STORYMIRROR

Rashmita Das

Horror Fantasy

4  

Rashmita Das

Horror Fantasy

ডাইনিবুড়ির কুঠি

ডাইনিবুড়ির কুঠি

22 mins
16

ওদিকটায় যেও না খুকি...! ---"কেন?ওখানে যেতে বারণ করছ কেন?" ---"ওখানে একটা ডাইনি বুড়ি থাকে...জান!ছোট বাচ্চাদের দেখলেই...ওদের ঘাড় মটকে...রক্ত চুষে খায়।" ---"সত্যি?" ---"হ্যাঁ গো মামনি...তিন সত্যি।একদম যেও না ওদিকটায়।তুমি বরং ওই মাঠে যাও...বিকেল তো হয়ে এল।আর বিকেল হলেই...তোমার মতো অনেক বাচ্চা ছেলে...বাচ্চা মেয়ে আসে ওইখানে চলে আসে খেলতে।তুমিও ওদের সাথে গিয়ে ভাব করে নাও...ওদের সাথে খেলা করো...কেমন!" বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় নাড়ল তিতির।যদিও মনে মনে ও জানে...এক্ষুনি নিবারণ দাদু যে কথাগুলো বলে গেলেন...সেই সব কথাগুলো ডাহা ভুল।শুধু নিবারণ দাদু কেন...আশেপাশের সব প্রতিবেশীর মুখেও এই ধরণের কথা ও শুনে নিয়েছে।কথাগুলোতে খানিক মেশানো ছিল ভীতি...আর খানিক মেশানো ছিল সতর্কীকরণ।এখন তিতির বোঝে...একটা ডাহা ভুল ধারণা নিয়ে বসে রয়েছে এরা সবাই।গত পরশুদিন যে কি ঘটনা ঘটেছিল...সে তো আর কেউ জানে না...এমনকি তিতিরের মা ও না।কথাখানা তিতির কাউকে বলেনি।পুরোপুরি চেপে গিয়েছে নিজের ভিতরে।তিতির অবশ্য এমনিতে খুব মা ভক্ত মেয়ে।রোজ স্কুলে যা যা হয়...ঘরে ফেরার পথেই গড়গড় করে সমস্তকিছু ওর মাকে বলা চাইই চাই।না হলে ওর পেটের ভাত হজম হয় না।বাবার কাছেও কিছুটা হলেও আড়াল আবডাল চলতে পারে।কিন্তু মা ওর কাছে একেবারে স্বচ্ছ আয়নার মতো।সেখানে নিজেকে পরিষ্কারভাবে মেলে ধরে দেখে নেয় নিজেকে।সেই পরিতৃপ্তিটাই ওকে ওর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ায় আরো আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।কিন্তু গত পরশুদিন...এই পুরো হিসেবটাই একেবারে ওলটপালট হয়ে গিয়েছে।পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে দিন কয়েকের জন্য এসেছে তিতির।ও কলকাতার মেয়ে।তিতিরের বাবা দেবাশীষ বাবু এখানে থেকে চাকরি করেন।আর তিতির কলকাতায় ওর মা আর ঠাকুরমার সাথে থাকে।দেবাশীষ বাবু আর তাঁর বন্ধু এবং সহকর্মী জয়ন্ত বাবুর জন্য পাশাপাশি দুটি বেডরুম মিলিয়ে যে মিলিয়ে একখানি কোয়ার্টার...সেখানেই ওরা উঠেছে আপাতত।সদ্য বদলি হয়ে  এসেছেন দেবাশীষ বাবু এখানে।রান্নাটান্না কিচ্ছু জানেন না।দিন কয়েকের জন্য স্বাতী দেবী শাশুড়ি মায়ের কাছে তিতিরকে রেখে এখানে আসবেন বলে মনস্হির করেছিলেন।কিন্তু তিতির ভীষণভাবে মনখারাপ করে বসে ছিল।না...কটাদিন মা কে ছেড়ে ও থাকবে না কিছুতেই।স্বাতী দেবী ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে বুঝিয়ে বলেছিলেন..."আমি ওখানে বেড়াতে যাচ্ছি না সোনা মা...তুমি জান...ওখানে এখন বাবার কত অসুবিধা...আমি এখন কদিন গিয়ে একটু সামলে দিয়ে আসি...সামনে যখন পূজোর ছুটি পড়বে...তখন তোমাকে নিয়ে যাব।কেমন!এখন তো বর্ষাকাল।এখন গেলে একদম ঘরে বসে থাকতে হবে।একটুও মজা পাবে না তুমি।পূজোর ছুটিতে গেলে...তুমি অনেক ঘুরতে পারবে।" কিন্তু এত বোঝানোতেও পুরোপুরি অনড় রয়ে গিয়েছিল তিতির।না...কোনো কথা ও শুনবে না।ওকে নিয়েই যেতে হবে।এই পরিস্হিতি দেখে...দেবাশীষ বাবু স্ত্রীকে বলেছিলেন..."ঠিক আছে...পূজো আসা পর্যন্ত আমি এখানে সামলে নিতে পারব।তুমি কদিন পরেই এসো।" কিন্তু স্বাতী দেবীর মন মানল না।এখন সত্যিই তাঁর স্বামীর দরকার তাঁকে।কাজেই কি আর করা...মেয়ের বেশ কিছুদিন স্কুল কামাই হবে জেনেও ওকে সাথে করেই নিয়ে আসতে বাধ্য হলেন তিনি।অযোধ্যা পাহাড়ের একেবারে কাছেই কোয়ার্টার।তিতিররা দিন কয়েক হল এসেছে।আর তিতির তো এখানে পা রাখার পর থেকে...একটা চঞ্চল প্রজাপতি যেন ভর করেছে ওর ভিতরে।শুধু এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছে তিতির।তবে এ নিয়ে স্বাতী দেবী আর বিশেষ আপত্তি তোলেননি।জীবনে প্রথম পাহাড় দেখছে মেয়ে...এই বৃষ্টি বাদলার মধ্যে হলেও...যতটুকু পারছে...নিজের মতো করে ঘুরুক মেয়েটা।তবে স্বাতী দেবী পইপই করে মেয়েকে বলে দিয়েছিলেন...ও যেন কোয়ার্টার এরিয়ার বাইরে না যায়।তো গত পরশু...জয়ন্ত কাকু...বাবা আর মা তিনজনে একটু বাজারে বেরিয়েছিলেন।তিতিরকেও নিতে চেয়েছিলেন সাথে...কিন্তু তিনজন বড় মানুষের মধ্যে ও আর ভীড় বাড়াতে চায়নি।কাজেই গররাজি তিতিরকে আর কেউ জোর করেনি।ওকে রেখেই চলে গিয়েছিলেন তাঁরা।তিতির মুক্ত বিহঙ্গের মতোই ঘুরে বেড়াচ্ছিল এদিক ওদিক।চারপাশে যা যা দেখছে সবই নতুন।আর সবকিছুই ওর ভিতরে নতুন আগ্রহের উদ্রেক করছে।ঘুরতে ঘুরতে কতদূর যে চলে গিয়েছিল ও...সে ও নিজেই জানত না।মা তো বলেছিলেন কোয়ার্টার এরিয়ার ভিতরে থাকতে।কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে...ঘুরতে ঘুরতে কখন যে কোয়ার্টার এরিয়া ফেলে...কতদূর চলে এসেছে সেটা ও নিজেই বুঝতে পারেনি।হঠাৎ ওর এটা খেয়াল পড়ল তখন...যখন মুষলধারে বৃষ্টি নামল।এবার বৃষ্টি নামতেই তিতির যখন বুঝতে পারল...যে ও পথ হারিয়েছে...তখন প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল ও।তাড়াতাড়ি একটা গাছের তলায় আশ্রয় নিয়েছিল ও।কিন্তু তারপরেই বুঝল...যেমন জোরে বৃষ্টি পড়ছে....ও তো কিছুক্ষণের ভিতরেই ভিজে একশা হয়ে যাবে।এই সময়ে...হঠাৎ ওর নজরে আসল...অদূরে রয়েছে একখানা কুঁড়েঘর। চারপাশে আর মানুষজনের কোনো চিহ্ন আছে বলে মনে হয়নি তিতিরের।বৃষ্টির জল ওর গায়ে লাগলেই...খুব বিশ্রীভাবে জ্বরে পড়ে যায় তিতির।এখন না হয় বৃষ্টি পড়ছে...কিন্তু বৃষ্টি যখন থামবে...তখন ওকে বিছানায় শুয়ে কাটাতে হবে!চারপাশে এত সুন্দর পরিবেশ...এত দারুণ একটা পাহাড়ী জায়গা...কিচ্ছু দেখাই হবে না ওর।কদিন পরেই তো এখান থেকে চলে যেতে হবে মায়ের সাথে।নাঃ...এখন এখানে এসে জ্বর বাঁধিয়ে বসার কোনো মানেই হয় না।তর চেয়ে সামনের ওই কুঁড়েঘরের ছাউনির তলাটায় যদি দাঁড়ানো যায়...তাহলে বৃষ্টির জল এইভাবে গায়ে লাগা থেকে পুরোপুরি বেঁচে যাবে ও।যেমন ভাবা...তেমন কাজ।প্রচন্ড গতিতে ছুটে...এক নিমেষে ও পৌঁছে গেল কুটিরের ছাউনির তলায়।বেশ ঠান্ডা লাগছিল তিতিরের।ঠান্ডায় জড়োসড়ো হয়ে...ও হাতদুটো দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ওই ছাউনির তলাটায়।যতক্ষণ না বৃষ্টি থামছে...ততক্ষণ এইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ওকে।ইস...ঠিক সময় মতো ঘরে না ফিরলে মা তো খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবেন।আর তাছাড়া যদি দেরি করে আজ ও ফেরে ঘরে...তাহলে হয়তো ওর ঘরের বাইরে বেরোনোও বন্ধ হয়ে যাবে...।তাহলে কি হবে!তাহলে তো সব পন্ড হয়ে যাবে! কুটিরের ছাউনির তলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইসব সাতপাঁচ ভাবছে তিতির...এমন সময় হঠাৎ ভিতর থেকে খুনখুনে এক বৃদ্ধার কন্ঠস্বর ভেসে এল।"কে...কে ওখানে?" ভীষণ চমকে গেল তিতির।শব্দটা যে আসছে এই কুঁড়েঘরের ভিতর থেকে...সেটা ও পরিষ্কার বুঝতে পারছে।অদ্ভুত ব্যাপার হল...এই কুঁড়েঘরের সব দরজা আর জানলা ভিতর থেকে বন্ধ করা রয়েছে।তাহলে ভিতরে যে রয়েছে...সে যেই হোক না কেন...সে তিতিরের উপস্থিতি জানতে পারছে কি করে!বন্ধ দরজা বা জানলার গায়ে যদি কোনো ছিদ্রও থেকে থাকে...তাহলেও তা দিয়ে তিতিরকে দেখতে পাওয়া সম্ভব নয় এ কুঁড়েঘরের ভিতরে বাস করা কোনো লোকের পক্ষে।কারণ তিতির এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল...সেটার লাগোয়া কোনো দরজা বা জানলা নেই।একটা দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে এখন ও।একটা ভয় এবার ওর ভিতরে শিরশির করে বইতে শুরু করল।আর ভয় ছাপিয়েও যেটা তীব্র হয়ে উঠল...সেটা হল কৌতূহল।কে থাকে এই কুঁড়েঘরের ভিতরে?চারপাশে মানুষজনের পা পড়ে বলে তো মনে হয় না।ব্যাপারটা যে কি...একবার দেখতেই হচ্ছে।বৃষ্টির তেজটা ওদিকে কমতে শুরু করেছে।কিন্তু তিতির ওই অজানা অচেনা জায়গাটা আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল।তারপর একটু একটু করে জানলার পাশে সরে আসতে শুরু করল।যদি ওখানে থাকে কোনো ছিদ্র বা গর্ত...তাহলে উঁকি দিয়ে দেখা যাবে ভিতরটা।হয়তো ভিতরে থাকা লোক এই ছিদ্রের চোখ রেখেই ওকে দেখতে পেয়েছে...।সে যাই হোক...এই বৃদ্ধাকে একবার চাক্ষুষ করতেই হবে ওকে।বুড়ির কন্ঠস্বর শুনেই ও বুঝেছে...এ কন্ঠস্বরের ভিতরে এমন একটা কিছু রয়েছে...যা অপার্থিব।যা মানুষের বোধ ও চেতনার সম্পূর্ণ উর্ধ্বে।ভয়টা এবার কৌতূহল হয়ে ওর ওপরে পুরোপুরি চেপে বসল।ভিতরে যেই থাকুক...তার চেহারাটা ওকে একটিবার দেখতেই হবে। এবার বৃষ্টিটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।এখন আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলে...ঠিকঠাক সময়মতোই ঘরের কাছাকাছি  পৌঁছে যাওয়া যাবে...এটা ভালোমতোই জানত তিতির।কিন্তু ওই সময়ে এরকম কোনো চিন্তাই ওর মাথাতে এল না।ও বরং জানালায় চোখ লাগিয়ে কোনো ছিদ্র খোঁজায় যারপরনাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল।অনেক্ষণ চেষ্টাচরিত্র করার পর ও বুঝল...এ জানালায় কোনো ছিদ্র নেই।কিন্তু তাতেও দমল না তিতির।এবার ও দরজার দিকে এগিয়ে গেল।দরজার গায়ে চোখ রাখতে যাবে...ঠিক এমন সময়ে হঠাৎ করে দুইপাশে সরে গিয়েছিল ভগ্ন কাঠের তৈরি দরজার পাল্লাদুটি...! ভীষণ চমকে উঠেছিল তিতির।দরজার পাল্লাদুটি দুইপাশে সরে গিয়ে...ভিতর হতে ক্রমে বাইরে বেরিয়ে আসল এক কঙ্কালসার খুনখুনে বৃদ্ধা।বৃদ্ধার চোখে যেন কোনো প্রাণ নেই।শুধু চোখ কেন...ওই...হাড়ের ওপর কোনোমতে চামড়া জড়িয়ে থাকা ক্ষীণ ও ভঙ্গুর শরীরটা নিয়ে দু পা চলাটাও যে খুবই কষ্টকর!একখানি লাঠির ওপর ভর করে কোনোমতে বৃদ্ধা উঠে এসে এই দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে।বৃদ্ধার সারা শরীর যেন কাঁপছে তিরতির করে।তিতির বৃদ্ধাকে আপাদমস্তক দেখে নিল খুব ভালো করে।এরপর বৃদ্ধার প্রতি বেশ একটা মায়া জন্মাল তিতিরের।আহা রে...এই বয়সে...এই জনবিহীন জায়গায় এইভাবে একা একা থাকে...এই মানুষটাকে দেখভাল করার মতো কেউ নেই বোধহয় এ দুনিয়ায়।নিজের ঠাম্মির কথা ওর মনে পড়ে গিয়েছিল বৃদ্ধাকে দেখে।তিতিরের ঠাম্মির এখন অনেকখানি বয়স হলেও তিনি এখন যথেষ্ট শক্তসমর্থ।কিন্তু তা সত্ত্বেও...এখন যখন বাড়ি থেকে সকলে এতদূরে চলে এসেছে...এই সময়েও তিনি একা নেই।পিসিমনি দিনকয়েকের জন্য চলে এসেছেন ঠাম্মির খেয়াল রাখার জন্য।এই কঙ্কালসার বৃদ্ধাটি নিশ্চয়ই দিনের পর দিআ একলাই থাকেন এই পান্ডববর্জিত জায়গাটায়...! তিতিরের ভাবনার তাল হঠাৎ কেটে গেল...ক্ষীণ গলায় বৃদ্ধা বলে উঠল তিতিরের উদ্দেশ্যে..."এলি মা...আয় আয়...তোর অপেক্ষাতেই তো এইখানে বসে ছিলুম এতকাল...আয় আয়...ভিতরে আয়...।এতদিনে আমার জ্বালা জুড়াল।" তিতির দেখল...বৃদ্ধা হাতছানি দিয়ে ওকে ভিতরে ডাকছে।তিতির এখন অতটাও ছোট নেই...যে...যে কেউ ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে যেকোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে...।বৃদ্ধার অবস্হা দেখে তিতিরের মন নরম হয়ে উঠেছিল ঠিকই...কিন্তু ও ভালোভাবেই জানে...কোনো চেনা লোকও যদি ডেকে কোথাও নিয়ে যেতে চায়...কোনোকিছু যাচাই না করে চট করে তার সাথে চলে যেতে নেই।আর সেখানে একজন অচেনা অজানা মানুষের ক্ষেত্রে তো সে প্রশ্নই আসে না...!কিন্তু বৃদ্ধার ওই শুন্য চোখের দৃষ্টিতে কি যেন একটা যাদু ছিল...যার অমোঘ একটা আকর্ষণ...ওকে ক্রমাগত টানতে শুরু করেছিল কুঁড়েঘরের ভিতরের দিকে।এই আকর্ষণ...এই টান...ও অস্বীকার করতে পারছিল না কোনোমতে।ওর ভিতর থেকে জাগতিক বোধ...বুদ্ধি ক্রমশই যেন লোপ পেতে আরম্ভ করেছিল।বৃদ্ধা ক্রমাগত হাতছানি দিয়ে তিতিরকে কুঁড়েঘরের ভিতরের দিকে ডাকতে শুরু করে দিয়েছিল...খোনা গলায় শুধু একনাগাড়ে বলে চলেছিল বৃদ্ধা..."আয়...আয়...নাতিন...ভিতরে আয় না...আমার জ্বালাটা একটু জুড়োক...।" বৃদ্ধার হাড়সর্বস্ব হাতের তালুর অঙ্গুলীলেহনের মায়ায় পরিপূর্ণ ওই হাতছানির অমোঘ আহ্বান...কোনোমতে উপেক্ষা করতে পারেনি তিতির।ওর পা দুটি যে কখন সচল হয়ে উঠেছে...ও নিজেই সেটা খেয়াল করেনি।দিনের আলো তখন প্রায় নিভু নিভু।দরজার ভিতরে পা রাখল তিতির।আর সাথে সাথেই হাওয়ার তীব্র দাপটে সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল দরজাখানা।দরজা বন্ধ হতেই চারপাশটা ছেয়ে গেল এক নিকষ আলকাতরা কালো অন্ধকারে।ওই বন্ধ ঘরের ভিতরের আলকাতরা কালো অন্ধকারের বুকে হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠল দশটি মোমবাতি।নয়টি বড়ো মোমবাতি...আর তার সামনে একখানি ছোট মোমবাতি।এবার তিতির চোখ মেলে কুঁড়েঘরের ভিতরটা ভালো করে দেখল।কি অদ্ভুত!একটা ছোট ঘরের মাঝ বরাবর বসানো রয়েছে একখানি মৃৎপাত্র।আর তার ওপরে সারি দিয়ে সজ্জিত করে রাখা রয়েছে চারখানি মোমবাতি।এই ঘরখানির ভিতরে আর কোনো জিনিসের অস্তিত্ব নেই।মানুষের ব্যবহারের কোনো আসবাব বা  কোনো জিনিসপত্রের চিহ্নমাত্র নেই এ ঘরের কোনোখানে।একখানা ফাঁকা ঘরের মাঝবরাবর শুধুমাত্র একটি চিৎ করে রাখা মৃৎপাত্রের ওপর রাখা রয়েছে চারটি মোমবাতি...যেগুলি ঘরের ভিতরে কোনো মানুষের পদস্পর্শ পাওয়ামাত্রই জ্বলে উঠেছিল দপ করে।তিতির ভিতরে ভিতরে বেশ ভয়ই পাচ্ছিল চারপাশটা দেখে।বুড়ি ততক্ষণে ওই মৃৎপাত্রের কাছে গিয়ে বসে পড়ে দুইদিকে হাঁটু মুড়ে।তারপর এক অপার্থিব মায়াময় দৃষ্টিতে সে তাকায় তিতিরের দিকে।তিতির বেশ ঘাবড়েই গিয়েছে ততক্ষণে।ওর কপালে ফুটে উঠেছিল বিন্দু বিন্দু ঘাম।যা ঘটছে...তা যে সুবিধার নয়...এটা যেন ওর ভিতর থেকে ফিসফিস করে ক্রমাগত কেউ বলে চলেছে।কিন্তু এই বৃদ্ধার চাহনিতে একটা অদ্ভুত মায়া আছে যেন।তিতির যেন বাঁধা পড়ে গেছে এই বৃদ্ধার চোখের মনিপ্রকোষ্ঠের অমোঘ যাদুর বন্ধনে।এবার বৃদ্ধা খোনা গলায় বলে উঠল..."আরে ভয় নেই রে ভয় নেই।এখানে তোর কোনো বিপদ নেই।আমার কাছে এসে বোস দিকি...একবারটি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখ...তোর কি মনে হচ্ছে...যে আমি মন্দ?" তিতির কখন যে গুটিগুটি পায়ে বৃদ্ধার কাছে এসে বসে পড়েছে...তা ওর নিজেরই খেয়াল ছিল না।ওর মুখ দিয়ে এইবার কথা বেরিয়ে এল। ---"কে তোমায় মন্দ বলে?" ---"চারপাশের সমস্ত মানুষজন বলে।বলে আমি নাকি ডাইনি।আমার কাছে ঘেঁষতে ওরা ভয় পায়।নিজের সন্তানদের আমার কাছে ঘেঁষতে দেয় না।আচ্ছা তুইই বল নাতিন...তুই আমার ঘরে এতক্ষণ এলি...বসলি...আমি তোকে কিছু করেছি?কোনো ক্ষেতি হয়েছে তোর?" তিতির দুইদিকে মাথা নাড়ল সজোরে। বৃদ্ধা আবার বলে উঠল। ---"এ জগতে আমি বড্ড একা রে নাতিন...মাঝে মাঝে মনে হয়...পুকুরে ডুব দিয়ে মরে যাই।কিন্তু আমার যে সেখানেও মাথা খুঁড়ে কোনো লাভ নেই!তুই আমায় কথা দে...তুই এবার থেকে এ বুড়ির কাছে একটু আসবি মাঝেমধ্যে...।" তিতির হেসে ঘাড় কাত করে বলেছিল..."আসব।" এরপর সন্ধ্যা নেমে এসেছিল।তিতির বৃদ্ধাকে বলেছিল..."সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।এরপর ঘরে ফিরতে দেরি হলে আমার মা আমাকে খুব বকা দেবে।আমি এখন আসি দিদিমা?আমি আবার আসব।তোমায় কথা দিচ্ছি।" সেইদিন বাস্তবিকই ওর ঘরে ফিরতে একটু দেরি হয়েছিল।স্বাতী দেবী বেশ ধমকেই বলেছিলেন মেয়েকে।"নতুন জায়গায় তোমাকে নিয়ে আসা হয়েছে বলে ভেবে নিয়ো না...তোমার চারটে ডানা গজিয়ে গেছে।এরপর আর যেন এরকম না দেখি।" জয়ন্ত কাকুও সুরে সুর মিলিয়ে বলেছিলেন..."হ্যাঁ বৌদি...দক্ষিণ দিকের ওই খোলা মাঠ যেদিকে আছে...ওইদিকে ওর যাওয়া একেবারে ঠিক না। ছোট বাচ্চাদের খুব বিপদ ওইদিকটায়।" চোখ পাকিয়ে স্বাতীদেবী তিতিরকে সেদিন বলেছিলেন..."ওই দ্যাখ...শুনলি তো?আমার চোখের আড়াল হবি না আর...বুঝেছিস?যতদিন রয়েছি এখানে আমরা...একদম সাবধানে থাকবি।এটা কলকাতা নয়।" তখনকার মতো তিতির মায়ের কথায় হু হা করে সায় দিয়ে ব্যাপারটা ম্যানেজ করে নিয়েছিল বটে...কিন্তু ভিতরে ভিতরে ও ছটফট করতে শুরু করেছিল।বৃদ্ধার ওই ভাঙ্গা কুঁড়েঘরের প্রতি কি যে একটা অপ্রতিরোধ্য টান জন্মে গেছে ওর...সে ওর নিজেরই আয়ত্তের বাইরে।ওই পুরো ব্যাপারটা সেদিন  সকলের কাছে চেপে গিয়েছিল তিতির।আজ যখন ফের নিবারণ দাদুর কাছে একই রকম কথা শুনল...তখন বেজায় হাসি পেল ওর।একজন রোগা দুর্বল বৃদ্ধাকে এই এত বড় বড় লোকগুলোর এত ভয়!এরা যদি একবার বৃদ্ধাকে সামনে থেকে দেখত...তাহলে বুঝত...কি বোকার মতো একটা বুড়ি মানুষকে বৃথা এতদিন ধরে সবাই মিলে শুধু ভয় পেয়ে এসেছে। মুখে নিবারণ দাদুকে বলল তিতির..."ঠিক আছে দাদু...তাহ‌লে ওদিকটায় যাব না।আমি তাহলে বাগানের দিকটায় খেলতে যাচ্ছি।সন্ধ্যার আগে চলে আসব।মা কে চিন্তা করতে বারণ করে দিও...কেমন!" নিবারণ দাদু এবার নিশ্চিন্ত হয়ে বলল..."আচ্ছা দিদিভাই।" তিতির দেখল...নিবারণ দাদু যেইদিকে আঙুল দেখিয়ে ওকে খেলতে যাওয়ার জন্য বলছিল...সেই মাঠে ওরই মতো কয়েকজন ছোট ছোট ছেলেমেয়ে খেলাধূলা করছে।এখনে আসার আগে ওর যদিও মনে হয়েছিল...যাচ্ছি তো কয়েকজন বড় মানুষের মাঝখানে।সবকিছু একদম কাঠখোট্টা।আমি তো একদমই একা পড়ে যাব সেইখানে।আমার বয়সী কাউকে তো সেখানে নাও পেতে পারি...জেদ করে যাচ্ছি বটে এখন মায়ের সাথে...সেখানে পৌঁছনোর পর যদি সবকিছু বিরক্তিকর লাগে!তখন! কিন্তু এখন সেই তিতির এখন শুধু চাইছে...একা...নিরালায় নিজের মতো করে চলতে।কারোর যেন নজর না পড়ে ওর ওপর...কেউ যেন ওর সাথে কথা বলতে বা ওকে বিরক্ত করতে না আসে! লোহা যেমন চুম্বককে আকর্ষণ করে...ঠিক তেমনই...ওকেও যেন কোনো এক অমোঘ যাদুশক্তি ক্রমাগত হাতছানি দিয়ে ডেকে চলেছে...আয়...আয়...।ওই হাড় জিরজিরে বৃদ্ধার ভগ্ন কুঁড়েঘরের ভিতরে এমন একটা মোহ...এমন অদ্ভুত একটা নেশা...একটা গন্ধ আছে...যেটার ঘোর ও কোনোমতে কাটিয়ে উঠতে পারছে না।এই ব্যাপারটা ও দ্বিতীয় কোনো মানুষকে বলে বোঝাতে পারবে না। একান্তে...নিজে অনুভব করতে পারবে শুধু।মাকে অনেক বলে কয়ে...শেষ পর্যন্ত ফের রাজি করিয়ে নিয়েছে তিতির...যাতে মা ওকে দুপুর বিকেলের পর ঘর থেকে একট বেরোতে দেন। কোয়ার্টার এরিয়ার বাইরে পা রাখার পর চারপাশটা একবার ভালো করে দেখে নিল তিতির।না এখানে কোনো চেনা লোক নেই।কেউ নেই ওকে কোনোকিছু বলার মতো।নিশ্চিত মনে ও ফের হাঁটা শুরু করল।প্রচন্ড দ্রুতবেগে হাঁটতে হাঁটতে...খুবই অল্প সময়ের মধ্যেই ও পৌঁছে গেল সেই ফাঁকা নির্জন মাঠটিতে...যার আশেপাশেও মানুষে দিনেদুপুরেও যেতে ডরায়।ইতিমধ্যে মায়ের কানেও এসেছে আশেপাশের মধ্যে থাকা একখানি মায়া কুটিরের কথা।সবাই মাকে পইপই করে সাবধান করে দিয়েছে..."খবরদার...মেয়েকে ওদিকটায় যেতে দেবে না একদম।" আর মাও ওকে এইদিকের ত্রিসীমানাতেও ঘেঁষতে বারণ করে দিয়েছেন।তবে সেইসব  কথাগুলো তিতির বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় নেড়ে শুনে নিলেও...কথাগুলো যে আসলেই ও এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বার করে দিয়েছে...সেটা তিনি একেবারেই বুঝতে পারেননি। মাঠে পৌঁছানোর পর প্রায় একছুটে ও গিয়ে থামল বৃদ্ধার সেই কুঁড়েঘরের দরজার সামনে।এত দ্রুতবেগে দৌড়োনোর পর ভীষণ হাঁপাতে শুরু করল তিতির।দেখল...দরজার সামনে বসে রয়েছে বৃদ্ধা।ওকে দেখে বৃদ্ধা বলে উঠল..."কিরে নাতিন...হাঁপিয়ে গেলি?আয়...ঘরের ভিতরে এসে বোস।তোর জন্যই অপেক্ষা করে বসেছিলুম।" এই বলে বৃদ্ধা ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল।ঢুকতে ঢুকতে খোনা গলায় বলল..."এত দূর থেকে ছুটে...হাঁপিয়ে এলি...দ্যাখ আমি তোর জন্য কি রেখে দিয়েছি...এটা গলায় ঢালবি...এত আরাম পাবি...যে মনে হবে এমন সুখ সাতজন্মেও পাসনি।" তিতির বৃদ্ধার পিছন পিছন ঢুকে গেল ঘরের ভিতরে।আর ভিতরে ঢুকেই দেখল একটা ভয়ংকর দৃশ্য।আগের দিন যে ঘরে শুধুমাত্র একটি উল্টানো মৃৎপাত্রের ওপরে রাখা দশটি মোমবাতি ব্যতীত আর একটা জিনিসও ছিল না...সেই ঘর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শুধু ছেঁড়া খুবলানো মাংস...হাড় আর রক্ত।কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার...এই ভয়ংকর দৃশ্য দেখেও এতটুকুও ভয় পেল না তিতির।বিস্ময়...ঘৃণা...কোনোকিছুই আর যেন স্পর্শ করতে পারছে না তিতিরকে।জাগতিক সব বোধবুদ্ধির বাইরে চলে গেছে যেন ও।তিতির ঘরের ভিতরে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ চারপাশে চোখ বুলিয়ে আনমনা দৃষ্টিতে সবকিছু নিরীক্ষণ করল তারপর চলে গেল জানলার কাছে।শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে।বাইরে ততক্ষণে প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে।বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘন ঘন।সারা ঘরজুড়ে কদর্য পৈশাচিকতার নিদর্শন ছড়ানো ছিটানো আর ঘরের ঠিক মধ্যিখানটায় প্রথম দিনের মতো সেই চিৎ করে রাখা মৃৎপাত্রটায় উজ্জ্বল শিখায় যেন গর্জাচ্ছে...মহোল্লাসে ফুলেফেঁপে উঠছে দশটি জ্বলন্ত মোমবাতির শিখা।আর ঘরের ভিতরের মায়াময় আলোআঁধারির নিস্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির এই তান্ডব দেখতে দেখতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে তিতির।হঠাৎ ওর ঘোরটা ভাঙল বৃদ্ধার কন্ঠস্বরে।খোনা গলায় বৃদ্ধা তিতিরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন..."দ্যাখ নাতিন...তোর জন্য আমি কি এনেছি!' তিতির ঘাড় ঘোরালো।দেখল...বৃদ্ধা ওর জন্য নিয়ে এসেছে...একটা বাটিভর্তি টাটকা রক্ত! চারপাশে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে দেখে এবার স্বাতী দেবী মেয়ের জন্য বেজায় চিন্তিত হয়ে পড়লেন... "এই মেয়েটাকে নিয়ে আমি আর পারি না।এইজন্য ওকে এখানে সাথে করে আনতে চাইনি আমি।সারাক্ষণ খালি টো টো করে ঘোরাঘুরি।এখন ঝড়বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেছে...আর ওদিকে মেয়েটা কোথায়...কি অবস্হায় রয়েছে...কিছুই জানি না...।" জয়ন্তবাবু বলে উঠলেন..."আরে বৌদি...তুমি শান্ত হও তো...তিতির এই কোয়ার্টার এরিয়ার বাইরে কোথাও তো আর যাবে না...আর নিবারণ কাকার ঘরে তো ওর হরদম যাওয়া আসা।এখন নিশ্চয়ই ওখানেই আছে।বৃষ্টি থামলে ঠিক ঘরে ফিরে আসবে।" দেবাশীষ বাবু বলে উঠলেন..."জয়ন্ত ঠিকই বলছে স্বাতী।মেয়ে তোমার সেখানেই আছে আমি জানি।নিবারণ কাকা একটু আগে আমায় গরম গরম বেগুনী দিয়ে গেল...কাকিমা ঘরে বানিয়েছে এখন।তো তোমার কি মনে হয়...তোমার মেয়ে এত তাড়াতাড়ি আসবে সেখান থেকে!" ---"সে ঠিক আছে...থাকুক না...তাতে সমস্যা কি!তবে একটা খবর পেলে নিশ্চিন্ত হতাম আর কি...।" আমতা আমতা করে বললেন স্বাতী দেবী। জয়ন্ত বাবু বলে উঠলেন..."ঠিক আছে...বৃষ্টিটা একটু কমুক...আমি গিয়ে নিবারণ কাকার ঘর থেকে ওকে নিয়ে আসব।ঠিক আছে বৌদি?" একটু সংশয় নিয়েও শেষমেষ সম্মতির ঘাড় নাড়লেন স্বাতী দেবী। চারদিকে একেবারে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে।ঘরের সেন্টার টেবিলে রাখা রয়েছে একটা বড়ো থালাভর্তি অনেকগুলি বেগুনী আর ধোঁয়া ওঠা গরম চা।এই বর্ষার সন্ধ্যায় হঠাৎ হঠাৎ করেই কারেন্ট বাবাজি উধাও হয়ে যান।এখনো সেই একই দশা।অন্ধকার ঘরে সেন্টার টেবিলে একখানি মোমবাতি জ্বেলে এখন চা আর বেগুনীর দিকে মনোনিবেশ করলেন দেবাশীষ বাবু,স্বাতী দেবী,জয়ন্ত বাবু আর কালীনাথ বাবু।কালীনাথ বাবু  এই অঞ্চলে কালীনাথ তান্ত্রিক নামেই খ্যাত।এনার স্বভাবসিদ্ধ রঙ্গতামাশা আর গল্পগুজব করার এই ছবিটার সাথে তান্ত্রিক শব্দটাকে অনেকেই মেলাতে পারে না সহজে...কিন্তু ইনি কালোযাদুতে সিদ্ধহস্ত।যৌবনে একজন সিদ্ধপুরুষের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন।যে কোয়ার্টারে এখন দেবাশীষ বাবু...জয়ন্ত বাবুরা থাকেন...তার আশেপাশেই এনার বাস।এমনি মানুষ হিসেবে তিনি বেশ দিলখোলা...একজন সাহায্য পরায়ণ মানুষ।তাঁর এমন স্বভাবের কারণেই তাঁর চারপাশে যে মানুষ থাকে...তার সাথেই ওনার একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।এখানে আসার পর দেবাশীষ বাবু আর জয়ন্ত বাবুও এর ব্যতিক্রম হননি।এখানে আসবার একেবারে প্রথম দিকটায় এনার কাছ থেকে ওঁরা অনেক সাহায্য পেয়েছিলেন।এভাবেই কালীনাথ বাবুর সাথে এখন তাঁদের বেশ ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেছে।মাঝে মাঝেই একসাথে সান্ধ্য আড্ডা চলে সেইরকমই আজ সন্ধ্যায় সেন্টার টেবিলের চারপাশে চেয়ার টেনে গল্প শুরু হওয়ার উদ্যোগ চলছে।এমন সময়ে...কালীনাথ বাবু স্বাতী দেবীকে বললেন..."স্বাতী মা...তোকে আমি যেই কবচটা দিয়েছিলাম...ওটা তোর মেয়ের গলায় বেঁধে দিয়েছিলি তো?" ---"হ্যাঁ বাবা...দিয়েছিলাম।" ---"কবচ?কিসের কবচ?" দেবাশীষ অবাক হয়ে একবার স্বাতী দেবীর দিকে আর একবার কালীনাথ তান্ত্রিকের দিকে তাকালেন। কালীনাথ বাবু এবার বললেন..."স্বাতী মা...তুইও তো আমায় প্রশ্ন করেছিলি...এ কবচ কেন তোর মেয়েকে পরাতে বললাম...তাই না...মেয়েটাকে যখন সাথে করে এখানে এনেই ফেলেছিস...তখন এই কথাগুলো তোদের সবারই জানা দরকার।এখন তোরা সবাই আছিস...এখনই বলছি।শোন তাহলে...। ঢকঢক করে বৃদ্ধার দেওয়া বাটির ভিতরের ওই আঁশটে জিনিসটা তিতির শেষ করে ফেলল এক নিমেষের মধ্যে।তারপর বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল..."তুমি কত ভালো গো দিদুন...আমার তেষ্টা পেয়েছে বুঝে কি সুন্দর একখানা জিনিস খাওয়ালে আমায়!আঃ...এখানকার লোকগুলো তোমায় দেখে মিথ্যেই ভয় পায়।মিছিমিছিই ঘেন্না করে করে সরে থাকে।তুমি একা একা এইখানে পড়ে থাকো...তোমার জন্য আমার ভারি কষ্ট হয়।" ---"তাহলেই বল নাতিন...আমার যে কি কষ্ট...সে তো একমাত্র তুইই বুঝিস...আর কেউ তো আমায় বোঝে না...।তবে এখন তুই এসে গেছিস...আমার আর কোনো চিন্তা রইল না।দাঁতহীন মুখখানি খুলে...বিকট...কদাকার হাসি হাসতে লাগল বুড়ি।বাইরে যেন পৃথিবী এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে ফের গর্জে উঠল আকাশ। কালীনাথ বাবু বলতে শুরু করলেন। সে অনেককাল আগের কথা।তা প্রায় তিনশো বছর আগে তো হবেই...ভিন গাঁ থেকে একজন গুনিন এলেন এ গ্রামে।তিনি তাঁর কালোযাদুর জন্য নিজের গ্রাম থেকে বিতাড়িত হন।কারণ তাঁর কালোযাদুগুলো জগৎ সংসারের জন্য ছিল বড় সর্বনাশী।বড় ক্ষতিকর।উনি এ গাঁয়ে এসে থাকার কদিন পর থেকে এ গ্রামের লোকেরাও ব্যাপারটা বুঝে ফেলতে আরম্ভ করে।গ্রামের সব লোকেরা তাঁকে গ্রাম থেকে তাড়ানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।ওদিকে এই গুনিন তাঁর কর্মদোষে অসংখ্য গ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়ে এসেছেন।তাই সেইবার এ গাঁয়ের মাটি এক্কেবারে আঁকড়ে ধরে পড়ে ছিলেন।তখন গ্রামের সব লোকেরা একজোট হয়ে আলোচনা করতে শুরু করল।গ্রামের মোড়লও ছিলেন সেখানে।এরপর তারা সদলবলে সেই গুনীনের কাছে গিয়ে তাঁকে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলল আর তার সাথে যারপরনাই অপমানও করল।ওদের তখন খেয়াল ছিল না...যে যাকে সবাই মিলে অপমান করছে...সে কালোযাদুতে সিদ্ধহস্ত।তাঁর অসাধ্য কিছুই নেই।এর পাল্টা প্রতিঘাত খুব ভয়ংকরভাবেই আসতে পারো।আর হলও তাই।ওই গুনিন গ্রামের  সকল লোকের সম্মিলিত অপমানে যারপরনাই ক্রোধান্বিত হলেন।আর অভিশাপ দিলেন...এই গ্রাম থেকে তোরা আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলি তো...আমি তোদের অভিশাপ দিচ্ছি...এই গ্রাম মড়কে ছেয়ে যাবে একদিন।রাতচরা প্রাণী ছাড়া একটা প্রাণীও বাঁচবে না।শ্মশান হয়ে যাবে সব।সব শ্মশান হয়ে যাবে।" এমন হুংকার দিতে দিতে সেই মূহুর্তেই সে স্হান তিনি পরিত্যাগ করেছিলেন।আর এরপরই সবাই দেখেছিল...যে স্হানে বসে তিনি গ্রামবাসীকে ওই অভিশাপ দেন...সেই স্হানটি আসলে একটি সদ্যমৃতা খ্রিস্টান বৃদ্ধা মহিলার কবর।তাঁর দেহ থেকে বার করে নেওয়া হয়েছে তাঁর হৃৎপিন্ডটা।