে নিত্যার হাত পা বাঁধা হচ্ছিল...তখন ওর চোখেমুখে ছেয়ে উঠতে শুরু করল একটা অদ্ভুত প্রশান্তি।এখন ওর নাতির খুনীরা নিজেদের অজান্তেই নিজেদের কবর খুঁড়তে চলেছে।নিজের হাতে সে তড়পে তড়পে হত্যা করতে পারবে ওর নাতির খুনীদেরকে।কোনো শক্তি আর এই ভবিতব্যকে আটকাতে পারবে না। এতখানি বলে এবার থামল বৃদ্ধা।হঠাৎ দরজার কাছ হতে ভেসে আসল রাতুল অঙ্কুশ অর্নব আর আবিরের গল্পকথার কলকল শব্দ। এতক্ষণে ঘোর কেটে হুঁশ ফিরল বিহানের।ওদের গলার আওয়াজ পেয়ে বৃদ্ধাও সাথে সাথে গল্পের দুনিয়া ছেড়ে বাস্তব জগতে ফিরে এল।তারপর একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল... "দেখেছেন দাদাবাবু...আপনাকে গপ্পো শোনাতে শোনাতে আমার খেয়ালই ছিল না...বেলা কত হল...।" তারপর তাড়াতাড়ি করে ওদের কাছে গিয়ে বৃদ্ধা বলে উঠল..."দাও গো বাবুরা...বাজার থেকে যা যা এনেছ সেগুলো আমার হাতে দিয়ে বলো কি কি রাঁধতে হবে।আমি ঝটপট রান্নাবান্না করে রাখছি আপনারা খাওয়াদাওয়া সেরে তারপর ঘুরতে বেরোবেন'খন। অঙ্কুশ বৃদ্ধার হাতে ধরিয়ে দিল একটা ছোট্ট স্টোভ আর কড়াই খুন্তিসহ সামান্য কিছু বাসনপত্র।আর রাতুল বৃদ্ধার হাতে দিল মুরগির মাংস,চাল আর কিছু সব্জি ও মশলাপাতি। তারপর বলল...আজকে এই মুরগির মাংস বেশ কষা কষা করে রাঁধো দেখি...সাথে সব্জি দিয়ে পোলাও করবে কেমন!" জিনিসগুলো হাতে নিয়ে বৃদ্ধা বলে উঠল..."যে আজ্ঞে।" হাতটা একটু ঝেড়ে অঙ্কুশ বলে উঠল..."কি ভায়া...শরীর ফিট এখন?বিশ্রাম ঠিকঠাক হল তো?" সত্যিই এখন শরীর একদম ঝরঝরে মনে হচ্ছে বিহানের। অঙ্কুশ বলে উঠল..."বেশ তাহলে তো আর কথাই নেই...শোনো বন্ধুগণ...রান্না সারা হতে হতেই স্নানের পর্ব চুকিয়ে নিতে হবে আমাদের।এরপর খেতে খেতে ঠিক করা হবে...কোথায় যাওয়া যাবে আজকে...।কেমন?" রাতুল,অর্নব আর আবির বলে উঠল..."একদম।" বিহান বলে উঠল..."হ্যাঁ সে তো ঠিকই...কিন্তু স্নানটা কোথায় করা যায় বল তো?" বিহানের কথাটা শোনামাত্র চোখ চকচক করে উঠল আবিরের।একলাফে ও বিহানের পাশে এসে বসে আনন্দে উদ্বেলিত কন্ঠে "আরে ইয়ার...আজকে দারুণ স্ফূর্তি হবে আমাদের।জানিস...বাইরে দেখে এলাম...এই বাংলোটার ঠিক পিছন দিকটাতে একটা ছোট্ট জলপ্রপাত রয়েছে।কুলকুল করে জল পড়ছে ক্রমাগত।আজকে আমরা পাঁচ বন্ধু ওইখানেই স্নান করব গিয়ে।হেব্বি মজা হবে।" অর্নব বলে উঠল..."হ্যাঁ রে ভাই...আর দেরি করা ঠিক হবে না।তাড়াতাড়ি তোয়ালে টোয়ালে সব বার করে এক্ষুনি চল। ঘরের একপাশে বৃদ্ধা রান্না বসিয়ে দিয়েছে...