বিহিত
বিহিত


অনিকদের বাড়িটা পুরোনো দিনের। ছাদটা বেশ বড়। এই এলাকায় এখনও প্রোমোটারের থাবা পড়েনি বলে চারধারের বাড়িগুলো পুরোনো হলেও টিকে আছে। অনিকদের বাড়ির পিছনে একটা বড় বাগান আছে। তাতে রয়েছে আম, জাম কাঁঠাল, পিয়ারা, নানা রকমের গাছ। কত রকমের পাখী ওই বাগানে আসে, ফল খায়, ক্যাচর ম্যাচর করে, কেউ কেউ আবার বাসা তৈরি করে ডিম পাড়ে। অনিক শিশুকাল থেকে এই পরিবেশে বড় হয়েছে। অন্যেরা ওকে ছেলেমানুষ ভাবলেও অনিক নিজেকে এখন বড়ই ভাবে। বড় ভাববে নাই বা কেন? ক্লাস এইটে পড়ে, কতগুলো ক্লাস টপকে তবে এখানে এসেছে। অনিকদের বাড়িটা বড় হলেও থাকে মাত্র চারজন, বাবা, মা, অনেক দিনের কাজের লোক বিমল কাকু আর ও নিজে। আর একজন মানুষ যাকে আঁকড়ে অনিক বড় হয়েছ সেই ঠাকুমা বছর দুয়েক হল আকাশের তারা হয়ে গেছেন। বাড়িতে আর আশেপাশে ওর বয়সি কোন বাচ্চা না থাকায় ঠাকুমাই ছিল ওর বন্ধু। সারাদিন ঠাকুমার সাথে সাথে ঘুরত এমনকি ঘুমতও ঠাকুমার কাছে। ঠাকুমা সকালে পুজোপাঠ করে ছাদে গিয়ে পাখীদের জন্য দানা ছড়াতেন। আয় আয় করে দুএকবার ডাকতেই চারিদিক থেকে কত পাখী উড়ে আসত দানা খেতে। ঠাকুমার শরীর খারাপ হওয়ার পর থেকে অনিক একাই এসে দানা ছড়াত। এক এক রকম পাখীর এক এক রকম বুলি। পাখীদের মাঝে থাকতে থাকতে অনিক ওদের অনেক কথা বার্তাই ধীরে ধীরে বুঝতে পারত। আর সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার একটা সময় পরে ও ওদের মত বুলিও আওড়াতে পারত। ওদের ভাষা বুঝতে পারে আবার বলতেও পারে, ফলে অনেক পাখীর সাথেই ওর বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ওরা যখন দানা খেতে আসে তখন অনিকের সাথে দুটো মনের প্রাণের কথা বলে। অনিকের এই অদ্ভুত ক্ষমতার কথা বাইরের কেউ ত নয়ই বাড়ির লোকেরাও কেউ জানে না। অনিক ব্যাপারটা গোপন রেখেছিল। একবার তো বিমল কাকুর কাছে প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিল। একদিন পাখীদের সাথে আড্ডা দেওয়ার সময় খেয়াল করেনি যে বিমল কাকু ছাদে এসেছে। আড়াল থেকে ওকে লক্ষ করেছে।
পাখীগুলো চলে যেতে ও অনিকের কাছে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে শুধল- খোকাবাবু, কেমন কেমন সব আওয়াজ করছিলে গো! তোমার ডাকগুলো তো এক্কেরে ওই পাখীগুলোর মত শোনাচ্ছিল। ক্যামনে শিখলে অ্যাত রকমের বুলি?
এটা ওটা সেটা বলে অনিক কোনরকমে বিমল কাকুকে সামলেছিল। অনিকের অনুরোধ মেনে বিমল কাকুও ব্যাপারটা পাঁচকান করেনি, তার বিনিময়ে কাকুকে মাঝে মাঝে ওইসব বুলি একটু আধটু শোনাতে হত।
কাক সংখ্যায় একটু বেশি থাকলেও টিয়া চড়াই শালিক ময়না টুনটুনির মত আরো অনেক পাখী আসত। নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি কমই হত, একটু আধটু হলেও অনিক চারিদিকে আরো দানা ছড়িয়ে দিয়ে তা মিটিয়ে দিত। একদিন খবর পেয়ে কোথা থেকে দুটো কোকিল এল। কোকিল ছাদে এসে বসা মাত্রই কাকেরা দল বেঁধে রে রে করে তেড়ে গেল। কোকিলরা ভয় পেয়ে দূরে সরে গেল। অনিক কাকেদের একটু ধমক দিয়ে বলল, “তোমরা ওদের সাথে অমন ব্যবহার করছ কেন?”
কাকেদের পান্ডা ‘কালিরাম’ বলল, “বন্ধু তুমি কি জান যে ওরা ঠক? আমাদের বাসায় চুপিচুপি ঢুকে ডিম পেড়ে পালিয়া যায়। আর আমাদের ডিমের সাথে সেই ডিমেও তা দিয়ে বাচ্চা ফোটাই আমরা”।
এই ব্যাপারটা অনিক জানে আর এও জানে যে কোনভাবে বুঝতে পারলে কাকেরা কোকিলের বাচ্চাকে ঠুকরে মেরে ফেলে। তবু কি প্রকৃতির নিয়ম, এইভাবেই কোকিলরা এই পৃথিবীতে বহাল তবিয়তে টিকে আছে।
অনিক কাকেদের শান্ত করে বলে যে, “তোমরা কত ভাল কাজ করছ, ওদের বাচ্চাকে তোমরা পৃথিবীর আলো দেখাচ্ছ। ওরা নিজেরা পারে না তাই তো তোমাদের সাহায্
য নেয়। তোমরা সাহায্য কর বলেই না ওদের অত সুন্দর গান শুনতে পাই”। কাকেরা যে না বুঝে কাজটা করে সে কথা অনিক বলে নি। আরো কিছু দানা দিয়ে কাকেদের মান ভাঙাল। ভরসা পেয়ে কোকিল দুটো এসে দানা খেতে শুরু করল।
অনিক ভাবে, একটু সাহায্য করে বলে কাকেদের কোকিলের ওপর কত রাগ। কোকিল না থাকলে অমন মিষ্টি ডাক কে শোনাত? কাকেদের রাগারাগি দেখে অনিকের হঠাৎ আশু কাকুর কথা মনে পড়ল।
কোকিলের মত আশু কাকুরও কিছু সমস্যা আছে। মানুষটার স্থায়ী কোন রোজগার নেই। তবে বসে থাকে না, এটা ওটা সেটা করে সবসময় কিছু না কিছু রোজগারের চেষ্টা করে। আর মানুষটাতো খুবই ভাল, যার যখন যা দরকার হাসিমুখে করে দেয়। সবার বিপদে আপদে পাশে থাকে। বিয়ে থা করেনি, দাদাদের সংসারে থাকে। দুই বৌদি সারাদিন ওকে দিয়ে ফাইফরমাস খাটায়, তার পরেও ‘বেকার’, ‘ভ্যাগাবন্ড’, ‘আপদ’, এইসব নানা কুকথা বলে গালমন্দ করে। ভালোমানুষ আশু মুখ বুজে সব সহ্য করে। আশু কাকুকে দেখে অনিকের খুব কষ্ট হয়। এইসব দুঃখ কষ্টের কথা একদিন সকালে গল্প করার সময় অনিক পাখীদের জানাল। বন্ধুর দুঃখে পাখীরাও দুঃখ পেল। সকলেই একমত হল যে এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। কিভাবে এর বিহিত করা যায় তা আলোচনার জন্য পরেরদিন খাওয়া দাওয়ার পরে পাখীদের সর্বদলীয় মিটিং ডাকা হল। ‘কালিরাম’ চিন্তা ভাবনা আর নিজের লোকজনদের সাথে আলোচনা করে জানাল, “বন্ধু, ওদের ভয় দেখাতে হবে”।
অনিক জিজ্ঞেস করল,”কিভাবে?”।
--ওদের বাড়ির গাছের আড়াল থেকে নানা রকম কথা বলে ভয় দেখাতে হবে। কিন্তু আমরা তো তোমাদের মত কথা বলতে পারি না, ওটা ময়না আর চন্দনা পারে।
ময়না আর চন্দনা দুজনেই রাজি।
ওরা বলল—আমরা রোজ মানুষের গলা করে ভয় দেখাব। কিন্তু সমস্যা হল, আমরা তো কেবল গলা নকল করতে পারি, নিজের মত করে কোন কথা তৈরি করে বলতে পারি না।
অনিক আশ্বস্ত করে বলল, “ওটা আমি বলে দেব”।
যেমন আলোচনা তেমনি কাজ। পরদিন সকালেই ময়না কপচাল,
হুকুম তামিল করে আশু, যখন যা দরকার,
আশু ছাড়া গতি নেই, তবু নাকি সে বেকার।
ময়নার বলা শেষ হতেই অনেকগুলো কাক ‘কালিরাম’এর নেতৃত্বে একসাথে কর্কশ কন্ঠে কাকাকাকা করে চিৎকার করে উঠল।
প্রথম দিকে তেমন খেয়াল না করলেও বার কয়েক এইরকম বলার পরে সকলের টনক নড়ল।
খানিক বাদে চন্দনা বলে উঠল,
ফরমাস দিনভর,
আশু কি তোদের চাকর?
পরে যথারীতি কাকেদের কর্কশ কোরাস। কত্তারা বাড়ি ফিরলে বৌয়েরা এই অদ্ভুত ঘটনার কথা তাদের জানাল। বড় ভাই গুরুত্ব দিয়ে শুনলেও মেজজন গা করল না। তবে ঘটনাটা আবার যদি ঘটে তাহলে তা নিজের কানে শোনার জন্যে দু ভাই পরের দিন অফিস কামাই করে বাড়িতে রইল। পরের দিন বেলা একটু বাড়তেই আগের দিনের বলা বুলির সাথে যোগ করে ময়না আর চন্দনা থেকে থেকে হাঁকল-
যার ঘাড়ে ভর করে
করছিস ঘর,
তাকেই কিনা ‘আপদ’ বলিস
তোরা এমনই বর্বর!
কিছু পরেই আবার--
আশুকে যদি কষ্ট দিস
সব কটাকে করব ফিনিশ।
বাসিস যদি আশুকে ভাল,
তবেই দেখবি সুখের আলো।
সব কটার শেষেই হচ্ছিল কাকেদের ভয়ানক চিৎকার।
নিজেদের কানে সবটা শুনে ভাইয়েরাও ঘাবড়ে গেল। কয়েক দিন এইভাবে চলার পরে ভয়ের ঠ্যালায় ছোট ভাইয়ের সাথে বাড়ির কেউ আর খারাপ ব্যবহার করার সাহস পায়নি। অনিকের আশু কাকু এখন সুখেই আছে।