আবিষ্কার
আবিষ্কার
আবিষ্কার
গোটা গ্রাম জুড়ে ছেয়ে গিয়েছে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।গ্রামের সকলের চোখেমুখে মারাত্মক রকমের আতঙ্ক পরিলক্ষিত হতে শুরু করেছে।সেইটাই স্বাভাবিক।এমন দৃশ্য চোখের সামনে দেখলে যেকোনো মানুষই ভিরমি যাবে।সকলের মুখে মুখে চাপাস্বরে যাকে কেন্দ্র করে আলোচনা চলছে...সে হল এক নিপাট গ্রাম্যবধূ।সকালে সে যখন ঘরের জন্য জল সংগ্রহ করতে বেরিয়েছিল...তখন সকলেই লক্ষ্য করেছে...ওর শরীর ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে একটি বৈদ্যুতিক তার।এই দৃশ্য দেখামাত্রই সকলের রক্তহিম হয়ে যায়।ওর সামনের মানুষগুলির মধ্যে উত্তেজনা বশত হঠাৎ করে এমন ঠেলাঠেলি আরম্ভ হয় যে সেই ধাক্কা লাগে সংশ্লিষ্ট বধূটির ওপরেও।ফলপ্রসূ সে দাঁড়িয়ে থাকা লাঠির মতোই পুরোপুরি সোজা থেকে একেবারে খটাং করে পড়ে যায় মাটিতে।ভালোরকম ঝনঝন শব্দ হয় এবং এতে বধূটির মাথার কিছুটা খোলনলচে ঘষা খেয়ে উঠে বেরিয়ে পড়ে লৌহনির্মিত কিছু যন্ত্রাংশ।
হঠাৎ ধরা পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বধূটি ধূলো ঝেড়ে ঘরের দিকে একেবারে দে ছুট।পরিচিত গ্রাম্য বধূটির এমন রূপ দেখে সবাই পরিত্রাহী চেঁচিয়ে চারদিকে ছুট লাগাল।সারা গ্রামে ঘটনাটা খবর হল।গ্রামের অশিক্ষিত মূর্খ মানুষজন ও তাদের মাথারা একসাথে হয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল..."নির্ঘাত বধূটির ঘাড়ে কোনো অপদেবতা ভর করেছে।ভূত খেদাতে হবে।"
কিন্তু গ্রামের কোনো গুনীন ওঝারই সাহসে কুলাল না।কি হবে এইবার!ভূত তো তাড়াতে হবে।কিন্তু তার উপায় কি!
অগত্যা গ্রামের সব মাথারা বধূটির খড়ের ছাওয়া দেওয়া কুঁড়েটির সামনেটা ঘিরে ধরে ফুল বেলপাতা নিবেদনে,সাধ্যমতো নৈবেদ্য দানের আয়োজন করে,রীতিমতো ঘটা করে দুহাত তুলে পূজো অর্চনা আরম্ভ করে দিল।ওদিকে কুঁড়ের দরজা তখন থেকেই বন্ধ।
ওই কুঁড়েঘরটাতে বধূটি একাই থাকে।ওর স্বামী গত হয়েছে বছর দুই হবে।আর বাবা মা ও দেহ রেখেছেন কয়েকমাস হল।সেই থেকে বধূটি এই ভগ্নকুটিরে একা থেকে কাঠ কেটে তার জীবন ও ও জীবিকা নির্বাহ করে।ওর স্বামীটি...শোনা যায় শহরের বাসিন্দা।অনেক লেখাপড়া জানা মানুষ।দুই বছর আগে স্বামীকে হারিয়ে...আর মাসখানেক আগে বাবা মাকে হারিয়ে ও একেবারেই শোকস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।থাকে নিজের মতন।কথাবার্তা বলে কম।ইদানীং বিভিন্ন নেশাখোর...স্ফূর্তিবাজের শকুনির দৃষ্টি আর কুপ্রস্তাব ওর জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।কোনোমতে দিন গুজরান হয় এখন ওর।এইরকম একজন ম্রিয়মান প্রদীপের এমন অকস্মাৎ আত্মপ্রকাশে স্তম্ভিত গোটা গ্রাম সবে তাদের বিস্ময়ের ঘোরটা কাটিয়ে উঠে যোগাড়যন্ত্র করে "প্রেত তাড়ানোর পূজো"তে যখন একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশ করেছে,তখন হঠাৎই সেখানে সাংবাদিকদের আনাগোনা শুরু হয়।খবর তার মানে গ্রামের চৌহদ্দি পার করে গিয়েছে।গ্রামের মানুষ তাদের পূজাপাঠে বিঘ্ন ঘটায় যারপরনাই ক্ষেপে উঠল।প্রেতাত্মার কবল থেকে সবাইকে বাঁচাতে বদ্ধপরিপক গ্রামবাসীরা বধূটির কুঁড়েঘরের ত্রিসীমানা পর্যন্ত ঘেঁষতে দিচ্ছে না।সমবেত কন্ঠে সবার একটাই বক্তব্য।আজ পূজোটা চুকে যাক...যার যা খবর নেবার বা ছবি তোলার...সব কাল করবেন।
ক্ষিপ্ত গ্রামবাসীদের সাথে ঝামেলা কিছুক্ষণ চলার পর অবশেষে সাংবাদিকরা সেদিনকার মতো রণেভঙ্গ দিতে বাধ্য হল।কিন্তু পরদিন তার জরাজীর্ণ ভগ্ন কুটিরটি ফের লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠল।এবারে গ্রামবাসীদের ছাপিয়ে গিয়ে সেখানে এখন হত্যে দিয়ে পড়ে আছে প্রেস,মিডিয়া।এত ডাকাডাকিতেও ভিতর থেকে উত্তর শুধু একটাই।দরজা সে কিছুতেই খুলবে না।
অনেক ডাকাডাকি...অনেক অনুরোধ উপরোধের পরে অবশেষে হঠাৎ ক্যাঁচ করে খুলল ঘরের দরজা।ভিতর থেকে আপাদমস্তক শাড়ি ঘোমটায় আবৃত যে নারীমূর্তি উদয় হল...তাকে আপাত দৃষ্টিতে নিপাট গ্রাম্য বধূর বাইরে আর কিছুই মনে হয় না।থতমত খাওয়া সলজ্জ চাহনি আর বারংবার ঘোমটা টেনেটুনে আব্রু রক্ষার আপ্রাণ প্রচেষ্টা দেখে তার সম্বন্ধে যা কিছু রটেছে...তা নির্দ্বিধায় ফু দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার কথা মনে হওয়াটাই নিতান্ত স্বাভাবিক।কিছু ঘটনা যে সত্য...সে কথা অস্বীকার করার এখন আর কোনো জায়গা নেই।
ওই ছোট্ট কুঁড়েটির চারপাশে ঘিরে থাকা অসংখ্য মানুষের বেষ্টনীটি জুড়ে এখন একটা প্রশ্ন তোলপাড় করে চলছে যার উত্তর খুঁজতে এখন কুঁড়েঘরের দরজার সামনেটায় ক্যামেরা নিয়ে উদগ্রীব একদল সাংবাদিক।অবশেষে তারা অনেক অনুনগ বিনয়ের পরে ভিতরে ঢোকার এবং তার কাছাকাছি আসবার অনুমতি পেল।তার খানিকক্ষণ পরেই শুরু হল সেই বিরল সাক্ষাৎকার পর্ব।আলোকচিত্রীদের সামনে বসে সলজ্জ বধূটির কথা,তার কাহিনী মূহুর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকল গোটা বিশ্ববাসীর কাছে।তার এই লৌহনির্মিত যান্ত্রিক দেহ ধারণকারী রক্তমাংসের নারীসত্ত্বাটি পেঁয়াজের খোসার মত উন্মোচিত হতে থাকল একটু একটু করে ক্যামেরা লাইট এখন তাকে ঘিরে রয়েছে আর তার ধাতব শরীর চুঁইয়ে বধূটির অশ্রুস্বরূপ হৃদয়কথন শুরু হল
সকলে ফিরে গেল দশ বছর আগের বৈজ্ঞানিক মহলে আলোড়ন জাগানো সেই বিতর্কিত সময়ে...যখন বিশ্বখ্যাত বাঙালি বৈজ্ঞানিক দীপঙ্কর গাঙ্গুলী তার সারা বিশ্বে সাড়া ফেলে দেওয়া আবিষ্কারের সফল পরিণতি দানের সফলতার দিশা দেখাতে শুরু করেছিলেন।তিনি মৃত মানুষের আত্মাকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলার এক নজির তৈরি করে পৃথিবীর বুকে ইতিহাস গড়র পদক্ষেপ নিতে যখন আরম্ভ করেছেন...তখন বৈজ্ঞানিক মহলে নানারকম স্বার্থের সংঘাত...জটিলতা...কুটিলতা...ঈর্ষা এবং ষড়যন্ত্রের কবলে এমনভাবেই পড়েছিলেন,যে তাঁর গবেষণা মাঝপথেই স্হগিত রাখতে হয়েছিল...এমনকি টাকার বিনিময়ে তাঁর রিসার্চের যাবতীয় খতিয়ান বিক্রি করার জন্য এমনভাবেই চাপ আসছিল...যা যেকোনো সময়েই তাঁর মৃত্যুর কারণে পরিণত হওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল।সবকিছুর হাত থেকে তার গবেষণাকে বাঁচাতে তিনি হঠাৎই অন্তর্ধান করেন।বৈজ্ঞানিক মহলে তাঁর রিসার্চের ব্যর্থতার কথা জানিয়ে একটি চিঠি পাঠান।এরপর আর তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।বর্তমানে তিনি জীবিত না মৃত তা নিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে জারি রয়েছে জোর বিতর্ক।কারোর মতে তিনি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন...আবার কারোর মতে তিনি মারা যাননি।সবার অলক্ষ্যে তার ইতিহাসের নতুন নজির তৈরি করার জন্য আত্মগোপন করে তাঁর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন আজও।সময় হলেই তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন।
তবে গবেষণায় অসফলতার কথা জানিয়ে যে চিঠিখানি তিনি বৈজ্ঞানিক মহলে পাঠিয়েছিলেন...তা প্রকাশ্যে আসবার পর আলোড়ন ক্রমে থিতিয়ে যেতে থাকে।সমসাময়িক সময়েই...বাঁকুড়ার এই প্রত্যন্ত গ্রাম্য অঞ্চলটিতে পৃথিবীর অগ্রগতির থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন...গ্রাম্য নিরক্ষর মানুষের মধ্যে তিনি সহজেই তাঁর পরিচয় গোপন করে সেখানে সাময়িক একটি আস্তানার ব্যবস্হা করেন এবং ওই পাহাড়ী জায়গার ছোট্ট উদরেই তিনি তাঁর অসমাপ্ত গবেষণা আরম্ভ করেন।সেই সময়ে...তিনি লক্ষ্য করেন...প্রতিদিন সকালে এক ছিন্ন-মলিন বসনা কিছু কৃষ্ণাঙ্গ নারী তার পাহাড়ী গুহার কাছাকাছি অবস্থিত বিরাট জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করতে আসে।তিনি ভাবলেন...রুজির তাগিদে আসা এই কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েগুলোর একজনকে যদি কিছুদিনের জন্য গবেষণার জন্য পাওয়া যেত...তাহলে এইবার গবেষণাটা সম্পূর্ণ হয়...।এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি তাঁকে।মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিন গুজরান করা এই গরীবগুর্বো মেয়েগুলির মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নিয়ে...একেবারে তার বাবা মায়ের সামনে পৌঁছে গেলেন তিনি।মোটা টাকা উপঢৌকন আর সাথে পূর্ণ গোপনীয়তার নিশ্চিন্ততায় আশ্বস্ত করলেন তাঁদের।নিজেদের ঘরের মেয়ে কয়েকটা দিন থাকবে একজন অপরিচিত পুরুষের জিম্মায়...এটা শিক্ষিত বা অশিক্ষিত...কোন বাবা মায়ের পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।কিন্তু তারা আর কিই বা করবে...!ঘরে যে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।ভরা পেটে মান ইজ্জত নিয়ে চিন্তা করা সম্ভব...খালি পেটে নয়!এমনই কিছু ভাবনাচিন্তা দিয়ে তাঁরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেদের মনকে বুঝিয়ে তাঁর কথাতে রাজী হয়ে গেল।এখন যে টাকার বান্ডিলটা ওর বাবার হাতে ধরা রয়েছে...অত টাকা একসাথে ওদের চোদ্দপুরুষ চোখে দেখেনি।
মেয়েটি বৈজ্ঞানিকের ওই পাহাড়ের গর্তটিতে সবার অলক্ষ্যে অনির্দিষ্ট কয়েকদিনের জন্য ঠাঁই নিল।আর বৈজ্ঞানিক দীপঙ্কর গাঙ্গুলি নিজে শুধুমাত্র মেয়েটির খাবার জোগাড় আর দৈনন্দিন কাজকর্মটুকু বাদ দিয়ে...নাওয়া খাওয়া ভুলে দিন রাত একেবারে এক করে কঠিন পরিশ্রমের অধ্যাবসায়ে একাগ্রচিত্তে অবগাহন করলেন।জনমানবহীন আঁধারগ্রাসী নিস্তব্ধতার সাগরে অবগাহন করে ছোট্ট গুহায় টিমটিমে বাল্বের মায়াবী আলোআঁধারিতে তাঁর ছোট্ট ল্যাবরেটরিতে লোকচক্ষুর আড়ালে তিনি ধীরে ধীরে কৃষ্ণাঙ্গ নারীটির অবয়বকে দু হাতে কয়েদ করে তৈরি করলেন এক যন্ত্রমানবী।চারদিকে শৃগালধ্বনি,ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক...আর জগৎজোড়া আদিমতার আচ্ছাদনে ওই ছোট্ট গুহায় নিজের প্রাত্যহিক জগৎ জীবন থেকে বেরিয়ে এসে অনির্দিষ্ট দিনের জন্য বাবা মা কে ছেড়ে এইভাবে পড়ে থাকাটা মেয়েটির পক্ষে কিন্তু মোটেই সহজসাধ্য হয়নি।মাঝে মাঝেই সে কান্নাকাটি করত,খিটখিটে হয়ে উঠত...রাগান্বিত হয়ে উঠত...আবার মাঝে মাঝে স্হানকালপাত্র ভুলে বৈজ্ঞানিকের ওপর মেজাজও দেখাত।পরিস্থিতির চোরাস্রোতে অবগাহনরত বৈজ্ঞানিক তাঁর গবেষণা অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে কখনো ক্রন্দনরত মেয়েটির পিঠে হাত বুলিয়ে...দুই হাতে তার চোখের জল মুছিয়ে দিতেন...কখনো মেজাজ হারানো মেয়েটির ক্রোধ শান্ত করতেন...বাবা মাকে ছেড়ে থাকার রাগে অভিমানে সে যখন দুই চোখের কোল ভরাত,তিনি নিজের হাতে তাকে খাইয়েও দিতেন।তাঁর কাজে সাহচর্য দিতে গিয়ে মেয়েটির কোনো ভুলভ্রান্তি হলে তিনি তাকে ভীষণ বকুনি দিতেন,কিন্তু মায়াবী পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় স্নাত সেই কৃষ্ণাঙ্গ অভিমান তিনি নিজে মিষ্টি কথা আর আদর দিয়ে ঠিকই ভাঙাতেন ওই ছোট্ট গুহায় তাদের নির্দিষ্ট করে দৈনন্দিন কোনো রুটিনই ছিল না।খাওয়া...ঘুম...আর কাজের সময়েরও কোনো ল্যাজামুড়ো ছিল না।কখনো কাজের মাঝে...দুজনে নিজেদের সুখ...দুঃখ...হাসিকান্নার প্রাণবন্ত গল্পকথায় মেতে উঠত।এইভাবে টকমিষ্টি একটি ভিন্নস্বাদের সময় অতিক্রম করার পর অবশেষে এল মেয়েটির অবয়বধারী যন্ত্রমানবীর সাথে ওর আত্মার সংযোগ করার সেই মাাহেন্দ্রক্ষণ।সেই সময় বৈজ্ঞানিক হঠাৎ জ্বরে পড়লেন।তুমুল জ্বরে তিনি একেবারেই শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন।মেয়েটি হঠাৎ বৈজ্ঞানিককে এইভাবে অসুস্থ হয়ে শয্যা নিতে যখন দেখল...তখন ওর মনের ভিতরটায় যেন প্রচন্ডভাবে উথালপাথাল শুরু হয়ে গেল।ও তখন রাত দিন এক করে তাঁর সেবাযত্ন আরম্ভ করে দিল।লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকার কারণে,গুহায় সঞ্চিত যৎকিঞ্চিৎ পরিমাণ চাল আর ডাল নিয়ে পাতলা খিচুড়ি রান্না করে খাওয়াত জ্বরক্লিষ্ট রোগীকে।সারারাত শিয়রে জেগে বসে থাকত রোগীর মাথাখানি নিজের কোলে নিয়ে।জ্বরের লক্ষণ বুঝে নিয়ে নিকটবর্তী জঙ্গল থেকে খুঁজে পেতে শিকড়বাকড় বা লতাপাতা...জরিবুটি সংগ্রহ করে এনে জ্বরের টোটকার মতো ওষুধ তৈরি করে নিজের হাতে খাইয়ে দিত।তুমুল সেই জ্বরের ঘোরে এল সেই উথালপাথাল ঝড়ের রাত।জনমানবহীন আদিমতার চাদরে মোড়া সেই মায়ারাতে যখন প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে মেতে উঠে উদ্দামিনীর রূপ ধারণ করেছে...সেই মাহেন্দ্রক্ষণে দুনিয়া জগৎ একদিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিক দীপঙ্কর গাঙ্গুলী তাঁর আপন দুইহাতের মুঠোয় কাঙালের মতো ওই গ্রাম্য রমনীর হাতদুটি ধরে কাতর কন্ঠে তাকে ছাড়া আপন অস্তিত্বহীনতার গোপন সত্যটি অকপটে বলে ফেললেন।চারদিকে প্রকৃতি উদ্দাম তান্ডবনৃত্য শুরু করে দিয়েছে।আর তার সেই ভৈরবী নৃত্যের উন্মাদনায় নিজেদের সবকিছু উজাড় করে দিয়ে উন্মাদনার অন্য সুর নিয়ে হঠাৎ সেখানে এক পার্বত্য গুহার আলোআঁধারির মায়ায় জেগে উঠতে থাকল একজোড়া কপোত কপোতী...।
অবশেষে...ধীরে ধীরে...সুস্থ হয়ে উঠলেন বৈজ্ঞানিক দীপঙ্কর।হাঁটাচলা করার ক্ষমতা আগের মতো ফিরে পেতেই আর কালবিলম্ব না করে তিনি মেয়েটিকে নিয়ে সোজা তার বাবা মায়ের সামনে হাজির হলেন তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে।ভুলে বসলেন তাঁর গবেষণার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের কথা।ওদিকে মেয়েটির দিন আনি দিন খাই দারিদ্র্যের জ্বালাতে সারাটা জীবন ধরে জাবর কাটতে থাকা মেয়েটির হতদরিদ্র বাবা মা তো তার এই প্রস্তাবে এক কথায় রাজি হয়ে গেল।দীপঙ্কর আর দেরি করতে চাইলেন না।সাত দিনের মাথায় একটা দিন দেখে তিনি বিয়ের তারিখটা ঠিক করে ফেললেন।এই মূহুর্তে বিয়ের ব্যাপারটা কাউকে জানানোটা তিনি সমীচীন মনে করলেন না।তাই তিনি একাই সবকিছুর যোগাড়যন্ত্র প্রস্তুত করার কাজে লেগে পড়লেন।এরই মধ্যে এক সন্ধ্যায় তিনি তাঁর হবু স্ত্রীর জন্য পছন্দ করে কিছু অলঙ্কার কিনে এনে সেগুলি নিয়ে তার সামনে এলেন।ঠিক এমন সময়ে...হঠাৎ এক বিষাক্ত পাহাড়ী সাপের দংশনে মেয়েটি নীল হয়ে যেতে থাকল।দুইহাত ভর্তি গহনার বাক্স তখনই মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল আর দিশেহারা দীপঙ্কর মৃত্যুপথযাত্রী প্রেয়সীকে দুইহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে উন্মাদের ন্যায়ে মাথা কুটতে আরম্ভ করলেন।তিনি জানতেন,এই সাপের ছোবলে মানুষ বাঁচে না।বিনামেঘে এহেন বজ্রপাতে ক্রন্দনরত দিশাহারা বৈজ্ঞানিককে মৃত্যুপথযাত্রী মেয়েটি আস্তে আস্তে বলতে থাকল...
---"বাবু...আমি তো আর বেশিক্ষণ নেই...আমি বুঝতে পারছি...আমাকে ছাড়া আপনি বাঁচতেই পারবেন নে।আপনি এক কাজ করুন...আপনি যে জন্য আমায় আপনের কাছে রেখেছিলেন...সেই কাজটাই শেষ করেন...আমার আত্মার সাথে আমার আদলে তৈরী আপনের লোহার পুতুলটাকে জুড়ে দিন।তাইলে মরণ আর আমাকে আপনার থেকে আলাদা করতে পারবে নে।"
এ কথাটা শুনে বৈজ্ঞানিকের মনে তখন হঠাৎ শেষ আশার আলো দপ করে জ্বলে উঠল।যতক্ষণ ওর দেহে প্রাণ আছে...যে করেই হোক...ওকে গুহায় নিয়ে যেতে হবে।
জীবন মরণ এক জায়গায় এনে মেয়েটিকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলেন বৈজ্ঞানিক।ঘন জঙ্গলের ভিতরে উন্মাদের মতো ছুটতে থাকলেন সেই পাহাড়ী গুহার পথকে গন্তব্য করে।গুহায় পৌঁছেই তিনি তাঁর কালজয়ী গবেষণার পরিণতির রূপ দিতে মরিয়া হয়ে উঠলেন...শুধুমাত্র তাঁর প্রেয়সীকে হারিয়ে না ফেলার আকুতি নিয়ে।তিনি মেয়েটির অবয়বধারী যন্ত্রমানবীর শরীরে একটু একটু করে মেয়েটির আত্মার সংযোগ ঘটাতে আরম্ভ করে দিলেন।আস্তে আস্তে করে লৌহ মানবী চোখ মেলল।তার ঠোঁট নড়ে উঠল।হাতের আঙুলে দেখা গেল কম্পন!আস্তে আস্তে করে প্রজ্জ্বলিত হল লৌহমানবীর কন্ঠস্বর।একেবারে তার প্রেয়সীর মতোই তার কন্ঠে ভেসে উঠল সেই চেনা ডাক।"বাবু...বাবু...!
জয়ের আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন দীপঙ্কর।ঠিক তখনই তিনি খেয়াল করলেন...এই "বাবু" শব্দটি দুইদিক থেকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।তিনি সম্বিৎ ফিরে পেয়ে লৌহমানবীকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে গেলেন তার রক্তমাংসের প্রেয়সীর দিকে।তার মুখে তখন গ্যাঁজলা উঠতে শুরু করেছে।সে মৃদু হেসে বলে উঠল..."বাবু...আমি ছেড়ে যাব নি আপনাকে...।আপনি কিচ্ছু ভাববেন নে।"
বলতে বলতে হঠাৎ তার দুচোখের মণি স্হির হয়ে গেল।সাথে সাথে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য দীপঙ্কর তাকে জাপটে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন।হঠাৎ পাশ থেকে ডাক শোনা গেল।"বাবু...কাঁদেন কেন!এই তো আমি...!"
চকিতে কন্ঠস্বর অনুসরণ করে দৃষ্টি ফেরান তিনি।দেখলেন...অবাক করা দৃশ্য।তার রক্তমাংসের মৃত প্রেয়সীর থেকে অল্প দূরেই লৌহশরীরের মধ্যে সে একেবারে পূর্বের মতোই জীবিত হয়ে উঠেছে...যেন কিছুই হয়নি
"বাবু...ওটা আমার রক্তমাংসের শরীর।ওটা নষ্ট হয়ে গিছে।এখন আমি এইখেনে আছি বাবু...আর কষ্ট পাবেন নে...!"
আনন্দে আত্মহারা ক্ষ্যাপা শিশুর মতো দীপঙ্কর ছুটে গিয়ে আলিঙ্গন করল লৌহমানবীকে...নতুন করে হারানো প্রেয়সীকে ফিরে পাওয়ার উন্মাদনা নিয়ে...!
বড়ো স্বর্গীয় সেই আলিঙ্গন।যেখানে নেই কোনো কোমল স্পর্শ...নেই তপ্ততা...নেই কোনোপ্রকার পার্থিব কামনা...।শরীরে তিনি অনুভব করলেন শুধুই ধাতব কাঠিন্য।কিন্তু তাতে তাঁর হৃদয়ের তৃষ্ণা ষোলোআনাই মিটল।তিনি বাস্তবকে এখন পুরোপুরি বোধগম্য করতে সমর্থ হলেন।তাঁর প্রেয়সী এইমাত্র তার রক্তমাংসের খোলস ছেড়ে রেখে তার মুখের অবয়বধারী এই লৌহশরীরে এসে প্রবেশ করেছে।তার শরীরের এই মৃত্যুতে নেই কোনো শোক বা কোনো বিরহযন্ত্রনা।শুধুমাত্র ওর আত্মা এবং অস্তিত্বের স্হানান্তর ঘটেছে মাত্র।আত্মা রক্তমাংসের পোশাক খুলে প্রবেশ করেছে বৈজ্ঞানিক দীপঙ্কর নির্মিত লৌহনির্মিত যন্ত্রের ভিতরে...।
ক্রমে তারা দুজনেই স্বাভাবিক হতে থাকল...এবং ভাবতে থাকল...এখন কি করা যায়...!অবশেষে তারা এই মনস্হির করল...শরীরটাকে গুহার মাটি খুঁড়ে তার নীচে কবর দিয়ে তারা ফিরে যাবে...এবং বিয়েটা সেরে ফেলবে।যা হয়ে গেছে...এই বিষয়ে কাউকে না জানানোই ভালো।সিদ্ধান্ত মতো তারা দুজনেই মাটি খুঁড়ে শরীরটা চাপা দিয়ে দিল।তারপর তারা ফিরে এল লোকালয়ে।বিয়ে সেরে নিল।আশংকা থেকে গেল...পৃথিবীর মানুষ না বুঝে বৈজ্ঞানিকের স্ত্রী কে পুরোপুরি মৃত হিসেবে ধরে নেবে...এবং বর্তমানে তার অস্তিত্বকে পুরোপুরি অস্বীকার করবে।ফলস্বরূপ পুনরায় আসবে বিচ্ছেদ।তাই এই সর্বপ্রকার সম্ভবনা এড়ানোর জন্য...দীপঙ্কর গাঙ্গুলী তাঁর বৈজ্ঞানিক মহলে তাঁর গবেষণার ব্যর্থতার কথা লিখে একটি খোলা চিঠি দিলেন।এবং তাঁর অতীত জীবনের সমস্ত গৌরব...বিশ্বজোড়া খ্যাতি...শহুরে জীবনযাপন...সবকিছু ছেড়েছুড়ে এই গন্ডগ্রামে এসে স্ত্রীর জবার সাথে কাঠ কেটে...সুখে শান্তিতে জীবন কাটাতে শুরু করলেন।তবে ধরা পড়ার ভয়ে...কদিন বাদে থেকেই জবা নিজেকে ক্রমশ গৃহবন্দী করে নিতে লাগল।তারপর তার স্বামী একাই কাঠ কেটে উপার্জন করে আনতেন আর জবা ছোট্ট কুঁড়েঘরের মধ্যে গুছিয়ে সংসার করত...আর স্বামীকে রেঁধেবেড়ে খাওয়াত।দিন সুখেই কাটছিল।বছর দুই আগে...দুর্ঘটনাবশত ওদের ঘরে আগুন লাগে...আর সেই আগুনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান দীপঙ্কর গাঙ্গুলী।সেই থেকে বিধবা জবা এই কুঁড়েঘরে একাই থাকে।সাথে থাকে কিছু নেড়ি কুকুর শাবক।এখন তাদের নিয়ে এই ছোট্ট সংসারে জববার দিন গুজরান।
গোটা কাহিনীটা শুনে সাংবাদিক থেকে শুরু করে সকলের পিঠের শিড়দাঁড়া জুড়ে একটি শীতল স্রোত নেমে গেল।
---"তার মানে আপনি রক্তমাংসের মানুষ নন?"
---"আজ্ঞে না।"
---"দশ বছর আগে আপনার পার্থিব শরীর মাটিচাপা পড়ে গেছে আর আপনি এই যন্ত্রের শরীর নিয়ে পৃথিবীর মাটিতে বিচরণ করছেন!তাই যদি হয়...তাহলে আপনার ক্ষুধা তৃষ্ণা বোধ থাকবার কথা নয়।তাই তো?"
---"আজ্ঞে হ্যাঁ।ঠিক ধরেছেন।"
---"তাহলে আপনি প্রতিদিন কাঠ কেটে উপার্জন করেন...রান্না করেন কার জন্য?"
---"আমার তো সংসার সন্তান নেই...হবেও না কোনোকালে।এই কুকুরছানাগুলোই আমার সন্তান।কাঠ কেটে টাকা রোজগার করে...এদেরকে রেঁধেবেড়ে খেতে দিই।এতেই আমার সন্তানসুখ..
সংসারের স্বপ্ন এইভাবেই আমি পালতে থাকি...।"
---"এই যে যন্ত্রের শরীরের মধ্যে আপনি রয়েছেন...এইভাবে আপনার আয়ূ কত আপনি জানেন?"
---"আমার তো মরণ নেই গো বাবুরা...আমি এ দুনিয়ায় অমর!অমরত্বের এই উপায়টিই আবিষ্কার করে গিয়েছেন আমার স্বামী।আমি মুখ্যু মেয়ে মানুষ বলে শেষকালে তাঁর মতো করে তাঁকে জীবন দিতে পারলুম নে...!"
সবাই দেখল...জবার ব্যথিত মুখমন্ডলে অশ্রুহীন ক্রন্দন।
---"তাঁর গবেষণার নথিগুলো এখন কোথায় আছে?"
---"আজ্ঞে...ওই কাগজগুলো তো ঘরে যেদিন আগুন লাগল...ওইদিনই পুড়ে শেষ হয়ে গিয়েছে।"
সকলের অপার বিস্ময়ের সাথে উন্মোচিত হল বহুদিনের আঁধারে নিমজ্জিত সত্যের।বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিক দীপঙ্কর গাঙ্গুলী তাঁর এই কালজয়ী আবিষ্কারের পরিণতি দানে সফল হয়েছিলেন এবং সৃষ্টি করে গিয়েছেন ইতিহাস।তারই নিদর্শন আজ বিশ্ববাসীর সামনে জাজ্বল্যমান এই লৌহমানবীর বেশে।কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে...তা উন্মোচিত হতে এতটাই সময় নিয়ে নিল...যে এই জীবন্ত ইতিহাস পৃথিবীর বুকে বিপ্লব না জাগিয়ে ফের ইতিহাসের পাতাতেই নিজের স্হান অলংকৃত করবে।
সমাপ্ত
রশ্মিতা দাস