আর অন্যদিকে পাঁচ বন্ধু একটা দারুণ স্নান সেরে আসার তোড়জোড় শুরু করেছে। জলপ্রপাতের জলের অঝোর ধারায় পাঁচ বন্ধু মিলে মহা স্ফূর্তির সঙ্গে স্নান শুরু করে দিল। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে অঙ্কুশ বলে উঠল..."আহা...এমন খোলা প্রকৃতির মাঝখানে এমন স্বর্গীয় স্নানের সুযোগ যদি রোজ রোজ মিলত।" "তা এমন সুযোগটাকে পার্মানেন্ট করেই নে না...তল্পিতল্পা গুটিয়ে ওই বাংলোয় থেকে যা সারাজীবনের মতো।কেউ ভাড়াও চাইতে আসবে না...আর রোজ রোজ ফ্রীতে এমন স্নান করতে পারবি সারা জীবন...।" ফোঁড়ন কেটে বলে উঠল রাতুল। হঠাৎ আবির বলে উঠল..."অ্যাই দ্যাখ দ্যাখ...এই জলপ্রপাতটার আড়ালে একটা গুহা মতন কি যেন রয়েছে।" অঙ্গুলিনির্দেশ করে আবির যেদিকে দৃষ্টি দিতে নির্দেশ করল আবির...সেইদিকে মনোযোগ দিল সকলে।সত্যিই তো...কুলকুল করে অনর্গল জল পড়ে চলেছে যেখানে...তার ঠিক পিছনে...রয়েছে একটা গুহায় প্রবেশের দরজা।দরজাটা একটা বিশাল পাথর দিয়ে আটকে রাখা রয়েছে।ব্যাপারটা খুবই ইন্টারেস্টিং...ওরা সকলেই মনস্হির করে ফেলল...সবাই মিলে ওই পাথরটাকে সরিয়ে...দেখবে...ভিতরে কি আছে...! যেমন ভাবা...তেমন কাজ।সবাই মিলে কোমর বেঁধে লেগে পড়ল এবার জলপ্রপাতের জল ভেদ করে...গুহামুখের বন্ধ দরজার মুখে আটকে রাখা ওই বিশাল পাথর সরানোর কাজে।আর এই ব্যাপারে জিম করা...পেশীবহুল শরীরের অধিকারী বিহানের ওপরেই বেশি ভরসা করল বাকি চারজন।অঙ্কুশই বলে উঠল..."বিহান একেবারে সামনে থেকে পাথরটা ঠেলুক...আর আমরা তাতে সাধ্যমতো হাত লাগাই...কি বলিস তোরা?" "একদম...বিহান...যা...তুই আগে ঠেলতে আরম্ভ করে দে।" এই বলে চারজন মিলে হৈ হৈ করে বিহানকে দাঁড় করিয়ে দিল গুহার মুখের লাগোয়া ওই পাথরটার এক্কেবারে সামনেটায়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার...পাথরটা সরাতে বিহানকে একেবারেই শক্তি প্রয়োগ করতে হল না।যেন ওই পাথরটা বিহানের হাতেরই স্পর্শ পাওয়ার জন্য উপোসী হয়ে পড়েছিল বহু বছর ধরে।পাথরটা বিহানের হাতের স্পর্শ পাওয়ার সাথে সাথেই আপনা হতেই ঘরঘর শব্দ করে সরে গেল।বিহান পাথরটা সরানোর জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিল।তাই ওর হাতের স্পর্শ পাওয়ামাত্র যখন পাথরটা সরে গেল...তখন বিহান এক ঝটকায় ঢুকে এল ওই গুহার দরজার ওপারে।আর তার সাথে সাথেই যেটা হল...সেটার জন্য বিহান মোটেই প্রস্তুত ছিল না।ঘরঘর শব্দ করে ফের বন্ধ হয়ে গেল গুহার সামনের ওই পাথরখানা।এইবার বিহানের সারা শরীর জুড়ে এক তীব্র আতঙ্ক একেবারে কাঁটা দিয়ে উঠল।ভয়ঙ্কর কোনো একটা প্রহসনের তীব্র গন্ধ অনুভব করে ওর পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠল যেন।ও সাথে সাথে ছুটে গেল গুহার দরজার সাথে লাগোয়া ওই পাথরটাকে সরাতে।কিন্তু নাঃ...এই পাথর একচুলও সরানো যেন এখন স্বয়ং ভগবানেরও অসাধ্য! হা ঈশ্বর!এই কি তবে ছিল অদৃষ্টে!শেষকালে এই পাহাড়ের অন্তরালে অলৌকিক গুহার ভিতরে আটকা পড়ে প্রাণটা যাবে শেষ পর্যন্ত! হঠাৎ চারপাশের বাতাস কাঁপিয়ে প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করল আবির অঙ্কুশ অর্নব আর রাতুলের কন্ঠস্বর! "আর পরিত্রাণ নেই।গতজন্মের পাপের মাসুল চোকানোর জন্যই যে আমাদের জন্ম!এই আমাদের অদৃষ্টের লিখন!" "কে?কে?" প্রচন্ড ভয়ে আর আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল বিহান। চারপাশে বাতাসের প্রতিটি কণায় কণায় প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করল অঙ্কুশ রাতুল,আবির আর অর্নবের কন্ঠস্বর! ওরা বলে উঠল..."ওরে...গতকাল রাতের পরে তুই যা দেখছিস...যা শুনছিস...তার সবটাই বিরাট বড় একটা প্রহসন!আমরা আর কেউই আর বেঁচে নেই এখন!" ---"মা...মা...মানে?ক্কি...কি বলছিস তোরা?কি হয়েছে তোদের সকলের!বল...বল আমাকে...!" ---"পাপ...পাপ...গতজন্মের জঘন্য পাপের শাস্তি হয়েছে আমাদের চারজনের...গতকাল রাতে।বেঁচে গিয়েছিস শুধু তুই।একবার ভালো করে নিত্যার মুখটা মনে করে দেখ দেখি...!" নিজের মাথাখানি দুইহাত দিয়ে চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ল বিহান।ওর অন্তর্দৃষ্টির পর্দায় একটু একটু করে ফুটে উঠতে শুরু করেছে একজন হতদরিদ্র অসহায় বৃদ্ধার অবয়ব।ওর মনে ভেসে উঠতে শুরু করল সেই বৃদ্ধার কাতর আকুতি...যখন ওর নাতি...দিদিমাকে প্রহাররত অবস্হায় ওকে দেখে দিগ্বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল...। ওর মনে পড়তে শুরু করল...অন্ধকুঠুরির ভিতরে তাকে হিংস্র লেপার্ডদের খাদ্য হওয়ার জন্য সে ছেড়ে দেবার আদেশ দিয়ে...তারপর সঙ্গীসাথীদের নিয়ে সে মদ ও মাংস সহযোগে বসে গিয়েছিল ওই অমানুষ দৃশ্যের মজা অনুভব করার জন্য! পাঁচশো বছর আগে নিজের কৃতকর্ম ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকল বিহানের...আর সেইসাথে ও একে একে রাতুল,অর্নব,অঙ্কুশ আর আবিরকেও চিনতে পারল নতুন করে।এরা আর কেউ নয়...এরাই হল সেইদিনের ওই নৃশংস আমোদপ্রমোদের সহচর! ক্রমে বিহান উপলব্ধি করতে আরম্ভ করল...পাঁচশো বছর আগের কৃতকর্মের শাস্তিভোগের মাহেন্দ্রক্ষণ আসার আর খুব বেশি দেরি নেই! ক্রমে ওর মনে পড়তে শুরু করল নিত্যার ওই যন্ত্রনাক্লিষ্ট মর্মাহত মুখখানি...যে নীরবে নিজের নাতির অমন ভয়ঙ্কর মৃত্যু চুপচাপ দেখে যেতে বাধ্য হয়েছিল! সেই মুখ আর একজনের মুখের অবয়বের যে অবিকল মিল!ঘরের ভিতরে এখন যে বৃদ্ধা ওদের জন্য রান্না করতে ব্যস্ত...সেই নিত্যারই মুখোমুখি আজ হয়েছে ওরা সকলে এই পাঁচশো বছর পরে...তাতে এখন আর কোনো সন্দেহই নেই বিহানের!কিন্তু সবথেকে বড় প্রশ্ন হল...গতকাল রাতেই যদি বাকি চারজনে মারা গিয়ে থাকে...তাহলে সকাল থেকে ও যাদের সাথে কথা বলে চলেছে...যারা বাজার করে নিয়ে এল...যাদের সাথে হাসিঠাট্টা...গল্পকথার পরে সবাই মিলে একসাথে আসা হল এই গূহ্য গুহার সামনে...তারা আসলে কারা!এই ভয়ঙ্কর প্রহসনের অর্থ কি! বিহানের পিঠ দিয়ে বইতে শুরু করল একটা হিমশীতল স্রোত...! হঠাৎ বাতাস কাঁপিয়ে ফের বলতে শুরু করল অঙ্কুশ অর্নব আবির আর রাতুল। "পাঁচশো বছর আগের পাপের শাস্তি ভোগ করবার জন্যই যে আমাদের পাঁচজনের জন্ম!পাঁচশো বছর আগে এই বাংলোর কাছে এক মন্দিরে ঠাঁই নিয়েছিলেন এক তান্ত্রিক...মনে পড়ে?আমরা ওই তান্ত্রিককে ভুল বুঝিয়ে বলেছিলাম...যে গরীবদের ওপর নিপীড়ন আর শোষণ করবে...আমরা তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার কোনো ব্যবস্হা করতে তার সাহায্য চাই...! তিনি তখন আমাদের কথা বিশ্বাস করে...নিদান দিলেন এই পাহাড়ের গায়ে এমন একখানি বাংলো তৈরি করার জন্য...!তান্ত্রিকের দেওয়া নক্সা অনুযায়ী বাংলো তৈরি হয়ে যাওয়ার পর তিনি তাঁর তন্ত্রবিদ্যার দ্বারা বাংলোটির পরিপূর্ণতা দিলেন।মন্ত্রোচ্চারণের ফলপ্রসূ খুলে যেত বাংলোর ভিতরে মেঝে সংলগ্ন গুপ্ত দরজাখানি...আর তাঁরই মন্ত্রের দ্বারা সৃষ্ট লেপার্ডগুলিকে আমরা লেলিয়ে দিতাম আমাদের শিকারের দিকে...।গরীবদের শোষণ আর নিপীড়ন করার কাজেই যে আমরা তান্ত্রিকের সহায়তা নিয়েছি...এটা তিনি সেইদিন বুঝলেন...যে ঝড়জলের রাতে নিত্যা মন্দিরে ধ্যানমগ্ন তান্ত্রিকের কাছে গিয়ে তার নাতিকে হত্যার সমস্ত বৃত্তান্ত উন্মুক্তভাবে তুলে ধরে এবং একটা সুবিচারের আশায় সে তান্ত্রিকের পায়ে কেঁদে পড়ে...। তখন তান্ত্রিক নিত্যাকে নিদান দেয়...যে শক্তি তিনি নিজের হাতে সৃষ্টি করেছেন...তার ধ্বংসও তারই হাতে হওয়া সম্ভব!কিন্তু এই শক্তির বিনাশ ঘটাতে গেলে চাই প্রচুর প্রচুর রক্ত!আর সে শুধুমাত্র লাল রক্ত হলেই হবে না...সেই রক্তে থাকতে হবে যন্ত্রনা আর প্রতিশোধের আগুন! তাহলেই তিনি সেই রক্তের সাথে মিশিয়ে দিতে সক্ষম হবেন ওই শক্তির বিনাশের বীজ...এবং সেইসাথে আমাদের পাপের শাস্তির ভবিতব্যের অদৃষ্ট! তান্ত্রিকের কথা শুনে খানিক ভাববার পর...নিত্যা শেষমেশ নিজেকেই বলি দিতে প্রস্তুত হল।ওই ঝড়জলের রাত্রে তান্ত্রিক শুরু করলেন যজ্ঞ।