STORYMIRROR

Rashmita Das

Horror Fantasy Thriller

4  

Rashmita Das

Horror Fantasy Thriller

অতৃপ্ত বাসনা

অতৃপ্ত বাসনা

35 mins
22

কয়েকদিন  ধরেই মারাত্মক আতঙ্ক আর অপ্রত্যাশিত বেসামাল ঝড়ের দাপটে ছিন্নবিচ্ছিন্ন পর্ণা একেবারে স্তম্ভিত,বাকরুদ্ধ।প্রতিদিনের থোড়বড়িখাড়া খাড়াবড়িথোড় দিনলিপি আর রোজনামচায়  দিনগুলো কেটে তো যাচ্ছিল।অতীতের আশা আকাঙ্খা স্বপ্নকে রাতারাতি বিসর্জন দিয়ে আর ভবিষ্যতের সমস্ত বাসনাকে মুলতুবি রেখে বর্তমানের খেয়ায় শর্তহীন বৈঠা ধরা কজ্বিতে আজ হঠাৎ এই নাম না জানা ধুমজ্বর এসে সবকিছু ক্রমশ এমনভাবে বেসামাল করে তুলেছে যে একেবারে দিশাহারা হয়ে পড়েছে পর্ণা। নতুন খাটটি আসার পর থেকে তার জীবনে যে এইভাবে বিপর্যয় নেমে এসে সমস্ত হিসাব ওলটপালট করে দেবে সেটা স্বপ্নেও ভাবেনি পর্ণা।ব্যাপারটা একটু গোড়া থেকেই বলি...। বেশ ধুমধামের সাথেই বিয়েটা হয়ে যায় প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার পাত্র স্বপ্নীলের সাথে বিয়েটা হয়ে যায় পর্ণার।কিন্তু পি এইচ ডি শেষ করে বিয়ের পিঁড়িতে বসার আগে বিয়ে নিয়ে প্রতিটি মেয়ের মতোই পর্ণার মনের মধ্যেও যে দুরুদুরু উৎকন্ঠার ধুকপুকানি ক্ষণে ক্ষণে প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করেছিল,তা বিয়ের রাতে এক লহমায় নিভে গেল।বিয়ের প্রথম রাতেই পর্ণা জানল,তার বাড়ি থেকে ঠিক করা সুপ্রতিষ্ঠিত ডাক্তার পাত্র আসলেই একজন পুরুষত্বহীন নপুংসক।এখন পর্ণা বুঝতে পারল কিভাবে তার জীবনটা বরবাদ হয়েছে।মাথায় হাত দিয়ে পর্ণার সামনে আর কোনো রাস্তা বেঁচে রইল না।চিরকাল জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে বাড়ির থেকে সীমাহীন স্বাধীনতা পেয়ে এলেও বিয়ের ক্ষেত্রটাতে পর্ণার কোনোরকম মতামতই গুরুত্ব পায়নি তার পরিবারের কাছে।সে বিয়ে করতে চেয়েছিল যাকে তাকে একটিবার নিজে দেখা বা যাচাই করারও সুযোগ সে পায়নি।যদি সেই সুযোগ সে পেত তাহলে প্রচুর টাকা আর প্রতিপত্তি দেখামাত্রই কিছুমাত্র বিবেচনা না করে তাতে সায় দিয়ে বসত না।সে গুরুত্ব দিত এমন কোনো ছেলেকে যার টাকা পয়সার তেমন জোর নেই কিন্তু জীবনের বাজি জিতে নেওয়ার দম যার মধ্যে জোরদারভাবে রয়েছে। সে তার সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে জীবনটাকে একটু অন্যভাবে অন্য আঙ্গিকে দেখতে...বাঁচতে আগ্রহী ছিল।আর সেক্ষেত্রে অন্তত স্বপ্নীলের সাথে তার বিয়েটা কোনোমতেই হত না আর তাকে এমন পরিস্থিতিতেও হয়তো পড়তে হত না।কিন্তু কপালের লিখন আর কিভাবেই বা সে খন্ডাবে! স্বপ্নীল রীতিমতো শান্তশিষ্ট স্বল্পভাষী ছেলে।সাত চড়ে রা নেই যাকে বলে।সে কখনোই চায়নি একটি মেয়েকে ঠকিয়ে তার জীবন নষ্ট করতে।কিন্তু তার পরিবারের সামনে তারও বিয়ে নিয়ে কোনো মতামত বা আপত্তি কিছুতেই ধোপে টিকল না।প্রায় জোরজবরদস্তি দুই পরিবার মিলে হৈ হৈ করে দুইজনকে এক খাঁচায় পুরে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল তাদের দুজনের সামনের জীবন আর ভবিষ্যৎকে অতল অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে।দুজনেই দুজনের পরিস্থিতি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল।কাজেই এখানে যে স্বপ্নীলকে দোষারোপ করে কোনো লাভই নেই সেটাও পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারল পর্ণা।বিয়ের পর বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। দমকা হাওয়ার মতোই।পর্ণা শ্বশুরবাড়ির দায়িত্ব কর্তব্য দিয়ে দিন শুরু করে কলেজে পড়িয়ে আসার পরে বিকেল নাগাদ ফিরে আসে।তারপর সবার জন্য জলখাবার তৈরি,রাতের রান্নার যোগাড়,নিজের প্রয়োজনীয় স্টাডি এইসব সেরেটেরে রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে সোজা চলে যায় বিছানায়।স্বপ্নীলও একেবারে সকালে বেরিয়ে যায় আর ফেরে একেবারে রাতের দিকে।এসেই সেও খাওয়া সেরে বিছানায় এলিয়ে দেয় শরীর।এইভাবে ব্যস্ততার অজুহাতটাকে সুন্দরভাবে খাড়া করে দিয়ে একই ছাদের তলায় বিনা কথোপকথন ও আলাপচারিতায় এক ছাদের তলায় প্রতিবেশীর মতো দিন পার করে চলেছে।রাতে অর্ধেক দিন স্বপ্নীল সোফায় ঘুমোয় নয় পর্ণা রাতকে সকাল করে স্টাডি টেবিলে।এইভাবে দিন যায়।দুজনেই এটা পরিষ্কার বুঝতে পারছে,এই সম্পর্ক টেনে নিয়ে যাওয়ার কোনো মানেই নেই।এই সম্পর্কের না আছে কোনো মানে না আছে কোনো ভবিষ্যৎ।পর্ণা এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে বাবা মায়ের সাথে দু একবার কথা বলতে গিয়ে ভীষণভাবে অবদমিত হয়ে ফিরে এসেছে।এখন ঘরে অবিবাহিত ছোটবোনের বিয়ের চিন্তায় রাতদিন এক করা বাবা মায়ের কাছে এসব কথা বলতে যাওয়ার আর কোনো মানে নেই সেটা বুঝে নিয়ে সে নিজের বিবাহিত জীবন সম্পর্কে যাবতীয় স্বপ্ন কে ধামাচাপা দিয়ে সরিয়ে রেখে এখন শুধুমাত্র দায়িত্বশীল পুত্রবধূ হয়ে সংসারে নিজের কর্তব্য করে চলেছে আর নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে একপ্রকার উদাসীন জীবন যাপন করছে। বেশিরভাগ দিনই পর্ণার রাত স্টাডি টেবিলে মাথা রেখে কাটলেও ইদানীং এক নতুন উৎপাতে স্বপ্নীলের ঘুম চৌপাট হওয়ার যোগাড়।তাদের বহুযুগের পুরোনো খাটটি এখন এতটাই বৃদ্ধ হয়ে পড়েছে যে সামান্য একটু নড়াচড়াতে অথবা পাশ ফিরলেই খাটে খুব বিশ্রীভাবে ক্যাঁচড় ক্যাঁচড় শব্দটা মারাত্মকভাবে বেড়ে গিয়েছে।এই খাট বদলে একটা নতুন খাট কিনতে হবে।খাট ঘর থেকে বিতাড়িত হল কদিনের মধ্যেই।আর তার জায়গা নিল যে খাটটি,সেটিকে কোনোভাবেই নতুন বলা চলে না।কতটা পুরোনো এই খাটটি, সেটা বলা শক্ত। কিন্তু এমন রাজকীয় অ্যান্টিক দেখে প্রায় জেদ করেই এই খাটখানা কিনে আনল স্বপ্নীল।তার বক্তব্য,এ জিনিস হাতছাড়া করা যায় না।সেইদিনের পর থেকেই ওদের দুজনের এই নিঃশব্দ জীবনে আচমকাই নেমে এল এক তোলপাড় করা ঝড়।এর পর থেকে যত রাত এসেছে সেই প্রত্যেক রাতে স্বপ্নীলের মধ্যে যেন জেগে ওঠে এক দীর্ঘবছরের কামপিপাসু পুরুষের ঘোর আস্ফালন। প্রতিরাতে নারকীয়ভাবে স্বপ্নীলের হাতে ধর্ষিতা হয় পর্ণা। রাত যত গভীর হয়,পর্ণা ঘনঘোর বিস্ময় নিয়ে প্রতিবার দেখে আলুভাতে স্বপ্নীলের শরীর ফুঁড়ে যেন জেগে উঠছে কাম পিপাসার জ্বালায় ছটফট করা এক গ্রীক পুরুষের সৌন্দর্য্যের মূর্ত প্রতীক।সে তার দুর্বার তৃষ্ণার ফল্গুধারার স্রোতের সাথে স্রোত মেলানোর জন্য পর্ণার শরীরখানা জাপটে ধরে ঠিকই কিন্তু কিন্তু পর্ণা প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করে...সে তাকে নয়...খুঁজছে অন্য কোনো এক নারীকে।যখন বন্য সোহাগের তীক্ষ্ণ ফলায় ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে পর্ণা,তখন সবকিছু এমনভাবেই পর্ণার হাতের বাইরে চলে যায় যে তখন সে কোনোকিছু বোঝা না কিংবা বোঝার জায়গাতেই আর থাকে না।একদিন দুইদিন... সপ্তাহখানেক গেল এইভাবে। পর্ণার মধ্যে নিজের কাঙ্ক্ষিত নারীকে খুঁজে না পেয়ে স্বপ্নীলের ভিতরের কামদস্যু ক্রমশ একেবারে লাগামছাড়া হয়ে উঠছে।পর্ণা আর স্বপ্নীল এতদিন সকলের সামনে স্বাভাবিক দাম্পত্যের নাটক করে আসলেও এবার যখন পর্ণার সহ্যের সমস্ত সীমা অতিক্রান্ত হয়েছে,তখন সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল...যা হওয়ার হয়ে যাক এই কামদস্যুর হাতে আর নির্যাতিতা,ধর্ষিতা সে হবে না।প্রতিরাতের হুঁশহীন স্বপ্নীল সকালে উঠে চেতনা ফিরে পাবার পর সে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে অসহায়ের মতো।পর্ণার পায়ে ধরে সে ক্ষমা চায় রাতের সমস্ত ব্যবহারের জন্য।কিন্তু রাত এলেই সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।স্বপ্নীলও এবার পর্ণার সাথে সহমত হল।প্রতিরাতে নিজের মধ্যে কামদস্যুর সমস্তকিছু ছিঁড়েফুঁড়ে ওঠা বন্য আস্ফালনকে আটকানোটা তার নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ।কিন্তু এভাবে আর বাড়ির সকলের সামনে স্বাভাবিক দাম্পত্যের নাটক করে চলাটা সম্ভব নয়।স্বপ্নীল পর্ণাকে বিবাহিত জীবনের পরিপূর্ণতা দিতে অক্ষম হলেও সে কোনোদিন চায়নি তাকে অসম্মান করতে।এবার যখন সে পর্ণার অবস্থা আর পরিস্থিতি নিজের চাক্ষুষ করছে তখন সে নিজেই পর্ণাকে জোর দিয়ে বলল,"এটা বাবা মায়ের উপর রাগ অভিমান করে চুপচাপ এখানে পড়ে থাকবার সময় তোমারও নয়...আমারও আর এই মিথ্যে দাম্পত্যের নাটকের আড়ালে তোমার এমন দুর্দশা দেখে যাওয়ার সময় নয়।আপাতত যে যা বলার বলুক।তুমি আর আমি একছাদের নীচে আর রাত কাটাব না।পর্ণা তাতে সম্মত হল। অদ্ভুত ঘটনা শুরু হল ঠিক সেই রাত থেকে।রাত ঘনিয়ে আসার সময়টা এলেই পর্ণার ভিতরে এক অজানা তোলপাড় আরম্ভ হয়ে যায়।মনে হয় সারা পৃথিবীর সমস্ত কামক্ষুধা যেন তার ধমনী ফুঁড়ে রক্তের সাথে উত্তাল হয়ে কালনাগিনির ন্যায়ে ফুঁসছে।নিজেকে কার্পেটের মতো স্বপ্নীলের পায়ের তলায় পেতে দেবার জন্য উতলা হয়ে ওঠে।সে যেমন খুশি দলেপিষে তার সর্বশরীর জুড়ে যন্ত্রনার অব্যক্ত স্বরলিপি আঁকতে থাকবে আর সেই মূর্ছনার তালে তালে এক অপার্থিব জগতে নিজেকে ভাসিয়ে দেবে পর্ণা।এখন রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে নতুন বিছানাটির প্রতি এক অমোঘ টান অনুভব করে পর্ণা যাকে অস্বীকার করা বা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো ক্ষমতাই তার নেই।কিন্তু সকাল হওয়ার পরেই হুঁশ ফিরে আসার সাথে সাথে সে যখন নিজের সারা শরীরে আঁচড় কামড়সহ বীভৎস সব ক্ষতচিহ্নের সম্মুখীন হয় তখন পর্ণা আর স্বপ্নীল দুজনেই উপলব্ধি করে ব্যাপারটা আর তাদের হাতে নেই।এবার সমস্তরকম সামাজিক বাধানিষেধ উপেক্ষা করে তারা হাইকোর্টে মিউচুয়াল ডিভোর্সের নোটিস পাঠাল।এরপর পর্ণা নিজের সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে স্হায়ীভাবে বাপের বাড়িতে ফিরে গেল।ডিভোর্সী মেয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে এসেছে দেখে চারদিকে নিন্দামন্দ আর বিভিন্নপ্রকার কথাচালাচালি আরম্ভ হয়ে গেলেও পর্ণার বাবা মা বুঝতে পারল একজন নপুংসক ছেলের সাথে সংসার করা তাদের নিজেদের মেয়ে কেন,কোনো মেয়ের পক্ষেই সম্ভব নয়।আর অন্যদিকে পর্ণার ছোটবোনও চাকরীর সাথে সাথে ইতিমধ্যেই প্রেম করে নিজের বিয়ে এবং ভবিষ্যতের সমস্ত পরিকল্পনা সেরে রেখেছে।হবু ভগ্নীপতির সাথে আলাপও হল পর্ণার।ওদের ইচ্ছা,খুব শীঘ্রই দুজনে বিদেশে গিয়ে সেখানে সংসার করবে।অতএব এখন পাড়াপ্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে মাথা ঘামানোটা,ঠেকে শিখে হলেও কমেছে পর্ণার বাবা মায়ের।অন্যদিকে স্বপ্নীলের বাবা মা জেনেশুনেই সকলের কথায় নেচে হুট করে ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলেও পরে ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন,একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে হলেও নিজেদের ছেলেকে আর পাঁচজনের মতো সংসারী হিসেবে দেখাটা সত্যিই অসম্ভব।কাজেই চারপাশে লোকজনের বিভিন্নপ্রকার কুমন্তব্য আর কথা চালাচালির জেরএ জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেলেও দুজনের পরিবারই এই বিচ্ছেদ নিয়ে আর কোনো কথা বাড়ায়নি।যাবতীয় সমস্যার সমাধান হয়ে গেল বেশ সহজেই।কিন্তু সমস্যা প্রকৃতপক্ষে যেদিকে মোড় নিয়েছে সেদিক থেকে সমাধানের রাস্তায় ফেরা যে এতটাও সহজ নয়,ক্রমেই সেটা বুঝতে পারল স্বপ্নীল আর পর্ণা।বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও ওরা এখন বেশ ভালো বন্ধু।স্বপ্নীল তো ইতিমধ্যে পর্ণার জন্য উপযুক্ত পাত্র দেখা শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু প্রতিদিনই,রাত গভীর হতে না হতেই স্বপ্নীল আর পর্ণা দুজনে পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক...পরস্পরের প্রতি একটা সাংঘাতিক টান অনুভব করতে শুরু করে যা পরিণতি না পেলে যেন পৃথিবী ওলটপালট হয়ে যাবে।এই অমোঘ টান উপেক্ষা করার ক্ষমতা ওদের দুজনের কারোর নেই।আজকাল স্বপ্নীল নাইট ডিউটির বাহানা দিয়ে রাতের পর রাত বাইরে কাটায়।পর্ণাও রাত গভীর হলেই তার শোবার ঘরের ব্যালকনি সংলগ্ন মই বেয়ে নীচে নেমে উন্মাদিনীর মতো সেই মায়া টানের স্রোতে ভাসিয়ে দেয় নিজের সর্বস্ব লোকচক্ষুর অন্তরালে... ধীরে ধীরে ওরা দুজনেই বুঝতে শুরু করল,ব্যাপারটা রীতিমতো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।স্বপ্নীল চরিত্রগত দিক দিয়ে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান এবং সৎ হলেও,দিনে যার বিয়ের জন্য পাত্র দেখছে রাতের অন্ধকারে তার কাছেই ছুটে যাচ্ছে হুঁশ ও চেতনাহীন অবস্হায়।এই ব্যাপারটা কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছে না স্বপ্নীল।আর ডাক্তার হওয়ার সুবাদে সে নিজে এটা বুঝতে পারছে,তার নপুংসক শরীরে  ভীষণ শক্তিশালীভাবে ক্রমশ ফুটে উঠছে পৌরুষত্বের সমস্ত অভিব্যক্তি। ওদিকে পর্ণাও এই ব্যাপারটা নিয়ে মনের ভিতরে তীব্র একটা অপরাধবোধ নিয়ে চলছে।ডিভোর্সের পরে প্রাক্তন স্বামীর কাছে একজন প্রাক্তন স্ত্রী যদি এভাবে ছুটে যায়ও...তাতে লেগে থাকে ফেলে আসা দাম্পত্যের মিষ্ট সুবাস আর তীব্র মন কেমনের যন্ত্রনাক্লিষ্ট হৃদয়ের আকুতি।কিন্তু শারীরিকভাবে অক্ষম হওয়ার জন্য যার সাথে একটি দিনও স্বামী স্ত্রী হিসাবে কাটানো সম্ভব নয় রাতের অন্ধকারে কোনো এক অলীক শক্তির তুমুল দাপটে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সম্পূর্ণ চেতনালুপ্ত অবস্হায় ঝড়ের গতিতে পর্ণা ছুটে চলে যায় তারই সংস্পর্শে চুম্বকের মতো...আচ্ছন্ন নেশার ঘোরে অবচেতন অবস্হায়।এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে দিনের পর দিন যার ওপর ওদের দুজনেরই কোনো হাত নেই।ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পরেও যখন বাবা মায়ের কাছে থাকা সংসারবিহীন পর্ণাকে তার হাতে পায়ে শরীরের আনাচেকানাচে আঁচড় কামড় আর নৃশংস অত্যাচারের চিহ্ন ঢেকেঢুকে চলতে হয় প্রতি মূহুর্তে তখন মাঝে মাঝে একটা অর্থহীন দাম্পত্য থেকে মুক্তি পেয়েও সে রীতিমতো কাতরচিত্তে অন্তর চেরা যন্ত্রণাক্লিষ্ট মূক আর্তচিৎকারে সে মুক্তি চায় জীবনের থেকে। স্বপ্নীল আর পর্ণা দুজনেই এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চায় কিন্তু পরিত্রাণের উপায় যে তাদের দুজনেরই হাতের বাইরে এটা দুজনেই তীব্রভাবে উপলব্ধি করতে পারছে। একদিন দুজনে সময় করে দেখা করল এই ব্যাপারটা কি করে বন্ধ করা যায় সেই উপায় ভাবনাচিন্তা করার জন্য।স্বপ্নীল আর পর্ণা দুজনেই এতদিনে এই বিষয়টা ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারছে যে এই গোটা ব্যাপারটার সঙ্গে স্বপ্নীলের ঘরের ওই নতুন খাটটির কোনো গভীর সংযোগ রয়েছে।স্বপ্নীল সে কথায় সায় দিয়ে পর্ণাকে জানাল,তাদের বিচ্ছেদের কিছুদিনের মধ্যেই সেই খাটের সমস্ত কলকবজা খুলে গুদামঘরে রেখে এসেছে বিক্রীর ব্যবস্হা করবার জন্য।স্বপ্নীলের পরিবারের লোকেরা এখন অনেকটাই পালটে গেছে।তারা এখন আর তার কোনো কাজেই কোনোরকম খবরদারি করে না বা জবাবদিহি চাওয়ার মধ্যে যায় না।কিন্তু পর্ণার বাবা মা তো ওর শাড়ি বা ওড়নার আনাচকানাচ আর ফাঁকফোকর দিয়ে অসাবধানে বেরিয়ে আসা বীভৎস ঘা আর ক্ষতগুলো দেখে তো দিনরাত পর্ণাকে চেপে ধরছেন আর তারপর এর কোনো সুরহায় আসতে না পেরে কপাল চাপড়াচ্ছেন।এই পুরো ব্যাপারটা যে জানাজানি হতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না সেটা আন্দাজ করতে পেরে বুক কেঁপে উঠছে পর্ণার।সে তার নিজের পরিস্থিতির কথা জানাল স্বপ্নীলকে।দুজনেরই বুঝতে পারল পরিস্থিতি এবার যেদিকে এগোচ্ছে এবার এই বিষয়ে কোনো একজন তৃতীয় ব্যক্তির হাত প্রয়োজন। এবং যা করার খুব শীঘ্র করতে হবে।এই অতিপ্রাকৃতিক শক্তির কুপ্রভাবে ঘটে চলা এই ভয়ানক অঘটনের খবর যদি একবার জানাজানি হয় তাহলে সবাই মিলে আবার ধরে বেঁধে তাদের এক ছাদের নীচে ঠেলে দেবে সংসার করার জন্য যেটা দুজনের কেউ কোনোভাবেই চায় না। স্বপ্নীল আর পর্ণা দুজনেই এখন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল,তাদের সাথে ঘটে চলা এই অপার্থিব ঘটনার ব্যাপারে যত দ্রুত সম্ভব,এমন কোনো বিশ্বস্ত বন্ধুর সাথে আলোচনা করা প্রয়োজন যার উপরে দুজনেই অনেকটা ভরসা করতে পারে।তারা ঠিক করল,স্বপ্নীলের জেঠতুতো দাদা সায়নের সাথে এই বিষয়ে কথা বলবে।সায়ন বর্তমানে চাকুরীসূত্রে শিলিগুড়িতে থাকে ।গোটা পরিবার যখন স্বপ্নীলের বিয়ে দেবার জন্য মরিয়া,তখনও স্বপ্নীল এই সায়নদারই দ্বারস্থ হয়েছিল বিয়েটা আটকাবার ব্যবস্হা করার জন্য।সায়ন স্বপ্নীলের বিপদের কথা শুনে তড়িঘড়ি কলকাতা এসে পৌঁছেছিল সবাইকে বলে বুঝিয়ে বিয়েটা আটকাতে,স্বপ্নীলের শিশুকাল হতেই একটা সমস্যা আছে সেটা স্বপ্নীলের বাবা মায়ের অজানা নয়।তাঁরা যাতে জেনেশুনে একটা নিরপরাধ মেয়ের জীবন না বরবাদ করেন তার জন্য সে তাঁদের দুজনকে বন্ধ দরজার ভিতরে এনে বহু চেষ্টা করেছে বোঝানোর।লাভ হয়নি।পরিবারের সব ছেলের ধূমধাম করে বিয়ে হওয়াটা পরিবারের রীতি।এখন বিয়ের বয়সে পা দেওয়া স্বপ্নীলের ব্যাপারে তাঁরা কি ভাবছেন এটা জানার জন্য আত্মীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশী সবাই ব্যগ্র।এখন একটা বিয়ে দিলে ভালোমন্দ সব প্রভাব বাইরে থেকে আসা একটা মেয়ের উপর দিয়েই যাবে।তাঁদের ছেলে আগে যেমন ছিল তেমনই থাকবে আর সকলের মুখও বন্ধ হয়ে যাবে।এইসব পোড় খাওয়া যুক্তির সামনে সায়নের কোনো কথা না টেকায় সে বাধ্য হয়েছিল বিয়ের আগেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে শিলিগুড়ি ফিরে যেতে।সেই সময়েই সে বুঝেছিল,একটা সময় এমন আসবে যখন ভাইএর ফের তার পরামর্শের প্রয়োজন পড়বে।চারহাত এক করার যজ্ঞে আগুন দেওয়ার জন্য কখনোই লোকের অভাব হয় না।কিন্তু এক ছাদের তলায় থাকতে গিয়ে যদি সমস্যার উদ্রেক হয় তখন পাশে কাউকেই পাওয়া যায় না।কাজেই সেই সময় যদি স্বপ্নীল তার কাছে সাহায্য চায়,তখন সে বিনা ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটে ওর পাশে দাঁড়াতে পারবে।সায়ন মোটামুটি প্রস্তুত ছিল স্বপ্নীলের হঠাৎ একটা ফোনকল আসার জন্য।বিয়ের আগে পর্ণাও সায়নকে যেটুকু দেখেছে,তাতে তারও সায়নের প্রতি একটা ভরসার জায়গা তৈরি হয়েছে।পর্ণা আর স্বপ্নীল দুজনেই একটা সিদ্ধান্তের কিনারায় এসে একত্রিত হওয়ার পর মোবাইল ফোনটাকে লাউড স্পিকারে রেখে সায়নকে ফোন দিল।সায়ন এতদিন বাদে ছোটভাইএর ফোন পেয়ে কুশল বিনিময়ের পরেই বলল ,আমি জানতাম তুই কদিন বাদেই আমায় ফোন দিবি।তোর ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলাম।এত দেরী হচ্ছে দেখে গতকাল পরশুই ভাবছিলাম আমিই তোকে একটা ফোন করব... ফোনের ওপার থেকে সায়নদার কন্ঠ শোনামাত্র যেন স্বপ্নীল অনুভব করল,সায়নদা যেন স্নিগ্ধ স্বরে তাকে আশ্বাস দিচ্ছে, "যা তোর সমস্যা মন খুলে বল...সমাধান ঠিক পেয়ে যাবি...।" স্বপ্নীল মনে মনে লজ্জা  সংকোচ সব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বলল,এতদূরে চলে গিয়েও এই এতবড় বাড়ির মধ্যেকার আমিটাকে শুধু তুমিই বোঝো সায়নদা...আমার আর পর্ণার এখন ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও একটা অদ্ভুত সমস্যায় পড়েছি আমরা দু্জনেই।ব্যাপারটা ক্রমশ আমাদের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।তোমার সাথে সামনাসামনি বসে কথা বলাটা ভীষণ দরকার সায়নদা...তুমি প্লিজ কটা দিনের জন্য একটু কলকাতায় আসতে পারবে? স্বপ্নীলের কথা শুনে বেশ আশ্চর্য হল সায়ন।সে সবিস্ময়ে বলল, ---তা ডিভোর্স যদি হয়ে থাকে তাহলে তো সেখানেই সমস্যার ইতি।আবার নতুন কি সমস্যা হল? ---ওইভাবে ফোনে সবটা খুলে বলা যাবে না।বিশেষ করে পর্ণাকে এমন সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে যে ওর জীবনে সামনের দিকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবতে গেলেই ওকে দশ পা পিছিয়ে যেতে হচ্ছে। পরিস্থিতি খুবই সঙ্গিন সায়নদা।তুমি কোনোভাবে ম্যানেজ করে কটাদিনের জন্য এখানে চলে এসো... স্বপ্নীলের কন্ঠে কাতর ধ্বনি স্পষ্ট। সায়ন স্বপ্নীলের কন্ঠে কাতরতার আর্তি শুনে একটা রহস্যের গন্ধ পেল।এখন ছোটভাইএর যে সত্যিই তাকে প্রয়োজন এটা সে অনুধাবন করতে পারল। যত শীঘ্র সম্ভব একটা ব্যবস্হা করে সে কলকাতায় আসবে দিনকয়েকের জন্য,এই বিষয়ে স্বপ্নীলকে আশ্বস্ত করে সে ফোন রাখল। সত্যিই এরপর আর দেরী করল না সায়ন।অফিসে ছুটির অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে দিনকয়েকের জন্য সে চলে এল কলকাতা। তবে সে কলকাতায় এসেও নিজের বাড়িতে না এসে,লাগেজ নিয়ে উঠল একটা হোটেলে। এখন সে ভাইয়ের সমস্ত কথা শুনতে চায় সমস্তরকমের উপদ্রবমুক্ত কোনো একটা নিরিবিলি জায়গায়।আর এক্ষেত্রে,এখন সায়নের কলকাতায় আসার খবরটা তার পরিবারের সকলের না জানলেও চলবে। কলকাতায় সায়ন পা দিতে না দিতেই আর দেরী না করে স্বপ্নীল আর পর্ণাকে ডেকে নিল নিজের রুমে।তারা দুজনেই কোনোমতে নিজেদের কাজ ম্যানেজ করে সন্ধ্যার আলো নিভতে না নিভতেই সায়নের রুমের দিকে পড়িমড়ি করে দৌড় দিল।তবে তারা আর হোটেলের রুমে না বসে বাইরে একটা ফাঁকা ঝিলের পাড় দেখে সেখানে ঠিকভাবে জুত করে বসল।সন্ধ্যার নিভু নিভু আলো ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছে।আকাশ দেখলে মনে হবে যে কোনো মূহুর্তে সূয্যিমামা ঝপ করে উল্টোদিকের আকাশের পকেটবন্দী হয়ে যাবে।চারপাশটা প্রায় জনহীন শুনশান।স্বপ্নীল আর পর্ণা দুজনেই লাজলজ্জা একপাশে সরিয়ে রেখে অকপটে যতটা সম্ভব সমস্ত ঘটনাক্রম ব্যক্ত করল সায়নের কাছে।এমনকি পর্ণা নিজের হাতে গলায় ঘাড়ে আঁচড় কামড়ের নৃশংস চিহ্নগুলোও স্বপ্নীলকে দেখাতে কার্পণ্য করল না।মোবাইলের আলো জ্বেলে সায়ন সেই চিহ্নগুলো‌র দেখতেই ছ্যাঁৎ করে উঠল তার বুকের ভিতরটা।সায়নের সামনে বসে স্বপ্নীল যখন অকপটে স্বীকার করছে এই ঘৃণ্য অপকর্মটি রাতের অন্ধকারে তার নিজেরই দ্বারা সৃষ্ট,এবং স্বপ্নীলকে পুরোপুরি সায় দিয়ে তার হাতে হাত মিলিয়ে সে কথা আরো জোর দিয়ে বলছে পর্ণা, তখন সায়ন পুরো ব্যাপারটার মধ্যে সাংঘাতিক জটিল কোনো একটা রহস্যের তীব্র একটা গন্ধ পেল।সে স্বপ্নীলকে বলল,"এখনো তুই সেই নতুন খাটটাতেই শুস নিশ্চয়ই?" ---না সায়নদা...সেই খাট আমি ডিভোর্স হয়ে যাবার পর পরই গুদামঘরে সরিয়ে দিয়েছিলাম।এখন ওটা বিক্রী হয়ে গেছে।আমার এক বন্ধু খাটটা কিনে নিয়ে গেছে সপ্তাহখানেক হল।কিন্তু এখন আমরা দুজনেই বুঝতে পারছি এই সমস্যার সঙ্গে সে খাটের কোনো সংযোগই নেই।কারণ এক সপ্তাহের উপর হয়ে গেল আমার বন্ধু শৈবাল সেটা কিনে নিয়ে গিয়েছে।নতুন বিয়ের পরে সেও তো সস্ত্রীক ওই খাটটাই ব্যবহার করে।আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি,তাদের কোনো সমস্যাই হয়নি কোনোদিন... স্বপ্নীলের কথায় সায় দিয়ে পর্ণা বলে উঠল,"হ্যাঁ...স্বপ্নীল ঠিকই বলছে।শৈবালের স্ত্রী তিয়াসা আমার বাল্যবন্ধু।ওর আর আমার মধ্যে কোনো কথাই চাপা থাকে না।যদি কোনো সমস্যা হত তাহলে ও আমাকে অন্তত নিশ্চয়ই বলত।" কপালটা একটু চেপে ধরে সায়ন চোখ বুঁজে একমনে কি যেন চিন্তা করতে লাগল। খানিক বাদে নীরবতা ভঙ্গ করে হঠাৎ সায়ন বলে উঠল..."ওই খাটটা আমায় একবার দেখতে হবে।" ---কিন্তু সায়নদা...ব্যাপারটার সঙ্গে তো খাটের কোনো সংযোগই নেই... ---"আমি যেটা বলছি সেটাই শোন মন দিয়ে।যে বিপদ ঘনিয়েছে তার থেকে মুক্তি যদি চাও তোমরা,তাহলে যেটা যেমনভাবে করতে বলছি চুপচাপ সেইটা করো।বুঝেছ?" সায়নদার কথাতে ধমকের সুর স্পষ্ট। পর্ণা মাথা চুলকে বলল,কিন্তু সায়নদা...খাটটা তো এখন বিক্রী হয়ে হাতের বাইরে চলে গিয়েছে।এখন ওটা তোমার সামনে আনি কি করে বলো তো... ---খাট হাতের বাইরে গেছে তো কি হয়েছে...খাটের ক্লায়েন্ট তো তোমাদের দুজনেরই চেনাশোনার মধ্যে পড়ছে।তাদের সাথে কোনোভাবে কথা বলে কিছুদিনের জন্য খাটটা আরেকবার ম্যানেজ করো কোনোভাবে। একবার খাটটা না দেখলে আমার পক্ষে কোনোকিছুই করা সম্ভব নয়। ---এই সমস্যার ব্যাপারটা তিয়াসার অজানা নয়।আর ওকে বলে খাটটা কিছুদিনের জন্য ম্যানেজও না হয় করা যাবে।কিন্তু শৈবালদা আর তিয়াসার শ্বশুরবাড়ির সবাইকে কি বলব এটাই তো বুঝতে পারছি না... চিন্তান্বিত মুখে বলল পর্ণা।স্বপ্নীল বলল, শৈবালকে না হয় আমিই বুঝিয়ে বলব।মনে হয় এই ব্যাপারে ওরা আমাদের সাহায্যই করবে। স্বপ্নীল আর পর্ণা আর কালবিলম্ব করল না।তারা শৈবাল আর তিয়াসার সাথে কথাটথা বলে নিয়ে সায়নদার সাথে দেখা করানোর জন্য নিয়ে এল।তারা পাঁচজন এক জায়গায় বসে কথা বলে বর্তমান পরিস্থিতি আর যাবতীয় সমস্যার সমাধানের একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য সঙ্গবদ্ধ হল।শৈবাল আর তিয়াসা বাড়িতে কোনোক্রমে ম্যানেজ করেটরে খাটটা ঘরের বাইরে আনাবার ব্যবস্হা করে ফেলল।তিয়াসার বাপের বাড়ির লাগোয়া একটি পরিত্যক্ত বাগানবাড়ি রয়েছে। তিয়াসার দাদু মারা যাওয়ার পরে ওই সম্পত্তির পুরোটাই এখন তিয়াসার ঠাকুরমার নামে উইল করে দিয়ে গিয়েছেন তিয়াসার দাদু।এখন শুধু ওই দলিলটা নিজের নামে করাতেই ব্যস্ত তিয়াসার মামা আর মাসীরা।আসল বাগানবাড়িটার দিকেই তাই বলতে গেলে বর্তমানে কারোরই দৃষ্টি নেই।সেটি এখন ঝোপজঙ্গল ছাওয়া পোড়োবাড়ির মতো অবহেলিত হয়ে পড়ে রয়েছে।সেখানে কোনো লোকজনের আনাগোনাও বিশেষ নেই।কাজেই সায়নদার কথামতো উপযুক্ত জায়গা হিসেবে ওই বাগানবাড়িটার কথা তিয়াসার সবার আগে মনে এল।সে সায়নদাকে সে বাগানবাড়ির বর্তমান অবস্হার বর্ণনা দিতেই সায়নদা সাথে সাথে বলে উঠল,ওইটাই একদম উপযুক্ত জায়গা।কাজেই দেরী করার তো আর কোনো প্রশ্নই নেই...ঠাকুরমার কাছ থেকে বাগানবাড়ির চাবিটা দিনকয়েকের জন্য হাতে করতে তিয়াসাকে খুব বেশি বেগ পেতে হল না।এরপর সেই বাগানবাড়িটা খুলে একটু পরিষ্কার টরিষ্কার করে নিয়ে খাটটা লোক দিয়ে ধরাধরি করে বাগানবাড়ির ভিতরের হলঘরের মতো বড়ো একখানা ঘরের মাঝ বরাবর রাখা হল।আর সায়নদার কথামতো ব্যবস্হা করা হল একটি যজ্ঞকুন্ডের। এইসব ব্যবস্হা করে ফেলতে ওদের দুইদিন মতো সময় লাগল।আর সেই দুই রাতে পর্ণার ঘাড়ে আর কোমরে দগদগে হয়ে ফুটে উঠেছে নতুন কালশিটে আর গভীর ক্ষত'র দাগ।সায়নদার কথামতো সেইদিন রাত বারোটা বাজার আগেই সেই বাগান বাড়ির ভিতরে এসে উপস্থিত হল স্বপ্নীল,পর্ণা,তিয়াসা,শৈবাল আর সায়নদা নিজে।কিন্তু সায়নদার বেশ দেখে প্রত্যেকেই ভীষণ অবাক হয়ে গেল।কপালে লাল তিলক,পরনে গেরুয়া বসন আর হাতে একটি রুদ্রাক্ষের মালা।মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে অফিসারের পদে কর্মরত সায়নদার এমন রূপ দেখে স্বপ্নীল আর পর্ণা তো বটেই,তিয়াসা আর শৈবালেরও রীতিমতো ভিরমি খাওয়ার মতন অবস্থা হল।ওরা চারজনই যখন সায়নদার দিকে হাঁ হয়ে তাকিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে গেল কিছুক্ষণ...নীরবতা ভাঙল সায়নদা নিজেই। ---"স্বপ্নীল তোর মনে পড়ে যখন তোর বয়স ছয় কি সাত...তোর জেঠুমনি আর ঠাকুর্দার সাথে আমার সাংঘাতিক একটা ঝামেলা বেঁধেছিল আর ফলপ্রসূ আমায় বছর দুয়েকের জন্য বাড়িছাড়া হতে হয়েছিল? ---হ্যাঁ হ্যাঁ সায়নদা।ওই সময়টার কথা আমার এখনো ভাসা ভাসা মনে পড়ে।যতদূর মনে হয় তোমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছিল আর তারপর তুমি যখন তখন ঘর থেকে উধাও হয়ে যেতে।তারপর কি একটা বিষয় নিয়ে ঝামেলা বেঁধেছিল একেবারে কুরুক্ষেত্ররই মতন।কিছু একটা এমন কাজ যেটা তুমি করবেই আর বাড়ির বড়রা তোমায় কিছুতেই করতে দেবেন না।শেষমেষ সবার বিরোধিতার মুখে পড়ে তুমিই ঘর ছাড়লে।ঝামেলার সময়ে আমি একবার বাবাকে বলতে গিয়েছিলাম,"দাদা যেটা চাইছে সেটা করুক না তোমরা সবাই বারণ করছ কেন!" ঠাটিয়ে একখানা চড়ের সাথে শুনেছিলাম,বড়োদের কথার ভিতর কথা বলাটা হল এঁচোড়ে পাকামির লক্ষণ।দু বছর পরে তুমি ফিরে এলে আর মানব না মানব না করেও দাদু জেঠু বাবা সবাই তোমায় আগের মতোই ঘরে জায়গা দিলেন।আর আমিও ব্যাপারটা ভুলে গেলুম।কিন্তু এতদিন বাদে তোমায় এভাবে দেখে আমার কেন জানি না ওইদিনগুলোর স্মৃতিই ভেসে আসছে...। ---তোর আন্দাজ ঠিক দিকেই এগিয়েছে।তুইও তো আর এখন কচি খোকাটি নেই।ব্যাপারটা খোলসা করে বলাই যাক।উচ্চ মাধ্যমিকটা দেবার পর থেকেই আমার বয়সী আর পাঁচটা ছেলের মতোই আমারও কাঁধের দুইপাশে দুটো অদৃশ্য পাখা আর পিছন দিকে একটা লেজ গজালো।বাড়ির গুরুজনদের চিন্তাভাবনা কথার বাইরে যে আমার নিজস্ব কিছু চিন্তাভাবনা বা কথা থাকতে পারে সেটা বলতে পারিস ওই সময় থেকেই আমি উপলব্ধি করতে আরম্ভ করি।তবে বাকিদের থেকে আমার চিন্তাভাবনার দিক বা দিশা কিছু আলাদাই ছিল।মাধ্যমিক দেবার বছরের গোড়ার দিকে যখন আমাদের পিসিমা মৃত্যুশয্যায় ছিলেন সেই সময় তোর মনে পড়ে আমরা সবাই পিসিমার শ্বশুরবাড়ির মেদিনীপুর গিয়েছিলাম কিছুদিনের জন্য?সেই গ্রাম্য মেঠো রাস্তায় আমার গাছের তলায় সাধনারত এক সন্ন্যাসী চোখে পড়ে।তাঁর চেহারায় এমন এক গাম্ভীর্য আর ব্যক্তিত্ব ছিল যে তাঁকে দেখে আমার আলতু ফালতু ভন্ড বলে মনে হল না কোনোভাবেই। আমি পরে লুকিয়ে তাঁর সাথে দেখা করেছিলাম।ওনার প্রতি আমার আগ্রহ বা ভক্তিভাবখানা প্রকাশই হয়ে পড়েছিল।ওনার সাথে একান্তে কথা বলে আমি জানতে পারি উনি অতিপ্রাকৃতিক শক্তিকে করায়ত্ত করার ক্ষমতা রাখেন।আমার জ্ঞানতৃষ্ণার তীব্রতা অনুভব করে তিনি আমায় বলেছিলেন,তিনি আমায় নিজের শিষ্য করে নিতে প্রস্তুত। আমি ওনার কাছে কিছুটা সময় নিয়ে বিদায় নিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম,কোনো না কোনো সময় আমি ঠিক তার সামনে আসব আর তাঁর সামনে আমার জ্ঞানভিক্ষার ঝুলি পেতে সামনে এসে দাঁড়াব। তারপর দুই বছর কেটে গিয়েছিল।আমি মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলাম এবং স্টার পেয়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে উচ্চ মাধ্যমিকটাও দিলাম।কিন্তু মনের ভিতরকার সেই খচখচানি যেমনকার তেমনই রয়ে গিয়েছিল। এবার উচ্চ মাধ্যমিক দেবার পর যখন আবার সাবজেক্ট আর কলেজ বাছবার সময় এল,তখন আমার ভিতর থেকে কে যেন তেড়েফুঁড়ে বলতে লাগল,জীবনের অনেক বড়ো কোনো একটি প্রাপ্তি আমি যেন ফেলে চলে আসছি।আমাকেই গিয়ে সেটা কুড়িয়ে আনতে হবে।আমি তখন ঠিক করলাম,আমি মেদিনীপুরের ওই তান্ত্রিক বাবার কাছে তন্ত্রসাধনা শিখব।ব্যস্...সেই থেকে ঝামেলা শুরু। আর তার পরের ঘটনা তোরা এখন সবাই জানিস। ---তার মানে তুমি তন্ত্রসাধনা আয়ত্ত করতে চেয়েছিলে আর সেই জন্য বাড়ির বড়দের আপত্তি উঠে অমন অশান্তির আকার ধারণ করেছিল! বিস্ময় নিয়ে বলে উঠল স্বপ্নীল। ---একদম ঠিক।আর সেটা করা থেকে আমাকে কেউ আটকাতেও পারেনি।আমি গুরুদেবের কাছে থেকে পাক্কা দুই বছর এক কথায় কৃচ্ছ্রসাধন করে অতিপ্রাকৃতির শক্তি আয়ত্তের মধ্যে এনে মৃত আত্মাদের সাথে যোগসূত্র স্হাপন করা শিখেছি।কোনো অতিপ্রাকৃতিক শক্তি আর তাদের কার্যকলাপকে শনাক্ত করবার ক্ষমতা আমার আছে।আর আমার আয়ত্ত করা বিদ্যার মাধ্যমেই আমি এই পুরো ব্যাপারটার মধ্যে এই পার্থিব জগতের সাথে অপার্থিব জগতের এক নিবিড় যোগসূত্রের সংকেত পাচ্ছি।আজ আমি সমস্ত ধোঁয়াশাকে এক জায়গায় এনে পুরো ব্যাপারটার একটা কিছু হেস্তনেস্ত করে ছাড়ব।তোরা সবাই আমার সঙ্গে ভিতরে আয়।ভয় পাস না।আমি আছি।" সায়নদার আশ্বাসবাণী পেয়েও স্বপ্নীল আর পর্ণার আতঙ্কের পারদ যেন আগের তুলনায় ক্রমশ দ্বিগুণ হয়ে উঠল।শৈবাল আর তিয়াসারও মনে হতে লাগল, বন্ধু হিসেবে তো স্বপ্নীল আর পর্ণার পাশে আছেই ওরা...খামোখা মরতে এভাবে এই ঘরের ভিতরে ঢোকাটা হয়তো উচিত হয়নি তাদের।কিন্তু সময়ের গাম্ভীর্য এবং একটা থমথমে চাপা বাতাসে অন্তর্নিহিত,চিন্তার গতি শ্লথ করা এমন এক অদৃশ্য শক্তি বিরাজ করছিল ঘরটার ভিতরে যা ঘরের ভিতরে অবস্হান করা প্রত্যেকটি মানুষকে নীরব করে তুলেছিল।তারা প্রায় বোবা পুতুলের মতো নিশ্চুপে সায়নদাকে অনুসরণ করল।হলঘরের ভিতরে ধীরপায়ে ঢুকে সায়নদা একবার চারিধারে চোখ বুলিয়ে নিল অনুসন্ধিৎসু চোখে।অতঃপর সজ্জিত যজ্ঞকুন্ডের সামনে আসন করে বসল।বাকি চারজনকে নির্দেশ দিল যজ্ঞকুন্ডটি ঘিরে আসন করে বসতে।এরপর চোখ বুঁজে সায়নদা একমনে অজ্ঞাত কিছু একটা মন্ত্রের মতো বিড়বিড় করতে করতে যজ্ঞের অগ্নিকুন্ডে আগুন জ্বালিয়ে দিল।অবাক চোখে দেখতে লাগল স্বপ্নীল,আলো আঁধারি সুবিশাল কক্ষের ভিতরে প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের দাউ দাউ অগ্নিশিখার রক্তিম আভা সায়নদার মুখে পড়ে এমন এক থমথমে পরিবেশ তৈরি হল যে ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে আসল সবার হাত পা...মাঘের এই তীব্র ঠান্ডার মধ্যেও ওদের কপালে দেখা দিতে শুরু করল বিন্দু বিন্দু ঘাম। যজ্ঞকুণ্ডের অগ্নিশিখা  ক্রমে যেন বড় বেসামাল হতে আরম্ভ করল।ক্রমে যেন সেটি ঘরের ছাদকে বাগে আনবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল।অগ্নিশিখার এই ভয়ঙ্কর সর্বগ্রাসী রূপ যত বেসামাল হতে থাকল ততই যেন সায়নদার মন্ত্রোচ্চারণের তীব্রতা বাড়তে থাকল।সপ্নীল,পর্ণা,শৈবাল আর তিয়াসা ক্রমে প্রবল উৎকন্ঠায় চেপে ধরে বসল একে অপরের হাত।ক্রমে তারা দেখল ওই রণচন্ডির রূপ ধারণ করা অগ্নিকুন্ডের ভিতর থেকে ক্রমে আবির্ভূত হচ্ছে এক নারীমূর্তি।তার বুকের ডানপাশে একটি ছুরি গাঁথা।সেই ক্ষতস্থান থেকে ঝরণার মতো গড়িয়ে পড়ছে তাজা রক্ত।তার চোখেমুখে এক অব্যক্ত যন্ত্রনার বোবা আকুতি যেন সদ্য পার্থিব বাতাসের স্পর্শ পেয়ে হয়ে উঠেছে আরো উচাটন...। সায়নদা তাকে বেশ রূঢ়কন্ঠে বলল, "তোমার পাপ আজ মুক্তকন্ঠে স্বীকার করো নারী।পৃথিবীর বাতাস আজ শুনবে তোমার কান্না।অনেক যন্ত্রনা এতদিন।আজ তোমার মুক্তি হবে।তুমি বলো।আমরা সকলে শুনব তোমার কথা..." "এই দিনটার জন্যই আমি তিনশো বছর ধরে অপেক্ষা করে রয়েছি।আজ এতযুগ বাদে এই পৃথিবীর বাতাসের সংস্পর্শে আসার পর এইবার আমি বুঝেছি... সত্যিই এবার আমার মুক্তি হওয়ার সময় চলে এসেছে অবশেষে।আজ আমি বলব।স্বীকার করব আমার পাপ যার আগুনে এতকাল ধরে দগ্ধে দগ্ধে মরেছি।আমি ক্ষমাভিক্ষা করব ঈশ্বরের কাছে... কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল আগ্নিকুন্ডের ভিতর হতে আবির্ভূত সেই অপরূপ সুন্দরী নারীর অপার্থিব কায়াখানি।সায়নদা দৃঢ়কন্ঠে বলে উঠল..."কেঁদো না...আজ কাঁদবার সময় নয়।তুমি আজ তোমার সমস্ত যন্ত্রনা হাল্কা করো।আমরা সবাই তোমার কথা শুনব।" ক্রমে কিঞ্চিৎ শান্ত হল নারীমূর্তি।আমরা সবাই বিস্ময় দৃষ্টিতে দেখছিলাম,আর অনুভব করছিলাম মায়াবী  আলোআঁধারির নেশাতুর এক অনির্বাচনীয় আবহের বুকে, ঢিল ছোঁড়া পুকুরের কম্পমান প্রতিবিম্বের ন্যায়ে অগ্নিকুন্ডের মাঝে প্রজ্জ্বলিত সেই অপরূপ সুন্দরী নারীর অপার্থিব উপস্হিতি। ধীরে ধীরে শান্ত হল নারীমূর্তি। ক্লিষ্ট ও মৃদুকন্ঠে সে বলতে শুরু করল। "সে আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগের কথা।লন্ডনের এক অভিজাত পরিবারে আমার জন্ম হয়।জন্ম থেকেই আমি ছিলাম মাতৃহীনা।আমার বারো  বছর বয়সকালে হঠাৎ করেই আমার বাবা দেউলিয়া হয়ে যান এবং আমাকে প্রতিপালনের দায়িত্ব তাঁর এক কন্যাসন্তানকামী বন্ধুকে,যাঁকে আমি আশৈশব কাকা বলে সম্বোধন করতাম,তাঁর হাতে আমাকে সমর্পণ করে আত্মহত্যা করেন ঋণের দায় থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য।সেই থেকে আমি কাকার কন্যাসন্তানের স্হান পাই এবং বেশ আদরে আর সুখে স্বচ্ছন্দেই বেড়ে উঠতে থাকি।রান্নাবান্না,ঘরকন্নার কাজ আমার খুব ছোট থেকেই খুব পছন্দের ছিল।আমি কাকার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতাম আর কাকার বাড়িঘর গোছাতাম নিজের হাতে নিজের ঘর মনে করে।কাকার জন্য চা আর টুকিটাকি জলখাবার বানাতাম।দিন দিব্যি কাটছিল।কাকা ছিলেন বিপত্নীক। ওনার পুত্রসন্তান অ্যাড্রিয়ান ছাড়া এই দুনিয়ায় আর কেউ ছিল না।অ্যাড্রিয়ান ছোট থেকেই খুব শান্ত প্রকৃতির চুপচাপ ধরণের ছেলে ছিল।তার স্বভাবও ছিল অত্যন্ত সুমিষ্ট।আর পাঁচটা দামাল বা দস্যি ছেলেদের মতো দুষ্টুমি অথবা কোনোরকম লম্ফঝম্ফতে ওর কোনোদিনই আগ্রহ ছিল না।একমনে বসে ছবি আঁকতে অথবা গল্পের বই পড়ত।সবাই ওর স্বভাব চরিত্রের প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ ছিল।আমার দিকে তাকাত সে অতীব সংকোচ আর লজ্জা নিয়ে।সেখানে থাকতে থাকতে ক্রমশ আমার মনেখ ওর জন্য মায়া তৈরি হতে থাকল।কাজকর্মের ফাঁকফোকরে আড়াল থেকে ওকে দেখতাম একমনে।যদি দৈবাৎ চোখাচোখি হয়ে যেত আমি একছুটে সেই স্হান পরিত্যাগ করে নিজের ঘরের দরজাখানা সপাটে বন্ধ করে দিয়ে নিজের বুকে হাত দিয়ে অনুভব করতাম আমার শরীর মন উথাল পাথাল করে তোলা সুতীব্র হৃদস্পন্দনের দামামার মতো প্রতিধ্বনি।এইভাবে দিন যাচ্ছিল।ক্রমে একদিন রান্নাঘরে কাকার জন্য চা তৈরি করবার সময় হঠাৎ শুনি একটি ফুলদানি ভাঙার শব্দ।তারপরেই রান্নাঘরে রীতিমতো গজগজ করতে করতে ঢুকে আসল ফাইফরমাশ খাটার জন্য বহাল মেরী।সে রান্নাঘরে এসেই গজগজ করে চিৎকার করতে শুরু করল।"কটা তো মাত্র লোক ঘরে থাকে।একটু কি দেখেশুনে চলা যায় না!আবার আমাকে সব কাজ ফেলে ভাঙ্গা ফুলদানির কাচ পরিষ্কার করতে হবে।যত্তসব!" আমি কিন্তু তখন আবার অনুভব করলাম আমার বুকের ভিতরকার ওই উথালপাথাল বুক ঢিপঢিপ।আমি তক্ষুনি চা টা মেরীকে করতে বলে সাথে সাথে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।চুপিসারে অ্যাড্রিয়ানের ঘরের দরজায় উঁকি দিলাম।দেখলাম,ও জামা থেকে ফুলদানির জল ঝেড়ে পরিষ্কার করছে।এবার ব্যাপারটা আমার কাছে একদম পরিষ্কার হয়ে গেল।রান্নাঘরের দরজার ঠিক পাশেই একটি লম্বাটে টেবিলে রাখা ছিল ফুলদানিটা।মেরীর পায়ের শব্দ পেয়েই অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াহুড়ো করে সেই স্হান পরিত্যাগ করতে গিয়েই এই কান্ড বাঁধিয়েছে অ্যাড্রিয়ান।অর্থাৎ এই দরজার আড়াল হতে নিষ্পলক চোখের এই তীব্র আকুতির ভাগীদার একা আমি নই।একই সুর,একই ছন্দ বইছে বিপরীত প্রান্তেও...এটা অনুভব করে আমার আর খুশির সীমা রইল না।এরপর অ্যাড্রিয়ানের ঘরের দরজার সামনে নিজেকে অপ্রস্তুত রূপে ধরা পড়ে যাওয়ার দ্বিধাটা আর রইল না।এইভাবে ক্রমশ দিন যেতে থাকল।আর এভাবে আমার ঘরেরই দরজার বাইরে এক সন্ধ্যায় আমার অ্যাড্রিয়ানের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল।তারপর আমাদের মধ্যে আর কোনো বাক্য বিনিময়েরই অবকাশ রইল না।পূর্ণিমার চাঁদের স্নিগ্ধ আলোতে আমরা তীব্র আবেগে মূহ্যমান হয়ে একে অপরের তৃষ্ণার্ত ঠোঁটে মিলিয়ে দিলাম অবশিষ্ট সুরটুকু... আমরা দুজনেই ভালোভাবে জানতাম যে কাকামণি যতই আমাকে ভালোবাসুন...আমাকে পুত্রবধূরূপে কিছুতেই মেনে নেবেন না কারণ আমার জাত ছিল আলাদা।উনি আমাকে পালিত কন্যার জায়গা দিয়ে স্নেহ আর ভালোবাসা দিতে কোনো কার্পণ্য করেননি কোনোদিন।কিন্তু আমাকে নিজের পরিবারের সদস্য হিসেবে কোনোদিনই তিনি স্বীকৃতি দেননি।আমাদের এই ব্যাপারটা যদি উনি জানতে পারেন,তাহলে যেকোনোদিনই আমাকে মাথার উপর থেকে আশ্রয় হারাতে হতে পারে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না।এবার আমার ঠিক কি করা উচিত কিছুতেই বুঝে উঠতে না পেরে দিশাহীন হয়ে পড়লাম।ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়লাম।চিন্তান্বিত আমার কাঁধে হাত রেখে তারপর নিজের বুকে আমাকে টেনে নিল অ্যাড্রিয়ান।বলল,আমরা একবার এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে চার্চে বিয়েটা সেরে নিই....আজ নয় কাল বাবা ঠিকই মেনে নেবেন...দেখো...। আমি আশায় বুক বাঁধতে শুরু করলাম।কাকামণির আড়ালে নিজের জামাকাপড় আর অল্প কিছু জিনিসপত্র নিয়ে গোছগাছ শুরু করলাম।এমন সময় ঘটল এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা।অ্যাড্রিয়ানের সৎমা এই পুরো ব্যাপারটা জেনে ফেলেন।উনি আমাদের বাধা দেওয়া তো দূর...আমাদের বাড়ি থেকে পালাতে সাহায্য করেন।চিরকাল উনি অ্যাড্রিয়ানকে যেভাবে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন তা আমার চেয়ে ভালো কেউ দেখেনি।উনি মনে করতেন তাঁর আর কাকামনির সম্পর্কের মাঝখানে কাঁটা হয়ে বিঁধে রয়েছে অ্যাড্রিয়ান। কাকামনি দিনরাত মা মরা ছেলেটার জন্য চিন্তাভাবনা করে আর ওনার দিকে ফিরেও তাকান না এই হল ওনার অভিযোগ।এই কারণে চেয়েও উনি এখনো সন্তানধারণ করতে পারেননি স্রেফ কাকামনির উদাসীনতার জন্য।সেই আক্রোশ নিয়েও আজ তাঁর এমন দিলখোলা ব্যবহার আর আমাদের দুজনকে কাকামনির অজ্ঞাতে বাড়ি থেকে বার হয়ে আসবার ব্যবস্হা করে দেওয়াতে আমরা যে কোনো দুরভিসন্ধির গন্ধ পাইনি তা নয়...তবে অ্যাড্রিয়ান আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল..."তুমি চিন্তা কোরো না।আমার বাবাকে আমি ঠিক মানিয়ে নেব।উনি আড়াল থেকে কোনো কলকাঠি যদি নাড়তেও যান...সফল হবেন না।" আমি ভেবে দেখলাম...অ্যাড্রিয়ান ঠিক কথা বলছে।আমি আর দেরী না করে ওনার এই সহায়তার ষোলোআনা সুযোগ নিয়ে অ্যাড্রিয়ানের হাত ধরে ঘরের বাইরে পা রাখলাম।তারপর আমরা চার্চে গিয়ে বিয়ে করে নিলাম।অ্যাড্রিয়ান ওর বাবার ওপর নির্ভরশীল কোনোকালেই ছিল না।আজও তার নিদর্শন দেখলাম।সে আগে থেকেই বিয়ের পরবর্তী সংসার হিসেবে একটা ছোট্ট বাগানবাড়ি কিনে রেখেছে। আর ভিতরটা কিছু সুন্দর কাঠের আসবাবপত্র কিনে সাজিয়ে রেখেছে।যখন সে আমার হাত ধরে সেই বাড়ির দরজার সামনে এনে সেই বাড়ির চাবি আমার হাতে দিয়ে বলল,"এই নাও... তোমার নিজের সংসারের চাবি যত্ন করে সামলে রেখো।আমার যেন মনে হচ্ছিল...আমার সারাজীবনের সুখের মূর্ছনাগুলি একসঙ্গে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমার এই সুখ বেশিদিন সইল না।ধীরে ধীরে পালটে যেতে থাকল অ্যাড্রিয়ান।প্রতি রাতে তার ভিতরে যেন এক নরপিশাচ জেগে উঠে আমাকে আঁচড়ে কামড়ে ফালাফালা করে নিজের বন্য কামপিপাসা মেটাত।আমি যেন একটা সুডৌল সুস্বাদু মাংসপিন্ড যাকে প্রতিরাতে সে বাজপাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ইচ্ছেমতো ছিঁড়ে খুবলে খেত।অ্যাড্রিয়ানের এই রূপ দেখে প্রতিদিন আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল একটু একটু করে।এরপর ও আরো জানোয়ার হয়ে উঠল।মাঝেমধ্যেই সে হয় বেশ্যার কাছে যেত নয় আমার এই বিছানাতেই বাইরের মেয়ে এনে স্ফূর্তি করত।যে অ্যাড্রিয়ানকে আমি কৈশোর থেকে দেখে আসছি...যার ভালোবাসার পরশে আমি পরম নিশ্চিন্তে আমার জীবনের সুখের রামধনুর প্রতিটি রংকে পরম নিশ্চিন্তে...যত্নে সাজিয়েছিলাম...তার এমন বীভৎস নরপিশাচ রূপ দেখে আমার আতঙ্কে দিশাহারা অবস্থা হয়ে যায় আমার। আমি আমার স্বামীকে প্রাণের থেকেও ভালোবাসতাম।তাকে ভালোবাসার স্পর্শটুকু পাবার জন্য আমার পিয়াসী মনটা উথালপাথাল করত।অথচ রাত্রি হলেই সেই মানুষটাই আমার উপরে পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ত।ওই বিছানায় ফের যাবার কথা ভাবলেই আমার সারা শরীর কাঁপত আতঙ্কে।এমনই এক রাত্রে আমি বিছানায় বসে ছিলাম। আমি জানতাম এটাই আমার প্রতি রাতের ভবিতব্য।আমি অন্য কোথাও লুকিয়ে থাকলেও ও ঠিক আমায় টেনে হিঁচড়ে ফের এই বিছানাতেই ফেলবে ওর বিকৃত লালসা মেটাবার জন্য।আমার যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না।কাকামনির কাছেই বা ফিরতাম কোন মুখ নিয়ে!আমি আমার দুর্বিষহ যন্ত্রনা বুকে চেপে বিছানায় বসে হাহুতাশ করছিলাম আর ভাবছিলাম..."এই অত্যাচার আর তো সহ্য হয় না..." হঠাৎ ঘ্যাঁচ করে দরজা খোলার শব্দ হল।আমি বুঝতে পারলাম অ্যাড্রিয়ান এসেছে।সারা গা আমার ঘাএ ভরে রয়েছে। তার উপরেই আবার আরম্ভ হবে সেই নৃশংসতা! আমি আর পারলাম না।ও আমার কাছে এসে পৌঁছোনোর আগেই আমি টেবিলের ওপর রাখা ফলের ঝুড়ি থেকে ফল কাটার ছুরিটা নিয়ে ওর বুকে বসিয়ে দিলাম। তারপর রুদ্ধশ্বাসে বেরিয়ে আসলাম সেই অভিশপ্ত জীবন থেকে চিরকালের মতো।আমি রক্তাক্ত ছুরিখানা হাতে নিয়ে ডাইনে বায়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে পুলিশের কাছে সোজা গিয়ে আমার অপরাধ কবুল করলাম। আমার বিস্ফারিত দুচোখ থেকে নির্গত বিগত কয়েকদিন ধরে পুঞ্জীভূত হতে থাকা অগ্নিবর্ষণের তীব্রতায় তারাও প্রথমটায় ক্ষণিকের জন্য থমকে যায়।পরক্ষণেই আমি তাদের হাতে গ্রেপ্তার হই।বিচারে আমার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।আমি জেলের একটা অন্ধকার সেলএ একাই থাকতাম।আমার খোঁজ করতে কেউ আসেনি।আমি একাকী ওই অন্ধকূপে পচে মরছিলাম।তবে আমার সেই যন্ত্রণা দীর্ঘ হয়নি।ওই অন্ধকার কুঠুরির মতো দমবন্ধ করা জেলখানার ছোট্ট কামরাতেও অ্যাড্রিয়ান আমার পিছু ছাড়ল না।রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে আমি শুনতে পেতাম কিছু অপার্থিব আকুতির প্রতিধ্বনি।দেওয়াল ফুঁড়ে ,হৃদয়ে সুনামি জাগানো কোনো আকূল আর্তি যেন কিছু বলতে চাইত।এইভাবে কাটতে থাকল আমার প্রত্যেকটি রক্তাক্ত রাত্রি।আমি বুঝতে পারলাম,কেউ ভীষণভাবে আমাকে কিছু বোঝাতে...কিছু বলতে চাইছে।সে আমার খুব আপন...খুব কাছের কেউ। আমি নিজের মনকে শান্ত করলাম।অপার্থিব কন্ঠের সেই  আকুতি শোনার জন্য আমি অবশেষে  খুলে দিলাম আমার মনের জানলা।দেখলাম...ধীরে ধীরে অন্ধকারের বুকে জেগে উঠছে এক উজ্জ্বল ছায়ামূর্তি। অ্যাড্রিয়ান! আমি ভীষণ চমকে সাথে  সাথে কয়েক পা পিছিয়ে গেলাম। আলোআঁধারির শরীর ফুঁড়ে অ্যাড্রিয়ানের ছায়ামূর্তি আকূল দৃষ্টিতে নিষ্পলক তাকিয়ে আমার দিকে।অপরাধবোধ আমায় যেন কন্ঠরোধ করতে উদ্যত হল।আমার দুচোখ বেয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ল কয়েক ফোঁটা জল।হঠাৎ নিস্তব্ধ সেল কাঁপিয়ে প্রতিধ্বনিত হল অ্যাড্রিয়ানের অপার্থিব কন্ঠস্বর।সান্ত্বনার সুরে অ্যাড্রিয়ান বলে উঠল..."দুঃখ কোরো না প্রিয়া...এটাই আমাদের ভবিতব্য ছিল।আমার সৎমা কোনোদিনই আমাকে দেখতে পারতেন না।ওনার ধারণা,আমার জন্য তার কোল এখনো অন্ধকার। তাই তিনি আমার সুখের পথে এমনভাবে সর্বনাশ হানলেন যে আমাদের দুজনের মধ্যেকার সম্পর্ক কদর্যতার অন্ধকারে আচ্ছাদিত হয়ে শেষ পর্যন্ত আমাদের দুজনের এই পরিণতি।" আমি এবার দুচোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম অ্যাড্রিয়ানের ছায়ামূর্তির দিকে। "তুমি ঠিকই শুনেছ"। আবার বলে উঠল সেই অপার্থিব প্রতিধ্বনি। যেদিন আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলাম,আমার সৎমা আমাদের সাহায্য করার ভালোমানুষী দেখিয়ে আমার খাবারে মিশিয়ে দিয়েছিলেন প্রেতসিদ্ধ ঔষধী যা আমার শরীরে ঢোকার পর থেকে আমার ভিতরে পরিবর্তন আসে।আমি আর আমার নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারলাম না।আমি ক্রমশ হয়ে উঠতে থাকলাম  কামপিশাচ নরপশু।ক্রমশ পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকল।আমি ছোটবেলা থেকেই দেখতাম...উনি কালোযাদু আর তন্ত্রসাধনার অধ্যায়নে ব্যস্ত থাকতেন।বাবা ওনার কোনো ব্যাপারেই খুব বেশি মাথা ঘামাতেন না।তিনি নিজের মতো থাকতেন বরাবর...আর তাঁকেও তাঁর জগৎ নিয়ে তাঁর মতো করে থাকতে দিতেন।কিন্তু তিনি যে ভয়ংকর পিশাচ ফোরক্লোরের সাধনা করতেন...সেটা আমি সেইদিন প্রথম বুঝতে পারলাম।যে পিশাচ ভর করেছিল আমার ওপরে...তার শিকার হল শুধু নারী।ওই পিশাচ তার কদর্য কামবাসনার ভয়াল ছোবলে নারীর শরীরকে ভোগ করে ইচ্ছামতো...বিকৃত আস্ফালন নিয়ে শ্বাপদের ন্যায়ে তাদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের লাজ...সম্মান...মনুষ্যত্ব ছিঁড়েখুঁড়ে খায়।যে নারী একবার তার শিকার হয়...আত্মহত্যা ব্যতীত তার সামনে আর কোনো দ্বিতীয় রাস্তা খোলা থাকে না।উনি আমার সর্বনাশ করতে নিজের ওই তন্ত্রসাধনাকেই যে হাতিয়ার করে বসবেন...এ আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।আমি যখন বুঝতে শুরু করি...যে ফোরক্লোরে আমার শিরায় শিরায়...রক্তের প্রতিটি কণায় তার আধিপত্য বিস্তার করে বসে আছে...তখন সবকিছু আমার হাতের বাইরে।আমি যিশুর কাছে হাজার প্রার্থনা করেও আর কোনোমতে আগের অ্যাড্রিয়ান হয়ে ধরা দিতে পারলাম না।আর তোমার ফুলের মতো শরীরের উপর নিজের অপ্রতিরোধ্য কামপিপাসা চরিতার্থ করার জন্য প্রতিরাতে জানোয়ারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তাম।আমাকে ভালোবাসো বলেই শুধু নীরবে এভাবে কুন্ঠিত হরিণীর মতো দিনের পর দিন এই নৃশংস নির্যাতন সহ্য করে গিয়েছ মুখ বুজে।তোমার জায়গায় যদি আমি থাকতাম তাহলে তুমি যেটা করেছ সেটা অনেক আগেই আমি করতাম।আমি তোমায় অপরাধী ভাবি না কারণ আমি জানি আসল অপরাধী কে!আমি শুধু তোমার কাছে একটা আর্জি নিয়ে এসেছি। তুমি যদি আমাকে মন থেকে ক্ষমা করে দিয়ে থাকো তাহলে দয়া করে আমায় মুক্তি দাও...তুমিই পারো আমায় মুক্তি দিতে...। ওর অপার্থিব কন্ঠের সেই কাতর আকুতি শুনে আমি আর স্হির থাকতে পারলাম না।ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম।বললাম..."বিশ্বাস করো প্রিয়...আমি মরে গেলেও তোমার এই পরিণতি কখনো করতাম না।কিন্তু সেদিন রাতে সারা শরীরের ঘায়ের যন্ত্রনা এমন চিড়বিড় করে দগ্ধে উঠেছিল যে আমার বোধবুদ্ধি সবকিছু লোপ পেয়ে প্রায় উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম।আমার জন্য তোমার এই পরিণতি...হা ভগবান...তুমি যা বলবে সেটা আমি নিজের জীবন বাজি রেখে হলেও করব...তুমি শুধু বলো আমি কি করতে পারি যাতে তোমার মুক্তি হয়.... অ্যাড্রিয়ান বলল, "যেদিন তোমার হাতে আমার মৃত্যু হয়...সেদিন তোমার ছুরির আঘাতে আমি বিছানায় শায়িত হয়ে পড়ি আর সেখানেই আমি প্রাণত্যাগ করি।আমার শরীর থেকে রক্তপাত হয়ে আর তা আর সেই শয্যার বাইরে পড়েনি।আমার ওই রক্তের সাথে ওই শয্যায় মিশে গিয়েছে পৈশাচিক অপশক্তি।এখন সে শয্যার রক্তের দাগ ধুয়েমুছে সাফ করা হয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর বাতাসে এখনো সেই অভিশপ্ত সত্ত্বার অস্তিত্ব জীবন্ত রয়ে গিয়েছে।তাই আমি কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছি না।আমি যন্ত্রনায় ছটফট করছি।তুমি যদি কোনোভাবে ওই শয্যাখানি আগুনে পুড়িয়ে নষ্ট করে দাও...তাহলেই আমি এই অসহ্য যন্ত্রনার হাত থেকে রেহাই পেয়ে যাই... হাউ হাউ করে কেঁদে আমার কাছে চাতকের মতো মুক্তিভিক্ষা করতে লাগল অ্যাড্রিয়ান।তখন আমারও অন্তর যেন ভীষণভাবে কেঁদে উঠল।আমি সঙ্গে সঙ্গে অ্যাড্রিয়ানকে কথা দিলাম...তাকে বললাম..."তুমি চিন্তা কোরো না প্রিয়...আমার শরীরে যতক্ষণ প্রাণ আছে...আমি ততক্ষণ তোমার মুক্তির ব্যবস্হা করার চেষ্টা করে যাব...আমি যেখানে যে অবস্হাতেই থাকি না কেন...।দীর্ঘযুগ পরে ফের আমাদের মধ্যে ফিরে এল সেই টান...সেই ভালোবাসা...বিশ্বাস ও ভরসার মধুরতা মাখানো সম্পর্কের চেনা সুর...।কিন্তু হায়...আজ সে আমি কোথায়...আর সে কোথায়...।আমার দুচোখ বেয়ে আকূল বারিধারার স্রোত বয়ে চলল। রাত কেটে ভোর হল।আমি আমার প্রতীজ্ঞার দৃঢ়তায় আমার হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করলাম। আমি ভিতরে ভিতরে জেল থেকে পালাবার পরিকল্পনা ছকতে শুরু করলাম সকলের অগোচরে।ওই শয্যাটিকে যত তাড়াতাড়ি আমি অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করতে পারব...তত তাড়াতাড়ি মুক্তি হবে অ্যাড্রিয়ানের।দীর্ঘ পরিকল্পনা আর চেষ্টার পর...প্রায় মাস ছয়েকের মাথায় আমি জেল থেকে পালানোর সমস্ত আঁটঘাট পাকাপাকিভাবে বেঁধে ফেলি।তুখোড় চাতুরীর নিপুণতা আর কৌশলে আমি জেলের প্রহরীদের চোখে ধূলো দেওয়ার সমস্ত বন্দোবস্ত করে ফেলি এবং যথা সময়ে নিজের প্রাণ হাতের মুঠোয় করে জেলের চৌহদ্দি হতে পালাতে শেষ পর্যন্ত আমি সমর্থ হই।কিন্তু জেলের চৌহদ্দি হতে পালাতে পারলেও শেষ রক্ষা হল না।কারণ আমার পালানোর খুব অল্প ব্যবধানেই জেল কতৃপক্ষ সবটা টের পেয়ে যায় এবং আমার ধরার জন্য শিকারি কুকুরের চেয়েও হিংস্র হয়ে ওঠে।নাঃ...শেষ পর্যন্ত ভাগ্যের কাছে আবার আমি হার মানলাম।পুলিশের লোকেরা পলায়নরত আমাকে লক্ষ্য করে উন্মত্তের মত গুলি ছুঁড়তে থাকে।আমি চিতায় তাড়া করা হরিণীর মতো ছুটতে ছুটতে এটা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম...এদের হাত থেকে আমার আর মুক্তি নেই।আর আমার সামনে পুলিশের গুলি খেয়ে মৃত্যু...নয় আজীবনের জন্য জেলখানার অন্ধকুঠুরির ভিতরে কয়েদ হয়ে পড়া...এর বাইরে আর সমস্ত রাস্তাই আমার জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে।যদি গুলি খেয়ে মরি তো তবুও ভালো...কিন্তু জীবিত অবস্হায় ওদের হাতে ধরা পড়ে বন্দী জীবন কাটাতে হবে অ্যাড্রিয়ানের মুক্তির ব্যবস্হা করতে পুরোপুরি নিরুপায় অবস্হায়...এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারলাম না।আমি নিজের সাথে আনা ধারালো ছুরিটা সজোরে বসিয়ে দিলাম নিজের বুকে।ফিনকি দিয়ে উঠল রক্ত।আমি লুটিয়ে পড়লাম মাটিতে...আর টাটকা রক্তে ভেসে উঠল চারপাশ।অামি যদি আমার কাজটা শেষ করতে পারতাম...তাহ‌লে এই মৃত্যুতে আমার কোনো আপশোষ থাকত না।কিন্তু আমি হেরে গেলাম।অ্যাড্রিয়ানের মুক্তির ব্যবস্হা আমি করে যেতে পারলাম না।আমার এই হাতে অ্যাড্রিয়ানের অকাল মৃত্যু যখন হল,তখন এই হাত দিয়েই ওর অন্তিম ইচ্ছা...ওর মুক্তির ব্যবস্হা যদি করে যেতে পারতাম...তাহলে হয়তো আমার পাপ খানিকটা হলেও লাঘব হওয়ার সম্ভবনা থাকত।কিন্তু আমি নিজে এখন দেহত্যাগ করার পর হতে অ্যাড্রিয়ানকে হত্যার পাপ বয়ে বেড়াচ্ছি দীর্ঘ বছর ধরে।এখন আমিও মুক্তি চাই।এই পাপের বোঝা থেকে মুক্তি চাই।সমস্ত পার্থিব হিসেবনিকেশের পর্ব চিরতরে চুকিয়ে আমি চলে যেতে চাই অনন্ত মুক্তির গন্তব্যে।আমি বড় ক্লান্ত! এতখানি বলে এবার দম নিল সেই বিদেহী আত্মা।সায়নদা এবার একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল..."আমরা ওই শয্যা আগুনে পুড়িয়ে ওর সর্বাঙ্গে জড়িয়ে থাকা পৈশাচিক শক্তির সমস্ত অস্তিত্ব একেবারে মুছে দেব পৃথিবীর বুক থেকে।তাহলেই অ্যাড্রিয়ানের সাথে সাথে মুক্তি পাবে তুমিও।কি...আমি ঠিক বলছি তো?" "হ্যাঁ...হ্যাঁ।আমার তো এই কাজটাই অসম্পূর্ণ ছিল।ওই পৈশাচিক দুরাত্মা এতদিনে না জানি কত ক্ষতি...কত অনিষ্ট করেছে...।তোমরা ওই শয্যা আগুনে পুড়িয়ে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে মুছে দাও ওই অপশক্তির চিহ্ন।অ্যাড্রিয়ানের আত্মা বড়ো যন্ত্রনায় আছে।ওর যন্ত্রনার ইতি টেনে ওকে মুক্তি তোমরাই দিতে পারবে।এটুকু করবে আমার জন্য!বলো...বলো...!" এমন কাতরতাপূর্ণ আকুতি শুনে ওদের সকলেরই হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল।শৈবাল,তিয়াসা,স্বপ্নীল,পর্ণা এবং সায়নদা সবাই মিলে একত্রিত হয়ে তাকে আশ্বস্ত করল...এই যজ্ঞকুণ্ডের আগুনে আজই ওই শয্যা তারা পুড়িয়ে ছাই করে ফেলবে। রাত একেবারে গভীর।বন্ধ দরজার ভিতরে চারটি মানুষ পুরোপুরি হতচকিত আর বিস্মিত।এই রাজকীয় শয্যার সাথে জড়িত ইতিহাস সমস্তটা শুনে ওরা এখন পুরোপুরি নির্বাক।শৈবাল আর তিয়াসা এটা ভালোভাবেই বুঝতে পারছে...কেন স্বপ্নীলের উপরেই এভাবে ভর করেছে দুরাত্মা...যার ফল এইভাবে ভুগতে হয়েছে পর্ণাকে।খাটটা যেদিন থেকে কেনা হয়েছে...তার পর থেকে আজ পর্যন্ত রাতে ওই খাটে একাই শুয়েছে পর্ণা।কারণ এই কদিন শৈবালের নাইট ডিউটি ছিল।তাই জন্যই যে ওই অভিশপ্ত শয্যায় দুজন নারী পুরুষের ওপরে ওই নির্মম পৈশাচিক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আর হয়নি।তাই ওই খাট যে আসলেই অভিশপ্ত,সেটা আজ পর্যন্ত জানার সুযোগটা ওদের হয়ে ওঠেনি ভাগ্যক্রমে।এখন পরবর্তী পদক্ষেপ,ওদের চারজনের কাছেই এখন স্পষ্ট।ওই অভিশপ্ত শয্যাটি চারজনে মিলে ধরাধরি করে ঘরের বাইরে বার করে বাগানে নিয়ে এল।তিয়াসা ভিতর থেকে কেরোসিনের বোতল খুঁজে পেতে বার করে নিয়ে এল।নিস্তব্ধ অমাবস্যার নিঝুম রাতে এই ঝোপজঙ্গলে আর আগাছায় পরিপূর্ণ নির্জনতায়...ঝিঁঝিঁ পোকাদের উল্লাসে চারপাশটা এক আধিভৌতিক গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি হয়েছে।আর দেরি করল না সায়নদা।হাতে কেরোসিনের বোতল নিয়ে ওই অভিশপ্ত শয্যার উপরে ভালো করে ঢেলে ঢেলে একেবারে পুরোটা ভিজিয়ে দিল।আর স্বপ্নীল পকেট থেকে দেশলাই বাক্স বার করে ফস করে একটা কাঠি জ্বেলে তীব্র ঘৃণায় সেটা ফেলে দিল ওই শয্যার ওপরে।ব্যাস...তারপর দাউদাউ করে জ্বলে উঠল আগুন।কাঠপোড়ার চিড়বিড় শব্দে যেন পর্ণা আর স্বপ্নীলের মনের ভিতরে এক অদ্ভুত প্রশান্তির স্পর্শ যেন পালকের উষ্ণ  আদরে পরম তৃপ্তির সুবাস ছড়িয়ে দিচ্ছে নিঃশব্দে।এভাবে কিছু সময় পার হওয়ার পর ক্রমেই সেখানকার বাতাস যেন বিষিয়ে যেতে থাকল একটা বিকট দুর্গন্ধে।যেন বহু বছর ধরে সৎকার না হওয়া কোনো পচন ধরা বিশালাকৃতি নিকৃষ্ট প্রাণী লাশের সৎকারের আগুন পেয়ে যেন একেবারে তেড়েফুঁড়ে উঠেছে।ধোঁয়ার সাথে মিশে গিয়ে বাতাসের কণায় কণায় উগরে দিচ্ছে তার অশুচি সত্ত্বা।তিয়াসা ঘরের ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল বেশ খানিক্ষণ আগেই।শৈবালও আর থাকতে না পেরে বমি চাপতে চাপতে চলে গেল ভিতরে।স্বপ্নীল...পর্ণা আর সায়নদা কিন্তু একেবারে কাঠপুতুলের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সেখানে।স্বপ্নীল অনুভব করতে পারছে...এই বাতাস ভারী করা পৈশাচিক দুর্গন্ধ নির্গমনের সাথে সাথে ওর এই অভিশপ্ত জীবনের যবনিকার পতন হচ্ছে।পর্ণাও  সেটা বুঝতে পারছে ভালোভাবে।আর তার সাথে সাথে ওর হৃদয়ের কোনো গহিন কোণা ফুঁড়ে একটা চাপা ক্রন্দন যেন ধোঁয়ার মতোই ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে যেতে থাকল।আজকের পর স্বপ্নীল অভিশাপের জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে আবার ফিরে যাবে ওর স্বাভাবিক জীবনে।আর পর্ণা নিজেও তাই।অতএব আজকের পর স্বপ্নীলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুটি কথা বলার মতো আর কোনো অজুহাতই অবশিষ্ট নেই ওর সামনে।একটা তীব্র অসহায়তা যেন ক্রমশ দুমড়ে মুচড়ে দিতে আরম্ভ করল পর্ণার অন্তরাত্মা।ওর মনের ভিতরে মনে কিছু কথা...কিছু অনুভূতি তোলপাড় শুরু করে দিল।সামাজিক অর্থে বিয়ে শব্দটির অর্থ কি!একটি নারী আর একটি পুরুষ সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে এক ছাদের তলায় থাকবে...সন্তানের জন্ম দেবে...পরিবার গঠন করে নিজেদের বংশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে...এই তো!আচ্ছা...এই বাঁধাধরা নিয়মের বাইরে যদি কেউ যায়...কেউ তো তাকে হাতকড়া পরিয়ে জেলে ভরে দেবে না...।ও নিজের দুচোখ বন্ধ করে নিল।ওর মনের পর্দায় ফুটে উঠল সুন্দর একটা শান্তির নীড়।ছোট্ট ঘর...একফালি বারান্দা...যেখানে পাতা রয়েছে দুটি আরামকেদারা।সূর্যাস্তের গাঢ় লাল আভায় স্নান করে ওঠা আকাশের নীচে ওই আরামকেদারায় এক কাপ কফি হাতে বসে দুজনে পরস্পরের চোখের তারায় ডুবিয়ে ফেলেছে নিজেদের হৃদয়ের নোঙর।নাই বা থাকল সেখানে শিশুর কলকলানি...নাই বা থাকল তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কোনো নাম চিহ্ন...।এইরকমই একটা জীবন যদি এখন ভাগ্যক্রমে পেয়ে যায় পর্ণা...তাহলে আর ওর জীবনের প্রাপ্তির খাতা একেবারে ভরে যাবে।প্রকৃতির...শরীরের সমস্ত দাবীদাওয়া এক লহমায় ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে এখন ওর  মন শুধুই চিৎকার করে ওকে বলছে...যা...এক্ষুণি স্বপ্নীলের হাতখানা চেপে ধর শক্ত করে যাতে আর সারাজীবনেও এই বাঁধন আলগা না হয়। ছাড়া আর কিছুই যে ওর চাওয়ার নেই...এই কথাটা এখন স্বপ্নীলের সামনে দাঁড়িয়ে নির্লজ্জের মতো কি করে বলবে পর্ণা...!ওর চোখের কোলজুড়ে এমনভাবে জল জমতে থাকল...যে সেটার কারণ হিসেবে আর ধোঁয়ার জ্বালার অজুহাতটা টিকবে না বুঝে পর্ণাও ধীরপায়ে ঘরের ভিতরে চলে গেল। সপ্তাহখানেক পর--- এই ঘটনার কিছুদিন পর হঠাৎই সায়নদার একটা পথ দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তড়িঘড়ি হাসপাতালে ছুটে যায় পর্ণা আর স্বপ্নীল।পরে শৈবাল আর তিয়াসাও আসে।এরপর ক্রমশ স্বপ্নীলের গোটা পরিবার জেনে যায় সায়নদার এই অকস্মাৎ আগমনের ব্যাপারটা।এতটাই খারাপভাবে আহত হয়েছে সায়নদা,যে আপাতত কোনো প্রশ্ন করার কথাটা সবাই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ওকে সুস্থ করার জন্য সবাই মনপ্রাণ দিয়ে সচেষ্ট হল।জ্ঞান ফেরার পর যখন সায়নদা চোখ মেলল...তখন ওর কথা শুনে সকলেই প্রচন্ড অবাক হল।সায়নদার স্মৃতি লোপ পেয়েছে ভীষণভাবে। শিলিগুড়ি থেকে হঠাৎ ও কখন কিভাবে কলকাতা এসেছে ও সেটাই মনে করতে পারছে না এখন।সায়নদার এহেন অবস্থা দেখে সকলেই ভীষণভাবে বিচলিত হয়ে পড়ল।তবে স্বপ্নীলের মনের ভিতরে আরো কিছু খটকা জেগেছিল।ও সায়নদার সাথে আরো কিছুটা কথা বলে এটা পরিষ্কার বুঝতে পারল,সায়নদার মন মস্তিষ্ক থেকে মুছে গিয়েছে ওর জীবনের বেশ কিছু অধ্যায়...।সে এখন মনে করতে পারছে না তার ষোড়শ বর্ষীয় সময়কালে উথলে ওঠা সেই রোখ...সেই জেদের কথা...সকলের অবাধ্য হয়ে ষোলো বছর বয়সে ঘর ছাড়ার কথা...এমনকি কিছুদিন আগে বাগানবাড়ির ভিতরে ঘটে যাওয়া অপশক্তির  নিধনযজ্ঞের ঘটনার সমস্ত স্মৃতি...সমস্ত তন্ত্রবিদ্যাও পুরোপুরি মুছে গিয়েছে সায়নদার মাথা থেকে।স্বপ্নীলের শিড়দাঁড়া দিয়ে যেন একটা শীতল স্রোত নেমে গেল।কারণ ওই অভিশপ্ত শয্যাটি যজ্ঞের আগুনে নিক্ষেপ করার আগে হঠাৎই সেটির পিছনের দিকটায় ইংরেজী অক্ষরে একটা কিছু যে লেখা রয়েছে,সেটা খেয়াল করেছিল এই সায়নদাই।ওটার ওপরে আলো ফেলে স্পষ্টভাবে দেখতে গিয়ে ওরা বুঝতে পারে,যেটি লেখা রয়েছে,সেটা আর কিছুই না...আজকেরই সাল এবং তারিখ।ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।ওটা যে এই অপশক্তির নিধনের ভবিষ্যদ্বানী,এটা বুঝতে আর কারোরই বাকি থাকেনি। এখন স্বপ্নীলের এটা বুঝতে আর কোনো বাকি রইল না...এই অপশক্তির নিধনের কার্য সম্পাদন করাটাই আসলে সায়নদার বিধিলিপি ছিল।বিধাতার লিখন ঠিক যেমন,এই পৃথিবীর কিছু মানুষকে দিয়ে ভাগ্য তেমনভাবেই সেই কার্য সম্পাদন করিয়ে নেয় সকলের অজান্তে এবং অজ্ঞাতে।কথাটা এখন মনেপ্রাণে উপলব্ধি করতে শুরু করল স্বপ্নীল।আর সেইসাথে ও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাল সায়নদাকে একেবারে সুস্হভাবে বাঁচিয়ে তোলার জন্য।হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর সায়নদা কিছুদিন বাড়িতেই বিশ্রাম নিল ভালোভাবে।তারপর শিলিগুড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করল সায়নদা।এই সায়নদা আর আগের সায়নদা নেই।ওর স্বভাব চরিত্রে এসেছে আমূল পরিবর্তন।রওনা দেবার সময়ে একেবারে ধীর এবং শান্ত কন্ঠে হেসে স্বপ্নীলকে আগের মতোই বলে উঠল..."কোনো দরকার হলেই ফোন করিস কিন্তু...আমি চলে আসব।" স্বপ্নীল সায়নদার দুইহাতে চাপ দিয়ে বলল...তুমি সাবধানে থেকো সায়নদা...একা থাকতে ভয় হলেই আমায় ফোন কোরো কিন্তু...।" নিজের ঘরে বসে এখন ব্যাগপত্র গোছাতে ব্যস্ত পর্ণা।কলকাতা ছেড়ে ও পাড়ি দিতে চলেছে ব্যাঙ্গালোরে ওর মাসীর বাড়ি।মেসো মশাইকে বেশ জোর দিয়ে অনুরোধ করার পর তিনি সেখানে পর্ণার জন্য একটা ছোট চাকরির বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন।কলকাতায় নামী কলেজের প্রফেসর হিসেবে নিজের কর্মজীবন অতিবাহিত করে আসা পর্ণা এখন নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে ব্যাঙ্গালোরে ছুটে চলছে একটা সামান্য কেরাণী র চাকরি হাতে নিয়ে।ঘরে আপাতত সে একা রয়েছে এখন।বাইরে এখন রোদ ঝলসানো দুপুর।খোলা জানলায় আসন্ন শরতের পেজা তুলোর মতো মেঘের দিকে তাকিয়ে... দীর্ঘশ্বাস ফেলে পর্ণা ব্যাগ গোছাতে থাকল পর্ণা।কোনোদিন ও ভেবেছিল...ওর জন্মস্থান...এই প্রাণের শহর কলকাতাতেই ওর দমবন্ধ হয়ে আসবে কোনোদিন...একজনের স্মৃতি ওকে এমনভাবে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে...যে টিকে থাকাটাই দুষ্কর হয়ে উঠবে ওর পক্ষে...! না...ও আর মুখ ফুটে কিছুতেই কোনো কথা বলতে পারবে না স্বপ্নীলকে।জাগতিক সমস্তরকম হিসেবের বাইরে ওর হৃদয়ে তোলপাড় করা এই সুনামির ঢেউ বুকের মধ্যে আঁকড়ে নিয়েই ও বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে...এরকমটাই মনস্হির করে নিয়েছে ও।ওর বাবা,মা ছোটবোন সকলেই বারবার করে ওকে বুঝিয়েছে...যাতে সমস্ত অতীত ভুলে পর্ণা আরেকটা বিয়ে করে নিজের জীবনটা সুন্দর করে সাজিয়ে তোলে।কিন্তু যেনতেন প্রকারেণ এভাবে কলকাতা ছাড়বার জন্য কেন যে ও এমন মরিয়া হয়ে উঠল...সেটা হাজার চেষ্টা করেও ওরা বুঝতে পারল না।পর্ণা একেবারে পাকাপাকিভাবে কলকাতার বাইরে কোথাও চাকরি করে বাকি জীবনটা সেখানেই কাটিয়ে দেওয়ার জন্য যেভাবে দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে...তাতে এখন কারোর কোনো প্রশ্ন বা কথাই যে খাটবে না...সেটা বুঝতে পেরে এখন ওকে আর কোনো পরামর্শ দিতে যাওয়া থেকে অবশেষে বিরত হয়েছে সকলেই।ওর জীবন...ও বাঁচুক ওর মনমতো...এখন এমনই চিন্তা মাথায় নিয়ে পর্ণার বাবা মা আর বোন একটু শপিং মলে বেরিয়েছে পর্ণার জন্য কিছু কেনাকাটা করার জন্য।পর্ণা ব্যাগ গোছানো শেষ করে আনমনা হয়ে তাকিয়ে রয়েছে আকাশের দিকে।ঠিক এমন সময়ে কলিং বেলটা যেন তীব্র শব্দ করে বেজে উঠল হঠাৎ।সঙ্গে সঙ্গে হুঁশ ফিরল পর্ণার।কি ব্যাপার!ওরা বেরিয়েছে এক ঘন্টাও তো হয়নি...এর মধ্যেই আবার ফিরে আসল কেন...নিশ্চয়ই বোন মোবাইল অথবা হেডফোনটা ফেলে গিয়েছে আবার।ওর মনের ভিতরের সমস্ত কথা আবেগগুলিকে এক ঝটকায় প্রায় গিলে নিয়ে তারপর সাড়া দিল..."যাই মা..."। স্বপ্নীলের ফটোটিকে সযত্নে ব্যাগের একেবারে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে ও চলে গেল দরজার লক খুলতে। দরজার ওপারে যে কতবড় চমক অপেক্ষা করে রয়েছে...সেটা ও দরজা খোলামাত্র বুঝতে পারল।প্রায় ঝড়ের মতো ঝাঁপিয়ে  পড়ে পর্ণাকে নিজের বুকের ভিতরে জড়িয়ে নিল স্বপ্নীল।আর সজোরে হাতের চাপে বন্ধ করে দিল দরজাটা।পর্ণা এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না।কিন্তু স্বপ্নীল যখন ওকে পরম কাতরতার উষ্ণ আকুতি নিয়ে তীব্রভাবে জড়িয়ে নিয়েছে নিজের বুকে...আর ওর কপাল ভরিয়ে দিচ্ছে ওর ওষ্ঠের উষ্ণ আদরে...তখন সমস্তকিছু ভুলে ওও স্বপ্নীলকে দৃঢ় আকুতিতে আঁকড়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ---কোথায় চলে যাচ্ছ তুমি আমাকে ছেড়ে?কোথাও যাওয়া হবে না তোমার। অভিমান আর অনুরাগ মিশ্রিত কন্ঠে দৃঢ়ভাবে বলে উঠল স্বপ্নীল।তারপর পর্ণাকে পাঁজাকোলা করে নিজের দুই বাহুতে উঠিয়ে নিয়ে সে সজোরে ঝাঁপিয়ে পড়ল গুছিয়ে রাখা সুটকেসের পাশে মখমলে কম্বলের উপর।পর্ণা নিঃশব্দে হারিয়ে যেতে থাকল নিজেকে খুঁজে না পাওয়ার দেশে।স্বপ্নীলের ওই আদর মাখা প্রতিটি স্পর্শে ও অনুভব করতে শুরু করল...এই স্বপ্নীল পুরোপুরি ওর অচেনা।ওর পৌরুষের এমন তীব্র আস্ফালনে মাঝ দরিয়ায় বেসামাল পর্ণা ওকে ক্রমশ নতুন রূপে আবিষ্কার করতে শুরু করল...যে রূপ ও দেখতে চেয়েছিল নিজের স্বামীর ভিতরে।দুটি মানুষের সই সমেত ওই কাগুজে ডিভোর্স পেপার ঘরেরই একটা কোণায় পড়ে রয়েছে আর সেখানেই আজ সংঘটিত হচ্ছে ওদের প্রকৃত ফুলশয্যা।স্বপ্নীল যে শুধু এতদিনের অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছে তাই নয়...ও ওর শরীরে ফিরে পেয়েছে পৌরুষ আর তার তীব্র আস্ফালনে এখন পর্ণার জীবন হতে সমস্ত কালোমেঘ কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সমাপ্ত রশ্মিতা দাস                


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror