মোহভঙ্গ
মোহভঙ্গ
মোহভঙ্গ অনেকক্ষণ ধরে লাগাতার সেবাশুশ্রুষার আর সেবাযত্নের পরে অবশেষে চোখ মেলে তাকাল বছর বারোর মেয়েটি।চোখদুটি মেলতে থাকল ধীরে ধীরে।চোখের দৃষ্টি তখনো ঝাপসা ওর।কিন্তু তাতেই ও এটা বুঝতে পারল...ওর চারপাশে এখন অনেক মানুষের ভীড়।যে মখমলে গদিযুক্ত বিছানায় শুয়ে রয়েছে ও...এমন বিছানার পায়ের কাছে ঠাঁই পাওয়াটাও যে ওর পক্ষে বিশাল ভাগ্যের ব্যাপার...এটা ও ভালোভাবেই অনুভব করল।আস্তে আস্তে করে ওর চোখের দৃষ্টি স্পষ্ট হতে থাকল।আর তাতে ও এতটুকু বুঝতে পারল...যে ঘরের ভিতরে ও এখন শুয়ে রয়েছে...সেই ঘর কোনো রাজপ্রাসাদের চাইতে কম নয়।এমন ঘরে...এমন বিছানায় ওর যে ইহজীবনে কোনোদিন ঠাঁই হওয়া সম্ভব...এমন চিন্তা শুধু ওর স্বপ্নে এসে বারে বারে ওকে কাঁদিয়ে গেছে।ভালো করে চোখটা কচলে নিয়ে এবার ভালোভাবে চারদিকে তাকিয়ে দেখল ও।ওর চারপাশে অনেক মানুষের ভীড়।সবাই ভীষণ উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে।এরা সবাই যে ওর চোখ মেলবারই অপেক্ষা করছিল...এটা ও বুঝতে পারল।এমনিতে যেরকম মানুষজনকে বরাবর সামনাসামনি দেখে এবং যাদের সঙ্গে থেকে ও অভ্যস্ত...তাদের সাথে যে এদের বেশভুষা...চালচলনের আকাশ পাতাল পার্থক্য...এটা স্পষ্ট বুঝতে পারল ও।যেমন মানুষজনের পাশ দিয়ে হাঁটবার চিন্তা আসাটাই যেখানে ওর কাছে আকাশ ছুঁতে চাওয়ার মতো ব্যাপার...তেমন মানুষজনের মাঝখানে কোমল মখমলে গদিওয়ালা বিছানায় সকলের মধ্যমণি হয়ে ওইভাবে শুয়ে ওর ক্রমশই মনে হতে থাকল...ও নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে।কিন্তু ওর ভুল ভাঙতে একেবারেই বেশি সময় গেল না।ওর জ্ঞান ফিরে এসেছে দেখে গলায় স্টেথোস্কোপ ঝোলানো এক ধোপদুরস্ত পোশাক পরিহিত ভদ্রলোক একটা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ হাতে নিয়ে ওর পাশে বসেই ওর ডানহাতটা শক্ত করে ধরে তার মাঝ বরাবর সেটা বসিয়ে দিলেন।ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠল ও।আর তার সাথে এটা বুঝতে পারল...চারপাশে ও যা দেখছে...যা অনুভব করছে...তার কোনোটাই স্বপ্ন নয়।সবটাই বাস্তব।এইমাত্র যে ভদ্রলোক ওকে ইঞ্জেকশন দিলেন...তিনি যে ডাক্তার...এটাও আর ওর বোঝবার বাকি রইল না।হঠাৎ ওর সমস্তটা কেমন জানি গুলিয়ে যেতে থাকল।বাবা আর মায়ের সঙ্গে ট্রেনে করে তো ও যাচ্ছিল মামার বাড়ি।এখন গভীর ঘুমের পর চোখ মেলে যা সব ও চাক্ষুষ করছে...তার ল্যাজা মুড়ো কোনোটাই মেলাতে পারছে না ও।বিছানা থেকে ওঠবার চেষ্টা করতে যেতেই ওর ঠিক মাথার পাশেই বসে থাকা ভদ্রমহিলা একেবারে হাঁ হাঁ করে উঠলেন।তিনি দুইহাত দিয়ে ওকে সস্নেহে...পরম ভালোবাসা দিয়ে আঁকড়ে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিতে দিতে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন..."আরে আরে করছিস কি!এত ছটফটে হয়েছিস তুই...তোকে নিয়ে আর পারি না আমি...!মা কে চিন্তায় ফেলতে এত ভালো লাগে তোর!জেদ করে বেরিয়ে কি হাল নিয়ে ফিরলি!ডাক্তার বলে দিয়েছেন...এক সপ্তাহ পুরো বেডরেস্ট।বুঝলি!" এই বলে সযত্নে ওকে ফের বিছানায় শুইয়ে দিলেন ভদ্রমহিলা।এবার তো ও রীতিমতো আকাশ থেকে পড়ল।গা ভর্তি সোনার গহনায় সুসজ্জিতা...দামী শাড়ি পরা...আভিজাত্যের আড়ম্বরে সর্বাঙ্গে ধারণ করা এই ভদ্রমহিলাকে তো জীবনে ও প্রথম দেখছে।আর মা বলতে তো ভাঙ্গা টিনের চালের ঘরের ভিতরে শতছিন্ন শাড়ি পরা...সর্বাঙ্গ হতে গোবর ঘুঁটের গন্ধ ভেসে আসা সেই একুশ ঘন্টা হাড়ভাঙা খাটুনির ঘামে ঘর্মাক্ত হাড় জিরজিরে মানুষটির মুখটাই ও চেনে এবং জানে।এখন ওর এমন অবস্থাতে তাঁর কেন দেখা নেই!এই প্রাসাদতুল্য ঘরের ভিতরে রানির মতো খাতির আর যত্নের মধ্যে এইভাবে কেন ও শুয়ে রয়েছে...আর এই ভদ্রমহিলা কেন নিজের সন্তান বলে দুহাতে ওকে আঁকড়ে ধরে রয়েছেন...এসবের কোনো কূলকিনারাই পাচ্ছে না ও।মাথাটায় কেমন যেন ঝিম ধরতে শুরু করল।আর বেশি কিছু ভাবতে পারল না ও।ফের তলিয়ে গেল গাঢ় ঘুমে। রাত প্রায় দুটো।গোটা শহর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।চারপাশে একেবারে মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে।আস্তে আস্তে নিজের নামটা স্পষ্টভাবে মনে করতে পারল হিয়া।ধীরে ধীরে ওর স্মৃতিপটে ভেসে উঠতে থাকল এমন কিছু জীবন্ত ছবি যেগুলি মনে ভেসে উঠতেই ওর ভিতরটা যেন কেঁদে উঠল।হ্যাঁ...এই তো ভেসে উঠেছে ওর নিজের মায়ের স্নিগ্ধ হাসিমাখা মুখখানি...।মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরম তৃপ্তির নিদ্রাযাপনের দৃশ্যটা মনে করেই ওর দুচোখ বেয়ে জল ঝরতে লাগল।ওর মনে পড়তে লাগল...জ্বরজারির সময়ে সারারাত দুচোখের পাতা এক না করে মা ওর সেবা করে যেতেন...।নিজের হাতে ওর সব পছন্দের খাবার তৈরি করে হাতে করে খাইয়ে দিতেন...।এখন ওর শরীর এত খারাপ।কই...কোথায় না কোথায়...কোন এক অচেনা বাড়ির ভিতরে এসে পড়ে রয়েছে ও...কই মায়ের তো কোনো চিহ্নমাত্র কাছাকাছি কোথাও নেই...।ধড়ফড় করে উঠে বসল ও।আর সাথে সাথেই ও দেখল...যে নরম মখমলে গদিওয়ালা দামি বিছানায় ও শুয়ে রয়েছে...সেখানে ও একা শুয়ে নেই।ওর পাশে শুয়ে রয়েছেন এক মাঝবয়সী মহিলা।বাইরে মুষলধারে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে আর মাঝেমধ্যেই সশব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।কাঁচের জানলা ভেদ করে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোর যে ঝলকানি আসছে...তাতেই সেই মহিলার মুখটা প্রায় স্পষ্টই দেখতে পেল হিয়া।হ্যাঁ।এ তো সেই মহিলা...যিনি আজ সকালে ওকে নিজের মেয়ে বলে বুকে জড়িয়ে দুহাতে ওকে আঁকড়ে পড়েছিলেন।সাথে সাথে ওর মনে ভেসে উঠল আজকের দিনের বেলার টুকরো টুকরো কিছু প্রতিচ্ছবি।ও কোনোমতে দুটি ছবিকে মেলাতে পারছে না।যে ভাঙ্গা টিনের চালের ঘরে ও জন্মইস্তক কাটিয়ে এসেছে...সেখানে তো হাজারো দারিদ্র্য আর অভাবের মাঝেও ও নিজের বাবা...মা আর বৃদ্ধ দাদু ঠাকুরমার মাঝে যে যত্ন আর আদর পেত... বিলাসব্যসনের মোড়কে আবৃত এই বাড়ির দেওয়ালের প্রতিটি ইঁট যেন ওকে বলছে...।এ যেন ওরই জায়গা।ওর নিজের ঘর।আর হবে নাই বা কেন...।সকাল থেকে সম্পূর্ণরূপে অচেনা এবং অজানা এই মানুষগুলি ওকে যে আদর...যে যত্ন দিয়ে ওর খেয়াল রেখেছে...ওর সেবা করে গিয়েছে...তাতে যেন এই বাড়ির ভিতরে আপনা থেকেই নিজের একটা শক্ত শিকড় ও অনুভব করতে শুরু করেছে।এরা সকলে এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে হিসেবেই যে ওকে আদর ভালোবাসা দিয়ে সেবাযত্ন করে গিয়েছে...সেটা ও ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে।আর বিশেষ করে...ওই যে যিনি...ওর সাথে...ওর পাশে...গভীর ঘুমের আচ্ছন্ন হয়ে আছেন...তাঁর মুখখানি আরেকবার ভালো করে দেখল হিয়া।এই ভদ্রমহিলাকে ও আজকেই প্রথম দেখছে।কিন্তু ওনার ভিতরে যে মায়ের মমতা দেখেছে...তার সাথে যে ওর নিজের মায়ের স্নেহ ভালোবাসার যে কোনো পার্থক্যই নেই...এটাও ও ভালোভাবে অনুভব করতে পারছে।এতদিন যে মায়ের স্নেহছায়ায় বেড়ে উঠেছে ও...তিনি ছিলেন জীর্ণ শাড়ি পরিহিতা...অভাব দারিদ্র্যের যন্ত্রনায় ক্লিষ্ট একজন হাড় জিরজিরে মহিলা।এমনকি অভাব অনটনের সাথে নিত্য ওঠাবসা করে চলা ওর চারপাশের মানুষজনেরা এমন বাড়ির ভিতরে ঢোকবার সাহসটুকুও যে পায় না...এটাও ও বোঝে ভালোভাবেই।একটু বোঝবাদ বয়স হওয়ার পর থেকেই ওর মনের ভিতরে একটা ছবি ফুটে উঠত...যেখানে কোনো বিলাসবহুল বাড়ির ভিতরে কোনো এক সব পেয়েছির দেশে ও সারাজীবনের রাজত্ব পেয়ে গিয়েছে।যেখানকার অভিধানে অভাব বলে কোনো শব্দ নেই।নেই রং...বাহার...জৌলুস আর প্রাচুর্যের কোনো কমতি।ও সেখানে বিচরণ করছে বিনা বাধায়।ঠিক যেন রানির মতো।হ্যাঁ...কোনোদিন খালিপেটে সে ঘুমোতে যায়নি...অথবা অন্য কারোর ফেলে দেওয়া ছেঁড়া জামা পরতে হয়নি...প্রচন্ড শীতে ছেঁড়া কাঁথা জড়িয়ে কাঁপতে হয়নি সারারাত।কিন্তু ওর শুধুই মনে হত...যদি হাত বাড়ালেই যেকোনো সুখ সাধ হাতের মুঠোয় ধরার আনন্দ জীবনে না থাকে...রঙ...জৌলুশ.... প্রাচুর্যের আলোর রোশনাই ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে...তাহলে অমন জীবনের কোনো তাৎপর্যই নেই।ওর মনের ভিতরে একটু একটু করে যে স্বপ্নগুলো এতদিন ধরে বীজ বপন করে এসেছে...হঠাৎ কোনো একদিন বন্ধ চোখের পাতা খুলেই সেগুলো সত্যি হতে দেখবে...এ যেন ওর কাছে স্বপ্নাতীত। আস্তে আস্তে ও মখমলে বালাপোশ সরিয়ে উঠে বসল।ধীর পায়ে নেমে এল বিছানা থেকে।প্রকৃতি তার প্রচন্ড রোষানলে জ্বলন্ত অঙ্গারসম হয়ে উঠেছে যেন।চারদিকে তীব্র শোঁ শোঁ শব্দের সাথে হয়ে চলেছে তুমুল ঝড়বৃষ্টি।আর থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকানোর ফলে কয়েক মূহুর্ত অন্তর অন্তরই জানলার কাঁচের আবরণ ভেদ করে ঘরের ভিতরটা যেন ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎ চমকের তীব্র আলোয়।আর সেই আলোতেই হিয়া বিস্মিত নয়নে শুধু হাঁ করে দেখে চলেছে ঘরের ভিতরের আভিজাত্যের লালনে সজ্জিত প্রাসাদতুল্য এই সুবিশাল বাংলোর ভিতরের প্রতিটি কোণা।বাড়ির প্রতিটি সদস্য এখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন৷ওই ঘরের দরজা পেরিয়ে এখন ও চলে এসেছে ঘরের মধ্যভাগে...যেখানে এসে ও বুঝতে পারল...এখন ও যেখানে রয়েছে...সেটি হল এই বাড়ির বৈঠকখানা।চারপাশে বিলাশবহুল দামী সোফা আর মাঝখানে একখানি সুন্দর শৌখিন বড় সেন্টার টেবিল।হিয়া আস্তে আস্তে করে গিয়ে বসল সেই সোফায় আর বসতেই ওর যেন মনে হল...ও যেন সোফার একেবারে ভিতরে যেন দেবে গিয়েছে।এমন সময়ে হঠাৎ করেই ওর দৃষ্টি চলে গেল সামনের দেওয়ালে বড় করে টাঙানো একখানি সুবিশাল ফটোফ্রেমের দিকে।বিদ্যুৎ চমকের ওই ক্ষণিকের আলোর ঝলকানিতেই ও স্পষ্টভাবে যেটা দেখল...সেটা দেখামাত্র বিস্ময়ে যেন ওর পায়ের তলার মাটি উথালপাথাল হওয়ার যোগাড়।ওই সুবিশাল ফটোফ্রেমটি যে আসলেই এই পরিবারের একখানি পারিবারিক ছবি সেটা বুঝতে ওর কোনো অসুবিধা হল না।কিন্তু ওই ফটোর ভিতরে সকলের মধ্যমণি হয়ে...একটি রাজকীয় লাল রঙের গাউন পরে বসে রয়েছে যে বছর বারোর মেয়েটি...তার মুখের যেন হুবহু বসানো রয়েছে হিয়ার নিজের মুখখানি।এ কি করে সম্ভব!ওর শরীরের প্রতিটি রোমকূপে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল।অবশ হয়ে আসতে চাইল ওর হাত পা...সারা শরীর।ওই তীব্র ঝড়জলের রাতে ওর কপালে ফুটে উঠল বিন্দু বিন্দু ঘাম।আর পারল না হিয়া।ও নিজের দুইহাতের তালু দিয়ে সজোরে নিজের মাথাখানি চেপে ধরে ধপ করে বসে পড়ল সোফায়।সমস্তকিছু ওর এমন ওলটপালট হয়ে গেল...যে ধাতস্থ হতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগে গেল ওর।এইবার ও বুঝতে পারল...এই বাড়ির সমস্ত লোকেরা কেন ওকে নিজেদের ঘরের মেয়ে বলে নিজেদের বুকে এক লহমায় টেনে নিয়েছে।আর কেনই বা এই বাড়িতে ও এমন আদরযত্ন পাচ্ছে।ছবিতে ওর মুখসদৃশ মেয়েটিকে যে স্হূলকায়...ঘরোয়া... মমতাময়ী ভদ্রমহিলা দুইহাতে জড়িয়ে রেখেছেন...তিনিই এখন ওর পাশের জায়গাটিতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।ইনিই যে মেয়েটির আপন মা...এটা বুঝে নিতে এখন আর ওর কোনো অসুবিধা নেই।আস্তে আস্তে ওর সামনে কিছুটা হলেও সমস্ত চিত্রটা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠল।এখন এখানে যেটা হচ্ছে...সেটার পুরোটাই একটা ভ্রম।আর সেটা এদের কেউই বুঝতে পারছে না।এরা আদৌ জানে না...যাকে এরা নিজেদের পরিবারের মেয়ে বলে কাছে টেনে নিয়েছে... আসলেই এই পরিবারের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই।সত্যিটা জানে শুধুমাত্র হিয়া নিজে।একান্তে...গোপনে। রাত গভীর।বিশাল হলঘর সমান ঘরের একেবারে মাঝখানে রাখা দেওয়াল ঘড়িটা বেজে উঠল ঢং ঢং করে।নিস্তব্ধ ঘরটাতে ওই শব্দ যেন হিয়ার ভিতরটা রীতিমতো এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে গেল।ব্যস...ফের চারপাশের বাতাসে রাজত্ব করতে আরম্ভ করল পিনপড়া শব্দের নৈঃশব্দ্য।মখমলে গদিযুক্ত সোফায় বসে বসে হিয়া সবার আগে এতটুকু ভাবল...ও যেখান থেকে এসেছে...সেখানকার সব মানুষজন এমন আরামের মখমলে সোফা কখনো চোখে দেখেছে কিনা সন্দেহ!একটা কোনো বড় ভুলের ফলপ্রসূই আজ ও এইখানে...এটা ও বুঝতে পারছে ভালোভাবেই। "স্বপন যদি মধুর এমন...হোক সে মিছে কল্পনা...জাগিও না...আমায় জাগিও না...!"এই লাইনটা ওর মনের ভিতরে হঠাৎ চক্কর কাটতে শুরু করল ভীষণভাবে।শেষমেশ ও মনস্হির করে ফেলল... কাউকে বুঝতে দেবে না যে...ও এই বাড়ির মেয়ে নয়।যেটা চলছে...সেটা চলুক আরো যতদিন খুশি...এখন বাবা মা হয়তো দুশ্চিন্তা করছেন...কিন্তু ওনারা যদি জানতে পারতেন...মেয়ে সুখে আছে...তাহলে কি তাঁরা ওকে স্রেফ নিজেদের কাছে টেনে নিয়ে ওকে সারাজীবনের সুখ হতে বঞ্চিত করতেন?নিশ্চয়ই করতেন না...।সব বাবা মা চায়...যে সন্তান ভালো থাক...সুখে থাক...!ওনারা যদি কোনোদিন জানতেও পারেন...তাহলে নিশ্চয়ই ওর সুখের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াতেন না! ও আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল।নিজের মাথা থেকে অতীত জীবনের সমস্ত ছবি মুছে ফেলল নিমেষে।মনে মনে বলল..."বাবা...মা...আমাকে ক্ষমা করে দিও।আমি আর ফিরব না তোমাদের কাছে।চোখের জল মুছে নাও...ধরে নাও...তোমাদের মেয়ে মরে গিয়ে জন্ম নিয়েছে অন্যত্র।সে খুব ভালো আছে...ভালো থাকবে সারা জীবন।ওর চোখের কোলটা যেটুকু মৃদু অশ্রুকণায় চিকচিক করে উঠেছিল...সেটাকে দুইহাতের তালুতে ও মুছে ফেলল সজোরে।আর তারপর দ্রুতবেগে হলঘর পেরিয়ে...সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল আর গিয়ে থামল সেই বিছানার পাশটাতে...যেখানে এতক্ষণ ও অঘোরে ঘুমিয়েছিল।হলঘরের ভিতরটায় ওইভাবে একা একা ও যে কতখানি সময় কাটিয়ে ফেলেছে...ওর নিজেরই সেটা খেয়াল নেই।এখন চারদিকে তাকিয়ে দেখল...আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে।বিছানায় এখনো অঘোরে ঘুমোচ্ছেন ভদ্রমহিলা।আর কোনো সংকোচের ধারেপাশে না গিয়ে হিয়া একলাফে বিছানায় উঠে গিয়ে দুইহাতে ওই ভদ্রমহিলাকে জড়িয়ে ধরে আরামে চোখ বুজল।আর ভদ্রমহিলাও হিয়াকে আরো সজোরে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বালাপোশটা টেনে ভালোভাবে দুজনের গায়ে জড়িয়ে নিলেন। চারপাশে পাখি ডাকতে শুরু করেছে।ভোর হয়ে এসেছে। ঘুম ভাঙতে যথেষ্টই বেলা হয়ে গেল হিয়ার।ঘুম ভেঙ্গে পাশ ফিরে ও দেখল...বিছানায় ও একাই শুয়ে রয়েছে।জানলার পর্দা সরানো রয়েছে দুইপাশে।ঝলমলে সূর্যের আলো ঘরের ভিতরে এসে পড়ছে।দুইহাতে চোখ কচলে শোয়া থেকে উঠে বসল ও।আর সাথে সাথে ঘরের দরজা দিয়ে থালাভর্তি লুচি আর পায়েস...মিষ্টি হাতে নিয়ে ঢুকলেন সেই ভদ্রমহিলা যিনি ওকে সারারাত মাতৃস্নেহে নিজের বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছিলেন।তিনি ঘরে ঢুকে হাতের জলখাবারের থালাখানি বিছানার পাশের কারুকার্যখচিত ছোট টেবিলটিতে রেখে বললেন..."উঠে পড়েছিস মা!এখন কেমন লাগছে শরীর?" বলে তিনি কাছে এসে হিয়ার গায়ে...কপালে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন...জ্বর এখনো আছে কিনা। কোনো সংকোচ না করেই হিয়া বলে উঠল..."না মা...আর জ্বর নেই।কালকে রাতে খুব ভালো ঘুমিয়েছি।" ---হ্যাঁ তাই তো দেখছি।জ্বর এক্কেবারে গায়েব।জয় রাধামাধব!ভগবান এতদিনে মুখ তুলে চেয়েছেন।মেয়েটাকে আমার অক্ষত শরীরে আমার কোলে ফেরত দিয়েছেন।" দুইহাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে শুন্যের দিকে চেয়ে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন ভদ্রমহিলা।এমন সময়ে ঘরের বাইরে থেকে একটা বাঁজখাই মহিলা কন্ঠস্বর ভেসে এল...যেটা শুনে ভদ্রমহিলা একেবারে যেন জুজু হয়ে গেলেন। ---কি গো বউমা...শুধু মেয়েকে নিয়ে সোহাগ করলেই চলবে?এদিকে রান্নাঘরে তো ছিষ্টির কাজ পড়ে রয়েছে।ওইগুলো কে করবে শুনি?তোমার বাপ?" হুঙ্কার শেষ হওয়ার সাথে সাথে সশব্দে জলখাবারের থালাখানি টেবিলের ওপরে রেখে ভদ্রমহিলা যেই দরজার দিকে ছুট দিতে যাবেন...এমন সময়ে ভেসে এল একটি পুরুষ কন্ঠ।"মনোরমা...ও মনোরমা...একবার এদিকে শুনে যাও তো...।" ---"এক্ষুনি আসছি!" ভদ্রমহিলা পড়ি কি মরি করে কোনোমতে দরজার বাইরে ছুট দিলেন।যাবার আগে হিয়াকে বলে গেলেন..."ভালো করে খা মা।আমি খানিক পরে এসে তোকে আরো লুচি দিয়ে যাব।" পঝড়ের গতিতে দৌড় দিয়ে দরজার বাইরে তিনি মিলিয়ে গেলেন।কিন্তু দরজা দিয়ে বেরিয়ে আগে তিনি কার হুকুম তালিম করতে গেলেন সেটা আর বুঝতে পারল না হিয়া।তবে এটুকু ঘটনায় কিছু কিছু জিনিস পরিষ্কার হল হিয়ার কাছে। ভদ্রমহিলার নাম যে মনোরমা...সেটা আর বোঝবার অপেক্ষা রাখে না।মনোরমা দেবীর শাশুড়ি...অর্থাৎ এখানে সম্পর্কে যিনি হিয়ার ঠাকুরমা...তিনি যথেষ্ট দাপুটে মহিলা।উনি মনোরমা দেবীকে একেবারে হাতের মুঠোতে রাখেন।আর যে পুরুষ কন্ঠ মনোরমা দেবীকে ডেকে উঠল...অমনভাবেই হিয়ার নিজের ঘরে ওর বাবা ওর মাকে ডেকে থাকে টুকিটাকি দরকারে।অতএব এখানে ওর নতুন বাবা মা আর ঠাকুরমাকে কিছুটা চিনে আর বুঝে নিল হিয়া।টেবিলে রাখা জলখাবারের থালাটা দুইহাতে টেনে নিল।প্রাণভরে লুচি দিয়ে কষা আলুর দম পায়েস খেতে লাগল ও।পাশে লোভনীয় সব দামী মিষ্টান্ন সাজানো।খেতে খেতে তৃপ্তিতে ওর দুই চোখ বুজে এল। শরীরে এখন আর কোনো কষ্ট নেই হিয়ার।সে এখন পুরোপুরি সুস্থবোধ করছে।আর সুস্থ হবে না ই বা কেন!এই কদিন মনোরমা দেবী এবং এই বাড়ির বাকি মানুষজনেরা যেভাবে ওকে সেবাযত্ন করেছে...তাতে যেকোনো কঠিন অসুখ বাধিয়ে বসা রোগীও যে অনায়াসে সুস্থ হয়ে চারদিকে ছুটে বেড়াবে...সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।হিয়া এখন ওই সুবিশাল প্রাসাদতুল্য বাংলোর ভেতরে আর বাইরে চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকল মনের আনন্দে।হিয়া বুদ্ধিমতী।ও নিজের আসল পরিচয় পুরোপুরি গোপন করে নিয়েছে তো বটেই...পাশাপাশি হাবেভাবে ও এমন ভাব প্রকাশ করছে...যেন পুরোনো সমস্ত স্মৃতিই ওর মাথা থেকে মুছে গিয়েছে।আর ক্রমশ ওই বাড়ির প্রতিটি সদস্য সেটাকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছে।ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে এসেছে...এইটাই তো বড় কথা।সকলের মধ্যে এইভাবে আদরে আর যত্নে থাকতে থাকতে ওর পূর্বেকার সব স্মৃতিও ফিরে আসবে খুব শীঘ্রই।কাজেই এই বিষয়টা নিয়ে কেউ আর বিশেষ দুশ্চিন্তা দেখাল না।হিয়ার দিন কাটতে থাকল দারুণ।হ্যাঁ...মাঝেমাঝে যে নিজের টিনের চালের ঘরের ভিতরে আপন বাবা মায়ের মুখখানি ওর দুচোখে ভেসে উঠত না...তা নয়...।তবে সেই বিষন্নতা এই বিলাসবহুল জীবনের স্রোতে খড়কুটোর ন্যায়ে ভেসে যেতেও খুব বেশি সময় লাগত না।এখন হিয়া এমন সব পোশাক পরে...যেগুলি পরার কথা ও আগে স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারত না।এমন খাবার খায়...যেগুলির নাম আগে শুনলেও ও চোখে কখনো দেখেনি।এখন ও গলায়...কানে সোনার গহনা পরে থাকে সবসময়।এছাড়া আরো অনেক সোনা আর হিরের দামি দামি সব গয়না ওর জন্য কোথায় রাখা রয়েছে...ও জানে।ইতিমধ্যে ও স্কুলেও যেতে শুরু করেছে।কলকাতার একটি নামী ইংরেজী মাধ্যম স্কুল।যেখানে রীতিমতো অভিজাত ঘরের সন্তানরা ছাড়া অন্য ছেলেমেয়েরা পড়বার সুযোগ পায় না।হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার আগে যে এই বাড়ির ছোট মেয়ে পরী যে এই স্কুলেই পড়ত সেটা বুঝতে এখন আর বাকি নেই ওর।সেই জায়গাতেই এখন ও পড়াশোনা শুরু করতে পারছে বিনা বাধায়।আহা...ওর এমন সুখের জীবনটা যদি বাবা মা একবার চোখে দেখতেন...তাহলে বড় নিশ্চিন্ত হত হিয়া।যদিও এতদিনে কেঁদে কেঁদে তাদেরও চোখের জল শুকিয়ে যাওয়ারই কথা...তবুও এই একটাই কষ্টের একটা জায়গা এখনো রয়ে গিয়েছে ওর।এছাড়া বাকি সবকিছুই ওর কাছে এখন খুবই সহজ হয়ে গিয়েছে।স্কুলে বাকি সব সহপাঠীরা...স্কুলের টিচাররা...সকলেই এখন হিয়াকে নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করে নিয়েছে খুব সহজভাবেই।স্কুলে গিয়ে...ইংরেজী বইখাতা হাতে পেয়ে...টিউশন টিচার...গাইড সমস্ত কিছু ঠিকঠাকভাবে পেয়ে হিয়া তো আনন্দে আটখানা।ও এটা ভালোভাবেই বুঝতে পারছে...স্কুলে পরী সকলের খুবই প্রিয়পাত্রী ছিল।আর সেই সুবাদেই ওই নামী ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে এত অপরিচিত মুখের ভিতরেও ও একেবারে নিজের ঘরের মতোই ব্যবহার পাচ্ছে। দিন কাটতে থাকল।হিয়া পরীর ছদ্মবেশে ওই পরিবারের অংশ হিসেবে পাকাপাকিভাবে স্হান অধিকার করে সুন্দর জীবন কাটাতে থাকল।ওর মনে হতে থাকল...ঈশ্বর ওর ওপর যারপরনাই সদয়।এই কারণেই এতদিন ধরে ও ঠিক যা যা স্বপ্ন দেখে এসেছে...সবকিছু এইভাবে এক লহমায় সত্যি হয়ে গেল। এই পরিবারের ভিতরে থাকতে থাকতে ও অনেককিছু জানতে আর বুঝতে শুরু করল।চোখ কান ঠিকভাবে খুলে সবকিছু দেখেশুনে...বুঝে কোথাও কোথাও যেন ওর মনে হত...এতদিন ও জীবন বলতে যা বুঝত...তা যে পুরোপুরি সঠিক নয়।এই প্রাসাদতুল্য বাংলোটিকে বাইরে থেকে দেখে যে কেউ বলবে...এটি একটি অভিজাত পরিবার।কিন্তু এই পরিবারের ভিতরে ঢুকলে প্রতিনিয়ত বোঝা যায়...শুধুমাত্র টাকা ছাড়া এরা কেউই কিচ্ছু বোঝে না।টাকাই হল এদের কাছে ধ্যান জ্ঞান...বোধ।টাকা ছাড়া যেন আর কিছুই নেই এদের।এই বাড়িতে সদস্য রয়েছেন অনেক।পরীর বাবা হলেন এই বাড়ির জ্যেষ্ঠ পুত্র।পরীর তিন কাকা আছেন।আর আছেন তিন কাকিমা।আর আছে খুড়তুতো দাদা দিদি আর ভাই বোন।পরীর যিনি ঠাকুরমা...তাঁর কথাতেই এই পুরো সংসারটা চলে।তাঁর দাপটের ওপরে কথা বলবারই সাহস পায় না কেউ।সবাই ওনাকে সামনে থেকে যারপরনাই ভক্তি শ্রদ্ধা আর সম্মান করে।কিন্তু সকলে যে এই বিশাল সম্পত্তির মালকিন ঠাকুরমার মৃত্যুরই প্রহর গুনে চলেছে প্রতিনিয়ত...সেটা এখন হিয়াও বুঝতে পারে।কবে বুড়ি মরবে...আর সম্পত্তির ভাগবাঁটোয়ারা হবে সেই চিন্তায় যারা প্রতিনিয়ত মশগুল...তাদের জীবন নিয়ে যত অভিযোগ...আর যতখানি অতৃপ্তি...জীবন তাঁদের ততখানিই ভরে ভরে দিয়েছে।কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা প্রতিনিয়ত "বুড়ি কবে মরবে" এই চিন্তাতেই নিজেদের বর্তমান জীবনের সমস্ত শান্তি বিঘ্নিত করে চলেছে।হিয়া মনে পড়ে নিজের মায়ের কথা।টিনের চালের ঘরে বাস করে উদয়াস্ত পরিশ্রম করা ওর মায়ের মধ্যে ও জীবন নিয়ে এক ক্ষোভ...অভিযোগ কখনো দেখেনি।নমাসে ছমাসে ঘরে মাংসের ঝোল দিয়ে রুটি...অথবা পূজোর দিনে বাবার নিজের হাতে আনা ছাপা শাড়ি পেয়ে মায়ের ভিতরে ও এতদিন যে প্রফুল্লতা দেখে এসেছে...ওই প্রফুল্লতা এদের ভিতরে এ জীবনে কোনোভাবেই আসবার নয়...এটা হিয়া বুঝতে পারে ভালোভাবেই।আচ্ছা...তাহলে প্রকৃত আভিজাত্যের সুখ কি আসলে মা অথবা বাবার মতো মানুষেরাই পায়?অঢেল পেয়েও এরা সেটা পায় না!বুঝে পায় না হিয়া।আর সবচাইতে বড়ো কথা...যাঁর প্রতি এতখানি হিংসা আর বিদ্বেষ ভিতরে ভিতরে এরা পুষে রেখেছে,তাঁর সামনাসামনি হওয়ামাত্রই ওদের সমস্ত হাবভাব আচার আচরণ নিমেষের মধ্যে কি করে পালটে যায়!এদের ভিতরে আছে টা কি!শুধুই হিংসা আর ক্ষোভ...আর বাকিটা অভিনয়ের মুখোশ!এতখানি অন্তঃসারশূন্য এদের জীবন!এদের চাইতে তো ওর সস্তার শাড়ি পরে,মেলা থেকে দু দশ টাকার বালা হাতে পরে ওর টিনের চালের তলায় সংসার করা মা অনেক বড়লো!মনে হয় হিয়ার। দূরের ঘাস সত্যিই বড়ো সুন্দর...সবুজ দেখায়...তাতে আসল চিত্র স্পষ্টভাবে সত্যিই দেখা যায় না।এই কথাগুলো যেমন ও অনুভব করত...পাশাপাশি এই বাড়ির ভিতরে এই পরিবারের অংশ হিসেবে বাস করতে করতে ও যেভাবে অনুভব করত...ওর জীবন হতে অভাব নামক শব্দটি চিরতরে বিদায় নিয়েছে...তখন আবার একটা তীব্র ভালো লাগার অনুভূতি ফুরফুরে হিমেল বাতাসের মতোই যেন ওকে স্পর্শ করে যেত।মন ওর ভালো হয়ে যেত সাথে সাথে।দিন কাটতে থাকল বেশ ভালোভাবেই।বেশ কিছুদিনের মাথাতেই ঘটল ঘটনাটা।এই চক্রবর্তী পরিবারে আগমন ঘটল এক নতুন অতিথির। এই চক্রবর্তী বাড়ির ভিতরে যে আরো একজন স্হায়ী সদস্য রয়েছে...সেটা হঠাৎই একদিন সকালে জানতে পারল হিয়া।দিনটা ছিল রবিবার।হিয়ার স্কুল ছুটি ছিল।চক্রবর্তী বাড়ির সামনেটায় একটা সুবিশাল সুদৃশ্য একখানি ফুলের বাগান রয়েছে।এই বাগানটির অায়তন এই সুবিশাল বাংলোটির পিছনের বিশাল আয়তনের প্রান্তর জুড়ে বিস্তৃত।তবে বাংলোর পিছনে এই ফুলের বাগানটি রূপান্তরিত করা রয়েছে ফলের বাগানে।বাংলোর পিছনটা জুড়ে সারি সারি ফলগাছ।কত রকমের ফল যে ফলে ওখানে...আর বাংলোর সামনেটায় তো কথাই নেই!কত রঙিন রঙিন নাম জানা...না জানা ফুল ফুটে থাকে...তার ইয়ত্তা নেই।এই বাগান হিয়ার বড়ো প্রিয়।ছুটির দিন হলে সকালের প্রাতরাশের পর্ব সেরে ও চলে আসে এইখানে।এখানে ও সময় কাটায় অনেক্ষণ।আর তায় এখন শীতের সকাল।চারপাশের রঙিন ফুলগাছের সারির মাঝে বসে রোদ পোহাতে ওর খুব ভালো লাগে।এইদিন ও সকালের জলখাবার খেয়ে নিয়েই বাগানের মধ্যিখানটায় চলে এসেছিল রোদ পোহানোর জন্য।