ওই দৃশ্য দেখে তো সকলেরই হৃৎপিন্ড খুলে বেরিয়ে আসবার উপক্রম হয়েছিল।কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার...ওইদিনের পর থেকে...ওই বৃদ্ধা জীবিত মানুষের মতো ঘোরাফেরা করতে শুরু করে দেয়।পরে ওই গুনিনের ফেলে যাওয়া কিছু পুঁথির অংশ থেকে জানা যায়...যে ওই গুনিন তন্ত্রসাধনার দ্বারা...এক বৃদ্ধা মহিলার মৃতদেহে নতুন করে প্রাণসঞ্চার করে এই গ্রামে জাগিয়ে তুলেছে এক পিশাচিনীকে।ওই পিশাচিনীর দশটি আঙুল যেদিন সক্রিয় হয়ে উঠবে...সেদিন গোটা গ্রামে শুরু হয়ে যাবে নারকীয় হত্যালীলা।ওই পিশাচিনীর সর্বগ্রাসী ক্ষুধার অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে যেতে শ্মশানভূমিতে পরিণত হবে গোটা গ্রাম।শুধুমাত্র রাতচরা নিশাচর প্রাণীরাই শুধুমাত্র ওই পিশাচের খাদ্য হবে না।তাই গোটা গ্রামজুড়ে যখন শুধুমাত্র মৃত মানুষ আর পশুপাখির দেহাংশ...রক্ত,হাড় আর মাংস পড়ে থাকবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে...তখন সেই প্রাণের স্পন্দনহীন ভূমির ওপর সৃষ্ট  সে নরকে থাকবে শুধুই নিশাচর প্রাণীদের ডাক আর তাদের বিচরণ। ওই পিশাচিনীর কাছে যদি চোদ্দ বছরের নীচে কোনো শিশু সম্পূর্ণভাবে স্বেচ্ছায় যায়...তাহলে জেগে উঠবে তার একটি করে আঙুল।আর ওই শিশুটি নিয়তির ফেরে পাঁচদিনের মাথায় ওই পিশাচিনীর খাদ্য হবে।ওই পিশাচিনীকে মারা কাটা...কোনোকিছুই করা সম্ভব নয়।কারণ সে প্রেতলোকের বাসিন্দা।ওই গুনিন তো সে গ্রাম ছেড়ে বিদায় নিয়েছিলেন।কিন্তু ওই পিশাচিনী সেই থেকে রয়ে গিয়েছিল এ গ্রামেই।একটা কুটির বেঁধে সেখানেই সে থাকে একা একা।ওর ধারপাশ মাড়ায় না কেউ।প্রথম প্রথম ওই পিশাচিনীটা ছোট বাচ্চাদের ভুলিয়ে নিয়ে আসত নিজের কাছে।আর তার কদিন পরে পরেই পাওয়া যেত বাচ্চাটার আধখাওয়া মৃতদেহ।সেই থেকে এই গ্রামের সর্বত্রই এই সাবধানবাণী জারি রয়েছে।পিশাচিনী ডাইনিটার ওই কুঠি র আশেপাশেও যেন কোনো ছোট বাচ্চা না যায়। এখনো এই সাবধানবাণী মেনে চলে এখানকার প্রতিটি গ্রামবাসী।কারণ তারা জানে...যে এই সাবধানতা অবলম্বন করার কারণবশতই বহু বছর যাবৎ কোনো অঘটন ঘটেনি।কিন্তু এই সাবধানতা অবলম্বনে যদি কিছুমাত্র ত্রুটি হয়ে যায়... তাহলে গোটা গ্রামজুড়ে সেইদিন থেকেই আরম্ভ হয়ে যাবে মৃত্যুযজ্ঞ।তোমরা এখানে নতুন এসেছো।সঙ্গে ছোট একটা বাচ্চা রয়েছে।সে বোধ করি চোদ্দ পেরোয়নি এখনো? স্বাতীদেবী বলে উঠলেন..."নাঃ...এখন ওর বয়স নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো দরকার নেই।মেয়েটা এতক্ষণ ধরে ফিরছে না...কোথায় যে গেল...!নিবারণদা...ও নিবারণদা...!" স্বাতীদেবী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন হনহন করে নিবারণদা র ঘরের দিকে।স্বাতীদেবী এইসব কুসংস্কার টুসংস্কার মানেন না কোনোকালেই।কাজেই এখন তিনি শুধু ভাবছেন..."মেয়েটাকে এইবার হাতে পেলে এমন শাসন করবেন...যে আর টৈ টৈ করে একা একা এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানোর নাম পর্যন্ত মুখে আনবে না। কালিনাথ বাবু এবার চোখ নীচু করে চাপা স্বরে দেবাশিষ বাবুকে বলে উঠলেন..."হ্যাঁ রে দেবু...তোর মেয়েটা সত্যিই নিবারণের ঘরেই গেছে তো?ওকে একা ছেড়ে রাখছিস...তুই জানিস না...এ জায়গা আর সব জায়গার মতো নয়।আমি তো তোকে সাবধান করার জন্যই এলাম আজকে...তুই ওঠ গিয়ে...মেয়েটাকে ঘরে নিয়ে আয়...আর ওকে ভালো করে বুঝিয়ে রাখ...যে জায়গায় কোনো মানুষের আনাগোনা নেই...সে জায়গায় যেন খবরদার না যায়!" হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে হনহন করে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়লেন স্বাতী দেবী। ভ্রুকুটি করে কোমরে হাত দিয়ে মা কালির ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে দেবাশীষ বাবুর উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলেন..."বলি...কেমন বাপ গো তুমি?মেয়ের জন্য কোনো চিন্তাটিন্তার বালাই নেই...সন্ধ্যাবেলায় জমিয়ে সব আষাঢ়ে গপ্পো শুনতে বসে গিয়েছ!যাও...চারপাশটা ভালো করে খুঁজতে শুরু করো গিয়ে...তোমার মেয়ে নিবারণদার ঘরে নেই।" স্বাতীদেবীর মুখ থেকে কথাটা শোনার সাথে সাথে হায় হায় করে উঠলেন কালিনাথ বাবু।"সর্বনাশ!যে আশঙ্কা করেছিলাম...সেইটাই তাহলে সত্যি হল!" ---"আপনি দয়া করে এইসব ফালতু গল্প বন্ধ করুন তো দেখি...এটা গপ্পো ফাঁদার সময় নয়...মেয়েটাকে খুঁজে বার করতে হবে।" দেবাশীষ বাবু ঘড়ির দিকে তাকালেন।ঘড়ির কাঁটা প্রায় নটা ছুঁইছুঁই।গল্প শুনতে শুনতে যে এতটা সময় পেরিয়ে গেছে...এটা তাঁর মাথাতেই আসেনি।তিনি প্রচন্ড চিন্তিত হয়ে এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরে বেরোনোর উদ্যোগ করতে শুরু করলেন।জয়ন্ত বাবু বলে উঠলেন..."আরে ভাই...বৃষ্টি তো এখনো থামেনি...ছাতাটা নিয়ে যাও! এরপর জয়ন্ত বাবু আর কালিনাথ বাবুও দেবাশীষ বাবুর পিছনে পিছনে এগোতে শুরু করলেন।জয়ন্ত বাবু চিৎকার করে বললেন..."ভাই দাঁড়াও...আমরাও তোমার সঙ্গে বেরিয়ে খুঁজব তিতিরকে। ক্রমে রাত গভীর হতে শুরু করল।ঘড়ির কাঁটা এগোতে এগোতে এখন প্রায় রাত একটা ছুঁইছুঁই।না।তিতিরের কোনো খোঁজই মেলেনি তখনো।স্বাতীদেবী এবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন।কাঁদতে কাঁদতে বারবার বলছেন..."সন্ধ্যাতেই আমি বারবার বলছিলাম তিতির ঘরে ফেরেনি ওর খোঁজ করা দরকার।তখন তো গল্পে বুঁদ হয়ে ছিলে।এখন মেয়েটাকে যদি খুঁজে না পাই...আমি কিন্তু তোমায় ছেড়ে দেব না...কিছুতেই ছেড়ে দেব না। স্বাতী দেবীকে সামলানোটাই রীতিমতো সমস্যা হয়ে পড়েছে এখন।তাঁকে কোনোমতে বলে বুঝিয়ে শান্ত রাখার চেষ্টা একদিকে...আর অপরদিকে তন্নতন্ন করে তিতিরকে খোঁজার চেষ্টা জারি রয়েছে।দুজন গেছে থানায় খবর দিতে।চারপাশের পাহাড়ি জঙ্গলের ভিতরে টর্চ জ্বেলে সকলেই এদিক সেদিক খোঁজাখুঁজি জারি রেখেছে...ঠিক এমন সময়ে জয়ন্ত বাবুর একটা ভয়াবহ চিৎকারে সকলে মিলে চলে এল সেখানে।জয়ন্ত বাবু যেদিকে তাঁর মোবাইলের টর্চলাইটটা নির্দেশ করে রয়েছেন সেদিকে তাকিয়ে ওঁদের সকলেরই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল।জঙ্গলের আগাছার ভিতরে অচৈতন্য অবস্হায় পড়ে রয়েছে তিতির।আর ওর দুইহাতে মুষ্ঠিবদ্ধ করে ধরা রয়েছে সদ্য কোনো মানবদেহ হতে উৎপাটিত হওয়া একটি লাল হৃৎপিন্ড।হৃৎপিন্ডটা এখনো ধকধক করছে।এই অমানুষিক ভয়াবহ দৃশ্য নিতে পারলেন না স্বাতীদেবী।সংজ্ঞা হারিয়ে কাটা কলাগাছের মতো নেতিয়ে পড়লেন স্বাতীদেবী।দেবাশীষ বাবু আর জয়ন্ত বাবু নিশ্চুপ কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন।চোখে যা দেখছেন এখন... সেটা কল্পনা না বাস্তব...সেটা এখনো ঠাহর করে উঠতে পারছেন না ওঁরা।ক্রমে ওঁরা বুঝতে পারলেন...তিতির পুরোপুরি অচৈতন্য অবস্হায় নেই।ও একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে এখন।আর সমানে বিড়বিড় করে কি যেন বলে চলেছে।কালিনাথ বাবু তিতিরের মুখের কাছটায় কান পাতলেন।শুনতে পেলেন...তিতির আস্তে আস্তে বিড়বিড় করে বলছে... "জাগল দশটি শিখা... হাতের করে জ্যান্ত আঙুল... তারে আর যাবে না রোখা..." কালিনাথ বাবু এই ছড়াখানি শুনেছেন তাঁর পূর্বপুরুষদের মুখে।গুনিনের ফেলে যাওয়া পুঁথির যে অংশবিশেষ পাওয়া গিয়েছিল...সেখানেই ছিল এই ছড়াটা।এই ছড়ার মানে তিনি মর্মে মর্মে বুঝেছেন।পিশাচিনীর হাতের দশটি আঙুল এইবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে।ওর হত্যালীলা এইবার শুরু হল বলে!এই ছড়া যদি কোনোদিন কোনো বাচ্চার মুখে শুনতে পাওয়া যায়...তবে সেই মূহুর্ত থেকেই এই গ্রামজুড়ে শুরু হয়ে যাবে হত্যালীলার নৃশংস তান্ডব।এই গোটা গ্রাম শ্মশানভূমি হয়ে উঠতে আর খুব বেশি বাকি নেই।তিতিরের হাতের মুঠোয় ধরা রয়েছে যে হৃৎপিন্ডটি...সেটির মৃত্যু যে তিনশো বছর আগেই হয়ে গিয়েছিল...এটা তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন।এই হৃৎপিন্ড আর কারোর নয়।এই গ্রাম হতে তাঁকে বিতাড়িত করতে চাওয়া মানুষগুলোর প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে এই গ্রামকে শ্মশানপুরি করে তোলার জন্য একজন খ্রীষ্টান মহিলাকে হাতে পেয়ে...তাঁকে  মেরে...তাঁর হৃৎপিন্ড খুলে বার করে নিয়ে...তারপর তাঁর শরীরে ওই গুনিন জাগিয়ে তুলেছিল পিশাচ সত্ত্বে।সেই হৃৎপিন্ড আর পুনরায় উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে।এই হৃৎপিন্ডই যে ওই পিশাচিনীর প্রাণভোমরা...এটা বুঝতে তাঁর বাকি নেই।কালিনাথ বাবু বলে উঠলেন..."দেবু...জয়ন্ত...এখন হাত পা গুটিয়ে বসে থাকার সময় নয়।সর্বনাশের ঘন্টাধ্বনি শুরু হয়ে গেছে।সারা গ্রাম ছারখার হয়ে যাওয়ার আগে এক্ষুনি তোমরা তিতিরের হাত থেকে ওই হৃৎপিন্ডটা ছাড়ানোর ব্যবস্হা করো।" এমন পরিস্থিতির কথা কোনোদিন দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি দেবাশীষ বাবু বা জয়ন্ত বাবু।কিন্তু এখন একমাত্র  কালিনাথ বাবু ই যে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার রাস্তা দেখাতে পারেন...এটা ওরা দুজনেই বুঝতে পারছে। কালিনাথ বাবু নিবারণের উদ্দেশ্যে বলে  উঠলেন..."পিশাচী জেগে উঠেছে।নিবারণ...তুমি আর তোমার স্ত্রী দুজনে মিলে বৌদিমনিকে ঘরে নিয়ে যাও।তাঁর দেখভাল কোরো।দেবু আর জয়ন্ত...তোমরা হৃৎপিন্ডটা তিতিরের হাত থেকে নিয়ে রাখো...আমি যজ্ঞের ব্যবস্হা করি গিয়ে।" এই বলে তিনি হনহন করে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। দেবাশীষ বাবু আর জয়ন্ত বাবু দুজনের প্রাণপণ চেষ্টা অবশেষে ব্যর্থ হল।ওরা কিছুতেই তিতিরের হাত থেকে হৃৎপিন্ডটা ছাড়িয়ে আনতে পারেননি।উল্টে তিতির ওদেরকেই আঁচড়ে কামড়ে একেবারে রক্তাক্ত করে দিয়েছে।তিতিরের ভিতরে তখন জেগে উঠেছিল একটা বিকৃত পাশবিক সত্ত্বা।কিন্তু এখন তিতির পুরোপুরি নেতিয়ে পড়েছে ওর শরীরটা অল্প সময়ের ভিতরেই পুরো ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে।এখন ওকে শুইয়ে রাখা হয়েছে একটি যজ্ঞকুণ্ডের সামনে।আর তার উল্টোদিকে বসে রয়েছেন কালিনাথ তান্ত্রিক।তাঁর পরনে এখন গেরুয়া বসন।গলায় রুদ্রাক্ষের মালা।এখনো মুষলধারে হয়ে চলেছে ঝড়বৃষ্টি।এ ঝড় যেন কোনো সাধারণ ঝড় নয়।একটা কোনো প্রলয়ের ইঙ্গিত!" মন্দিরের প্রাঙ্গনে কালিনাথ তান্ত্রিক যজ্ঞ শুরু করে দিয়েছেন।একমনে তিনি মন্ত্র পড়ে চলেছেন আর যজ্ঞকুণ্ডের অপরপ্রান্তে শায়িত তিতিরের সংজ্ঞাহীন দেহের ওপরে ছিটিয়ে দিচ্ছেন মন্ত্রঃপূত কিছু অস্হি র গুঁড়ো।আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চলছে মন্ত্রোচ্চারণ।যজ্ঞকুণ্ডের চারপাশে ওড়াউড়ি করছে অসংখ্য বাদুড়।আর চারপাশে শুরু হয়েছে বিকৃত অপার্থিব কন্ঠের এক ভয়াল আর্তনাদ আর ক্রন্দনধ্বনি।যেন লেলিহান শিখার অগ্নিকুন্ডে ফেলে দগ্ধ করা হচ্ছে কোনো বিষাক্ত আত্মাকে।দেবাশীষ বাবু আর জয়ন্ত বাবু অদূরে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছেন।দেবাশীষ বাবু এখন শুধু ভাবছেন...আমার মেয়েটা শেষ পর্যন্ত বাঁচবে তো! ক্রমে ভোর হয়ে এল।যজ্ঞ শেষ হয়ে এসেছে।তিতিরের হাতে ধরা ওই হৃৎপিন্ডটা ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে এখন পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে গেছে।এখন ওটার আর কোনো অস্তিত্ব নেই।ধীরে ধীরে চোখ মেলল তিতির।আর খুলেই দেবাশীষ বাবুকে দেখতে পেয়ে অস্ফুটে বলে উঠল..."বাবা...আমি এখানে শুয়ে আছি কেন?আর মা কোথায়? দেবাশীষ বাবু মেয়ের কাছে গিয়ে ওকে শান্ত করতে যাবেন...এমন সময়ে হঠাৎ স্বাতী দেবী সেখানে ছুটে এসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।তারপর দেবাশীষ বাবুর উদ্দেশ্যে বললেন..."আমার মেয়ে এখানে আর এক মূহুর্তও থাকবে না।তুমি এক্ষুনি আমাদের ফেরার টিকিটের ব্যবস্হা করো।আমরা আজই রওনা দেব।" ব্যাগপত্র গোছগাছ করে বেরোনোর সময়ে স্বাতী দেবী কালিনাথ বাবুকে হাতজোড় করে বললেন..."আমি  আপনাকে রাগের মাথায় কিছু কটু কথা বলে ফেলেছি।অথচ আজ আপনিই নিজের প্রাণের পরোয়া না করে আমার মেয়েটাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিলেন।আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।পারলে আমায় ক্ষমা করে দেবেন।" "ধুর পাগলি...মেয়ের কথায় বাপ কিছু মনে করে নাকি!যা মা...সাবধানে রওনা দিস।অবশ্য এখন আর কোনো ভয় নেই।"মৃদু হেসে বললেন কালিনাথ তান্ত্রিক। দিন কয়েকের ছুটি নিয়ে দেবাশীষ বাবুও এখন বাড়ি যাচ্ছেন।বেরোনোর মুখে নিবারণ এসে বলতে শুরু করল..."কি সব্বোনেশে কান্ড বাবুরা...সকালের পর অব্দি জানতুম...শুধু আমাদের এখানেই চারপাশে এত এত মাংস খোবলানো পশুপাখির মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে।কিন্তু এখন তো কানে আসছে...কাল সন্ধ্যার পর এই গোটা গ্রামজুড়ে হত্যার তান্ডব চলেছিল।দুই একজন মানুষকেও নাকি ওই একইভাবে মাংস খুবলে খেয়ে গেছে কোনো পিশাচ!হে রাধামাধব...এ কি ভয়ঙ্কর দিনই না দেখতে হল...!" জয়ন্ত বাবু বললেন...ওই ডাইনি তার মানে জেগে উঠেই সারা গ্রাম জুড়ে শুরু করে দিয়েছিল ওর তান্ডব।উফ...আমি ভাবতে পারছি না...কালিনাথ বাবু ওই সময়েই যজ্ঞ না শুরু করলে এই গোটা গ্রামটা শ্মশানে পরিণত হতে খুব বেশি সময় নিত না।" ---"হ্যাঁ...যা বলেছ জয়ন্ত।আর এখন তো ওই ডাইনির কুঠিটার সামনে ওই বুড়ির মৃতদেহ পাওয়া গেছে।মৃতদেহটার বুকের কাছটায় একটা বড় গর্ত ছিল।ওর ভিতরের ওই হৃৎপিন্ডটাই যে তিনশো বছর ধরে মাটির তলায় থাকার পর গতকাল প্রাণ ফিরে পেয়ে তিতিরের হাতে কিরকম ধকধক করছিল!দৃশ্যটা ভেবেই তো এখনো আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।" দেবাশীষ বাবু বললেন। নিবারণ বলে উঠল..."ওই দেহ গ্রামবাসী রা কবর দিয়ে দিয়েছে।এতদিন ধরে ওই খ্রিস্টাব্দে মহিলার শরীরে ভর করেছিল একটা পিশাচী।আজ ওই পিশাচীর নিধন হয়ে যাওয়ার পর দেহটার যাহোক একটা গতি তো হল...মানুষটার আত্মা এতদিনে শান্তি পেল। ---কিন্তু কালিনাথ বাবু...একটা প্রশ্ন আমার মনে কেমন খচখচ করছে।আপনি যজ্ঞের সময়ে যে মন্ত্রঃপূত হাড়ের গুঁড়োটা তিতিরের শরীরে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন...ওতে এমন কি ছিল যে ওই দুষ্ট আত্মা যন্ত্রনার আর্তনাদ আর ক্রন্দনধ্বনিতে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠেছিল? মৃদু হেসে কালিনাথ তান্ত্রিক বললেন..."তোমাদের তিনশো বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই কাহিনীর সবটা এখনো বলিনি।এখনো কিছু বাকি আছে।ওই গুনিন যেদিন এই গ্রাম থেকে ভিনগাঁয়ে পা দেয়...ওইদিনই সেই গ্রামের লোকেরা ওকে সবাই মিলে হঠাৎ একত্রিত হয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে।ওই গুনিন যে আগে থেকে কোনো প্রস্তুতি নিয়ে রাখবে...সেরকম কোনো সুযোগই পায়নি।ওই সময়ে আমার এক পূর্বপুরুষ ওই গ্রামে গিয়েছিলেন কোনো এক কাজে।তিনি ওই সময়ে ওই গুনিনের মৃতদেহটা সংগ্রহ করে ওর দেহের অস্হি সংগ্রহ করে...সেটাকে গুঁড়ো করে তাতে মন্ত্র পড়ে রেখে দিয়েছিলেন নিজের কাছে...এবং পুরুষানুক্রমে তা হাতবদল হয়ে আমার হাতে আসে।তিনি জানতেন...যার হাত দিয়ে এই সর্বনাশের বীজ প্রোথিত হয়েছে সেই বিষকে ক্ষয় করতে...তারই শরীরের কোনো অংশ ওষুধ হিসেবে কাজ করবে।তিনি বলে গিয়েছিলেন...পিশাচী যদি কোনোদিন জেগে ওঠে...তবে এই ওষুধই একমাত্র পারবে...তাকে বিনাশ।করতে।উনি একজন বড়ো তান্ত্রিক এবং একজন সিদ্ধপুরুষ ছিলেন।" ---"কই গো...চলে এসো...স্টেশনে যাওয়ার গাড়ি চলে এসেছে...।" স্বাতীদেবীর ডাক শুনে হঠাৎ যেন ঘোর কাটল দেবাশীষ বাবুর।তারপর বললেন..."চলি তাহলে...ট্রেনটা আবার বেশিক্ষণ স্টেশনে দাঁড়াবে না।" ---"যাই নয়...বলো আসি...বুঝলে ভায়া...এখন আর কোনো ভয় নেই এ গ্রামে।বৌদিকে বুঝিয়ে বলিস।আর পূজোর ছুটিতে এখানে চলে আসবি।খুব আনন্দ করব।" জয়ন্ত বাবু বলে উঠলেন। দেবাশীষ বাবু হেসে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন।তারপর কালিনাথ বাবু আর জয়ন্ত কে বিদায় জানিয়ে উঠে পড়লেন গাড়িতে।এখন সূর্য অস্ত যাওয়ার সময়।গোধূলির রাঙা আলোয় চারপাশটা বড়ো মনোরম লাগছে।বহু বছর পর আজ গ্রামের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বইছে একটা নিশ্চিন্তির আশ্বাস। গাড়িতে উঠে পড়লেন দেবাশীষ বাবু।জয়ন্ত বাবু বলে উঠলেন..."পৌঁছে ফোন করে দিও কেমন!" ---"একদম...তুমি এ কদিন নিজের খেয়াল রেখো কেমন!" গাড়ি স্টার্ট নিল।তারপর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। সমাপ্ত   


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror