আইভরি ফটোফ্রেম
আজ প্রিয়াংশুবাবুর ছোট্ট ফ্ল্যাটটি একেবারে লোকে লোকারণ্য।জন্মদিন উপলক্ষে অফিস কলিগদের জন্য একটা পার্টি দিয়েছেন তিনি।একেবারে এলাহি আয়োজন।হার্ড ড্রিংসের আয়োজনও বাদ রাখেননি তিনি।এমনিতে বেশ শৌখিন মানুষ প্রিয়াংশু বাবু।নিজের প্রতি একটা আলাদা ভালোবাসা রয়েছে তাঁর।যে চাকরি তিনি করেন,তা একজন মধ্যবিত্ত ব্যাচেলর মানুষের জন্য যথেষ্ট। বিশেষ করে যার বয়স অল্প আর যার কেরিয়ার বছর দুয়েক হল আরম্ভ হয়েছে।কিন্তু তাঁর ঠাঁটবাট চলনবলন দেখে মনে হয়...শিশুকাল হতে সোনার চামচ মুখে নিয়ে বড় হওয়া এক ধনী আর ক্লাসি পরিবারের সন্তান তিনি।বাপ কাগজের ঠোঙা বেচে আর মা লোকের বাড়ি ঠিকে কাজ করে যেভাবে যেমন সংসার চালিয়েছেন,সেই সংসারে তাঁর জন্ম ও বড় হওয়া...এ কথা আজ তাকে যে সামনে থেকে চাক্ষুষ করেছে সে এসব কথা একেবারেই বিশ্বাস করবে না।প্রিয়াংশুবাবুর বাবা আজও কাগজের ঠোঙা বেচেন...আর মা আজও লোকের বাড়ি ঠিকে কাজ করেন।সেদিনের সাথে আজকের পার্থক্য হল...সেদিন তাঁরা মুখে রক্ত তুলে পরিশ্রম করতেন শুধুমাত্র সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলার জন্য...আর আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ওই একইভাবে পরিশ্রম করে চলেছেন...স্বামী স্ত্রী দুজনের ভুখা পেটে দুটো ভাতের যোগান দেবার জন্য।আজ তাঁদের রাস্তায় দেখলে হয়তো চিনতেও পারবেন না প্রিয়াংশু বাবু।তবে প্রিয়াংশুবাবুর আজকের এই ঠাঁটবাট পূর্ণ জীবনটা যে শুধুমাত্র তাঁর বাবা মায়ের ত্যাগ ও পরিশ্রমের ফল তা কিন্তু নয়।চিরকালই ধূর্ত প্রিয়াংশুবাবু শুধুমাত্র খোঁজ করে গেছেন এমন মানুষের যাদের মাথায় বাড়ি মেরে নিজের আখের গুছিয়ে নিতে পারবেন।জন্মলগ্নেই অপার স্নেহপরায়ণ বাবা ও মা কে সামনে পেয়ে যাওয়ায় ওনার প্রথম টার্গেট বানিয়েছিলেন তাঁদেরকেই।তাঁদের যাবতীয় স্নেহ...ভালোবাসা...মায়া...মমতা সমস্তকিছুকে শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ হেতু ব্যবহার করে নিয়ে পরিশেষে সেইসবের অসাড় অস্হিটুকুকে পর্যন্ত ছিবড়ে করে দুই পায়ে দলে,তাঁদের জন্য নিজের মনে অকাল চিতা জ্বালিয়ে তাঁদের শেষকৃত্য সম্পন্ন করে তিনি চলে এসেছিলেন তাঁর প্রথম প্রেমিকার কাছে...যে ছিল একজন শিল্পপতির কন্যা।মাতৃহারা মেয়েটিকে অতি ধূর্ততার সাথে নিজের প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে তার প্রতিপত্তিশালী পিতার সামনে পর্যন্ত পৌঁছোনোর রাস্তাটা বেশ অল্পদিনের মধ্যেই করে ফেলেছিলেন তিনি।মেয়েটির বাবা যত বড় শিল্পপতিই হোন না কেন...নিজের মেয়ের সুখের কাছেই তাঁর একমাত্র দুর্বলতা।কাজেই অনাথ বলে পরিচয় দেওয়া ছেলেটিকে সেদিন নিজে দায়িত্ব নিয়ে চাকরি দিয়ে প্রিয়াংশু বাবুর পায়ের তলায় একটা মাটি দিলেন।আর সেটা পাওয়ামাত্র প্রিয়াংশুবাবুও সেটিকে একটি কংক্রিটের পাকা সড়ক তৈরি করে ফেললেন।তারপর মেয়েটির যাবতীয় আশা আর স্বপ্নের দরজায় লাথি দিয়ে...ওনার জীবন গড়ে দেওয়ার সমস্ত দায়ভার কাঁধে তুলে নিয়ে নিজের একমাত্র মেয়ের জীবনের সুখের জন্য ভিক্ষাপাত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক মানুষটির সামনে নিজের বেইমানির চূড়ান্ত নিদর্শন রেখে দিয়ে... একটা ভালো চাকরি নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন প্রিয়াংশু বাবু।চাকরির মাইনে মোটামুটি হলেও...বেশ অল্পদিনের মধ্যেই ঘুষের টাকায় একটা ছোট ফ্ল্যাট আর একটা চারচাকা কিনে ফেললেন।প্রিয়াংশুবাবু।আর সাথে সাথে নিজের জীবনটাকে টুকিটাকি শৌখিনতা আর বিলাসিতা দিয়ে সাজাতে শুরু করলেন তিনি।জীবনের শুরুটা এভাবেই বেশ চমৎকারভাবেই অতিবাহিত হচ্ছিল।বস্তুত...শুধুমাত্র লোক ঠকিয়ে...মানুষের সাথে বেইমানি করেই কত সহজে তরতর করে উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে জীবনে ওপরে ওঠা যায়...এটা ভেবেই এক ধরণের অপার সুখ ও তৃপ্তি অনুভব করেন তিনি।নিজেকে যে তিনি ভীষণ ভালোবাসেন..
এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।প্রতি বছর জন্মদিনটা দারুণ ধূমধাম করে উদযাপন করেন তিনি।তাঁকে পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান তিনি।তারপর গোটা দিনটা দারুণ উৎসবের মেজাজ নিয়ে কাটান প্রিয়াংশুবাবু।আজ তাঁর বত্রিশতম জন্মদিন।ডেকরেটর ডেকে ছোট ফ্ল্যাটটিকে বেশ সুন্দর করে সাজিয়েছেন তিনি।ছাদে ক্যাটারিং কোম্পানি থেকে আসা রান্নার লোকেরা এখন রান্নায় ব্যস্ত।আর সকাল থেকেই দরজায় পরপর কলিং বেলের শব্দে স্হির হয়ে একটু বসবার উপায় নেই।একটার পর একটা উপহারের পার্সেল আসছে তো আসছেই।মোটামুটি একটু বেলার দিকে পার্সেল আসাটা বন্ধ হয়েছে।অর্থাৎ উপহার যা আসবার,তা এসে গিয়েছে। প্রিয়াংশুবাবুর স্নান হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই।আর পার্টি শুরু হবে বিকেল সন্ধ্যার দিকে।অতএব এখন বেশ খানিকটা সময় ফাঁকাই কাটবে।উনি ইচ্ছা করলে কোথাও হতে একটু ঘুরেও আসতে পারেন।কিন্তু না...এখন এই রোদে বেরোনোর কোনো মানেই হয় না।তার চাইতে বসে বসে উপহারগুলো আনপ্যাক করা যাক...।যেমন ভাবা তেমন কাজ।রঙচঙে রাঙতা মোড়া উপহারের প্যাকেটগুলো বেশ আয়েশ করে বসে খুলতে শুরু করলেন প্রিয়াংশু বাবু।তাঁর চারপাশের স্বার্থান্বেষী মানুষজনের সমস্ত তোষামোদগুলি এখন নিজের বিছানায় জড়ো করে বসে নিজেকে মহাসুখী ভাবতে তাঁর বেশ ভালোই লাগছে।একটা একটা করে উপহারের প্যাকেট খুলতে লাগলেন তিনি।হাতঘড়ি, দামী পারফিউম...ঘর সাজানোর শোপিস...এইসব শৌখিন জিনিসের ভীড়ে হঠাৎ একটা জিনিসে তাঁর ভীষণভাবে চোখ আটকে গেল। অপূর্ব সুন্দর একটা সাদা রঙের আইভরি ফটোফ্রেম।
এত সুন্দর কারুকার্যখচিত ফটোফ্রেমটা একেবারে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন প্রিয়াংশুবাবু।ফটোফ্রেটার চারপাশে,একটা ভয়ঙ্কর হিংস্র নেকড়ের মতো কোনো একটা প্রাণীর শাণিত দাঁতযুক্ত হাঁয়ের ভিতরের চৌকোণা জায়গা জুড়ে রয়েছে ফটো রাখবার জায়গা।চট করে দেখলেই যেন বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে।কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্যি...ওই হিংস্র ও ক্ষুধার্ত জন্তুর অবয়বে গড়া এই ফটোফ্রেমটির কারুকার্য এত সুন্দর আর রাজকীয়...যে শুধু এটার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।এর ভিতরে ফটো রাখবার জন্য যে জায়গা রয়েছে সেটা ফাঁকা নয়।ওই জায়গাতে রয়েছে এমন একটা ছবি...যেটায় শুধুমাত্র আলকাতরার মতো কালো রঙ ছাড়া আর কোনোকিছুই তেমন স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে না।ওই কালো রঙের ছবিটার ভিতরে একেবারে আবছা একটুখানি সাদা রঙএর আভা রয়েছে।সব মিলিয়ে এমন একটা অদ্ভুত ছবি সমেত এমন একখানা অদ্ভুত ফটোফ্রেমখানি হাতে পাওয়া অব্দি প্রিয়াংশুবাবুর মনের ভিতরে চলতে থাকা প্রশ্নসূচক বিস্ময় যেন তাঁর চোখেমুখে ফুটে উঠল।এমন অদ্ভুত উপহার তাঁকে কে পাঠাল আর কেনই বা!উপহারের প্যাকেটের গায়ে উপহার প্রেরকের নাম খুঁজতে গেলেন তিনি...কিন্তু বৃথা চেষ্টা।গাদা গাদা উপহারের ভীড়ের ভিতর অনায়াসে মিশে ছিল এই রঙিন কাগজে মোড়া ফটোফ্রেমটি...যেটি প্রিয়াংশুবাবুর সমস্ত মনোযোগ আকর্ষণ করে তাঁর দুইহাতের তালুতে বিরাজ করছে।উপহারখানি যেই পাঠিয়ে থাক না কেন...এ বড় সুন্দর।মনে মনে তিনি এই উপহার প্রেরককে ধন্যবাদ জানালেন আর তারপর ওনার বেডসাইড টেবিলে টেবিল ল্যাম্পের পাশটাতে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখে দিলেন।ঠিক করলেন...পরে নিজের সুন্দর দেখে একখানি ছবি এই ফটোফ্রেমটায় ভরে রাখবেন।যথা সময় জন্মদিনের পার্টির সময় হয়ে গেল।প্রিয়াংশুবাবুর সমস্ত বন্ধুবান্ধবরা একে একে আসতে শুরু করল।তারপর উদ্দাম বিদেশী গানের বিটসের তালে তালে শুরু হল নাচ।শ্যাম্পেনের বোতলগুলির মুখে ছুটল ফোয়ারা।মদের নেশায় চূর হয়ে সবাই স্ফূর্তির তালে তালে একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়তে লাগল।খানাপিনা আর আনন্দ স্ফুর্তির এই পর্ব শেষ হতে হতে প্রায় রাত দুটো বাজল।তারপর সব একে একে ঢেঁকুর তুলে নেশায় ঢলতে ঢলতে প্রিয়াংশু বাবুর কাছ থেকে বিদায় নিল।সবাইকে শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় দিয়ে নেশায় চূর হয়ে থাকা প্রিয়াংশুবাবু নিজের বেডরুম পর্যন্তই পৌঁছোতে পারলেন না।দরজার সামনেই সোফায় ঢলে পড়ে একেবারে ঘুমিয়ে গেলেন পরদিন প্রায় সকাল দশটা নাগাদ ঘুম ভাঙল প্রিয়াংশু বাবুর।আর ঘুম ভাঙ্গার পরে চোখ কচলাবার আগে তাঁর হঠাৎই মনে ভেসে উঠল ওই ফটোফ্রেমটির ছবি।প্রায় সাথে সাথে যেন তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন প্রিয়াংশু বাবু।প্রায় একছুটে বেডরুমে ঢুকে বিছানার পাশের টেবিল থেকে প্রায় ছোঁ মেরে হাতে তুলে নিলেন ফটোফ্রেমখানি।যাক...জানলা দিয়ে বয়ে আসা বাতাসের ধাক্কায় এটা টেবিল থেকে নীচে পড়ে যায়নি।একেবারে অক্ষত রয়েছে।একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি।আর সাথে সাথে ঠিক করে নিলেন...এটাকে সবসময়ে নিজের কাছাকাছি রাখবেন ঠিকই...তবে আর ওই বেড সাইড টেবিলের ওপরে নয়...একেবারে বিছানার মাথার কাছের তাকএ।এত সুন্দর ধবধবে সাদা কারুকার্যখচিত জিনিসটা এভাবে বাইরে থাকায় এক রাতেই যেন অল্প ধূলো পড়ে কিঞ্চিৎ মলিন হয়ে গিয়েছে...।প্রিয়াংশুবাবু দরজার পিছনে ঝুলিয়ে রাখা তাঁর রোজকার ব্যবহারের জিন্সের প্যান্টের পকেটের ভিতর থেকে নিজের রুমালখানি বার করে নিয়ে এসে ভালো করে ফটোফ্রেমটা মুছে নিলেন।মুছতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন একটা অদ্ভুত জিনিস।ফটোফ্রেমের ভিতরের ওই কালো ছবিটার ভিতরে যে ছোট্ট সাদা ছোপটা তিনি কাল দেখেছিলেন...ওটা আজ সকালে দিনের আলোতে সামান্য বড় লাগছে না কি!এমন সময়ে হঠাৎ সজোরে বেজে উঠল কলিং বেল।কাজের মাসি এল বোধহয়...।রবিবার হলেই কাজের মাসিটা দেরি করে আসে আর এটা ওটা বাহানা দেয়।সাথে সাথে এই সমস্তকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সেটি ফের সযত্নে তাকএ রেখে দিয়ে কাজের মাসির উদ্দেশ্যে গজগজ করতে করতে দরজা খুলতে গেলেন প্রিয়াংশু বাবু।
প্রিয়াংশু বাবু ওই ফটোফ্রেমটা থেকে ওই কালো রংএর ফটোটা খুলে সরিয়ে...ওখানে নিজের একটা সুন্দর ছবি লাগিয়ে দিয়েছেন।এত সুন্দর একখানা জিনিস পেয়ে মনটা ভারি খুশি আর ফুরফুরে হয়ে উঠেছে প্রিয়াংশু বাবুর।তাঁর মনে হচ্ছে...তিনি যেন কোনো দুষ্প্রাপ্য অ্যান্টিক জিনিস নিলামে জিতে ঘরে এনেছেন। নিজের বিছানার পাশের টেবিলে নিজের এতটাই কাছে সেটাকে রেখেছেন তিনি...যে ঘুম থেকে চোখ মেললেই তাঁর দৃষ্টি সোজা চলে যায় ওই ফটোফ্রেমেরই দিকে।এছাড়া,ঘরে সমস্ত ধরণের ফাইফরমাশ খাটার জন্য কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজে নিয়মিত কাপড় দিয়ে মুছে সেটিকে পরিষ্কার করেন।ঘরে তাঁর শৌখিন জিনিসপত্রের অভাব নেই।কিন্তু তা সত্ত্বেও এই ফটোফ্রেমটির প্রতি একটা বিশেষ ভালোবাসা জন্মে গিয়েছে প্রিয়াংশু বাবুর।জন্মদিনে পাওয়া সমস্ত উপহারের মধ্যে এটাই যে তাঁর শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি,সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।জনে জনে সমস্ত পরিচিতদের ফোন করে জিজ্ঞেস করে ওই ফটোফ্রেমটা তাদের মধ্যে কে তাঁকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে সেটা জানার চেষ্টা করলেন প্রিয়াংশুবাবু।এত সুন্দর একটা জিনিস যে তাকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেে তার তো একটা ধন্যবাদ অবশ্য করেই প্রাপ্য। কিন্তু না।এই উপহার কে তাকে পাঠিয়েছে,সেটা তিনি বার করতে পারলেন না।জন্মদিনের দিন তাড়াহুড়োয় কলিং বেলে শব্দ শুনেই তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে সই করে পার্সেল তো হাতে নিলেন...কিন্তু এখন তার মনে আবছা একটা ছবি ভেসে উঠল...যে তাঁকে এই পার্সেল দিতে এসেছিল...সে এমনভাবে আপাদমস্তক একটা কালো কাপড়ে নিজেকে ঢেকে রেখেছিল...যে তার মুখ দেখাই যাচ্ছিল না বলতে গেলে।না...সেদিন তিনি পার্সেল যে হাতে করে দিতে এসেছে,তার দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করেননি।কিন্তু এখন হঠাৎ তাঁর মনে যখন সেই কালো কাপড়ে আবৃত রহস্যময় অবয়বের আবছা ছবি ভেসে উঠল...তখন কোনো এক অজানা শিহরণে তাঁর বুকের ভিতরে একটা মৃদু আলোড়ন হল।তবে সেদিনকার মতো আজও আর পার্সেল কার হাতে কিভাবে এসেছে সেটা নিয়ে আর সাত পাঁচ ভেবে সময় নষ্ট করলেন না তিনি।এমন সুন্দর একটা জিনিস তাঁর হাতে যে কোনোভাবে এসেছে সেটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।তিনি তাঁর রোজকার জীবন নিয়ে ফের ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।ইতিমধ্যে অফিসের একটা জরুরী কাজের সূত্রে হঠাৎ দিনকয়েকের জন্য অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে আরম্ভ করলেন তিনি।ফ্লাইটের টিকিট থেকে শুরু করে সেখানে থাকা খাওয়া সবকিছু পরিষেবা অফিস থেকেই দেওয়া হবে তাঁকে।প্রিয়াংশুবাবু এই প্রথম পা রাখবেন বিদেশে।বেশ খুশিমনেই তিনি যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন।প্রয়োজনের জিনিসপত্রের সঙ্গে ফটোফ্রেমটাও ব্যাগের ভিতরে রেখে নিলেন সযত্নে। অল্পদিনের মধ্যেই টিকিট ও সমস্ত ব্যবস্হাপনা হয়ে গেল।ব্যাগপত্র গুছিয়ে অস্ট্রেলিয়ার গন্তব্যে তিনি পা রাখলেন এয়ারপোর্টে।
দৃশ্য দুই
অস্ট্রেলিয়া থেকে ফেরার পর থেকেই প্রিয়াংশুবাবুর চেনাপরিচিত সবাই লক্ষ্য করল,এক অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে প্রিয়াংশুবাবুর ভিতরে।ওনার কথাবার্তা...চালচলন...স্বভাব চরিত্র হয়েছে ভদ্রসভ্য আর শান্ত।শুধু তাই নয়...কেমন একটা গুম মেরে গিয়েছেন তিনি।সবসময় মনমরা থাকেন আর কি যেন ভাবেন।হাসিঠাট্টা আর অশালীন স্ফূর্তি রসিকতা করা উগ্র আর রগচটা স্বভাবের মানুষটার অন্যমনস্কতা এখন তার আকাশের দিকে উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা দুই চোখের সামনে হাতে তুড়ি বাজিয়ে ভাঙাতে হয় ওনার বন্ধু আর সহকর্মীদের।দিনে দিনে ব্যাপারটা সকলের মধ্যেই বেশ বিস্ময় জাগিয়ে তুলল।যত দিন যেতে থাকল...ততই যেন ধীরে ধীরে প্রিয়াংশুবাবু যেন ভীষণভাবে গুটিয়ে যেতে থাকলেন।যেন মনের ভিতর চেপে রাখা ভয়ংকর কোনো তুফান চেপে রেখেছেন তিনি প্রবল কষ্টে।ওনার চোখেমুখে সেই যন্ত্রনাক্লিষ্ট কালো মেঘের ছায়া ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যেতে থাকল চারদিকে।ক্রমশ তাঁর আচার আচরণ আর স্বভাব চরিত্রে দেখা দিতে শুরু করল অস্বাভাবিকতা।কাজেকর্মেও তার প্রভাব পড়তে শুরু করল ভীষণভাবে।সবাই এবার বলাবলি করতে শুরু করল...প্রিয়াংশুবাবুর মাথায় গুরুতর গোলযোগ দেখা দিয়েছে।যত দ্রুত সম্ভব তাঁর এখন সাইকোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া দরকার।
প্রিয়াংশুবাবুর সমস্ত বন্ধুবান্ধব আর চেনাপরিচিত মানুষজনেরা এখন এক বাক্যে একমত...এই প্রিয়াংশু বাবুকে তাঁরা কেউই চেনেন না।মাত্র কয়েকদিনের ভিতরেই এতখানি বদলে গেছেন তিনি...যে শুধুমাত্র মুখের আদলটুকু না থাকলে উনিই যে প্রিয়াংশু বাবু...এটা কাউকেই বিশ্বাস করানো যেত না।অস্বাভাবিক আচরণ তো তাঁর মধ্যে বেশ ভালোরকমই দেখা দিয়েছে।এর সাথে তার কথাবার্তা...চালচলন...আচার আচরণ দিন দিন সকলের চোখে এতখানি অজানা অচেনা হয়ে উঠছে...যে এখন তাঁকে নিয়ে তাঁর চারপাশের সমস্ত মানুষজনের মধ্যে উদ্রেক হয়েছে কৌতূহলের।শুরু হয়েছে এক চাপা ফিসফিসানি।এই আনকোরা নতুন অচেনা মানুষটাকে দেখে প্রত্যেকের ভিতরে একটাই কথা বাজছে...আসল প্রিয়াংশু বাবু কোথায় হারিয়ে গেল!এ কাকে দেখছি আমরা!
বেশ কিছুদিন কাটল...।কাজেকর্মে তুমুল ভুল আর অসংগতি দেখা দেওয়ায় প্রিয়াংশু বাবু এবার হারিয়ে বসলেন তাঁর চাকরিটাই।বেকার হয়ে ঘরে বসে রয়েছেন সপ্তাহখানেক হতে চলল।তাঁর সব বন্ধুবান্ধব আর চেনাপরিচিত মানুষজনেরা এখন তাঁকে এড়িয়ে চলে।কেউ কেউ হাসিঠাট্টাও করতে আরম্ভ করেছে ইদানীং।যাদের নিজের আপন ভাবতেন প্রিয়াংশু বাবু...ভালো সময়ে যাদের নিয়ে মদের গ্লাস হাতে স্ফুর্তির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিতেন...তাদের কেউই যে প্রকৃতপক্ষে তার শুভাকাঙ্ক্ষী বা আপন নয়...এবার সেই চিত্রটাই স্পষ্ট হয়ে উঠছে একটু একটু করে।
তাঁর বিভিন্ন অসংগতিপূর্ণ কথার মধ্যে এখন একটা কথা বার বার শোনে তাঁরা।নিজের মাথার চুল দুইহাতে ছেঁড়ার উপক্রম করে তিনি বারবার বলে ওঠেন..."সবার সামনে আমার ফাঁসির সাজা হওয়া উচিত।আমি একমাত্র ওইটারই যোগ্য।"
সবাই তাচ্ছিল্যপূর্ণ সুরে বলে ওঠে..."মাথাটা পুরোপুরিই গেছে।একটা চিকিৎসার দরকার এখন।"
এখন গোটা দুনিয়া এক দিকে আর প্রিয়াংশু বাবু একা হয়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো নিজের ফ্ল্যাটের একটা কোণায় পড়ে থাকেন জঞ্জালের মতো।কাজের মাসীটা কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছে বেশ কয়েকদিন হল।কি করেই বা থাকবে!ওই বদ্ধ উন্মাদের ছন্নছাড়া ঘরে কাজ করার মতো কোনো উপায় বা তার প্রয়োজনীয়তা কোনোটাই আর নেই।আর তাকে মাইনে দেবার লোকটিই এখন সম্পূর্ণ অপ্রকৃতিস্হ।কাজেই এখন ফাঁকা ফ্ল্যাটের ভিতরে সম্পূর্ণ একাই পড়ে রয়েছেন প্রিয়াংশু বাবু।কি খাচ্ছেন...কোথায় শুচ্ছেন...তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।এখন তাঁর না আছে কোনো অতীত....না আছে কোনো বর্তমান...আর না আছে কোনো ভবিষ্যত।এখন প্রিয়াংশু বাবুর রাস্তায় রাস্তায় ভবঘুরে হয়ে ঘোরার দিন যে আর বেশি দূরে নয়,এ কথা পরিষ্কার বুঝতে পারছেন সকলে।
দৃশ্য তিন
ঝড়জলের রাত।রাত হয়ে এসেছে।আকাশ যেন তার সবটুকু আক্রোশ তীব্রভাবে ঢালতে হয়ে উঠেছে বেপরোয়া উন্মাদ।রাস্তাঘাট একেবারে শুনশান।সমস্ত ঘরে ঘরে দরজা জানলা সব বন্ধ।খুব প্রয়োজন পড়লেও ঘর থেকে বেরোনোর কথা ভাবলেই এখন আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে মানুষজন।এহেন সময়ে,এমন বেপরোয়া দামাল ঝড়ের থেকেও দশগুণ বেপরোয়া হয়ে,হাতে কোনোরকম ছাতা না নিয়ে বা গায়ে কোনো বর্ষাতি না নিয়ে দুর্বার গতিতে হনহন করে হেঁটে চলেছেন।বৃষ্টির জলের সাথে যদিও মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে তাঁর চোখের জল।তা সত্ত্বেও,সেই সময়ে যদি তাঁকে কেউ সামনে থেকে দেখত,তাহলে সে বুঝতে পারত...একটা কোনো অপ্রতিরোধ্য দুর্দম যন্ত্রনার লেলিহান আগুন আঁচে প্রতিটা মূহুর্তে কি সাংঘাতিকভাবে দগ্ধ হয়ে চলেছেন তিনি।তার এই দুর্বার গতি যেখানে গিয়ে থামল...সেটি হল সেখানকার স্হানীয় পুলিশ স্টেশনের গেট।অমানুষিক শক্তি প্রয়োগ করে সেখানকার দাররক্ষীদের উড়ন্ত বাজপাখির ন্যায়ে নিজের পথ থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে উন্মাদের মতো ছুটে গিয়ে একেবারে সেখানকার কর্মরত থানার বড়বাবুর সামনে গিয়ে একেবারে তার টেবিলের সামনের চেয়ারটা টেনে ধপ করে বসে কুকুরের মতো হাঁপাতে লাগলেন প্রিয়াংশু বাবু।এহেন অপ্রত্যাশিতভাবে থানার একেবারে ভিতরে এমনভাবে এই আগন্তুকের আগমনে ক্ষণিকের জন্য সেখানকার কর্মরত বড়বাবুও বেশ খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন।নির্বাক বড়বাবু বিস্মিত ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন আগন্তুকের দিকে।একটু দম নিয়ে প্রিয়াংশু বাবু ভগ্ন কন্ঠে বলে উঠলেন..."বড়বাবু...আমি তিন তিনটে খুন করেছি।আজ আমি থানায় এসেছি সবকিছু স্বীকার করার জন্য।
তীব্র ঝড়জলের সে রাত্রে থানার ভিতরে পুলিশের সামনে বসে প্রিয়াংশু বাবুর নিঃশর্ত স্বীকারোক্তি পর্ব শুরু হল,যা দাগী ক্রিমিনাল-খুনিদের শায়েস্তা করে এতখানি জীবন পার করে আসা এই দুঁদে পুলিশ অফিসার আর কনস্টেবলদের কপালেও এই ঝড়জলের রাতে বিন্দু বিন্দু শিশিরফোঁটাসদৃশ ঘামের বিন্দু উৎপন্ন করল।
প্রিয়াংশু বাবুর চারপাশ এখন পুলিশ ঘিরে রয়েছে।আরো এক গ্লাস জল খেয়ে নিয়ে এবার ঠান্ডা স্বরে বলতে শুরু করলেন প্রিয়াংশু বাবু।
"মোটামুটি বছর চারেক আগে শুধু একখানা ছোট ব্রিফকেস সম্বল করে আমি একা পা রেখেছিলাম এই কলকাতা শহরে।ধারদেনা করে এর তার হাতেপায়ে ধরে বাবা আমাকে গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ করিয়েছিলেন বটে...কিন্তু টেনেটুনে স্নাতক একটা ছেলের পক্ষে এই প্রতিযোগিতার বাজারে একটা চাকরি যোগাড় করা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছিল।এক বন্ধুর মারফৎ কলকাতার একটা ছোট কোম্পানীতে একটা মেকানিকের কাজ যোগাড় করেছিলাম অতি কষ্টে।এরপর এই এত বড় শহরে আমি পুরোপুরি একা থাকতাম...কাজ করতাম।আমার মন শুধু বলত...কেউ যদি এসে আমাকে সমস্ত সুযোগ সুবিধা একেবারে হাতের মুঠোয় গুঁজে দিত...তাহলে কত ভালোই না হত...!আমার এই ভাবনা কিন্তু খুব বেশিদিন অতৃপ্ত থাকেনি।কারণ আমার এই সুযোগ সন্ধানী চোখ খুঁজে পেয়ে যায় একটি নদীর জলের মতো কল্লোলিনী অথচ স্বচ্ছ...সুন্দর এক বিশ বর্ষীয়া মেয়েকে।যাকে আমি প্রতিদিন কাজে বেরোনোর সময়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত জরিপ করতাম দু চোখ ভরে।নানা ঘাটের জল খেয়ে আসা এই আমার চোখ...মেয়েটির জমকালো দামী পোশাক আর সাজসজ্জার আড়ালে লুকিয়ে থাকা চাপা যন্ত্রনার অস্তিত্ব ঠিকই পড়ে নিয়েছিল।দামী গাড়ি থেকে ও যখন নামত তখন চারপাশের মানুষজন ওকে দেখে যখন সেলাম ঠুকত...তখন আমি সানগ্লাসের তলায় ঢাকা ওর শিশুর মতো নিষ্পাপ আর যন্ত্রনাক্লিষ্ট চোখদুটিকে আমার পাখির চোখ বানালাম আর সেইমতো আমার দাবার ঘুঁটি সাজাতে শুরু করলাম।আমি খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি...বিশবর্ষীয়া তারুণ্যে যৌবনবতী এই মেয়েটির নাম বৃষ্টি।একেবারে শিশুকালেই এই মেয়েটি তার মা কে হারিয়েছে।তারপর থেকে ও আয়া আর কাজের লোকেদের হাতেই প্রতিপালিত।ওর বাবা কলকাতা শহরের বড়ো শিল্পপতিদের মধ্যে একজন।তিনি এতটাই ব্যস্ত মানুষ যে মাসের পর মাস...বছরের পর বছর মেয়ের মুখের দিকে তাকানোর পর্যন্ত সময় পান না।এতবড় শিল্পপতির মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও সে একেবারেই মাটির মানুষ আর ভীষণ সহজ সরল...এবং সৎ চরিত্রের মেয়ে।কোনোরকম জটিলতা কুটিলতা...মিথ্যাচার করা...নিজের সুবিধা গুছিয়ে নেওয়ার জন্য অন্যকে ঠকানো...এইসব ওর একেবারেই আসত না।বরং সব সময় সকলের জন্য ও হাজির থাকত খোলামনে।তাই মানুষজন ওকে সস্তা আর সহজলভ্য ভাবে।নিজের কাজ গুছিয়ে নিত আর ওকে ব্যবহার করত।কিন্তু আন্তরিক ব্যবহার ও কারোর কাছ থেকেই পেত না।তাই ওর বন্ধুবান্ধবও প্রায় ছিল না বললেই চলে।একেবারেই সঙ্গীহীন একাকী জীবন পার করত হাতে পেন আর কবিতার খাতা নিয়ে।যখন ওকে প্রথম দেখি...তখন ওর কলেজের পরীক্ষা ছিল বলে গাড়ি করে আসত।এরপর থেকে দেখি...ও পায়ে হেঁটেই কলেজের ক্লাস করতে আসছে।ব্যাস...আমার পরবর্তী পদক্ষেপ স্হির করে নিয়ে আমি পরে নিলাম একটি মুখোশ।একজন দিলখোলা এবং সহৃদয় নিঃস্বার্থ প্রেমিকের মুখোশ।না দেখতে পাওয়ার ভান করে একবার জোরে একটা ধাক্কা খেলাম ওর সঙ্গে আর তারপর দু কান ধরে ক্ষমাটমা চেয়ে ওর মাটিতে পড়ে যাওয়া ঝোলাখানি সযত্নে হাতে তুলে ধূলো ঝেড়ে ওর হাতে দেওয়ার মাধ্যমে কথা শুরু হল...আর খুব অল্পদিনের মধ্যেই সেই দৃষ্টি বিনিময় উথালপাথাল প্রেমে পরিণত হয়ে গেল অচিরেই।আমি হয়ে উঠলাম ওর কথা বলার সাথী...ওর আস্হা...ভরসা...আর বিশ্বাসের একটা শক্তিশালী জায়গা।আমি ধীরে ধীরে ওর সবথেকে কাছের মানুষ হয়ে উঠলাম এমনভাবে...যে আমার বুকে মাথা রাখলে ওর মনে হত...ওর নিঃসঙ্গ আঁধারকালো জীবনের উঠোনে রামধনু রঙা বসন্তের আগমন ঘটেছে সারাজীবনের জন্য।এতবড় শিল্পপতির মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও ও আমার মতো একটা মেকানিকের ইউনিফর্ম পরা নগন্য ছেলের দুচোখে নিজের সারাজীবনের দিপাবলীর প্রদীপ জ্বালিয়ে ফেলে আমার বুকে মাথা রেখে নিজের স্বর্গকানন রচনা করে ফেলল অচিরেই।আমি বুঝলাম...আমার তীর একেবারে ঠিকভাবে চলে একদম ঠিক জায়গাতে ঠিকভাবেই ঘা টা দিয়েছে।বৃষ্টি ওর মন দেওয়ার ঠিকানাটা ওর পারিবারিক প্রতিপত্তি আর সামাজিক অবস্থানের যাবতীয় হিসেব নিকেষের বিরুদ্ধে গিয়ে করলেও...বিয়েটা করার ক্ষেত্রে বিরাট অশান্তি হবে জেনেও ও ওর বাবাকে ওর সিদ্ধান্তের কথাটা জানানোর জন্য মনস্হির করে ফেলল।ও এটাও জানত...মাতৃহারা... বাবার একমাত্র মেয়ে হয়ে জীবনে প্রথমবার বাবার কাছে হাত পেতে বসলে ওকে নিরাশ হতে হবে না।
বৃষ্টির আশা সত্যিই বিফলে গেল না।প্রথমটায় যখন কলেজ পড়ুয়া মেয়ে একটি চালচুলোহীন সামান্য মেকানিকের হাত ধরে দাঁড়াল বাবার সামনে...তখন সাথে সাথে মেয়ের অপরিণত বুদ্ধি আর সিদ্ধান্তের ওপর তীব্র ক্রোধ আর আমার এমন স্পর্ধা আর ঔদ্ধত্বে অপরিমেয় অপমান আর গালিবর্ষণ করে তৎক্ষণাৎ আমাকে উনি ওনার মেয়ের জীবন থেকে চলে যেতে বললেন।মেয়ের সমস্ত ছটফটানি অগ্রাহ্য করে ওর হাতদুটিতে নিজের হাতে সবলে চেপে আটকে রেখে আমাকে হুমকি দিলেন...ওনার মেয়ের জীবনে আমার ছায়াও যদি আর পড়ে...তাহলে এই কলকাতা শহরে আমার টিকে থাকাটাই অসম্ভব হয়ে পড়বে।ওনার কথায় কোনো ভুল ছিল না।এতবড় একজন ক্ষমতাশালী শিল্পপতির কাছে এই চালচুলোহীন সামান্য একটা ছেলে হাতের খেলনা ছাড়া কিছুই নয়।সেদিন আমি ওনার সামনে থেকে চলে এসেছিলাম নিঃশব্দে।কিন্তু আমার মনে আত্মবিশ্বাস ছিল অটুট।কারণ ওই সরল সাধাসিধে ফুলের মতো সুন্দর মনের মেয়েটাকে আমি আমার মিথ্যে প্রেমের জালে এমনভাবেই ফাঁসিয়েছিলাম...যে শেষ পর্যন্ত নিজের মেয়ের জীবন ভিক্ষা করতে ওনাকে যে আমার দরজাতেই এসে ভিখারীর মতো হাত পাততে হবে...এই ভবিতব্য আমি তখনই চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম।আমি নিজের মনে হেসে সেখান থেকে বেরিয়ে চলে এসেছিলাম।আর আমার অনুমান যে মিথ্যা নয়...সেটা প্রমাণ হতে চব্বিশটা ঘন্টাও পুরো কাটল না।সেইদিনই গভীর রাতে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে আমি ধড়ফড় করে জেগে উঠলাম।দরজা খুলে দেখি...স্বয়ং রজতাভ রায় আমার দরজার সামনে নিজের একমাত্র মেয়ের জীবনভিক্ষার ঝুলি খুলে আমার সামনে ভিখারীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন।আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম...এখন আমার দরজায় যিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন...তিনি কোনো প্রভাবশালী শিল্পপতি নন।তিনি শুধু একজন বাবা।তাঁর মেয়ে এখন যন্ত্রনায় ছটফট করছে।বৃষ্টি যখন চোখের সামনে ওর প্রেমিককে চিরকালের জন্য ওর জীবন থেকে দূরে সরে যেতে দেখছিল...ওই যন্ত্রনা ও নিতে পারেনি।ও প্রায় সাথে সাথেই নিজের ঘরে ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে।কোনোমতে ওদের বাড়ির পরিচারিকার সহায়তা নিয়ে মেয়েকে অমন সর্বনাশের পথে পা বাড়ানো হতে আটকাতে সক্ষম হন তিনি।কিন্তু মেয়ের অবস্হা দেখে তিনি এটা পরিষ্কার বুঝতে পারেন...মেয়ে নিজের প্রাণভোমরা ঠিক কোথায় সঁপে দিয়ে বসে আছে!সেটি ওর কাছে না এনে দিলে যে আর মেয়েকে বাঁচানো যাবে না...এটা তিনি বুঝে যান অচিরেই।নিজের প্রাণভোমরাটিকে তার হাতের নাগালে না এনে দেওয়া পর্যন্ত সে অন্নজল ত্যাগ করে বসে রয়েছে।এমন পরিণতি যে হওয়ারই ছিল সেটা আমি জানতাম।কিন্তু একরাতের মধ্যেই যে আমার এইকদিনের মেহনত এইভাবে ফল দেবে...সেটা আমি আশাই করিনি।আমি যে এমন মূহুর্ত আসবারই অপেক্ষায় ছিলাম।কাজেই...রজতাভ বাবুর কাতর আর্জি শোনামত্র আর আমি দেরি করলাম না।সাথে সাথে ঘরের দরজা দিয়ে ওনার সাথে ছুটে গেলাম ওনার মেয়ের কাছে।ব্যস...তারপর আমাকে আর এই একচালার ভাড়ার ঘরে থাকবার জন্য ফিরে আসতে হয়নি।শুধু নিজের সামান্য কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে আমি পাকাপাকিভাবে রজতাভ বাবুর প্রাসাদতুল্য বাংলোয় থাকবার ছাড়পত্র নিয়ে প্রবেশ করলাম।আমি ঠিক যেভাবে ছক সাজিয়েছিলাম...খেলা একদম সেইমতোই এগোতে থাকল এরপর।রজতাভ বাবু আমাকে নিজের হবু জামাই হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আমাকে স্যুট ব্যুট পরিয়ে সমাজের উচু জায়গায় চলাফেরা করে একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যত তৈরি করার জন্য একেবারে কার্পেট বিছিয়ে দিলেন আমার পায়ের নীচে।বলা বাহুল্য...রজতাভ বাবুর একমাত্র ওয়ারিশ হল ওনার মেয়ে বৃষ্টি...আর তাই মেয়ের সুখের জন্য তিনি আমায় যেভাবে তৈরি করতে শুরু করলেন আর যা যা করলেন আমার জন্য...তা শুধু নিজের মেয়ের প্রতি অন্ধ অপত্যস্নেহেরই ফসল।পঞ্চান্ন বছর বয়সে এসে উনি কলকাতার বুকে যেভাবে নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন...তা অল্পদিনের মেহনতে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।এতদিনে আমার সমস্ত চাওয়া...সব অলীক স্বপ্নগুলোকে একসঙ্গে পরিপূর্ণ হতে দেখলাম...যেন কোনো আলাদীনের প্রদীপের দৈত্য নিজে থেকে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলছে...বল তোমার কি চাই!
আমার নিজের আখের গোছানোর পর্ব তখন থেকেই শুরু হয়ে গেল।আমার যোগ্যতা বিচার বিবেচনা করবার ধারপাশ পর্যন্ত না মাড়িয়ে রজতাভ বাবু আমাকে সমাজের উঁচুস্তরের নিয়ে গিয়ে সেখানকার একেবারে যোগ্য তৈরি করে আমার জীবন এবং গোটা ভবিষ্যত এমনভাবে নিজের হাতে গড়ে তুলতে লাগলেন...যে আর কোনোদিন আমাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হল না।আমার পায়ের তলার জমিটা শক্ত করার দিকেই এবার আমি পুরোপুরি মনোনিবেশ করলাম।রজতাভ বাবু তাঁর অবর্তমানে নিজের মেয়ের বৈঠা একজন যোগ্য এবং প্রভাব প্রতিপত্তিসম্পন্ন মানুষের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য আমার পিছনে যেভাবে নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিতে থাকলেন...তার পুরোপুরি ফায়দা তুলে আমি নিজের ভোল সম্পূর্ণ পালটে নিজের জায়গাটা রীতিমতো পোক্ত করে ফেললাম।রজতাভ বাবু যখন আমাকে দেখে নিজের মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত হলেন...আর আমার সাথে নিজের মেয়ের বিয়ের বন্দোবস্ত করার চিন্তাভাবনা শুরু করে দিলেন...ততদিনে আমি আমার নিজের আকাশ তৈরি করে নিয়ে অনেক উচুতে উড়ান দিতে শুরু করেছি।নীচের দিকে তাকিয়ে...কে আমার জন্য একমনে ভালোবাসা নিয়ে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে...সেইদিকে তাকানোর ফুরসত আমার কোথায়!আর তাছাড়া একটা মই ব্যবহার করে উপরে উঠে যাওয়ার পর সেটার কোনো মূল্য আর জীবনে ছিল না।আমি সহজেই ওটা আমার জীবন থেকে অনেক দূরে নিক্ষেপ করে আমার নিজের জীবন ও তার সাফল্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।বৃষ্টিকে অবশ্য সরাসরি কিছু বলিনি...কিন্তু ক্রমশই ও তীব্রভাবে এটা উপলব্ধি করতে শুরু করল...যে ও আসলেই আমার হাতের খেলনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমি রজতাভ রায়ের প্রাসাদ তুল্য বাংলো ছেড়ে দিয়ে নিজের আলিশান ফ্ল্যাট...গাড়ি...টাকা...ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স সব করে নিলাম।বৃষ্টির কাছে আমাকে রাখবার জন্য রজতাভ বাবু একদিন আমায় টিনের ভাড়া ঘরের দরজা হতে হাত ধরে টেনে বাইরে বার করে নিজের বাংলোয় জায়গা দিয়েছিলেন...আর তারই ফলপ্রসূ আমার...নিজের নিজের আলিশান ফ্ল্যাটের দরজায় বৃষ্টিকে দেখলে চিনতেও অনীহা হয়।রজতাভ বাবুর হাজারো অনুরোধ উপরোধ আমি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উপেক্ষা করতে আরম্ভ করে দিই বৃষ্টি কে দেখি করুণার চোখে।বৃষ্টি তখন পরিষ্কার বুঝতে পারছে...আমার জীবনে আদৌ ওর কোনো জায়গাই নেই।আমার উপর ও নিজের হৃদপিন্ড চিরে সব রক্ত উপুড় করে দিলেও বিনিময়ে ও পাবে না কিছুই।মেয়েটার শুধু ছিল ভালোবাসার ভুখা।আমাকে অবলম্বন করে ও নিজের আস্ত জীবনের স্বরলিপি লিখে ফেলেছিল একা।ও যখন বুঝতে শুরু করল...সবকিছুই আসলে ওর একার ভ্রম ছিল...এই ভালোবাসা শুধুমাত্র ওর একতরফা...ও সেটাকেই মেনে নিয়েছিল।এতবড় শিল্পপতির একমাত্র কন্যা তখন ভিখারিনীর মতো আমার দরজায় এসে দাঁড়িয়ে বলল..."তোমার জীবনে আমি না হয় ঘরের ডাস্টবিনে রাখা জঞ্জালের মতোই পড়ে থাকব...আমার কিচ্ছু চাই না...শুধু তোমার কাছটায় পড়ে থাকব সারা জীবনের মতো।আমায় তোমার কাছে একটু ঠাঁই দাও..."।
ওর কাতর আর্জি শুনে দয়া হল আমার।ওকে আমার ফ্ল্যাটে জায়গা দিলাম।ও তাতেই নিজেকে ধন্য মনে করল।নিজের অল্পকিছু জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়ে চলে এল সাথে সাথেই।ওর বাবার সাথে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করে চলে এল সারাজীবনের মতো।যে মেয়ে বাবাকে ছাড়া কোনোকিছু ভাবতে পারত না...সেই মেয়ে ওইভাবে বিনামেঘে বজ্রপাতের মতোই হঠাৎ করে শুধুমাত্র আমাকে সারা জীবনের মতো কাছে পাবার জন্য নিজের সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে আমার কাছে এসে নিঃশর্তে নিজেকে সঁপে দিল আমার কাছে।ও এটা ভালো করেই বুঝে গিয়েছিল...যে আমার কাছে ও কোনোরকম সামাজিক মর্যাদা পাবে না।আর এইভাবে একজন পুরুষের কাছে আশ্রিতা হয়ে থাকবার জন্য কোনো বাবা নিজের মেয়েকে অনুমতি দেবে না।আর এ ছাড়া আমাকে কাছে পাবার আর কোনো উপায়ই ওর কাছে ছিল না।তাই ও নিজের জীবনের সাথে জুয়া খেলে নিজের বাবাকে অগ্রাহ্য করে এতবড় একটা পদক্ষেপ নিয়েছিল।আমি আমার ঘরে ওকে একজন রক্ষিতা হিসেবেই রেখে নিয়েছিলাম নিজের মনোরঞ্জন আর স্ফূর্তির জন্য।ও ওইভাবেই আমার কাছে আমার আশ্রয়ে থেকে গেল বিনা প্রতিবাদে।চারপাশে এই নিয়ে কথা উঠতে শুরু করল।কিন্তু সেসবে আমি কর্ণপাত না করে নিজের কাজ আর নিজের জীবন নিয়েই মেতে থাকতাম।অল্পদিনের মধ্যেই বৃষ্টির বাবা পুরো ব্যাপারটা জেনে গেলেন।এতদিনে তিনি চাক্ষুস করলেন বিনয় আর ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে আমার আসল কদর্য রূপটা।তিনি এখন পরিষ্কার বুঝতে পারলেন তাঁর একমাত্র আদরের মেয়ের সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করে আমি ওনার কাছ থেকে ঠিক কি হাসিল করতে চেয়েছিলাম।এতদিন ধরে কেন যে আমি এটা ওটা অজুহাত খাড়া করে বৃষ্টির সাথে আমার বিয়েটা খালি পিছোচ্ছিলাম...এটাও তিনি দুয়ে দুয়ে চার করে এখন স্পষ্ট বুঝতে পারলেন।তাঁর মেয়ে যে কতবড় ভুল সিদ্ধান্ত আর পদক্ষেপ নিয়েছে...সেটা বুঝে তিনি আমার আমার ওপর ভয়ঙ্কর ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলেন।তিনি বৃষ্টিকে হাজার বলে...বুঝিয়েও কোনোমতে ওকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারলেন না।বলা বাহুল্য...আমার কাছে যে ওনার মেয়ে একজন দাসী এবং রক্ষিতা হিসেবে রয়েছে...এটা বুঝতে তাঁর কোনো বাকি ছিল না...এবং বৃষ্টি নিজেও নিজের এই পরিণতি মেনে নিয়েছিল হাসিমুখে।নিজেকে জাহান্নমে ফেলে দিয়েও ও শুধু চেয়েছিল ওইভাবেই আমার কাছে থাকতে...পাশে থাকতে।কিন্তু রজতাভ বাবু মেয়ের এই পরিণতি আর মেনে নিতে পারলেন না।যে সর্বনাশের অন্ধকূপের অতল অন্ধকারের গর্ভে মেয়ে নিজেকে সমর্পণ করে ফেলেছে...সেখান থেকে যে আর ওকে ফিরিয়ে আনবার কোনো উপায় নেই...এটা যখন তিনি বুঝতে পারলেন...তখন তিনি পুরোপুরি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আমার প্রতি মারাত্মক প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে আমাকে পুরোপুরি নিকেষ করার জন্য একেবারে উঠেপড়ে লাগলেন।রজতাভ বাবু যদি চান...তাহলে আমাকে এই দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলাটা যে তাঁর বাঁ হাতের খেল...এটা আমি খুব ভালোভাবেই জানতাম।কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার খুব একটা দুশ্চিন্তা ছিল না।কারণ আমার কোনো ক্ষতি হলে যে বৃষ্টি নিজেকে শেষ করে ফেলবে...এটা রজতাভ বাবু খুব ভালোভাবেই জানতেন।কাজেই উনি যতই আমাকে নিকেষ করার জন্য উঠেপড়ে লাগুন...ওনার সমস্ত ছটফটানি আসলেই বৃষ্টির নিষ্পাপ ভালোবাসার শক্তিশালী গন্ডির বাইরেই সীমাবদ্ধ...এই ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম।কিন্তু যত দিন যেতে থাকল...আমার জীবনটা যেন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল।আমার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে রজতাভ বাবু আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রথমটায় যারপরনাই ঘৃণা আর বিদ্বেষ নিয়ে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করলেন...আর সেইসব শেষ হত...বৃষ্টিকে বিয়ে করে নেওয়ার কাকুতি মিনতি আর অনুরোধে।অতবড় ক্ষমতাশালী একজন শিল্পপতি যখন আমার সামনে বারংবার নিজের মেয়ের সম্মান আর জীবনের ভিক্ষাপাত্র হাতে আমার হাতে পায়ে পড়ে কাকুতিমিনতি করত...সেটা আমায় বেশ আত্মতৃপ্তি দিলেও ক্রমশই সেটা আমার জীবনে ভীষণ বিরক্তির কারণ হয়ে উঠল।অন্যদিকে বৃষ্টিকে ফিরিয়ে দেবার খুব একটা ইচ্ছা আমার ছিল না।কারণ ওর মতো বিনা শর্ত আর নির্ঝঞ্ঝাট একজন বেগার খাটবার দাসী আর স্ফূর্তি করার খোরাক আমি এত সহজে কোথাও পাব না।আমি মনে মনে ভাবলাম...সব কিছুর এমন একটা শেষ দরকার...যাতে সাপও মরে...আবার লাঠিও না ভাঙে।
প্রতিনিয়ত রজতাভ বাবুর অক্লান্ত কাকুতি মিনতির উপদ্রব থেকে পুরোপুরি নিস্তার পাওয়ার জন্য আমি তাঁকে এই পৃথিবী থেকেই সরিয়ে ফেলব বলে মনস্হির করে নিই।আমার চলার পথের প্রতিটি পদক্ষেপে, বীরুৎ লতায় পা জড়িয়ে যাওয়ার মতোই যেন প্রতিনিয়ত আমি শুধু হোঁচট খাচ্ছিলাম আর এইভাবে চলা সম্ভব নয় বলেই... তিতিবিরক্ত এবং অতিষ্ঠ হয়েই এহেন সিদ্ধান্ত নিতে আমি বাধ্য হয়েছিলাম।এতবড় একজন ক্ষমতাশালী শিল্পপতি আজ যখন একজন অসহায় পিতা হয়ে নিজের মেয়ের খুশি আর সম্মানের একটা জীবন চেয়ে আমার সামনে ঝুলি পেতে প্রতিনিয়ত আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছেন...তখন তাঁকে থামানোর জন্য এই রাস্তাটাই অবলম্বন করব বলে মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলি আমি।দীর্ঘদিন ওনাকে এড়িয়ে চলার পর আমি ঠান্ডা মাথায় শান্ত আর ভদ্রভাবে ওনার সাথে কথা বলি।আমি ওনাকে কথা দিই...অল্পদিনের মধ্যেই আমি তাঁর মেয়েকে বিয়ে করব।ইতিমধ্যেই রজতাভ বাবুর সই নকল করে আমি ওনার সমস্ত সম্পত্তির দলিলপত্র নিজের নামে তৈরি করে নিয়েছি।অতএব এখন দুধটুকু চেটেপুটে খেয়ে নিয়ে বোতলটা দুমড়ে মুচড়ে ছুঁড়ে ফেলতে আমার কোনো সমস্যা নেই।
শহরখ্যাত একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি...যাঁর নাম মানুষের সামনে একবার উচ্চারণ করাটাই যথেষ্ট...এমন একজন ক্ষমতাসম্পন্ন লোককে সকলের অজ্ঞাতে নিপুণ শিল্পীর মতোই হত্যা করলাম আমি যাতে কাকপক্ষীতেও টের না পায়।শুধু তাই নয়...খুন করে আমি মৃতদেহটাকে পুরোপুরি লোপাট করে ফেলার পাকাপাকি বন্দোবস্ত সেরে ফেললাম।অতঃপর আমি আমার গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম শুনশান নির্জন রাস্তার দিকে।শুনশান ফাঁকা হাইওয়ের ওপর দিয়ে আমি গাড়িটাকে প্রায় ঝড়ের গতিতে উড়িয়ে নিয়ে চললাম।অতঃপর একটা সময়ে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে নিলাম।তারপর চারপাশটা ভালোভাবে দেখে বুঝে নিয়ে তারপর রাস্তার পাশের ম্যানহোলের ঢাকনাটা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে অতি কষ্টে খুলে ফেললাম।আর তারপর গাড়ির ডিকিটা খুলে দুমড়ে মুচড়ে কোনোমতে ঢুকিয়ে রাখা রজতাভ বাবুর মৃতদেহটাকে টেনে বার করলাম।তারপর আর এক মূহুর্তও সময় নষ্ট না করে দেহটা নিক্ষেপ করে দিলাম ম্যানহোলের ভিতরে আর তারপর সন্তর্পণে বন্ধ করে দিলাম ম্যানহোলের ঢাকনা।দেহ লোপাট...অতএব হত্যার প্রমাণও লোপাট।এবার রজতাভ বাবুর নিখোঁজ রহস্যের তীর যদি কোনোভাবে আমার দিকে আসে...ওই সন্দেহকে পরিণতি দেবার জন্য কোনো পাথুরে প্রমাণই রইল না আর।আমি নিশ্চিন্ত মনে গাড়িতে উঠতে যাব...এমন সময়ে দেখি...অদূরেই একটি প্লাস্টিকের অস্হায়ী ছাউনি খাটিয়ে তার ভিতরে এই মাঘমাসের তীব্র শীতের প্রবল কষ্টে থরথর করে কাঁপছেন দুই বৃদ্ধবৃদ্ধা।আঁধার রাতে রাস্তার আলোতে যেটুকু আমার চোখে পড়ল...তাতে বুঝলাম...তাঁদের গায়ে যে পাতলা আর ছেঁড়া চাদর জড়ানো রয়েছে...তা থাকা আর না থাকা দুইই সমান।তাঁদের অমন উদ্বাস্তুদ মতো দুরবস্হা দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে...এই শহরের মাটিতে তাঁদের পা রাখার মেয়াদ আদৌ বেশিদিনের নয়।ওই আলোআঁধারির ভিতরেও তাঁদের মুখ চিনতে আমার অসুবিধা হল না।আমাকে শিক্ষিত...এবং মানুষের মতো মানুষ গড়ে তোলার জন্য নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছিলেন তাঁরা...সেটা আমি জানতাম।কিন্তু তাঁরা যে আজ নিজেদের সমস্ত সহায়সম্বল খুইয়ে একেবারে পথে এসে দাঁড়িয়েছেন...এটা আমি জানতাম না।আর জানবই বা কি করে...!নিজের জীবন ঝকঝকে তকতকে করে সাজিয়ে তুলতে আমি এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি... যে বাবা মায়ের খোঁজ নেওয়ার কথা মাথাতেই আসেনি কখনো।আর খোঁজখবর নিলেও সত্যি বলতে কি দুইজন অশীতিপর বৃদ্ধবৃদ্ধার দায়িত্ব নেওয়ার মতো মানসিকতা এমনিতেই আমার ছিল না।আমি কলকাতায় আসবার পর...আমাকে মানুষ করে তোলার জন্য যাবতীয় ধারদেনা শোধ করে টরে এখন যে তাঁরা পথের ভিখারী হয়েছেন...আর রাস্তায় রাস্তায় যাযাবরের মতো ঘুরে আধপেটা খেয়ে না খেয়ে জানোয়ারের থেকেও নিকৃষ্ট জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন...এটা বুঝতে আমার বাকি রইল না।কিন্তু ওই সময়ে সেইসব মোটেই আমার চিন্তার বিষয় ছিল না।আমি শুধু এইটা পরিষ্কার বুঝতে শুরু করলাম...যে রজতাভ বাবুর মৃতদেহটা আমি যখন সরাতে ব্যস্ত ছিলাম...তখন ওই পুরো দৃশ্যটাই চাক্ষুষ করেছেন আমার বাবা আর মা।এতদিন পরে তাঁদের ওইভাবে ওই অবস্হাতে দেখেও আমার হৃদয় এতটুকুও নরম তো হলই না...বরং আমার ভিতর থেকে কে যেন বারে বারে বলতে লাগল..."তোর এই অপরাধের কোনো সাক্ষী যেন জীবিত না থাকে।নিজের ডানহাতের কাজ বাঁম হাতকে দেখিয়ে করার বান্দা তুই নোস...নিজের বাবা মা বলে তাই তাঁদেরও রেয়াত করার কোনো মানে হয় না।"
যেমন ভাবা তেমন কাজ।আমি ধীরপায়ে তাঁদের দিকে এগোতে থাকলাম।আমাকে এতদিন বাদে দেখতে পেয়ে তাঁদের বিস্ময় যেন বাঁধ মানছে না...।তাঁরা হয়তো ধরেই নিয়েছিলেন এই জীবনের মতো আর আমাকে চোখের দেখাটুকুও দেখতে পাবেন না।এই কষ্ট বুকে নিয়েই এইভাবে দুজনে মিলে বয়ে চলেছেন জীবনযন্ত্রনার দুঃসহ বোঝা।এইভাবে মেঘ না চাইতেই জলের মতো আমাকে দেখতে পেয়ে যাবেন...এই বিস্ময়ের ঘোর যেন তাঁদের কাটছে না।কিন্তু আমি তাঁদের চোখে খুশির চাইতে বিস্ময়টাই দৃঢ়ভাবে লক্ষ্য করলাম।আর এখানেই আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম...আমি যে মানুষ খুন করে তার দেহ লোপাট করছি...এই পুরো দৃশ্যটা ওনারা স্পষ্টভাবে চাক্ষুষ করেছেন।আমার প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে আমার হাতের মুঠো শক্ত হতে শুরু করল।আমার ভিতরের পিশাচটা ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করল আরো দুইটি ন্যক্কারজনক ঘৃণ্য পাপকাজ করবার জন্য।
আমি কোনোরকম দোটানার মধ্যে না গিয়েই বিনা দ্বিধায় দ্রুতপায়ে এগোতে থাকলাম তাঁদের দিকে।দুজন অশীতিপর...রুগ্ন বৃদ্ধবৃদ্ধা ক্ষুধা আর ঠান্ডার যন্ত্রনায় রীতিমতো কাবু।অতএব এই কাজটা সারতে আমাকে যে খুব একটা বেগ পেতে হবে না...এটা আমি স্পষ্ট বুঝে গিয়েছিলাম।দ্রুতপায়ে হেঁটে তাঁদের একেবারে মুখোমুখি পৌঁছে...তাদের কোনো কথা বা শব্দ তো দূর...বিস্ময়প্রকাশ করার সুযোগ পর্যন্ত না দিয়ে আমার দুইহাতের তালুতে চেপে ধরলাম তাঁদের দুজনের কন্ঠনালী।এরকম অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি চাক্ষুষ করার পর নিজের সন্তানের হাতে সম্পূর্ণ অযাচিতভাবে এইরকম অমানুষিক আক্রমণের মুখে পড়ে তাঁরা ভীষণভাবে আতঙ্কগ্রস্হ হয়ে পড়লেন।তাঁদের বিস্তারিত দুই চোখ থেকে বেরিয়ে আসা আতঙ্কগ্রস্হ অসহায় আকুতি যেন হাহাকার করে আমায় প্রশ্ন করে চলেছিল...একটার পর একটা পাপকাজ তুই কেন করে চলেছিস!এইসবের মানে কি!
আমার হাতের পাশবিক চাপ সহ্য করতে না পেরে মা সংজ্ঞা হারালেন।তখন আমি আমার দুইহাত কাজে লাগিয়ে বাবার কন্ঠনালী সজোরে চেপে চেপে ধরলাম যতক্ষণ না তাঁর দেহ থেকে প্রাণ না বেরিয়ে যায়...।আর এর জন্য আমাকে খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি।কিছুক্ষণের ভিতরেই চোখের সামনে শিথিল হয়ে যেতে দেখলাম বাবার প্রাণহীন নিথর দেহ।যখন আমি বুঝতে পারলাম...তাঁর দেহে আর প্রাণ নেই...তখন আমি তাঁর নিথর দেহখানি পাশে ছুঁড়ে ফেলে এবার মায়ের হাতের নাড়ি টিপে দেখলাম।বুঝতে পারলাম...মায়ের শরীর থেকে প্রাণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই।
তখন আমি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হয়ে শান্তির শ্বাস ফেললাম।তারপর মা আর বাবার যন্ত্রনাক্লিষ্ট দেহদুটিকে তারপর রজতাভ বাবুর দেহ যেই ম্যানহোলের ভিতরে ছুৃঁড়ে দিয়ে খুনের সমস্ত প্রমাণ লোপাট করেছিলাম...ওই ম্যানহোলের ভিতরেই পরপর আরো দুটি মৃতদেহ নিক্ষেপ করে...হাত ঝেড়ে নিশ্চিন্ত মনে ফুরফুরে মেজাজে গাড়ির ভিতরে ঢুকে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ঘরে ফেরার পথ ধরলাম।জীবন জেরবার করে তোলা ঝামেলার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আমাকে কম ঝুঁকি পোহাতে হয়নি।শেষ পর্যন্ত সবটা ভালোয় ভালোয় কাটবার পর আমি ভীষণ ক্লান্তি অনুভব করলাম।নরম বিছানায় ততোধিক কোমল...বৃষ্টির ওই মাংসল শরীর আমায় টানতে থাকল ভীষণভাবে।বেডসাইড টেবিলে রাখা মদের বোতলটা এক মিনিটের মধ্যে পুরো খালি করে বিছানার এক কোণে জড়োসড়ো বৃষ্টির উপরে জন্তুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়লাম।আর স্ফূর্তির ফুরফুরে আমেজের সাথে সাথে আমার সমস্ত পাপ একেবারে বুদবুদের মতোই বাতাসে মিলিয়ে গেল সকলের অগোচরে।দুনিয়ার কাছে সমস্ত পাপ গোপন থাকলেও...ওই যে যিনি ওপরে বসে রয়েছেন...তার কাছে আমি কিচ্ছু লুকোতে পারিনি।কিচ্ছু না..."
ঝড়জলের গভীর রাতে প্রিয়াংশু বাবুর কথা শুনতে শুনতে থানার ভিতরে পুলিশ অফিসার আর সমস্ত পুলিশকর্মীরাই রীতিমতো বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন।প্রিয়াংশু বাবু ধীরে ধীরে অচৈতন্য হয়ে প্রায় বীরুৎ লতার ন্যায়ে টেবিলের ওপরে নুয়ে পড়লেন।থানার ভিতরে দেখা দিল পিন পড়া নৈঃশব্দ্য।চার পাঁচ সেকেন্ড কাটল এভাবেই।সকলে এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।কোনো মানুষের পক্ষে এতটা নৃশংস হওয়া সম্ভব!
হঠাৎ টেবিলের ওপরে মাথা নুইয়ে পড়া প্রিয়াংশু বাবুর ভিতরে যেন জেগে উঠল অন্য কোনো সত্ত্বা।ঘন্টাখানেক মেয়াদের এই পরিচয়ে থানার ভিতরের পুলিশ অফিসার ও অন্যান্য পুলিশকর্মীরা ওনাকে যতটুকু দেখেছেন বা বুঝেছেন...মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ভিতরেই তার চিত্রটাই সম্পূর্ণরূপে ওলটপালট হয়ে গেল এক নিমেষে।প্রিয়াংশু বাবুর ভিতরে যেন হঠাৎ ভয়ংকরভাবে জেগে উঠেছে কোনো ভয়াল দানব।থানার ভিতরে সবাই লক্ষ্য করল...প্রিয়াংশু বাবু মাথা তুলছেন ধীরে ধীরে।তাঁর চোখের ভিতর থেকে মনিটা পুরোপুরি উধাও হয়ে গিয়েছে।মনিবিহীন দুই চোখ নিমেষে রক্তবর্ণ হয়ে আগুনের লেলিহান শিখার মতো জ্বলতে শুরু করল।তাঁর দুই ঠোঁটের দুইপাশ ঠেলে বেরিয়ে আসতে থাকল তীক্ষ্ণ স্বদন্ত।সবাই সাংঘাতিক স্তম্ভিত হয়ে পুরোপুরি স্হবির হয়ে গেল।কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই...এতক্ষণ চেয়ারে বসে থাকা প্রিয়াংশু বাবু হঠাৎ প্রচন্ড বেগে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন...আর তারপর চোখের পলক ফেলবারও অবকাশ না দিয়ে একেবারে বিদ্যুতের গতিতে তাঁর সামনে বসে থাকা পুলিশ অফিসার আর তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা এতজন পুলিশ কর্মীদের চোখের সামনে দিয়ে চোখের পলক ফেলবার সুযোগটুকু না দিয়ে দমকা ঝোড়ো হাওয়ার মতোই থানা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
একজন অপরাধী নিজে থানায় এসে পুলিশের সামনে নিজের স্বীকারোক্তি পেশ করে আত্মসমর্পণ করার পর এতজন কর্তব্যরত পুলিশের চোখের সামনে দিয়ে এইভাবে ঝোড়ো হাওয়ার গতিতে বেমালুম গায়েব হয়ে গেল...তাদের সকলের পুরো ব্যাপারটা ঠাহর করে ওঠবার আগেই...এটা যখন তারা বুঝতে পারলেন...তখন তারা সদলবলে প্রিয়াংশু বাবুকে ধরার জন্য দ্রুতগতিতে পদক্ষেপ নিলেন।কিন্তু তাঁদের মনের ভিতর থেকে বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটতেই চাইছে না।ওরকম জ্বলন্ত আগুনের মতো চোখ কোনো মানুষের যে হওয়া সম্ভব নয়...সেটা চিন্তা করতেই তাঁদের যেন রক্তহিম হয়ে এল।ওই দৃশ্য থানার ভিতরে যারা কর্মরত ছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই চাক্ষুষ করেছেন।অতএব এখানে কারোর দৃষ্টিভ্রমের কোনো সম্ভাবনাই নেই।আর এতজন কর্তব্যরত পুলিশ আর খোদ পুলিশ অফিসারের চোখের সামনে দিয়ে ওইরকম ঝড়ের গতিতে প্রায় অদৃশ্য হয়ে যাওয়াটাও কোনো মানুষের পক্ষে এক কথায় অসম্ভব।রাত গভীর।বাইরে বজ্রবিদ্যুতসহ ঝড়বৃষ্টি হয়ে চলেছে নাগাড়ে।তার মধ্যেই পুলিশের জিপ অপরাধীকে হাতের নাগালে পাওয়ার জন্য দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে।রজতাভ বাবুর নিখোঁজ রহস্য যে শেষ পর্যন্ত এইদিকে এসে মোড় নেবে সেটা ভাবতে পারেনি কেউই।রজতাভ বাবুর হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার কেসের দায়িত্বটা এই থানার ওপরেই পড়েছিল...যার কোনো কূলকিনারা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।আজ যখন তাঁর হত্যাকারী নিজে থানায় এসে অপরাধ স্বীকার করেছে...তখন তো এত সহজে তাকে অধরা হতে দেওয়া যায় না...।থানার এলাকার চারপাশের সমস্ত রাস্তা আর গলিতে পুলিশের টহল আরম্ভ হল রাতবিরেতে।থানা থেকে পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে আর কতদূরেই বা যেতে পারবে ওই হত্যাকারী!ওই এলাকার ভিতরেই এমনভাবে টহল দেওয়া আরম্ভ করল পুলিশ...যে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে থানা থেকে বেরোতে পারলেও...ওই এলাকা ছেড়ে বেরোনোটা যাতে প্রিয়াংশু বাবুর পক্ষে কোনোমতে সম্ভব না হয়।ওই ঝড়জলের রাতে গোটা রাত ধরে প্রিয়াংশু বাবুকে হাতেনাতে পাকড়াও করার কম চেষ্টা চালায়নি পুলিশ।কিন্তু সমস্ত চেষ্টাই বৃথা গেল।ঝড়বৃষ্টি থেমে...রাতের আঁধার কেটে আকাশ যখন রীতিমতো ফর্সা হতে শুরু করেছে...তখন তারা বুঝতে পারল...প্রিয়াংশু বাবু জিতে গিয়েছেন।থানা সংলগ্ন এলাকা ছেড়ে তিনি পুলিশের নাগালের পুরোপুরি বাইরে চলে গিয়েছেন।প্রিয়াংশু বাবু পুলিশের চোখের সামনে থেকে গায়েব হওয়ার সাথে সাথেই পুলিশ যেভাবে থানার চারপাশে সমগ্র এলাকাজুড়ে পুরো ঈগলের দৃষ্টি নিয়ে ফাঁদ পেতে তাঁর ধরবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল...তাতে এত অল্প সময়ের ভিতরে গোটা একটা এলাকা হতে পুরোপুরি গায়েব হয়ে যাওয়াটা এক কথায় অসম্ভব।কিন্তু প্রিয়াংশু বাবুর পক্ষে যে এটা করা খুব একটা অসম্ভব ব্যাপার নয়...সেই আঁচটা পুলিশ তখন পর্যন্ত কিছুটা হলেও পেয়েছে।কারণ এতজন কর্মরত পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে তাদের এতটুকুও নড়বার সুযোগটুকু না দিয়ে রীতিমতো বিদ্যুৎগতিতে যেভাবে প্রিয়াংশু বাবুকে ওরা থানার ভিতর হতে গায়েব হতে দেখেছিলেন...তাতে তখনই তারা এটা বুঝে গিয়েছিল...প্রিয়াংশু বাবুকে জীবিত ধরাটা শুধু মুশকিলই নয়...হয়তো অসম্ভব।
রজতাভ বাবুর খুনীকে যে চিহ্নিত করা গেছে...আর সেই খুনী যে থানায় এসে অপরাধ স্বীকার করে এতজন কর্মরত পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে গায়েব হয়ে গেছে...এই পুরো ব্যাপারটাই আপাতত থানার ভিতরেই গোপন রেখে আপাতত প্রিয়াংশু বাবুকে ধরার জন্য পুলিশ একেবারে উঠেপড়ে লেগে গেল।সকাল সকাল প্রিয়াংশু বাবুর ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেল পুলিশ।গিয়ে দেখল...ফ্ল্যাট পুরোপুরি ফাঁকা।দরজা লকড।ততক্ষণে পুলিশ পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে...চারপাশের গোটা এরিয়ার ভিতরে গরুখোঁজা করেও প্রিয়াংশু বাবুকে হাতে পাওয়া এক কথায় অসম্ভব...কারণ উনি এতক্ষণে হয়তো কলকাতার বাইরে চলে গিয়েছেন।পুলিশ এবার তাঁকে ধরার জন্য রীতিমতো মরিয়া হয়ে উঠল।এবার তারা প্রিয়াংশু বাবুকে ধরার জন্য বড় কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠল।তারা ভালোভাবেই বুঝতে পারছে,যে পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে নিজের ফ্ল্যাট লক করে প্রিয়াংশু বাবু এখন গা ঢাকা দিয়েছেন অন্য কোথাও।পুলিশ প্রিয়াংশু বাবুর ফ্ল্যাটের তালা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিল।এখান থেকে হয়তো কোনো সূত্র মিললেও মিলতে পারে।প্রিয়াংশু বাবুর ফ্ল্যাটের লক ভাঙার কাজ শুরু হল।কিছুক্ষণের মধ্যে,রীতিমতো দরজা ভেঙ্গে পুলিশ ঢুকল ওই ফাঁকা ফ্ল্যাটের ভিতরে।আর ঢুকেই তাদের একপ্রকার অদ্ভুত ভ্যাপসা আর বোঁটকা গন্ধে নাকে রুমাল চাপা দেওয়ার উপক্রম হল।সমস্ত দরজা জানলা বন্ধ থাকায় ফ্ল্যাটের ভিতরটায় এতক্ষণ রাজ করছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার।
আধ ভেজানো ওই দরজার ভিতর থেকেই যে বহু দিন ধরে জমতে থাকা চাপা ভ্যাপসা দমবন্ধ করা গন্ধটা আসছে...সে বিষয়ে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই।পুলিশ দ্রুতগতিতে ওই ঘরের দরজাটা খুলতেই একটা কর্ণবিদারক ক্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁচ শব্দে ঘরের স্তব্ধ বাতাস যেন কেঁপে দুলে উঠল।এই ঘরে কারোর থাকা তো দূর...যে দীর্ঘদিন ধরে কোনো মানুষের পা পড়েনি এটা এতক্ষণে পুরোপুরি পরিষ্কার।কিন্তু তাহলে ঘরের ভিতর ওই পুরুষ কন্ঠের শীর্ণ আর যন্ত্রনাক্লিষ্ট আর্তধ্বনি আসছে কিভাবে।ফ্ল্যাটটার আয়তন রীতিমতো বিশাল।যেমন বড় ড্রইংরুম...ড্রইংরুমের পাশে অবস্থিত কিচেনটা তো দুটি মাঝারি সাইজের বেডরুমের সমান।বেবরুমটা যে আরো বিশালায়তন হবে সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই।এখন দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে এত বড় হলঘর সমান বেডরুম আর তার ভিতরে সজ্জিত নামীদামী ফার্নিচারের আড়ালে আবডালে কোনো এক কাতর মানুষের আর্তধ্বনি অনুসরণ করে মানুষটিকে সামনে নিয়ে আসতে মিনিট দুইতিন মতো সময় লেগে গেল পুলিশ বাহিনীর।কিন্তু মানুষটাকে চোখের সামনে আনবার পর তো পুলিশের চোখ একেবারে কপালে ওঠার যোগাড়।শরীরের সমস্ত মাংস প্রায় শুকিয়ে...ভিতরের কঙ্কালটা যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে।চেহারাটা এতটাই বীভৎস হয়ে গিয়েছে...যে হঠাৎ দেখলে যেকোনো মানুষই ভীরমি খাবে।এই শরীরটা যে একটা দুটো দিন নয়...দীর্ঘদিন ধরে টানা কোনো একটা অব্যক্ত যন্ত্রনার শিকার...সেটা তাকে দেখামাত্রই বোঝা যায়।এবং এই ঘরের ভিতরে এইভাবে যে এই মানুষটাকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরজবরদস্তি আটকে রাখা হয়েছে...সেটাও তারা বুঝতে পারছে ভালোভাবেই।সারা শরীরে যন্ত্রনার চিহ্ন বহন করা এই মানুষটাকে চিনতে পুলিশের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।গতকাল মাঝরাতে স্যুট বুট পরে যে লোকটি থানার ভিতরে হঠাৎ এসে পড়ে অনর্গল স্বীকার করে চলেছিল তার দীর্ঘদিনের পাপাচার আর পর্দা তুলে সামনে এনেছিল তার সমস্ত অপরাধের খতিয়ান...সে আর এ যে আসলেই এক...সেটা দেখে পর্যন্ত পুলিশের বিস্ময়ের কোনো সীমা রইল না।এক রাতের ভিতরেই প্রিয়াংশু বাবুর এমন অবস্থা কি করে হল সেইটাই এখন সবচাইতে বড় প্রশ্ন।নিজের ফ্ল্যাটের ভিতরে নিজে এমন অবস্থায় কেন পড়ে আছেন...যে বাইরে থেকে তাঁকে উদ্ধার করে বাঁচানোর প্রয়োজন পড়ছে...একটা রাতের ভিতরে পুরো ছবিটাই এমন দিকে মোড় নিল কিভাবে...এইসব হাজারো প্রশ্ন যেন এক লহমায় যেন একসঙ্গে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল।সাথে সাথেই প্রিয়াংশু বাবুকে জলটল খাইয়ে সুস্থ করার চেষ্টা আরম্ভ হল।প্রিয়াংশু বাবু যেন অন্য কোনো দুনিয়ায় চলে গিয়েছেন...যেখান থেকে তাঁকে ইহজগতে ফেরানোটা রীতিমতো কষ্টকর।শুধুমাত্র একপ্রকার যন্ত্রনাক্লিষ্ট কাতর গোঙানি ছাড়া প্রিয়াংশু বাবুর গলা থেকে আর কিছুই বেরোচ্ছে না।কারোর কোনো কথা বুঝতে পারা বা কারোর সাথে কথা বলা...এইসমস্ত কিছুরই এখন তিনি উর্দ্ধে।আর দেরি না করে সাথে সাথেই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল।চারপাশে একেবারে ঢি ঢি পড়ে গেল।প্রিয়াংশু বাবুর বন্ধুবান্ধব সকলেই বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে গেল।প্রিয়াংশু বাবু অস্ট্রেলিয়া থেকে কলকাতায় ফিরেছেন খুব বেশিদিন হয়নি।আর ফেরার পর থেকেই তাঁর মধ্যে ক্রমশই একটা বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিল তাঁর বন্ধুবান্ধব...প্রতিবেশী...চেনাপরিচিত সকলেই।তাঁর মস্তিষ্ক যে ক্রমশই বিকারগ্রস্হ হয়ে পড়ছে...সেই বিষয়েও একমত হয়েছিলেন সকলেই।আর এই কিছুদিন যাবৎ তো তার মাথার গন্ডগোল এতটাই বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে কাজটাজ সবকিছু বন্ধ হয়ে যায় তাঁর।চলে যায় তাঁর চাকরিও।এরপরে কাজ হারিয়ে...একটি অনিশ্চিত অন্ধকার ভবিষ্যৎএর ভারে জর্জরিত প্রিয়াংশু বাবু এই ফ্ল্যাটে একাই ছিলেন।তাঁর হালচাল দেখে কেউ তাঁর সাথে কোনো কথা পর্যন্ত বলত না।কিন্তু ওইভাবে নিজেকে চার দেওয়ালের ভিতরে নিজে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে যে তিনি কোনোদিনই ছিলেন না...এ বিষয়ে ওই ফ্ল্যাটে এবং পাড়ায় বাস করা সমস্ত প্রতিবেশীরাই একমত।প্রিয়াংশু বাবুকে ঘর থেকে বেরোতে প্রতিনিয়তই এরা সবাই দেখেছেন।কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তি এসে প্রিয়াংশু বাবুকে দীর্ঘদিন ধরে তাঁকে জোরজবরদস্তি এই ফ্ল্যাটের ভিতরে আটকে রেখে অত্যাচার করবে...এটা এক কথায় অসম্ভব।তাছাড়া গতকাল রাত্রে থানার ভিতরে যদি এতজন কর্মরত পুলিশ ওনাকে স্বশরীরে চাক্ষুষ করে থাকে...অন্যদিকে ওই একই দিনে বিকেল সন্ধ্যার দিকে প্রিয়াংশু বাবুকে পাড়ার অনেকেই দেখেছিল বাইরে বেরোতে।তাহলে এক রাতের ভিতরে পুরো চিত্রটাই এইভাবে উলটে যাওয়াটা কিভাবে সম্ভব!রহস্য ক্রমশ ঘন হতে থাকল।
মৃতপ্রায় প্রিয়াংশু বাবুর মুখ থেকে শুধুমাত্র যন্ত্রনাক্লিষ্ট আর্তনাদ ছাড়া আর কিছুই যে এখন বার হওয়া সম্ভব নয়...সেটা পুলিশ বুঝতে পারল ভালোভাবেই।এখন সবার আগে জরুরী...প্রিয়াংশু বাবুকে সুস্থ করা।ঘন কুয়াশার আড়ালে চাপা পড়ে যাওয়া আসল চিত্রখানি তারপরেই সামনে পরিষ্কারভাবে আনা সম্ভব হবে।তৎক্ষণাৎ প্রিয়াংশু বাবুকে ভর্তি করা হল হাসপাতালে।জোরকদমে আরম্ভ হল তাঁর চিকিৎসা।আর পাশাপাশি প্রিয়াংশু বাবুর স্বীকারোক্তির সমস্ত সূত্র ধরে আরম্ভ হল শিল্পপতি রজতাভ রায়ের হত্যাকান্ডের কিনারা।প্রিয়াংশু বাবুর স্বীকারোক্তিতে বলা প্রতিটি কথার সূত্র ধরে পুলিশ খুনের কিনারা করতে নামবার পর খুব অল্প সময়ের ভিতরেই উদ্ধার হল...ম্যানহোলের ভিতরে রজতাভ বাবুর পচাগলা লাশ।প্রিয়াংশু বাবু ই যে এই হত্যা করেছেন...সেটি তার কারণ সমেত এখন পুরোপুরি স্পষ্ট।রজতাভ বাবুর অনেক কাছের মানুষেরই কিন্তু মনে হয়েছিল...যে চেনা নেই...জানা নেই...একটা চালচুলোহীন ছেলেকে দান খয়রাতি করা পর্যন্ত ঠিক আছে।কিন্তু এইভাবে তাকে নিজের বাড়িতে ঠাঁই দিয়ে...অপরিণত মেয়ের কথায় সায় দিয়ে তাকে নিজের জামাই হিসেবে নিজের পরিবারের সদস্যের জায়গায় বসিয়ে নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়াটা হয়তো উচিত কাজ হবে না।রজতাভ বাবুও কি এই কথাগুলো ভাবেননি?হ্যাঁ ।তিনি তো সবার আগে এগুলোই ভেবেছিলেন।কিন্তু মা মরা একমাত্র মেয়েটা যখন তাঁর অবর্তমানে নিজের একটা অবলম্বন খুঁজে নিয়ে সেটাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচবার চেষ্টা করছে,তখন মেয়েটার চোখ থেকে এক ফোঁটাও জল পড়তে দিতে আর চাননি তিনি।এই একটা জায়গাতেই তাঁর এতদিনের সব অভিজ্ঞতা...বিচক্ষণতা যেন পঙ্গু হয়ে পড়েছিল।আর তার মাশুল তাঁকে যে কিভাবে চোকাতে হল...সেটা দেখে তো এখন গোটা শহরবাসী রীতিমতো শিউরে উঠেছে।এমনকি রজতাভ বাবুর মা মরা একমাত্র আদরের কন্যা বৃষ্টিও এখন পুরোপুরি নিখোঁজ।আর এর পিছনেও যে প্রিয়াংশু বাবুরই হাত রয়েছে...তাতে এখন আর পুলিশের কোনো সন্দেহই নেই।আর এইসব সত্য সামনে আসতে যতখানি সময় লাগল,তার মধ্যে প্রিয়াংশু বাবুও মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করেছেন।কথাও বলতে পারছেন একটু একটু।এখন শিল্পপতি রজতাভ রায় হত্যার কিনারা সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার সকলের কাছে।ঝড়জলের ওই রাত্রে প্রিয়াংশু বাবু থানায় এসে ঠিক যেমন যেমন স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন...তার এক বর্ণও নির্ভুল ছিল না।তাঁর বলা প্রতিটি কথা এখন অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত।বৃষ্টির খোঁজ এখনো পর্যন্ত পাওয়া না গেলেও...পুলিশ খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছে...এই কলকাতা শহরের ভিতরের এই বন্ধ ফ্ল্যাটের ভিতরে একা থেকে থেকে ক্রমশ দমবন্ধ হয়ে আসছিল বৃষ্টির।সে বাবার সঙ্গে রীতিমতো ঝগড়া অশান্তি করে করে বাবার কাছ থেকে প্রিয়াংশু বাবুর কাছে এসেছিল অনেক বড়ো আশা নিয়ে...অনেক স্বপ্ন নিয়ে।কিন্তু প্রিয়াংশু বাবুর ফ্ল্যাটে এসে থাকতে শুরু করার পর থেকেই ও যেভাবে প্রতিনিয়ত প্রিয়াংশু বাবুর কাছ থেকে অত্যাচারিত আর অসম্মানিত হতে থাকছিল...সেটা একটা সময়ের পর সমস্ত সীমা অতিক্রম করে যায়।না।বাবার কাছে ফিরে যাওয়ার মুখ বৃষ্টির ছিল না।ও শুধু সমস্তকিছুর জন্য শুধু নিজেকে দায়ী করে একটুখানি শান্তিতে টিকতে পারার আশা নিয়ে এই কলকাতা শহর ছেড়ে দিয়ে দেশের বাইরে পাড়ি দিয়েছে বেশ কিছুদিন আগেই।অফিসের কাজ শেষে হঠাৎ একদিন ফ্ল্যাটে ফিরে আসার পর প্রিয়াংশু বাবু আর বৃষ্টিকে দেখতে পাননি।আর তাতে কিন্তু তিনি এতটুকুও বিচলিত হননি।বরং হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলেন তিনি...যাক...প্রথমে বাপটাকে নিকেষ করে ফেলবার পর আসল আপদটাই ঘাড় থেকে নেমেছে।এইভাবে একে একে প্রিয়াংশু বাবুর রাস্তা ক্রমশ মসৃণ হতে থাকল...আর প্রিয়াংশু বাবুও একেবারে মসৃণভাবে নিজের আখের গুছিয়ে নিয়ে হাত আর মাথা থেকে যাবতীয় পাপের কালি এক লহমায় মুছে নিলেন।বৃষ্টিকে তার যে কাছের যেসব বান্ধবীরা এয়ারপোর্ট পর্যন্ত সিঅফ করতে গিয়েছিল...তারা প্রত্যেকেই একই কথা বলছে।মানসিক দিক থেকে বৃষ্টি এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল... যে...যে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য ও চিরকালের মতো ও এই শহর ছেড়ে চলে গিয়েছে একা।নিজের সমস্ত অতীত এয়ারপোর্টের সীমার বাইরেই খোলসের মতো ছেড়ে রেখে মেয়েটা স্বচ্ছ নদীর মতো স্হির আর নিস্তরঙ্গ...নির্ঝঞ্ঝাট শান্তিময় একটা জীবন খুঁজতে চলে গিয়েছে সারা জীবনের মতো।যাবেন সময়ে ওর একটাই অনুরোধ ছিল।কেউ যেন কোনোদিন ওর খোঁজ না করে।না।কারোর কোনো বারণ...কোনো অনুরোধ ও শোনেনি।কারোর অনুরোধ বা চোখের জল ওকে আটকাতে পারেনি।ও ধীরে ধীরে যেন একটা পাথরে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।ওর বাবার যে কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না...চতুর্দিকে যেভাবে সেই নিয়ে রীতিমতো শোরগোল পড়ে গিয়েছে...সেই নিয়ে ওর কোনোপ্রকার হুঁশতাপই ছিল না।যা হোক...বৃষ্টি সেই যে চলে গিয়েছে বুকে জমে থাকা হাজারো যন্ত্রনা নিয়ে...তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না।যে স্বেচ্ছায় হারিয়ে যায়...তাকে খুঁজে বার করে সামনে আনা খুবই কঠিন।তবে রজতাভ বাবুর খুনি যখন একেবারে প্রমাণসমেত ধরা দিয়েছে...তখন এই কেসের বিচার যে হবেই...এতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু প্রিয়াংশু বাবু একটু সুস্থ হয়ে ওঠার পর থেকে...ওনার মুখ থেকে যে কথা বেরিয়ে আসছে...সেগুলোকে পুরোপুরি অসত্য বলে পুলিশ এক লহমায় উড়িয়েও দিতে পারছে না...আবার চারপাশের সমস্ত ঘটনার সাপেক্ষে ওই কথাগুলো বিশ্বাস করার কোনো প্রশ্নই আসছে না।প্রিয়াংশু বাবুর কথাগুলোর সারমর্ম এই...
যেদিন তাঁর অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা ছিল...সেইদিন সমস্ত গোছগাছ সেরে দরজার কাছে বসে বেরোনোর জন্য জুতোর শেলফ থেকে জুতোটা বার করতে যাবেন...ঠিক ওই সময়ে হঠাৎই নিভে যায় তাঁর ফ্ল্যাটের ভিতরের এসি আর লাইট।সমস্ত বৈদ্যুতিক যন্ত্রগুলোও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।তিনি ভাবলেন...এ বোধহয় লোডশেডিং।তাই তিনি ব্যাপারটায় বিশেষ গা করলেন না।আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়বেন।তাই জেনারেটরটা চালানোরও এখন আর দরকার নেই।তাই তিনি মোবাইলের টর্চলাইটটা জ্বেলে নিয়ে জুতোটা বার করতে যাবেন...এমন সময়ে হঠাৎ মোবাইলের টর্চলাইটটাও নিভে গেল দপ করে।ফোনটা হাতে নিয়ে তিনি দেখলেন...ওটার স্যুইচ অফ হয়ে গিয়েছে।এবার তিনি যারপরনাই আশ্চর্য হয়ে গেলেন।খানিক আগেই ফুলচার্জ করা মোবাইলটা অন করতেই যে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে...।এসব কি কান্ড আরম্ভ হল...।ঘরের ভিতরটা এতটাই ঘুটঘুটে অন্ধকার...যে কোনোকিছুই দেখা সম্ভব হচ্ছে না।আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই যে তাঁকে বেরোতে হবে...সেটা তাঁর মাথা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে গেল।সোফায় বসে মোবাইলটাকে অন করার জন্য তিনি অনর্গল চেষ্টা করতে থাকলেন।হঠাৎ কোনো একটা রোমশ হাত অমানুষিক শক্তিতে তাঁর দুই পা ধরে এক ঝটকায় টেনে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে নিয়ে চলল ভিতরের দিকে।প্রচন্ড বিস্মিত এবং ভীত হয়ে তিনি পরিত্রাহী চ্যাঁচাতে যাবেন...তখন তিনি দেখলেন...তাঁর মুখ থেকে হাজার চেষ্টা করলেও খুবই মৃদু গোঙানি ছাড়া আর কোনো শব্দ বার করাই সম্ভব হচ্ছে না।ভয়ে...আতঙ্কে তখন তাঁর একেবারে দিশাহারা অবস্থা।ওদিকে প্রবল শক্তিশালী ওই রোমশ হাত তাঁকে টানতে টানতে নিয়ে এসেছে একেবারে তাঁর শোবার ঘরের ভিতরে।অমন রোমশ আর রাক্ষুসে হাত যে কোনো মানুষের হওয়া সম্ভব নয়...এই বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত তিনি।তাঁকে ওই ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দেয় ওই হাত।ব্যস...তারপর থেকে সেইদিন পর্যন্ত তিনি ওই ঘরের ভিতরেই বন্দী হয়ে পড়েছিলেন।আর তাঁর কোনো খোঁজও পড়েনি।সেইদিন যদি ঘরে পুলিশ না আসত...তাহলে ওই অন্ধকার ঘরের ভিতরেই অনাহারে মৃত্যু নিশ্চিত ছিল তাঁর।
প্রিয়াংশু বাবুর মুখে এমন বৃত্তান্ত শোনা পর্যন্ত তাঁর চেনাপরিচিতরা সবাই একবাক্যে বলে উঠলেন..."ওনার পক্ষে এমন আষাঢ়ে কাহিনী বলা এখন খুবই স্বাভাবিক।যেদিন ওনার অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা ছিল...সেদিন তো আদৌ তিনি যাননি।প্লেনের টিকিট থেকে শুরু করে সমস্ত ব্যবস্হা করে টরে...শেষমূহুর্তে আর গেলেনই না।আর তার পর থেকেই তাঁর মস্তিষ্কে পুরোপুরি বিকৃতি দেখা দেয়।শেষ পর্যন্ত তাঁর এমন অবস্থা হয়...যে চাকরীটা পর্যন্ত আর রাখতে পারলেন না।এরপর থেকে যদিও ওনার ফ্ল্যাটের মুখো কেউ হয়নি...কিন্তু প্রতিদিনই মানুষজনে দেখেছে তাঁকে।অতএব দীর্ঘদিন অনাহারে একটা বন্ধ ঘরের ভিতরে পড়ে থাকার গল্পটা নেহাতই পাগলের প্রলাপ।
কিন্তু প্রিয়াংশু বাবুর শরীরের যা অবস্থা...তাতে ডাক্তাররা পর্যন্ত বলছেন...যে প্রিয়াংশু বাবু নেহাত মিথ্যে বলছেন না।আর তাছাড়া সবথেকে বড় গরমিলের বিষয় হল...ওই ঝড়জলের রাত্রে থানায় এসে যে খুনের স্বীকারোক্তি দিয়ে গিয়েছে...সেটা যে তিনি নন...সেইটাই এখন বারংবার সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করে চলেছেন প্রিয়াংশু বাবু।এটা কিভাবে সম্ভব!স্বীকারোক্তিতে যা যা তিনি বলেছিলেন সেদিন...সেগুলি তো পুরোপুরি অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছে।আর যাই হোক...রজতাভ বাবুকে যে প্রিয়াংশু বাবু ই হত্যা করেছেন...এতে এখন আর কোনো দ্বিমত রাখার জায়গাই নেই।আর খুনের শাস্তিও এখন তাঁর অবশ্যম্ভাবী ভবিতব্য।কিন্তু একটা কোথাও বড় ধরণের কোনো গরমিল রয়েছে।একটা কোনো হিসেব যেন মিলছে না কিছুতেই।আদালত সমস্ত প্রমাণ সাপেক্ষে প্রিয়াংশু বাবুকে মৃত্যুদন্ডের সাজা ঘোষণা করেছে।মোটামুটি আর সপ্তাহখানেকের মধ্যে স সাজা সম্পন্ন হতে চলেছে।কিন্তু প্রিয়াংশু বাবু সমানে শুধু একটাই কথা বলে চলেছেন..."ওই স্বীকারোক্তি আমার নয়।"
রজতাভ বাবুর খুনের কিনারা একেবারে সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়ে গেলেও একটা কোনো হিসেব কিছুতেই পুলিশ মেলাতে পারছে না।যদিও এই কেসএ তাদের ডিউটি এখানেই শেষ...তবুও একটা কোনো খচখচানি কিছুতেই যেন শান্তি দিচ্ছে না।
রজতাভ বাবুর খুনী ধরা পড়বার পরে সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার কুন্তল দত্তর পদোন্নতির ব্যাপারে চিন্তাভাবনা আরম্ভ হয়েছে দিনকয়েক হল।কিন্তু কুন্তল মানসিক দিক থেকে শান্তি পাচ্ছেন না মোটেই।একটা অসংগতি...একটা খটকা যেন কিছুতেই শান্তি দিচ্ছে না তাঁকে।রজতাভ বাবুর নিখোঁজ রহস্যের কিনারা করার দায়িত্ব তাঁর ওপরে ছিল।নিজের দায়িত্ব এতটাই সফলভাবে তিনি পালন করেছেন...যে রজতাভ বাবুর নিখোঁজ রহস্যের কিনারা করে ওনার মৃতদেহ সমেত সকলের সামনে নিয়ে এসে একেবারে তাঁর খুনীকে সামনে এনে হাজির করলেন অকাট্য প্রমাণ সহ।এতবড় একটা অ্যাচিভমেন্টও এখন কুন্তলকে আত্মতৃপ্তি দিতে যেন কুন্ঠিত।কুন্তলের এখন শুধুই মনে হচ্ছে...একটা কোনো খটকা রয়ে গিয়েছে।কোনো একটা না মেলা সূত্র যেন কুন্তলকে আড়াল থেকে অট্টহাস্যের সাথে বলে চলেছে...তাঁর এতদিনের কর্মজীবনের সমস্ত গৌরব যেন শুধুই বুদবুদ।আজকের এই অ্যাচিভমেন্টটা পাওয়ার মতো যোগ্যতা এখনো হয়নি তাঁর।সামনে একটা দিন ছুটি তাঁর।ওইদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে তিনি চলে এলেন প্রিয়াংশু বাবুর ফ্ল্যাটের সেকেন্ড ফ্লোরের একটি ফ্ল্যাটের দরজার সামনে।যেখানে থাকেন তাঁর বাল্যবন্ধু সায়ন ভট্টাচার্য।কুন্তল আর সায়ন একসঙ্গেই বড় হয়েছে।কুন্তলের বরাবরই ইচ্ছা...ও বড় হয়ে বড় পুলিশ অফিসার হবে।ও সেটাই হয়েছে।কিন্তু সায়নের ছোট থেকেই লেখাপড়ার প্রতি বড় একটা মনোযোগ ছিল না।জীবন নিয়ে কোনোরকম সিরিয়াসনেসও ওর ছিল না কোনোদিন।ও পড়ার বইএর আড়ালে রহস্য গল্প পড়ত গোগ্রাসে।এর জন্য বাবার কাছে কম ধোলাই জোটেনি ওর।কিন্তু রহস্য ওর ভেদ করার নেশা...ওর বাবার...ছেলেকে বড় ডাক্তার করার স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করেছে।যদিও সায়নের মনে ছোট থেকেই ইচ্ছা...বড় হয়ে ও হবে ফেলু মিত্তির অথবা ব্যোমকেশের একটা জলজ্যান্ত সংস্করণ।কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে আজ ওর ঠাঁই হয়েছে বাবার অ্যান্টিক জিনিসের দোকানে।বাবার দোকান সামলেই এখন জীবন অতিবাহিত হয় ওর।এছাড়া ওর ছোটখাটো কিছু সাইড বিসনেসও রয়েছে।ওকে হঠাৎ দেখলে যে কেউ বলবে...ও আদৌতে একটা অপদার্থ ইউসলেস।ওর ছোটবেলার বন্ধুরা এখন কেউ ডাক্তার...কেউ ইঞ্জিনিয়ার...কেউ বা পাড়ি দিয়েছে বিদেশে বড় চাকরি নিয়ে।এরা সকলেই ওকে এখন ছ্যাছ্যাফ্যাফ্যা করে। কিন্তু সায়নের সঙ্গে মিশলে বোঝা যায়...ও মানুষটা দারুণ রকমের রসিক আর দিলখোলা।লোভ লালসা...জটিলতা কুটিলতা...এইসব ওর একেবারেই নেই।টাকার পিছনে ছুটে জীবনের হাসিমজার সঙ্গে সমঝোতা করবে...ও সেই বান্দাই নয়। ঠোঁটের ফাঁকে একখানা সিগারেট গুঁজে...রহস্য গল্পের বই হাতে মজে যাওয়া...টুকিটাকি দোকানদারির দায়িত্ব বা ব্যবসা দেখভাল করা...এই নিয়ে ও আছে বেশ।প্রাচুর্যও যেমন নেই...তেমন অভাবও নেই।অনেকের তুলনায় যথেষ্ট আনন্দে দিনযাপন করে সায়ন।এই মানুষটির সঙ্গে কুন্তলের বন্ধুত্ব এখনো আগের মতোই অটুট।চাকরি জীবনে যেদিন সাফল্য কুন্তলকে হাতছানি দিয়ে সাদর আহ্বান জানাচ্ছে...সেই সময়ে ওর মনের ভিতরে যে কোন দ্বিধা...সংশয় ওকে এই খুনের কিনারার সঙ্গে জড়িত হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি এনে দাঁড় করাচ্ছে...সেইসব কথা ও নিজের বাল্যবন্ধুর কাছে গোপন রাখেনি।সবটা শুনে সায়ন শুধু একটাই কথা বলেছিল..."এই পুরো ব্যাপারটায় একটা রহস্যের গন্ধ আছে।"
ওর কথা শুনে কুন্তল রেগে গিয়ে বলল..."গল্পের বই হাতে ফোনে কথা বলবার কোনো দরকার নেই।আমি এখন ফোন রাখছি।"
তা শুনে সায়ন বলল..."আহা...চটছিস কেন!আমি এখন খুব সিরিয়াস দোকানদার।এই তো এখন দোকানেই বসে একজন কাস্টামারের সঙ্গে কথা বলছিলাম।হাতে বই নেই বিশ্বাস কর...তোর কি হয়েছে আমায় একটু খুলে বল দিকি...।"
সেইদিন সায়নের সাথে ফোনে যা কথা হয়েছিল...সেইমতো একেবারে সকাল সকালই ও সায়নের দরজায় এসে কলিং বেলটাতে আঙুল দিয়ে চাপ দিল।কুন্তল এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই ফ্ল্যাটে...যার ওপরের তলায় প্রিয়াংশু বাবু নিজের জীবন আর ভবিষ্যৎ গোছানোয় মগ্ন হয়ে একটি বিলাসবহুল...উগ্র আর উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনে চূর হয়ে থাকতেন।
সায়ন দরজা খুলতে কুন্তল দেখল...এই এত বেলায় সায়ন উড়োখুড়ো চুলে বোকার মত দাঁত বার করে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে আর বলছে..."এমন একখান দারুণ রোমহর্ষক স্বপ্ন দেখছিলুম...কলিং বেল বাজিয়ে পুরো চৌপাট করে দিলি!তুই বন্ধু না শত্তুর রে!"
আপাদমস্তক সায়নের চেহারা দেখে আর ওর কথাগুলো শুনে এবার রীতিমতো গা জ্বলে গেল কুন্তলের।
---"তুই কি জীবনেও একটু সিরিয়াস হবি না!তোর সঙ্গে আমার কথা বলতে আসাটাই দেখছি ভুল হয়েছে।"
---"আহা চটছিস কেন...আয় ভিতরে আয়।আমার জীবনে রোমহর্ষক স্বপ্ন বা গল্পের এমনিতেও কোনো কমতি নেই।বাস বা ট্রেনের মতোই...একটা হাতছাড়া হলে সাথে সাথেই আরেকটা চলে আসবে।তুই আয়...ভিতরে বসে মাথাটা একটু ঠান্ডা কর।আমি বরং মুখটা ধুয়ে তোর জন্য একটু চা বানিয়ে আনি।"
কুন্তল ভিতরে ঢুকতে সায়ন দরজাখানা বন্ধ করে শীস দিতে দিতে চলল বাথরুমের দিকে।সায়নের বোনের তো বহুদিন আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছে...আর ওর বাবা মা কাশী গিয়েছেন তীর্থযাত্রায়।তাই এখন ফাঁকা ফ্ল্যাটে সায়ন একা।কুন্তল গজগজ করতে করতে ভিতরে এসে বসল।সায়ন মিনিট দশেকের মধ্যেই হাতমুখ ধুয়েটুয়ে দুইকাপ চা বানিয়ে ট্রে তে খাস্তা বিস্কুট সাজিয়ে নিয়ে এসে হাজির হল।
তারপর উষ্ণ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মিচকে হেসে বলে উঠল..."তোর মতো দুঁদে পুলিশ অফিসার আমার মতো দোকানদারের সাথে তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেসের সমাধানে আসতে আলোচনায় বসবে... এটা কোনো ধোপে দেওয়ার মতো কথাই নয়।তোর কথা শুনেই আমি বুঝেছি...যে এই পুরো কেসটা আপাতদৃষ্টিতে মিটে গেলেও এর ধোঁয়াশা এখনো কাটেনি...একটা বড় কোনো রহস্যের আড়ালে সবটা ঘোলাটে হয়ে আছে।আমার প্রতি তোর আস্হাটাও পোক্ত হয়েছে এই জন্যই।ঠিক কিনা বল দেখি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে...?"
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অসহায় দৃষ্টিতে কুন্তল তাকাল সায়নের দিকে।
সায়ন বলল..."এক কাজ কর...আর বেশি কথা বাড়িয়ে কাজ নেই...প্রিয়াংশু বাবুর ওই ফ্ল্যাটটা তো এখন পুরোপুরি সিল হয়ে রয়েছে।ওই ফ্ল্যাটের চাবি তোর কাছে আছে না?"
---"হ্যাঁ...সে আছে।"
---"ওটা এখন সাথে আছে তো তোর?"
---"হ্যাঁ ওটা সাথে করে নিয়েই এসেছি।"
---"গুড।চল...চা টা খেয়ে নিয়ে একবার ওখানে যাওয়া যাক।"
---"ওকে...তাই চল।"
বন্ধ ফ্ল্যাটের তালা খুলতে ফের একটা ভ্যাপসা আর প্রচন্ড অদ্ভুত একটা বুনো একটা গন্ধের সংমিশ্রণ যেন মানুষ তাড়ানোর উপক্রম করে বসে আছে।কোনোমতে রুমাল দিয়ে নাক চেপেটেপে ওরা দুই বন্ধু ভিতরের দিকে অগ্রগামী হল।কুন্তল এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করলেও সায়ন কিন্তু সোজাসুজি এগিয়ে চলল ফ্ল্যাটের বেডরুমের দরজার দিকে।প্রিয়াংশু বাবুকে মূমুর্ষ অবস্হায় ওই ঘর থেকে উদ্ধার করে বার করে নিয়ে যাবার সময়ে ওই দরজা বাইরে থেকে বন্ধই করে দেওয়া হয়েছিল।দরজাটা খুলতেই ফের ক্যাঁ-অ্যা-অ্যা-অ্যা-চ করে কর্ণবিদারক একটা আওয়াজ হল।সায়ন কুন্তলকে ডেকে বলল..."চল...এই ঘরের ভিতরে একবার যাব।"
কুন্তল দ্রুতপায়ে এগিয়ে এল বেডরুমের দিকে।দুই বন্ধু বেডরুমটায় ঢুকে এল...কুন্তল সুইচ টিপে আলোটা জ্বেলে নিল।আলোটা জ্বালতেই সায়ন গটগট করে ঘরের একেবারে ভিতরে ঢুকে গেল।তারপর বসে পড়ল নরম বিছানায়।কুন্তল এবার ভয়ঙ্কর খচে গিয়ে বলল..."জানতাম তোকে দিয়ে কিস্যু হবে না।এসেছি একটা দরকারী কাজে...আর তুই নরম বিছানা পেয়ে একেবারে জুত করে সেখানে বসে গেলি...!তোর কথা শুনে আজকের সকালটা নষ্ট করাটাই দেখতে পাচ্ছি আমার মূর্খামী।একটা কোনোকিছুকেও জীবনে সিরিয়াসলি নিলি না তুই।"
---"শান্ত হও বৎস...শান্ত হও...।ওরে...এমন কথা কোথায় লেখা আছে...যে সিরিয়াস কাজ করতে গেলে মুখখানাকেও একদম সিরিয়াস সিরিয়াস করে হাঁড়ির মতো করে রাখতে হবে!আমরা তো রহস্যের কিনারাতেই পৌঁছে গেছি রে।"
কোমরে হাত দিয়ে কুন্তল রেগে বলল..."মানে!"
বিছানায় বসে সায়ন ধীরে ধীরে বেডসাইড টেবিলের দিকে হাত বাড়াল।আর তার পর হাতে তুলে যেটা কুন্তলের দিকে এগিয়ে দিল...সেটা আর কিছুই নয়...একটা সুদৃশ্য আইভরি ফটোফ্রেম।
ফটোফ্রেমটা হাতে করে নিয়ে যখন সায়ন বাড়িয়ে ধরল কুন্তলের দিকে...তখন ওই পরিস্থিতিতেও সেটির দিকে তাকিয়ে রীতিমতো চোখ আটকে গেল কুন্তলের।এইরকম অবয়বের এমন অদ্ভুত কারুকার্য করা ফটোফ্রেম আজ পর্যন্ত কুন্তলের চোখে পড়েনি।ক্ষণিকের জন্য ও ভুলে গেল ও এখানে কেন আর কি জন্য এসেছে।সায়নের হাত থেকে ফটোফ্রেমটা নিজের হাতে নিয়ে একেবারে মুগ্ধদৃষ্টিতে সেটিকে দেখতে থাকল কুন্তল।ফটোফ্রেমটির ভিতরে ফটো রাখার জায়গা বলতে একটা ভয়ালদর্শন হিংস্র জন্তুর ক্ষুধার্ত এবং যারপরনাই বিকট একখানা মস্ত হাঁ।দুইপাশে তার স্বদন্ত প্রকট।জন্তুটি যতখানি বন্য...ততখানিই রাজকীয়।বিশেষ করে জন্তুটার চোখদুটো কি নিখুঁত হাতে গড়া...।মানুষের হাতে নির্মিত কোনো অবয়বে এমন ভাষায় অব্যক্ত হিংস্রতা আর নির্মমতা যে কিভাবে ফুটে উঠতে পারে সেটাই অবাক হয়ে দেখার জিনিস এই অদ্ভুত ফটোফ্রেমটি।ওই হাঁয়ের ভিতরে যে ফটোটি রয়েছে...ওটা দেখামাত্র কুন্তলের বিস্ময়ের সীমা রইল না।ফটোফ্রেমটির ভিতরে যে প্রিয়াংশুবাবুরই ছবি রয়েছে...এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার সেটা নয়।ছবিতে যে প্রিয়াংশু বাবুকে দেখা যাচ্ছে...এ কোন প্রিয়াংশু বাবু!প্রিয়াংশু বাবুর এমন চেহারার সঙ্গে কুন্তল বিলক্ষণ পরিচিত।প্রিয়াংশু বাবুর খোঁজে যেদিন পুলিশের বাহিনী নিয়ে এই ফ্ল্যাটে এসেছিল কুন্তল...আর ভগ্ন...ক্লিষ্ট মূমূর্ষ প্রিয়াংশু বাবুকে এই বেডরুমের ভিতরে একা পড়ে কাতরাতে দেখেছিল...যার মুখে ক্ষীণ কন্ঠে শুধু একটাই আকুতি ছিল...এই বন্দীদশা থেকে আমায় উদ্ধার করো...সেই চেহারাখানিই হুবহু ফটোফ্রেমের ভিতরে ফটোর আকারে বিরাজমান।ওনার ওই পরিস্থিতিতে কে ওনার অমন ছবি তুলে ওই ফটোফ্রেমের ভিতরে ওইভাবে যত্ন করে সাজিয়ে রাখল!সবথেকে বড় প্রশ্ন...ওনার ওই অবস্থায় এই ভ্যাপসা ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরের ভিতরে ওনার এমন ফটো তুললই বা কে!এবার কুন্তল কপালে রীতিমতো চিন্তার ভাঁজ নিয়ে বসে পড়ল ফটোফ্রেমটা নিয়ে।আর অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকল...ফটোর ভিতরে প্রিয়াংশু বাবুর প্রতিকৃতির গলার একেবারে মাঝখানটায় একটা খুলিচিহ্ন।আর অল্পদিনের ভিতরেই যে প্রিয়াংশু বাবুর ফাঁসির দিনক্ষণ একেবারে স্হির হয়ে বসে আছে...সেটা এখন গোটা শহরবাসী জানে।কোনো একটা অজানা আতঙ্কের চোরাস্রোতের সাথে যেন কুন্তলের শিরদাঁড়া বেয়ে হিমশীতল একটা স্রোত নেমে গেল।আর কুন্তলের কানে তখন বারংবার একটাই প্রতিধ্বনি ভেসে উঠতে লাগল।"ওই স্বীকারোক্তি আমার নয়!ওই স্বীকারোক্তি আমার নয়!"
রজতাভ বাবুকে যে প্রিয়াংশু বাবু ই হত্যা করেছেন...সেটা এখন একেবারে হাতে কলমে প্রমাণিত।ঝড়জলের রাত্রে ওই খোলামেলা এবং ঝরঝরে স্বীকারোক্তি যদি ওইভাবে সামনে না আসত...তাহলে হয়তো রজতাভ বাবুর লাশটাও পাওয়া সম্ভব হত না।নিজের কৃতকর্ম এবং পাপেরই শাস্তি পেতে চলেছেন প্রিয়াংশু বাবু...আর কিছুদিনের মাত্র অপেক্ষা।কিন্তু চারপাশের লোকজনে যতই বলুক...ওনার সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার দেখা দিয়েছে...কুন্তল ওনাকে যতটুকু দেখেছে...ওর একবারের জন্যও এ কথাটা মনে হয়নি।আর এখন তো পার্থিব সব যুক্তিবুদ্ধি একপাশে সরিয়ে রেখে ও মানতে বাধ্য হচ্ছে...আসলেই প্রিয়াংশু বাবু একটা বিরাট প্রহসনের শিকার।ওনাকে এই ঘরের ভিতরে বন্ধ করে নিয়ে...তারপরে একটু একটু করে সূতো ছেড়ে ছেড়ে...শেষ পর্যন্ত একেবারে উলঙ্গ করে সামনে এনে হাজির করা হয়েছে ওনার যাবতীয় অপকীর্তি।কিন্তু কে এই পুরো ব্যাপারটা ঘটাল!কার হাত রয়েছে প্রিয়াংশু বাবুর আজকের এই পরিণতির আড়ালে!যবনিকার আড়ালে শোনা যাচ্ছে কার অট্টহাস্য?পার্থিব যুক্তিবুদ্ধির সমস্ত হিসাবনিকাশ কেমন যেন গুলিয়ে যেতে শুরু করল কুন্তলের।ফটোফ্রেমের ওই ভয়ালদর্শন রোমশ জন্তুটির অবয়বটিকে কুন্তল ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকল...আর মনে করতে থাকল প্রিয়াংশু বাবুকে এই ঘরের ভিতরে খুঁজতে এসে ওনাকে ক্ষুধার্ত মূমূর্ষ অবস্থায় যখন উদ্ধার করা হল...তখন উনি ঠিক কি কি বলেছিলেন!এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরোনোর সময়টাতে হঠাৎ করে ঘরের সমস্ত আলো নিভে যাওয়া...এবং পরিশেষে ফুলচার্জ দেওয়া মোবাইলটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া...আর তারপর এই বন্ধ ঘরে একটা কোনো অমানুষ রোমশ হাত প্রচন্ডভাবে প্রিয়াংশু বাবুকে বসার ঘর থেকে একেবারে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসে এই শোবার ঘরের ভিতরে।আর তারপর বাইরে থেকে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় দরজাখানি।অমন অমানুষিক হাত যে কোনো মানুষের হতে পারে না...এই বিষয়ে ষোলোআনা নিশ্চিত প্রিয়াংশু বাবু।সকলে এই কথাগুলো শুনে পাগলের প্রলাপ বলে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে।দুঁদে পুলিশ অফিসার কুন্তল এখন এই সমস্তকিছুকেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে ধরে ধরে একটা কোনো কিনারায় পৌঁছনোর চেষ্টা করছে...আর যার ফলপ্রসূ ঠিক যে চিত্রটা বারেবারে সামনে এসে ধরা দিচ্ছে...এরকম চিন্তাভাবনা করাটা যে কোনো পুলিশ অফিসারের পক্ষে শোভা পায় না...সেটা বিলক্ষণ জানে কুন্তল।এই চার দেওয়ালের ভিতরে দাঁড়িয়ে কুন্তল সায়নের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল..."আমি ঠিক যা ভাবছি...তুইও কি সেটাই ভাবছিস?"
সেই জিনিসপত্রের মধ্যেই ছিল এই সুদৃশ্য ফটোফ্রেমখানি।এমন অনেক কিছু আছে এই দুনিয়ায়...যা সবাই দেখতে... শুনতে বা উপলব্ধি করতে পারে না...আমি সেইসব দেখতে...শুনতে...উপলব্ধি করতে পারি।এর জন্য আর পাঁচটা মানুষের চেনা ছকে আমাকে মেলানো যায় না কোনোভাবেই।তাই লোকে আমায় অস্বাভাবিক বলে...তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে...আবার পাগল ছাগল বলেও টোন টিটকিরি কাটে।কিন্তু ওসবে আমি মোটেই পাত্তাটাত্তা দিই না।আমি থাকি আমার খেয়ালে...আমার দুনিয়া নিয়ে।আমি যা দেখি...যা শুনি...যা উপলব্ধি করি...সেসব ছোটবেলায় আহাম্মকের মতো মানুষজনকে বলতে যেতাম ঠিকই...কিন্তু এখন আমি ঠেকে শিখেছি।এখন সেসব কথা আমি কাউকে বলতে যাই না মোটেই।এই ফটোফ্রেমটা যখন আমার দোকানে সাপ্লাই এসেছিল...তার কিছু সময় পার হওয়ার পর পরই আমি এটা স্পষ্ট বুঝতে পারি...এটা কোনো নির্জীব জড় পদার্থ নয়।এর ভিতরে প্রাণ রয়েছে।
আমি নির্জনে এটা হাতে নিয়ে কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করি।বহুক্ষণ মনোযোগ নিয়ে চেষ্টা চালানোর পর ক্রমশ এর ভিতর থেকে একটা অদ্ভুত ধরণের শব্দ আমি শুনতে পাই।হিংস্র কোনো বন্য জন্তুর প্রচন্ড ক্রোধান্বিত তীব্র গর্জন আর আস্ফালন।জানতাম...আমি যা শুনতে পাচ্ছি...যা অনুভব করছি...সেসব যেকোনো মানুষেরই ধরাছোঁয়ার বাইরে।উল্টে আমি এসব কথা কাউকে বলতে গেলে শুধু ঠাট্টা তামাশার খোরাক হওয়ার বাইরে আর কিছুই হওয়ার নয়।এই আইভরি ফটোফ্রেমটা নিয়ে আমার একটা কৌতূহল জন্মে গিয়েছিল।আমি জানতাম...আর কিছুদিন যদি ওটা আমার কাছে থাকে...আমি ঠিক এটার রহস্য পুরোটাই অনুধাবন করতে পারব।কিন্তু আমার সবথেকে বড় ভুল ছিল এইটাই...আমি ফটোফ্রেমটাকে ব্যক্তিগতভাবে নিজের কাছে না রেখে...রেখেছিলাম আমার আর পাঁচটা বিক্রির জিনিসের সাথেই।বৃষ্টি ম্যাডামের চোখ ওটার ওপর পড়াটা ছিল অত্যন্তই স্বাভাবিক ব্যাপার।কিন্তু ওই সময়ে আমার সে কথাটা মাথাতেই আসেনি।আর ঘটনা যেটা ঘটার ছিল...সেইটাই ঘটল।বৃষ্টি ম্যাডামের একদিন চোখ পড়ে গেল ওই ফটোফ্রেমটার ওপরে।আর চোখ পড়ামাত্রই সাথে সাথে উনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন...ওটা উনি কিনে নিয়ে যাবেন।আমার ভিতরটা তখন হায় হায় করে উঠল।কি ভুলটাই না আমি করেছি ওটা ওই জায়গাতে রেখে...!আমি সাথে সাথে বৃষ্টি ম্যাডামকে ওটার একটা রাশভারী দাম শুনিয়ে দিলাম।দেখলুম...তাতেও উনি নিরস্ত হলেন না।আমি যে দাম বললুম...সেই টাকা দিয়েই ওটা কিনে নিয়ে যেতে চান উনি।মহা মুশকিল!কিন্তু কি আর করা...।দোকানে খদ্দের হল লক্ষ্মী...আর দোকানদার প্যাঁচা।একটা বিশাল অঙ্কের দাম বলেও যখন তাঁকে নিরস্ত করা গেল না...তখন ওনার মতো শিক্ষিত মেয়েকে যে কোনো আজগুবি গপ্পো শুনিয়ে আদৌ কোনো লাভ হবে না...এটা বোঝার মতো বুদ্ধি যেকোনো মানুষেরই আছে।কি আর করা...।
বাধ্য হয়েই টাকার বিনিময়ে জিনিসটা আমায় হাতছাড়া করতে হল।এরপর কেটে গেল অনেক দিন।বৃষ্টি ম্যাডাম আর প্রিয়াংশু বাবুর কাছে থাকতে না পেরে সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে চলে গেলেন দেশের বাইরে।কোথায় গেলেন...কার কাছে গেলেন...সেটা পুরোপুরিই অধরা।যাই হোক...এর কিছু পরেরই ঘটনা।একটা বড় প্রমোশন নিয়ে প্রিয়াংশু বাবুর বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারটা ফ্ল্যাটের বাকিদের মতোই অজানা ছিল না আমারও।কিন্তু পরে জানতে পারি...উনি আর কোথাও যানইনি।রয়ে গেলেন এখানেই।আর তারপর থেকেই আস্তে আস্তে ওনার মধ্যে একটা মানসিক বিকার লক্ষ্য করি আমরা সকলেই।আর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ওই মানসিক বিকৃতি এমন পর্যায় পৌঁছে যায়...যে চাকরি হারিয়ে বসেন তিনি...টাকার গদিতে বসে থাকলেও পথেঘাটে ঘুরে বেড়ানো উন্মাদ ভবঘুরেদের সঙ্গে তাঁর আর কোনো পার্থক্যই রইল না।সবাই তাঁর সংস্রব পুরোপুরি ত্যাগ করল।বৃষ্টি ম্যাডামকে আমি যত দেখতাম...তত বুঝতাম...প্রিয়াংশু বাবু আসলেই একটা মানুষরূপী শয়তান।লোকটার অমন অবস্হায় তাই আমারও তাঁর প্রতি কোনো দয়ামায়াই জাগল না।আমিও তাঁকে পুরোপুরি এড়িয়ে বাঁচিয়েই চলতাম।এইভাবে কেটে গেল বেশ কিছুদিন।প্রিয়াংশু বাবু নিজের ওই ফ্ল্যাটটাতে ক্রমশ স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে যেতে থাকলেন।ঘর থেকে বেরোতেন কালেভদ্রে।এইভাবে বেশকিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পরেই হঠাৎ আমরা সবাই শুনতে পাই প্রিয়াংশু বাবুর ওই বিস্ফোরক স্বীকারোক্তি বৃত্তান্ত।সবটা শুনেটুনে আমার খুবই রাগ হয়েছিল।যে লোক নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য একটা মাতৃহীনা মেয়ের যন্ত্রনাক্লিষ্ট হৃদয় নিয়ে নোংরা খেলা খেলে কাজ হাসিল করে তারপর তাকেই প্রতিদিন একটু একটু করে দলেপিষে মারে...ঠান্ডা মস্তিষ্কে একজন মানুষকে হত্যা করতে পারে...এমনকি নিজের বাপ মাকে পর্যন্ত রেহাই দেয় না...প্রমাণ লোপাট করার স্বার্থে নৃশংসভাবে খুন করে তাঁদের দেহ পর্যন্ত লোপাট করে ফেলে রাতারাতি...এমন পিশাচের জন্য মৃত্যুদন্ডই উপযুক্ত শাস্তি।এরই মাঝে তোর মনের এই দোলাচল নিয়ে তুই যখন এলি আমার কাছে...তোর সবটুকু দ্বিধা আর সংশয় খুলে বললি আমায়...তখন এই পুরো জিনিসটা আমায় ফের নতুন করে ভাবাল।পরে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে আমার দৃঢ়ভাবে মনে হচ্ছে...এই পুরো ঘটনাটার সাথে এই ফটোফ্রেমটা গভীরভাবে যুক্ত।আর এখন এই ব্যাপারে আমি পুরোপুরিই নিশ্চিত।
সায়নের কথাগুলো বেশ মন দিয়ে শুনছিল কুন্তল।সায়নের কথা শেষ।কেটে গেল কিছু নিঃশব্দ মূহুর্ত।থুতনিতে আঙুল ঘষতে ঘষতে কুন্তল বলে উঠল..."তোর কথা সবটা না হয় বুঝলাম...আর তোর এই মনে হওয়াটাকে উড়িয়েও দিচ্ছি না আমি।কিন্তু এরপর?একটা ভাসা ভাসা আন্দাজ তো আমি তোর কাছে খুঁজতে আসিনি...আমাদের এবার আসল রহস্যের সামনাসামনি হতে হবে।জানতে হবে আসলেই পুরো ব্যাপারটা ঠিক কি!"
---হ্যাঁ...সে তো বটেই...।আমিও তো সেই কথাই ভাবছি।আমি তোকে একটা প্রস্তাব দেব শুনবি?"
---বল...।
---কাল সন্ধ্যাবেলায় আমার সাথে দেখা কর।এই ফটোফ্রেমটা আজ রাতটা থাকুক আমার কাছে।কাল আমরা এটা নিয়ে যাব একটা কোনো নির্জন জায়গায়।যেখানে চারপাশে আর কেউ থাকবে না।এই ফটোফ্রেমের ভিতরে একটা প্রাণের অস্তিত্ব আছে।আমি নিজে এটা টের পেয়েছি।একটা প্রচন্ড ছটফটানি আর চাপা হুংকার এর ভিতরে গর্জন করে মরছে।এ কার হুংকার!কার ছটফটানি!তাকে আমাদের সামনে আনতে হবে।আর তাদের জন্য আমাদের দরকার একটা নির্জন জায়গা।আমার বিশ্বাস...আমি ঠিক পারব এই ফটোফ্রেমের ভিতরে দীর্ঘদিন ধরে চাপা পড়ে থাকা অজানা এই সত্ত্বাটিকে সামনে এনে মুখোমুখি দাঁড় করাতে।"
---বেশ...আমি আসব।কাল সকাল সকালেই চলে আসব।আমাদের এই কাজটার জন্য কোন জায়গা ঠিক হবে...সেইটাও ভেবে ঠিক করে রাখব।"
---হ্যাঁ সেই ভালো।এখন এটা হাতে নিয়ে এখানে বসে থেকে আমাদের আর কোনো লাভ নেই।তার থেকে তুই বরং এখন বাড়ি চলে যা...আমারও বাবা মা ফিরতে দুই তিনদিন দেরি হবে।কাজেই আমারও কোনো অসুবিধা হবে না।কাল একদম ঘুম থেকে উঠে আমার এখানে চলে আসবি...এখানেই খাওয়াদাওয়া করবি কেমন...!তারপর সময় নিয়ে চিন্তাভাবনা করে ব্যাপারটা ডিল করতে হবে।"
---ঠিক আছে ভাই।আমি তবে এখন আসলাম...ফটোফ্রেমটা তুই রাখ তোর কাছে...।আমি কাল সকাল সকাল চলে আসব।"
দুই বন্ধু আর কথা না বাড়িয়ে প্রিয়াংশু বাবুর ওই পরিত্যক্ত ফ্ল্যাটের দরজায় চাবি দিয়ে যার যার ঘরমুখো হল।
ভোরের আলো ফুটে উঠেছে।একটা নতুন দিনের শুরু।আর আজকের এই দিনটা যে কুন্তলের জীবনের কতখানি কাঙ্ক্ষিত একটি দিন...সেটা উপলব্ধি বা অনুভব কোনোটাই করার মতো মানসিক অবস্থায় এখন ও নেই।কুন্তলের প্রমোশনের এই দিনটাকে ঘিরে ওর পরিবারের ভিতরে রীতিমতো উৎসব উৎসব গন্ধ।শহরের নাম করা বড় শিল্পপতি হত্যার কিনারা হয়েছে তাদেরই পরিবারের ছেলের হাতে।কুন্তলের ঘুম আজকাল খুব একটা গাঢ় হয় না।ভোররাতের দিকেই ঘুম ভেঙ্গে যায় ওর।আজকেও তার ব্যতিক্রম হল না।ভোর পাঁচটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যেতে গিয়ে ও দেখল...রান্নাঘরে মা আর মাসিরা ইতিমধ্যেই রান্নাবান্নার যোগাড়যন্ত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।মাসিরা তো গতকাল সকাল থেকেই চলে এসেছে এখানে।আজ দুপুরে এই ফ্ল্যাটে তাদের সমস্ত আত্মীয় স্বজন আর চেনা পরিচিতদের নিয়ে একটা ছোটখাটো খাওয়াদাওয়ার অনুষ্ঠান হবে ওর কেরিয়ার জীবনের এত বড় উন্নতি সেলিব্রেট করার জন্য।ভোর ভোর তারই প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে জোর কদমে।কুন্তল দেখল।কিন্তু এইসবের কোনোকিছুতেই ওর কোনো গা নেই।সারাটা জীবন ও অপেক্ষা করে ছিল শুধু এমন একটি সাফল্যের সূর্যোদয় দেখবার জন্য।অথচ আজ ওর শুধু মনে হচ্ছে...ওর আজকের এই সাফল্যের কণামাত্রও ওর নিজের প্রাপ্য নয়।সবটাই যেন একটা বিরাট বড় একটা ফাঁকি।আর এই কারণেই সমস্তকিছুর ভিতরে ও যেন থেকেও নেই।আর আজকে এই ঘরোয়া অনুষ্ঠানটার ভিতরে আটকা পড়ে যাওয়ার আগেই কোনোমতে পালাতে পারলে ও বাঁচে।কাউকে কিছু টের পেতে না দিয়েই তাড়াতাড়ি করে জামাপ্যান্ট গলিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ও।গাড়ি স্টার্ট দিল আর একেবারে সায়নের ফ্ল্যাটের দোরগোড়ায় পৌঁছে তারপর ও থামল।এত সকাল সকাল সায়নও ঘুম থেকে উঠে পড়েছে।ওর মতো গা ছাড়া একটা ছেলে...যে কিনা বেলা আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমোয়...তার মধ্যে এমন সিরিয়াসনেস দেখে বেশ নিশ্চিন্ত হল কুন্তল।বসবার ঘরের ভিতরে পৌঁছোনোর সাথে সাথে কোনো চা কফির ভনিতা না করেই সায়ন বলল..."শোন কুন্তল...এখান থেকে জলখাবার খেয়ে নিয়ে তুই থানায় চলে যা।সেখানে আজ তোর যাওয়ার দরকার আছে।আমাদের কাজটা করবার সময় হল রাত।গভীর রাতে একটা নির্জন ফাঁকা জায়গায় পৌঁছতে হবে আমাদের দুজনকে।আমি কাল অনেক্ষণ সময় নিয়ে ওই ফটোফ্রেমটা নেড়েঘেঁটে যা পরিকল্পনা করবার...সেটা করে নিয়েছি।আর শোন...আমাদের এই কাজটা করতে হলে মাথা একদম শান্ত আর ঠান্ডা রাখতে হবে।কাজেই থানা থেকে বেরিয়ে আজ আর তোর নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে কাজ নেই।কাকিমা আমাকেও নিমন্ত্রণ করেছিলেন সপরিবারে আসবার জন্য।কাজেই আজ যে ওখানে যথেষ্ট হৈ হুল্লোড় হবে...সেটা আমার বুঝতে বাকি নেই।আজ ওসবের মধ্যে না গিয়ে তুই থানা থেকে সোজা এখানে চলে আসবি।তারপর আমরা আমাদের কাজে বেরোব।জায়গা টায়গা আমার সব ঠিক করা আছে বুঝলি!
যেমন কথা...তেমন কাজ।সকালের জলখাবারের ব্যবস্হা আগে থেকেই করে রেখেছিল সায়ন।দুইজনে মিলে তাড়াতাড়ি করে ব্রেকফাস্টটা সেরে নিল।আর খেতে খেতেই কথাবার্তা সব হয়ে থাকল।থানা থেকে ফিরে কুন্তল সোজা চলে আসবে সায়নের ফ্ল্যাটে তারপর দুজনে একসাথে বেরোবে হাওড়া স্টেশনের দিকে।তারপর দুজনে মিলে রওনা দেবে পুরুলিয়া...সায়নের পিসির বাড়িতে।সায়নের পিসি এখন বেঁচে নেই।উনি সায়নের বাবার থেকে বয়সে অনেকটাই বড় ছিলেন।দেহ রেখেছেন বহুদিন আগেই।পিসতুতো দাদা পিসেমশাইকে নিয়ে বিদেশে...তার কর্মস্হলে রয়েছে...আর সেখানেই বাবার চিকিৎসা করাচ্ছে।অথর্ব বৃদ্ধকে আর জীবনের বাকি দিনগুলো নিজের পৈতৃক ভিটেতে ফিরে একাকীত্বের অসহায়তা নিয়ে কাটাতে হয় না।কাজেই বাড়িখানা বহু বছর যাবৎ পুরোপুরি ফাঁকা পড়ে রয়েছে বেওয়ারিশ সম্পত্তির মতো।ওই বাড়ির চাবি তাঁরা সায়নের বাবার কাছে গচ্ছিত রেখেছেন।সেই চাবি ঘরের কোথায় আছে...সেটা সায়নের অজানা নয়।জনবিরল ধূ ধূ ফাঁকা প্রান্তরে জঙ্গলে ছাওয়া ওই বাড়িখানিই এখন ওদের এই কাজের জন্য দরকার।রাতে থাকা...এবং খাওয়াদাওয়ার কোনো অসুবিধাই হবে না...কারণ রান্নাটা ভালোভাবেই জানে সায়ন।কুন্তল আজই থানায় গিয়ে তিনদিনের মতো ছুটির ব্যবস্হা করে নেবে।তারপর ঘরে গিয়ে সবার চোখের আড়ালে প্রয়োজনের কিছু জিনিস গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসতে হবে।পৌঁছতে হবে হাওড়া স্টেশনে।আর সেখানেই সায়নের সাথে মিট করে নিয়ে তারপর দুজনে একসাথে রওনা দেবে।কাজ থেকে তিনদিনের ছুটির ব্যবস্হা করে নিতে পারবে কুন্তল।কিন্তু সমস্যাটা নিজের ঘরেই হবে।ওর সাফল্যকে ঘিরে এমনিতেই ওর পরিবার যখন খুশির উৎসবে মেতে রয়েছে...তখন ওর এমন গা ছাড়া মনোভাবে বিস্ময়সূচক প্রশ্ন নিয়ে এমনিতেই যেন সবাই মিলে ওকে চেপে ধরছে প্রতিনিয়ত...আর প্রতিনিয়তই সেগুলোর সাথে যুঝে চলেছে কুন্তল।আজ যখন ওকে উপলক্ষ করে ঘরে অনুষ্ঠান চলছে...তখন ওঁদের চোখ এড়িয়ে চোরের মতো চুপিচুপি বেরিয়ে আসাটা যে কি কষ্টের সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝেছে কুন্তল।সারাটাদিন ঘরে ওর অনুপস্হিতির পরে একবার ঘরে ওকে ঢুকতে র
দেখলে তো সবার আগে হাজারটা প্রশ্নবাণ এমনভাবে ওকে এসে তাক করবে...যে থানায় দুঁদে পুলিশ অফিসার হলেও সেখানে ও পুরোপুরি আসামীতে রূপান্তরিত হবে।আর তারপর ফের ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে নিয়ে তিনদিনের জন্য বেরিয়ে আসাটা তো আরো চাপের ব্যাপার হয়ে যাবে।সমস্ত পরিস্থিতিটাকে ম্যানেজ করে হাওড়া স্টেশনে আসতেই হবে ওকে।সমস্ত পরিকল্পনা সেরে নিয়ে...আসন্ন সমস্ত পরিস্থিতি ম্যানেজ করে নির্দিষ্ট সময়ে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছনোর যাবতীয় ছক কুন্তল নিজের মনে সাজিয়ে নিল খুব অল্প সময়ের ভিতরেই।তারপর থানায় গেল।রাত দশটার পর পা রাখল নিজের ফ্ল্যাটে...তখন অতিথিরা সবাই চলে গিয়েছে।বাবা মায়ের হাজারো অভিযোগ আর প্রশ্নচিহ্ন হতে কোনোমতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ক্লান্তির অজুহাত দেখিয়ে কোনোমতে পা রাখল নিজের ঘরে।আর ঘরের দরজা বন্ধ করেই ওয়ার্ড্রোব খুলে অল্পকিছু জিনিসপত্র নিয়ে একটা ছোট্ট ব্যাগ প্যাক করে ফেলল।তারপর একটা কাগজ কলম নিয়ে পড়ার টেবিলে বসল।খসখস করে কলম দিয়ে লিখল..."মা...একটা কারণবশত তিনদিনের মতো আমাকে ঘরের বাইরে থাকতে হবে।ফিরে আসবার পরে তোমায় সবটা খুলে জানাব।আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না...ঘরের সবাইকে কথাটা জানিয়ে দিও।আর আমার প্রণাম নিও।"
তারপর কাগজখানা টেবিলের একেবারে মাঝ বরাবর খোলা অবস্থায় রেখে...ভিতর থেকে ঘরের দরজাটা খুলে দিল।ঘরের সবাই তখন ঘুমিয়ে গিয়েছে।কিন্তু ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরের আলোটা জ্বাললে বাড়ির চাকর শম্ভুদা টের পেয়ে যাবে।কাজেই আর কোনো উপায় না দেখে...কাঁধে ছোট্ট ব্যাগখানি চাপিয়ে ও চলে গেল নিজের ঘরের ব্যালকনির দিকে।আর তারপর ব্যালকনি বেয়ে নীচে নামতে থাকল পেশাদার চোরের মতো।নীচে পৌঁছোনোর গাড়ি না নিয়েই একটা ক্যাব ডেকে নিয়ে রওনা দিল হাওড়া স্টেশনের দিকে।ঠিক সময়ের মধ্যে পৌঁছতেই হবে।নইলে আজকের ট্রেনটা মিস হয়ে যাবে।
একদম ঠিক সময়ে দুই বন্ধু হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছল।রাতের ট্রেন ধরে সময়মতো এসে পৌঁছাল বাঁকুড়া স্টেশনে...আর তারপর সেখান থেকে ভ্যানরিক্সায় করে বেশ কিছুটা পথ।সায়নের নির্দেশ মতো ভ্যানরিক্সাটি নির্দিষ্ট পথ পেরিয়ে এসে পাহাড়ী জায়গায় জঙ্গলে ছাওয়া নির্জন জায়গায় আগাছায় মুড়ে থাকা জীর্ণ একখানি বাড়ির সামনে এসে থামল।বাড়িটাতে যে বহুযুগ কোনো মানুষের পা পড়েনি...তা বাড়িটার চেহারা দেখে বুঝতে বাকি থাকে না।একটা দিনের জন্যই এখানে থাকতে আসা...।তাই আর আগাছা জঙ্গল সাফ করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করবার ঝামেলার মধ্যে গিয়ে আর সময় নষ্ট করল না ওরা।তালা খুলে ঘরের ভিতরে ঢুকে রাতটুকু কাটানোর মতো বন্দোবস্ত করে নিল।খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্তও সেরে রাখল।চারপাশটা এক্কেবারে নির্জন।সায়ন চারপাশটা ভালো করে দেখে মনে মনে একটা আত্মতৃপ্তি অনুভব করল।এমন জায়গাই তাদের দরকার ছিল।ক্রমে দিনের আলো ম্লান হতে থাকল।তারপর এক সময়ে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল।অন্ধকার
যত গাঢ় হতে থাকল...চারপাশে তত বাড়তে শুরু করল ঝিঁঝিঁ পোকা আর শিয়ালের মহোল্লাস।বাড়িখানায় দীর্ঘদিন ধরে কেউ না থাকায় এখানকার সাথে বিদ্যুতের সংযোগটাও বহুদিন ধরে বিচ্ছিন্ন।অবশ্য সেটা ওদের অসুবিধার কারণ মোটেই নয়।ওদের তো এমন জায়গা...আর এমন পরিবেশই দরকার।ক্রমে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত ঘন হতে শুরু করল।রাতের খাবার জন্য রুটি আর কষা মাংস অন্ধকার নামার আগেই কিনে নিয়ে এসেছিল ওরা দুজনে।রাত নটা নাগাদ রাতের খাওয়ার পাট পুরোপুরি চুকিয়ে নিল দুজনে।খাওয়াদাওয়া সেরে হাতমুখ ধুয়ে...তারপর অন্ধকার ঘরের ভিতরে ব্যাটারির একটা ছোট্ট...মৃদু আলো জ্বালিয়ে বসে রইল রাত আরো গভীর হওয়ার অপেক্ষায়।কি যে হতে চলেছে...তা ওরা কেউই জানে না।ঠিক ভয় নয়...একটা অদ্ভুত ছটফটানি মিশ্রিত উদ্বেগ ওদের দুজনকেই ক্রমশ বিচলিত করে চলেছে।আঙুলে নখ খুঁটিতে খুঁটতে এখন দুজনের অপেক্ষা একটাই।ঘড়ির ভিতরের দুটি কাঁটাই কখন বারোটার ঘরে এসে একত্রিত হবে।
ক্রমে ঘরের ভিতরে বসে থাকতে আর ভালো লাগছিল না ওদের।একটু হাওয়া বাতাস পাওয়ার জন্য ঘরের বাইরে বেরোল ওরা।চারদিকে শুধুই জঙ্গল আর জঙ্গল।চারপাশটা যত দেখছে...ততই সায়নের একটাই কথা মনে হচ্ছে।পিসেমশাই আর ঘর করবার জায়গা পেলেন না...!
বেশ কিছুক্ষণ ধরে ওরা চারপাশে পায়চারি করতে থাকল।দুজনের কারোর মুখে কোনো কথা নেই।নির্জন পরিবেশে দুই বন্ধুর ভিতরের তোলপাড় চিন্তা...নৈঃশব্দ পরিবেশটাকে যেন আরো গা ছমছমে করে তুলেছে।কুন্তল একটা চিন্তায় মগ্ন।প্রিয়াংশু বাবুর ফাঁসির দিন যত এগিয়ে আসছে...ততই ওর মনে হচ্ছে...বৃষ্টি নামের ওই হতভাগ্য মেয়েটাকে খুঁজে...একবার ওর সামনাসামনি হওয়াটা খুবই দরকার।এই রহস্যাবৃত ফটোফ্রেমটা যার হাতে পড়ার ফলপ্রসূ জটিলতা এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে...একবার তার সামনাসামনি হওয়াটা খুবই দরকার।হঠাৎ কুন্তলের কাঁধে একটা হাত পড়ল।মায়াবী চাঁদের আলোতে সায়নের চিন্তিত মুখখানি দেখল কুন্তল।সায়ন বলে উঠল..."এখন যেটা ভাবছি...তুইও কি সেটাই ভাবছিস!"
দুজনের চিন্তাটা কোথায় যেন এক হয়ে গেল।কুন্তল দেখল...ফটোফ্রেমখানি সায়ন নিজের ডানহাতে ধরে রয়েছে।দুজনেই এখন বৃষ্টির কথা ভাবছে।দুজনের মধ্যে একজন বৃষ্টিকে সামনাসামনি দেখেছে...আর অন্যজন তার হতভাগ্য জীবনকাহিনী শুনেছে।রাত যে গভীর হয়ে গিয়েছে সেটা ওদের খেয়াল নেই।দুজনে দুজনের চোখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।ভাবছে একজনেরই কথা।সে আর কেউ নয়...বৃষ্টি।ঠিক সেই সময় সায়ন নিজের ডানহাতে একটা কিছু অনুভব করল।ও সাথে সাথে হাতখানা সামনে এনে দেখার চেষ্টা করল।নির্জন জঙ্গলের মায়াবী নৈঃশব্দ্যতার ভিতরে মায়াবী চাঁদের আলোয় এবার ওরা দুজনেই স্পষ্ট শুনতে পেল একটা নারীকন্ঠের যন্ত্রনাক্লিষ্ট চাপা গোঙানি।ওই শব্দ যে সায়নের হাতে ধরা ফটোফ্রেমটার ভিতর থেকেই বেরিয়ে আসছে...এই বিষয়ে ওদের দুজনেরই এখন কোনো সন্দেহ নেই।
চারপাশে আগাছায় ছাওয়া জঙ্গল আর কিছু বড় বড় গাছ।সেগুলির পাতা ঝরে গিয়েছে।গাছগুলোর ন্যাড়া ডালপালার ফাঁকফোকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে মায়াবী চাঁদের জ্যোৎস্না।হতচকিত দুই বন্ধু এখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে।দুজনের সম্মিলিত চিন্তা এখন যাকে নিয়ে সে এখন যেন তেড়েফুঁড়ে প্রবলভাবে উজ্জীবিত হয়ে উঠছে।ওর ভিতরে চেপে থাকা দীর্ঘদিনের যন্ত্রনা...কান্নাগুলো যেন আকাশে...বাতাসে...চাঁদের মায়াবী জ্যোৎস্নার সাথে যন্ত্রনাক্লিষ্ট সুরের মূর্ছনায় বাজতে থাকা ভায়োলিনের ধ্বনির মতো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।সায়ন ওর হাতে ধরা ফটোফ্রেমটা এবার একেবারে সামনে এনে ধরল।ওই আলোআঁধারি মায়াবী জ্যোৎস্নার রাতে দুই বন্ধু স্পষ্ট দেখল...হিংস্র জান্তব কারুকার্যের ওই স্বদন্তের হাঁয়ের ভিতরে প্রিয়াংশুবাবুর প্রতিকৃতিখানি একেবারে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হয়ে ফটোর একটা কোণায় স্হান পেয়েছে।আর ফটোর পুরো জায়গাটা জুড়ে জেগে উঠেছে এক যন্ত্রনাক্লিষ্ট আর রক্তাক্ত যুবতী মেয়ে।মেয়েটা এই ফটোফ্রেমের ভিতরে ক্রমশ জীবন্ত হয়ে উঠছে।ওর দুই চোখ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে টাটকা রক্তের ধারা ওর যন্ত্রনাক্লিষ্ট আর্তনাদে যেন এখানকার সমস্ত আকাশ বাতাস কেঁদে উঠছে।এই মেয়াটাকে বিলক্ষণ চেনে সায়ন।এই মেয়েটা আর কেউ নয়।এই মেয়েটাই তো বৃষ্টি।যে মেয়েটা কারণে অকারণে চলে আসত সায়নের দোকানে...আর টাকাপয়সার থলি ইচ্ছামতো উপুড় করে...ছড়িয়ে ছিটিয়ে ওর দোকান থেকে কিনে নিয়ে যেত এটা ওটা অ্যান্টিক জিনিসপত্র।মেয়েটার দুচোখ উপচে আসায় মরিয়া যন্ত্রনাগুলো যখন সে মোলায়েম হাসি দিয়ে ঢেকে দিত...সেদিনও ওর লুকিয়ে থাকা অশ্রু দেখতে পেয়েছিল সায়ন।ও জানত সমস্তকিছু।কিন্তু আজ সেই মুখটাকে যে এভাবে দেখতে হবে...সেটা ও দুঃস্বপ্নেও কখনো ভাবেনি।অস্ফুটে ওর গলা থেকে ভয়ার্ত কন্ঠে একটাই শব্দ ভেসে উঠল।
"বৃষ্টি ম্যাডাম...আপনি!"
সায়নের ওই কথাটা শোনামাত্র যেন পায়ের তলা থেকে জমি সরে গেল কুন্তলের!যুক্তি তর্ক...বাস্তব...অবাস্তব...
সমস্তকিছু যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে উঠল ওর ভিতরে।প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে ও যখন ফটোফ্রেমটার সায়নের হাত থেকে নিজের হাতে নিয়ে সেটার ওপরে একেবারে ঝুঁকে পড়ল...তখন ফটোফ্রেমের ভিতরে যে মেয়েটির অবয়ব ও দেখতে পেল...তা দেখে এবার যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না কুন্তল।যে রাতে প্রিয়াংশু বাবু থানায় এসেছিলেন নিজের স্বীকারোক্তি পেশ করার জন্য...ওইদিন তাঁকে আপাদমস্তক লক্ষ্য করেছিল কুন্তল।ওঁর গলার কাছে একটা ছোট্ট গর্ত ছিল যার আকৃতিটা মানুষের হুবহু মাথার খুলির মতো।কোনো মানুষের চামড়ায় কোনো খুঁত বা সেরকম কোনোপ্রকার গর্ত থাকাটা স্বাভাবিক ব্যাপার।কিন্তু সেটার অমন আকৃতি হলে....সেটা কাকতালীয় হলেও বেশ আশ্চর্যজনকই বটে।চাকরি জীবনে শনাক্তরণের ক্ষেত্র ওর এসেছে বহুবার।আর সেই সুবাদে মানুষের শরীরের বিভিন্ন প্রকার তিল বা ছোটখাটো দাগ...এইসবের সাথে কুন্তল ভালোই পরিচিত।কিন্তু এর আগে কুন্তল কারোর শরীরে এমন অদ্ভুত দর্শন চিহ্ন কখনো দেখেনি।সেদিন প্রিয়াংশু বাবুর গলা লক্ষ্য করে যখন কুন্তল তাঁর ত্বকে এই গর্তটা দেখেছিল...বেশ আশ্চর্যই লেগেছিল ওর।কিন্তু ওই একই গর্ত আজ এই মেয়েটির গলার ওই একই জায়গায় যখন দেখল...তখন দুয়ে দুয়ে চার করে যে ভয়ঙ্কর সত্যটা ওর সামনে কম্পমান হয়ে দুলে উঠল...তাতে কুন্তলের শিড়দাঁড়া দিয়ে একটা হিমশীতল স্রোত নেমে গেল।আর তার প্রায় সাথে সাথেই ফটোফ্রেমের ভিতর থেকে বৃষ্টি বলে উঠল..."হ্যাঁ কুন্তল বাবু...আপনি যা ভাবছেন সেটাই ঠিক।আমাদের আগেই দেখা হয়েছিল...সেই প্রবল ঝড়জলের রাতে...যেদিন আপনি আমার মুখে শুনেছিলেন প্রিয়াংশুর যাবতীয় পাপের স্বীকারোক্তি।
অপার বিস্ময়ে...কুন্তলের মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বেরোচ্ছে না।তার মানে প্রিয়াংশু বাবু বার বার করে কাতরভাবে সমানে বোঝানোর চেষ্টা করে গিয়েছেন...ওই স্বীকারোক্তি আদৌ তাঁর ছিলই না...আর তাঁর অনুসঙ্গিক বাকি সমস্ত কথা শুনে সকলেই এক কথায় বলেছিল...উনি ওনার মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন আর গাঁজাখুরি গালগল্প বলছেন...তা যে কতখানি ভ্রান্ত...এটার জলজ্যান্ত প্রমাণ এখন এইভাবে তাদের হাতের তালুতে।সবকিছুকেই যে ওইভাবে সাদা কালোর মতো..."এটা হতে পারে আর ওটা হতে পারে না" র মতো দুটি ভাগে ভাগ করে নিতে পারে না বলে এমনিতেই সায়নকে চারপাশের সমস্ত লোকজন একটা ইউজলেস লুজার বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে।অথচ ও এমন অনেক কিছু দেখতে...শুনতে বা বুঝতে পারে...যা আর পাঁচটা লোকে পারে না। সায়নই প্রথম বুঝেছিল...এটা কোনো সাধারণ কারুকার্যখচিত একটা নিরীহ ফটোফ্রেম নয়।এর ভিতরে এমন কোনো গূঢ় রহস্য আছে...যা বুঝতে হলে একটা অন্য লেভেলে নিজেকে নিয়ে যেতে হয় যেটা সবার পক্ষে সম্ভব নয়।আজ নিজের এমন অযাচিত সাফল্যটাকে সেলিব্রেট না করে কুন্তল চলে এসেছে এই জলাজঙ্গল ছাওয়া...মানুষের বাসের অযোগ্য এই জনমানবশুন্য বাড়িতে...কারণ কুন্তলও বুঝেছিল...প্রিয়াংশু বাবু অপরাধী অবশ্যই...কিন্তু তিনি একটা বর্ণও বানিয়ে মিথ্যা বলছেন না।কুন্তল আর সায়ন এবার দুজনই সমানভাবে জানতে উৎসুক...যে আসল ব্যাপারটা কি!
ওদের দুই বন্ধুর চোখের ভাষা এক লহমায় পড়ে ফেলল ফটোফ্রেমের ভিতরে বন্দিনী বৃষ্টি।ও আলতো স্বরে বলে উঠল..."বলব...বলব...আমি তোমাদের সবটাই খুলে বলব।আমি তো ভেবেছিলাম আমার আর কোনোদিনই মুক্তি হবে না।কারণ নির্জন জায়গা না হলে আমার পক্ষে জেগে ওঠা অসম্ভব।তো আমি কার কাছে আমার মুক্তির জন্য ভিক্ষা চাইব!তোমরা দুজনে এত কষ্ট করে এত ঝামেলা পুইয়ে আমাকে এখানে এনেছ বলেই আমি জেগে উঠতে পারলাম।তোমাদের আজ আমি সবটাই খুলে বলব।কিন্তু আমাকে তোমরা দয়া করে একটা কথা দাও...""
অস্ফুট স্বরে কুন্তলের মুখ থেকে এবার মৃদু কয়েকটি শব্দ বেরিয়ে এল।
"কি কথা বলো...আমরা চেষ্টা করব তোমার কথা রাখার।"
---আমার কথা শেষ হওয়ার পরে তোমরা এই ফটোফ্রেমটাতে আগুন ধরিয়ে এটাকে পুড়িয়ে দেবে।আগুনের ওই ধোঁয়ার সাথেই মুক্তি হবে আমার।আমার এই কথা তোমরা রাখবে তো...বলো...!"
এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল ওরা দুজন।তারপর সায়ন বলল..."আপনি যা চান...আমরা তাই করব বৃষ্টি ম্যাডাম...কথা দিলাম।এবার আপনি দয়া করে খুলে বলুন...পুরো ঘটনাটা আসলেই কি"
পিনপতনের শব্দের নৈঃশব্দ্যতায় কাটল কয়েক মূহুর্ত।তারপর নির্জন মায়াবী রাতের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায় স্নাত নৈঃশব্দ্য ভেঙ্গে এবার ফটোফ্রেমের ভিতর হতে বৃষ্টির বিদেহী আত্মা কথা বলা শুরু করল।
"এই ফটোফ্রেমটা আমি প্রথম দেখি সায়ন বাবুর দোকানে।ওই সময়ে আমি যে কি যন্ত্রনার ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলাম...সেটা এক ঈশ্বর আর আমি ছাড়া আর কারোর পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়।প্রিয়াংশু যে আমাকে এবং আমার ভালোমানুষ বাবাকে ঠকিয়েছে...সেটা তখনও এই এক আমি ছাড়া বাকি প্রত্যেকেই বুঝে গিয়েছিল।বাবা তো শুধুমাত্র আমার জন্যই ওর মতো জোচ্চরকে পুলিশে দেওয়ার বদলে দিন নেই রাত নেই ভিখারির মতো প্রায় ওর পায়ের কাছে পড়ে থাকতেন যদি ও আমাকে বিয়ে করে...চতুর্দিকে ঢি ঢি পড়ে যাওয়া আমাদের এই সম্পর্কটাকে একটু সামাজিক স্বীকৃতি দিয়ে আমাকে লোকলজ্জার হাত থেকে বাঁচায়।আমার ভবিষ্যৎ জীবনটা যাতে কোনো একটা দিশা পায়...।
আমি তখন প্রিয়াংশুর প্রেমে পুরোপুরি অন্ধ।যখন দেখলাম ও আমাদের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে এখানে...তখন অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে খুঁজে খুঁজে আমি চলে এলাম ওর ফ্ল্যাটে।না।সেদিন ও আমাকে ফিরিয়ে দেয়নি।ও বলেনি...তুমি এখান থেকে চলে যাও।আমিও আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে এনে ওর ওই ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করলাম পাকাপাকিভাবে।ওর হবু স্ত্রী হিসেবে।মনে মনে আমি ভেবে নিয়েছিলাম...সমস্ত দিকটা আর একটু গুছিয়ে নিয়ে খুব শীঘ্রই ও আমাকে বিয়ে করবে।ওই ফ্ল্যাটটাকে আমি পুরোপুরিই নিজের সংসার ভাবতাম...আর একজন গৃহিনী ঠিক যেভাবে নিজের সংসারটাকে যত্ন করে...আগলে রাখে...সাজায় সুন্দর করে...আমিও ঠিক তাইই করতাম।কিন্তু যত দিন এগোতে থাকে...ততই আমি বুঝতে পারি ওর ফ্ল্যাটে আসলেই আমার স্হান একটা রক্ষিতা এবং বিনা মাইনের ঠিকে কাজের লোকের বাইরে আর কিছুই নয়।আর ওর ভিতরের জন্তুটা ক্রমেই আত্মপ্রকাশ করতে থাকে আর আমার ওপর আস্ফালন দেখাতে থাকে।এই বাড়িতে একটা আবর্জনা চাইতে বেশি মর্যাদা যে আমার নয়...এটা আমি বুঝে যাই খুব শীঘ্র।যাকে নিংড়ে শুষে ব্যবহার করা যায় ইচ্ছামতো।আমার মন ভাঙতে শুরু করে।কিন্তু তাও...জীবনে প্রথম যাকে নিজের সর্বস্ব উজাড় করে ভালোবাসলাম...তাকে কিছুতেই ছেড়ে চলে যেতে পারতাম না।আমি ওর মতি ফেরার অপেক্ষা করতাম।শুধুই অপেক্ষা...!"
আর আমার সব ধৈর্য...সমস্ত ভালোবাসার উত্তর হিসেবে শুধুই পেতাম মনুষ্যেতর অসম্মান আর নির্যাতন।হ্যাঁ।প্রিয়াংশুর ওই ফ্ল্যাটে যে ঠিকে কাজের লোকটি আসত...তার জায়গাও সেখানে আমার চাইতে সম্মানের ছিল।কারণ আমি সেখানে ছিলাম প্রিয়াংশুর পা ধরে পড়ে থাকা আশ্রিতা...এবং রক্ষিতা।প্রতিনিয়ত ও আমাকে ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিত...যে এখানে এর থেকে বেশি মর্যাদা তোমার প্রাপ্য নয়।হ্যাঁ...আমি ওই ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠেছিলাম প্রিয়াংশুর হবু স্ত্রী হিসেবেই...যাকে আজ না হোক কাল...বিয়ে করে তার সাথে ঘর বাঁধবে ও।কিন্তু দিনে দিনে আমি বুঝতে পারি...এই ফ্ল্যাটের ভিতরে তো বটেই...গোটা সমাজের সামনে আমাকে ওর রক্ষিতা হয়েই থাকতে হবে।এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ার আর কোনো আশাই অবশিষ্ট নেই।যেভাবে ও ফ্ল্যাটের ভিতরে আমার সাথে ওর ব্যক্তিগত ক্রীতদাসীর মতো ব্যবহার করত আর বাইরে লোকের সামনে ও উঠতে বসতে আমাকে অপমান করত...তাতে আমাকে ওর আলাদা করে সরাসরি এটা বলবার প্রয়োজনই ছিল না...যে তুমি চলে যাও এখান থেকে।আমার ঘরে ও জীবনে তোমার কোনো জায়গাই নেই।তোমাকে আমার ব্যবহার করা সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে...তো এখন তুমি একটা ছিবড়ে বই আর কিছুই নও।
কিন্তু তাও আমি ওকে ছেড়ে চলে যেতে পারিনি।জানতাম...এখানে আর থাকা র অর্থ শুধুই নিজের বাকি জীবনটাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া।তাও ছিলাম ওইভাবে পড়ে।তবে হ্যাঁ...ওখানে আমার বিন্দুমাত্র মান ইজ্জত না থাকলেও...আর্থিক দিক থেকে কোনো অভাব সেখানে আমার ছিল না।ওর একটা আলমারিতে ফ্ল্যাটের খরচ চালানোর জন্য টাকাপয়সা কিছু রাখা থাকত।সেই টাকার পরিমাণ ছিল প্রচুর আর ওখান থেকে ইচ্ছামতো টাকা নিজের হাতে নেবার অনুমতি ছিল আমার।আমি জানতাম...আমার জায়গায় হতদরিদ্র ঘরের কোনো মেয়ে যদি থাকত...তাহলে এটাকেই ওর সারাজীবনের সবচাইতে বড় পাওয়া বলে মনে করত।মান সম্মানের পরোয়া আদৌ করত না।কিন্তু আমি সেখানে প্রতি মূহুর্তে একটু একটু করে মরছিলাম।সরাসরি আত্মহত্যা না করে তিল তিল করে ওর কাছে পড়ে থেকে নিজেকে শেষ করছিলাম আমি।ওই সময়ে...যখন প্রিয়াংশু অফিসে বেরিয়ে যেত...তখন ওই পুরো সময়টাই আমি ওই বিশাল ফ্ল্যাটটায় একা থাকতাম।সময় কাটত না একেবারেই।হাতে কিছু টাকা নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়তাম।বারে গিয়ে মদ খেতাম...আর কখনো চলে যেতাম সায়ন বাবুর অ্যান্টিকের দোকানে।ওখান থেকে ইচ্ছামতো জিনিসপত্র কিনতাম।এইভাবে কাটছিল দিন।ওই সময়েই হঠাৎ একদিন সায়নবাবুর দোকানে আমি একটা অদ্ভুত দর্শন আইভরি ফটোফ্রেম দেখতে পাই।ওইরকম কারুকার্যের ফটোফ্রেম আমি আগে কোনোদিন দেখিনি।যতটা সুন্দর...ঠিক ততটাই ভয়ঙ্কর।আমার ওটাতে চোখ পড়বার সাথে সাথেই মনস্হির করে ফেলি...আজকে ওইটাই কিনব আমি।
যেমন ভাবা তেমন কাজ।কেনার সময়ে সায়নবাবু বারংবার আমার মনোযোগ অন্য জিনিসের দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিলেন সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম যদিও...কিন্তু ওনার কথায় আমি আমল দিইনি একেবারেই।আমি আমার পছন্দের জিনিসটা নিয়ে চলে এসেছিলাম ঘরে।ছোটবেলায় বেশ দীর্ঘ সময়ের জন্য আমাকে ইজিপ্টে থাকতে হয়েছিল।ওখানে থাকাকালীন নিজের আগ্রহেই আমি মিশরীয় ভাষার ওপর বেশ ভালোরকম পড়াশোনা আরম্ভ করে দিই।আর তার ফলে মিশরীয় ভাষা আমার আয়ত্তের মধ্যে আছে।এই কারণেই...এই ফটোফ্রেমটার একেবারে নীচের দিকে ছোট্ট ছোট্ট করে লিখে রাখা কিছু অক্ষর যেগুলো অন্যদের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকবে...সেটা আমি অতি সহজেই পড়ে ফেলি।আর তার থেকেই আমি জানতে পারি এই ফটোফ্রেমটার সাথে জড়িত ভয়ঙ্কর কিছু তথ্য।
সুদৃশ্য এই ফটোফ্রেমটি আসলেই একটি গুপ্ত পৈশাচিক শক্তির পার্থিব আবরণ।ফটোফ্রেমটি তৈরি করার পরে এটির ভিতরে তন্ত্রসাধনার দ্বারা বন্দী করা হয়েছে একটি হিংস্র জানোয়াররূপী পিশাচ,যার হিংস্রতা এতটাই বর্বরোচিত...আর নৃশংসতা এতটাই নির্মম...যে এই পিশাচের নাম যে শুনত...তারই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠত।মিশরের এক তান্ত্রিক ওই পিশাচকে তন্ত্রসাধনার মাধ্যমে এই ফটোফ্রেমের ভিতরে বন্দী করতে সক্ষম হন।এই ফটোফ্রেমটি তৈরি হয়েছে হিংস্র জানোয়ারসদৃশ ওই পিশাচের মুখেরই আদলে।যার হিংস্র স্বদন্তের ভিতরে রয়েছে ফটো রাখার জায়গা।এ প্রায় একশো বছর আগেকার ঘটনা।ওই সময়ে পিশাচটিকে এই ফটোফ্রেমের ভিতরে বন্দী করার পরে তান্ত্রিক নিদান দেন...কোনো মানুষের শিরশ্ছেদ করার পরে ওই রক্তকে এই ফটোফ্রেম স্পর্শ করলে তখনই ফের জেগে উঠবে সেই পিশাচ এবং তারপর সে বলিদাতার আজ্ঞাবহ দাস হয়ে উঠবে।আর যদি এই পিশাচ শিরশ্ছেদের রক্তের স্বাদ পেয়ে একবার জেগে ওঠে...তাহলে বলিদাতার... তাকে নিজের দাস হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে নিজের ইচ্ছামতো।এই দুনিয়ায় তার অসাধ্য বলতে আর কিছুই থাকবে না।
আমি ফটোফ্রেমের নীচে ছোট্ট ছোট্ট অক্ষরের লেখাগুলো পড়ে বুঝতে পারি সবই।কিন্তু তখন আর এইসব নিয়ে আর খুব বেশি মাথা ঘামাই না।শুধু আমার কেন জানি না মনে হয়েছিল...জিনিসটাকে গোপনে মুড়ে ভিতরে রেখে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।আমি ওটাকে আবার আগের মতো করেই প্যাকেট মুড়েটুড়ে রেখে দিলাম আলমারিতে আমার জামাকাপড়ের ভিতরে।তারপর মদের বোতল আর গ্লাস নিয়ে বসে পড়লাম।রাতে প্রিয়াংশু অফিস থেকে ফেরার পর আমার জন্য যে অকথ্য শারীরিক অত্যাচার অপেক্ষা করে রয়েছে...আমাকেও তো তার জন্য শরীরে মনে প্রস্তুতি নিতে হবে...!
ব্যস... সেদিনের পরে আমিও প্রায় এটার কথা প্রায় ভুলেই বসেছিলাম।দিন যেতে থাকল।আর যত দিন যেতে থাকল...প্রিয়াংশু আমার সঙ্গে ততোধিক কদর্য ব্যবহার আরম্ভ করে দিল।ও এটা ধরেই নিয়েছিল...যে আমি ওর বেডরুমের একখানি পাপোশ বই আর কিছুই না।আমার সাথে যা খুশি করা যায়।সত্যি বলতে কি...প্রিয়াংশুর ফ্ল্যাটে ওর ব্যক্তিগত রক্ষিতার পরিচয়ে থাকতাম মানে এটা কখনোই নয়...এই দুনিয়াতে কোথাও আমার কোনো জায়গা নেই।আমি দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থেকে শুধু এইটাই দেখবার জন্য পড়ে থাকতাম...যে মানুষটা একটা সময়ে নতুন করে আমাকে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছিল...সেই মানুষটাই নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়ার পর আমার সামনে নিজের অন্তঃসারশূন্য বিবেকের কাপড়চোপড় খুলে তার সমস্ত নগ্নতাকে আর কতখানি প্রকটভাবে মেলে ধরতে পারে আমার সামনে!আর কতটা নীচে ও নামতে পারে! ঠিক ওই সময়েরই ঘটনা।একটু রাতের দিকে প্রিয়াংশুর মোবাইলে একটা ফোন আসে।আমি দেখি...ফোনের রিংটোন বাজতে যখন ও ফোনটা হাতে নিল...তখন স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নম্বরটা দেখে ও অশ্রাব্য ভাষায় একটা গালাগালি দিল।তারপর আমার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে নিয়ে ফোনটা নিয়ে ও ফোন হাতে নিয়ে চলে গেল ব্যালকনির দিকে।এতক্ষণ ধরে ও যেভাবে জানোয়ারের মতো আমার ওপরে নিজের লালসা মিটিয়ে নির্যাতন করে গিয়েছে...তার ধকল বইছে আমার সারা শরীর জুড়ে।যদিও এসবে আমি অভ্যস্ত তখন...কিন্তু মোটামুটি রাতটা পেরোনোর আগে পর্যন্ত যে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা আমার থাকে না... সেটা ভালো করেই জানত ও।কিন্তু এই পুরো ব্যাপারটাই আমার একটু গন্ডগোল ঠেকল।কারণ...ওর বেডরুমের সামান্য একটা পাপোশের সামনে থেকে নিজেকে আড়াল করে নিয়ে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ওর অন্তত পড়বে না।আর দ্বিতীয়ত...কতবার ও বাইরে থেকে মেয়েদের এনে কখনো দরজা বন্ধ করে সময় কাটিয়েছে...আবার কখনো একসাথে জমিয়ে মদ্যপান করেছে।ওর অফিশিয়াল কোনো সিক্রেট আমি জেনে গেলে বিপদ এমন ব্যাপারও ঠিক নয়।তাহলে?আমাকে ব্যাপারটা বড়ই কৌতূহলী করে তুলল।সারা শরীরে বিষের মতো যন্ত্রনা নিয়েও আমি নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালাম।তারপর পা টিপে টিপে দাঁড়ালাম ওর পিছনে।আমি বুঝতে পারলাম...ও কথা বলছে আমার বাবার সঙ্গে।শুনলাম....আমার বাবাকে ও আশ্বস্ত করছে...ও বাবার সাথে এইবার দেখা ঠিকই করবে।দেখা করার জায়গাও ঠিক করে নিল।আমার কিন্তু ওর কথা বলার ধরণ একেবারেই সুবিধার লাগল না।যেভাবে অ্যাশট্রেতে সিগারেটের ছাই ঝেড়ে ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে কথাগুলো ও বলছিল...তাতে ওর বাবার সঙ্গে এই দেখা করার ব্যাপারটা যথেষ্ট গন্ডগোলের ঠেকল।আমি মনে মনে ভাবতে শুরু করলাম...আমার সাথে ও যা করে চলেছে...সেটা তো করেই চলেছে বিনা বাধায়।এখন আবার আমার বাবার সাথে কোন খেলা খেলবার ছক কষছে ও!কারণ ও যে আমার বাবার সাথে শুধু দেখা করার কথা দিচ্ছে তাই নয়...দেখা করে...আমার সাথে বিয়ের তারিখ পাকা করবে...এই বিষয়েও ও পুরোপুরি আশ্বস্ত করছে আমার বাবাকে।অথচ শুধু আমি জানি...আমার নিজের শরীর ও জীবনের সমস্ত ঘা গুলো জানে...ও কোনোদিনই আমাকে নিজের স্ত্রীর মর্যাদা দেবে না তাহলে!খটকা যখন আমার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করল...তখনই ও কথে শেষ করে ফোন কাটল।আমি সতর্ক হয়ে গেলাম।ও ফোন হাতে পিছন ঘোরার আগেই আমি একেবারে নিঃশব্দে ছুটে চলে এলাম বেডরুমে।পড়ে রইলাম মড়ার মতো।আমি টের পেলাম...ঘরে ঢুকে প্রিয়াংশু এসিটা আরো একটু বাড়িয়ে দিল।তারপর বিছানায় পরিশ্রান্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে ওও পুরোপুরি ঘুমিয়ে গেল।
কিন্তু একটা খটকা আমায় বাকি রাতটা আর ঘুমোতে দিল না।প্রিয়াংশু আমার সাথে যা করেছে...করেছে।কিন্তু আমার বাবার সাথে কোনো নোংরা খেলা খেলবার ভাবনাচিন্তা যদি ও করে...সেটা আমি কোনোমতে মেনে নেব না।আমার হাতের তালু দৃঢ়ভাবে মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে এল।পরদিন থেকে আমি প্রিয়াংশুকে লুকিয়ে সন্তর্পণে ওর প্রতিটা কাজে আর গতিবিধির ওপরে নজর রাখা শুরু করলাম।ওকে এতটুকুও টের পেতে দিলাম না...যে কেউ একজন ওকে ফলো করছে।
কিন্তু প্রিয়াংশুর মনে যে ঠিক কি চলছে...কোন লক্ষ্যকে নিশানা করে ও এগিয়ে চলেছে সে বিষয়ে তখনো পর্যন্ত আমি আঁধারেই ছিলাম।আমার বাবা যে প্রিয়াংশুর পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন...সেটা আমি বুঝতে পারি কিন্তু বুঝিনি...প্রিয়াংশু আসলেই আমার বাবাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করছে।ওর পিছু নিয়ে আমি রাতের দিকে পৌঁছে যাই একটি বড় হোটেলে...যেখানে আমার বাবার সাথে একটা ডিনার টেবিল বুক করেছিল প্রিয়াংশু।আমি বাইরে অপেক্ষা করতে থাকি।একটা বিরাট কোনো ঝড়ের আশঙ্কাতে তখন আমার হৃদস্পন্দনের গতি খুব দ্রুত হয়ে গিয়েছিল...কারণ প্রিয়াংশুর চোখেমুখে যে ক্রূর হাসি আমি দেখেছিলাম...সেটা আমার একেবারেই ভালো লাগেনি।প্রিয়াংশুর কথামতোই বাবা একাই এসেছেন ওর সাথে দেখা করার জন্য।খানাপিনার পর হোটেল থেকে দুজনে বেরোলেন।প্রিয়াংশু বাবাকে ওর নিজের গাড়িতে করেই বাড়িতে পৌঁছে দিতে গেল।আমি যে পিছনেই ছিলাম...সেটা ওদের কাউকেই বুঝতে দিইনি।আমার এক বান্ধবীর একটি স্কুটি আমি ধার চেয়ে নিয়েছিলাম কয়েকটা দিনের জন্য।মাথায় হেলমেট চাপিয়ে...ওই স্কুটি নিয়ে আমি প্রিয়াংশুর গাড়ির পিছুধাওয়া করা শুরু করলাম।আমার দৃষ্টিশক্তি খুবই বেশি হওয়ায় অনেকখানি দূরত্ব বজায় রেখেও আমি ঠিকই গাড়িটাকে ফলো করতে পারছিলাম।ওরা কেউই বুঝতে পারেনি...একটা স্কুটি ওদের অনুসরণ করছে।নির্জন রাস্তার ভিতরে দেখলাম...হঠাৎ গাড়িটা থামল।আমিও স্কুটি থামালাম।কিন্তু গাড়ির ভিতরে যে ঠিক কি হচ্ছে...ওটা কোনোমতেই ঠাহর করে উঠতে পারলাম না।কি ব্যাপার!অমন নির্জন হাইওয়ের ওপর এইভাবে এতক্ষণ ধরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখার মানে কি!মানেটা যে আসলেই কি...সেটা তখন বোধগম্য হতে আমার অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল তাই সবকিছু চোখের সামনে হওয়া সত্ত্বেও আমি কোনোকিছুকেই আর আটকাতে পারলাম না।গাড়ি ফের স্টার্ট নিল।আমিও সন্তর্পণে গাড়িটাকে ফলো করতে থাকলাম।আরো বেশ খানিকটা এগোনোর পর গাড়ি আবার থামল।তারপর খুলে গেল গাড়ির দরজা।আর তারপর যে দৃশ্য আমি দেখলাম...তাতে আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল।প্রিয়াংশু আস্তে আস্তে করে ধরে ধরে গাড়ির দরজা দিয়ে বার করে আনছে বাবার নিথর দেহখানি।তারপর রাস্তায় ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে আবর্জনার মতো দেহটা তার ভিতরে নিক্ষেপ করল।তারপর সন্তর্পণে চারপাশটা ভালো করে দেখে নিয়ে ম্যানহোলের ঢাকনাটা ফের লাগিয়ে দিল।একটা গাছের আড়াল থেকে ওই দৃশ্য দেখার পর আমার যেন মাথা কাজ করা ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।ও যে বাবাকে বেশি করে মদ খাইয়ে...তারপর শ্বাসরোধ করে খুন করেছে...এই ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহই নেই।বিনা রক্তপাতে ঝামেলা মিটিয়ে নিয়ে হাত ঝেড়ে ও যখন ফের গাড়িতে উঠতে যাবে...তখন হঠাৎ ওর একটা কিছু মনে হতে...ও গাড়ির ডিকি বন্ধ করে খানিকটা দূর এগিয়ে গেল।আমি দেখলাম...একটা প্লাস্টিকের ছাউনির ভিতরে দুই অশীতিপর কঙ্কালসার বৃদ্ধবৃদ্ধা শীতে কাঁপছেন প্রিয়াংশু ওইদিকে সামান্য এগিয়ে যাওয়ার পরে যা দেখলাম...তাতে আমার একেবারে আকাশ থেকে পড়বার উপক্রম।বৃদ্ধবৃদ্ধার দুইচোখ একেবারে বিস্ফারিত।এত খুশিও যে তাঁদের কপালে ছিল এ যেন তাঁদের স্বপ্নাতীত।তাঁরা দুজনেই প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন..."খোকা রে!"
এ আমি কি দেখছি!আমি তো চিরকালই জানতাম প্রিয়াংশু বাপ মা হারা একটা অনাথ ছেলে।এই দুনিয়ায় ওর আপন বলতে কেউ নেই।আর আজ যখন ওই দুই রুগ্ন হাড় জিরজিরে অশীতিপর বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে নিজের চোখে দেখলাম...তখন আমার সামনে পুরো চিত্রটা একেবারে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে উঠল। প্রিয়াংশুর বাবা মাকে এখন সহায়সম্বলহীন এবং আশ্রয়হীন অবস্হায় রাস্তার ফুটপাতে প্লাস্টিক দিয়ে অস্হায়ী ত্রিপল টাঙিয়ে উপোস করে দিন গুজরান করতে হচ্ছে।ওনাদের দুচোখে যে যন্ত্রনা...যে আকুতি ফুটে উঠছিল...তাতে বেঁচে থাকতে থাকতেই যে নিজেদের ছেলেকে সশরীরে একবার চোখের দেখা দেখতে পেয়েছেন...এতেই যে তাঁদের জীবন ধন্য হয়ে গিয়েছে...এটা বুঝতে আমার আর বাকি রইল না।আর সেই সাথে প্রিয়াংশুর সমস্ত চাতুরী আর ধূর্ততা এক লহমায় পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে।দুনিয়ার বুকে সম্পূর্ণরূপে আপনজনহীন একজন অনাথ ছেলে প্রিয়াংশু...যে গ্রাম থেকে শহরে এসেছে মাথা গোঁজার মতো একটু ঠাঁই পাওয়ার আশায়...যে কিনা অনাথ আশ্রমের সবথেকে বাধ্য সুশীল ছেলে এবং ভালো ছাত্র ছিল। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে চলা ছেলেটির মনে শুধুই একটাই যন্ত্রনা...অনাথ বলে কেউ তাকে আপন মনে করে নিজের করে নিল না।শুধুমাত্র কলেজ পাশ করার ডিগ্রিটুকু সম্বল করে কংক্রিটের এই শহরে পড়ে রয়েছে আবর্জনার মতো যার দিকে ফিরে তাকানোর মতো এই দুনিয়ায় কেউ নেই।প্রিয়াংশুর এইসমস্ত মনগড়া বানানো গল্পের দুধ আর জল এইবার আমার কাছে এক লহমায় আলাদা হয়ে গেল।নিজের বাবা মাকে নিংড়ে শুষে...তাঁদেরকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করে...ওনাদের পুরোপুরি নিংড়ে শুষে নেওয়ার পরে আজ ও শুধুমাত্র একটা টুথপেস্টের ব্যবহৃত টিউবের মতোই নিজের জীবন থেকে নিক্ষেপ করে দিয়েছে জন্মের মতো।এই শহরে ও এসেছিল শুধুমাত্র নিজের আখের গোছাতে...এবং তার জন্যই একজন ধনী মানুষের একমাত্র মেয়ের দুর্বল জায়গা আর আবেগের সাথে নোংরা খেলা খেলে তাকে নিজের সিঁড়ি হিসেবেই ব্যবহার করতে চেয়েছিল এটা বুঝতে পেরে রাগে ঘৃণায় আমার সারা শরীর রি রি করে উঠল।ওই পরিস্থিতির ভিতরে আমি আমার সমস্ত ক্রোধ আর আক্রোশ সাময়িকভাবে গিলে নিয়ে চুপচাপ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম নিঃশব্দে।আর এরপর যে দৃশ্য আমি দেখলাম...তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।আমি দেখলাম...প্রিয়াংশু ওর বাবা মায়ের সামনে এগিয়ে যাচ্ছে এক পা এক পা করে।শীতে কাতর...ক্ষুধার্ত বৃদ্ধবৃদ্ধার যে হাঁটাচলার ক্ষমতাও নেই সেটা আমি বুঝতে পারলাম।প্রিয়াংশু বৃদ্ধবৃদ্ধার সামনে গিয়ে দাঁড়াল...আর তার পরমূহুর্তেই ওর দুইহাতের তালুর একটি ওর বাবার গলায় আর আরেকটি ওর মায়ের গলায় প্রচন্ড বলের সাথে চেপে বসল।আকস্মিক এমন অযাচিত আক্রমণে একেবারে দিশাহারা হয়ে গেলেন বৃদ্ধবৃদ্ধা।ওনাদের প্রাণ একেবারে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হল।ভয়ে...আতঙ্কে বিস্ফারিত ওনাদের চোখদুটিতে যেন একটাই প্রশ্ন উথলে বেরিয়ে আসতে চাইছিল।"বাবা...অমন কেন করছিস আমাদের সাথে...আমরা কি দোষ করেছি!"
এবার আমার আর সহ্য হল না।আমি একেবারে মরিয়া হয়ে উঠলাম।নাঃ...আর বসে বসে প্রিয়াংশুর পাপের খেলা আর দেখতে পারব না।ওর হাত থেকে ওর বাবা মাকে বাঁচাতেই হবে।আমার হুঁশ ফিরে এল পুরোপুরি।আমি প্রিয়াংশুকে আটকানোর জন্য ছুটে সেখানে যেতে যাব...সেই মূহুর্তেই দেখলাম...প্রিয়াংশুর হাতের মুঠো হঠাৎ আলগা হয়ে গেল।ওর হাতের কব্জি ফের স্বাভাবিক হয়ে উঠল আর আঙুলগুলোও আগের মতো শিথিল হয়ে গেল।আর সাথে সাথেই নির্জন রাস্তার মধ্যে পড়ল পরপর দুটি মানুষের লাশ।তাঁদের বিস্ফারিত চোখ দেখে...আমার প্রচন্ড কষ্ট হতে শুরু করল।দেখলাম...ওনাদের জিভটা বাইরে বেরিয়ে এসেছে।এইরকম একটা কসাইকে ভালোবেসেছিলাম আমি!দিনের পর দিন এর সাথেই এক ছাদের নীচে বাস করেছি!ঘৃণায় আমার গা রীতিমতো গুলিয়ে উঠল।অল্প সময়ের ভিতরেই একেবারে ঠান্ডা মাথায় পরপর তিন তিনটে খুন করে ফেলল প্রিয়াংশু মুখের ভিতরে চ্যুইংগাম রেখে।এরপর নিজের বাবা মায়ের লাশদুটিও একইভাবে ম্যানহোলের ভিতরে ফেলে দিল প্রিয়াংশু।তারপর ওটার ঢাকা গ্লাভস পরা হাত দিয়ে ঠিকভাবে আটকে আগের মতো করে দিল।ওর হাবভাব দেখে ওকে বেশ দিলখুশ আর চাঙ্গা লাগল।ওর হয়তো মনে হচ্ছিল...একটা রাতের ভিতরে অল্প কিছু সময়ের ভিতরেই ওর জীবন থেকে যাবতীয় আবর্জনা হতে মুক্তি ঘটল ওর।শিষ দিতে দিতে ফের গাড়ির ভিতরে ঢুকে গাড়ি স্টার্ট দিল ফ্ল্যাটে ফেরার রাস্তার দিকে।এতবড় ক্ষত আর আঘাত প্রায় সাময়িকভাবে গিলে নিলাম আমি।আমার স্কুটিটাতে আমি স্টার্ট দিলাম।যেমন করেই হোক...ওর আগেই আমাকে ফ্ল্যাটে পৌঁছতে হবে।হ্যাঁ।ওর ওই ফ্ল্যাটেই ফিরব আমি।আমার আর হারানোর কিচ্ছু নেই।ওর পাপের শাস্তি আমিই ওকে দেবার ব্যবস্হা করব।এটা না করতে পারলে আমি যে মরেও শান্তি পাব না!হঠাৎ এক লহমায় মানুষ থেকে আমি রূপান্তরিত একটা নিরেট পাথরে।আমার ভিতরে আর কোনো দুঃখ...যন্ত্রনা...ক্ষোভ...কষ্ট...ক্রোধ বা কান্নার কোনো অস্তিত্বই রইল না।আমার শিরায় শিরায়...আমার ধমনী জুড়ে শুধু একটাই লক্ষ্য প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছিল।প্রিয়াংশুকে আমায় শাস্তি দিতেই হবে।তা সে যেকোনো মূল্যেই হোক!
নির্জন ফাঁকা রাস্তায় প্রবল বেগে স্কুটিটা চালিয়ে প্রিয়াংশুর আগেই ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেলাম আমি।ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢুকেই সাথে সাথে ঘরের সমস্ত আলো নিভিয়ে পরে নিলাম আমার রাতপোশাকটি...আর সাথে সাথে বিছানায় নিজের শরীরটাকে মেলে রাখলাম একেবারে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা চেতনাহীন একটা শরীরের মতোই।খানিক পরেই প্রিয়াংশু ঘরে ঢুকল।আর ঢুকেই একেবারে বন্য পশুর মতোই আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।আরম্ভ করল চিরপরিচিত ওর সেই পাশবিক নির্যাতন।আমার ইচ্ছে করছিল...আর কিছু হাতের কাছে না পাই...নিজের হাতের ধারালো নখটুকু দিয়েই আঁচড়ে ফালাফালা করে রক্তাক্ত করে মেরে ফেলি জানোয়ারটাকে।আমার চোখের সামনে ও আমার বাবাকে হত্যা করেছে।তারপর ওই পাপ চাপা দিতে নিজের সহায়সম্বলহীন রুগ্ন ভুখা বাবা মাকেও রেয়াত করেনি।রাতের অন্ধকারে নিজের এইসমস্ত ন্যক্কারজনক পাপ ম্যানহোলের ভিতরে ঢাকাচাপা দিয়ে এসে এখন আমার শরীর নিয়ে স্ফূর্তি করতে এসেছে!যে আমি একটা সময়ে প্রিয়াংশুকে ভালোবেসে জগৎ সংসার সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম...সেই আমার ভিতরে এবার জেগে উঠল ভয়াল প্রতিশোধের আগুন।সেই মূহুর্তে প্রিয়াংশুকে কিচ্ছু টের পেতে দিলাম না আমি।চুপচাপ মড়ার মতো পড়ে রইলাম আর সহ্য করে যেতে থাকলাম ওর যাবতীয় পাশবিকতা।আর ঠিক ওই সময়েই প্রিয়াংশুকে শেষ করার যাবতীয় পরিকল্পনা আমি সেরে নিলাম।পরদিন সকালে নিজের সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে...ফ্লাইটের একটা টিকিট করে আমি রওনা দিলাম।কাউকেই জানতে দিলাম না আমি কোথায় যাচ্ছি।সবাইকে বলেছিলাম...জীবনের প্রতি আমি বড্ড বিতশ্রদ্ধ।এখানে আর কিছুই ভালো লাগছে না আমার।তাই আমি চলে যাচ্ছি অনেক দূরে কোথাও।কলকাতা থেকে বেরিয়ে আমি প্রথমে পৌঁছোলাম লন্ডন।ওখানে আমার মায়ের এক পরিচিত থাকেন।সেখানে অল্প কিছুদিন কাটিয়ে আবার আমি ফিরে আসি কলকাতা।কিন্তু আমার এই প্রত্যাবর্তনের খবরটা আমি পুরোপুরি গোপন রেখেছিলাম।কলকাতায় ফেরার পর পরিচয় গোপন করে থাকতে আমার খুব একটা সমস্যা হয়নি কারণ কলকাতা শহরে আমার বাবা একজন স্বনামধন্য মানুষ হলেও আমি কিন্তু চিরকালই ছিলাম খুবই মুখচোরা এবং চাপা স্বভাবের।কাজেই পথে বেরোলে আমাকে চিনতে পারাটা যেকোনো লোকের পক্ষে সম্ভব নয়।কলকাতা শহরে একটা সেলস গার্লএর কাজ নিয়ে একা একটা থাকার জায়গার ব্যবস্হা করে থাকতে শুরু করলাম সুকৌশলে।আমি জানতাম...ওইভাবে হঠাৎ করে কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়াতে আমার পরিচিতিজনেরা আর বিশেষ করে বন্ধুবান্ধবরা খুবই হতবাক হয়ে গিয়েছিল।ওরা সবাই আমাকে বার বার করে বারণ করেছিল ওইভাবে শহর ছেড়ে একা না চলে যাওয়ার জন্য।আর তখন যদি ওদের কারোর চোখে কোনোভাবে আমি পড়ে যেতাম...তাহলে কেলেঙ্কারির সীমা থাকত না।আমার সমস্ত পরিকল্পনা একেবারে চৌপাট হয়ে যেত।নিজের জন্মশহরেই আমি অত্যন্ত কৌশলে আত্মগোপন করে রয়ে গেলাম আর গোপনে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম আমার পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য।
কলকাতার কাছাকাছি...কিন্তু কলকাতার বাইরে একটা নির্জন ফাঁকা জায়গার সন্ধান করতে শুরু করলাম।আর সেরকম একটা জায়গার খোঁজ পেয়েও গেলাম।নিজের জীবনের একটা ভয়ঙ্কর নির্মম পরিণতি নিজের হাতে লিখে নিয়ে আমি শেষ পর্যন্ত ব্যাগপত্র গুছিয়ে চলে গেলাম সেখানে।জায়গাটা ছিল একেবারেই গ্রাম্য।শহরতলি বলা চলে।দোকানপাট কম আর জলাজঙ্গল...নির্জন জায়গা সেখানে যথেষ্ট বেশি।সেখানে পৌঁছোনোর পর আমি একটা হোটেলে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম আর তারপর অপেক্ষা করতে থাকলাম দিনের আলো নিভে আসার।ওই সময়ে আমার মনে হচ্ছিল...সময় যেন বড্ড খোঁড়া আর অলস।যেন সামনে এগোতেই চায় না।আমার ভিতরে হৃদস্পন্দন যেভাবে প্রবল দামামাধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়েছিল তা বর্ণনাতীত।কিন্তু সময় শেষ পর্যন্ত আমায় নিরাশ করল না।আস্তে আস্তে সূর্য ডুবতে শুরু করল।আমি একা একটা মেয়ে...সেদিন ছিলাম সর্বহারা আর নিঃস্ব।পার্থিব সুখের পাহাড় আমি একতাল ঘৃণা নিয়ে লাথি দিয়ে সরিয়ে ফেলে এখানে এসেছি নিজেকে শেষ করার জন্য...কারণ জীবনের ঝুলিতে আমার পুরোপুরি শুন্য।হারাবার আর কিছুই ছিল না আমার।নির্জন জলাজঙ্গলপূর্ণ একখানি জায়গা বেছে নিলাম আমি।চারপাশে লোকজন এত কম ছিল...যে আমার তাতে খুবই সুবিধা হয়ে গিয়েছিল।আলোআঁধারি জ্যোৎস্না রাতে ব্যাগ থেকে আমি বার করলাম এই আইভরি ফটোফ্রেমটা।
তারপর সাথে করে আনা ধারালো কাটারিটা বার করে নিলাম ব্যাগ থেকে।তারপর আর এক মূহুর্তও সময় ব্যয় না করে প্রচন্ড জোরে একটা কোপ বসিয়ে দিলাম নিজের ঘাড়ে।কাটারিটা ধার দিয়ে রেখেছিলাম।কাজেই ওই এক কোপেই আমার ধড় থেকে মুন্ড নিমেষের মধ্যে আলাদা হয়ে গেল...আর ফোয়ারার মতো রক্ত প্রবাহিত হতে থাকল এই আইভরি ফটোফ্রেমটার ওপরে।আমার বলিপ্রদান সম্পূর্ণ হল।মানুষের শিরশ্ছেদের রক্তের স্বাদ পেয়েই জীবন্ত হয়ে ওঠে এর ভিতরের শক্তি।আমি নিজেকেই বলি দিলাম বিনা দ্বিধায়...কারণ জীবন বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না আমার।শুধু একটাই লক্ষ্য আমার...প্রিয়াংশুকে ওর পাপের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া।আমার রক্তের স্পর্শ পেয়েই এই ফটোফ্রেমের ভিতরের ভয়াল জান্তব পিশাচটা বহুযুগ পরে নড়েচড়ে উঠল।নিজের মাথায় কোপটা বসানোর আগে...আমি ফটোফ্রেমের পিছনে লিখে রাখা নির্দেশ অনুযায়ী...মিশরীয় ভাষার মন্ত্রটি উচ্চারণ করার শেষে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করি নিজের নাম।যাতে নিজেকে বলি প্রদান করবার পর আমার আত্মার দাসত্বে আসে ভয়াল পিশাচটি।হলও ঠিক তাই।মৃত্যুর পর আমি অনুভব করলাম...আমার শুধুমাত্র খোলসটুকুরই বদল ঘটল।রক্তমাংসের শরীর থেকে আমি প্রবেশ করলাম এই আইভরি ফটোফ্রেমের ভিতরে।আর তারপর মূহুর্তের মধ্যে এই বিকটদর্শন জান্তব পিশাচটা গা ঝাড়া দিয়ে জেগে উঠে ক্ষুধার্ত হায়নার মতো ছটফট করতে থাকে।ওটা এই ফটোফ্রেম হতে গা ঝাড়া দিয়ে বেরিয়ে পড়ে আর আমার গলা কাটা পড়ার ফলপ্রসূ যতটা রক্ত বেরিয়েছিল...তার পুরোটাই চেটেপুটে একেবারে নিঃশেষ করে ফেলে।তারপর এখানেই ওটা থামল না।আমার রক্তমাংসের শরীরটাকেও হিংস্র নেকড়ের খেকেও নৃশংসভাবে পুরোটাই চিবিয়ে খেয়ে শেষ করে ফেলল মাত্র দশ কি পনেরো মিনিটের মধ্যেই।খানিক আগেই যে এখানে একটা মানুষের বলি সংঘটিত হয়ে গেছে...সেটা আর বোঝার কোনো উপায়ই রইল না।বহুদিন পরে মানুষের শিরশ্ছেদের রক্তের স্বাদ পেয়ে পিশাচটা ধাতস্হ হতে বেশ খানিকটা সময় নিল।তারপর আমার আনুগত্যে সেটা মাথা ঝুঁকিয়ে বসল ফটোফ্রেমটার সামনে...যার ভিতরে বন্দী আমি।ফটোফ্রেমের ভিতর হতে আমি দেখলাম...একটা বিকটদর্শন রোমশ...আটহাতযুক্ত জন্তু...মাথা ঝুঁকিয়ে বসে রয়েছে আমার সামনে।ঠিক যেন অতিকায় একটা মাকড়সা।চারপাশ একেবারে নিস্তব্ধ...শুনশান...!শুধু ঝিঁঝিঁপোকা আর ব্যাঙের ডাকে বাতাস একেবারে ভরে উঠেছে।চাঁদের মায়াবী আলো এসে পড়েছে আমার ওপর।যতদিন রক্তমাংসের শরীরটা আমার কাছে ছিল...ততদিন আমি ছিলাম অসহায়।কিন্তু এখন রক্তমাংসের শরীর হারিয়ে তখন আমার মনে হচ্ছিল...এবার সবকিছুই আমার হাতের মুঠোয়।এ জগতে আমার অসাধ্য আর কিচ্ছু নেই।এরপর আমার আত্মাকে রক্তমাংসের নারীর আকার দিয়ে...তারপর ফটোফ্রেমটাকে হাতে নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম আমার গন্তব্যে।ওইদিন রাত বারোটাতেই ছিল প্রিয়াংশুর জন্মদিন...সেটা আমি জানতাম।পরদিন সকালে...ফটোফ্রেমটাকে একটা গিফটপ্যাকের আকার দিয়ে...এটা হাতে নিয়ে আমি চলে এলাম প্রিয়াংশুর ফ্ল্যাটের দরজার সামনে।আমি জানতাম...ওই সময়ে প্রিয়াংশু জন্মদিনের পার্টির আয়োজন নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকবে।বহু মানুষ ওকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবে...উপহার দেবে...উপহার পাঠাবেও।আর ওই সময়ে পরিচিতদের পাঠানো উপহার নিয়ে এত লোক ওর দুই তিন মিনিট অন্তর অন্তর দরজায় এসে কলিং বেল বাজাবে...যে সবাইকে খেয়াল করা ওর পক্ষে সম্ভব হবে না।কাজেই...ওর সব সময়ের কাজের লোকটি ওই সময়ে ছুটিতে থাকলেও...প্রিয়াংশু নিজে এসে দরজা খুলে যখন দেখল...একজন বোরখা পরা মহিলা উপহারের প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে...ও সামনের দিকে কোনো দৃষ্টিপাত না করেই শুধু উপহারের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে দিল।আর তারপর আমি আবার প্রবেশ করলাম প্রিয়াংশুর ওই ফ্ল্যাটের ভিতরে...যেখানে রক্তমাংসের শরীর যখন ছিল...তখন নিয়মিত জুটত পশুর মতো নির্যাতন আর অপমান।আজ আমি বন্ধ দরজা ভেদ করে যখন ঢুকলাম...তখন প্রিয়াংশু সেটা জানতেই পারল না।আমি চারপাশে তাকালাম...পরতে পরতে যেখানে শুধুই প্রিয়াংশুর পাপাচারের বিষাক্ত স্পর্শ।আমার ভিতরে লেলিহান শিখার মতো জেগে উঠতে থাকল ভয়াল প্রতিশোধ স্পৃহা।
বন্ধুবান্ধব আর চেনা পরিচিত নিমন্ত্রিতরা ওই দিন বিকেল হতে না হতেই প্রিয়াংশুর ফ্ল্যাটে আসতে আরম্ভ করল।জমিয়ে খানাপিনা...নাচ..
গান আর জমাটি মদের আসরে জমাটি পার্টি চলল রাত পর্যন্ত।তারপরের দিনই প্রিয়াংশুর ফ্লাইটের টিকিট বুক করে রাখা ছিল।আমি দেখলাম...ওর গোছগাছ মোটামুটি তৈরিই হয়ে রয়েছে।কাজেই ওইদিকে মনোযোগ না দিয়ে ও ওর জন্মদিনে পাওয়া উপহারগুলো আনপ্যাক করতে ব্যস্ত হল।এই ফটোফ্রেমটা পেয়ে ওর ভিতরে যে খুশির ঝলকানি আমি দেখলাম...তা আমাকে বড়ই নিশ্চিন্ত আর তৃপ্ত করল।আমি দেখলাম...ও এই ফটোফ্রেমটার ভিতরে নিজের একখানি ফটো ঢুকিয়ে রাখল...আর তারপর ফটোফ্রেমটাকে নিজের বেডসাইড টেবিলের মাঝখানে রেখে দিল সযত্নে।ব্যস...তারপর থেকেই আমার নির্দেশে সেখানে জেগে উঠতে শুরু করল অষ্টপাদ ভয়ালদর্শন ওই জান্তব পিশাচটা।এয়ারপোর্ট যাওয়ার জন্য যখন প্রিয়াংশু রেডি হয়ে বেরোতে যাবে...ওই সময়েই পিশাচটা ধীরে ধীরে...ওই বিকট দর্শন শরীরের সাথে ভীষণভাবে জীবন্ত হয়ে উঠতে শুরু করল।সোফায় বসে প্রিয়াংশু যখন জুতো পরতে ব্যস্ত...ঠিক তখন থেকেই ওর জীবনে সর্বনাশের ঘন্টাধ্বনি বেজে উঠল।ওর ফ্ল্যাট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল বৈদ্যুতিক সংযোগ...আর ইন্টারনেট পরিষেবা।ওর মোবাইলের সুইচ অফ হয়ে গেল আপনা থেকেই।আর তারপর...ফ্ল্যাট থেকে বাইরে বেরোনোর দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।পিশাচটা ততক্ষণে পুরোপুরি জেগে উঠেছে।ওর রোমশ হাত আর পা ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছিল প্রিয়াংশুর দিকে।আর তারপর খপ করে রোমশ হাত দিয়ে সেটা সেটা ধরে ফেলল প্রিয়াংশুর পা দুখানি।আর তারপর ওকে মেঝেয় ফেলে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল ওর বেডরুমের দরজার ভিতরে।আর তারপর বাইরে থেকে দরজাটা লক করে দিল।ব্যস...প্রিয়াংশু যাবতীয় খেলা শেষ হয়ে এবার আমার খেলা শুরু হল।ওই পিশাচের সাহায্য নিয়ে আমি প্রিয়াংশুর রূপ ধারণ করে নিলাম।আর তারপর থেকেই প্রিয়াংশুর সমস্ত চেনাপরিচিতরা বলাবলি শুরু করে দিল...প্রিয়াংশুর মস্তিষ্কে বিকৃতি দেখা দিয়েছে।আসল রক্তমাংসের প্রিয়াংশু যে নিজের বেডরুমের ভিতরে বন্দী হয়ে পড়ে পড়ে একটু মুক্তির আশায় ছটফট করে চলেছে...এটা কেউ জানল না।আমি প্রিয়াংশুর অস্তিত্ব ধারণ করে নিয়ে পুরো পরিস্থিতি আর সময়কে নিজের হাতের মুঠোয় আনতে শুরু করলাম।ফ্ল্যাটের কাজের লোককে ছাড়িয়ে দিলাম কাজ থেকে।সবাই জানল...প্রিয়াংশু বাবু এই ফ্ল্যাটেই রয়েছেন...কিন্তু সে বদলে গিয়েছে ভীষণভাবে।এই প্রিয়াংশুকে কেউ চেনে না...জানে না...আগে কোনোদিন দেখেনি। প্রিয়াংশুর যে মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটে গিয়েছে...এটা অচিরেই বুঝে গেল সবাই।এই ফ্ল্যাটে মানুষের আনাগোনা এক্কেবারে বন্ধই হয়ে গেল।আর আমি ওর কেরিয়ার...জীবন সবকিছুকে ধ্বংস করতে থাকলাম একে একে।আমাকে ঠকিয়ে...আমার জীবন নষ্ট করে...আমার বাবাকে নির্মমভাবে হত্যা করে...এবং সর্বোপরি নিজের সহায়সম্বলহীন ভুখা বাপ মাকে ঠান্ডা মাথায় পৃথিবী থেকে সরিয়ে...নিজের সাফল্য আর জীবনের যে ইমারত ও সাজিয়েছিল...তা আমি ভেঙ্গে একেবারে গুঁড়িয়ে দিতে শুরু করলাম।ওর সম্মান যেতে শুরু করল।মানুষজন বুঝে যেতে থাকল...এইবার প্রিয়াংশুর সংস্রব ত্যাগ করতে হবে।ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে।এই পৃথিবীতে ওর প্রকৃত আপন বলতে কেউই নেই।কাজেই এতদিন সব মানুষেরা যখন প্রিয়াংশুর সাফল্য আর সুখের দিনের সঙ্গীসাথী ছিল...আজ তারা বিনা দ্বিধায় সংস্রব ত্যাগ করল প্রিয়াংশুর।শেষ পর্যন্ত মানসিক স্হিতি হারানোর কারণে ওর চাকরীটা পর্যন্ত গেল।এতবড় সর্বনাশ যার হয়ে গেল...সেই রক্তমাংসের প্রিয়াংশুর,নিজের বেডরুমের বাইরে একটা পা পর্যন্ত রাখবার উপায় আজ নেই।আমি মনে মনে অনির্বাচনীয় এক তৃপ্তি অনুভব করলাম।কিন্তু আমার শেষ কাজ তখনো বাকি ছিল।সেইটাও করতে আর দেরি করলাম না আমি।এক ঝড়জলের রাত্রে আমি বেরিয়ে পড়লাম থানার উদ্দেশ্যে।অতঃপর...সেখানেই আপনার সঙ্গে আমার প্রধান দেখা হয়।
এই কথা শোনবার পর কুন্তল প্রচন্ড জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সায়নের মুখের দিকে চাইল।কয়েক মূহুর্ত কাটল এক ভয়ঙ্কর বোবা নিস্তব্ধতায়।তারপর ফের বলতে শুর করল ফটোফ্রেমের ভিতরে প্রিয়াংশু বাবুর ফটোর প্রতিকৃতির আড়াল হতে প্রচন্ড তীক্ষ্ণ আলো আর জ্যোতির সাথে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাওয়া বৃষ্টির বন্দী আত্মা।
---আমি থানার ভিতরে আসি...এবং পরিশেষে আপনার সামনে এসে উপস্থিত হই প্রিয়াংশুর রূপ নিয়ে।শুধু আপনি কেন...কোনো মানুষের পক্ষেই সেটা বোঝা সম্ভব নয়।প্রিয়াংশুর জবানিতেই আমি এক এক করে আপনার সামনে তুলে ধরতে থাকি ওর যাবতীয় পাপাচারের কলঙ্কিত অধ্যায়।এবং শেষ পর্যন্ত সমস্ত কর্তব্যরত পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে আমি সেখান থেকে পুরোপুরি গায়েব হয়ে পড়ি।আর আমার পিছু করে প্রিয়াংশু ওই ফ্ল্যাট পর্যন্ত পৌঁছে যায় পুলিশ...এবং অবশেষে ওর বেডরুম হতে তারা উদ্ধার করে বেশ কয়েকদিনের ভুখা...তৃষ্ণার্ত...রক্তমাংসের প্রিয়াংশুকে।
ওই কদিনে আমি প্রিয়াংশুকে ওর বেডরুমের ভিতরে বন্দী করে রেখে...চারপাশে এমন আবহ তৈরি করে নিয়েছি...যে এখন প্রিয়াংশু নিজে কাউকে কোনোকিছু বলতে গেলে সেটা শুধুমাত্র পাগলের প্রলাপ হিসেবেই গন্য হবে সকলের কাছে।আর ও যে অপরাধ করেছে...তার হাতেকলমে প্রমাণও এখন সবার সামনে হাজির।কাজেই কেউ যদি ধরেও নেয়...যে প্রিয়াংশুর কথাগুলোর একটাও পাগলের প্রলাপ নয়...তাহলেও ওর অপরাধ হাতেকলমে প্রমাণিত হয়ে এখন সবকিছু দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার।রেহাই ওর নেই।আমি এখন অপেক্ষা করে রয়েছি ওর শাস্তির জন্যই।ওর মতো একটা নরকের কীটের জন্য মৃত্যুদন্ডই হল উপযুক্ত শাস্তি...যেটা রক্ত মাংসের শরীর নিয়ে নিজের হাতে দেওয়া আমার পক্ষে কোনোদিনও সম্ভব ছিল না।ও শাস্তি পেলে পৃথিবীর বুক থেকে জঞ্জাল কিছুটা হাল্কা হয়ে যাবে...আর সেই সাথে আমার আত্মাও শান্তি পাবে।কিন্তু আমার সমস্যা অন্যখানে।যেদিন সন্ধ্যায় নিজের শিরশ্ছেদ করে তার রক্ত দিয়ে এই ফটোফ্রেমের ভিতরের পিশাচটাকে আমি জাগিয়ে তুলি...সেইদিনের পর থেকেই আমার এই আত্মাটা বন্দী হয়ে পড়েছে এই ফটোফ্রেমটার ভিতরে।আমি যেখানেই যাই...যাই করি না কেন...আমার সাথে অঙ্গাঙ্গীকভাবে জুড়ে থাকে এই ফটোফ্রেমটা।আর যেহেতু এটা একটা পার্থিব জড়বস্তু...তাই আমারও এই পার্থিব জগৎ হতে আর মুক্তি নেই...যদি না কেউ এই ফটোফ্রেমটা পুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলে...!কুন্তল বাবু...আপনার কাছে আমার দুটি আর্জি রয়েছে।ভিক্ষাও বলতে পারেন।দয়া করে কথা দিন...আমার এই দুটি অনুরোধ আপনি রাখবেন!
কুন্তল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সায়নের দিকে একবার চাইল।কিছু নীরব মূহুর্ত কাটল।তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুন্তল ফটোফ্রেমের ভিতরে বন্দিনী বৃষ্টির যন্ত্রনাক্লিষ্ট ছলছল চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বলল..."আমি আপনার সব অনুরোধ রাখব।আপনি বলুন...।"
বৃষ্টির দুচোখ জুড়ে যেন হঠাৎ প্রশান্তি নেমে এল।তারপর বৃষ্টি কুন্তলকে একটা অনাথ আশ্রমের ঠিকানা বললেন...যেখানে অল্প কিছুদিন আগেই একটা সদ্যজাত পুত্রসন্তান সে রেখে গিয়েছিলেন সকলের অলক্ষ্যে।যেভাবে প্রিয়াংশু বাবু বৃষ্টিকে নিজের জীবনে গ্রহণ করেননি...ঠিক সেইভাবেই বৃষ্টির কোলে নিজের সদ্যজাত সন্তানকে দেখেও এতটুকু মায়া পর্যন্ত জাগেনি প্রিয়াংশু বাবুর পাষাণ হৃদয়ে।জন্মদাতা পিতার স্বীকৃতি না পেলে...এই সমাজের বুকে যে জীবন প্রাপ্য হবে এই নিষ্পাপ শিশুটির...তাতে যে প্রতিটা মূহুর্তে ওকে একটু একটু করে পিষে মারবে...এটা বুঝতে পেরেই বৃষ্টি আর নিজের কলিজার টুকরোটিকে নিজের কাছে রাখার সাহস পাননি।সে বাধ্য হয়েছিল একটা গভীর রাতে...একটা অনাথ আশ্রমের দরজার সামনে তাকে সকলের অলক্ষ্যে রেখে দিয়ে চোরের মতো পালিয়ে আসতে।প্রিয়াংশু বাবু শুধু নিজে পাপ করেই ক্ষান্ত থাকেননি।বৃষ্টিকেও বাধ্য করেছিলেন তাঁর নিজের জীবনের একমাত্র কদর্য আর ঘৃণ্য পাপটি করতে।আর এই কারণেই তখনো পর্যন্ত ভিতরে ভিতরে দগ্ধে মরছিলেন বৃষ্টি।বৃষ্টি ভিখারিনীর মতো কুন্তলের কাছে অনুরোধ করল...অনাথ আশ্রম থেকে তাঁর শিশুটিকে নিয়ে এসে যেন কোনো নিঃসন্তান দম্পতির হাতে যেন কুন্তল তুলে দেয়...যাতে একটি পরিবারের মধ্যে থেকে শিশুটি ভালোভাবে বড় হতে পারে।
আর এরপর এই আইভরি ফটোফ্রেমটা...এমনই একটা নির্জন জায়গাতে পুড়িয়ে নষ্ট করে দেওয়া হয়।তাহলেই সবশেষে একমুঠো শান্তি নিয়ে মুক্তিলাভ করতে পারবে বৃষ্টির অতৃপ্ত আত্মা।
কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে এবার থামলেন বৃষ্টি।আকাশের অবস্হা ক্রমে সঙ্গিন হতে আরম্ভ করেছে।প্রচন্ড জোরে বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করেছে ঘন ঘন।মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হতে যে আর দেরি নেই...সেটা এবার সায়ন ভালোভাবেই বুঝতে পারছে।ওই আলোআঁধারির ভিতরে...ওরা দুজনেই পরিষ্কার দেখল...ফটোফ্রেমের ভিতরের ওই যন্ত্রনাক্লিষ্ট...সুমিষ্ট নারীমূর্তির অবয়বখানি ধীরে ধীরে ফিকে হতে শুরু করেছে।এমন সময় সায়ন বেশ জোরে কুন্তলের কাঁধে ধাক্কা দিয়ে ওর হুঁশ ফেরাল।তারপর বলে উঠল..."ওরে...আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক না...দেখতে পাচ্ছিস না আকাশের পরিস্থিতি...!এক্ষুনি বৃষ্টি নামল বলে...!
একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুন্তল বলে উঠল..."হ্যাঁ রে...ঠিকই বলেছিস...এই ছোট্ট আইভরি ফটোফ্রেমের ভিতরে উনি ছটফটিয়ে তিলে তিলে দগ্ধে মরছেন।এবার আকাশ ফুঁড়ে কান্না ঝরালে পরেই হয়তো কিছুটা শান্তি পাবে তাঁর আত্মা...!চল...আমরা ভিতরে যাই।
ফটোফ্রেমটা সযত্নে নিজের রুমাল দিয়ে যতটা সম্ভব মুড়ে নিল কুন্তল।তারপর তাড়াতাড়ি করে দুজনে ঘরের দিকে পা বাড়াল।
ফাঁসির মঞ্চের সামনে নীরব মুখে...শুন্য দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে কুন্তল।হিড়হিড় করে টানতে টানতে সেখানে আনা হচ্ছে প্রিয়াংশু বাবুকে।
প্রিয়াংশু বাবু পরিত্রাহী চেঁচিয়ে চলেছেন।ক্রমাগত উন্মত্ততার সাথে শুধুই বলে চলেছেন..."ওই স্বীকারোক্তি আমার নয়...ওই স্বীকারোক্তি আমার নয়।"
উত্তর হিসেবে তাঁর শুধুই মিলছে আরো জোরে হ্যাঁচকা টান...ফাঁসির মঞ্চের দিকে।শেষমেষ ফাঁসির মঞ্চে ওঠানোর পর যখন তাঁর মাথাটা কালো কাপড় দিয়ে ঢাকার কাজটা শুরু হচ্ছিল...তখন একেবারে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন প্রিয়াংশু বাবু।কাঁদতে কাঁদতে এইবার জীবনে প্রথমবার অনুশোচনার সাথে তিনি বললেন..."ভুল করেছি...ভীষণ পাপ করেছি আমি।আমাকে ছেড়ে দিন...ক্ষমা করে দিন...।"
ব্যস...ওইটাই ছিল তাঁর মুখ দিয়ে নির্গত হওয়া শেষ কথা।
কুন্তল মনে মনে ভাবতে থাকল...রজতাভ বাবুর অকস্মাৎ অন্তর্ধানের পিছনে যে প্রিয়াংশু বাবুর হাত থাকার সম্ভবনা সিংহভাগ...সেই বিষয়ে অনেকেই সন্দেহ করেছিল ঠিকই...কিন্তু মৃতদেহ সমেত কোনো পাথুরে প্রমাণই ছিল না...যার দ্বারা কোনোদিন পুলিশ প্রিয়াংশু বাবুকে অ্যারেস্ট করতে পারে।সত্যিই...কর্মের ফল যে কোথা দিয়ে কিভাবে মানুষকে চোকাতে হয়...তা কেউ আগে থেকে আন্দাজ পর্যন্ত করতে পারে না।নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী ফাঁসির কার্যক্রম নির্বিঘ্নেই হতে থাকল।যখন প্রিয়াংশু বাবুর পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে দেওয়া হল...সেই মূহুর্তে কুন্তল গোপনে...সবার চোখ এড়িয়ে...বার করল আইভরি ফটোফ্রেমখানি।ফটোফ্রেমের ভিতরে বন্দিনী বৃষ্টি দীর্ঘদিন পরে একরাশ শান্তি নিয়ে দুচোখ ভরে দেখলেন...কিভাবে অপরাধী তার পাপের শাস্তি পাচ্ছে।
এক সপ্তাহ পর
প্রিয়াংশু বাবুর যেদিন ফাঁসি হল...ওইদিনই সকলের অলক্ষ্যে গভীর রাত্রে...এক নির্জন জায়গা খুঁজে...কুন্তল আর সায়ন আইভরি ফটোফ্রেমটিতে আগুন ধরিয়ে দিল।ওদের চোখের সামনে একটু একটু করে ভস্মীভূত হয়ে ক্রমে নিঃশেষ হয়ে যেতে থাকল একটি অপার্থিব পৈশাচিক শক্তির সমস্ত অস্তিত্ব।আর সেই দহনের ধোঁয়ার সাথে মিশে মুক্তি পেল বৃষ্টির বিদেহী আত্মা।ওইটুকু একটা ফটোফ্রেমের থেকে যেভাবে ধোঁয়া নির্গত হতে থাকল...যেন বড় কোনো বাড়িতে আগুন লেগেছে।ওই ধোঁয়ার ভিতরেই বৃষ্টির অবয়বখানি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠতে শুরু করল।ওর চোখেমুখে তখন এক পরিতৃপ্ত প্রশান্তি আর কৃতজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট।ইহলোক হতে বিদায় নেবার সময় জিজ্ঞাসু চোখে শুধু একটাই প্রশ্ন করেছিলেন বৃষ্টি।"আমার ছেলেটাকে খুঁজেছিলে?"
কুন্তল তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেছিল..."চিন্তা করবেন না...ওকে আমি খুব শীঘ্রই খুঁজে বার করে একটা পরিবারের হাতে তুলে দেব।
কুন্তলের মুখ থেকে ওই আশ্বাস শোনার পর প্রায় চোখের নিমেষে ইহলোক ছেড়ে পরলোকে পাড়ি দিলেন বৃষ্টি।ধীরে ধীরে নিভে আসতে থাকল আগুন।খুব অল্পক্ষণের মধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল আইভরি ফটোফ্রেমটির সমস্ত চিহ্ন।এক কণা ছাই পর্যন্ত পড়ে রইল না আর।ধোঁয়াও পুরোপুরি মিলিয়ে গেল।
এতখানি বলে হাঁপাতে থাকল আমাদের গল্প বলিয়ে বন্ধু অনির্বান।অনির্বাণের এমন একখানা জমজমাট গল্পে মজলিশ যে একেবারে জমে গেছে...সেটা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না।কিন্তু একটা প্রশ্ন...বলা ভালো...একটা খটকা আমাদের প্রত্যেকের মনেই রীতিমতো খচখচ করছে যেন।প্রিয়াংশু বাবুর মতো অমন একটি নরকের কীট...যার কীর্তিকলাপ শুনে আমাদের তো ভিতর থেকে রীতিমতো গালাগালি বেরিয়ে আসছিল...অথচ অনির্বান ওর গল্পের একটা জায়গাতেও এতটুকু অশ্রদ্ধার সম্ভাষণ করেনি তাকে।গল্প যখন শেষ হল...ঘরের পরিবেশ তখন থমথমে।এক্কেবারে চুপচাপ।কিন্তু আমরা সবাই লক্ষ্য করলাম...ওর চোখের কোণায় একবিন্দু জল চিকচিক করে উঠেছে...যা ও আমাদের কাছ থেকে প্রাণপণে লুকোতে চাইছে।এবার আমরা বুঝলাম...গল্প ওখানেই শেষ হয়ে যায়নি।এর বাকি অংশটা এখনো আমাদের অজানাই রয়ে গেছে।আমরা সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকালাম।চশমার ফ্রেম মুছতে মুছতে অনির্বান আমাদের সকলের মন পড়ে ফেলল।ধীর কন্ঠে ও বলে উঠল...তোমরা সবাই ঠিকই বুঝেছ বন্ধুগণ...গল্প শেষ হয়নি এখনো।গল্পের আসল উপসংহার তোমাদের সামনেই বসে রয়েছে।আর সেখানেই এই গল্পের সমাপ্তি।
ঠান্ডা পানীয়র গ্লাসে চুমুক দিয়ে রনি বলে উঠল...
---"তার মানে?"
এই একই প্রশ্ন যখন আমাদের সকলের মনে ঘোরাফেরা করছে...তখন আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে অনির্বান বলে উঠল..."বৃষ্টির সেই স্বীকৃতিহীন সন্তান হলাম আমি নিজে।"
প্রচন্ড চমকে গিয়ে আমরা বিস্ময়ে একেবারে থ হয়ে গেলাম।
অনির্বান আবার বলতে শুরু করল..."হ্যাঁ প্রিয়া...আমি আজ তোমার কাছে নিজের স্বীকারোক্তি রাখছি।আমি যে আমার বাবা মায়ের দত্তক সন্তান...এটা নিয়ে তোমার পরিবারে আমাকে নিয়ে অশান্তি এখন চরমে।ওনারা আমার জাত নিয়ে এখন মারাত্মক রকমের ধন্দে রয়েছেন।যদি আমি মুসলমান বা খ্রীষ্টান হই...তাহলে তো তোমার পরিবারের মানসম্মান একেবারে ধূলোয় মিশে যাবে...তাই না!আজ তুমি তোমার পরিবারকে বলে দিও...যে তোমার অনির্বানের শরীরে হিন্দুর রক্তই বইছে।আর এটা হলেই তো ওনারা আর কিছু চান না...তাই না!কিন্তু আজ যখন ওনারা আমার আসল পরিচয় জানবেন...তখন আমার শরীরে হিন্দুর রক্ত বওয়া সত্ত্বেও একজন খুনীর ছেলেকে নিজেদের পরিবারের জামাই হিসেবে মেনে নেওয়াটা কি ওনাদের পক্ষে খুব সহজ হবে!
এতখানি একনাগাড়ে বলে...তারপর
ঢকঢক করে একটা মদের বোতলের প্রায় অর্ধেক খালি করে ফেলে তারপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রিয়ার চোখের দিকে সোজাসুজি তাকাল অনির্বান।
অনির্বান আর প্রিয়ার সম্পর্কটা এখন একটা পূর্ণতার রূপ দিতে ওরা দুজনেই এখন বদ্ধপরিপক।কিন্তু বাধ সাধছে প্রিয়ার পরিবার।একজন জাত কুলহীন অনাথ ছেলের হাতে কিছুতেই মেয়েকে তুলে দেবেন না তাঁরা।পরিস্থিতি ক্রমে এতটাই জটিল হয়ে উঠেছে...যে প্রিয়া দিনকে দিন মনের জোর হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে।আজকের আগে ওর শুধু এইটাই মনে হচ্ছিল...যেনতেন প্রকারেন অনির্বানকে হিন্দু প্রমাণ করতে পারলেই আর কোনো সমস্যাই থাকবে না।কিন্তু আজ যখন অনির্বাণের প্রকৃত পরিচয় ওর সামনে এল...তখন ও এটা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারল...একজন খুনীর ছেলের শরীরে হিন্দু রক্ত বইলেও ওর পরিবার অনির্বানকে কোনোমতেই জামাই হিসেবে। মেনে নেবে না।অনির্বানকে কোনোদিনই যে প্রিয়ার পরিবার মেনে নেবে না...এটা এখন পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে গেল প্রিয়ার কাছে।রক্ত যে সবক্ষেত্রে কথা বলে না...এটার প্রমাণ অনির্বান নিজে।শুধু প্রিয়া নয়...অনির্বানের চেনা পরিচিত যারা রয়েছে...তারা সকলেই এক কথায় বলবে...অনির্বানের মতো ছেলে হয় না।আজ শুধু অনির্বানের পিছনে জড়িয়ে থাকা একটা জঘন্য অতীতের জন্য সারাটা জীবন ছেলেটা কষ্ট পাবে...প্রিয়াও অনির্বানকে নিজের করে পাবে না কোনোদিন...এটা আর মানতে পারল না প্রিয়া।ও এখন...এই মূহুর্তেই মনে মনে স্হির করে নিল...ও কি করবে।অনির্বানের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে...তারপর অনির্বাণের হাতখানি শক্ত করে কয়েদ করে নিল নিজের হাতের মুঠোয়।তারপর দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠল..."যাই পরিস্থিতি আসুক...সেটা এখন আমরা দুজনে দেখে নেব।আমি থাকব তোমার পাশে সারাটা জীবন...তুমি আর কষ্ট পেও না অনির্বান!"
প্রিয়ার চোখ ছলছল করে উঠেছে কথাগুলো বলবার পর।
ব্যস...আর আমাদের আর পায় কে!আমরা খুশিতে পুরোপুরি মেতে উঠলাম।যাক...এতদিনের সমস্যা আজ তাহলে একটা সমাধানের রাস্তা পেল।রনি বলে উঠল..."তোরা চিন্তা করিস না...আমরা সবাই আছি তোদের পাশে।তোরা একবার বিয়েটা করে নে...দেখবি...তারপর সবাই ঠিক মেনে নিয়েছে।"
আমরা সবাই সহমত হলাম।পার্টিটা খুব আনন্দের সাথেই শেষ হল।
পার্টি শেষ হতে যথেষ্ট রাত হয়ে গিয়েছিল।সবাই চলে যাওয়ার পর আমি ঘরটা পরিষ্কার করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।হঠাৎ দপ করে সব আলো নিভে গেল।বুঝতে পারলাম...লোডশেডিং হয়ে গিয়েছে।কি আর করা...একখানি মোমবাতি জ্বালিয়ে নিলাম।তারপর ঘরে ভালোভাবে হাওয়া ঢোকানোর জন্য পরদাগুলো একটু সরালাম।তারপর একটা দৃশ্য দেখে...আমার রক্তহিম হয়ে গেল।লোডশেডিংএর এই আলোআঁধারির ভিতরে...বিরাটাআকৃতি কোনো এক অষ্টপাদ প্রাণীর ছায়া ফুটে উঠেছে ঘরের দেওয়াল জুড়ে।কিন্তু প্রাণীটার তো কোনো অস্তিত্ব আমার চোখে পড়ছে না...!দেওয়ালের বুকে ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে শুরু করল মিশরীর অক্ষরের একটি লেখা।মিশরীয় বর্ণমালা আমার অপরিচিত নয়...ভাগ্যক্রমে।তাই লেখাটার মর্মোদ্ধার করতে পারলাম আমি।দেওয়ালে যে লেখা ধীরে ধীরে ফুটে উঠল তার মর্মার্থ এই..."যতদিন পৃথিবীর বুকে পাপের অস্তিত্ব আছে...ততদিন পৃথিবীর বুকে রয়ে যাবে পাপের বিনাশকারীর অস্তিত্ব।"
চোখের সামনে লেখাটি ধীরে ধীরে ঝাপসা হতে হতে শেষে একেবারে মিলিয়ে গেল।আমার পিঠ দিয়ে যেন হিমশীতল একটি স্রোত নেমে গেল...!
সমাপ্ত
রশ্মিতা দাস