ঠিক ওই সময়েই হঠাৎ বাংলোর মেন গেটে ক্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-চ করে একটা শব্দ হল।এ যে গেট খোলার শব্দ...সেটা হিয়া বিলক্ষণ জানে।মেন গেটের পাশটায় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়ে বাংলোর বৃদ্ধ দারোয়ান অনাগত অতিথিকে একটা লম্বা সেলাম ঠুকে তার দুইহাত ভর্তি ব্যাগপত্র নিজের কাঁধে আর মাথায় তুলে নিয়ে তাঁকে ভিতরে আসবার জন্য সাদর আমন্ত্রণ জানাল।বাগানের একটা পাশে হিয়া বসে রোদ পোহাতে পোহাতে সবটাই দেখছিল মন দিয়ে।একজন বছর পঁচিশের তরতাজা একটা হাট্টাকাট্টা যুবকের হাত থেকে যখন বৃদ্ধ দারোয়ান তার দুইহাত ভর্তি জিনিসপত্র নিজের কাঁধে মাথায় তুলে নিতে গেল...তখন ওই যুবকটি কি সুন্দর নির্লজ্জের মতো তার হাতে ঘাড়ে নিজের সমস্ত মালপত্র চাপিয়ে দিয়ে নিজের দুইহাতের তালু ঝেড়ে দিব্যি হেলতে দুলতে বাংলোর ভিতরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকল।বাংলোর মেইন গেটটা যেখানে...তার অনেকটা ভিতরের দিকেই বসেছিল হিয়া।তাই ওকে কারোর চোখে পড়ার কথাও নয়।কিন্তু বাগানের একটা পাশে বসে বসে হিয়া দেখতে পাচ্ছিল সবটাই।মোটামুটি মাস ছয়েক হল এখানে আছে ও।এর মধ্যে তো বাইরে থেকে কোনো লোক এত জিনিসপত্র নিয়ে এই বাংলোর ভিতরে থাকবার জন্য আসতে ও দেখেনি কোনোদিন...।বেশ কৌতূহল হল ওর।ও ধীরপায়ে বাংলোর ভিতরে ঢোকার মুখে এগোতে থাকল।আর কিছুটা এগোতেই ও দেখতে পেল...পরিবারের কত্রী...ঠাকুরমা গায়ত্রী দেবী রীতিমতো বিচলিত হয়ে প্রায় ছুটে চলে এসেছেন বাগানের মাঝ পর্যন্ত। "এতদিন পরে এই বুড়ির কথা তোর মনে পড়ল রে বাপ!কাউকে কিচ্ছুটি না জানিয়ে এইভাবে গায়েব হয়ে যেতে হয়!এইবার পেয়েছি তোকে।কান ধরে নিয়ে যাব ভিতরে...আর কোথাও যেতে দেব না।" গায়ত্রী দেবীর কথা শুনে যুবকটি হেসে বলল..."তুমি আর চিন্তা কোরো না দিদুন। তোমার এ নাতি এই যে তোমার কাছে চলে এসেছে...সারাজীবন তোমার কাছেই থাকবে।বরাবরের মতো চলে এলাম গো...নাও ভিতরে চলো গো...আমার বড় ক্ষিদে পেয়েছে। পুরো ব্যাপারটা মন দিয়ে নিরীক্ষণ করছিল হিয়া।সবকিছু দেখেশুনে তো ও ভারি তাজ্জব হয়ে গেল।যে মাস ছয়েক ও এই পরিবারে রয়েছে...তাতে গায়ত্রী দেবীর সমস্ত নাতিদেরকে ও ভালোভাবেই চেনে এবং তারা সকলে এই বাড়িতেই থাকে।গায়ত্রী দেবীর কোনো কন্যা সন্তানও নেই যে সেই সূত্রে তাঁর কোনো নাতি থাকবে।আর এরকম কেউ যে এই পরিবারের সাথে জড়িত...সেটা তো আজই ও প্রথম জানছে।অবশ্য এটা হতেই পারে এই ছয় মাস ধরে এই পরিবারের সবাই তো ওকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল।কাজেই এই প্রসঙ্গটা ধামাচাপা পড়ে যাওয়াটা খুব একটা আশ্চর্যেরও নয়।ও দেখল...ঠাকুরমা আগত যুবকটিকে রীতিমতো বাবা বাছা বলে গায়ে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে ঘরের ভিতরে নিয়ে যাচ্ছেন।ব্যাপারটা আরো ভালো করে বোঝার জন্য হিয়া ধীরপায়ে ওদের পিছু পিছু বাংলোতে ঢোকার দরজার দিকে অগ্রগামী হল। বাংলোর দরজা দিয়ে ঢোকার মুখে ও দেখল...এই নবাগত আগন্তুকটি হেলতে দুলতে এমনভাবে ঘরের ভিতরে ঢুকল...যেন এটা ওর নিজেরই বাড়ি।সোফায় বসে উষ্ণ কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে ব্যস্ত বড়কাকা খবরের কাগজের ওপর দিয়ে আড়চোখে আগন্তুককে দেখে বলে উঠলেন "আরে এসো ভায়া এসো...অ্যাদ্দিন পর ঠিকানাটা মনে পড়ল!" আগন্তুক বেশ ঔদ্ধত্যের সঙ্গে ধপ করে মেজোকাকার পাশে বসে পড়ল।তারপর বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটির কাঁধে কনুই রেখে বলল..."চাকরি টা ছেড়ে দিয়ে এখানে তোমাদের কাছেই চলে এলাম মেজকা।এক্কেবারে সারা জীবনের মতো।তোমাদের ছেড়ে কোথাও আমার মন টিকবে না।সে যত বড় আর ভালো মাইনের চাকরিই হোক...সেটা এবার পাকাপাকিভাবে বুঝতে পারলাম।" মেজোকাকার কাঁধের ওপর কনুই রেখে সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে পায়ের ওপর পা নাচাতে নাচাতে কথাটা বলল আগন্তুক। ---তবে আর কি!এ হোটেল তো তোমার জন্য পার্মানেন্ট...চাকরি হল কি হল না...তাতে কিস্যু যায় আসে না...অ্যাঁ!তোমার ঘরের দরজার সামনে একখানা কালো বেড়াল ঘোরাঘুরি করছে আজকাল।পারলে ওটাকে তাড়িও।আমার ছেলে আবার এইসব বিড়াল ফিড়াল একদম সহ্য করতে পারে না।নিবারণ...নিবারণ...আমার জন্য একটু ফল কেটে নিয়ে এসো তো...খেয়ে আমায় একটু বেরোতে হবে।" খালি কফির পেয়ালাটা বেশ সশব্দে টেবিলে রেখে সোফা থেকে উঠে হনহন করে ওপরে উঠে গেলেন মেজকাকা।নিবারণ এসে কফির ফাঁকা কাপটা নেওয়ার জন্য টেবিলের দিকে এগোতেই আগন্তুক বেশ ঔদ্ধত্বের সঙ্গে বলে উঠল..."আবে...দেখতে পাস না নাকি...দিলি তো আমার ব্যাগটা নোংরা করে...!" নিবারণ কাকা ভয়ে একেবারে জড়োসড়ো হয়ে গেল।যাওয়া আসার রাস্তার মাঝখানেই নিজের কাঁধের ছোট ব্যাগখানা রেখে দিয়ে মেজোকাকার সাথে কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়াটা এই আগন্তুকের বেখেয়াল হওয়ার নিদর্শন না হলেও বাড়ির হেঁসেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নিবারণ কাকার নগ্ন পা খানি ওনার ব্যাগ স্পর্শ করাটা বোধহয় রীতিমতো গুরুতর অপরাধে পর্যবসিত হল। জড়োসড়ো মিনমিনে কন্ঠে নিবারণ কাকা বলে উঠল..."আ...আজ্ঞে...ভুল হয়ে গেছে সুশীল দাদাবাবু...।" ---"যতসব অপদার্থের দল।দূর হও আমার সামনে থেকে...!" বাঁজখাই গলায় ধমক দিয়ে উঠল সে।নিবারণ কাকা কোনোমতে কফির কাপটা তুলে নিয়েই সাথে সাথে ঘরের ভিতরের দিকে দৌড় দিল।স্বল্প মেয়াদের শান্তির সময় পেরিয়ে গিয়ে ফের আতঙ্কের জুজু নেমে এলে কোনো মানুষের মুখচোখের যেরকম অবস্থা হয়...নিবারণ কাকার মুখেচোখে হুবহু সেরকম ছাপই পরিলক্ষিত হল।এই নবাগত আগন্তুকটির নামের সঙ্গে যে এর চরিত্রের কি "আশ্চর্যরকমের" সামঞ্জস্য...সেইটাই ভারি অদ্ভুত বিষয়।দরজার পাশে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ ধরে সবকিছু নিঃশব্দে লক্ষ্য করে যাচ্ছিল হিয়া।সুশীল ওর ব্যাগখানি হাতে নিতে যাবে...এমন সময়ে ওর সাথে একেবারে সোজাসুজি চোখাচোখি হল হিয়ার।এই দৃষ্টি বিনিময়টা আদৌ স্বাভাবিক ছিল না।হিয়াকে চোখের সামনে দেখে সুশীলের পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল।এতক্ষণ ধরে চারপাশের সমস্ত মানুষজনের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলা সুশীল...হিয়াকে দেখামাত্র ওর গলা বুজে এল অজানা কোনো আতঙ্কে।সুশীলের হাত থেকে সশব্দে নীচে পড়ে গেল ব্যাগখানি।সুশীলের পা দুটো যেন ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে।আর নিজের ভিতরেই যেন সে থাকতে পারছে না অপার বিস্ময়ে।আর দাঁড়িয়েই থাকতে পারছে না ও।নরম মখমলে গদির ওপরে ধপ করে বসে পড়ল সুশীল।এই মাঘ মাসেও ও ঘামতে শুরু করেছে দরদর করে।ওকে দেখামাত্রই সুশীলের ভিতরটা কেন যে এইভাবে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল...সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না হিয়া।ঠাকুরমা নিজের হাতে করে জলখাবার সাজিয়ে নাতির সামনে এসে দাঁড়ালেন যখন...সুশীল প্রচন্ড ভয়ার্ত এবং কম্পিত কন্ঠে ঢোক গিলে হিয়ার দিকে আঙুল দেখিয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় কোনোমতে জিজ্ঞাসা করল ঠাকুরমাকে..."ও কে দিদুন!" জলখাবারের প্লেট টা টেবিলের ওপরে রাখতে রাখতে ঠাকুরমা আনন্দিত হয়ে হেসে বলে উঠলেন..."ও তোকে তো বলাই হয়নি রে...পরীকে আমরা খুঁজে পেলুম শেষ পর্যন্ত।কোথায় না কোথায় যে ওকে খুঁজেছিলুম আমরা সেটা তুই ধারণা করতে পারবি না।ওই সময়ে তুই থাকলে হয়তো ওকে খুঁজে পেতে এতটা দেরি হত না। ---"কোথায় পেলে ওকে তোমরা?" সুশীলকে দেখে মনে হচ্ছিল...ও নিজের ভিতরে কোনো প্রচন্ড ভয় জবরদস্তি চেপেচুপে আপ্রাণ চেষ্টা করছে স্বাভাবিকভাবে কথা বলবার।কিন্তু ঠাকুরমা ওর দিকে দৃষ্টি না দিয়ে খানিক উদাস হয়ে গেলেন যেন।বৈঠকখানার মাঝ বরাবর বড়ো করে টাঙিয়ে রাখা চক্রবর্তী পরিবারের পারিবারিক ছবিটির দিকে তাকিয়ে আর একবার ওপরের দিকে জোড়হাত করে বললেন..."রাধামাধব রক্ষে করেছেন...মেয়েটা আমাদের খুব বেশি দূরে যাবার আগেই এলাকার লোকজনের নজরে পড়ে গিয়েছিল...তাই এ যাত্রা মেয়েটাকে ফিরে পেলুম আমরা।" সুশীল পকেট থেকে রুমাল বার করে নিয়ে ওর ঘামটাম মুছে নিল।তারপর হাসিমুখে তাকাল ঠাকুরমার দিকে। উনি বলে চলেছেন..."সামনের স্টেশনের রেললাইনের ধারে একটা ছেঁড়া জামা পরে ভিখারীর মতো পড়ে ছিল এই চক্রবর্তী পরিবারের একমাত্র মেয়ে।ভাবতে পারিস!এলাকার লোকজনে কিন্তু তা সত্ত্বেও ওকে চিনতে এতটুকু ভুল করেনি।এরপর তো বড়খোকা খবর পেল সবার আগে।তারপর একে একে ছুটে গেলুম আমরাও।রাস্তার ওই রেললাইনের ধার থেকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা পরীটাকে আমরা ঘরে নিয়ে এলাম।ওইসব ছাইপাশ জামাকাপড় ছাড়িয়ে...শুশ্রুষা করে...ডাক্তার দেখানোর পর পরিস্থিতি একটু হালে ফেরে।" ---তোমরা যখন আমাকে খবর পাঠিয়েছিলে...বিশ্বাস করো ঠাকুরমা...আমার তো এখানে ফিরে আসার জন্য ভিতরটা একেবারে ছটফট করছিল।কিন্তু কি করি...চাকরির ইন্টারভিউটা শেষ না করে কি করে ফিরি বলো...।ওর ফিরে আসার খবরটাও যদি আমাকে ফোনে একবার জানাতে...আমি একটু নিশ্চিন্ত হতাম...। ---হ্যাঁ রে।তুই ঠিকই বলেছিস।আসলে ওকে ফিরে পাওয়ার পর ওকে সুস্থ করে তোলা নিয়ে আমাদের সবাইকেই ব্যস্ত থাকতে হয়েছে রে কটাদিন...।তখন আর কিছু মাথায় করার মতো পরিস্থিতিই ছিল না।আর সেই সময়েই তোর যে ফোন নাম্বারটা একখান কাগজে লিখে আমাকে দিয়ে গিয়েছিলি...ওটা আমি হারিয়ে ফেলি।আমি পুরোনো দিনের মানুষ।ফোন নম্বর পড়ে পড়ে টেলিফোনে আঙুল দিয়ে সে নম্বর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তারপরেই কথা বলতে পারি।তোদের মতো তো আর পকেটে করে ছোট ফোন নিয়ে ঘুরি না...তাই আর তোকে খবরটা দিয়ে ওঠা হয়নি।তবে বলতে নেই...এখন আগের থেকে ও অনেক ভালো আছে।ইস্কুলে যাচ্ছে...পড়াশোনাও আরম্ভ করেছে...শুধু আগেকার কোনোকিছু ঠিক করে আর মনে করতে পারছে না।তবে এটা নিয়ে আর আমরা খুব একটা চিন্তা করছি না।ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে এসেছে...এটাই বড় কথা।আর এখন তুইও চলে এলি...ব্যস...আমার ঘর ভরে গেল।নে...তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে নে।আমি নিবারণ কে বলে তোর ঘরটা ঝেড়েপুঁছে পরিষ্কার করতে বলে আসি গে...।" বাতের ব্যাথায় জেরবার পা খানি কোনোমতে সামলে ধীরপায়ে থপথপ গতিতে ভিতরের দিকে অগ্রগামী হলেন ঠাকুরমা।বিশাল বৈঠকখানার ওই ঘরটার একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুশীল...আর অন্যপ্রান্তে হিয়া। এবার এই প্রথম সুশীল কথা বলল হিয়ার সঙ্গে। ---"আমায় চিনতে পারছ পরী?" হিয়ার মনে হল...উত্তরটা এমনভাবে দেওয়া উচিত...যাতে কেউ ওকে সন্দেহ করার কোনো সুযোগ না পায়।ও আমতা আমতা করে বলল..."ইয়ে...মানে...চেনা চেনা লাগছে।" হিয়ার মুখে ওই কথা শুনে সুশীল টেবিলে রাখা জলখাবারের প্লেটখানি সজোরে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল।তারপর বাজখাই গলায় হেঁকে উঠল।"নিবারণ...অ্যাই নিবারণ...একটা ঘর গোছাতে কি বুড়ো হয়ে গেলে নাকি!" তারপর হনহন করে চলে গেল ভিতরের দিকে।কিচ্ছু না বুঝতে পেরে ওইদিকে একেবারে বোকার মতো তাকিয়ে রইল হিয়া। সুশীল আসার পর থেকে হিয়া একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছে...গায়ত্রী দেবী...অর্থাৎ ওর বৃদ্ধা ঠাকুরমা...ওকে একেবারে চোখে হারান।এই ছেলেটি সম্পর্কে ওনার নাতিই বটে।গায়ত্রী দেবীর আপন ছোট ভাইএর পক্ষাঘাতগ্রস্ত একমাত্র পুত্রের ছেলে এই সুশীল।গায়ত্রী দেবীর বাপের বাড়ির বংশে বাতি দেবার একমাত্র প্রদীপ হল এই সুশীল।গায়ত্রী দেবীর ছোট ভাই বহু বছর আগেই একটা পথ দুর্ঘটনায় মারা যান।তাঁর বিধবা স্ত্রী সুশীলের বাবাকে অনেক কষ্ট করে বড় করেন।ওই সময়ে ভাইএর পিতৃহীন ছেলের জন্য কষ্টে ওনার বুক ফেটে গেলেও বছরে দুইবার হাতে উপহার সামগ্রী নিয়ে বাপের বাড়ি ঘুরে আসার বাইরে কোনো কিছু করার উপায় তাঁর ছিল না।কারণ ওই সময়ে এই বাড়ি গায়ত্রী দেবীর শাশুড়ির শাসনাধীনে ছিল।ওনার অনুমতি ছাড়া এই বাড়ির দেওয়াল থেকে একটা বালি খসবারও উপায় ছিল না।ওই সময়ে বাড়ির বৌদের নিজেদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছা...প্রয়োজন অপ্রয়োজন বলে কিছুই ছিল না।সাথে পুরুষ মানুষ না থাকলে তাঁরা পায়ে হেঁটে এই বাড়ির চৌকাঠ পর্যন্ত পার হতে পারতেন না।সেই সময়ে গায়ত্রী দেবী যখন নিজের একমাত্র ভ্রাতুষ্পুত্রকে দেখাশোনা করবার অনুমতি চেয়েছিলেন...সেটা সাথে সাথেই খারিজ হয়ে গিয়েছিল ।নির্দেশ এসেছিল..."বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি আর সংসার হল মেয়েদের একমাত্র দায়িত্ব আর কর্তব্য।মন দিয়ে এখানে ঘর সংসার করো।বাপের বাড়ি থেকে বিয়ে হয়ে এখানে চলে এসেছো যখন...সেখানকার চিন্তা মাথা থেকে বার করে দাও।" আদেশ পালন করতে যদিও বাধ্য ছিলেন তিনি...কিন্তু মন তাঁর মানতে চায়নি।তিনি ভালো করেই জানতেন...তাঁর বাপের বাড়ির বংশের প্রদীপ এখন ভীষণভাবে ম্রিয়মান।আর তাছাড়া ওনার ছোটভাই মারা যাওয়ার পর সেখানকার আর্থিক অবস্হাটাও ভীষণভাবে পড়ে যায়।একজন সদ্য স্বামীহারা বিধবা স্ত্রী তার স্বল্প বিদ্যায় আর বুদ্ধিতে ছোটখাটো একখানা কাজ জুটিয়ে নেয় বটে...কিন্তু তাতে মা ছেলের সংসার আর ভবিষ্যত ঠিকভাবে গোছানোটা ছিল যথেষ্টই মুশকিল।সুশীলের বাবা যখন ছোট ছিলেন...তখন বহু দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন বারবার...যার ঠিকঠাক চিকিৎসা তাঁর বিধবা মা একা দায়িত্ব নিয়ে ঠিকভাবে করতে পারেননি।ফলপ্রসূ...সুশীলের বাবা ছোট থেকেই শারীরিকভাবে বড়ো দুর্বল ছিলেন।পরবর্তীকালে সুশীলের বাবা ব্যাঙ্কে একটা চাকরি পান...আর বিয়েও করেন।সুশীলকে জন্ম দেওয়ার সময়েই মারা যান ওর মা।এরপর বাবা আর ছেলের সংসার যাও বা চলছিল...খুব অল্পদিনের মধ্যেই সুশীলের বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন।তখন সুশীল সবে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে।ততদিনে গায়ত্রী দেবীর শ্বশুর শাশুড়ি...স্বামী সবাই গত হয়েছেন।চক্রবর্তী পরিবারে একমাত্র বয়োজ্যেষ্ঠা সদস্য তখন শুধুমাত্র গায়ত্রী দেবী।এই চক্রবর্তী পরিবারের চাবিসমেত সমস্ত কতৃত্ব এখন তাঁর হাতে।সুবিশাল এই বাংলো সমেত এতবড় সম্পত্তির মালকিন তিনি।অতএব এখন তাঁর সিদ্ধান্তের ওপরে কথা বলে এমন কেউই নেই।গায়ত্রী দেবী সুশীলের বাবাকে বহুবার অনুরোধ করেছিলেন এই চক্রবর্তী বাড়িতে এসে থাকবার জন্য।কিন্তু তাঁর ছোটভাই তাঁর আত্মসম্মান বিকিয়ে দিদির শ্বশুরবাড়িতে থেকে যেতে রাজী হননি।কিন্তু গায়ত্রী দেবীর জোরাজুরিতে তাঁর বছর তেরোর ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর কাছে।সেই থেকেই সুশীল এই বাড়িতেই থাকে।গায়ত্রী দেবী ভাইকে দেখাশোনা করে রাখবার জন্য একটি আয়াও ঠিক করে দিয়েছিলেন বটে...কিন্তু সুশীলের বাবা আর খুব বেশিদিন বাঁচেননি।জন্মের সাথে সাথে মাতৃহারা হওয়ার পর মাত্র পনেরো বছর বয়সে সুশীল পিতৃহারা হয় এবং পুরোপুরি অনাথ হয়ে পড়ে।কিন্তু অনাথ হওয়ার যন্ত্রনা গায়ত্রী দেবী ওকে এতটুকুও বুঝতে দেননি।যদিও ছোট থেকেই হুইলচেয়ারের ওপরে নির্ভরশীল বাবার প্রতি ওর তেমন কোনো ভালোবাসা ছিল না।কিন্তু গায়ত্রীদেবীর হাত ধরে যেদিন থেকে ও এই চক্রবর্তী পরিবারে এসে থাকতে শুরু করেছে...গায়ত্রীদেবীর তত্ত্বাবধানে থাকা কিশোর ছেলেটি সেইদিন থেকে আরম্ভ করে আর কোনোদিনই বাপ মায়ের অভাব বোঝেনি।পরের দিকে নিজের বাপের মুখখানা মনে করাটাই ছিল ওর কাছে দুরূহ ব্যাপার।ওর সুখের জীবন দেখে ওর বয়সী অনেক ছেলেই হয়তো ওকে হিংসা করত।ছোট থেকে থাকতে থাকতে ওও এখন এই চক্রবর্তী পরিবারের একজন সদস্য।গায়ত্রী দেবী সুশীলকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করে...একটি ভালো মেয়ে দেখে ওর বিয়ে দিতে পারলেই নিশ্চিন্ত।তাঁর বাপের বাড়ির বংশের বাতি অক্ষুণ্ণ থাকুক...এইটাই তাঁর চাওয়া।কিন্তু গায়ত্রী দেবী তাঁর নিজের মতো করে ভেবে অনাথ ছেলেটিকে আপন করে তো নিয়েছিলেন...কিন্তু সুশীলার মতি বরাবরই কিছু অন্য।লেখাপড়ায় তো ওর কোনোকালেই মন ছিল না...।উচ্চ মাধ্যমিকে তিনবার আটকে গিয়ে শেষ বারে কোনোমতে টায় টায় পাশ।এরপরে আর ওকে বইখাতা ধরানো যায়নি।বয়স মোটামুটি সতেরো পেরোতেই ওর কাঁধের দুইপাশে গজিয়ে গেল দুটি অদৃশ্য ডানা।সব সময় টো টো করে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়।পরের দিকে কখনো ইচ্ছা হলে দোকানের হেল্পার...কখনো বাসের খালাসী...এইসব টুকিটাকি কাজটাজ করেছে। গায়ত্রী দেবী এইসব খবর জানেনও না।গায়ত্রী দেবীর সামনে সুশীল একেবারে সুশীল বালকের মতোই ধরা দেয়।কাজেই ওর গতিবিধি অথবা কাজকর্ম সম্পর্কে গায়ত্রী দেবীর কোনো ধারণা নেই বললেই চলে।সুশীলকে উনি অন্ধের মতো বিশ্বাস করেন আর স্নেহ করেন। মোটামুটি ছোটবেলা থেকেই এই বাড়িতে স্হায়ীভাবে থাকতে থাকতে সুশীল এই চক্রবর্তী পরিবারের একজন স্হায়ী সদস্য হয়ে গিয়েছে।পড়াশোনায় খুব একটা বেশিদূর না গেলেও...এমনিতে ছেলেটা বেশ হাসিখুশি আর মিশুকে।যে বাড়িতে থাকে...খায়...তাদের সঙ্গে বেশ আন্তরিকতা আর সম্মানের সঙ্গেই আচার ব্যবহার বজায় রেখেছে।বেশ উপকারীও।পরিবারের টুকিটাকি কাজে ও লাগে ভালোই।তাই মোটের ওপর ও এই পরিবারের সকলেরই প্রিয়পাত্র।ওর স্বভাব চরিত্র দিয়ে ও মন জয় করে নিয়েছে সকলেরই।এই কারণেই পাতে দেবার মতো আয়পয় না থাকা সত্ত্বেও ওকে এই বাড়ির ছেলের থেকে কম হিসেবে দেখা হয় না।আর বিশেষ করে সে মনোরমা দেবী আর ওনার কর্তা সঞ্জয় বাবুর একেবারে চোখের মণি।কারণ একটা সময় এমন ছিল...যখন পরী মনোরমা দেবীর পেটে ছিল...সেই সময়ে কর্মসূত্রে সঞ্জয় বাবু ছিলেন গুজরাটে।মেজোভাই তাঁর সস্ত্রীক ছিলেন শ্বশুরবাড়িতে...আর আর বাকি সকল সদস্যই বাড়ির বাইরে ছিলেন যে যার কাজে।বাড়ির চাকর নিবারণও ছিল ছুটিতে।ঘরে ছিলেন শুধুই বৃদ্ধা ঠাকুরমা গায়ত্রী দেবী আর এই সুশীল।ওই সময়ে হঠাৎই সময়ের আগে অপ্রত্যাশিতভাবে প্রসব বেদনা ওঠে মনোরমা দেবীর।ওই সময়ে যদি ঘরে সুশীল না থাকত...তাহলে মনোরমা দেবী অথবা পরী...কাউকেই বাঁচানো যেত না।কাজেই এই বাড়িতে ওর মাস কয়েকের অনুপস্থিতির পরে আগে থেকে কোনো খবর টবের না দিয়ে এইভাবে হঠাৎ আগমনে পরিবারের ভিতরে যে একটা প্রচ্ছন্ন খুশি এবং একটা নিশ্চিন্ত হওয়ার মতো ব্যাপার যে ঘটেছে...এতে হিয়ার কোনো সন্দেহ নেই।কিন্তু যেদিন থেকে সুশীল এই বাড়িতে পা রেখেছে...তারপর থেকে ও সকলের সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করলেও...ওকে যে রীতিমতো সচেতনভাবেই এড়িয়ে যাচ্ছে ও...সেটা হিয়া লক্ষ্য করেছে ভালোভাবেই।ও পরে জেনেছে...পরী ওকে মামু বলে ডাকত...আর পরীকে ও খুবই ভালোবাসত।আর খুব ছোট্ট থেকে পরীও ছিল মামু বলতে অজ্ঞান।কিন্তু সুশীলের হাবভাব দেখে কিন্তু ওর মোটেও এরকম কিছুই মনে হচ্ছে না।ওর মতো একটা বারো বছরের ছোট্ট মেয়েকে বছর পঁচিশের একজন তাগড়া জোয়ান যে কেন এত ভয় পায়...ও সেটাই বুঝে উঠতে পারে না মাঝে মাঝে।ওর সাথে চোখ মেলাতে গেলেই যে সুশীলের ভিতরে একটা ভয়ঙ্কর আড়ষ্টতা কাজ করে...সেটা আর কেউ না বুঝুক...হিয়া নিজে সেটা কটাদিন পেরোনোর পর বুঝেছে ভালোভাবেই।আর সেই কারণেই একটা সন্দিগ্ধ চোখে ও তাকায় সুশীলের দিকে। তবে সারা পরিবারের সমস্ত মানুষজন ওকে এতটাই খাতির যত্ন করে...যে একজন মানুষের আচার আচরণের অসঙ্গতি ওকে আর বিশেষ ভাবায় না।ও ওর নিজের স্কুল...পড়াশোনা...খেলাধুলা এইসব নিয়ে দিব্যি আছে।হিয়া বয়সের তুলনায় যথেষ্ট পরিণত আর বুদ্ধিমতী মেয়ে।দিন যত যায়...এই পরিবারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকা কদর্য অন্ধকার দিকগুলো উপলদ্ধি করতে শুরু করল।এক টাকাপয়সার প্রাচুর্য আর আভিজাত্য ছাড়া আর কোনোকিছুই এই পরিবারের মানুষেরা বোঝে না।আর যে মানুষের প্রাচুর্য বা আভিজাত্য কম...তাকে এরা তো মানুষ বলেই গণ্য করে না।এমনকি এদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি আর ভালোবাসাও শুধুমাত্র এই একটি জিনিসের ওপরেই নির্ভরশীল।"তোমার কি আছে এবং কতটুকু আছে...তার নিক্তিতেই বিচার করা হবে ঠিক কিরকম ব্যবহার তুমি পাবে"---এইটাই এই পরিবারের একমাত্র নীতি।বস্তুত...গায়ত্রী দেবী যদি সুশীলকে এই বাড়ির সম্পত্তির ভিতর থেকে একটা ভালো অংশ আগে থেকেই ওকে না লিখে দিতেন...তাহলে যে এই পরিবারের আশ্রিত হিসেবে সুশীলের...যে এই বাড়ির বেতনভুক চাকর নিবারণ দাদুর থেকেও কদর্য ব্যবহার বরাদ্দ ছিল...এটা বুঝতে কোনো বাকি থাকে না হিয়ার।এমনকি ওকেও যে খাতির যত্ন দিয়ে সক্কলে একেবারে মাথায় তুলে রাখে...তার একমাত্র কারণটা বুঝতেও এখন আর বাকি নেই ওর।গায়ত্রী দেবী প্রচুর দামী দামী গহনা তাঁর একমাত্র নাতনির জন্য গড়িয়ে রেখে দিয়েছেন...এবং নিজের গহনার থেকে সিংহভাগ তিনি ওর জন্যই সরিয়ে রেখে দিয়েছেন...তাতে ওর কাকিমাদের অসন্তোষ গোপন নেই ওর কাছে।অতটুকু বছর বারোর মেয়েকেও এতবড় বড় বয়স্কা মহিলারা যেভাবে সমীহ করে চলে...সেটা দেখে রীতিমতো হাসি পায় ওর।আজ যদি এতগুলি দামী গহনার মালকিন যদি ও না হত...তাহলে ওনাদের...ওর প্রতি আচার আচরণ ঠিক কিরকম হত...সেইটাই অবাক হয়ে ভাবে ও।ওরকম গলাউচু দাজ্জাল আর উগ্র স্বভাবের মহিলাদের আশেপাশেও ও টিকতে পারত কিনা সন্দেহ।এই পুরো পরিবারের ভিতরে একমাত্র মনোরমা দেবী আর সঞ্জয় বাবুর আচরণই পুরোপুরি নিঃস্বার্থ মনে হয় ওর।যাঁরা বাবা মা হিসেবে সন্তানের মঙ্গলের জন্য মেয়েকে আদর শাসন দুই দিয়েই একেবারে বুকে আগলে রাখেন।এই পরিবারে সঞ্জয় বাবু ই একমাত্র সদস্য...যিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎই এক গরীব ঘরের মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে এনে তোলেন প্রায় এক কাপড়ে।পরে অবশ্য মনোরমা দেবীর বাবা তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয় ভাঙ্গিয়ে পুরোপুরি নিঃস্ব হয়েই কিছু যৌতুকের ব্যবস্হা করে সেগুলি দেবার জন্য এসেছিলেন এই চক্রবর্তী পরিবারে।কিন্তু তার আনা যৌতুক দেখে অব্দি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে গায়ত্রী দেবী যারপরনাই অপমান করে ওনাকে প্রায় ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দেন।সেদিন থেকে আর মনোরমা দেবীর বাপের বাড়ির কেউই আর এমুখো হন না।আর মনোরমা দেবী যে এই বাড়ির পুত্রবধূ হিসেবে তাঁর প্রাপ্য সম্মানের কতটুকু পান...তা তো হিয়া দেখতে পায় প্রতিনিয়তই।তাঁর সুমিষ্ট সুন্দর স্বভাব আর যাবতীয় ভালো গুণ এই একটা জায়গাতেই পুরোপুরি চাপা পড়ে যায়।গায়ত্রী দেবী তাঁর গহনার ভাগ বাকি সমস্ত পুত্রবধূকে দিলেও তা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত মনোরমা দেবী।এ নিয়ে তাঁর কোনো ক্ষোভ নেই।তিনি সম্পূর্ণ বিনা স্বার্থেই গায়ত্রী দেবীর সমস্ত হুকুম তামিল করে তাঁর সেবা করে চলেন আর এই সমস্ত কিছু থেকে ছাড় পেয়েছেন এই বাড়ির বাকি পুত্রবধূরা।প্রকৃত সম্মান আর ভালোবাসা আসলেই কে পাওয়ার দাবী রাখে এই এতবড় বড় মানুষগুলো সেটা বুঝতে পারে না।যে সবুজ ঘাস দেখে দেখে দূর থেকে মুগ্ধ হত হিয়া...তা এই কয়েক মাসে ওর চোখে বেশ খানিকটা ফিকে হয়ে আসতে শুরু করেছে বটে...কিন্তু মোটের ওপর দিন ওর কাটছে দারুণ।এমনই এক রবিবারের ছুটির দিনে হিয়া উঠে পড়ল বেশ সকাল সকাল।তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে...জলখাবার খেয়ে...ও ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল ওর প্রিয় জায়গায়।ফুলে ফলে ভর্তি বাগানের ভিতরে...যেখানে শত শত রঙিন প্রজাপতি মনের আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে...সেখানে এই শীতের সকালে বসে রোদ পোহাতে ভারি ভালো লাগে ওর।স্কুলের অল্প কিছু হোমওয়ার্ক বাকি ছিল।ও ওর বইখাতা নিয়ে সেখানেই বসে গেল আঁক কষতে।হঠাৎ এমন সময়ে ও ঘাড়ের কাছে অনুভব করল...একটা উষ্ণ নিঃশ্বাস।ও অবাক হয়ে পিছনে তাকাতেই বেশ অবাক হয়ে গেল।ও দেখল...ওর ঠিক পিছনে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুশীল।অদ্ভুত ব্যাপার...এখন ওর চোখে সেই আড়ষ্টতার চিহ্ন একটুকুও নেই।রীতিমতো হিয়ার চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে রয়েছে সুশীল।ঠান্ডা গলায় মৃদু হেসে বলল সুশীল..."এখানে বসে বসে কি করছ পরী?" এই প্রথম সুশীল কথা বলল হিয়ার সঙ্গে।ও আমতা আমতা স্বরে বলল..."এই স্কুলের হোমটাস্কগুলো করছিলাম...।" "তা বেশ বেশ...মন দিয়ে পড়াশোনা করো।তা এখন একটু আমার সঙ্গে এসো তো একটা জায়গায়...!" "কোন জায়গায়?" "আঃ...প্রশ্ন কেন করছ বলো দেখি...এসোই না আমার সঙ্গে...এলে কিন্তু ভালো চকলেট পাবে তুমি।" এই বলে পকেট থেকে সত্যি সত্যিই সুশীল বার করে ফেলল রঙচঙে রাঙতায় মোড়া রীতিমতো দামী চকলেট।ওটা বার করে হিয়ার দিকে এগিয়ে ধরতেই ওটা হাত বাড়িয়ে নিতে গেল হিয়া।