মন্ত্রবলে ওর শরীরের রক্তের প্রতিটি কণায় মিশিয়ে দিলেন তাঁর সৃষ্ট শক্তির বিনাশের বীজ।সৃষ্টি করলেন এক ভয়াল পিশাচ! যে পিশাচ জীবন্ত নরমাংস ভক্ষণ করতে সময় নেয় শুধু কয়েক মূহুর্ত! পরদিন নিত্যা আমাদের আমোদ প্রমোদের আসরে কাজের ছলে এসে...ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের গায়ে মদের পাত্র হতে মদ ছুঁড়ে ফেলল।আর রুষ্ট হয়ে আমরা ওকে দিলাম একই শাস্তি।ও তো এইটাই চেয়েছিল... !পরক্ষণেই হিংস্র বুভুক্ষু লেপার্ডের দল এক নিমেষে ওর শরীর ছিন্নভিন্ন করে ফেলে আর আমরা হাতে মদের পাত্র নিয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি সেই দৃশ্য!আমরা সেইদিন জানতেও পারিনি...নিজেকে এইভাবে বলি দিয়ে ও কিভাবে আমাদের বিনাশের রাস্তা তৈরি করছে...!কয়েক মূহুর্তের মধ্যেই ওর ছিন্নভিন্ন শরীর হতে রক্তের ফোয়ারা ঝরে পড়তে শুরু করে...আর সেই রক্তের প্রতিটি কণা একত্রিত হয়ে জন্ম নিতে শুরু করে এক ভয়াল পিশাচ!নিমেষের মধ্যে ধ্বসে পড়ে বাংলোখানি...আর নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তান্ত্রিকের মন্ত্রঃপূত লেপার্ডের দল!ওই ভয়াল পিশাচের পরিপূর্ণতা প্রাপ্তির জন্য প্রয়োজন পাঁচশো বছর। নিত্যার প্রার্থনা ছিল...ও নিজের হাতে আমাদের শাস্তি দেবে।আর সেই কারণেই পুনর্জন্ম আমাদের পাঁচজনের।আমাদের অদৃষ্ট আমাদেরকে একসঙ্গে টেনে এনেছে আমাদেরই গতজন্মের শাস্তি দেবার জন্য।নিত্যা নিজে নিয়েছে ওর ফুলের মতো নিষ্পাপ নাতির নৃশংস হত্যার নির্মম প্রতিশোধ!আর একটু সামনে এগিয়ে যা...তাহলেই বুঝতে পারবি!" বাতাসে প্রতিধ্বনিত কন্ঠগুলি এবার পেয়েছে এক উজ্জ্বল বায়বীয় অবয়ব!তারা বিহানকে যেইদিকে দিকনির্দেশ করছে...বিহান এখন যন্ত্রচালিত রোবটের মতো সেইদিকে এগিয়ে চলেছে এক পা এক পা করে।খানিকটা এগিয়ে এবার ও যা দেখল...তাতে ভয়ে আতঙ্কে ওর হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হল।ও দেখল...ভিতরে পড়ে রয়েছে চারটি নরকঙ্কাল...যার গায়ে এখনো লেগে রয়েছে টাটকা রক্ত আর অল্প মাংস!এবার বিহানের আর বুঝতে বাকি রইল না...অঙ্কুশ অর্নব রাতুল আর আবিরের ঠিক কি পরিণতি হয়েছে!গতকাল রাতে নিত্যার রক্ত হতে জন্ম নেওয়া ওই ভয়াল পিশাচ জেগে উঠেছে আর তারপর একে একে চারজনকেই জ্যান্ত ভক্ষণ করেছে! ওর এইখানে পৌঁছনোর আগে পর্যন্ত ও যা যা দেখছিল...যা যা শুনছিল...সেইসবকিছুই যে নিত্যার প্রেতাত্মার সৃষ্ট মায়াজাল...আর প্রহসন...এটা বুঝতে আর বাকি রইল না বিহানের।ওই প্রহসনই ওকে এই গুহা পর্যন্ত টেনে নিয়ে এসেছে...এটাও ও অচিরেই বুঝতে শুরু করে।হঠাৎ ও টের পেল...ওর পিছন দিকে প্রচন্ডভাবে ধ্বস নামতে আরম্ভ করেছে।প্রচন্ড ভীত আর আতঙ্কিত হয়ে বিহান সামনের দিকে ছুটতে শুরু করল দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে।এইভাবে ছুটতে ছুটতে...ও পৌঁছে গেল সেই জায়গাতে...যেই জায়গাটা ও গতকাল স্বপ্নে দেখেছিল।এই তো সেই অন্ধকুঠুরি আর এর ঠিক ওপরেই রয়েছে এর দরজা!দরজা সংলগ্ন একটি সিঁড়িও রয়েছে।ও আর কালবিলম্ব করল না।প্রচন্ড বেগে ও ছুটে...সিঁড়ি বেয়ে ও তরতর করে উঠতে শুরু করল ওপরে।চারপাশের বাতাস বৃদ্ধার অট্টহাস্যের সাথে যেন গর্জে উঠছে।বিহান যত সামনের দিকে এগোচ্ছে...ততই পিছনের ক্রমাগত ধ্বস নামার ফলে বুজে যেতে শুরু করেছে ওই অন্ধকুঠুরির সমস্ত অস্তিত্ব!শেষ পর্যন্ত বিহান ওই অন্ধকুঠুরি হতে পুরোপুরি নিজেকে মুক্ত করে নিতে সক্ষম হয়...আর তারপর প্রচন্ড বেগে ও বাংলোর একেবারে বাইরে বেরিয়ে আসে।বাংলোর বাইরে বেরিয়ে ও দেখল...এখন গভীর রাত।পিছন দিকে তাকাতেই ও দেখল...হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে পাহাড়ের গায়ে মিশে যেতে শুরু করেছে ওই ভগ্ন বাংলোর ধ্বংসাবশেষ!আকাশের গায়ে প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠেছে ওই বৃদ্ধা...থুড়ি...নিত্যার অট্টহাস্যরত অবয়ব।দীর্ঘ বছর পরে নিজের প্রতিশোধ স্পৃহা মিটিয়ে...নিজের হাতে ওর অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে...অপার শান্তি নিয়ে একটু একটু করে পাড়ি দিচ্ছে অমৃতলোকের পথে। ঘুম ভাঙ্গার পর বিহান চোখ মেলে চেয়ে দেখল...চারপাশে প্রচুর লোকের সমাগম।ক্রমে ও বুঝতে পারল...চারপাশের সমস্ত লোকজন এখন উৎসবের আয়োজনে ব্যস্ত।এই গ্রামে একটা নিদান রয়েছে বহু বছর আগে থেকেই...সেটা এই কিছুদিন আগে জেনেছিল বিহান।যদি কোনোদিন আপনা হতেই ওই ভগ্ন বাংলোর ধ্বংসস্তূপ ভেঙ্গে পড়ে মিশে যায় পাহাড়ের গায়ে...অদৃশ্য হয়ে পড়ে পুরোপুরি...তাহলে সেইদিনটা গ্রামবাসীদের জন্য বড়ো শুভদিন। গ্রামবাসীরা যখন উৎসবের আয়োজনে মগ্ন...তখন বিহানের সারা শরীর জুড়ে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে ভয়ানক ঘা।কিন্তু তার চাইতেও অদ্ভুত ব্যাপার হল...ওকে এখন কোনো মানুষ যে দেখতেই পাচ্ছে না...সেটা ক্রমে বিহান বুঝতে শুরু করল।ঘাএর যন্ত্রনায় ও ক্রমে উন্মাদের মতো অবস্থা হল ওর।কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার...ও এই এত লোকের জমায়েতের মধ্যে গিয়ে...চিৎকার করে করেও কারোর কাছেই জানান দিতে পারছে না নিজের অস্তিত্ব!বলতে পারছে না নিজের যন্ত্রনার কথা...আর তা সারানোর সমস্ত উপায়ও এখন পুরোপুরি বন্ধ এর ফলে।কষ্টে যন্ত্রনায় বিহানের যখন এহেন অসহায় অবস্হা...তখন একটা কন্ঠ যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল ওর কানের কাছে।ওই কন্ঠ পরিষ্কারভাবে বলে উঠল..."এইটাই তোর উপযুক্ত শাস্তি।তুই রক্তমাংসের শরীর নিয়ে বেঁচে রয়েছিস...কিন্তু তবু পৃথিবীর কেউ আর কোনোদিন তোকে দেখতে পাবে না...তোকে শুনতেও পাবে না।বেঁচে থেকেও চিরতরে বিলীন হয়ে গিয়েছে তোর সমস্ত পার্থিব অস্তিত্ব!" এই কন্ঠে চিনতে কোনো অসুবিধা হল না বিহানের।এই কন্ঠ যে নিত্যার...সে আর বুঝতে বাকি রইল না ওর।এবার ওর যেন মনে হল...ও একদম বদ্ধ উন্মাদ হয়ে পড়বে যন্ত্রনায়।ধীরে ধীরে ওর স্বাভাবিক স্হিতি ক্ষয় হতে আরম্ভ করল।এক পর্যায়ে...ও লোকজনকে হাতে পায়ে ধরে ধরে নিজের হাত...শরীরের অংশ মানুষের শরীরে ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে....এমনকি প্রবলভাবে ঘষে ঘষেও নিজের পার্থিব অস্তিত্বের জানান দিতে পারল না কারোর কাছে।ও জানে...সর্বাঙ্গ জুড়ে এই ভয়াবহ ঘা হল ওর নিজের কৃতকর্মের শাস্তি।কিন্তু যন্ত্রনায় ক্রমে ক্রমে ও এতটাই পাগল হয়ে উঠল...যে শেষ পর্যন্ত নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য...একটা ধারালো অস্ত্র যোগাড় করে ও নিজেকে ক্রমাগত ক্ষতবিক্ষত আর রক্তাক্ত করতে আরম্ভ করে দিল।এতেও কাজ না হওয়ায়...এরপর ও নির্মমভাবে এক এক করে নিজের অঙ্গচ্ছেদ করতে শুরু করল।ক্রমে প্রবল রক্তপাতের দরুন অচিরেই প্রাণ বেরিয়ে গেল বিহানের অদৃশ্য শরীর হতে...। পরবর্তীতে অঙ্কুশ,অর্নব,রাতুল আর আবিরের কঙ্কাল পেয়েছিল গ্রামবাসীরা।তারা বুঝতে পেরেছিল...ওদের মৃত্যুটা কোনো সাধারণ মৃত্যু ছিল না।একটা কোনো ভয়ঙ্কর অপশক্তির হাত রয়েছে এই হত্যালীলায়।কিন্তু এই মৃত্যুরহস্যের প্রকৃত কোনো কিনারা করে উঠতে পারেনি কেউই।আর তাছাড়া...পাঁচ বন্ধুর ভিতরে পাওয়া গেছে চারজনের কঙ্কাল।আর একজনের কি পরিণতি হল?এই রহস্য পুরোপুরি অধরা রয়ে গেল সকলের কাছে।আর সবচাইতে আশ্চর্যের ব্যাপার হল...এই হত্যালীলার পরে ওই ভবঘুরে বৃদ্ধাকে আর দেখা যায়নি কোথাও।এই হত্যালীলার সঙ্গে কি তার কোনোপ্রকার সংযোগ ছিল? চার বন্ধু যেভাবে খুন হয়েছে...তাতে তো এই খুন কোনো মানুষের দ্বারা যে সম্ভব নয়...এই ব্যাপারে এখন সবাই নিশ্চিত। কে ছিল ওই বৃদ্ধা?যাকে এতদিন ধরে পাগলছাগল বলে খেদিয়ে এসেছে সবাই...সে কি আসলেই তবে এক ভয়াল অপশক্তির ছায়ামূর্তি ছিল!এই চিন্তাটা আসতেই গ্রামবাসীদের সকলেরই পিঠ দিয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল যেন...! সমাপ্ত