কিন্তু ওটা হাতে নেবার আগেই হুশ করে ওটা সরিয়ে ফেলল সুশীল।তারপর বলল..."আগে আমার সঙ্গে চলো...তারপর এটা দেব।" এরপর হিয়া সুশীলের সাথে যেতে রাজী হল।সুশীল ওকে নিয়ে যেতে থাকল বাগানের আরো গভীরে...একেবারে ভিতরের দিকে...।যে জায়গাটা একেবারে জংলা গাছগাছালিতে ভর্তি।বহুদিন যে এই জায়গাটা পরিষ্কার করা হয় না...সেটা বোঝা যায়।তাছাড়া বাগানের এই অংশটায় কেউই বড় একটা আসেও না।সেই জায়গার ভিতর দিকে একটা জায়গায় এনে সুশীল দাঁড় করাল হিয়াকে।তারপর ওর ডানহাতটা চেপে ধরল বেশ শক্ত করে।ওর চোখের দিকে এখন সুশীল যে দৃষ্টিতে তাকাল...সেই দৃষ্টি দেখে যেন রক্তহিম হয়ে এল হিয়ার। হিমশীতল কন্ঠে সুশীল হিয়াকে প্রশ্ন করল..."এখানে দাঁড়িয়ে আমাকে সত্যিটা বল...তোর কি কিছুই মনে পড়ছে না?নাকি আমার সঙ্গে মস্করা করে চলেছিস তুই?তোর মতলবটা আমায় বল।" এত জোরে সুশীল চেপে ধরে রয়েছে হিয়ার হাতখানা...যে কোনোমতে সেখান থেকে ছুটে পালাবার উপায় নেই ওর।এই মাঘ মাসের শীতেও যেন হিয়ার সারা শরীরে ঘাম ছুটে যাচ্ছে।ও লক্ষ্য করল...সুশীলও রীতিমতো দরদর করে ঘামছে।সারা শরীর যেন কাঁপছে ওর।হিয়া কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।ও আর নিতে পারল না।ভয়ে আতঙ্কে একেবারে দিশাহারা হিয়া হঠাৎ এক কান্ড ঘটিয়ে বসল।সুশীলের হাতা সজোরে এক কামড় বসিয়ে দিল।হঠাৎ করে এমন "কামড় খেয়ে সুশীল বাবা গো মা গো বলে হাত চেপে ধরে বসে পড়ল...আর সেই সুযোগে পড়ি কি মরি করে রীতিমতো ভীতস্ত্রস্ত হরিণশিশুর মতো পাঁই পাঁই করে ছুট লাগাল।একেবারে ঘরের দোরগোড়ায় পৌঁছোনোর আগে অব্দি সে থামল না। প্রচন্ড এই শীতের রাতে হিয়ার ধূমজ্বর এল।হিয়ার শরীর স্বাস্থ্য এমনিতে বেশ শক্তপোক্ত।সহজে কাবু হয়ে পড়ার মেয়ে ও নয়।আপাদমস্তক লেপ দিয়ে নিজেকে আবৃত করে নরম বিছানায় পড়ে রীতিমতো কাঁপছে হিয়া।ওকে নিয়ে ফের চিন্তিত হয়ে পড়লেন মনোরমা দেবী।ডাক্তার ডাকা হল।কিন্তু ডাক্তার এসে হিয়ার লক্ষণ দেখে এইরকম অদ্ভুত জ্বরের কোনো কারণ হদিশ করতে পারলেন না।এ জ্বর ঠান্ডা লাগার কারণবশত যে আসেনি এটা মনোরমা দেবী বুঝেছিলেন।কিন্তু ডাক্তার এসে হিয়াকে দেখেশুনে...জ্বরের কারণ হদিশ না করতে পারলেও তিনি মনোরমা দেবীকে স্পষ্ট সাবধানবাণী দিয়ে গেলেন..."মেয়েকে একদম চোখে চোখে রাখবেন বৌদি...লক্ষণ ভালো নয়।" জ্বর কমানোর কিছু ওষুধ দিয়ে উনি চলে গেলেন বটে...কিন্তু এতে যে আদৌ কোনো সুরাহা হল না...সেটা দিনকয়েক পার হওয়ার পরেই বোঝা গেল।এ জ্বর কমার বদলে রীতিমতো হু হু করে বাড়তে শুরু করল।থার্মোমিটারের পারদ যেভাবে চড়তে শুরু করেছে...তাতে এতখানি তাপমাত্রা কোনো মানুষের শরীরে থাকলে তার যে রীতিমতো প্রাণসংশয়ের উপক্রম হওয়ার কথা...এটা বুঝতে কোনো বাকি নেই ডাক্তারবাবুর।এমনতরো জ্বরের কারণ খুঁজতেই রীতিমতো কালঘাম ছুটে যাচ্ছে তাঁর।জ্বর কমানোর ওষুধও এখন একেবারে ফেল মেরে যাচ্ছে।বাড়িশুদ্ধ সমস্ত মানুষজন ফের পরীকে নিয়ে ভীষণভাবে চিন্তিত হয়ে পড়ল।চিকিৎসা চলছে যথাসম্ভব...আর তার সাথে সাথে পরীর জ্বরটাও বেড়েই চলেছে একেবারে পাল্লা দিয়ে।এইবার লন্ডন থেকে ডাক্তারী পাশ করে আসা ডাক্তার হাল ছেড়ে দিলেন।বললেন..."ওর এই জ্বর ঠিক করা আমার সাধ্যের বাইরে।আপনারা ওকে বাইরে থেকে চিকিৎসা করিয়ে চেষ্টা করে দেখুন...।"তখন সকলের মাথায় রীতিমতো বাজ ভেঙ্গে পড়ল।ওর শরীরে হাত ঠেকালেই হাত একেবারে ঝলসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।এমতাবস্থায় এই মেয়েকে নিয়ে ছোটাছুটি করতে হবে! "মেয়েটা আমার বাঁচবে তো!" মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন মনোরমা দেবী।গায়ত্রী দেবী নিজে হিয়ার গা থেকে থার্মোমিটারটা খুলে নিতে গেলেন...আর তখনই যেটা ঘটল...সেটার জন্য কেউ আদৌ প্রস্তুত ছিল না।হিয়ার শরীরের সংস্পর্শে থার্মোমিটারটি মিনিট দুয়েক মতো থাকার পর...প্রচন্ড তাপপ্রবাহের কারণে সেটি একেবারে সশব্দে ভেঙ্গে গিয়ে ছিটকে চারদিকে ছড়িয়ে গেল তরল পারদ।ব্যাপার দেখে প্রবল আতঙ্কে আর বিস্ময়ে একেবারে দেওয়াল ধরে থরথর করে কাঁপতে শুরু করলেন গায়ত্রী দেবী।মনোরমা দেবী একছুটে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে গেলেন...কিন্তু হিয়াকে স্পর্শ করামাত্রই "ও মা গো" বলে মনোরমা দেবী প্রচন্ডভাবে ছিটকে বিছানার থেকে সাতহাত দূরে চলে এসে ছটফট শুরু করে দিলেন নিজের ডানহাতখানি...অন্যহাতে প্রচন্ডভাবে চেপে ধরে।ডাক্তারবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন বেশ খানিকক্ষণ আগেই।এখন সে ঘরে হিয়ার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে সঞ্জয় বাবু...গায়ত্রী দেবী...পরীর মেজো আর ছোটোকাকি...আর বাড়ির পরিচারিকা মালতী।দেওয়ালের এককোণায় দাঁড়িয়ে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন মনোরমা দেবী।কারোর মুখে কোনো ভাষা নেই।প্রত্যেকে যেন ছবির মতো স্হির।খানিক বাদে মালতী ধীরপায়ে এগিয়ে গেল মনোরমা দেবীর কাছে। "বৌদিমণি...কি হইছে আপনের?"---বলে যেই তাঁর ডানহাতখানা টেনে নিয়ে দেখল মালতী...সাথে সাথে আতঙ্কে ওর ভিতর থেকে একেবারে আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল।"উরে সব্বোনাশ!এ তো হাতটায় এক্কেবারে ফোসকা পড়ে গেছে গা...।" বিলক্ষণ তাই!মনোরমা দেবী তাঁর ডানহাতের যে অংশ দিয়ে স্পর্শ করেছিলেন হিয়াকে...হাতের ওই অংশটা জুড়ে একেবারে ঝলসে পুড়ে ফোসকা পড়ে...সেখানকার পোড়া চামড়াখানি বীভৎসভাবে ঝুলে রয়েছে।এই দৃশ্য এবার ভালোভাবে দেখল প্রত্যেকে।ভয়ে...আতঙ্কে এবার আর কারোর মুখ থেকে কোনো কথা সরল না।থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে দুইচোখ বুজে গায়ত্রী দেবী দুইহাত উপরে জড়ো করে তুলে কম্পিত কন্ঠে বলে উঠলেন..."হে রাধামাধব...রক্ষে করো...রক্ষে করো...!" ওই আগুন ছোটা শরীর হতে হঠাৎ করে এতটাই উত্তাপ বেরোনো আরম্ভ হয়েছে...যে ও যে বিছানাতে শুয়েছিল এতক্ষণ...সে বিছানা বালিশে পোড়ার দাগ ধরা আরম্ভ হয়ে গিয়েছে।ভীষণভাবে আঁতকে উঠে কোনোমতে বিছানা ছেড়ে নেমে বাথরুমের দিকে দৌড় দিল হিয়া।থামল একেবারে বাথটাব পর্যন্ত।বাথটাবে কোনোমতে জল ভর্তি করে...তারপর তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল হিয়া।ততক্ষণে সকলে সেখানে চলে এসেছে।ওরা প্রত্যেকে বিস্ময়দৃষ্টিতে দেখতে থাকল...হিয়া জলের ভিতরে নিজের শরীরখানি মেলে দেওয়ার সাথে সাথে ওই জল হতে কিরকম গলগল করে ধোঁয়া নির্গত হতে শুরু করেছে! সকাল হয়ে এসেছে।হিয়ার ঠিকঠাক চিকিৎসার জন্য ভেলোরে যাওয়ার জন্য সমস্ত প্ল্যানপ্রোগ্রাম করা থেকে টিকিট পর্যন্ত কাটা হয়ে গিয়েছে সঞ্জয় বাবুর।গতকাল রাত্রিটা যে কিভাবে কেটেছে সকলের...তা আর কহতব্য নয়।মেয়ের অমন অবস্হা দেখে আর নিতে না পেরে মনোরমা দেবী জ্ঞান হারান।একদিকে বাড়ির মেয়ের অমন আশ্চর্য ব্যামো...আর অন্যদিকে সংজ্ঞাহীন মনোরমা দেবীকে নিয়ে...সবাই মিলে রীতিমতো নাকানিচোবানি খেয়েছিল গোটা রাতটা।এখন মনোরমা দেবী একটু ধাতস্হ হয়েছেন।আর পরী...থুড়ি...হিয়ার শরীরও অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।শরীর থেকে চলে গিয়েছে অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ।আর আগের চাইতে অনেকটা ঝরঝরে আর তরতাজা অনুভব করছে ও।শরীরে আর কোনো যন্ত্রনা বা কষ্ট তো দূর...সামান্য অস্বস্তিটুকুও নেই।সকালের পরে মনোরমা দেবীকে দেখতে যখন ডাক্তারবাবু এলেন...তখন হিয়াকে দেখে তো তিনি অবাক!একদম স্বাভাবিক আর সুস্থ হয়ে গিয়েছে সে।গতকাল রাত্রে পর্যন্ত ওই শরীরটার ওপর দিয়ে যা গেছে...তার কোনো চিহ্নমাত্র নেই।আর এইসব দেখেশুনে মনোরমা দেবীও আগের চেয়ে অনেক ভালো বোধ করছেন।সবটা দেখেশুনে যারপরনাই অবাক হলেন ডাক্তারবাবু।আর তার সাথে খুশিও হলেন।স্টেথোস্কোপ দিয়ে মনোরমা দেবীকে চেকআপ করতে করতে হাসিমুখে বলে উঠলেন..."আর কোনো চিন্তা নেই সঞ্জয়...তোমার বউ আর মেয়ে দুজনেই এখন একেবারে বিপদমুক্ত।আর টিকিটের ঝক্কিঝামেলা পুইয়ে দূরে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই তোমার।বুঝলে?" ডাক্তার বাবুর কথা শুনে গায়ত্রী দেবী হাতদুটো জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে বলে উঠলেন..."জয় রাধামাধবের জয়!" সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠল আগের মতো।কিন্তু হিয়ার এই অস্বাভাবিক জ্বরের পর এবার যখন ও এক রাতের ভিতরেই পুরোপুরি সুস্হ হয়ে উঠল...তারপর থেকেই সবাই লক্ষ্য করতে শুরু করল...চক্রবর্তী পরিবারের একমাত্র মেয়ে পরীর স্মৃতি ফিরে এসেছে পুরোপুরি।বাইরে থেকে মনে করানোর ফলপ্রসূই নয়...ও যে এই চক্রবর্তী পরিবারে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ফিরে এসে...সবকিছুকে ওর ভিতর থেকে অনুভব করতে...চিনতে শুরু করেছে...এটা এখন প্রত্যেকে বুঝতে পারছে।ওকে এখন আর বাইরে থেকে ধরে এনে এই পরিবারের মেয়ে করে রাখবার প্রয়োজন পড়ছে না।ও এখন নিজে থেকে মনে করতে পারছে সমস্তটাই।মাসছয়েক আগে যে মেয়েটাকে ওরা সবাই হারিয়ে ফেলেছিল...এক রাতের ভিতরেই যেন সে আবার ফিরে এল।এখন চক্রবর্তী পরিবারের সবাইকে বড় খুশি...বড় নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে।যেদিন পরী নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল...সেদিন সন্ধ্যায় ও মায়ের কাছে মালপোয়া খাওয়ার আব্দার করেছিল...এখন মালপোয়া বানাতে গেলে তো এই এত বড় পরিবারের বৌ হয়ে উনি তো আর একা নিজের মেয়ের জন্য বানাতে পারবেন না...কাজেই এই গোটা পরিবারের খাওয়ার জন্য পরিমাণটাও করতে হবে প্রচুর...আর তার জন্য লাগবে সেরকম যোগাড়যন্ত্র।রাতের খাবার তৈরির প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া মনোরমা দেবী মেয়েকে বলেছিলেন...পরদিন সন্ধ্যার মধ্যেই তিনি মেয়েকে মালপোয়া তৈরি করে খাওয়াবেন।আর সেইদিন রাতের পর থেকেই জলজ্যান্ত মেয়েটাই উধাও হয়ে গিয়েছিল।আজ হঠাৎ সে মা কে হঠাৎ পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল..."মা...তুমি আমাকে বলেছিলে না...আমাকে মালপোয়া করে দেবে।এতদিন বাদে তুমি এটায় সেটায় ভুলেই গেছ।আজ আমি শুনব না।আজ আমায় বানিয়ে দিতেই হবে।" হিয়ার মুখে এ কথা শুনে যে কি খুশি হলেন মনোরমা দেবী...তার কোনো ইয়ত্তা নেই।পরিবারের প্রত্যেকের রাতের খাবার তৈরির দায়িত্ব মনোরমা দেবীর ওপর থাকা সত্ত্বেও তিনি তড়িঘড়ি নিবারণ কাকাকে ডেকে ফর্দ করে সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে আসতে বললেন আর প্রস্তুতি তে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন একটা অনির্বাচনীয় উচ্ছ্বাস নিয়ে। গায়ত্রী দেবীর কাছে গিয়ে হিয়া বলল..."ঠাকুরমা...সামনে কলিপিসির বিয়ে আসছে না...আমি আমার সমস্ত গয়নাগুলো বার করে দেখেছি...আমার ড্রেসের সাথে ওগুলোর কোনোটাই ঠিক যাচ্ছে না।তোমার কাছে একটা পান্নার ছোট্ট কানপাশা ছিল আমি দেখেছিলাম ছোটবেলায়...আমাকে ওইটা বার করে দিতে হবে।আমার ড্রেসের সাথে ওটা খুব যাবে।" হিয়ার কথাগুলো শুনে গায়ত্রী দেবী এত খুশি আর এত নিশ্চিন্ত হলেন যে তা আর বলবার নয়।তাঁর ওই বাক্সবন্দী গহনার খবর তাঁর খুব কাছের মানুষজন ছাড়া আর কারোর চোখেই পড়ার কথা নয়। হিয়ার প্রতিটি আচার আচরণে...কথাবার্তা আর কাজেকর্মে...ক্রমাগত পরী এমনভাবে জীবন্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে...যে সেই আনন্দে গায়ত্রী দেবী এই চক্রবর্তী পরিবারে তাঁর রাধামাধবের উদ্দেশ্যে ধন্যবাদজ্ঞাপনের জন্য বড় করে পূজো এবং কাঙালিভোজনের আয়োজন করলেন।এখন চক্রবর্তী পরিবারের ভিতর যেন উৎসবের আমেজ চলছে।প্রচুর কাজ এখন।এখন গায়ত্রী দেবীর সুশীলকে বড়ো দরকার।কিন্তু এটা নিয়ে গায়ত্রী দেবী পড়েছেন মহা মুশকিলে।সে ছেলে কে তো বলতে গেলে খুঁজেই পাওয়া যায় না আজকাল।সবসময় কেমন যেন চোরের মতো লুকিয়ে গুটিয়ে...চোখের আড়াল হয়ে থাকছে ও...আর যখন তখন উধাও হয়ে যাচ্ছে।কি যে চিন্তা নিয়ে থাকে ও...আর কি যে করে বেড়ায়...তার থৈ পাওয়াটাই বড় ঝঞ্ঝাট গায়ত্রী দেবীর কাছে। গোটা চক্রবর্তী পরিবারের ভিতরে এখন আনন্দের আবহ।মেয়ে সুস্হ হয়ে হয়ে উঠছে একেবারে আগের মতো।ঘরের মেয়ে ফের শরীরে মনে ঘরে ফিরে এসেছে...মনোরমা দেবী...সঞ্জয় বাবু আর গায়ত্রী দেবীর আনন্দ যেন আর ধরে না।গোটা বাড়ির ভিতরে যেন উৎসবের আবহ।কারোরই কারোর দিকে দৃষ্টি স্হির রেখে তাকানোর...বা কোনোকিছু নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করার মতো আবহটাই নেই।ঘরের মেয়ে পরী সু্স্হ স্বাভাবিক হয়ে আবার ঘরের মেয়ে হয়ে উঠছে...এটা সকলে বুঝতে পারলেও...আরো অনেক কিছু ঘটে চলেছে সকলের চোখের সামনেই...যেগুলো সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে।চক্রবর্তী পরিবারের ভিতরে এখন যে অকাল উৎসবের আমেজ...তাকে প্রায় ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতোই দায়সারা ভাবে কোনোমতে দায়িত্ব কর্তব্যের বেড়াজাল ডিঙিয়ে সুশীল যেটুকু যা বোধগম্য করতে পেরেছে... তাতে এখন যেন হাত পা পেটের ভিতরে একেবারে সেঁধিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে ওর।ও না পারছে কাউকে কিছু বলতে...আর না পারছে সবটা নিজের ভিতরে চেপে রাখতে।যেটা সাদাচোখে সকলের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে...সেইগুলো সুশীলের চোখে যেন কাঁটার মতো এসে বিঁধছে।ভয়ংকর একটা বিপদের অশনিসংকেত ও প্রতিটা মূহুর্তে মর্মে মর্মে অনুধাবন করে ওর অন্তরাত্মা শিহরিত হয়ে উঠছে। চক্রবর্তী পরিবারের ভিতরে সমস্ত অনুষ্ঠানাদি শেষ হল ভালোভাবে।এখন ঘরের ভিতরকার পরিবেশটা একটু চুপচাপ...শান্ত হয়েছে।পূজোর যাবতীয় আয়োজন...লোকজন নিমন্ত্রণ...খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত নিয়ে বিস্তর ব্যস্ততা আর মাথাব্যথার পর এখন সবাই এখন একটু হাল্কা হয়েছে।ঘরের ভিতরের শোরগোল সব শান্ত হয়ে এখন বেশ নৈঃশব্দ্যতা বিরাজ করছে।নির্জন দুপুর।গায়ত্রী দেবী নিজের ঘরে বসে একটু বিশ্রাম করছেন।এমন সময়ে বিড়ালের মতো নিঃশব্দে তাঁর ঘরের দরজার সামনে এসে যে দাঁড়াল...সে সুশীল।অন্য সময় হলে গায়ত্রী দেবীর ঘরে ঢোকার জন্য ওর আলাদা করে কোনো অনুমতি টনুমতির ধার ধারতে হত না।কিন্তু এখন সুশীলের মনের অবস্থা একেবারেই অস্হির...টালমাটাল।যে কথাটা বলবার জন্য এখন ও এসেছে...সেটা যে গায়ত্রী দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে বলাটা খুব একটা সহজ কথা নয়...এটা ও ভালভাবেই জানে।এই কথাগুলো গায়ত্রী দেবীর এক্ষুণি জানাটা খুবই প্রয়োজন...এবং তাঁর সামনে গিয়ে এইভাবে কথাগুলো সরাসরি বলা ব্যতীত আর কোনো উপায়ই নেই।কিন্তু এগুলো তাঁর সামনে বলতে যাওয়াটাই যেন এখন সুশীলের নিজের কাছেই নিজের একটা চ্যালেঞ্জ।ওর বুকের ভিতরে যেন কামার হাতুড়ি পিটছে।কিন্তু সত্যি বলতে কি...ওর সামনে আর কোনো উপায় নেই।যেমন করেই হোক...ওকে গায়ত্রী দেবীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলতেই হবে।দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ক্ষীণকন্ঠে মিনমিন করে গায়ত্রী দেবীর কাছ থেকে অনুমতি চাইল সুশীল..."ভিতরে আসব দিদুন?" সুশীলকে দেখে প্রসন্ন মুখে গায়ত্রী দেবী বলে উঠলেন..."আরে সুশীল যে...আয় আয়...এখানে আমার কাছে এসে বস।" একবুক সাহস সঞ্চয় করে এক পা এক পা করে সুশীল গায়ত্রী দেবীর সামনে এগোতে থাকল...আর ওর ভিতরে চলতে থাকা টালমাটাল ঝড়টাকে কোনোমতে সামলে ওর ভিতরের কথাগুলোকে এপিঠ ওপিঠ সাজিয়ে নিতে থাকল। সুশীলের মুখে কথাখানি শোনার পর গায়ত্রী দেবী যে দৃষ্টিতে তাকালেন ওর দিকে...তাতে সুশীল এটা স্পষ্ট বুঝতে পারল...সুশীলের মুখ থেকে কথাখানি আরেকবার শুনতে চাইছেন তিনি।যাচাই করতে চাইছেন...এক্ষুনি যেগুলি সুশীলের মুখ থেকে শুনলেন...কথাগুলো আদৌ সেইটাই ছিল কিনা!প্রচন্ড এক দোলাচলে এবার সুশীলের একেবারে টালমাটাল অবস্থা।ও নিজের হাতের মুঠো শক্ত করে নিজের মনের ভিতরে যথাসম্ভব সাহস এনে ফের সুশীল বলে উঠল..."পরীকে তুমি ঘর থেকে বার করে দাও দিদুন।ও যে তোমাদের সব্বাইকে ঠকিয়ে চলেছে... সেটা আর কেউ না জানুক...আমি জানি " কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে প্রায় হাঁপাতে থাকল সুশীল। গায়ত্রী দেবী এবার বড় বড় চোখ করে তাকালেন সুশীলের দিকে। "কি বলছিস তুই!পরী আমাদের ঠকাচ্ছে!ওকে বাড়ি থেকে বার করে দেব!মাথাটা কি পুরোপুরিই গেছে তোর!" এবার মরিয়া হয়ে উঠল সুশীল।ও প্রায় হাঁ হাঁ করে ছুটে এসে একেবারে গায়ত্রী দেবীর পায়ের কাছে বসে পড়ে বলতে শুরু করল।"বিশ্বাস করো দিদুন...আমি এক বর্ণও ভুল বলছি না।যাকে তোমরা নিজেদের ঘরের মেয়ে ভাবছ...ও আদৌ এ বাড়ির মেয়ে না।ও আসলে একটা মায়াবিনী।ও আজ পরী সেজে আমাদের সবাইকে ঠকাচ্ছে।কাল যে এই গোটা পরিবার জুড়ে সর্বনাশের কালোমেঘ ঘনিয়ে আসবে... সেটা আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।কথাগুলো আমি ভরসা করে তোমাকে বললাম...এ পরী নয়...হতে পারে না...এ আমার চাইতে ভালো আর কেউ জানে না...।বড় কোনো সর্বনাশ ঘটার আগে যত তাড়াতাড়ি পারো...এই মায়াবিনী বহুরুপীকে ঘর থেকে বিদেয় করো দিদুন...এখনো সময় আছে...।" গায়ত্রী দেবী লক্ষ্য করলেন...এই মাঘ মাসের সন্ধ্যাতেও রীতিমতো দরদর করে ঘামছে সুশীল। চারপাশে এখন পিনপড়া নিস্তব্ধতা।শুধু দেওয়াল ঘড়িটা ক্রমাগত নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে চলেছে।টিক...টিক...টিক...টিক।এই কদিনের ব্যস্ততায় কারোর দিকেই ঠিকমতো খেয়াল করার সুযোগ পাননি গায়ত্রী দেবী।এখন সুশীলের মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন গায়ত্রী দেবী।একটা ভয়ানক কোনো দুশ্চিন্তা যেন একেবারে গ্রাস করে ফেলেছে ছেলেটাকে।ওর চোখের তলায় কালি পড়ে গিয়েছে।গায়ত্রী দেবী সুশীলের কপালে...বুকে হাত দিয়ে দেখলেন...।না।জ্বরটর নেই। তিনি এবার সুশীলকে বললেন..."বাবা সুশীল...তোমায় একটা কথা বলি...বয়সটা কিন্তু নেহাত কম হয়নি এখন তোমার।এবার নিজের জীবনের প্রতি একটু সিরিয়াস হও।এতদিন ধরে তুমি তোমার ইচ্ছামতো চলেফিরে বেরিয়েছ...আমি কিছু বলিনি।কিন্তু আমার স্বর্গত ভাইটাকে তো জবাব আমাকেই দিতে হবে একদিন...তোমার জীবনের একটা ঠিকঠাক গতি না দেখলে আমি মরেও শান্তি পাব না।কাল থেকে তোমার এই এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি...আজ এই কাজ...কাল ওই কাজ...এই সমস্তকিছু বন্ধ।আমি সঞ্জয়কে বলব...তোমার জন্য একটা স্হায়ী কাজের একটা বন্দোবস্ত করে দিতে।কাজ ভালো লাগুক...না লাগুক...সে কাজই তুমি করবে।আর খুব শীঘ্র আমি তোমার একটা বিয়ের ব্যবস্হা করব।নিজের কাজকর্ম আর নিজের ঘর সংসার নিয়ে থাকবে।কোনো ভুলভাল চিন্তাভাবনা আর আমি তোমার মধ্যে দেখতে চাই না।বুঝতে পেরেছ!রাত হতে যায়...এখন তুমি তোমার নিজের ঘরে যাও।আমার পূজোর কাজগুলো সারতে হবে এখন।" উঠে দাঁড়িয়ে হাই তুললেন গায়ত্রী দেবী।তারপর বাতে ধরা পা সামলে ক্ষীণগতিতে ঠাকুরঘরের দিকে এগিয়ে চললেন। সুশীল তো পড়ল মহা ঝামেলায়...গায়ত্রী দেবী যে আদৌ ওর কথাগুলো ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি...সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারল সুশীল।ও ধড়মড় করে উঠে পড়ে একেবারে গায়ত্রী দেবীর পথ আটকে দাঁড়িয়ে গেল।ওর চোখের দৃষ্টিতে যে অসম্ভব রোখ...সেটা এবার পরিষ্কার দেখতে পেলেন গায়ত্রী দেবী।সুশীলের এমনতরো আচরণে তিনি এবার যতখানি বিস্মিত...ততটাই ক্রুদ্ধ।অন্তত যেভাবে ও গায়ত্রী দেবীর হাতখানি সবলে চেপে ধরেছে...তাতে গায়ত্রী দেবীর এখন এইটাই মনে হচ্ছে...এই ছেলেটাকে সঠিক শিক্ষা দিয়ে মানুষ তিনি করে উঠতে পারেননি।তিনি যারপরনাই কড়া এবং ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে এবার তাকালেন সুশীলের দিকে।এবার সুশীলও বুঝতে পারল...কাজটা মোটেই ঠিক হয়নি।কিন্তু ও এখন আর কিই বা করবে...কথাগুলো যেভাবেই হোক...গায়ত্রী দেবীকে বোঝাতেই হবে।ও হাতের পেশীর জোর আলগা করে যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে এবার শান্ত এবং ঠান্ডা স্বরে গায়ত্রী দেবীকে বলল..."দেখো দিদুন...তুমি যেমন বলবে...ঠিক তেমনটাই করব আমি।কিন্তু এখন তুমি দয়া করে আমার কথাগুলো শোনো।আমি বলছি...ওই মেয়ে সর্বনাশিনী...কালনাগিনি।আমাদের সবাইকে শেষ করার জন্য এসেছে।ওকে যত তাড়াতাড়ি পারো তাড়িয়ে দাও এ বাড়ি থেকে।তোমার ওপরে এ বাড়িতে কেউ কথা বলবে না।এ বাড়ির অভিভাবক তো তুমি!" কথাগুলো যদিও অনুরোধেরই ছিল...কিন্তু যে রোখ নিয়ে কথাগুলো বলছিল সুশীল...তাতে যেন মনে হচ্ছিল...সেগুলি ওর কড়া হুকুম। এবার প্রচন্ড রেগে গেলেন গায়ত্রী দেবী। "মাথাটা কি তোমার পুরোপুরিই খারাপ হয়ে গেছে?ওইটুকু একটা বাচ্চা মেয়ের সম্বন্ধে তুমি কি ধরণের কথা বলছ তা জানো তুমি?দেখো...বহুদিন পর আমার সংসারটায় একটু শান্তি এসেছে।তুমি আবার নতুন কোনো আজগুবি কথাবার্তা তুলে সেগুলো নিয়ে ফালতু ঝামেলা পাকিও না।যতসব!" এই বলে গটগট করে ঠাকুরঘরের দিকে এগোলেন গায়ত্রী দেবী। সুশীল এবার একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল।ওর যেন মনে হতে লাগল...একটা অতল অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভিতরে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দী হয়ে পড়ছে ও...যেখান থেকে মুক্তির আর কোনো রাস্তাই নেই।এমন সময়ে হঠাৎ ও শুনল হিয়ার গলা।ও ঠাকুরমাকে বলছে..."ঠাম্মি...গতবছর যে সোয়েটারটা বানাচ্ছিলে আমার জন্য...ওটা শেষ হয়েছে?" ঠাকুর ঘরের দরজার কাছ হতে জবাব এল..."হ্যাঁ মা...হয়েই গিয়েছে।শুধু বোতাম লাগানো বাকি।" ওটা কালকেই আমাকে কম্প্লিট করে দিও...বড্ড ঠান্ডা পড়েছে।ওটা গায়ে দিলে আরাম হবে আমার।" ---"হ্যাঁ সোনা...আমিই কাল সকালের মধ্যেই করে রাখব কেমন!" ---"আচ্ছা দিদুন...।" এইসব কথপোকথন শুনে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না সুশীল।এই মেয়ে পরী না হয়ে যায় না।কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব! আর পারল না সুশীল।মেঝেয় বসে পড়ে প্রায় নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে বসল ও। চক্রবর্তী পরিবারের সমস্ত কতৃত্ব আর নিয়ম শৃঙ্খলা যাঁর ওপরে সেই গায়ত্রী দেবী কটাদিন বাতের ব্যাথার জন্য ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারছেন না।মনোরমা দেবী যদিও তাঁর সেবাযত্নের কোনো ত্রুটিই রাখছেন না...কিন্তু বাকি সব জায়েদের গা ছাড়া মনোভাব থাকা সত্ত্বেও পরিবারের কোনো ব্যাপারেই কোনো কথা বলার দৃষ্টতা তাঁর সাজে না বলেই এ বাড়ির সকলে মনে করে।কাজেই বিশৃঙ্খলা চোখে পড়লেও তাঁর করবার কিছুই নেই।ঘরে বাজার সঠিক সময়ে এসে পৌঁছোয় না...কারোর সময়ের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই...যেন এটা কোনো পরিবার নয়...একটা সরাইখানা।বাগানের মালীটাও পর্যন্ত কাজে ফাঁকি দিতে শুরু করেছে আর তার ফলে বাগানের ভালো ভালো ফুলগাছ আর ফলের গাছগুলো অযত্ন পেয়ে প্রায় নষ্ট হতে বসেছে।আগাছা ছেয়ে যেতে শুরু করেছে।অনুষ্ঠান টা শেষ হওয়ার পর পরই চক্রবর্তী পরিবারের ভিতরকার পরিবেশটা যেন ক্রমেই বিষাক্ত হয়ে উঠেছে।সকলের চোখে যেন একটা অশান্তি আর অধৈর্য হয়ে পড়ার লক্ষণ স্পষ্ট।এরা সকলে সামনে গায়ত্রী দেবীর সামনে হাত কচলে আর কপট ভক্তি বিনয় রেখে চলে বটে...কিন্তু আড়ালে এরা শুধুই বৃদ্ধার মৃত্যুর জন্য প্রহর গুণে চলেছে।পরীর মেজোকাকা চিন্ময় বাবু আর তাঁর স্ত্রী নলিনী দেবী তো গায়ত্রী দেবীর পায়ের কাছে বসে ইনিয়ে বিনিয়ে শুধু তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করে চলেছেন..."মা গো...তোমার বয়সের ভার এখন বাড়ছে।আর কতদিন সম্পত্তির ঝামেলা পোহাবে!এখন সব আমাদের ঠিকভাবে ভাগ বাঁটোয়ারা করে দিয়ে তুমি বিশ্রাম নাও।দায়িত্ব কর্তব্যের ভার থেকে ছুটি নিয়ে আরাম করো...তোমার দেখাশোনার জন্য আমরা তো রয়েইছি!" এই কথাগুলোই এখন পরিবারের প্রতিটি মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রেই শুধু নয়...দেওয়ালের প্রতিটি ইঁটেদ খাঁজে খাঁজে যেন প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে বড় নগ্নভাবে।পুরো সম্পত্তির একছত্র মালকিন তিনি।শুধুমাত্র এই কারণেই তাঁর মতো এক থান পরিহিতা বৃদ্ধার কথাতে এই পুরো পরিবার উঠছে আর বসছে।কিন্তু এইবার এই একছত্র কতৃত্বের একটা শেষ দেখবার জন্য হাঁপিয়ে উঠেছে ওরা।তাঁর অসন্তোষের কারণে ঘরে লোকজনকে ডেকে নাইটপার্টি করা...মদের আসর জমানো...মাইকে জোরে গান বাজনা চালিয়ে হৈ হুল্লোড় করা এইসব করার...জীবনটাকে এনজয় করার...আনন্দ স্ফূর্তি করার কোনোরকম কোনো উপায়ই নেই।ভিতরের বেলেল্লাপনা করা জন্তুটাকে আর কাঁহাতক ঘুম পাড়িয়ে রেখে সবসময় ভদ্র মানুষ হয়ে থাকা যায়!কিন্তু সম্পত্তির ভাগ বাঁটোয়ারা না হওয়া পর্যন্ত গায়ত্রী দেবীর অনুশাসন হতে পরিত্রাণের কোনো উপায়ই নেই।একমাত্র সঞ্জয় বাদে গায়ত্রী দেবীর বাকি ছেলেরা আর পুত্রবধূরা এখন শুধু চাইছে সম্পত্তির ভাগ বাঁটোয়ারা হয়ে যাক...আর তারপর একজন কানাকড়ি-সহায়সম্বলহীনা বৃদ্ধার শেষ জীবনের গতি করবার জন্য বৃদ্ধাশ্রম তো রয়েছেই...!জীবনটা ইচ্ছামতো উপভোগ করা যাবে...এই চিন্তা মনের ভিতরে রেখে এখন মনোরমা বাদে গায়ত্রী দেবীর বাকি পুত্রবধূরাও তাঁর সেবাযত্ন করার নাটক করা শুরু করে দিয়েছে বটে...কিন্তু মনোরমা দেবীর সেবাযত্নে যে আদর যত্ন আর আরাম পেয়ে তিনি অভ্যস্ত...তা এদের এইসব সাজানো নাটকে একেবারেই পান না।তাই এখন সব পুত্রবধূরা তাঁকে সেবাযত্ন করার জন্য একপায়ে খাড়া থাকলেও গায়ত্রী দেবী সেসব গ্রহণ করতে চান না কোনোমতেই।হা ঘরের মেয়ে বলে প্রতি পদে পদে লাঞ্ছনা গঞ্জনা করার সাথে সাথে মনোরমা দেবীর ছোঁয়ায় আর যত্নেই তিনি শান্তি আর তৃপ্তি পান।ছেলেরা মায়ের জন্য ফল ওষুধ আর আরো আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র এনে এনে তাঁকে তোষামোদ করে ঠিকই...কিন্তু জিনিসগুলো অতিরিক্ত হয়ে যাওয়ায় তিনি সেগুলো একে ওকে দিয়ে দিতে থাকেন।চিন্ময় বাবু তো স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে মাকে সবসময় দেখভাল করে রাখার জন্য একটা কাজের মহিলাও ঠিক করেছিলেন।কিন্তু তাতে বাধ সাধলেন গায়ত্রী দেবী নিজেই।তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য..."এমন কিছু শরীর ভেঙ্গে পড়েনি আমার...যে আমার জন্য সবসময়ের লোক রাখতে হবে।ভাত ছড়ালে তো আর কাকের অভাব হয় না...আমারো তেমনি সেবাযত্ন করার লোকের এমনিতেই অভাব নেই।" কথাটা যে মনোরমা দেবীকে চিহ্নিত করেই বলা...সে সবাই বুঝতে পারছে।যদিও গায়ত্রী দেবীর ওপরে মনোরমা দেবীর ভরণপোষণের ভার অর্পিত নেই।আর তাছাড়া মনোরমা দেবী যদি গায়ত্রী দেবীর দিকে ফিরেও না তাকান...তাহলে এইসব কথা এত গুমর নিয়ে বলার মতো জায়গাই যে তাঁর থাকত না...এ কথা তিনি নিজেও ভালোভাবে জানেন।আসলে...বিপরীত প্রান্ত হতে কোনোপ্রকার বাধা না আসলে কেউ নিজের সীমারেখাটাকে দেখতে পায় না।এক্ষেত্রেও তাই হল।এইসব কথা বাইরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ শোনবার পরে গায়ত্রী দেবীর অনুমতি নিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকে তাঁর পায়ে গরম তেল মালিশ করতে বসে গিয়েছিলেন মনোরমা দেবী।চিন্ময় বাবু ও তাঁর স্ত্রী বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।এ কথা সত্যি...শুধু এক বাতের ব্যথাটার জন্য বড় কষ্ট পান গায়ত্রী দেবী।নাহলে বয়সের তুলনায় তিনি যথেষ্ট শক্তপোক্ত।সহজে অসুস্থ হয়ে পড়ারও সম্ভবনা নেই তাঁর...তো তাঁর মরণ চিন্তা করা টা তো রীতিমতো গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল দেওয়ার মতো ব্যাপার।গায়ত্রী দেবীকে তোষামোদ করার আর কোনো পদ্ধতি আপাতত মাথায় আসছে না কারোরই।এত সেবাযত্ন করার পরেও মরণকালে যে মনোরমা দেবী তাঁর কাছ থেকে একটা কানাকড়িও পাবেন না...এ বিষয়ে নিশ্চিত বাকি সকলেই।সঞ্জয় বাবুর ভাগটাকে কি করে কম করানো যায়...এ বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করতে শুরু করেছে তাঁর মেজো,সেজো এবং ছোট ভাইএরা সকলেই...কিন্তু মা না মরা পর্যন্ত যে তাঁদের সমস্ত হাত পা বাঁধা...এই বাস্তবটাই ওদের ভিতরটা একেবারে অতিষ্ঠ করে ছাড়ছে।তাই প্রত্যেকের একটা গা ছাড়া ভাব।সবার মনে শুধু একটাই চিন্তা..."মা...সম্পত্তি এইবার আমাদের নামে লিখে দিয়ে এ বাড়ির ওপরে...আমাদের ওপরে...তোমার কতৃত্ব ছাড়ো।দেখে নাও নিজের রাস্তা।" কয়েকদিন ধরে বাতের ব্যথাটা চাগাড় দেওয়ায় গায়ত্রী দেবী এখন বেশ কষ্ট পাচ্ছেন।আগের মতো ঘরের প্রতিটি কোণায় কোণায় নিজের কতৃত্ব জারি রাখার মতো অবস্থা এখন তাঁর নেই।ব্যথা নিয়ে তিনি আপাতত থাকেন নিজের ঘরে।মনোরমা দেবীর যেহেতু এ পরিবারের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই...তাই এ বাড়ির রান্নার লোক...কাজের লোক যারা রয়েছে...তাদের এখন প্রতিনিয়ত উপরতলায় গায়ত্রী দেবীর ঘর আর রান্নাঘর...সংসারের কাজ এইসব করতে হয়।তার ওপরে বাড়ির লোকগুলোও এখন হয়ে পড়েছে মহা খিটখিটে।এত খাটা খাটুনি আর তার ওপরে উপরি পাওনা হিসেবে কথায় কথায় মুখঝামটা আর মেজাজের ঠেলায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে ঘরের ভিতরে প্রতিটি কাজের লোক কাজ ছেড়ে পালাল।নিবারণ কাকাকে ছুটি দেওয়া হল।গোটা পরিবারের ভিতরের চিত্রটা তাই এখন অত্যন্তই শোচনীয়।শুধু যে রয়ে গিয়েছে এখনো...সে হল এই বাড়ির মালী।বাগানের সৌন্দর্য ক্রমে ঢাকা পড়ে গিয়ে এখন সেটা হয়ে উঠেছে মশাদের বৈঠকখানা।সন্ধ্যা না গড়াতেই মশার জ্বালায় ঘরে টেকা দায় হয়ে উঠেছে।বাগানটাকে দেখভাল করার কাজে ফাঁকি দেওয়ার জন্য ডেকে পাঠানো হল মালীকে। সে আসতেই তাকে প্রচন্ডভাবে তিরস্কার করা হল।আর হুকুম হল...বাগানের সামনে আর পিছনের অংশ জুড়ে সমস্ত আগাছা যেন পরিষ্কার হয়ে যায় আগামীকাল সকালের মধ্যেই। হাতজোড় করে মালী বলল..."এজ্ঞে বাবু...সামনের অংশটা আজ বিকেলের মধ্যে হয়ে যাবে।কিন্তু পিছনের অংশটা করতে কালকে পর্যন্ত সময় লাগবে।" ---"কেন...পিছনের অংশে আবার আজকে সমস্যা কি!" ধমকের সুরে বলে ওঠেন চিন্ময় বাবু।ঘরভরতি লোকের সামনে আমতা আমতা করতে থাকল মালী।তা দেখে ফের বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে ওঠেন চিন্ময় বাবু। "কি হল!কিসের সমস্যা!' ধমক খেয়ে একবার হিয়ার দিকে সভয়ে তাকাল মালী।তারপর আমতা আমতা করে বলল..."আজ্ঞে...প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার পর পরী দিদিমণি ঘরে না ঢুকে আগে ওইদিকে চলে যান।তারপর ঢোকেন ঘরে।আর আমাকে বারণ করে দিয়েছেন...যে উনি সেখান হতে এসে ঘরে ঢুকে যাওয়ার পর হতে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে যেন আমি নিজে ওখানে না যাই...আর কাউকে যেতে না দিই।কথাটা কাউকে বলা বারণ আমার।কিন্তু এইভাবে ধমক দিলে আমি আর কি করেই বা চেপে রাখব!ওঃ ভগবান!স্কুল থেকে ফিরে এসে নিশ্চয়ই পরী দিদিমণি আমাকে আর আস্ত রাখবেন না!" ওর চোখেমুখে এখন ঘরভর্তি সকলের কাছে একটাই আকুতি প্রকাশ পাচ্ছে...একান্ত গোপনীয় এই কথাটা যে বেমালুম ফাঁস করে ফেলেছে ও...এই খবরটা যেন পরী দিদিমণির কানে না যায়। মালীর কথা শুনে পরিবারের সকলেই বেশ অবাক হয়ে গেল।কিন্তু মুখে চিন্ময় বাবু এবার শান্তভাব বজায় রেখো বললেন..."ঠিক আছে।তুমি আগাছা সাফ করার কাজে লেগে পড়ো।কালকের মধ্যে কিন্তু পুরো বাগান সাফ চাই।কি!ঠিক তো!" "যে আজ্ঞে..." বলে মালী প্রস্হান করল।কিন্তু কেউ লক্ষ্য করেনি...মালীর মুখে এমন একখানি কথা শোনার পরেই সুশীলের কি ভয়ঙ্কর অবস্হাটা হল।ভয়ে...আতঙ্কে...ওর যেন হৃদযন্ত্রের অকাল পতন হয়ে পড়া বাকি তখন।মালীর সাথে কথায় ব্যস্ত থাকায় কেউই খেয়াল করেনি...কিভাবে একছুটে সুশীল সেখান থেকে পালিয়ে গেল।নিজের ঘরে গিয়ে সজোরে ঝাপটা দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে প্রচন্ড আতঙ্কে সুশীলের গলা...জিভ যেন শুকিয়ে আসতে থাকল।ওর শুধু মনে পড়তে লাগল সেই সকালের কথা...যেদিন বাগানের পিছনের ওই জায়গাটাতে হিয়াকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরের ঘটনাটা।কিভাবে ওর হাতে সজোরে কামড়ে দিয়ে মেয়েটা ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল।হিয়া যখন স্কুল থেকে ফেরে...তখন সুশীল ঘরে থাকে না।একটা মেয়ের পিছনে কুকুরের মতো পড়ে থেকে ওকে পাহারা দেওয়ায় ব্যস্ত থাকলে উল্টে হিতে বিপরীত হবে ভেবেই দিদুনের কাছে ভালো থাকার জন্য বাইরে একটা দোকানে ও কাজ করে এখন।আর সেইটাই যে ওর সবথেকে বড় ভুল হয়েছে...সেটা বুঝে ওর এখন নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছা হচ্ছে।পরী কি তাহলে সত্যিই ফিরে এল!এরপর কি হতে চলছে!ভয়ে আতঙ্কে সুশীলের সারা শরীর অবশ হয়ে আসতে শুরু করল। গায়ত্রী দেবী সুশীলকে নিয়ে ইদানীং বড়ই চিন্তিত হয়ে পড়লেন।কি যে করে বেড়াচ্ছে ছেলেটা...আর কিই বা ওর মতিগতি...এইসব ভেবে ভেবে তিনি রীতিমতো দিশাহারা হয়ে পড়ছেন।এই ছেলেটাই ওঁর বাপের বাড়ির বংশের একমাত্র ওয়ারিশ।ওকে যদি সময় থাকতে থাকতে সংসারী করে থিতু করা না যায়...তাহলে ওঁর বাপের বাড়ির বংশ যে এখানেই একেবারে শেষ হয়ে যাবে।ওঁর বড় ছেলে সঞ্জয় ইদানীং ওর ব্যবসা নিয়ে বড়ই ব্যস্ত।ওর এখন একেবারেই সময় নেই মায়ের সঙ্গে দু দন্ড কথা বলার।কিন্তু এখন গায়ত্রী দেবীর বাকি ছেলেরা যে মায়ের একটি ডাক পেলেই তাঁর হুকুম তালিম করার জন্য সামনে এসে দাঁড়াবে...এটা তিনি খুব ভালো করেই জানেন।তিনি আর দেরি না করে ছোট ছেলে মৃন্ময়কে নিজের কাছে ডেকে পাঠালেন।সুশীলের একটা স্হায়ী কাজের বন্দোবস্ত করে দেবার জন্য ছেলেকে খুব করে বললেন।আর তারপর সুশীলের জন্য একটা অভিজাত ঘরের সুশ্রী সুলক্ষণা মেয়ে দেখে রাখতে বললেন সুশীলের জন্য।চিন্ময়বাবু মাকে আশ্বস্ত করলেন...সুশীলের জন্য একটা স্হায়ী কাজের বন্দোবস্ত করে ওকে সেখানেই বেঁধে রাখবার বন্দোবস্ত উনি করবেন।আর পাশাপাশি ওর বিয়ের জন্য মেয়ে পছন্দ করার কাজটাও তিনি নিজেই দায়িত্ব নিয়ে করবেন।যদিও মনে মনে একচোট হেসে নিয়ে তিনি ভাবলেন...এসব ব্যাপারে তাঁকে অন্তত কোনো কষ্টই করতে লাগবে না।সুশীল যে তাঁর হাতের পুতুলমাত্র...এটা একমাত্র সুশীল...আর তিনি নিজে ছাড়া পৃথিবীর কেউই জানে না।একমাত্র ওঁর সামনেই সুশীলের সমস্ত উগ্রতা যে নিমেষে ঠান্ডা হয়ে...জঙ্গলের দাপিয়ে বেড়ানো লেপার্ডটা পরিণত হয় একটা মেনি বিড়ালে।এটা পরিবারের সকলের সাথে সাথে গায়ত্রী দেবীর চোখ এড়ায়নি বলেই চার ছেলের ভিতরে ওকেই এইভাবে একান্তে ডেকে সুশীলের ব্যাপারে অনুরোধ করা।যদিও এর কার্যকারণ নিয়ে কারোরই বিশেষ আগ্রহ নেই...কিন্তু গায়ত্রী দেবী এখন ছোট ছেলের হাতদুখানি চেপে ধরে কাতর অনুরোধ জানালেন।আর পরিশেষে আশ্বস্তও হলেন। সত্যিই মৃন্ময় বাবু তাঁর কথা রাখলেন।মায়ের কথা শুনে পরের দিনই তাঁর পরিচিত এক বন্ধুকে ধরে সুশীলকে ঢুকিয়ে দিলেন একটি কারখানার কাজে।একেবারে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কাজ।কিন্তু সুশীল বিনা প্রতিবাদে...বিনা ক্লান্তিতে ওই কাজ করে যেতে লাগল।কিন্তু এখন মন ওর পড়ে থাকে শুধু চক্রবর্তী বাড়ির পিছনের জলাজঙ্গল হয়ে পড়ে থাকা বাগানের ওই বিশেষ জায়গাটাতে।এখন ও শুধু এইটাই ধরে নিয়েছে...যেভাবে একটা জালের ভিতরে ও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গিয়েছে...তাতে ডাইনে বাঁয়ে আগে পিছে সমস্ত রাস্তাতেই ওর জন্য ফাঁদ পাতা রয়েছে।সর্বনাশ এবার ওর একেবারে ঘাড়ের উপরে চড়ে বসে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে দিয়েছে যে আর কোনোদিকেই আর মুক্তির আশা ওর নেই। এইভাবে মোটামুটি দুইদিন মতো কাটল।দুইদিনের মাথায় ঘটল ঘটনাটা।চক্রবর্তী বাড়ির ভিতরে স্বয়ং গায়ত্রী দেবী নিখোঁজ।প্রতিদিনের মতো ভোরবেলা বাসি কাপড় ছেড়ে স্নান সেরে মনোরমা দেবী বাগান থেকে সাজি ভরে গায়ত্রী দেবীর পূজোর জন্য নিয়ে এসেছিলেন পূজোর গোছা ফুল।গায়ত্রী দেবীর ঘরের দরজার সামনে এসে দেখেন...দরজা তখনো বন্ধ।দরজা বন্ধ দেখে বেশ অবাক হয়ে যান মনোরমা দেবী।যেদিন থেকে মনোরমা দেবী বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে এসেছেন...সেদিন থেকে আরম্ভ করে কোনোদিনই এত দেরি করে শাশুড়ি মাকে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে থাকতে তিনি দেখেননি।শরীর টরীর ঠিক আছে তো মানুষটার! বেশ বিচলিত হয়ে দরজায় মৃদু ধাক্কা দিতে গেলেন তিনি।আর তাতেই ভেজিয়ে রাখা দরজার পাল্লাদুটি দুইপাশে সরে গেল।মনোরমা দেবী দেখলেন...বিশাল ঘরখানি পুরোপুরি ফাঁকা।বিছানার ওপর অগোছালোভাবে পড়ে রয়েছে মখমলে কম্বলখানি।এহেন অস্বাভাবিকতায় একটা কোনো বিপদের অশনিসংকেত পেয়ে মনোরমা দেবীর বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। ঘরের ভিতরে ঢুকে গিয়ে ব্যালকনি...বাথরুম...সমস্ত জায়গায় খুঁজে দেখলেন মনোরমা দেবী।এরপর তিনি ফুলের সাজিটা সেখানেই সশব্দে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।গোটা বাড়িতে গঙ্গাজল ছিটিয়ে শুদ্ধ করার পর আরেকবার ফের তিনি গোটা ঘরময় খুঁজলেন গায়ত্রীদেবীকে।পেলেন না।গায়ত্রী দেবীর পায়ে এখন বাতের ব্যথার প্রকোপ খুবই বেড়েছে।আজকাল তিনি বিছানা থেকেই যতটা সম্ভব কম নামেন।সেই মানুষ একেবারে রাতারাতি পুরো বাড়ি থেকে গায়েব হয়ে গেলেন কি করে!" গোটা বাড়ি তো বটেই...বাগানের আনাচ কানাচও তিনি খুঁজতে বাকি রাখলেন না।আর এই করতে গিয়ে আজ সকালের জলখাবারটাও বানানো হল না তাঁর।চাকরকে কোনো কাজের হুকুম দেওয়ার হুকুম তাঁর নেই।কারণ এই বাড়িতে তাঁকে কাজের লোকেদের থেকে আলাদা জায়গায় স্হান দেননি গায়ত্রী দেবী। সকালের জলখাবার না পেয়ে যখন ঘরের ভিতরে মানুষজনের শোরগোল উঠতে যাবে...তখন মনোরমা দেবী সঞ্জয় বাবুকে আড়ালে ডেকে চাপা স্বরে বললেন..."সর্বনাশ হয়ে গেছে...মা কে বাড়িতে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।" জলের গ্লাসটা সবেমাত্র মুখের কাছে ধরতে যাবেন তিনি...মনোরমা দেবীর কথায় প্রচন্ডভাবে চমকে উঠলেন তিনি।তাঁর হাতে ধরা জলের গ্লাসটা মেঝেতে সশব্দে পড়ে ভেঙ্গে গেল।এ তিনি কি কথা বলছেন! সঞ্জয় বাবু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মনোরমা দেবীর দিকে তাকিয়ে বেশ জোরেই বলে উঠলেন..."মা কে সারাবাড়ি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে!কি যা তা বলছ!" মনোরমা দেবী এবার সঞ্জয় বাবুকে জোরে চেপে ধরে আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে বললেন..."আস্তে বলো...না হলে এক্ষুনি সারাবাড়ি শোরগোল পড়ে যাবে।আমি তোমাকে বলছিলাম...মায়ের পায়ের বাতের ব্যথাটা তো কালকে রাতেও বেশ বেশিই ছিল।আমি তো কাল রাত জেগে ওনার পায়ে তেল মালিশ করে দিলাম।আজকে সকাল না হতেই মানুষটা রাতারাতি গায়েব হয়ে গেলেন কি করে বলো তো...আমি সারা বাড়ি...বাগান টাগান সব জায়গায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি।" মনোরমা দেবীর কথাগুলো শুনে প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে সঞ্জয় বাবু বাজখাঁই গলায় বলে উঠলেন..."মা'র দিকে একটু ঠিকভাবে খেয়াল রাখতে পারো না!রাতে হয়তো মায়ের কিছু দরকার হয়েছিল...কাউকে না পেয়ে নিজেই নেমেছেন বিছানা থেকে...!বিয়ের পর আমাকে তো কথা দিয়েছিলে...পরিস্থিতি যাই আসুক...তুমি সবসময় মাকে সেবাযত্ন করে দেখেশুনে রাখবে।এখন তো দেখতে পাচ্ছি তোমার কথার কোনো দাম নেই।এখন মা কে কি করে খুঁজে বার করি...ওঃ ভগবান...!" কথাগুলো বলেই তিনি হনহন করে হেঁটে গেলেন বাগানের দিকে।মালী কে জোরে জোরে হেঁকে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলেন।আর বললেন..."বাড়ির চারপাশটা আর গোটা বাগানটা ভালো করে খুঁজে দ্যাখ তো...তোদের মা জননীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সকাল থেকে...!" এইসব ব্যাপার স্যাপার দেখেশুনে গায়ত্রী দেবীর বাকি তিন ছেলে আর পুত্রবধূরা যারপরনাই বিস্ময় নিয়ে এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।যদিও এমনই একটি দিন যে আসুক...এইটাই এতদিন ধরে মনেপ্রাণে চাইছিল ওরা কিন্তু ঘটনা যে এমন একটা মোড় নিয়ে সামনে আসবে...সেটা ওরা কেউই ভাবতে পারেনি।এতে যে হিতে বিপরীত হয়ে গেল।এখন তো বুড়িকে খুঁজে বার করতে না পারলেই বরং চতুর্দিকে হয়রানির একশেষ...! কিছুক্ষণ পরে মালি এসে বলল..."না গো বাবুরা...মা জননীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলনিকো।" বিছানা থেকে নামাটাই যে মানুষের পক্ষে কষ্টসাধ্য...সেই মানুষটাকে এখন চক্রবর্তী বাড়ির ত্রিসীমানায় কোথাও দেখা যাচ্ছে না...এ খবরটা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগল না।সঞ্জয় বাবু আর কালবিলম্ব না করে থানায় গেলেন নিখোঁজ ডায়েরি করতে।বাকি তিন ভাই আর পুত্রবধূরা এখন এটা বুঝতে পেরে প্রচন্ড বিরক্ত হল...যে তারা সকলেই এখন একটা বাজে ঝামেলায় ফেঁসে গিয়েছে।মনোরমা দেবী দুইহাত জড়ো করে উপরের দিকে তুলে বললেন..."রাধামাধব...রক্ষে করো...!" ধীরে ধীরে যখন জ্ঞান ফিরতে শুরু করল গায়ত্রী দেবীর...তখন উনি বুঝতে পারলেন...তাঁর হাত পা মুখ সবটাই শক্ত কাপর দিয়ে প্রচন্ড আঁটোসাঁটোভাবে বাধা রয়েছে।ভয়ে...আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে পরিত্রাহী চ্যাঁচাতে গেলেন গায়ত্রী দেবী।আর পরক্ষণেই বুঝতে পারলেন...এটা অসম্ভব।একটা কাঠের চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে তাঁকে।ভীত সন্ত্রস্ত চোখে চারপাশটা দেখে তিনি এটা বুঝতে পারলেন...তাঁকে আটকে রাখা হয়েছে একটা পরিত্যক্ত গুদাম ঘরে।গুদাম ঘরটা একেবারে স্যাঁতসেঁতে।আলোআঁধারি...আর আবর্জনায় ভর্তি।চারদিকে শুধু পরিত্যক্ত কিছু যন্ত্রপাতি...ধূলো ময়লা আর মাকড়সার জাল।উপরের দিকে বাতাস চলাচলের জন্য একটা গোলাকার রাস্তা রয়েছে ঠিকই...কিন্তু দরজা...জানলা সব বন্ধ। একখানা কম পাওয়ারের টিমটিমে হলুদ বাল্ব জ্বলছে শুধু।আর এমন অস্বাস্থ্যকর একটা বদ্ধ ঘরের ভিতরে হাত পা মুখ বাঁধা অবস্থায় একেবারে একা গায়ত্রী দেবী।এমন কোনো দিনও যে অপেক্ষা করে রয়েছে ওঁর জন্য সেটা দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি গায়ত্রী দেবী।সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে গিয়ে যখন দেখলেন...সেটা ওই শক্ত কাপড়ের আঁটোসাঁটো বাঁধন পেরিয়ে শুধুমাত্র একটা চাপা গোঙানিতে রূপান্তরিত হচ্ছে...তখন তিনি এটা স্পষ্ট বুঝে গেলেন...এখনই তাঁর অন্তিমকাল ঘনিয়ে এসেছে।কে...কি উদ্দেশ্যে তাঁকে এইরকম একটা জায়গাতে গোপনে তুলে এনেছে...সেই ব্যাপারে চিন্তা করে আর যে কোনো লাভই নেই...এটা বুঝে তিনি চোখ কান বুঁজে শুধুমাত্র অন্তিমকালের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতে থাকলেন। চক্রবর্তী বাড়ির ভিতরে এখন রীতিমতো শোরগোল আরম্ভ হয়ে গেল।থানা পুলিশ তো করা হয়েইছে...এখন চক্রবর্তী বাড়ির ভিতরে সব সময়েই একেবারে লোকে লোকারন্য।আত্মীয় স্বজন...পাড়া প্রতিবেশী...চেনা পরিচিত...বন্ধু বান্ধব সবাই এসে জনে জনে খোঁজ করছে গায়ত্রী দেবীর খোঁজ পাওয়া গেল কিনা।পাড়ার মধ্যে মূহুর্মূহুই সৃষ্টি হচ্ছে গোলাকার কিছু জটলা।চলছে মুখরোচক চটপটা আলোচনা।জমিজমা মিলিয়ে চক্রবর্তী বাড়ির পুরো সম্পত্তির মালকিন গায়ত্রী দেবী যে দিনদিন তাঁর ছেলে বৌমাদের কাছে চক্ষুশূল হয়ে উঠছিলেন...এটা অল্পবিস্তর হলেও এদের কারোর অজানা নয়।আড়ালে আবডালে চলতে থাকল বিভিন্ন ধরণের কথা।কেউ কেউ বলছে..."দ্যাখো...ওনার ছেলে বৌমাদেরই কেউ জমি বাড়ি লিখিয়ে নিয়ে কায়দা করে ওনাকে সরিয়ে দিল কিনা....!" হিয়া নাওয়া খাওয়া ভুলে শুধুই কেঁদে চলেছে।পড়ে রয়েছে ঠাকুর ঘরে।ঠাকুরমা কে না দেখলে ভাতের থালাই ও ছোঁবে না। মনোরমা দেবী আনমনা হয়ে বসে রয়েছেন জানলার পাশে।বিয়ের সময়ে স্বামীকে কথা দিয়েছিলেন তিনি।পরিস্থিতি যেমনই আসুক।ওনার মা'কে সবসময় তিনি যত্ন করে আগলে রাখবেন।শুধুমাত্র এই কারণেই শত লাঞ্ছনা গঞ্জনা আর অপমান সয়েও মনপ্রাণ দিয়ে গায়ত্রী দেবীকে সেবাযত্ন করে স্বামীকে দেওয়া কথা এতদিন রেখে এসেছেন তিনি।এই প্রথমবার নিজের এমন অপারগতায় স্বামীর সামনে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর হিম্মত আর পাচ্ছেন না তিনি।যদিও তিনি জানেন...এই পুরো ঘটনাটাতে তাঁর কোনো হাতই নেই।তবুও বড় কুন্ঠিত...বড় বিচলিত হয়ে পড়েছেন তিনি।এদিন সকালেই তিনি জানতেন...আজ শাশুড়ি মার কাছে ঘোরতর তিরস্কার প্রাপ্য রয়েছে তাঁর।গায়ত্রী দেবী তাঁর যে রুদ্রাক্ষের মালাখানি মনোরমা দেবীকে রাখতে দিয়েছিলেন...তা তিনি ক্ষণিকের অসাবধানতায় হারিয়ে বসেছিলেন।মেয়েটা এত ছটফটে আর এত দুরন্ত হয়েছে...!কোথায় কোথায় যে চলে যায় তার কোনো ঠিক থাকে না।রাতে মেয়েটাকে খাওয়ানোর সময় যখন এল...তখন সারাবাড়ি ওকে খুঁজে পাচ্ছেন না মনোরমা দেবী।উনি ভালোভাবেই জানেন...পরী সুযোগ পেলেই বাগানের পিছনের দিকটায় যায় এটা মাথায় আসতেই আর দেরি না করে তিনি ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিলেন সেদিকে।আর যেমন ভাবা...ঠিক তাই।মেয়ে ওই ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভিতরে ওখানেই আছে।ওই জলাজঙ্গলের ভিতরে ওই অন্ধকারে মেয়েটা যে কি করতে যায়...কে জানে!টর্চের জোরালো আলোয় মেয়েকে দেখতে পেয়েই প্রচন্ড বকাঝকা করতে করতে প্রায় কান ধরে মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন ঘরে...আর ওই সময়েই বেখেয়াল বশত মনোরমা দেবীর হাত থেকে পড়ে যায় গায়ত্রী দেবীর রাখতে দেওয়া রুদ্রাক্ষের মালাখানি।আরো খানিক অপমান আর তিরস্কারের জন্য প্রস্তুত ছিলেন মনোরমা দেবী।কিন্তু সকালের পর থেকে মানুষটার যে আর দেখাই মিলবে না...এটা তিনি ভাবতেই পারেননি।সঞ্জয়ের দুশ্চিন্তাগ্রস্হ অবস্থা দেখে বড় মায়া হতে শুরু করল মনোরমা দেবীর।সাথে তীব্র হতে শুরু করল অপরাধ বোধও। কখন যে চোখটা লেগে গিয়েছিল ...তা খেয়ালই ছিল না গায়ত্রী দেবীর।আস্তে আস্তে করে চোখ যখন খুললেন...তখন একটা প্রবল শারীরিক কষ্ট অনুভব করলেন।ওইভাবে দড়ি দিয়ে প্রচন্ড শক্ত করে তাঁর হাত পা সব বাঁধা রয়েছে এখনো।মুখটাও একটা শক্ত কাপড় দিয়ে যেভাবে আঁটোসাঁটো করে বাধা ছিল...তেমনই রয়েছে।হাতে পায়ে তীব্র যন্ত্রনা শুরু হয়ে গিয়েছে গায়ত্রী দেবীর।দম যেন বন্ধ হয়ে আসবার যোগাড়।সারা শরীর জুড়ে অনুভব করছেন মারাত্মক কষ্ট সাথে তীব্র ক্ষুধার জ্বালা।এই প্রথম বার তাঁর মনে হল...যে পুত্রবধূকে দিনরাত উঠতে বসতে অপমান করেন তিনি...সে আসলেই সাক্ষাৎ লক্ষ্মী।কিভাবে সে মুখ বুজে সমস্ত ধরণের অবহেলা আর অসম্মান সয়েও তাঁর সেবাযত্ন করে যায় নিঃস্বার্থভাবে।এই বয়সে এসে পুত্রবধূর যত্ন পেয়ে কতটা ভালো থাকেন তিনি।মেয়েটাকে কেন এত লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়!ও গরীব ঘরের মেয়ে বলে!অথচ তাঁর বাকি পুত্রবধূরা কিন্তু যথেষ্ট অভিজাত ঘরের সন্তান।আর শুধুমাত্র সেই কারণেই তাদের যাবতীয় অশিক্ষা আর স্বার্থান্বেষী কুটিল ব্যবহারগুলো কত সহজেই এতদিন উড়িয়ে দিয়ে এসেছেন তিনি!এখন শারীরিক কষ্ট এতটাই অসহনীয় হয়ে পড়েছে...যে মনোরমা দেবীর অভাবখানি বড়ো তীব্র হয়ে দেখা দিচ্ছে যেন।তাঁর মন যেন বলছে...এখন যদি কোনোভাবে হতভাগী মেয়েটাকে সামনে পান তিনি...তাহলে ওকে নিজের বুকে জড়িয়ে নেবেন তিনি।মনে মনে হাহুতাশ করা ছাড়া যে এখন আর কোনো উপায়ই নেই...সেটা ভালো করেই বুঝতে পারছেন তিনি।এমনভাবে এখানে পড়ে থাকার চেয়ে মৃত্যুও ঢের ভালো...এই কথা ভেবে তাঁর বুকের ভিতরটা যেন হু হু করে উঠল।ঠিক সেই সময়ে...গুদাম ঘরের দরজায় ক্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-চ করে একটা কর্ণবিদারক আওয়াজ হল।এতক্ষণ বাদে কোনো মানুষের পা পড়ছে এই ঘরে এইভাবে কে যে তাঁকে এমন জায়গায় ধরে আনল...আর কিই বা তার উদ্দেশ্য...সেই বিষয়ে অন্ধকার থেকে আলোয় আসতে পারবেন....এটাই মনে করে তাঁর ভিতরে শ্বাসরোধ করা উত্তেজনার পারদ চড়তে শুরু করল দ্রুতগতিতে।কিন্তু দরজাটা খুলে যে ভিতরে ঢুকে এল...তাকে দেখে তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারলেন না গায়ত্রী দেবী।এ তিনি কাকে দেখছেন!এ আর কেউ নয়...তাঁরই কলিজার টুকরো সুশীল।একটা চরম বিশ্বাসঘাতকতার আঘাত আর হাজারো বিস্ময় আর প্রশ্ন একসঙ্গে এমনভাবে তাঁর শিরায় শিরায় গর্জে উঠল প্রবল ঢেউসদৃশ...যে প্রচন্ড ছটফট করতে শুরু করলেন তিনি ওই শারীরিক অবস্থাতেই।মুখে শক্ত করে বাঁধা কাপড় ভেদ করে বেরিয়ে আসতে থাকল তাঁর প্রবল একটা চাপা গোঙানি। সুশীলের হাতে একটা ঢাকা দেওয়া থালা।একটা ভাঙ্গা চেয়ার টেনে নিয়ে গায়ত্রী দেবীর চেয়ারের সামনাসামনি রাখল সুশীল।তারপর ওই চেয়ারের ওপর ঢাকা দেওয়া থালাখানি রেখে...ওপরের ঢাকাখানি সরিয়ে নিল।থালায় ভাত...মাছ আর নানাবিধ পঞ্চব্যঞ্জন দিয়ে সাজানো।প্রবল ক্ষুধার্ত ছিলেন যদিও গায়ত্রী দেবী...কিন্তু এখন যখন সুশীল এভাবে তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়ে খাবার দিয়ে সাজানো থালাখানি রাখল...তখন খাবারের ওই থালাখানি ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছা হল গায়ত্রী দেবীর।প্রচন্ড রাগে আর অভিমানে এখন তিনি রীতিমতো ফুঁসছেন। চক্রবর্তী বাড়ির ভিতরে এখন প্রতিটি মানুষই এটা বুঝে গেছে...যে যেদিনটা তাদের এতদিনের কাম্য ছিল...সেই দিনটা এত সহজে এসে গেলেও তাকে ধরে রাখা কোনোমতেই যাবে না।কারণ প্রথমত গায়ত্রী দেবী তাঁর সম্পত্তির কোনো উইল করে যাননি।আর দ্বিতীয়ত,একটা রক্তমাংসের মানুষ স্রেফ হঠাৎ করে এভাবে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার পর এখন যেনতেন প্রকারেণ তাঁকে খুঁজে বার করা ব্যতীত আর কোনো উপায়ই নেই।অতএব এখন গায়ত্রী দেবীকে খুঁজে বার করবার জন্যই তাঁর পুত্র এবং পুত্রবধূরা একেবারে মরিয়া হয়ে উঠল।থানায় খবর দেওয়ার পর পুলিশ এই বিষয়ে এখন রীতিমতো সক্রিয় হয়ে উঠল।বাড়ির চাকরবাকর...মালি...কেয়ার টেকার...কেউ বাদ গেল না জেরা থেকে।পরিবারের প্রতিটি সদস্যের সক্রিয় উপস্থিতি আর সহচর্য পাচ্ছে পুলিশ।কিন্তু বাতের ব্যথায় কাবু...বিছানায় পড়ে দিনযাপন করা এক বৃদ্ধার...তিনতলার শোবার ঘরের ভিতর হতে এইভাবে রাতারাতি গায়েব হয়ে যাওয়ার কোনো সূত্রই পুলিশ পাচ্ছে না এখনো পর্যন্ত। গায়ত্রী দেবীর মুখের বাঁধন সযত্নে খুলে দিল সুশীল।তারপর গায়ত্রী দেবীর চোখের দিকে রীতিমতো ক্রোধান্বিত রক্তচক্ষু নিয়ে চাপাস্বরে জিজ্ঞাসা করল..."বাগানের পিছনে তুমি কেন গিয়েছিলে দিদুন!" এবার প্রচন্ডভাবে আর্তচিৎকার করে উঠলেন গায়ত্রী দেবী।তাঁর দুই চোখ দিয়ে ঝরছে অশ্রুর বারিধারা।তিনি ভীষণভাবে চিৎকার করে...তিরস্কারপূর্ণ আর্তনাদের সাথে বলে উঠলেন..."তুই আমাকে এখানে কেন এনেছিস!তোর ভিতরে কি মনুষ্যত্ব বলে কিছুই নেই!দুধকলা দিয়ে এতদিন আমি এই কালসাপ পুষে যাচ্ছিলুম!" ---"আস্তে দিদুন আস্তে।তোমার আজকের এই পরিণতির জন্য তো তুমি নিজেই দায়ী।আমি তো বার বার তোমাকে সাবধান করেছিলাম।কিন্তু তুমি আমার কোনো কথাই কানে তোলোনি।আমার কিচ্ছু করার ছিল না গো দিদুন...তুমি এখন প্রয়োজনের থেকে অনেককিছু জেনে গিয়েছ...বুঝতে পারছি।এখন আমাকে খোলসা করে বলো দেখি...বাগানের পিছনে তুমি কেন গিয়েছিলে!কি দেখেছ তুমি সেখানে?" ---"আরে মরণ...বাতের ব্যথার জন্য আমি তো বিছানা থেকেই নামতে পারি না!আমি খামোখা বাগানের পিছনে ওই জলা জঙ্গলের ভিতরে কি করতে যেতে যাব!আমাকে কি পাগল কুকুরে কামড়েছে!" প্রচন্ডভাবে উত্তেজিত হয়ে হাঁপাতে থাকলেন গায়ত্রী দেবী। ---আমার চোখকে ফাঁক দিয়ে পার পাবে না দিদুন...তুমি যে ওখানে গিয়েছিলে...ওই ব্যাপারে নিশ্চিত আমি।এর প্রমাণ আছে আমার কাছে।তুমি যদি ওখানে না যেতে...তাহলে আজ আমাকে এই পাপকাজটা করতে হত না...আর তোমাকেও এমন দিন দেখতে হত না।কি আর করবে...!সবটা তো আমাদের হাতের মধ্যে থাকে না...নাও...খাবার টা খেয়ে নাও।আর এটা জেনে রাখো...যত তাড়াতাড়ি তুমি আমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেবে...ততই তোমার মঙ্গল।" ঠান্ডা স্বরে কথাগুলো বলে নিয়ে সুশীল ফের বেঁধে দিল গায়ত্রী দেবীর মুখ।হাতদুটো খুলে দিল।তারপর খাওয়ার জন্য শুধু ডানহাতখানি মুক্ত রেখে বাঁম হাতখানি ফের শক্ত করে বেঁধে দিল চেয়ারের হাতলের সাথে।তারপর ওই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নিঃশব্দে।বাইরে থেকে তালা লাগানোর শব্দ পরিষ্কার শুনতে পেলেন গায়ত্রী দেবী।এবার প্রচন্ড ভেঙ্গে পড়লেন তিনি।এখন শুধু এইটাই বারে বারে তাঁর মনে হতে থাকল...এমন দিন দেখার আগে ঈশ্বর কেন তাঁকে তুলে নিচ্ছেন না! চক্রবর্তী পরিবারের ভিতরে তখন এমনই একটা আবহ...যে কারোরই আর মাথা শান্ত নেই।একটা উদ্বেগ যেন গোটা পরিবারটাকে ঘিরে রেখেছে।মনোরমা দেবী রাতদিন পড়ে রয়েছেন ঠাকুরঘরে।ওই সময়ে...সন্ধ্যার দিকে...হঠাৎ চিন্ময় বাবু ঢুকলেন ঠাকুরঘরে।গড় করে প্রণাম করলেন ঠাকুরকে।তারপর মনোরমা দেবীকে বললেন..."বৌঠান...পরীটাকে দেখছি...মা নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে বড্ড মনমরা হয়ে রয়েছে।ওর জন্য আমার বড্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে।আমরা বড়রা নাহয় দুশ্চিন্তার মোকাবিলা করতে পারি...কিন্তু ও ছোট মানুষ...ওর ওপরে বড্ড চাপ পড়ছে।তুমি এক কাজ করো বৌঠান...ওকে একটু ঠিকঠাক করে জামাটামা পরিয়ে রেডি করে দাও...আমি বরং ওকে একটু বাইরে থেকে ঘুরিয়ে আনি।" প্রস্তাবটা শুনে ভালো লাগল মনোরমা দেবীর।তিনি বললেন..."এটা তুমি খুবই ভালো কথা বলেছ ঠাকুরপো।কটাদিন ধরে মেয়েটা একেবারে মনমরা হয়ে ঘরের ভিতরে একা একা পড়ে রয়েছে।স্কুলেও যেতে চাইছে না।মা হয়ে যে ওর দিকে একটু তাকাব...সেই মানসিক স্হিতি আমারও নেই।তোমার বড়দারও দুশ্চিন্তায় চোখের কোণায় কালি পড়েছে...মেয়ের দিকে তাকানোর অবস্থা ওরও নেই।তুমিই বরং ওকে বাইরে থেকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে এসো।তাতে যদি মেয়েটা একটু স্বাভাবিক হয়!" এই বলে মনোরমা দেবী ছুটে গেলেন মেয়ের কাছে।কিন্তু খানিক বাদেই ওই ঘর থেকে শোনা যেতে থাকল মা মেয়ের তুমুল কথা কাটাকাটি আর বিবাদ।ক্রমে সেটা মাত্রা ছাড়াতে শুরু করল।চিন্ময় বাবু এবার প্রমাদ গুণলেন।পুরোনো দিনগুলো একবার তাঁর ভিতরে জেগে উঠল।যদিও সবটা ভালোভাবেই জানেন তিনি।কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা প্রবল ভয়ের অশনিসংকেত পেয়ে তাঁর পিঠে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল।আর তার পরক্ষণেই তিনি পুরো ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিলেন।যে কারণে তিনি ভয় পাচ্ছেন...সেটা স্রেফ তাঁর মনের ভ্রম।তিনি নিজে ভালোভাবেই সেটা জানেন।কাজেই কোনোপ্রকার দুশ্চিন্তাকে আর প্রশ্রয় না দিয়ে এবার তিনি নতুন শিকার হাতে পাওয়ার আনন্দে ডগমগ হয়ে...ব্যাপার টা কি হয়েছে সেটা জানার জন্য পরীর ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। গিয়ে দেখলেন...তুমুল কান্ড!পরী ভয়ার্ত কন্ঠে বলছে...সে কিছুতেই ছোটকাকার সাথে একা কোথাও যাবে না। বারবার হিয়া বলতে থাকল..."তোমাকে কতবার বলেছি মা...আমি ছোটকার কাছে একদম যেতেই চাই না।ছোটকা খুব খারাপ লোক।" মনোরমা দেবী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন..."ছি পরী মা...অমন বলতে নেই।ছোটকা তো কত ভালোবাসে তোমাকে।দেখো...এখন ঠাম্মিকে দেখতে না পেয়ে সব্বার কষ্ট...মন খারাপ।কিন্তু তাও ছোটকা তোমার মন যাতে ভালো থাকে তাই তোমাকে নিয়ে বেরিয়ে আসবেন বলছেন।আর তুমি ওনাকে নিয়ে এরকম উল্টোপাল্টা কথা বলছ!লজ্জা হওয়া উচিত তোমার।" ---মা...তোমাকে আমি একটাই কথা গত তিন চার বছর ধরে বোঝানোর চেষ্টা করছি...তোমরা কেউ আমার কোনো কথা বিশ্বাস করোনি।ছোটকা প্রচন্ড অসভ্য একটা লোক।আমার সঙ্গে অসভ্যতা করার জন্যই সে আসতে চায় আমার কাছে।" কথাগুলো বলতে বলতে যেন হিয়ার ভিতর থেকে দলা পাকানো একতাল ঘৃণা বেরিয়ে এল। মনোরমা দেবী দেখলেন...পরীকে নিতে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর ছোট ঠাকুরপো চিন্ময় নিজে।এইমাত্র পরীর বলা কথাগুলোর সবটাই তাঁর কর্ণগোচর হয়েছে।প্রচন্ড লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা হল মনোরমা দেবীর।এ কেমন শিক্ষা দিয়ে মেয়েকে মানুষ করছেন তিনি!এই প্রশ্ন যদি আজ সরাসরি করে বসে চিন্ময়...তাহলে কি উত্তর দেবেন তিনি!মেয়েকে আদর ভালোবাসা যতটা দিচ্ছেন...শাসন ঠিক ততটা পড়ছে না বলেই বাড়তে বাড়তে আজকে পরীর এই অবস্হা।প্রচন্ড রেগে গিয়ে এবার মনোরমা দেবী একটা চড় কষালেন হিয়ার গালে। "বড়দের সম্বন্ধে এইধরণের কথা বলতে শিখিয়েছি আমি তোমাকে!সবাই তোমাকে ভালোবাসে বলে যদি তুমি এটা ভেবে নাও...যে তুমি যা খুশি বললেও কেউ তোমাকে কোনোদিন শাসন করবে না...তাহলে খুব বড়ো ভুল করছ তুমি।আর যদি কোনোদিন আমি শুনেছি...যে বাড়ির কোনো গুরুজন সম্বন্ধে কোনো খারাপ কথা বলেছ তুমি...ওইদিন তোমার কপালে প্রচন্ড দুঃখ আছে বলে দিলাম।যাও তো...এক্ষুনি দূর হয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে।যাও...!" মায়ের কাছ থেকে কড়া ধমক খেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে প্রস্হান করল হিয়া।হিয়া ঘরের দরজার বাইরে যেতেই মনোরমা দেবীর ভিতরের মায়ের মনটা কেঁদে উঠল।আহা রে!এমনভাবে ওকে শাসন করাটা একদম ঠিক হয়নি।তার পরক্ষণেই তিনি ভাবলেন...নাঃ...শাসনের দরকার পরীর আছে বইকি!ঠিকঠাক শাসন করা হয় না বলেই পরীটার ভদ্রতা সভ্যতা আর শিক্ষাদীক্ষার বিকাশ হচ্ছে না সঠিকভাবে।দরজা দিয়ে যখন হিয়া একছুটে বেরিয়ে গেল...তখন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা চিন্ময়ের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন মনোরমা দেবী। চিন্ময়বাবু মৃদু হেসে সান্ত্বনা দেবার স্বরে মনোরমা দেবীকে বললেন..."তুমি অপরাধীর মুখ করে মতো আমার সামনে দাঁড়িয়ে থেকো না বৌদি...পরী ছেলেমানুষ।আমি ওর কথায় কিছু মনে করিনি।" ---আর তোমায় কি বলি ছোট ঠাকুরপো...ওর এরকম উদ্ধত কথা আর উগ্র আচরণ তো আজকের নয়...আমরা সকলেই সেটা জানি।তোমার সম্পর্কে ওর এরকম খারাপ কথা আর খারাপ চিন্তা আমি বা ওর বাবা কেউই বদলাতে পারলাম না আজ পর্যন্ত।ওকে শাসন করতে পারিনি...এ আমাদেরই খামতি ঠাকুরপো...আমি তোমার কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি।" মনোরমা দেবী হাত জোড় করে করুণ দৃষ্টিতে তাকালেন চিন্ময় বাবুর দিকে। ---"আরে ছি ছি বৌদি...তুমি আর আমাকে লজ্জা দিও না।আমি জানি...পরী এখন ছোট আছে...ও যত বড় হবে...ওর স্বভাব ঠিক পরিবর্তন হয়ে যাবে...তুমি দেখো...!" আশ্বস্ত করার সুরে চিন্ময় বাবু মনোরমা দেবীর উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললেন। ---"তাই যেন হয় ছোট ঠাকুরপো...তাই যেন হয়!আর কি...সে মেয়ে বোধহয় রাগ করে ঘরে দোর দিয়ে বসে রয়েছে।যাই...সেদিকে একবার গিয়ে দেখি...!" মনোরমা দেবী ম্লান মুখে মাথা নীচু করে ঠাকুরঘর হতে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন। উনি এটা বুঝতেই পারেননি...চিন্ময় বাবুর ভিতরে কি সাংঘাতিক ঝড় বয়ে চলেছে।এতদিন যাবৎ যা ভেবে আসছিলেন চিন্ময় বাবু...সেই ধারণাটা যে কতবড় ভুল ছিল...সেটা এইমাত্র হাতে কলমে বুঝতে পারলেন চিন্ময় বাবু।তাঁর গলা শুকিয়ে আসতে থাকল।হাত পা একেবারে ঠান্ডা হয়ে আসতে থাকল।একটা ভয়ঙ্কর চক্রান্তের গন্ধ পেয়ে তাঁর দুটি হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে এল ক্রোধে।সুশীল সাহস পেল কি করে তাঁর আড়ালে গোপনে তাঁরই বিরুদ্ধে এরকম ভয়ঙ্কর চক্রান্ত করার!পরীকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত নিরীক্ষণ করেছিলেন তিনি।কি করে সুশীল এটা সম্ভব করল!চিন্ময় বাবুর মনে হল...এক্ষুণি সুশীলের গলা টিপে শ্বাসরোধ করে ওকে খুন করে ফেলেন! ক্ষুধায়...তৃষ্ণায় শরীর থেকে প্রাণ বেরিয়ে আসবার উপক্রম হয়েছে গায়ত্রী দেবীর।যদিও তাঁর ডানহাতখানি এখন উন্মুক্ত...আর সামনেই চেয়ারের ওপরে রাখা রয়েছে পঞ্চব্যঞ্জন দিয়ে পরিপূর্ণ একখানি থালা...কিন্তু তা সত্ত্বেও একদানাও মুখে তোলার প্রবৃত্তি নেই গায়ত্রী দেবীর।সারাটা জীবন তিনি নিজের নাতি নাতনিদের চাইতে কম জায়গা দেননি সুশীলকে।...বরং যেভাবে যত্ন ভালোবাসা দিয়ে মায়ের মতো করে আগলে রেখে ওকে বড় করে তুলেছেন...তার এমন চমৎকার প্রতিদান পাওয়ার পর ক্রোধে...ঘৃণায় সর্বাঙ্গ রি রি করছে তাঁর।এতবড় একটা অকৃতজ্ঞ বেইমানকে দুধকলা দিয়ে নিজের পরিবারের একজন করে রেখেছিলেন...এটা ভাবতেই তাঁর দুই চোখ বেয়ে অঝোরে জল পড়তে শুরু করল।অন্তত কোনো ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে যে সুশীল তাঁর সঙ্গে এরকম জঘন্য একটা আচরণ করবে না...এই ব্যাপারে ষোলোআনা নিশ্চিত তিনি।তাঁর এই অবস্থার কথা পরিবারের কেউ হয়তো এখনো জানে না।এখন তাঁকে নিয়ে সবাই কত না দুশ্চিন্তা করছে...!সুশীলের ওপরেই এখন নির্ভর করছে...এই নরক থেকে তাঁর পরিত্রাণ।সুশীলের এমন রূপ দেখার চাইতে যে মৃত্যুও ঢের ভালো ছিল!এমনিতেই কটাদিন ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না তাঁর।মনোরমা দেবীর সেবাশুশ্রুষায় বেশ আরামেই দিন কাটছিল তাঁর।হঠাৎ কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল...!প্রচন্ড মানসিক চাপে আর অবসাদে...এবং সর্বোপরি ভুখা পেটে...গায়ত্রী দেবীর শারীরিক অবস্হার খুব দ্রুত অবনতি ঘটতে শুরু করল।তাঁকে দেখলে এখন হয়তো যে কারোর মনে হবে...এই মানুষটির আয়ূ আর খুব বেশিক্ষণ নয়। দুইচোখ বুঁজে বামহাতখানি... সারা শরীর আষ্টেপৃষ্টে চেয়ারের সাথে শক্ত করে বাঁধা অবস্হায়...অসহায়ের মতো দুই চোখ বুজে পড়ে রয়েছেন গায়ত্রী দেবী...এমন সময়ে ফের দরজায় ক্যাঁচ করে একটা আওয়াজ হল।গায়ত্রী দেবী বুঝতে পারলেন...সুশীল আসছে ভিতরে।সুশীলের মুখদর্শন করার কোনো প্রবৃত্তি হল না গায়ত্রী দেবীর।তিনি আরো শক্ত করে চোখদুটি বন্ধ করে পড়ে রইলেন।ধীর পায়ে ঘরের ভিতরে ঢুকল সুশীল।তারপর এক পা এক পা করে সে এগিয়ে এল গায়ত্রী দেবীর একেবারে সামনে।কপালের ওপরে একটা গরম নিঃশ্বাসের বাতাস...পড়ার গায়ত্রী দেবী স্পষ্ট অনুভব করলেন।কিন্তু তিনি চোখ কিছুতেই খুললেন না।কোনো কথাও বললেন না।সুশীল গায়ত্রী দেবীর মুখের ওপরে ঝুঁকে পড়ে...যারপরনাই শীতল কন্ঠে বলে উঠল..."অতিরিক্ত কৌতূহলটা কোনোকালেই ভালো নয় সেটা জানো তো দিদুন!তুমি অনেক কিছু জেনে ফেলেছ...যা তোমার এক্তিয়ারের বাইরে।আমার এক্ষেত্রে কিচ্ছু করার ছিল না বিশ্বাস করো...।" ক্রোধে ঘৃণায় রীতিমতো থরথর করে কাঁপছেন গায়ত্রী দেবী।দুইচোখ তাঁর দৃঢ়ভাবে বন্ধ। সুশীল আবার বলতে শুরু করল..."তোমাকে খাবার দেওয়াটা কর্তব্য বলেই দিয়েছি।খাওয়া না খাওয়াটা একান্তই তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।কিন্তু একটা কথা তোমায় জানিয়ে রাখি...তোমার আয়ূ খুব বেশি হলে আজকে রাত পর্যন্ত।কাল যখন সূর্যাস্ত হবে...তখন তোমার এই শরীর জড়বস্তুতে পরিণত হবে।তোমাকে খুন করতে যদিও আমার খুবই কষ্ট হবে...কিন্তু কি আর করা...তুমি কি দেখেছ...কতটুকু কি জেনেছ...সেটা তুমি আমাকে না বলতেই পারো।কিন্তু এখন তোমার বেঁচে থাকাটা শুধু আমার জন্যই নয়...চিন্ময়দা...অর্থাৎ তোমার কনিষ্ঠ পুত্রের জন্যও এখন হানিকর।নিজের বিপদ তুমি নিজে ডেকে এনেছ।যদি তুমি ওইদিন গভীর রাত্রে বাগানের পিছন দিকটায় না যেতে...তাহলে এই পাপে আমাকে নিজের হাত কলুষিত করতে হত না।আমি নিজেকে প্রস্তুত করছি...তুমিও মরবার জন্য প্রস্তুত থেকো।" কথাগুলো বলে খাবার রাখা চেয়ারটা ধরে গায়ত্রী দেবীর আরো কাছাকাছি রেখে দিয়ে...তারপর ওই ঘর থেকে গটগট করে বাইরে বেরিয়ে গেল সুশীল।বাইরে থেকে লাগিয়ে দিল তালা গায়ত্রী দেবীর এখন শুধু মনে হতে লাগল...ঈশ্বর যেন এক্ষুনি মৃত্যু দিয়ে তাঁকে মুক্তি দেন...! মোটামুটি ঘন্টাখানেক কাটল এভাবেই।হঠাৎ গায়ত্রী দেবী শুনতে পেলেন...ঘরের পিছন দিকে একটা খসখস শব্দ।কোনো মানুষ কি তবে এসেছে এখানে!টালমাটাল ঝড়ের প্রচন্ড তুফানের দাপটে...মাঝ সমুদ্রে হঠাৎ পেয়ে যাওয়া সামান্য খড়কুটো পেয়ে যাওয়ার মতোই...মুক্তির একটা ক্ষীণ আশা পেয়ে গায়ত্রী দেবী একেবারে শিশুর মতো ছটফটিয়ে উঠলেন।চেঁচিয়ে কিছু বলতে যাবেন...এমন সময়ে তিনি বুঝতে পারলেন...গলা দিয়ে একটা শব্দও বার করবার ক্ষমতা তাঁর নেই।মুক্তির আশায় মরিয়া গায়ত্রী দেবী যখন দিশাহারা...তখন যে কন্ঠস্বর তিনি শুনলেন...সেটা এই সময়ে আর এই জায়গায় তিনি কোনোমতেই আশা করেননি।তিনি স্পষ্ট শুনতে পেলেন সেই কন্ঠস্বর...আর তারপর তাঁর বুঝতে আর কোনো অসুবিধাই হল না...এ কন্ঠস্বর আর কারোর নয়।এ যে তাঁর জ্যেষ্ঠা পুত্রবধূ মনোরমার গলা।মনোরমা চাপা স্বরে ফিসফিস করে বলছে..."আপনি আর কোনো চিন্তা করবেন না মা...আমি ঠিক এখান থেকে আপনাকে বার করে আনব।" চক্রবর্তী পরিবারের ভিতরে প্রাণটাই যেন হারিয়ে গেছে।কোনোকিছুই আর আগের মতো নেই।কোনো ঘরে দরজা বন্ধ করে চলছে কুটিল বৈষয়িক শলাপরামর্শ...আবার কোনো ঘরে দুশ্চিন্তায় মানুষের দুইচোখের পাতা এক হচ্ছে না কোনোমতেই।সবাই যেন বড্ড গা ছাড়া।একটা কড়া অনুশাসন আর নিয়মানুবর্তিতা ছিল...চক্রবর্তী পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে এক সূতোতে বেঁধে রাখত।এখন কাজের সাথে সময়ের কোনো সামঞ্জস্য নেই...আর না আছে কোনো শ্রী।সমস্তকিছুই এক্কেবারে সৃষ্টিছাড়া।কে ঘরে আছে...আর কে ঘরে নেই...এ বিষয়ে কারোরই কোনো হুশতাপ নেই।মনোরমা দেবী যে গতকাল রাত থেকে বাড়িতেই নেই...এই খবরটা খোদ সঞ্জয়বাবুও জানেন না।দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় তাঁর প্রচন্ডই শারীরিক এবং মানসিক অবনতি ঘটছে দিন দিন।হিয়াও দিন দিন প্রচন্ড মনমরা হয়ে পড়েছে।স্কুলে যাওয়া...পড়াশোনা...এইসবের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে একেবারেই।এখন বিকেল পাঁচটা।অন্য সময় হলে...এই সময়ে বাড়ির ভিতরে শঙ্খধ্বনি শোনা যেত।ধূপ জ্বেলে সন্ধ্যা দিতে ব্যস্ত হতেন বাড়ির গিন্নি।সেইসব পাট চুকে গেছে বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল।হিয়া মনমরা হয়ে ছাদে একা একা বসে রয়েছে।হঠাৎ কাঁধে একটা হাত পড়ায় ও ভীষণভাবে চমকে উঠল।পিছন দিকে চাইতেই ও যাকে দেখল...তাঁকে দেখে একরাশ ঘৃণায় ওর যেন অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসতে চাইল।কোনোমতে ধড়ফড় করে উঠে...সেখান থেকে ছুটে পালাতে যাবে হিয়া...এমন সময়ে ওকে খপ করে চেপে ধরে একেবারে হাতের নাগালের মধ্যে করে নিলেন চিন্ময় বাবু।হিয়া ওর ছোট শরীরে যতটা শক্তি আছে...ততটাই প্রয়োগ করে ওই হাত ছাড়িয়ে নিতে তৎপর হল প্রচন্ডভাবে। যেন প্রচন্ড দুর্গন্ধযুক্ত অশুচি কোনোকিছুর স্পর্শ থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টায় মরিয়া হিয়া।কিন্তু না...চিন্ময় বাবুর শক্তির কাছে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হল হিয়া।প্রচন্ড আস্ফালনের ব্যর্থ প্রয়োগের পর যখন হিয়া হার মেনে গিয়ে প্রচন্ডভাবে হাঁপাচ্ছে...তখন চাপা অথচ প্রচন্ড শীতল কন্ঠে চিন্ময়বাবু চোখে প্রতিহিংসার আগুন এনে শুধোলেন..."কে তুই!কি তোর পরিচয়!তুই তো পরী নোস!আমি চাইলে কিন্তু যেকোনো মূহুর্তে তোর পর্দা ফাঁস করে দিতে পারি!ভালো চাস তো সত্যিটা স্বীকার কর।খুলে বল সবটা।নাহলে কিন্তু আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।" চিন্ময়বাবুর ওই রক্তচক্ষুর চাইতেও যেন দশগুণ পীড়াদায়ক তাঁর হাতের স্পর্শখানি।ও এবার পরিত্রাহী চিৎকার করে উঠল..."বাবা...মা...কে আছ...আমাকে বাঁচাও...!" সর্বনাশ!এ মেয়ে নির্ঘাত বিপদ ঘটিয়ে ছাড়বে!চিন্ময় বাবু এবার হাত দিয়ে সজোরে চেপে ধরলেন হিয়ার মুখ।তখনই একটা অপ্রত্যাশিত কান্ড করে বসল হিয়া।চিন্ময়বাবুর হাতে একটা জোর কামড় বসিয়ে দিল ও।তাতে ক্ষণিকের জন্য চিন্ময়বাবুর হাত আলগা হয়ে গেল।আর সেই সুযোগে হিয়া প্রচন্ড বেগে একেবারে দে ছুট!সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড় করে নামতে থাকল হিয়া।যেন ওকে হিংস্র কোনো বাঘে তাড়া করেছে।হঠাৎ ওর নামার পথে ও দেখল...সামনেই দাঁড়িয়ে সঞ্জয় বাবু।তার মানে বাবা ওর ডাক শুনতে পেয়েছে।প্রচন্ড আতঙ্কে আর ঘৃণায় ও সঞ্জয় বাবুর বুকের একেবারে ভিতরে ঢুকে গিয়ে নিজেকে পুরোপুরি আবৃত করে নিতে চাইল যেন...!ঠিক ওই সময়েই আঙুল থেকে দরদর করে পড়তে থাকা রক্ত আরেক হাত দিয়ে চেপে ধরা অবস্হায় সিঁড়ি থেকে ছোট ভাই চিন্ময়কে নামতে দেখে এবার যারপরনাই অবাক হলেন সঞ্জয় বাবু।চিন্ময় কে দেখলেই পরী যেভাবে ওর সাথে দুর্ব্যবহার করে...তার জন্য ও সঞ্জয়বাবুর কাছে তিরস্কৃত হয়েছে বহুবার।কিন্তু আজ সামনে এমন দৃশ্য দেখে...নিজের বুকের ভিতরে একেবারে ঢুকে গিয়ে ভীত হরিণীর মতো কম্পিত আর ঘর্মাক্ত পরীটাকে যে কি বলবেন...তা কিছুতেই ভেবে পেলেন না সঞ্জয় বাবু। রাত গভীর।পরিত্যক্ত গুদাম ঘরের দরজায় তালা খোলার শব্দ।দরজার তালা,চাবি দিয়ে খোলায় ব্যস্ত সুশীল নিজের সাথে করে এখন নিয়ে এসেছে একটা বড়সড় ছোরা।যে দিদুন সহায়সম্বলহীন ছোট্ট সুশীলকে বিনা দ্বিধায় নিজের কোলে তুলে নিয়েছিলেন...নিজে দায়িত্ব নিয়ে মানুষ করে ওকে পায়ের তলায় একটা শক্ত মাটি করে দিয়েছিলেন...সেই অবলম্বনকে...আজ দু পা চলতে শেখার পর বুকে ছুরি বসিয়ে সকলের অলক্ষ্যে দুনিয়া থেকে উৎখাত করে ফেলতে কোনো সংকোচই নেই সুশীলের।"আপনি বাঁচলে বাপের নাম" এই "বেদবাক্য"টিতেই অন্ধের মতো বিশ্বাসী সুশীল।বাতের ব্যথায় চলাফেরা করা বন্ধ থাকলেও কোনো না কোনোভাবে যে উনি বাগানের পিছনের দিকটাতে গিয়েছিলেন...এই বিষয়ে একশো শতাংশ নিশ্চিত সুশীল।না হলে এত ঝুঁকি নিয়ে একজন বৃদ্ধা মহিলার খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে...তারপর সকলের চোখ এড়িয়ে তাঁকে সরিয়ে ফেলে এমন জায়গার ব্যবস্হা করে সেখানে আনবার ঝক্কি পোহাতে হত না।এখনো পর্যন্ত যে কেউ ওকে সন্দেহ পর্যন্ত করেনি...সেইটাই রক্ষা।এই বুড়ি কিছু যে জেনেছে সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহই নেই...তা সে যতটুকুই হোক...ততটুকুই বড়সড় একটা বিপদ নেমে আসার জন্য যথেষ্ট...সেটা যত ভাবছে সুশীল...ততই ওর মনে হচ্ছে...যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঝামেলা...পৃথিবী হতে নিকেষ করতে হবে।এ ছাড়া এখন আর কোনো উপায়ই নেই।মানুষের দেহ লোপাট করার কাজে ইতিমধ্যেই অভিজ্ঞ সুশীল।কাজেই সম্পূর্ণ বিনা দ্বিধায়...প্রচন্ড তাড়াহুড়ো নিয়ে দরজার তালা খোলায় ব্যস্ত সুশীল এটা এখন প্রথম খেয়াল করল...ও নিজে যে তালা এই দরজায় দিয়ে গিয়েছিল...এটা আদৌ সেই তালা নয়।এটা যখনই ও বুঝল...তখনই ভয়ে ওর হাত পা একেবারে ঠান্ডা হয়ে আসল।।এই ঘরে তার মানে অন্য কেউ ঢুকেছে।আর যে ঢুকেছে...তার কাছে অবশ্যই এই ঘরের দরজায় সুশীলের লাগিয়ে যাওয়া তালার ডুপ্লিকেট রয়েছে।ওই দ্বিতীয় ব্যক্তি...সেই ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঘরের দরজা খুলে ঢুকেছে...আর বেরোনোর সময়ে নিজের আনা তালা লাগিয়ে গিয়েছে দরজায়...যাতে সুশীল কোনোমতে এই ঘরে ঢুকতে না পারে।সুশীলের খুব ঘনিষ্ঠ কেউ না হলে এই কাজ তার পক্ষে কোনোমতেই সম্ভব নয়।কে হতে পারে এই দ্বিতীয় ব্যক্তি!সুশীলের সমস্ত কার্যকলাপ যে দিদুন বাদেও আরো একজনের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে...সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে সুশীল।হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় আসতেই ওর হাত পা যেন পেটের ভিতরে একেবারে সেঁধিয়ে যেতে শুরু করল।ও সাথে সাথে ছুটে গেল ঘরের পিছন দিকের একটা জানলার কাছে।ওই জানলার পাল্লাটা রীতিমতো নড়বড়ে।মানুষের হাতের দু ঘা পড়লে ওই পাল্লা ভেঙ্গে পড়বে।যদিও ওই জানলা ব্যবহার করে ঘরের ভিতরে ঢোকা সম্ভব নয়...কারণ জানালায় লোহার শক্ত গ্রীল রয়েছে।কিন্তু ঘরের ভিতরটা পুরোটাই দেখা সম্ভব ওই জানলা দিয়ে...আর সুশীলের উদ্দেশ্য আপাতত তাই।যেমন ভাবা...তেমন কাজ।সুশীলের শক্ত হাতের বেশ কয়েকটি বাড়ি খাবার পর ঝরঝর করে খসে পড়ল জানলার কাঠের পাল্লাখানি।আর তার ফলে ঘরের ভিতরের দৃশ্য পুরোপুরি স্পষ্টভাবে ধরা দিল সুশীলের কাছে।আর তাতে যা দেখল সুশীল...তাতে এবার ওর পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল।ঘরের ভিতরে দিদুনের কোনো চিহ্নমাত্র নেই।চেয়ারটা পড়ে রয়েছে উল্টে...আর তার চারপাশে দড়ি এলোমেলো হয়ে পড়ে রয়েছে সাপের মতো।মাথায় হাত দিয়ে একেবারে বসে পড়ল সুশীল।ভিতর থেকে ওর নিজের সত্ত্বাই যেন ওকে চিৎকার করে বলতে লাগল..."এইবার তুই শেষ।আর তোর বাঁচার কোনো সম্ভাবনাই নেই!" ঠিক একই সময়ে,চক্রবর্তী বাড়ির বাগানের পিছনের দিকটায় এখন সকলের অলক্ষ্যে চলছে উদ্ভ্রান্ত হাতে মাটি খোঁড়ার কাজ।এই কাজটা যে করছে তিনি কোনোদিন দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি...যে তাঁকেই একদিন নিজের হাত কর্দমাক্ত করে এই কাজ করতে হবে।ভয়ে...আতঙ্কে তাঁর হাত পা একেবারে থরথর করে কাঁপছে।আজ তাঁকে জানতেই হবে সত্যিটা কি!এতদিন যেটা ভেবে একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে ছিলেন তিনি...সেটা কি শুধুই একটা বিরাট বড় প্রহসন!নিজের ওপরেই এবারে পুরোপুরি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন তিনি।একটা বছর বারোর মেয়ে...দিনের পর দিন তাঁর সঙ্গে এইরকম একটা খেলা কিভাবে খেলে চলেছে!তাঁর হাতের গতি ক্রমশ দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকল...আর ধীরে ধীরে মাটির ওই খোঁড়া জায়গাটাতে একটু একটু করে উন্মোচিত হতে থাকল আস্ত একটি নরকঙ্কাল! দরদর করে ঘামতে শুরু করলেন চিন্ময় বাবু।হঠাৎ একটা পায়ের শব্দ শুনতে পেলেন যেন তিনি।প্রচন্ড ভয়ে আর আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে সদ্য উন্মোচিত নরকঙ্কালটাকে চাপাচুপি দিয়ে ঢাকার মধ্যে না গিয়ে আগে পড়ি কি মরি করে নিজের গা ঢাকা দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে তৎক্ষণাৎ সেই স্হান হতে প্রচন্ড বেগে ছুটে পালাতে গেলেন চিন্ময়বাবু।তিনি এতটাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লেন...যে পায়ের শব্দটা কোনদিকে থেকে আসছে...সেটা ঠাহর করার ক্ষেত্রেই বেমালুম ভুল করে বসলেন।প্রচন্ড বেগে দৌড়াতে গিয়ে যার একেবারে সামনাসামনি পড়ে গেলেন...সে আর কেউ নয়।সুশীল।ওকে দেখামাত্র যেন প্রচন্ডভাবে ক্রোধে ফেটে পড়লেন চিন্ময় বাবু। "কি মনে কর তুমি নিজেকে!খুব চালাক তাই না!আমাকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে নিজের হাত ধুয়ে নিতে চাইছ তুমি!" প্রচন্ডভাবে হাঁপাতে হাঁপাতে কথাগুলো যথাসম্ভব গোপনীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করে যথাসম্ভব ধীর শব্দে বললেন চিন্ময় বাবু। "শ্...শ্...শ্...শ্...আস্তে কথা বলো ছোটকাকা...আমার জন্য নয়...তোমার ফাঁসির দড়ি প্রস্তুত করছ তুমি নিজে।আমি কোনো অপরাধ করিনি যে আমার হাত ধুয়ে নেবার কোনো প্রসঙ্গ আসবে।নিজে খুন করে...তারপর আমাকে ব্ল্যাকমেল করে ভালোই তো নিজের বাঁচার রাস্তা করে নিয়েছিলে!এখন দেখো...সত্যিটা তুমিই নিজের হাতে খুঁড়ে বার করলে!" প্রচন্ড ক্রোধ আর ঘৃণামিশ্রিত কন্ঠে কথাগুলো বলল সুশীল। ---"দ্যাখ সুশীল...এমনিতেই আমার মাথাটা তেতে রয়েছে।তুই আর তাতে লঙ্কাবাটা দিস না।এই বাড়িতে আমার রেপুটেশনটাই কিন্তু আমার বেঁচে যাবার জন্য যথেষ্ট।এ বাড়ির ছেলে আমি।আর তুই!ফুঃ...চালচুলোহীন একখানা অনাথ ছেলে...তোকে চোর বা খুনি প্রমাণ করাটা আমার বাঁ হাতের খেলা।তোর অপকর্ম আমি নিজের হাতে মাটি খুঁড়ে বার করেছি...এটা প্রমাণ করাটা আমার কাছে জলভাত।সহায়সম্বল দরকার তোর...আমার না।এখন তুই আমাকে সত্যি কথা বল।লাশ নিয়ে তুই কি করেছিস!আমি যেটা মৃতদেহ ভেবে মাটিচাপা দিতে বলেছিলাম তোকে...ওটা কি আদৌ মৃতদেহ ছিল...নাকি তুই ওকে বাঁচিয়ে তারপর লুকিয়ে রেখেছিলি!আমাকে সত্যিটা বল।" চিন্ময় বাবুর কন্ঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে তীব্র রোষানল। ---"মাথা ঠান্ডা করো ছোটকাকা।এই ব্যাপারটা আমারো মাথায় ঢুকছে না এতদিন ধরে তো আমিও প্রচন্ড ভয়ে ছিলাম।কারণ এই খুন যে কে করেছে...তার কোনো প্রমাণই নেই।দিদুনের আলমারি থেকে দামী কয়েকটা গয়না সরাতে গিয়ে যখন তোমার সামনে ধরা পড়েছিলাম...তখন টাকার সত্যিই ভীষণ দরকার ছিল আমার।না হলে পাওনাদাররা হয় আমাকে মারত...নয় আমাকেই আত্মহত্যা করতে হত।কিন্তু আমি বুঝিনি...যে এর চাইতেও আরো খারাপভাবে ফেঁসে যাব আমি।টাকা চুরির কথাটা গোপন রাখার কথা দিয়ে তুমি যখন আমার হাতে লাশটা তুলে দিলে ওটা নিজের দায়িত্বে লোকচক্ষুর আড়াল করার জন্য...তখন বুঝিনি...তোমাকে ওই খুন করতে দেখে ফেলাটাই আমার সর্বনাশের কারণ যার থেকে কোনো নিস্তার আমার নেই।ওই খুনের সাক্ষী এই পৃথিবীতে একমাত্র আমি...যার উপর যেকোনো ধরনের দোষ চাপিয়ে তাকে ফাঁসিতে পর্যন্ত লটকানো সম্ভব।কারণ যে ছেলের কোনো সহায়সম্বল নেই...একজন বৃদ্ধা মহিলার অন্ধ স্নেহ তাকে সবধরনের বিপদ থেকে বাঁচাতে অক্ষম।তাই আমি তোমার ওই ঘৃণ্য অপরাধের দায়ভার নিজের হাতে নিয়ে লাশটা গায়েব করেছিলাম নিজের দায়িত্বেই।পাগলেও নিজের ভালো বোঝে।কাজেই এটা ভেবো না...ওই কাজে কোনোরকম ভুলচুক ছিল আমার।আমি হঠাৎ করে ফিরে এসে ঠিক যেভাবে চমকে গিয়েছিলাম...ভয়ে ভয়ে ছিলাম...ওই ভয় এতদিনে তোমাকেও গ্রাস করেছে বুঝতে পারছি।যেদিন থেকে তুমি এটা বুঝেছ...নিশ্চিন্তে ফের আগের মতো আরো একটা ঘৃণ্য অপরাধ করে তারিয়ে তারিয়ে তার মজা নেবার জন্য জিভ চাটতে থাকাটা আসলেই নিজের পায়ে নিজের কুড়ুল মারা...তখনই নিজের অপরাধের জলজ্যান্ত পরিহাসকে চোখের সামনে দেখে দেখে সন্দেহটা আমাকেই করলে।তোমাকে ফাঁসিয়ে আমার মতো সহায়সম্বলহীন একটা ছেলের কোনো লাভই নেই।নিজের কবর তুমি নিজেই খুঁড়েছ।এখন আমার সঙ্গে চটপট হাত লাগিয়ে ওই মৃতদেহ ঢাকা দিতে থাকো কাকপক্ষী টের পাওয়ার আগেই।তুমি নিজেকে বাঁচাও...আর আমিও নিজেকে বাঁচাই।অপরাধ কিভাবে জীবন্ত হয়ে আমাদেরই সামনে চলেফিরে বেড়াচ্ছে...সে প্রশ্নের সমাধান তারপরে করতে হবে।জলদি এসো।" এই বলে সাথে সাথে সুশীল হনহন করে এগিয়ে চলল সদ্য উন্মোচিত হয়ে পড়া নরকঙ্কালটির দিকে।আর সুশীলের পিছন পিছন হতবুদ্ধি হয়ে এগোতে থাকলেন চিন্ময়বাবু।চারদিকে ঝিঁঝিঁ পোকারা উচ্চৈঃস্বরে ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে।এই প্রথমবার আকাশের গায়ে ফুটে ওঠা একফালি চাঁদের সৌন্দর্য দেখে চিন্ময়বাবুর শুধু মনে হতে থাকল...এই স্নিগ্ধ চাঁদের আলোতেই যদি কেউ আড়াল হতে দেখে ফেলে চক্রবর্তী বাড়ির ভিতরে ঘটে যাওয়া ন্যক্কারজনক অপরাধের এই পাথুরে প্রমাণখানি! মানুষের লাশের পচা দুর্গন্ধটা সদ্য চারপাশের বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করে দিয়েছে।মাস ছয়েক আগে এইরকমই একটা নির্জন রাতের নিশুতি অন্ধকারে সুশীল একা...সকলের অগোচরে এই জায়গার মাটি খুঁড়ে লাশ পুঁতেছিল।আর মনে মনে শুধু ভাবছিল..."হায় ভগবান...এ কি জঘন্য একটা পাপের দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়ে ফেঁসে যেতে হল...!" সত্যিই সেদিন যদি দিদুন তাঁর দামী কিছু অলঙ্কার পরীকে না দিয়ে নিজের কাছে রাখতেন...তাহলে ওই অলঙ্কার চুরি করার জন্য ওকে বড়দার ঘর সেদিন মাড়াতেই হত না।এখনো সেই সময়টা ওর মনে ভেসে উঠতেই ওর যেন গা গুলিয়ে উঠল।নিকট প্রতিবেশীর বিয়েতে যাওয়ার জন্য গোটা চক্রবর্তী পরিবার যখন প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে...তখন দর্জিবাড়ি হতে সদ্য আসা জামাখানি গায়ে ঠিকমতো আঁট না হওয়ার কারণে মন খারাপ করে যখন পরী বিয়ে বাড়িতে যাওয়াটাই ক্যানসেল করে বসল...তখন মনোরমা দেবী স্বামীকে বলেছিলেন...মেয়ের সঙ্গে তিনিও বাড়িতেই থেকে যাবেন।কিন্তু সঞ্জয় বাবু মনোরমা দেবীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে গেলেন নিজেদের সাথে।কারণ মনোরমা দেবীকে না নিয়ে গেলে বিয়ের কনে যথেষ্টই মন খারাপ করবে।আর তাছাড়া বাড়িতে মা তো রয়েই গেলেন।আর ঘরে চাকরবাকর সবাই রয়েছে।সন্ধ্যা হতে রাত...ওইটুকু সময়ের জন্য পরী একা ঠিকই থাকতে পারবে। বাস্তবিকই বিয়ে বাড়িতে এক গায়ত্রী দেবী বাদে প্রত্যেকেই গিয়েছিল।এমনকি সুশীল নিজেও বাদ ছিল না।কিছু ও মনে মনে তখন অন্য এক পরিকল্পনা ছকে নিচ্ছিল।বিয়ের অনুষ্ঠানে পরার জন্য দিদুন পরীকে যে অলঙ্কারগুলি দিয়েছিলেন সেগুলো একবার হাতাতে পারলেই শোধ হয়ে যাবে ওর সমস্ত দেনা...! সকলের সঙ্গে বিয়েবাড়িতে সুশীল গিয়েছিল বটে...কিন্তু এতবড় নিমন্ত্রণ বাড়ির ভিতরে বিয়ের অনুষ্ঠান চলাকালীন খানিকটা সময় পেরোনোর পর স্বাভাবিকভাবেই আর সুশীল সেখানে আছে কি নেই সেটা নিয়ে ভাবার মতো কেউ ছিল না।সকলের চোখ এড়িয়ে সুশীল কখন যে বিয়েবাড়ি হতে বেরিয়ে গিয়ে রওনা দিয়েছে বাড়ির দিকে...সেটা কেউই জানতে পারেনি।বড়দার ঘরে তখন একাই ছিল পরী।কোন জায়গায় কিভাবে লুকিয়ে থেকে কিভাবে জিনিসগুলোকে হাতে করতে হবে...সেটা সুশীল মনে মনে ভেবেই রেখেছিল।সেইমতোই ও চক্রবর্তী বাড়ির পিছন দিয়ে লুকিয়ে পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকে সকলের অগোচরে দেওয়াল ধরে ধরে কোনোমতে পৌঁছে গিয়েছিল তিনতলায়...বড়দার ঘরের জানলার কাছটায়।কাকপক্ষীতে টের পাওয়ার আগেই সুশীল...টেবিলের কাছটায় গল্পের বইএ মগ্ন পরীর দৃষ্টি এড়িয়ে নিঃশব্দে ঢুকে গিয়েছিল সে ঘরের ভিতরে।ঢুকেই সুশীল লুকিয়ে পড়ল বিরাট পালঙ্কের তলায়।পরী সেসবের কিছুই টের পেল না।বাথরুমে যাওয়ার জন্য পরী যে কখন চেয়ার থেকে উঠবে...সুশীল সেইটারই অপেক্ষা করছিল প্রাণপণে।মিনিট দুয়েকের জন্যও পরী ওই ঘরের বাইরে গেলে...কিভাবে গয়নাগুলো হাতে করতে হবে...সেটা সুশীলের খুব ভালোভাবেই জানা।সময় যত এগোতে থাকে...পালঙ্কের ভিতরে গা ঢাকা দিয়ে বসে থাকা সুশীলের হৃদস্পন্দন ততই যেন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।এইভাবে কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ।হঠাৎ আসল সুশীলের পরম কাঙ্খিত সেই মূহুর্তখানি।হ্যাঁ।পরী ঘরঘর শব্দ করে চেয়ারটা ঠেলে সরিয়ে উঠে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।পাওনাদারদের বজ্রমুষ্ঠিতে কন্ঠরোধ করা এই প্রতিকূল পরিস্থিতি হতে রেহাই পাওয়ার আনন্দে তখন সুশীলের মনের ভিতরে প্রফুল্লতা আর উত্তেজনা দুইই একদম চরমে।আর তো কিছুক্ষণের অপেক্ষা।তারপরেই এক্কেবারে মুশকিল আসান।সুশীল যখন বুঝল...পরী বাথরুমের দরজায় ছিটকিনি দিয়েছে...তখনই আর কালবিলম্ব না করে ও পালঙ্কের তলা থেকে বেরিয়ে এসে ঝটপট সেরে নিল নিজের কাজ।গয়নাগুলো নিজের হাতে করে নিয়েই সাথে সাথে...পালাবার জন্য ফের ও জানলার দিকে এগোতে যাবে...ঠিক এমন সময় ও ওই ঘরের বাইরে অন্য একটি পায়ের শব্দ পেল।এই অসময়ে...এই ফাঁকা বাড়ির ভিতরে এই ঘরে আসবার মতো আছেটাই বা কে!দিদুনের ঘর তো ওপরের তলায়।উনি তো সিঁড়ি দিয়ে ওপর নীচ করাটা যতটা সম্ভব এড়িয়েই চলেন।আর চাকর বাকরেরা বিনা অনুমতিতে কখনোই মনিবের ঘরে ঢুকবে না।তাহলে এখন এই ঘরের দরজার দিকে ক্রমশ জোরালো হয়ে আসছে কার পায়ের আওয়াজ!সাথে সাথে ও প্রমাদ গুনল।ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে ও দরদর করে ঘামতে শুরু করল।চুরি করার জন্য বড়দা যদি ওকে সবার সামনে খড়ম দিয়েও পেটান...তাহলেও ওর সমস্যা নেই।কিন্তু এবার যদি ও ধার না শোধ করতে পারে...তাহলে মরা ছাড়া আর কোনো রাস্তাই খোলা থাকবে না ওর সামনে।ওর এই দুরবস্থার কথা বড়দাকে সরাসরি বলতে পারলে এই চুরিটা করার দরকারই পড়ত না ওর।বড়দা স্নেহপরায়ণ মানুষ...দয়াপরবশ হয়ে ঠিকই সাহায্য করতেন সুশীলকে।কিন্তু বেআইনি ব্যবসা করার জন্য ধার করতে হয়েছে...এটা বলা ছাড়া আর কোনো উপায়ই থাকত না সেক্ষেত্রে।আর সবটা জানার পর কোনো সাহায্য তো সুশীল পেতই না...উপরন্তু এই চক্রবর্তী পরিবার হতে ওর জুটত অর্ধচন্দ্র।অতি কষ্টে যাও বা পরিস্থিতি হতে একটা সুরাহা পাওয়ার উপায় করে নিয়েছিল সুশীল...কিন্তু তীরে এসেই তরীটা ডুবতে যাচ্ছে এখন শেষে।প্রচন্ড ভয় পেয়ে তড়িঘড়ি পালানোর পথের দিকে চাইতেই ও বুঝল...দরজার বাইরের আগন্তুকটি সেখানে সুশীলকে পরিষ্কার দেখতে পেয়ে যাবে।পায়ের আওয়াজ একেবারে ঘরের দরজার ভিতর পর্যন্ত আসবার আগেই বিদ্যুত গতিতে সুশীল ফের লুকিয়ে গেল ওই পালঙ্কের তলাটায়। ওর বুকের ভিতরে যেন কামারের হাতুড়ি পেটা শুরু হয়েছে।আরো কয়েক মূহুর্ত কাটল চুপচাপ...নিঃশব্দ...।একটা সময় পরে বাথরুমের দরজা হতে বেরিয়ে এল পরী।ওর চোখেমুখে বিন্দু বিন্দু জল।এই প্রচন্ড গরমে তিষ্ঠাতে না পেরে পরী যে চোখে মুখে আর হাতে ভালো করে জল দিয়ে বেরিয়েছে...সেটা আর বোঝার বাকি থাকে না।বাথরুম থেকে বেরিয়ে জানলার কাছে মেলে রাখা শুকনো টাওয়ালটার দিকে যেই হাত বাড়াতে যাবে পরী...ঠিক সেই মূহুর্তেই ওকে পিছন থেকে একেবারে জাপটে ধরল যে...এবার তাকে স্পষ্টভাবে দেখতে পেল সুশীল ওই পালঙ্কের নীচে লুকিয়ে থাকা অবস্থাতেই...!এ তো আর কেউ নয়...ছোটকাকা!আশ্চর্য...ছোটকাকার তো এখন বিয়েবাড়িতে থাকার কথা!অন্ততঃ সুশীল পরিবারের সকলের সাথে বিয়েবাড়ির দিকে রওনা দিচ্ছিল...তখন ছোটকাকা তো ওদের সকলের সঙ্গেই ছিল...!এমনকি বিয়েবাড়ির ভিতরেও সকলের সঙ্গে হাস্যমুখে আলাপচারিতায় ব্যস্ত ছোটকাকাকে সুশীল নিজেই দেখে এসেছে।তাহলে সেই মানুষটাই এখন এই ফাঁকা বাড়িতে একা পরীর ঘরে এইভাবে চোরের মতো ঢুকেছেন কি মতলবে?আর যাও বা ঢুকলেন...এইভাবে নিঃশব্দে ঢুকে ভিতর থেকে দরজার ছিটকিনি আটকে দিয়ে তারপর একা পরীর ওপরে এইভাবে পিছন থেকে চড়াও হওয়ার মানেটাই বা কি!যদিও চুরির জিনিসটা কব্জায় চলে আসবার পর এখন ওই ঘরের ভিতর ভূমিকম্প হয়ে গেলেও তাতে কিছুই যায় আসে না সুশীলের।কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমনই...ওখান থেকে সুশীলের চম্পট দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও কোনো উপায় নেই।কি আর করা...কলে পড়া ইঁদুরের মতোই পালঙ্কের তলা থেকে সবটা নিরীক্ষণ করে যাচ্ছিল সুশীল...আর অপেক্ষা করে চলেছিল শুধু একটা সুযোগের...যাতে যেভাবে সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এই ঘরের ভিতরে ঢুকে ও কাজ হাসিল করেছিল...ঠিক ওই একইভাবে এই ঘরের বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে।কিন্তু ক্রমশ ঘরের ভিতরে যে পরিস্থিতি তৈরি হতে শুরু করেছে...তাতে তো এবার রাগে...ঘেন্নায় ওর নিজেরই মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল...কারণ এতখানি ন্যক্কারজনক আর ঘৃণ্য...অসহনীয় দৃশ্য চোখের সামনে দেখে যেতে হচ্ছে ওকে পুরোপুরি কাঠপুতুলের মতো...যা চোখের সামনে সহ্য করাটা যতখানি অসম্ভব...সশরীরে বাইরে বেরিয়ে এসে সেটা আটকানোটাও ওর পক্ষে ততখানিই অসম্ভব।সুশীল নিজে এমনিতে কম বেলেল্লাপনা করে বেড়ায় না।মদ...জুয়া...বখাটে বন্ধু জুটিয়ে মজলিশ...ছোটখাটো চুরি চামারি এইসব "চমৎকার গুণগুলো" হচ্ছে ওর স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য।ওকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে নেবার পর কোনো মানুষই যে অন্তত ওকে ভদ্র ছেলে বলবে না...এই ব্যাপারে ও একেবারে নিশ্চিত।কিন্তু আজকের আগে পর্যন্ত ও এটা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি...যে দামী স্যুট ব্যুট পরিহীত...আর হাতে বিলিতি চুরুটের ধোঁয়া সহযোগে...মুখে ইংরেজী বুলি আওড়ানো আপাদমস্তক ভদ্রসভ্য...হাই সোশ্যাইটিতে ওঠাবসা করা এই ছোটকাকা আসলেই ওর থেকেও অসভ্য আর কদর্য।প্রবল ক্রোধ চেপে সুশীল শুধু দেখতে থাকল ওই ঘরের ভিতরে ছোটকাকার ন্যক্কারজনক কান্ডকীর্তি।ও দেখল...হাত বাড়িয়ে টাওয়ালখানি ধরতে যাওয়ার সাথে সাথেই কিভাবে পিছন থেকে পরীকে একেবারে জাপটে ধরল ছোটকাকা।আর পরী যাতে মুখ থেকে কোনো শব্দ না বার করতে পারে...তার জন্য হাতের তালু দিয়ে প্রচন্ড জোরে ছোটকাকা চেপে ধরেছে পরীর মুখখানি।হঠাৎ এমন এক অযাচিত আক্রমণে যারপরনাই দিশাহারা পরীর চোখ দুটো থেকে বিস্ফারিত আতঙ্কের তীব্র ক্রন্দনের চাপা বহিঃপ্রকাশ হতে থাকল শুধু...যা কেবলই একটা চাপা গোঙানি হয়ে ঘরের বাতাসে ক্ষীণভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল।সুশীল দেখল...এক হাতে পরীর মুখখানা সজোরে চেপে ধরে অন্য হাত দিয়ে ছোটকাকা এক কদর্য লালসার খেলায় মেতে উঠছে ধীরে ধীরে।ছোটকাকার হাতের আঙুলগুলো প্রচন্ড ঘৃণ্য রূপ ধারণ করেছে মূহুর্তের মধ্যেই...আর সেগুলি খেলা করতে আরম্ভ করেছে পরীর জামার ভিতরে...নিষিদ্ধ গলিখুঁজির উন্মত্ত সন্ধানে মরিয়া হয়ে।সুশীল পরিষ্কার শুনতে পেল...চাপা গলায় ছোটকাকা বলছে..."এইবার তুই আমার হাত থেকে পালাবি কোথায় পরী?ওই দ্যাখ...ঘরের কোণায় ক্যামেরা একেবারে ফিট করে রেখেছি।এইবার এই ঘরে যা যা হবে...সেটা গোটা দুনিয়া দেখবে।বদনাম হবে তোর।আমার মুখটা ওতে বোঝাই যাবে না।তোর এই ডাগর শরীরটা শুধু পাবার জন্য তোর এইসব ফড়ফড়...ডানা ঝাপটানি অনেক সহ্য করেছি।আর না...!এমনিতেই তোর একটি কথাও তোর বাপ...মা...ঠাকুরমা...কেউ বিশ্বাস করে না।ভবিষ্যতেও কোনোদিন করবে না।কিন্তু এই ভিডিও এখন আমার হাতে আসবার পর এখন থেকে আমি যখন যেভাবে চাইব...তখন ঠিক সেইভাবে চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মতো তুই আমার সামনে এসে নিজের হাতে নিজেকে নিরাবরণ করবি আমার জন্য।তোদের মতো উড়ন্ত প্রজাপতিকে কি করে হাতের মুঠোয় ধরতে হয়...সেটা ভালোই জানা আছে আমার।বুঝেছিস!" এই বলে ছোটকাকা একটা শক্ত কাপড়ের টুকরো দিয়ে প্রচন্ড শক্ত করে খুব অল্প সময়ের মধ্যে বেঁধে ফেলল পরীর মুখ।আর তারপর একটা প্রচন্ড হ্যাঁচকা টানে ওই পালঙ্কের ওপরে পরীকে একেবারে ছুঁড়ে ফেলল ছোটকাকা।আর তারপর এক লাফে তিনি নিজেও উঠে পড়লেন পালঙ্কের ওপরে।আর তারপরেই...সুশীল এবার টের পেল...পালঙ্ক জুড়ে যেন নেমেছে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল কাঁপানো ভয়াল ভূমিকম্প।রাগে...ঘেন্নায়...সুশীলের সারা শরীর ঘিনঘিন করতে লাগল যেন। এইভাবে কেটে গেল বেশ কিছু পৈশাচিক মূহুর্ত...।সুশীলের পরিস্থিতিটা ঠিক যেন ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো।ওইভাবে আটকেও থাকতে পারছে না...আবার কোনোমতে বমি চেপেটেপে সে ঘর থেকে বেরোতেও পারছে না।পরীকে এই মুখোশধারী জানোয়ারটার হাত থেকে বাঁচানোর যে কোনো ক্ষমতাই সুশীলের নেই...এটা ও ভালোভাবেই জানে।কিন্তু পালঙ্কের তলায় ওইভাবে ঘাপটি মেরে নিশ্চুপ হয়ে পড়ে থাকতে থাকতে ও তখন শুধু ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছিল..."হে ভগবান...এ যাত্রা আমার এই অপকর্মটা উদ্ধার করে দাও...এই ঘর থেকে সকলের অলক্ষ্যে বেরিয়ে যেতে পারলে আমি বাঁচি...!" দমবন্ধ করা ওই অসহ্য মূহুর্তটার শেষ হওয়ারই অপেক্ষা করছিল ও প্রাণপণে...কিন্তু হঠাৎ করে যেটা ঘটল...সেটার জন্য ও মোটেই প্রস্তুত ছিল না।পরীর গলা থেকে একটা চাপা আর্তধ্বনি প্রবলভাবে বেরিয়ে আসছিল গোঙানির মতো।হঠাৎ সেই গোঙানির শব্দও বন্ধ হয়ে এতক্ষণ ধরে চলতে থাকা সব তান্ডবলীলা এক মূহুর্তে পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেল।পালঙ্কের নীচে থেকে...পালঙ্কের ওপরে যে এখন আদৌ কারোর অস্তিত্ব রয়েছে...সেটা বোঝার এখন বোঝাই যাচ্ছে না।একটা কোনো অঘটনের আশঙ্কায় এবার প্রমাদ গুনল সুশীল।হঠাৎ ওর পায়ের সাথে ধাক্কা লেগে খাটের পাশে রাখা টেবিলটা সামান্য নড়ে উঠল।আর তার ফলে টেবিলের ওপরে রাখা শরবোতের গ্লাসখানি উলটে পড়ল মাটিতে।ঘটনার আকস্মিকতায় প্রচন্ডভাবে ঘাবড়ে গেল সুশীল।আরো খানিকটা সরে গিয়ে পালঙ্কের একেবারে ভিতরে ঢুকে যেতে চাইল ও।আর তার ফলপ্রসূ অসাবধানতাবশত ওর পা টা যে পালঙ্কের বাইরে বেরিয়ে এসেছে...সেইটা খেয়ালই করেনি সুশীল।এতক্ষণ তো ঘটনার মোড় একটাই দিকে এগোচ্ছিল।কিন্তু এর ফলে পুরো ব্যাপারটাই সম্পূর্ণ অন্যদিকে মোড় নিল।যদিও পালঙ্কের ওপরে এখন ঠিক কি ঘটেছে...তার কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারেনি সুশীল...কিন্তু পালঙ্কের ওপরে থেকে,চিন্ময় বাবু পরিষ্কার দেখতে পেলেন...সেই মূহুর্তে ওই ঘরের ভিতরে তিনি আর পরী বাদে আরেকজন তৃতীয় ব্যক্তির অস্তিত্ব।আর তার পরক্ষণেই আর কালবিলম্ব না করে সাথে সাথে তিনি পালঙ্কের তলায় চাক্ষুষ করলেন সুশীলকে। ব্যস...এই পুরো ব্যাপারটার যে একজন সাক্ষী থেকে গেল...এটা এখন চিন্ময় বাবু পরিষ্কার বুঝে গেলেন।নিজের চুরি করা জিনিসপত্র হাতে করেই সুশীল একবুক পাপবোধ নিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়াল চিন্ময় বাবুর সামনে।আর বমাল সমেত সুশীলকে দেখামাত্রই চিন্ময় বাবু পরিষ্কার বুঝে গেলেন...সুশীল এই মূহুর্তে এই পালঙ্কের নীচে কেন লুকিয়েছিল গোপনে...!কিন্তু সুশীল পালঙ্কের বাইরে থরোথরো হৃৎপিন্ড নিয়ে বেরিয়ে আসার পরক্ষণেই বুঝল...যে চরম পাপকাজটা এইমাত্র ঘটে গেল এই ঘরের ভিতরে...তার কাছে সুশীলের এই অপকর্মটা নেহাতই নস্যি কারণ পালঙ্কের ওপরে সম্পূর্ণ নিরাবরণ অবস্থায় শায়িত বারো বছরের মেয়ে পরীর শরীরে যে এখন আর প্রাণ নেই...সেটা ওর বুঝতে আর বাকি নেই।এবার নিজের চুরি ধরা পড়ে যাওয়া...বা তার পরিণতি নিয়ে কোনোরকম ভাবনাচিন্তা করা...এইসব ওর ভিতরে এলই না।সমস্তকিছুকে ছাপিয়ে গিয়ে এবার প্রচন্ড রেগে ফুঁসে উঠল সুশীল।ও রেগে চিৎকার করে উঠল।"এটা তুমি কি করেছ ছোটকাকা!ওকে তুমি খুন করলে!" আর তার সাথে সাথে প্রায় দ্বিগুণ ফুঁসে উঠে সুশীলকে বলে উঠলেন চিন্ময় বাবু..."চো...ও...ও...প" একদম চুপ করে থাকবি তুই..." এরপর কাটল আরো কিছু নিঃশব্দ মূহুর্ত...!রাজকীয় পালঙ্কের ওপরে পড়ে রয়েছে পরীর নিষ্প্রাণ দেহ...আর তার দুইপাশে দুজন অপরাধী তাকিয়ে রয়েছে পরস্পরের দিকে।একজনের চোখে ঝরছে ক্রোধের রোষানল...আর অন্যদিকে আরেকজনের চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ভীতি আর তীব্র আতঙ্ক...! নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে চিন্ময় বাবু বলে উঠলেন..."আমি ওকে প্রাণে মারার জন্য এখানে আসিনি...বিশ্বাস কর সুশীল... আর ওকে মারতেও চাইনি আমি।কিন্তু এই মেয়েটাকে নিজের বাগে আনা প্রচন্ড মুশকিল।ওকে লোভ দেখিয়ে...মিষ্টি কথা বলে...কোনোমতে বাগে আনতে পারলাম না বলেই আমার রোখ চেপে গিয়েছিল...যে ওইটুকুন মেয়ে...আমার সামনে তার এত তেজ কেন!অন্যভাবে ভয় দেখিয়ে ওকে বাগে আনতে চেয়েছিলাম আমি...আর এইটুকুই ছিল আমার উদ্দেশ্য।কিন্তু এই অ্যাত্তটুকুন মেয়ে...এর আজ আমি ইজ্জত পুরো নষ্ট করে দিলাম...কিন্তু তা সত্ত্বেও এর ফোঁসফোঁসানি কমার নাম নেই... !ওকে থামানোর জন্য ওর গলাটা শক্ত করে চেপে ধরেছিলাম আমি।এতে যে ও মরে যাবে...এটা আমি বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছি রে...!" চিন্ময়বাবুর লাজলজ্জাহীন অভিব্যক্তি আর কথা শুনে এবার সুশীল ওর হাতে রাখা গয়নাগুলো পালঙ্কে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এবার রাগে ফুঁসতে থাকল। চিন্ময় বাবু ফের বলতে শুরু করলেন। "যাক গে...যা হবার সেটা তো হয়ে গিয়েছে...!এখন তুই এই মৃতদেহটাকে তোর নিজের দায়িত্বে সরিয়ে ফেলবি।কারণ খুনটা আমি না...করেছিস তুই...সেইটাও আবার গয়না চুরি করতে গিয়ে পরীর কাছে ধরা পড়ে গিয়ে।" কথাগুলো বলবার সাথে সাথেই একটা ক্রুর হাসি খেলে গেল চিন্ময় বাবুর মুখ জুড়ে।তিনি একেবারে ছোঁ মেরে হাতে তুলে নিলেন সুশীলের চুরি করা গয়নাগুলো।ঘটনায় আকস্মিকতা এবার সুশীলকে প্রচন্ডভাবে বিস্মিত করে তুলল।নিজের সীমাহীন ভয়ংকর পরিণতির অশনিসংকেত যেন কাঁটার মতো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে লাগল সুশীলের সর্বাঙ্গ।ওর পায়ের তলার জমি নড়ে উঠল যেন ভীষণভাবে...! প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়ে সুশীল তুতলিয়ে গিয়ে বলল..."এ...এ...এ...এসব কি বলছ তুমি ছোটকাকা!" ---"শোন...আর এক মূহুর্তও সময় নষ্ট করিস না।বিয়েবাড়ির ভীড়ের ভিতরে...আমরা দুজনেই যে নেই...সেটা হয়তো এতক্ষণে কেউই খেয়াল করেনি।এইসব ঝামেলা মিটিয়ে বিয়েবাড়ির ভিতরে আবার আগের মতো গল্পকথায় ব্যস্ত হয়ে উঠতে হবে আমাদের।এটা করলেই এই খুনের দায় থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব হবে।আমি তো এক্ষুনি এই ঘর থেকে বেরিয়ে যাব।এখন তুই দেখ...এই লাশ নিয়ে তুই কি করবি...!নিজের দায়িত্বে লাশ যদি সরাতে পারিস তো ভালো...না হলে তোকে চোর এবং খুনি প্রমাণ করে ফাঁসিতে ঝোলানোটা আমার কাছে বাঁ হাতের খেল।আর একটা কথা...যদি লাশ ঠিকভাবে সরাতে পারিস...তাহলে এইসমস্ত গয়না আমি নিজে হাতে তোর হাতে তুলে দেব।এই খুনের কথা ফাঁস করার কোনোরকম চেষ্টা ভবিষ্যতেও যদি করতে চাস...তাহলে আমি না...খুনের দায়ে ফাঁসবি তুই।এখন তোর যা করার কর...আমি আসলাম।" কথাগুলো বলে চিন্ময়বাবু চোরের মতো বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।চক্রবর্তী বাড়ি তখন এক্কেবারে খালি।চাকরবাকরের চোখ এড়িয়ে কি করে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যায় চুপিসারে...এটা তো চিন্ময়বাবুর খুব ভালোভাবেই জানা।অতএব এতবড় একটা জঘন্য পাপ করে তার দায় পুরোপুরি সুশীলের ওপর চাপিয়ে দিয়ে চিন্ময়বাবু এই যে গা ঝাড়া দিয়ে বেরিয়ে গেলেন...এখন তিনি সকলের সমস্ত সন্দেহের উর্দ্ধে চলে গেলেন।আর কেউ কোনোদিন তাঁকে অন্তত কোনো সন্দেহ করবে না।আর বিপাকে পড়ে কিছু গয়না চুরি করতে এসে এখন এই পুরো অপকর্মের দায় সুশীলকেই একা হাতে নিয়ে সেটা চাপাচুপি দিতে হবে। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে সুশীলের মনের ভিতর ভেসে উঠছিল মাস ছয়েক আগের সেই দুঃসহ সময়ের ছবিগুলি।ছোটকাকার ওপরে রাগে...ঘেন্নায় ওর সমস্ত শরীর একেবারে রি রি করছে।ওর মনে হচ্ছে...এক্ষুনি ছোটকাকাকে গলা টিপে খুন করতে পারলে এই দুনিয়া থেকে কিছু জঞ্জাল সাফ হয়ে যাবে।কিন্তু না...এটা মাথা গরম করার সময় নয়।এতদিন ধরে এই মৃতদেহটার খোঁজ কেউ পায়নি।আর পরীর মৃত্যুর অল্পদিনের মাথাতেই এই চক্রবর্তী পরিবারের ভিতরে এমনই একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে গিয়েছে...যে পরীর নিখোঁজ হওয়া...বা পরীর মৃত্যুর কূলকিনারা করার সমস্তরকমের সম্ভবনাই এক লহমায় চাপা পড়ে গিয়েছে।চক্রবর্তী পরিবারের একমাত্র কন্যাসন্তান হিসেবে এখন যে বছর বারোর মেয়েটি সকলের আদর আর ভালোবাসা আর মর্যাদা নিয়ে পরীর জায়গাটা আলো করে রয়েছে...সে যে পরীর সমস্ত চেহারা এবং মুখের গড়নে হুবহু সাদৃশ্যরূপী এক প্রতিমূর্তি ভিন্ন আর কেউই নয়...সেটা শুধুমাত্র সুশীল আর চিন্ময়বাবু ছাড়া আর কেউ বুঝতেই পারেননি আজ পর্যন্ত।ওরা জানে না...পরীর এই প্রতিমূর্তির আসল নাম বা পরিচয়...!কিন্তু এটা এখন ওরা স্পষ্ট বুঝতে পারছে...এই মেয়ে হল...চুপিসাড়ে হওয়া এই ঘৃণ্য পাপের মুখোমুখি দন্ডায়মান এক অবশ্যম্ভাবী বজ্রনিনাদ ও ঘনঘোর কালবৈশাখী ঝড়ের জলজ্যান্ত অশনিসংকেত। এখন এই ঝড়ের সামনাসামনি হওয়া ভিন্ন আর কোনো উপায়ই নেই ওদের দুজনের কাছে।অতএব নিজেদের মধ্যে কোনোরকম লড়াই-দ্বন্দ্ব কে স্হান দেওয়াটা এই মূহুর্তে মূর্খামি।এটা মাথায় করে...মাথাটাকে যথাসম্ভব ঠান্ডা করে সুশীল এখন কাজে মন দিল।মাটিটা যেভাবে খুঁড়েছেন চিন্ময়বাবু...তাতে আগের মতো নিখুঁত করে কঙ্কালটাকে ঢেকেঢুকে মাটি চাপা দিয়ে আবার আগের মতো করে দিতে যথেষ্টই সময় লাগবে।ফাঁকা বাড়ির ভিতরে বন্ধ দরজার আড়ালে... ন্যক্কারজনক পাপকাজটা বিনা দ্বিধায় করে সেইদিন অনায়াসে হাত ঝেড়ে হেলতে দুলতে পরীর মৃতদেহের সমস্ত দায় আর দায়িত্ব সুশীলের ওপরে চাপিয়ে দিয়ে ওকে ওই ঘরে ওইভাবে একা ফেলে রেখে বেরিয়ে গিয়েছিলেন চিন্ময়বাবু।কিন্তু আজ সেই চিন্ময় বাবু সুশীলকে সেইভাবে একা ফেলে ভিতরে যেতে সাহসই পাচ্ছেন না।ভিতরে গিয়ে এক্ষুনিই যার মুখোমুখি হতে হবে...তার কথা ভেবে যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে চিন্ময়বাবুর।তাঁর মনে হচ্ছে...যেনতেন প্রকারেণ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই মৃতদেহ চাপা দেওয়া দরকার।নিজের সর্বাঙ্গে এবং নিজের হাতের তালুতে মাখানো কদর্য পাপের দুর্গন্ধ এখন রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করছেন চিন্ময়বাবু।তাঁর শুধুই মনে হচ্ছে...আর খুব বেশি সময় নেই তাঁর হাতে।খুব তাড়াতাড়িই মেয়েটা তাঁর সামনে এসে দাঁড়াবে...আর গোটা দুনিয়ার সামনে নগ্ন হয়ে পড়বেন তিনি...আর অসহায়ের মতো কাতরাবে তাঁর সুশিক্ষিত রুচিশীল ভদ্র মানুষের সমস্ত পোশাকগুলি। মোটামুটি দেহটা চাপা দিয়ে ফের প্রায় আগের মতোই জায়গাটাকে করে ফেলেছে ওরা দুজনে মিলে...ঠিক এমন সময় হঠাৎ তীব্রভাবে ওদের দুজনের মুখে এসে পড়ল টর্চের জোরালো আলো।নিস্তব্ধ বাতাস কাঁপিয়ে একটি পুরুষ কন্ঠ শোনা গেল।"হ্যান্ডস আপ"! নিকষ কালো আঁধার রাতে হঠাৎ করে মুখের ওপরে তীব্র টর্চের আলো এসে পড়া মাত্র সুশীল আর চিন্ময় বাবু দুজনেই প্রচন্ডভাবে চমকে উঠে একেবারে দিশাহারা হয়ে গেলেন।চারপাশে বুট পরিহিত পায়ের শব্দ কর্ণগোচর হয়েছে ওদের দুজনেরই...আর তাতে এটা বুঝতে ওদের আর কোনো অসুবিধাই রইল না...যে ওদের পালিয়ে যাবার সমস্ত রাস্তাই একেবারে বন্ধ।আলোটা চোখে সয়ে ওঠবার জন্য যেটুকু সময় নিল...সেটুকু সময় নিল...তারপরে চোখ মেলে চারদিকে তাকিয়ে সুশীল আর চিন্ময়বাবু বুঝে গেলেন...এইবার ওরা ধরা পড়ে গেছে।পুলিশ ওদের দুজনকে একেবারে ঘিরে ফেলেছে।আধ খোড়া কবর হতে এখনো প্রকটভাবে আত্মপ্রকাশ করে রয়েছে মাটি মাখা নরকঙ্কালটি।একেবারে ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো পরিস্থিতি এখন ওদের দুজনের।না পারছে পালাতে...আর না পারছে আসল সত্যিটা লুকোতে!হঠাৎ সেখানে খোঁড়াতে খোঁড়াতে যিনি সামনে এসে দাঁড়ালেন,তাঁকে দেখে তো এবার সুশীল শুধু তীব্রভাবে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগল..."হে ভগবান...কৃপা করো এ অধমের ওপরে...আমার পায়ের নীচের মাটিটাকে এক্ষুনি দুই ভাগ করে দাও...আমি সেখানে আত্মগোপন করে লজ্জার হাত থেকে বাঁচি...!" লাঠির ওপরে ভর করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গায়ত্রী দেবী একেবারে সুশীলের সামনে এসে দাঁড়ালেন! "এতদিন ধরে আমি দুধকলা দিয়ে এই কালসাপ পুষেছি!" প্রবল মনঃকষ্ট...ক্ষোভ আর আক্ষেপ মিশ্রিত তীব্র রোদন চুঁইয়ে পড়ছে বৃদ্ধার কন্ঠের পরতে পরতে!বিশ্বাসঘাতকতার দংশনে তাঁর দুইচোখ দিয়ে ঝরছে বারিধারা...! সত্যি বলতে কি...এই প্রথম লজ্জা বলে বস্তুটি স্পর্শ করল সুশীলকে...যার দরুণ ওর মাথাটা একেবারে নীচু হয়ে গিয়েছে।ও এটা ভালোভাবেই বুঝে গিয়েছে... সমস্তকিছুই এখন হাতের বাইরে চলে গিয়েছে।এই গোটা দুনিয়াতে ওর একমাত্র সহায়সম্বল এই বৃদ্ধাও এখন ওর বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তর্জনী তুলে জবাবদিহি চাইছে...সওয়াল করছে।আর এহেন পরিস্থিতিতে...নিজের বাপের ভিটায়...নিজ পরিবারের ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকা চিন্ময়বাবু সাময়িকভাবে ধরা পড়লেও...উনি ঠিকই এই বিপদের হাত থেকে কিছু না কিছু উপায় বার করে ঠিক নিজেকে বাঁচিয়ে নেবেন।নিজের ভাগ্য এবং তার পরিণতি এখন সুশীল স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে।মুখে ওর কোনো কথা নেই।যেন স্বেচ্ছায় হাঁড়িকাঠে গলা রেখে এখন শুধু প্রতীক্ষা করছে...কখন কোপটা এসে পড়বে...! "আমাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার এত দরকার পড়েছিল রে সুশীল...!সারা হাতে মাটি মাখামাখি করে এ কোন পাপ ঢাকার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলি!বিশ্বাসঘাতকতা...অপহরণ...খুন...!এইসব শব্দগুলোর সঙ্গে তোকে কোনোদিন মেলাতে বসতে হবে...এ তো আমি দুঃস্বপ্নেও কোনোদিন ভাবিনি রে!" চারপাশ নিস্তব্ধ শান্ত। পুলিশ ততক্ষণে কবরের ওপরে ঝুঁকে পড়ে পুরো ব্যাপারটা ইনভেস্টিগেশন করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পুলিশ সুশীলের হাতে হাতকড়া পরাতে পরাতে চিন্ময় বাবুকে জিজ্ঞাসা করল..."স্যার...আপনি এত রাতে এর সঙ্গে এখানে কি করছেন?" সাথে সাথে দুইহাতের মাটি ঝেড়ে সহাস্যে চিন্ময়বাবু বলে উঠলেন..."আরে আর বলবেন না ইন্সপেক্টর মশাই...সে অনেক লম্বা কাহিনী...এ ছেলেকে আমাদের পরিবারে জায়গা দেওয়াটা যে কতবড় ভুল হয়েছে...সেটা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝছি।সবটা এর মুখেই শোনা...।এর তো বরাবরের হাতটানের অভ্যেস।ঘরে ছোটখাটো চুরি...টাকাপয়সা...এমনকি ঘড়ি...চেনটেনও সরাতো।হাঘরের ছেলে তায় অনাথ।...নিচ্ছে যখন নিক...আমি বুঝতে পেরেও ওকে কোনোদিন কিছু বলতাম না।জুয়াটুয়া খেলত এইসব টাকা নিয়ে।এই জুয়া খেলতে গিয়েই মারামারিতে জড়িয়ে একটা খুন করে বসেছে সুশীল।ছুরি বসিয়ে যাকে খুন করতে গিয়েছিল...তার গায়ে ছুরিটা না বসে...ছুরি বসেছিল তার বাচ্চার বুকে।সবাই নেশাগ্রস্ত ছিল বলে এ রক্ষে পেয়েছিল।মৃতদেহটাকে নিয়ে গায়েব করার জায়গা হিসেবে ও বাছল আমাদেরই বাড়ির বাগানখানা...!ভাবুন দেখি...কতবড় দুঃসাহস!ও কবে এই অপকর্ম করেছে...সেটা তো ঈশ্বরই জানেন...কিন্তু এখন কদিন ধরে যখন আমি এই জায়গাটা একটু সাফসুতরো করার কথা ভাবছিলাম...এই জমিটার মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করে...সারটার দিয়ে নতুন কিছু গাছের চারা পুঁতব বলে...তখন থেকেই শুরু হল এনার তীব্র অশান্তি।শেষটায় আমার সন্দেহ হল।ওকে প্রচন্ডভাবে চেপে ধরায় কবুল শেষমেশ সত্যিটা কবুল করেই বসল আমার কাছে।কিন্তু চুরিচামারি করলেও...ও যে খুন করতে পারে...এটা আমার কিছুতেই বিশ্বাস হয়নি।আমি ওকে বলেছিলাম..."ঠিক আছে...ঘটনা যদি সত্যি হয়েই থাকে...তবে এখনই এটা পাঁচকান আমি করব না।তবে আমি নিরিবিলিতে...রাতের অন্ধকারে নিজে ব্যাপারটা চাক্ষুষ করতে চাই একবার।বিশ্বাস করুন ইন্সপেক্টর মশাই...মাটি খোঁড়ার আগের মূহুর্ত পর্যন্ত আমার বিশ্বাস ছিল...সুশীল কোনো খুন করতে পারেই না...!কিন্তু এখন তো দেখতে পাচ্ছি...ও একটা নরাধম বই আর কিছুই নয়!আপনি ওকে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যান ইন্সপেক্টর মশাই...ওর মতো ঠগ জোচ্চর আর খুনির সঙ্গে আমাদের পরিবারের আর কোনো সম্পর্কই নেই!" এতক্ষণে চক্রবর্তী পরিবারের প্রতিটি সদস্য এসে হাজির হয়েছে বাড়ির পিছনের এই পরিত্যক্ত জায়গাটিতে। সকলের চোখে ঝরে পড়ছে সুশীলের প্রতি ঘৃণার রোষানল। মনোরমা দেবী এবারে বলে উঠলেন..."শুধুই খুনী নয়!ও তো একজন অপহরণকারীও বটে।আমার শাশুড়ি মাকে অপহরণ করে বেশ কয়েকদিন ধরে একটা পরিত্যক্ত গুদাম ঘরে আটকে রেখেছিল ও।ও ভেবেছিল...কেউ ওকে ধরতে পারবে না।ওর ঘরে খাবার দিতে গিয়ে আমি যখন দেখি...ওর টেবিলে সেই রুদ্রাক্ষের মালাটা পড়ে রয়েছে...যেটা আগের দিন রাতে পরীকে খেতে ডাকতে ডাকতে এইখানে চলে আসার ফলে হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল...তখনই সন্দেহটা দানা বাঁধে আমার মনে।ওই রুদ্রাক্ষের মালাটা আমার শাশুড়ি মা-ই রাখতে দিয়েছিলেন আমাকে।আমি পরদিন দিনের আলোতে ওই জায়গায় প্রচুর খোঁজাখুঁজির পরেও জিনিসটা পাইনি।আর ওটা সুশীলের টেবিলে পড়ে থাকতে দেখে আমি ওকে ওটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতে যেতেই ও একেবারে ঝাঁঝিয়ে উঠে আমার হাত থেকে কেড়ে নিল ওটা।ও বলল...ওটা নাকি ওর পূজোআচ্চার কাজের জিনিস।অথচ আমরা সকলেই জানি...সুশীল কোনোদিন ঠাকুর দেবতার ধার ধারে না।আমি গোপনে ওর পিছু করে করে অবশেষে সবটা দেখতে এবং জানতে পারি।পুলিশে খবর দিইনি...কারণ এতে আমার শাশুড়ি মায়ের প্রাণের ঝুঁকি রয়েছে।আমি নিজেই একটা সময়ে প্রচন্ডভাবে ঝুঁকি নিয়ে সুশীলের ঘরে ঢুকে সুযোগমতো ওই গুদামঘরের চাবি চুরি করি...আর তারপর আমার শাশুড়ি মাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে তারপর আপনাদে খবর দিই।কিন্তু এখানে এসে তো দেখতে পাচ্ছি কেঁচো খুঁড়তে একেবারে কেউটে বেরিয়ে পড়েছে!চক্রবর্তী পরিবারের ভিতরে অপহরণ...আর পরিশেষে খুন!ওকে এমন শাস্তি দিন...যেন জীবনে ভুলতে না পারে।" তীব্র ক্রোধের সঙ্গে বলে উঠলেন মনোরমা দেবী। সুশীল চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে নির্বিকার একটি মূর্তির মতো।পুলিশ সুশীলের হাতে হাতকড়া পরাতে মনোরমা দেবীকে বলল...আপনি আমাদের খবর দিতে অনেকটাই দেরি করে ফেলেছেন ম্যাডাম।আপনার এত ঝুঁকি নেবার প্রয়োজনই ছিল না।ব্যাপারটা আন্দাজ করার সঙ্গে সঙ্গে যদি আমাদের খবরটা দিতেন ...তাহলে গায়ত্রী দেবীকে ওই বন্ধ গুদাম ঘরের ভিতরে ওইভাবে আটকে থেকে এতদিন ধরে ভুগতে হত না। পাশ থেকে আরেকজন পুলিশ বলল..."কিন্তু স্যার...লাশটাকে তো শনাক্ত করার একটা ব্যবস্হা করা দরকার।" ---"হ্যাঁ।তোমরা কঙ্কালটাকে মাটি খুঁড়ে ওপরে তুলে আনো।এটাকে আমি থানায় নিয়ে গিয়ে একটু খাতির যত্নের ব্যবস্হা করি...লাশ কার...সেটা বেরিয়ে আসতে খুব বেশি সময় লাগবে না। পুলিশ ইন্সপেক্টর বলে উঠলেন। সাথে সাথে হাঁ হাঁ করে উঠলেন চিন্ময় বাবু। "না না...ওসব করার কি দরকার...ও যেসব বন্ধুবান্ধবের সাথে মেশে...তাদের খোঁজখবর নিলেই নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে লাশটা কার।' ---"চিন্ময় বাবু...আপনার জায়গাটা আমি বুঝতে পারছি।আপনার এই পরিবারের খুবই ক্লোজ আমার বাবা।সেই সূত্রেই আমি জানি...ও আপনাদের পরিবারে একেবারে ছোট থেকেই আশ্রিত হিসেবে বড় হয়েছে তো...তাই শত হলেও বড় দাদা হয়ে ভাইএর এহেন পরিণতি ঠিক মানতে পারছেন না।কিন্তু আপনি জানেন না স্যার...এদের একমাত্র ওষুধ হল পুলিশের থার্ড ডিগ্রী।" এহেন পরিস্থিতিতে কেউই খেয়াল করেনি...কখন পরী ঘুমচোখে উঠে চলে এসেছে এখানে।নরকঙ্কালটাকে এখন অনেক মানুষ মিলে ঘিরে রয়েছে।হঠাৎ এই ছোট্ট ভীড়টা দুইহাতে ঠেলে,মাটিতে শায়িত নরকঙ্কালটার একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল হিয়া।চোখদুটো কচলে নিয়ে,তারপর বড় বড় চোখ মেলে দেখতে শুরু করল নরকঙ্কালটাকে।এইবার চিন্ময়বাবুর যেন মনে হতে থাকল..."শেষরক্ষা বোধহয় আর করা গেল না।তাঁর ভরাডুবি হয়তো এই এখন থেকেই শুরু হবে।" মাটি থেকে উন্মোচিত হয়ে পড়া পরীর কঙ্কালটার একেবারে সামনে দন্ডায়মান হিয়াকে দেখে অজানা এক অশনিসংকেত নিজের ভিতরে প্রাণপণ চাপবার চেষ্টা করে চলেছেন চিন্ময়বাবু।সুশীল একেবারে নির্বিকার।চিন্ময় বাবু এবার বেশ জোরেই বলে উঠলেন। ---"পরী মা...তুমি ঘুম থেকে উঠে এখানে আসতে গেলে কেন!এখানে আমরা বড়রা কথা বলছি না...তুমি এখানে এলে শুধু শুধু ভয় পাবে।যাও যাও...ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো ।তোমার মা কে আমরা পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমার কাছে।" সাথে সাথে চিন্ময় বাবুকে বলে উঠলেন সঞ্জয় বাবু..."আহা...তুই আর কিছু বলতে যাস না ওকে।কিরকম ব্যবহার করে ও তোর সাথে...সেগুলো তুই বড় হয়ে ক্ষমা করে দিলেও আমার বড় গায়ে লাগে।আগে বাড়ির গুরুজনদের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয়...সেই শিক্ষাটা ওকে ঠিকঠাকভাবে দিয়ে নিই...তারপর ওর সাথে কথা বলিস ভাই।দোহাই তোর।" হাতজোড় করেই কথাগুলো বললেন সঞ্জয় বাবু। তারপর হিয়ার দিকে তাকিয়ে রাগত কন্ঠে বলে উঠলেন..."তুমি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে এইখানে কি করছ পরী মা...যাও...শুতে চলে যাও...এখানে আমরা বড়রা দরকারী কথা বলছি।তোমার এখানে কোনো কাজ নেই।" তারপর মনোরমা দেবীকে বললেন..."রমা...তুমি এখন বরং মেয়েকে নিয়ে ঘরে গিয়ে শোও...বিশ্রাম নাও।সারাদিনে অনেক ধকল গেছে তোমার।স্বামীর কথায় সম্মত হয়ে মনোরমা দেবী মেয়েকে নিয়ে ঘরে যাবার জন্য ওর হাতটা ধরতে এগিয়ে এলেন।ঠিক এমন সময় যে ঘটনাটা ঘটল...সেটার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না।হঠাৎ একটা প্রচন্ড আর্তনাদ করে হিয়া জ্ঞান হারিয়ে একেবারে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে শায়িত নরকঙ্কালটির ওপরে।আর তার পরমূহুর্তেই হিয়ার শায়িত শরীর হতে একেবারে গলগল করে নির্গত হতে আরম্ভ করল ঘন কালো ধোঁয়া।গভীর রাত।সদ্য খোড়া মাটির আবরণ হতে উন্মোচিত একটা নরকঙ্কালের ঠিক ওপরে আছড়ে পড়ে শায়িত হয়ে পড়া হিয়ার অচৈতন্য শরীরখানি হতে ক্রমে যেন আরো ভয়াল...আরো লেলিহান শিখায় নির্গত হয়ে চলেছে কালো ধোঁয়া...আর তার চারপাশটায় ঘিরে রয়েছে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়া একদল মানুষ।কয়েকজন সহকারীসহ পুলিশ ইন্সপেক্টর..এবং চক্রবর্তী পরিবারের প্রতিটি সদস্য।হিয়ার শরীর থেকে যেভাবে কালো ধোঁয়া নির্গত হয়ে চলেছে...তাতে যে কারোর মনে হবে...ওই জায়গাতে একটা কিছু পুড়ছে।মনোরমা দেবী আর নিতে পারলেন না।তিনি একেবারে ছুটে গেলেন হিয়ার কাছে।ডুকরে কেঁদে আর্তনাদ করে উঠলেন..."পরী মা...কি হয়েছে তোর!" এই বলে ওকে নরকঙ্কালটির ওপর হতে সরিয়ে আনার জন্য যেই ওর শরীরে হাত ছোঁয়ালেন...সাথে সাথে..."ও মা গো...!" বলে প্রচন্ড ছ্যাঁকা খেয়ে হাতের ওই অংশটা অন্য হাতে চাপা দিয়ে সরিয়ে নিলেন।এতক্ষণে সঞ্জয় বাবু মনোরমা দেবীর কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।তিনি মোবাইলের আলো ফেলতে দেখা গেল এক বীভৎস দৃশ্য।মনোরমা দেবীর হাতের ওই অংশখানি একেবারে ঝলসে গেছে।পোড়া চামড়ার ফাঁক দিয়ে উন্মোচিত হয়ে পড়েছে মাংস।সেখানে উপস্থিত সকলের শিড়দাঁড়া দিয়ে যেন একটা হিমশীতল স্রোত নেমে গেল।চক্রবর্তী পরিবারের প্রতিটি সদস্যেরই হঠাৎ মনে পড়ে গেল মাস কয়েক আগের সেই সময়টার কথা...যখন হঠাৎ করেই এক অদ্ভুত জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল পরী।ওর শরীর থেকে ক্রমাগত নির্গত হচ্ছিল ধোঁয়া।ওর শরীরের সংস্পর্শে এলেই যেকোনো জিনিস তখন একেবারে পুড়ে যেত।যেভাবে হঠাৎ করেই সে অদ্ভুত জ্বরের আগমন ঘটেছিল...ঠিক তেমনই হঠাৎ করেই সে জ্বর সেরেও গিয়েছিল আপনা আপনিই।চক্রবর্তী পরিবারের সকলেই স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিল সেদিন।আজ ফের চক্রবর্তী পরিবারের প্রতিটি সদস্য সেইদিনের ছায়াই যেন এখন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে।একটা কোনো অশনিসংকেত পেয়ে মনোরমা দেবীর ভিতরটায় কু ডেকে উঠল ভীষণভাবে।তিনি সেখানেই প্রায় অচৈতন্য হয়ে ঢলে পড়লেন সঞ্জয় বাবুকে আঁকড়ে ধরে...! মমনোরমা দেবীকে অচৈতন্য হয়ে পড়তে দেখে সঞ্জয়বাবু যারপরনাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন।ঠিক ওই সময়ই হঠাৎ একটা হাড়হিম করা দৃশ্য দেখে সকলের হৃৎপিন্ড যেন গলার কাছে উঠে এল।ওই গগনচুম্বী ঘন কালো ধোঁয়ার ভিতরে একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে ছায়া ছায়া মানুষের অস্পষ্ট একখানি অবয়ব।ক্রমশ...এ অবয়বখানি চিনতে চক্রবর্তী পরিবারের কারোর আর কোনো অসুবিধা রইল না।এ অবয়ব আর কারোর নয়...চক্রবর্তী পরিবারের একমাত্র আদরের কন্যাসন্তান পরী।সম্পূর্ণ বিবস্ত্র শরীরের ওই অবয়বের নিম্নাঙ্গে প্রকট হয়ে উঠেছে রক্তের বারিধারা।চোখের সামনে এইরকম একটা দৃশ্য চাক্ষুষ করামাত্র সকলে ভয়ে...বিস্ময়ে...নিজেদের বোধজ্ঞান...বাকশক্তি সমস্তকিছু হারিয়ে নিস্তব্ধ ছবির মতো স্হবির হয়ে...হাঁ করে তাকিয়ে রইল ওই অবয়বের দিকে।মনোরমা দেবী এসবের কোনোকিছুই টের পেলেন না।তিনি অচৈতন্য অবস্হাতে তিনি সঞ্জয় বাবুর কোলে শায়িত হয়ে রয়েছেন।নরকঙ্কালটির ওপরে শায়িত রয়েছে হিয়ার অচৈতন্য দেহখানি...আর তার ওপরে বিরামহীনভাবে নির্গত হতে থাকা আকাশচুম্বী কালো ধূম্রকুন্ডের ভয়াল শিখার ভিতর থেকে যন্ত্রনাক্লিষ্ট কন্ঠে এবার কথা বলে উঠল পরী।একটা অনির্বাচনীয় যন্ত্রনামিশ্রিত ভয়ংকর ঘৃণা আর ক্রোধান্বিত...জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে সে তাকিয়ে রয়েছে চিন্ময় বাবুর দিকে। "আর কত মিথ্যা বলবি তুই!আর কতদিন ধোঁকা দিয়ে ভালো সেজে থাকবি সকলের সামনে!তোর আসল রূপটা তো আমি জানি।বলব?বলে দেব এইবার সকলকে?" পরীর কন্ঠনিঃসৃত এই বজ্রনিনাদে যেন আকাশ...বাতাস...ধরিত্রী সবকিছু কেঁপে উঠল। থরথর করে কাঁপছেন এবার চিন্ময় বাবু বলির পাঁঠার মতো।হাতদুটি তাঁর জুড়েছে ওই অবয়বের সামনে।আপনা হতেই...। "বাবা...আজ তোমার মেয়েকে শাসন করবে না?গুরুজন...বস্তুত বয়সে অগ্রজ হওয়ার কারণ দর্শিয়ে একজন শিশুধর্ষক...খুনের অপরাধীকে আজ সমীহ করতে শেখাবে না বাবা?" সঞ্জয় বাবু এবার মেয়ের কথা শুনে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। "তোর এই অবস্থা কে করেছে মা?একবার...শুধু একবার বল আমাকে সেই নামটা!" শোকে...যন্ত্রনায় আকূল হয়ে,ধোঁয়ার কুন্ড হতে আবির্ভূত ওই অবয়বের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন সঞ্জয় বাবু।এতক্ষণে সকলেই এটা বুঝে গিয়েছে...মাস ছয়েক আগে পরী যে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল...তার শেষ পরিণতি হল চক্রবর্তী বাড়ির বাগানের পিছনের পরিত্যক্ত এই অংশে মাটির তলায় প্রোথিত এই নরকঙ্কালখানি।এই মূহুর্তে যাকে ওরা পরী বলে ভাবছে...সে আদৌ পরী নয়। ---আমার ইজ্জত লুট হওয়ার পর...আমার রক্ত...মাংস সব মাটির সাথে মিশে যাওয়ার পর তুমি এই কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করছ বাবা...অথচ আমি তোমাদের মাঝে যখন ছিলাম...কতবার কতরকমভাবে বলতে...বোঝাতে চেয়েছিলাম এই কথাটা।কিন্তু তোমরা কেউ আমার কথার কোনো আমলই দাওনি।উল্টে প্রতিবার আমাকেই মেরেধরে শাসন করে চুপ করিয়ে দিয়েছ।আর তার ফলেই তোমার এই "গুণধর" ছোটভাই যে কিনা সম্পর্কে আমার ছোটকাকা...সে তত বেশি প্রশ্রয় পেয়ে গিয়েছে।ও ধরেই নিয়েছিল...আমি সবাইকে বলে বলে গলা থেকে রক্ত বার করে ফেললেও সবাই আমাকেই বকে মেরে চুপ করিয়ে দেবে।বয়সে বড়...গুরুজন মানুষকে সম্মান দেওয়ার কথা বলে আমার প্রতিটি আর্তচিৎকার ঢেকে দেবে তারই ফল দেখো...বাড়তে বাড়তে জিনিসটা আজ কোন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে!" জ্বলন্ত কন্ঠে কথাগুলো বলল পরীর ওই অবয়ব। সকলে এবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। হ্যাঁ...কথাটা ঠিকই বটে।পরী যে চিন্ময়বাবুকে দুচক্ষে দেখতে পারত না...এই কথাটা চক্রবর্তী পরিবারের কারোর অজানা নয়।কাজেই চিন্ময় বাবুর প্রতি ওর ব্যবহার দেখে সকলের বাস্তবিকই এইটাই মনে হত...পরীকে ঠিকমতো মানুষ করা হচ্ছে না।ওর শিক্ষাদীক্ষায় ঘাটতি রয়ে গিয়েছে।এরপর ব্যাপারটাকে সকলেই ঝেড়ে ফেলত মাথা থেকে।বস্তুত...পরীর এই ব্যাপারটাতে কেউ কোনোদিন কোনো গুরুত্বই দেয়নি।আর সেইটাই তো স্বাভাবিক।চিন্ময়বাবু নামী কলেজের একজন প্রফেসর।সমাজে তাঁর যেরকম সম্মান...এবং পরিবারে ছেলে হিসেবে তাঁর যে গুরুত্ব...যে রেপুটেশন...তার উর্দ্ধে গিয়ে চিন্তা করতে পারেননি কেউই।চিন্ময়বাবুর এই চেনা চেহারাটির মধ্যে আসলেই যে লুকিয়ে রয়েছে একটি বিকৃতকাম লালসায় পরিপূর্ণ একটি নরপিশাচ...এটা কেউই জানতে পারেনি কোনোদিন।আর এইসব নরপিশাচদের চেনা এমনিতেই খুব কঠিন হয়...শুধু এদের শিকার যে বা যারা হয়...শুধু তারাই জানে এদের আসল রূপটা।কারণ ওই আসল রূপটা কাউকে দেখাতে গেলে...সকলেই ওই নরপিশাচটাকে তার পরিচিত চেনা ছবির সাথে মেলাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়...আর পরিশেষে শিকারকেই মিথ্যাবাদী ঠাওরায়।এইসবকিছুই এঁরা প্রত্যেকে ভালোভাবে জানেন।বোঝেনও।কিন্তু ঘটনা যখন নিজেদের পরিবারের ভিতরেই ঘটল...তখন সমস্ত বোধ অকেজো হয়ে পড়েছিল।এই কথাটা এখন উপলব্ধি করতে পারছে প্রত্যেকে। ---"আমার ইজ্জত লুটে নিয়ে...আমার গলা চেপে ধরে খুন করেছে যে...সে হল ওই...!" এক পৃথিবীর জ্বলন্ত অঙ্গারের রোষানল নিয়ে কথাগুলো বলে উঠল পরী।ওর আঙুল এখন যার দিকে তাক করে রয়েছে...তার দিকে এবার তাকাল সকলে।চিন্ময়বাবুর এবার যেন মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা হল...! তাঁর শুধু মনে হতে লাগল...পরিবারের প্রতিটি চোখ যেন এখন গিলে খেতে আসছে।যে পুলিশ ইনস্পেক্টর এতক্ষণ ধরে চিন্ময় বাবুর সাথে সমীহের সঙ্গে কথা বলছিলেন...তিনিও এই পুরো ব্যাপারটাকে যেন হজম করে উঠতে পারছেন না কোনোমতেই...! আকাশ কাঁপিয়ে ফের শোনা গেল পরীর বিদেহী আত্মার আর্তনাদ। "নির্জন বাড়ির ভিতরে সকলের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে ওই লোকটা আমার ঘরে চোরের মতো ঢুকেছিল।আমার সঙ্গে ও যা যা করেছে...তাতে ওই শরীর নিয়ে যদি বেঁচেও যেতাম...তার পরে আত্মহত্যা করা ছাড়া এমনিতেও আর কোনো উপায় আমার থাকত না।ওই লোকটার মুখোশ খুলে গিয়ে যদি ওর পাপের শাস্তি পায়...তাহলে পৃথিবীর বুক থেকে একটা ঘৃণ্য কীট অন্তত হাল্কা হবে...।" পরীর যন্ত্রনাক্লিষ্ট ওই ক্রন্দনধ্বনিতে যেন বাতাসের প্রতিটি কণা ভারী হয়ে উঠতে থাকল।বর্ণনাতীত ওই যন্ত্রনা আর ক্রন্দনের সাথে ধীরে ধীরে বাতাসের সাথে মিলিয়ে যেতে থাকল পরীর বিদেহী আত্মাখানি...।আর পরীর গুপ্ত কবর হতে সদ্য উন্মোচিত ওই নরকঙ্কালের উপরেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে চলেছে পরীর প্রতিমূর্তি হিয়া।এখন চক্রবর্তী পরিবারের কাছে সমস্তটা একেবারে জলের মতো পরিষ্কার।মাস ছয়েক আগে তাঁদের বাড়ির মেয়ে পরী নিখোঁজ হওয়ার মাত্র দিনকয়েকের ভিতরেই ওকে খুৃঁজে পাওয়া গিয়েছে ধরে নিয়ে সকলে নিশ্চিন্ত হয়ে...আসলেই পরীর সাদৃশ্যরূপী প্রতিমূর্তি একজন অচেনা বালিকাকে তাঁরা স্হান দিয়ে বসেছিলেন।যাকে পরীর শুন্য স্হানে বসিয়ে...পরীর প্রাপ্য আদর যত্ন...ভালোবাসা আর মর্যাদা দিয়ে রাখা হয়েছিল...তার সঙ্গে আদৌ এই চক্রবর্তী পরিবারের কোনো রক্তের সংযোগই নেই।কে এই মেয়ে!চক্রবর্তী পরিবারের ভিতরের সাথে যেভাবে ও মিশে গিয়েছিল...যেভাবে গড়গড় করে...ছয়মাস আগে এই পরিবারের ভিতরে ঘটে যাওয়া তুচ্ছাতিতুচ্ছ কোনো কথা বা যেকোনো ঘটনার সাথে বরাবর তাল ঠিক রেখে মিশে যাচ্ছিল...সেইটাই বা সম্ভব হয়েছিল কিভাবে!যার সাথে এই পরিবারের কোনো সংযোগই ছিল না কোনোকালে...সে পরিবারের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে এইভাবে মিশে গেল কি করে!কোনোকিছুর সাথে কোনোকিছুকেই মেলাতে পারছে না কেউই।চিন্ময় বাবুর কদর্যরূপটা এখন সকলের সামনে একেবারে নগ্ন।সেই ধাক্কাটা সামলে নিয়ে কঙ্কালের ওপরে চোখ পড়তেই যখন এই অপরিচিত বালিকার নিদ্রিত এবং শায়িতরূপখানি দেখে...সকলের মনের ভিতরে ভীড় করছে হাজারো প্রশ্নের ভীড়...যার কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছে না কেউই।ওই গগনভেদী লেলিহান ধূম্রকুন্ডখানি এখন নিভে গিয়েছে একেবারেই...যে ধোঁয়া এতক্ষণ ধরে নির্গত হচ্ছিল হিয়ার রক্তমাংসের শরীর হতে।দীর্ঘদিনের একটা চাপা যন্ত্রনা যে এইবার প্রকাশ করতে পেরে হাল্কা হল পরী...তারপর ধোঁয়া হয়ে মিশে গেল বাতাসের সাথে...এটা এখন অনুভব করতে পারছে সেখানে উপস্হিত প্রত্যেকেই।এতক্ষণে সকলে এটা বুঝতে পারছে...এই অপরিচিত বালিকাটির শরীর এখন একেবারে শীতল।আর পাঁচটা রক্তমাংসের মানুষের মতোই।ঠিক সেই সময়ের মতোই হঠাৎ জ্বর এসে হঠাৎই মিলিয়ে গেল।পার্থক্য শুধু এই...আগেরবারে যেটা সময় নিয়েছিল সপ্তাহখানেক...এবারে সেটা সময় নিল কিছুক্ষণমাত্র। ভোরের আলো ফুটে উঠেছে।মনোরমা দেবী এইমাত্র জানলেন...তাঁর একমাত্র কন্যা...তাঁর বুকের ধন...আর নেই এই পৃথিবীতে।সে তাঁর কোল ছেড়ে...এই পৃথিবীর মাটির মায়া কাটিয়ে...চলে গিয়েছে বহুদিন আগেই।সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে এবার মনোরমা দেবী অপ্রকৃতিস্হের ন্যায়ে একেবারে মেঝেয় আছড়ে পড়ে কান্নাকাটি করতে লাগলেন।হা ভগবান...মেয়েটা যখন বেঁচে ছিল...তখন কত করে...কত রকমভাবে পরিবারের প্রতিটি মানুষকে তো বটেই...নিজের বাবা মাকে কত করে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল কথাটা।ইস...ছোট বলে ওর কথাগুলোকে অবহেলা না করে...যদি একবার কথাগুলো শুনতেন...সেগুলো যাচাই করার ভাবনাচিন্তা করতেন...তাহলে এইভাবে অকালে এইরকম নির্মম পৈশাচিক যন্ত্রনা বুকে নিয়ে অকালে পৃথিবী ছাড়তে হত না ওকে।একই কথা ভেবে চলেছেন সঞ্জয়বাবুও।সময় থাকতে তিনিও তো শুধু মেয়েকে শাসন করার চেষ্টাতেই মনোযোগী ছিলেন।ওর কথা শোনবার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে তিনিও তো মনে করেননি কখনো...!যদি কোনো যাদুমন্ত্রে সময়টাকে ফের পিছিয়ে নিয়ে দাঁড় করানো যেত বেশ কয়েক মাস আগে...তাহলে সমস্ত ভুলগুলো শুধরে নিতেন তিনি। পরীকে কক্ষনো কাছছাড়া হতে দিতেনই না...! চশমা হাতে নিয়ে উদাসী দৃষ্টিতে সঞ্জয় বাবু দাঁড়িয়ে রয়েছেন জানলার পাশে।জানলার নীচ দিয়ে তাঁর দৃষ্টিগোচর হল...তাঁর স্নেহের ছোটভাই...পরিবারের ছোট ছেলে চিন্ময়কে পুলিশ সকলের সামনে দিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে যখন টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে।আর পাড়াপ্রতিবেশীরা প্রত্যেকে জড়ো হয়ে...বিনা টিকিটে সার্কাসের শো দেখবার মতো করেই ভীড় করে দাঁড়িয়ে পড়ে দেখছে ওই দৃশ্য।সঞ্জয়বাবু এখন পুরোপুরি উদাসীন।আর কোনোকিছুতেই আর কিছু যায় আসে না তাঁর। গায়ত্রী দেবী তাঁর নিজের ঘরে বসে রয়েছেন এখন।একা...শোকে মূহ্যমান।চারপাশে পিন পড়া নিস্তব্ধতা।এমন সময়ে তিনি তাঁর দরজার কাছে একটা পায়ের শব্দ পেলেন।আস্তে আস্তে করে সেইদিকে চোখ মেলে তাকালেন তিনি।তিনি দেখলেন...দরজার বাইরে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুশীল। ক্ষীণকন্ঠে গায়ত্রী দেবী বলে উঠলেন..."ভিতরে আয়...।" অন্ধকার ঘরের দরজার বাইরে হতে আলোটা ঘরের মেঝের ওপরে লম্বাটে এবং চৌকোনা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে...আর তার ওপরে পড়েছে সুশীলের ছায়া।ওর ছায়াখানি ধীরে ধীরে দীর্ঘাকৃতি ধারণ করতে থাকল।এক পৃথিবী জড়তা কাটিয়ে ও এক পা এক পা করে এগোতে থাকল একটি বেতের আরামকেদারার দিকে।ওই আরামকেদারায় শরীর এলিয়ে শুষ্ক...বিবর্ণ মুখে বসে রয়েছেন গায়ত্রী দেবী।ঘরখানি অন্ধকার বলেই হয়তো অপরাধ বোধে জর্জরিত নিজের চোখদুটিকে গায়ত্রীদেবীর সামনে থেকে আড়াল করতে পেরে কিছুটা অন্তত স্বস্তি অনুভব করছে এখন সুশীল।ধীরপায়ে এগিয়ে এসে ও আরামকেদারার সামনেটায় হাঁটু মুড়ে বসল।প্রায় বিশ বছর আগে এই ভদ্রমহিলার আঙুল ধরে ও এসেছিল এই বাড়িতে।তারপর থেকে ওর শৈশবের শেষ পর্যায়...কৈশোর...যৌবনে পদার্পণ...সবটাই এই বাড়ির শিকড়ের সঙ্গে একেবারে আদ্যোপান্তভাবে জড়িয়ে রয়েছে।কিন্তু কোনোদিনই ওর মনে হয়নি...এই মানুষটার সঙ্গে ওর আলাদা করে কোনো কথা থাকতে পারে...!নিজের বাপ...মা...কারোর সাথেই কোনো কথা বলা হয়ে ওঠেনি ওর।শুধু শ্যাওলার মতো এ স্হান থেকে গড়িয়ে চলে এসেছিল আরেক জায়গায়।বাবা মা সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে নিজের ওয়ারিশ...নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হিসেবে সন্তানকে নিজের সংস্পর্শে রেখে অপার স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে তাকে বড় করেন।এই বাড়িতে পা রাখবার আগে...গায়ত্রী দেবী সুশীলের মায়ের হাতে হাত রেখে কথা দিয়েছিলেন...এইসমস্তকিছুরকোনো অভাব তিনি সুশীলকে বুঝতে দেবেন না কোনোদিন।বাস্তবিকই সে কথা রেখেছিলেন গায়ত্রী দেবী।কিন্তু সেটা যে পুরোপুরি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ছিল না...সেটা তিনি নিজেই ভালোভাবে জানেন।সুশীলই হল তাঁর বাপের বাড়ির বংশের একমাত্র ওয়ারিশ।সুশীল বড় হবে...মানুষ হবে...একটা চাকরি করবে...তারপর বিয়ে থা করবে...তার সন্তান হবে...আর তার মাধ্যমেই জিইয়ে থাকবে তাঁর বাপের বাড়ির বংশ ও তার অস্তিত্ব।সুশীলের প্রতি এই একখানি প্রত্যাশাকে ঘিরেই ওর প্রতি গায়ত্রী দেবীর যাবতীয় স্নেহ-ভালোবাসা।এই প্রত্যাশাটুকুর বাইরে বেরোলে সুশীল আদৌ তাঁর আপনজন নয়...ও তাঁর কেউ নয়...সুশীলকে তিনি চেনেনও না...জানেনও না।নিজের ছেলেদেরকে তাই তিনি দিয়েছেন উন্মুক্ত আকাশ।আজ তাঁর সব ছেলেরাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত।কিন্তু তারা ছোটবেলায় আঁকা...গান...ক্যারাটে সবকিছুতে পারদর্শী ছিল।ঘরভরতি পুরস্কার আসত ওদের এইসব কৃতিত্বের হাত ধরে।কিন্তু শুধুমাত্র স্কুল আর লেখাপড়া বাদ দিয়ে গায়ত্রী দেবী সুশীলের আর কোনো ইচ্ছা...আকাঙ্ক্ষা...শখ...আহ্লাদের দিকে দৃষ্টিই দেননি কোনোদিন। শুধু সংসারের দায়িত্ব কর্তব্য পালন করার জন্য দরকার একটা চাকরি।তার জন্য যা দরকার...যতটা দরকার তিনি করেছেন।এই ব্যাপারটা সুশীল অনুভব করতে পারত ছোট থেকেই।আঁকার প্রতি ছোট থেকেই ওর খুব টান।সেটা গায়ত্রী দেবীর একদিন চোখে পড়ে যাওয়ায়...তিনি সুশীলকে বুঝিয়ে বলেন..."ছবি এঁকে কোনো লাভ নেই বাবা...তোমাকে তো বড় হতে হবে...টাকাপয়সা রোজগার করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে তো...একটা চাকরি পেতে হবে তোমাকে...।" আঁকা শেখার কথাখানা যে গায়ত্রী দেবীকে বলে কোনো লাভ নেই...এটা সেইদিন ও বুঝে গিয়েছিল।সেইদিন মাঝরাতে সুশীল একা...নির্জনে অনেক কান্নাকাটি করেছিল।ওর শুধু মনে হচ্ছিল...আজ যদি ওর মা বেঁচে থাকতেন...তাহলে তিনি নিজের ওর চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝে ফেলতেন...ওর খুশি কোথায়! সুশীল একটু বড় হওয়ার পর ও যখন নিজের চেষ্টায় ছোটখাটো যাহোক কিছু চাকরি যোগাড় করার ভাবনাচিন্তা করত...তখন গায়ত্রী দেবী সুশীলকে বিয়ের পরিকল্পনা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করে দিতেন।সুশীলের ঘরের ভিতরে ঢুকে দশটা মিনিট বসেও দেখেননি কোনোদিন গায়ত্রী দেবী।যদি ঢুকতেন...তাহলে দেখতে পেতেন...সে ঘরের ভিতরে এত অপূর্ব সব পেন্টিং রয়েছে...যা জাতীয় স্তরের প্রদর্শনীতে স্হান পাবার যোগ্যতা রাখে।গায়ত্রী দেবীর সব ছেলেরাই আজ যতটা সুপ্রতিষ্ঠিত...তাদের চাইতে কোনো অংশে কম ছিল না সুশীল।আজ অন্তত ওর এখানে ওখানে ছোটখাটো চাকরি করে...টুপাইস কামানোর ধান্দা করে...এইভাবে একটা অসফল জীবনের অতল অন্ধকার আঁকড়ে পড়ে থাকবার কথা আদৌ ছিল না।সুশীলকে বরাবর...একটা মিষ্টি ব্যবহার দিয়ে...ওর খরচখরচা বহন করে. ..দেখেশুনে রেখেছিলেন গায়ত্রী দেবী...কিন্তু কোনোদিন ওকে শাসন করার মধ্যে দিয়েও যাননি।একটা চাপা রাগ আর অভিমান নিয়ে বড় হয়েছে সুশীল...যেটা ও কোনোদিন কাউকে বলে উঠতে পারেনি।ওর মাঝে মাঝে দমবন্ধ লাগত।গতানুগতিক জীবনটাই যে আসলে ওর জন্য নয়...যে ছকে বেঁধে রাখতে চিরকাল মরিয়া গায়ত্রী দেবী।ওর মাঝে মাঝে মনে হত...এই একটিমাত্র মহিলাই ওর জীবনখানা শেষ করে দিচ্ছে।যদিও ও নিজের মনের ভাব কোনোদিন প্রকাশ্যে আসতে দেয়নি...কিন্তু মাঝেমধ্যে ওর এত রাগ হত...যে ওর মনে হত...নিজের হাতে ও গায়ত্রী দেবীকে শেষ করে দেয়।এই মহিলা নিজের চিন্তা...স্বার্থ আর প্রত্যাশার বাইরে যে কোনোদিনই আসতে পারবেন না...এটা সুশীল বরাবরই জানত। আজ হঠাৎ দীর্ঘদিনের চাপা রাগ...একটা ঠোঁট ফুলোনো অভিমানের আকার ধারণ করল।সাথে জাগল তীব্র অপরাধ বোধও।ও গায়ত্রী দেবীর পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে কান্নাভেজা কন্ঠে বলে উঠল..."আমি তোমার সাথে অমন করতে চাইনি দিদুন...বাগানের পিছন দিকটায় সেইদিন ভোররাতে তোমার রুদ্রাক্ষের মালাটা পড়ে থাকতে দেখে...আমার মনে হয়েছিল...তুমি নিজে কোনোভাবে চলে গিয়েছিলে সেখানে...জানতে পেরে গিয়েছ সব...!" গায়ত্রী দেবীর হাতের তালুর আলতো স্পর্শ অনুভব করল সুশীল।দীর্ঘ বছর পর হঠাৎ মায়ের মমতা পাওয়ার জন্য ওর ভিতরটা যেন হাহাকার করে উঠল। ---"স্বার্থ...প্রত্যাশা...বড় বিষম বস্তু...বুঝলি সুশীল...আমার তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে...তবে এই সারসত্যটা আমি মর্মে মর্মে বুঝেছি।অনেক কিছু এখন আমি উপলব্ধি করতে পারছি...বুঝলি সুশীল...অনেক কিছু...।সময়ের সাথে সাথে আমাদের গতানুগতিক চিন্তাভাবনাকেও যদি পরিবর্তন করতে না পারি...তাহলে একটা সময় পরে অনর্থের শেষ থাকে না।এই দেখ না...গরীব ঘরের মেয়ে বলে বড় বউমাকে আমি কোনোদিন মানুষ বলেই ভাবতে চাইনি।অথচ আজ বুঝতে পারছি...কার কাছে কি পার্থিব সম্পদ রয়েছে...তা দিয়ে মানুষ বিচার হয় না।আজ ওর জন্যই আমি প্রাণে বেঁচে আছি।এখন ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর মত দৃঢ়তাটুকু নেই আমার...!" গায়ত্রী দেবীর কোলে মাথা রেখে কথাগুলো তাঁর শুনছিল সুশীল।প্রায় সত্তরের কোঠায় পৌঁছনো এই মানুষটার ভিতরে আজ সেই দাপট...সেই দম্ভ...কোথায় যেন মিলিয়ে গিয়েছে।গায়ত্রী দেবীর মনের ভিতরে যে একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে...এটা বুঝতে পারল সুশীল।নাহলে...ওইভাবে একটা বদ্ধ গুদামঘরে বেশ কয়েকটাদিন অসহনীয় কষ্ট সয়ে আটকে থাকার পর...বাইরে বেরিয়ে আসবার পর যেভাবে তিনি সুশীলের ওপর রাগে ফুঁসছিলেন...আর ওকে পুলিশে দেবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন...সেই মানুষটাই পুলিশের কাছে অনুরোধ করে সুশীলকে ছাড়িয়ে আনবার ব্যবস্হা করেছেন থানা থেকে।ওর ওপর থেকে সমস্ত অভিযোগ তিনি তুলে নিয়েছেন।কিছুদিন আগের দিদুন...আর আজকের দিদুনের মধ্যে পার্থক্য অনেকখানি...এটা বুঝতে পারছে সুশীল।এই কয়েকদিনের ব্যবধানে...গায়ত্রী দেবী মানুষ হিসেবে অনেকখানি বদলে গিয়েছেন...।নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে...হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন..."হ্যাঁ রে সুশীল...এইসব চাকরিবাকরি করতে তোর একেবারেই ভালো লাগে না...না রে?" সুশীল এবার ভীষণভাবে চমকে উঠে তাকাল দিদুনের দিকে। গায়ত্রী দেবী বলে উঠলেন..."পরী যখন বেঁচে ছিল...ও তো মাঝে মাঝেই যেত তোর ঘরে।ওর নাকি তোর ওই ঘরটায় যেতে খুব ভালো লাগত।ওর কাছেই শুনেছি...তোর ঘরে গেলেই ও নাকি দারুণ দারুণ সব পেন্টিং দেখতে পায়...যেগুলো নাকি তোর নিজের হাতে আঁকা...।ও তো বলত...ওই ছবিগুলো থেকে নাকি চোখ ফেরানোই যায় না...।আর তাছাড়া তোর কাছে বায়না করলে...আরো বিভিন্নরকম ছবি টেবিলের ড্রয়ার থেকে...বিছানার তোষকের তলা থেকে বার করে করে তুই ওকে দেখাতিস...!" সুশীল মাথা নীচু করে রইল। গায়ত্রী দেবী বলে উঠলেন..."আজ থেকে তুই মুক্ত।আমার সমস্ত চিন্তাভাবনা...সব প্রত্যাশার বাঁধন থেকে তোকে আমি মুক্তি দিলাম।তোর জীবন...তুই বাঁচ তোর নিজের মতো করে...।" ---"সত্যি বলছ দিদুন...সত্যি বলছ?" ---"হ্যাঁ রে আমার পাগল ছেলে...আজ থেকে আমি জানব...আমার নিজের চার ছেলে নয়...পাঁচ ছেলে।" জীবনে প্রথম এক অনির্বাচনীয় খুশি যেন চারদিক থেকে ঘিরে ধরল সুশীলকে।গায়ত্রী দেবীর কোলে নিজের মাথাখানি গুঁজে চোখটা বন্ধ করল পরম আনন্দে।" রাত গভীর।মনোরমা দেবী ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করে চলেছেন।ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে তার আপন খেয়ালে।কিন্তু মনোরমা দেবী দুচোখের পাতা এক করতে পারছেন না কোনোমতে।ক্ষণে ক্ষণে শুধু তার মনের আয়নায় ভেসে উঠছে পরীর ছবি।যে মেয়েটাকে তিনি দশমাস দশদিন গর্ভে ধারণ করেছিলেন...একটু একটু করে কাদার পুতুলের মতো শিশুটিকে দুইহাতে আগলে একটু একটু করে বড় করে তুললেন...কি সুন্দর সে মেয়েটা হেসে খেলে মাতিয়ে রাখত সারাবাড়ি...সেই মেয়েটা আজ নেই!এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না মনোরমা দেবী।তিনি আর বিছানায় শুয়ে থাকতে পারলেন না।শেষমেশ তিনি ধড়ফড় করে বিছানা থেকে উঠে পড়লেন।পরীর কঙ্কাল যেখানকার মাটি খুঁড়ে বার করা হয়েছিল...সেখানে যাওয়ার জন্য উথালপাথাল করে উঠল তাঁর মন।বিছানা থেকে উঠে তিনি যেই দরজার দিকে এগোতে যাবেন ছিটকিনি খোলার জন্য...এমন সময়ে হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে ভীষণভাবে চমকে উঠলেন মনোরমা দেবী।তিনি দেখলেন...বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে পরী।তিনি এবার চিৎকার করে উঠলেন।"কে তুমি...কোথা থেকে তুমি এসেছ?এই বাড়ির সঙ্গে তো কোনো সম্পর্ক নেই তোমার...আর আমার সঙ্গেও তোমার কোনো সম্পর্ক নেই।বুঝেছ?আর কক্ষনো যেন তোমাকে আমার সামনে না দেখি।দূর হয়ে যাও আমার সামনে থেকে।দরজার সামনে থেকে সরো।আমাকে আমার মেয়ের কাছে যেতে দাও।" ---"আহা মা...তুমি ফের আমায় চিনতে ভুল করছ।দরজা তো তুমিই বন্ধ করে রেখেছ ভিতর থেকে।এই ঘরের ভিতর এখন আমি ছাড়া কারোর পক্ষেই আসা সম্ভব নয়। আগন্তুকের মুখে এই কথাটা শোনার পর এবার ভীষণভাবে চমকে উঠলেন মনোরমা দেবী।তাঁর ঘরের ভিতরে এখন যে দাঁড়িয়ে রয়েছে...সে তো রক্তমাংসের মানুষ নয়...!এই কি তাঁর নাড়ি ছেঁড়া ধন পরী!মনোরমা দেবী এবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন। "কেঁদো না মা...কেঁদো না...তোমার দুটি পায়ে পড়ি...তোমায় কাঁদতে দেখলে যে আমার বড়ো কষ্ট হয়...।" বলে উঠল ঘরের ভিতরে প্রবিষ্ট...পরীর বিদেহী আত্মা।এই নিকষ অন্ধকারের ক্যানভাসে আলোর মতো ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে পরীর অবয়বখানি।পরীর সম্পূর্ণ অবয়বখানি আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকল। সম্পূর্ণ বিবস্ত্র ওই অবয়বখানির নিম্নাঙ্গে প্রকট হয়ে উঠছে রক্তের লাল।এবার আর পারলেন না মনোরমা দেবী।ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন তিনি। ---"আমায় তুই ক্ষমা করে দে মা...সেদিন যদি তোর কথা শুনতাম...তাহলে আজ..." কেঁদো না মা...যা হওয়ার ছিল...সেটা হয়ে গেছে।তোমার কাছে যে মেয়েটা আমার জায়গা নিয়ে রয়েছে এতদিন ধরে...তার সাথে যে এই পরিবারের কোনো সম্পর্কই নেই...সেটা প্রথম দিন থেকে শুধু একজনই বুঝেছিল।সে হল আমার হত্যাকারী।কারণ ও লুকিয়ে চুপিচুপি ঠিক দেখে নিয়েছে...মাত্র কয়েকদিন আগে আমার শরীরে ওর সৃষ্ট সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগটা ওর শরীরে নেই।তাই ও ধরে নিয়েছিল...এই আগন্তুক হল ওর নতুন শিকার।কিন্তু তুমি...বাবা...ঠাম্মি...তোমরা কেউ ধরতেই পারলে না...আমি আর নেই তোমাদের মাঝে...!" বিদেহী পরীর কন্ঠ অভিমান ভরা কান্নায় ভিজে উঠেছে যেন...! কয়েক মূহুর্তের নিস্তব্ধতার পর আবার পরী বলে উঠল... আমি বেঁচে থাকতে যেমন বারংবার সত্যিটা বলতে চেয়েছিলাম তোমাদের...মরার পরেও আমি শুধু ছটফট করে যাচ্ছিলাম...একবার তোমার সামনে আসবার জন্য...একবার আসল সত্যিটা তোমাদের জানানোর জন্য...কিন্তু একটা রক্তমাংসের শরীর না পেলে সেটা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল।আমি শুধু ঘরের চারপাশে...তোমাদের সকলের চারপাশে বৃথা ছটফটিয়ে...মাথা কুটে মরেছি।আর সৃষ্টিকর্তার কাছে...শুধু প্রার্থনা করে গিয়েছি...আমার ডাক তিনি শুনেছেন।আমার প্রতিমূর্তি এই মেয়েটাকে তিনিই এখানে পাঠিয়ে দিলেন।তার দিন কয়েক পর থেকেই ওর রক্তমাংসের শরীরে একটু একটু করে প্রবেশ করতে থাকি আমি...আর তার ফলেই এ বাড়িতে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নোংরা পিশাচটা ধীরে ধীরে নিজের ফাঁদ নিজেই তৈরি করে নিজেই সেখানে আটকা পড়ে যায়।আমি তোমাদের কাছে শেষ পর্যন্ত বলতে পারলাম...আবার আমি তোমার কাছে আসতে পারলাম মা...!" মনোরমা দেবী দেখলেন জাজ্বল্যমান ওই অবয়বটির দুচোখের পাশে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অশ্রুধারা।মনোরমা দেবীর ভিতরের সমস্ত শোক যেন এবার হাহাকার করে উঠল।এখন তাঁর মৃত মেয়ে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে।তিনি এখন ওকে ছুঁতেও পারবেন না...নিজের বুকের ভিতরে জড়িয়ে নিতেও পারবেন না। ---"তোকে ছেড়ে কিভাবে থাকব রে মা!" এক সন্তানহারা মায়ের কান্নায় যেন ধরিত্রী ফুঁড়ে আগ্নেয়গিরির মতো বেরিয়ে আসতে চাইল বর্ণনাতীত মূক যন্ত্রনা। ---"আমায় ছেড়ে থাকতে হবে না তোমায় মা...আমি এই বাড়িতেই থাকব।এইভাবেই চিরকাল রয়ে যাব তোমার কাছে কাছে...তোমার পাশে পাশে...চিরকাল।তুমি কষ্ট পেয়ো না মা...আমার কথা শোনো...এক্ষুনি আঁচল দিয়ে মোছো চোখের জল...মোছো বলছি...!" ধমক শুনে বাধ্য মেয়ের মতো চোখের জল আঁচল দিয়ে মুছে নিলেন মনোরমা দেবী।দেখলেন...পরীর ঠোঁটের কোণায় ফুটে উঠেছে শান্তির হাসি।ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে মনোরমা দেবী...আর দেখলেন...আস্তে আস্তে ঘরের বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে পরীর বিদেহী অবয়বখানি...। ভোরবেলায় হঠাৎ হিয়া ঘুম ভেঙ্গে দেখল...মনোরমা দেবী বসে আছেন ওর মাথার পাশে।আস্তে আস্তে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন সস্নেহে।ধড়ফড় করে উঠে বসল হিয়া। "কাকিমা...আমি বাড়ি যাব...আমার বাড়ি...বহরমপুরে। হিয়ার মুখে কথাটা শোনামাত্র একটু অবাক হয়ে তিনি তাকালেন হিয়ার দিকে। বললেন... "তোমার বাড়ি বহরমপুরে?তা কে কে আছেন তোমার বাড়িতে?" ---"বাড়িতে আছে আমার বাবা...মা...আর ঠাকুরমা।অনেকদিন হয়ে গেছে...আমি তোমাদের বাড়িতে এসে রয়েছি।ওনারা নিশ্চয়ই চিন্তা করে...কেঁদে কেঁদে আধমরা হয়ে গিয়েছেন...আপনার দুটি পায়ে পড়ি কাকিমা...আমাকে আমার বাবা মায়ের কাছে নিয়ে চলুন...!" হিয়ার কন্ঠে কাতরতা স্পষ্ট। ---"বহরমপুর তো এখান থেকে অনেকটা দূরে।তুমি এইখানে এসে পৌঁছলে কিভাবে?" ---আমি বাবা মায়ের সাথে জামাই ষষ্ঠীতে মামার বাড়ি যাচ্ছিলাম জীবনে প্রথমবার।আমার বাবা দিনমজুর তো...একটা দিন কাজে কামাই হলে অনেক ক্ষতি হয় বলে কোনোবারই যাওয়া হয় না।এইবার বাবার মালিক বাবাকে কিছু বখশিশ দিয়েছিলেন তাঁর কাজে খুশি হয়ে...তাই প্রথমবার ট্রেনে চেপে যাচ্ছিলাম মামার বাড়ি।এরপর ভীড়ে আমি বাবা মায়ের থেকে আলাদা হয়ে পড়ি।তারপর কিভাবে যে আমি এইখানে এসে পড়লাম...কিছুতেই মনে করতে পারি না...। কিছুক্ষণ নীরব থাকল দুজনেই।মনোরমা দেবী হিয়ার কথা শুনে বুঝতে পারলেন অনেক কিছু।এরপর আস্তে আস্তে তিনি হিয়াকে বললেন... ----"তোমার নামটাই আমাদের কারোর জানা হয়ে ওঠেনি।তোমার নাম কি মা?" ---আমার নাম হিয়া।হিয়া সাধুখা।আমি আমার বহরমপুরের বাড়ির ঠিকানাটা আপনাকে বলছি...আপনি দয়া করে আমাকে আমার মায়ের কাছে পৌঁছে দিন...। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মনোরমা দেবী বললেন..."তোমার মা কি করেন?" ---"আমার মা বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ করেন।' স্বতস্ফুর্তভাবে বলল হিয়া। মনোরমা দেবী বললেন..."তা মা...তুমি বরং এক কাজ করো...তোমার বাবা মাএর সাথে দেখাসাক্ষাৎ করে...ওনাদের বলেটলে...তুমি এই বাড়িতেই থেকে যাও।আমার তাহলে খুব ভালো লাগবে।তোমার এখানে কোনো অযত্ন হবে না।আমরা পরীকে যেমন আদর যত্ন করতাম...তোমাকেও তেমন করেই আদরযত্ন করব।যেটা হয়তো তোমার নিজের বাড়িতে পাবে না তুমি।" কথাটা শুনে মাথা নীচু করে রইল হিয়া।ওর মুখে বিরূপভাব স্পষ্ট।তা দেখে মনোরমা দেবী আবার বললেন..."মা বাবাকে চিরকালের জন্য ছেড়ে থাকতে মন কেমন করবে তো তোমার?তুমি এই বাড়িতে থাকো...এতকিছু পাবে তুমি...তখন নিজের বাড়ি ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হবে না তোমার।তোমার মুখটা দেখলে আমার পরীর কথা মনে পড়বে।এর থেকেই বুঝে দেখো...এই বাড়িতে কতখানি আদরযত্ন পাবে তুমি।তোমার সুন্দর একটা ভবিষ্যত...সুন্দর জীবন হবে।' ---"না কাকিমা...আপনি এটা ঠিক বললেন না।" হিয়ার এই কথাটায় এতখানি দৃঢ়তা ছিল...যে বেশ বিস্মিত হলেন মনোরমা দেবী।তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন হিয়ার দিকে। হিয়া সে দৃষ্টির অর্থ বুঝল।ও বলল... "আপনাকে একটা সত্যি কথা বলি কাকিমা...আমি যখন প্রথম এই বাড়িতে আসি...তখন জ্ঞান ফেরার পরে পরেই আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারি...যে আমি আমারই মতো দেখতে...এই পরিবারের আদরের মেয়ের জায়গায় রয়েছি।এই সুবিশাল বাড়ি...আর তার প্রাচুর্য দেখে আমি প্রথমটায় আমার আসল পরিচয়টা ইচ্ছাকৃতভাবেই গোপন করে যাই আর নিজেকে লুকিয়ে ফেলি তৎক্ষণাৎ।একটা সুন্দরবনের জীবন...একটা সুন্দর ভবিষ্যত পাওয়ার জন্যই।চক্রবর্তী পরিবারের এই প্রাচুর্য... আমার মাথা ঘুরিয়ে দেয়...এইসব পাওয়াই তো আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল...সেইসবকিছু ম্যাজিকের মতো সত্যি হয়ে গেল আমার জীবনে...রূপকথার গল্পের মতো।কিন্তু এই পরিবারের ভিতরে থাকতে থাকতে ক্রমশ সেই মোহ ভাঙতে শুরু করে আমার।শুধু অর্থ আর বিলাস মানুষকে যে আদৌ সুখী করতে পারে না...তা নিজের চোখে দেখে নিলাম আমাদের ওই ছোট্ট ঘরে বিলাসিতা না থাকলেও সন্তুষ্টি আছে।শান্তি আছে।হাসি আছে।কোনো জটিলতা কুটিলতা কিচ্ছু নেই।অথচ এখানে এসে আমি দেখলাম...এখানে সবার এত এত আছে...তাও খালি ভিখারীর মতো দিনরাত শুধু চাই চাই করে।এদের মনে কোনো শান্তি নেই...মুখে কোনো হাসি নেই।শুধু রাশি রাশি অসন্তোষ...আর অন্যের অনিষ্ট করার হীন চিন্তাভাবনা।এরা টাকাপয়সা...প্রাচুর্যে এসেই আটকা পড়ে যায়।মানুষের কোনো মূল্যই নেই এদের কাছে।এমনকি এইরকম বিলাসিতাপূর্ণ ধনীর ঘরে বাস করে মুখোশধারী ঘৃণ্য অপরাধী পর্যন্ত।যে জীবন বাঁচার স্বপ্ন বুকে নিয়ে বড় হচ্ছিলাম...আজ সেখানে নিজে এসে দেখলাম...এই পরিবেশ বড় অস্বাস্থ্যকর।এখানে সুন্দর জীবন তো বটেই...একটা সুস্হ জীবনের কথা ভাবাটাই পরিহাস।টাকা দিয়ে সবকিছু কেনা যায় না।আমার মোহ ভেঙ্গে গেছে কাকিমা...আমার ওই ছোট্ট টিনের ঘরে যা আছে...এই এত বড় প্রাসাদতুল্য বাড়িটায় সেটার কিচ্ছু নেই।আমি বাড়ি যাব...আমার বাড়ি।আমি ঠিকানা লিখে দিচ্ছি...আপনি দয়া করে আমার বাবা মাকে একটা খবর পাঠান...আমি আর এখানে থাকতে চাই না।" পরদিন সকালে হিয়ার মা আর বাবা একেবারে পাগলের মতো ছুটে এলেন চক্রবর্তী বাড়ির উঠোনে।হিয়াকে দেখেই হিয়ার জীর্ণ শাড়ি পরিহিতা মা ওকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলেন।হিয়ার কোনো খোঁজ না পেয়ে...দীর্ঘদিন দেখতে না পেয়ে...তাঁর চোখের কোণায় কালি পড়ে গিয়েছে।ওনার শরীরটাও যেন প্রচন্ডভাবে ভগ্নপ্রায় হয়ে পড়েছে।দীর্ঘদিন পরে নিজের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে যেন তাঁর ওই ভগ্ন শরীরে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে।অনুজ্জ্বল ও জরাজীর্ণ পোশাক পরিহিত হিয়ার দীনমজুর বাবার চোখ আনন্দে আর খুশিতে এত উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে আজ...যেন এক্ষুনি তিনি পৃথিবীর সবচাইতে মূল্যবান ধনসম্পদের হদিশ পেলেন...যার খোঁজে এতদিন ধরে কেঁদে মরছিলেন তিনি...।হিয়া নিজের বাবা আর মাকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে...সমস্ত পৃথিবী ভুলে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁদের বুকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হিয়া ওর জামাকাপড় গুছিয়ে নিল।যেসব দামী গহনা ও গায়ত্রী দেবীর কাছ থেকে উপহার স্বরূপ পেয়েছিল...সেগুলো ও গায়ত্রী দেবীর কাছে অকাতরে ফেরত দিল...আর তারপর তাঁকে প্রণাম করে...নিজের পরিচয় গোপন করে পরীর জায়গায় এতদিন ধরে নিজেকে বসিয়ে রাখার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করল।আজ গায়ত্রী দেবী নিজে হিয়াকে টেনে নিলেন নিজের বুকে।বললেন..."তোমার মধ্যে দিয়েই বেঁচে উঠেছিল আমাদের পরী। নিজের সমস্ত যন্ত্রনা ও বলতে পেরেছে।সুবিচার পেয়েছে।এই শেষ বয়সে এসে আমি অনেক কিছু নতুন করে জানলাম...বুঝলাম...উপলব্ধি করলাম মা...যেটা তুমি এইভাবে আমাদের মাঝে না এলে কখনোই সম্ভব হত না।রক্তের সম্পর্ক আর টাকাই যে আপন পর বিচারের মাপকাঠি হয় না...এই এতবড় উপলব্ধিটা এই শেষ বয়সে আসবার পর আমার হল।তুমি বেঁচে থাকো মা...যেখানেই থাকো...ভালো থেকো...।" আঁচলের খুট দিয়ে তিনি আড়ালে মুছে নিলেন চোখের জল। চোখের জল আঁচলে মুছলের মনোরমা দেবীও।চারপাশে পরীর কাকিমারা তখন নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছেন..."ভিখারীর বাচ্চার রানি হওয়ার সাধ জেগেছিল!ভগবানই ওকে আজ ওর নিজের আস্তাকুঁড়টা দেখিয়ে দিলেন।" এই কথা শুনে ঝাঁঝিয়ে উঠল হিয়া।বলল..."ঠিক করে কথা বলুন কাকিমা...যেখানে যাচ্ছি...ওটা আস্তাকুঁড় নয়...ওটা হল মন্দির।ওইরকম জায়গায় ঠাঁই পাওয়ার যোগ্যতা আপনাদের অন্তত নেই।" ওইটুকু মেয়ের জবাব শুনে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ওঁরা।ব্যাগপত্র নিয়ে বিদায় নেওয়ার সময় মনোরমা দেবী বলে উঠলেন..."আমাদেরকে একেবারেই ভুলে যাস না...চিঠি পাঠাস মাঝে মাঝে...পাঠাবি তো মা?" ---"অবশ্যই পাঠাব কাকিমা...।"হেসে বলল হিয়া। ব্যাগপত্র নিয়ে চক্রবর্তী বাড়ির মেন গেট থেকে বেরোতে যাবে হিয়া...এমন সময়ে একটা দৃশ্য দেখে প্রচন্ডভাবে চমকে গেল হিয়া।ও চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পেল...গেটের একপাশে দাঁড়িয়ে মুখে আলতো হাসি নিয়ে ওকে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে ওরই বয়সী একটি মেয়ে।একদম হুবহু ওরই মতো দেখতে।ওর জমজ বললে ভুল হবে না একেবারেই।এতটাই অবাক হয়ে গেল হিয়া...যে ও গেট থেকে বেরোতে গিয়েও থমকে গেল।একেবারে কাঠপুতুলের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল।তা দেখে ওর মা ওকে তাড়া দিলেন।"কি রে মা...চল...বেলা এগারোটায় ট্রেন।আমাদের তো তার আগে স্টেশনে পৌঁছতে হবে!তাড়াতাড়ি চল...।" মায়ের তাড়া শুনে ঘোর কাটল হিয়ার।আর সেই সঙ্গে প্রচন্ড আশ্চর্যও হল।ও এক্ষুনি যাকে দেখল...তাকে ওর বাবা...মা...বাড়ির দারোয়ান কেউই কি তবে দেখতে পাচ্ছে না! সমাপ্ত রশ্মিতা দাস

