বিদিশার রিসার্চ পেপার
বিদিশার রিসার্চ পেপার
আজও ফারাও এর শয়ন কক্ষ অবধি পৌঁছতে পারলেন না রাণী। ফারাও খুবই অসুস্থ। কিন্তু কি অসুখ কেউ তো বুঝিয়ে বলছে না। কি চিকিৎসা করছেন রাজবৈদ্য? সামান্য একটা চোট তিনি সারতে পারছেন না! নাকি সারতে চেষ্টা করছেন না! আজকাল কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। মনে হয় চারিদিকে কিসের যেন ষড়যন্ত্র চলছে। মৃত্যু যেন ওৎ পেতে রয়েছে প্রাসাদের আনাচে কানাচে। আপন কক্ষে ফিরে এলেন বিষণ্ণ রাণী। অনেক গুলো প্রশ্ন ঠেলে উঠে আসছে ভেতর থেকে। কিন্তু সেই প্রশ্ন গুলোর উত্তর কার কাছে পাবেন! এ কি! জাফরির ফাঁক দিয়ে কার যেন দুটি চোখ, অপলকে তাকিয়ে রয়েছে এদিকেই ! কি ক্রুর দৃষ্টি তার! খাপ মুক্ত ছুরিকা হাতে ছুটে গেলেন রাণী দরজার বাইরে। কে? কে ওখানে? কই! নেইতো কেউ ! লম্বা প্রশস্ত প্রাসাদের অলিন্দ । জনপ্রাণী নেই। একটা সময়ে আলোয় ঝলমল করত এই অলিন্দ ।আজ দু প্রান্তে দুটি মাত্র দেওয়ালগিরি জ্বলছে। স্থানে স্থানে জমে রয়েছে চাপ বাঁধা অন্ধকার। বারান্দার থামগুলোর পেছনে কোন ভয়ংকর লুকিয়ে রয়েছে কে জানে! ওই তো, ওই থামটার পেছনেই সেদিন এক গলা কাটা প্রহরীর দেহ পাওয়া গিয়েছিল।হঠাৎ দেওয়ালে কার যেন ছায়া দেখে শিউরে উঠলেন রাণী। কে ওখানে? নাঃ। এবারেও ভুল। নিজের ছায়াকেও ভয় লাগছে এখন। ধীর পদক্ষেপে আপন কক্ষে ফিরে এলেন রাণী। বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস।
ফারাও আখেনআটেন এবং রাণী নেফেরতিতির কন্যা আঙ্খেসেনামুন, অষ্টাদশ রাজবংশীয় ফারাও তুতনখামেন যার স্বামী, তার কি এরকম ভয় পাওয়ার কথা! তবু ভয় পাচ্ছেন আঙ্খেসেনামুন। প্রধান সেনাপতি হোরেমহেব এবং রাজপুরোহিত অয় এর লোভের ফাঁদে পা দিতে চাননি। তাই আজ তিনি নজর বন্দি। তুতনখের শয়ন কক্ষে যাবার অধিকার কেড়ে নিয়েছে ওরা। ফারাও বেঁচে থাকা কালীন তাঁর রাণীর সাথে কি এরকম আচরণ করা যায়! এটাই আজ বোঝাতে চেয়েছিলেন প্রধান সেনাপতি হোরেমহেব কে। বোঝাতে পারেন নি রাণী। বুক কাঁপানো হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে হোরেমহেব, ওদের শর্ত না মানলে ফারাও পত্নী কে প্রাণ খোয়াতে হবে ।
রাত দুটো। খাতার মধ্যে কলম টা রেখে উঠে দাঁড়ালো বিদিশা ব্যানার্জি । ইতিহাসের ছাত্রী। রিসার্চ স্কলার। মিশরের ইতিহাস ওর বিষয়। বিষয় টা যথেষ্ট জটিল এবং রহস্যের আবরণে মোড়া। বিশেষ করে অষ্টাদশ রাজবংশের ফারাও তুতনখামেনের অধ্যায় টা ভীষণ রহস্যময়।
অষ্টাদশ রাজবংশের ফারাও, বালক তুতনখ। সূর্য দেবতা আমেনের উপাসক ।
তাই তুতনখ-আমেন ।নিজের থেকে বয়সে সামান্য বড় আঙ্খেসেনামুনের সাথে বালক তুতনখ এর বিয়ে হয়। তারপর রাজ্যাভিষেক। অনেকেই ভেবেছিল, রাজ্যের শাসনভার এক অনভিজ্ঞ বালকের হাতে। সুতরাং যা খুশি তাই করা যাবে। কিন্তু তাদের ধারণা কে ভূল প্রমাণিত করে শক্ত হাতে রাজদন্ড ধারণ করেছিলেন বালক ফারাও। আঙ্খেসেনামুনের বুদ্ধি আর তুতনখ এর শক্তি সাহস, ও কর্মনিপুনতা মিশরের উন্নয়নে এনেছিল এক অন্য মাত্রা। কারো কারো তাতে অসুবিধা ঘটছিল। শুরু হল ষড়যন্ত্র। ভালোবাসার আড়ালে শানিত ছুরির ঝলক কি টের পেয়েছিলেন তুতনখ! কথাটা ভাবতে ভাবতে আবার ডুবে যায় নিজের স্বপ্নের মধ্যে।
কি সেই শর্ত? ডাগর দুটি চোখ তুলে প্রশ্ন করে রুবেলা। দ্রুত শয্যা থেকে নেমে কক্ষের দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় সায়রা। উঁকি মেরে বাইরে টা দেখে নেয় একঝলক ।নিঃশব্দে অর্গল রুদ্ধ করে ফিরে আসে শয্যায়। ফিসফিস করে বলে, কেউ শুনতে পেলে আমাদের দুজনেরই গর্দান যাবে। ওই যে শয়তান সেনাপতি আর রাজ পুরোহিত, দুজনেই আমাদের রাণী মা কে বিয়ে করতে চাইছে। রাণীমা কে যে বিয়ে করবে, সে ই তো এরপর ফারাও হবে। কিসের একটা খসখস আওয়াজ শুনে সায়রা র মুখটা সবলে চেপে ধরে রুবেলা। দুজনের চোখ বিস্ফারিত। পাথরের মেঝের ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে সরিসৃপ টা। সাংঘাতিক বিষধর। বাইরের থেকে আসা একঝলক ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটায় নিভে গেল দেওয়ালগিরি টা। অন্ধকারে শয্যার ওপরেই মুর্ছিত হয়ে পড়ল রাজ বংশীয় দুই নারী ।
এককাপ কফি নিয়ে আবার নিজের চেয়ারে ফিরে আসে বিদিশা। এতক্ষণ যেন ইতিহাসের পাতার ভেতরেই হারিয়ে গিয়েছিল মনটা। কিছু ছবি যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। কফির কাপে চুমুক দিয়ে নিজেকে আবার বাস্তবে ফিরিয়ে আনে বিদিশা। নাঃ ।এসব গল্পের কোনও ভিত্তি নেই। স্বপ্ন দেখে রিসার্চ পেপার তৈরি করা যায় না। প্রামাণ্য তথ্য চাই।
তুতনখামেনের মৃত্যুও রহস্যের আবরণে মোড়া। মাত্র উনিশ বছর বয়সে মারা যান তুতনখামেন। কিন্তু এই মৃত্যুর কারণ কি! তাঁর সমাধি আবিস্কারের পর মমির এক্সরে করে জানা যায়, তাঁর মাথার পিছনের অংশে ছিল আঘাতের চিহ্ন। সারা শরীরের হাড় গুলোতেও ছিল ফাটল। তাই অনুমান করা হয়, হত্যা করা হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু কারণ কি! সিংহাসনের দাবী! তুতনখামেনের পরমাসুন্দরী স্ত্রী আঙ্খেসেনামুনের অতুল রূপ আর যৌবন! আর ভাবতে পারে না বিদিশা। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে শরীরটা। চেয়ারের পিঠে এলিয়ে দেয় নিজেকে। এক সময়ে তলিয়ে যায় ঘুমের অতলে। রাত্রি শেষের স্বপ্নে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে যায় বিদিশা ।
নীলনদের বুক থেকে দীর্ঘশ্বাসের মতো এক হাওয়া উঠে আসছে। নিজের কক্ষে বাতায়নের পাশে বসেছিলেন বিষণ্ণ রাণী। তাকিয়েছিলেন অনেকটা দূরে, রাজন্য উপত্যকার দিকে। গোধূলির রাঙা আলোয় ভেসে যাচ্ছে উপত্যকা। দেখা যাচ্ছে কর্ম চঞ্চলতা। দূর দূরান্ত থেকে শকটে করে নিয়ে আসা হচ্ছে পাথর। তৈরি হচ্ছে পিরামিড, তুতনখ এর সমাধি গৃহ। ওরই পাশে একটুখানি জায়গায় ঠাঁই কি হবে না তুতনখ এর রাণীর? দেবতা আমেন রা এর কাছে জীবনের শেষ ইচ্ছে টুকুর জন্য প্রার্থনা জানান আঙ্খেসেনামুন।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আলো জ্বেলে দিতে কেউ এখনো আসেনি আজ এই ঘরে। একটু আগেই এসেছিলেন অয়। বৃদ্ধ মানুষটার দুচোখে ছিল কামনার আগুন। ধ্বক ধ্বক করে জ্বলছিল চোখদুটো। মুখে ছিল পিচ্ছিল, ক্লেদাক্ত হাসি। প্রসাধন করোনি কেন রাণী? আভরণ বিহীন কেন তোমার সোনার বরন অঙ্গ? আলুলায়িত কেশ গুচ্ছ তোমার, সুন্দর নিতম্ব খানি স্পর্শ করে রয়েছে। এসো, আমি আজ কবরী বন্ধনে আবদ্ধ করে দিই তোমার কেশ।
কোমরের খাপ থেকে একটানে মুক্ত করেছিলেন সুতীক্ষ্ণ ছুরিকা, ভুলে যাবেন না অয়, আমি আঙ্খেসেনামুন। আমার সব সময়ের সঙ্গী এই কোষবন্ধ ছুরিকা। আপনাকে বিদ্ধ করতে যদি না পারি, তাহলে আমি নিজেকেই বিদ্ধ করব এই ছুরিকায়। ভয়ে ভীত কুক্কুরের মতো ছুটে চলে গিয়েছিলেন অয়।
নিজের সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে বুঝতে পারছিলেন রাণী। একবার, শুধু একটিবার দেখা করতে হবে ফারাও এর সঙ্গে।
কার যেন করুণ কান্নার শব্দে ঘুমটা ভেঙে যায় বিদিশার। এ কি স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষণ ! কি অদ্ভুত! স্বপ্নের মধ্যেই যেন মিশরের রাজপ্রাসাদের অলিন্দে অলিন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। যেন টাইম মেশিনে চেপে কত সহস্র শতাব্দী পিছিয়ে গিয়েছিল ও। বিদিশা বুঝতে পারছে, এই ইতিহাসের সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িয়ে পড়ছে ও। না না। আর এভাবে স্ট্রেস নেওয়া যাবে না । যেভাবেই হোক এবার শেষ করতেই হবে। আর তো মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই থিসিস সাবমিট করতে হবে। আর সামান্যই কাজ বাকি রয়েছে।
আজ ইউনিভার্সিটি তে গিয়েছিল বিদিশা। সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরেছে। ফ্রেশ হয়ে এককাপ চা নিয়ে চেয়ারে এসে বসল। ধীরেসুস্থে চা টা শেষ করে আবার কলমটা তুলে নিল বিদিশা। সন্ধ্যার পর এ জায়গাটা এমনিতেই শান্ত, নির্জন হয়ে পড়ে। দূরে কোথাও একটা কুকুর ডেকে উঠল।তারপর আবার সব নিস্তব্ধ ।অবিশ্রান্ত ঝিঁঝিঁর ডাক, তার মধ্যে লেখনীর খসখস শব্দ। ঝড়ের গতিতে লিখে চলেছে বিদিশা:—
সে রাত্রে নীলনদের বুক থেকে উঠে এসেছিল দীর্ঘশ্বাস। প্রাসাদের অলিন্দে অলিন্দে এসে আছড়ে পড়েছিল সেই দীর্ঘশ্বাস বাহি সজল বাতাস, এনেছিল উনিশ বছর বয়সী তরুণ ফারাও এর মৃত্যুর সংবাদ। পৌঁছে গিয়েছিল তরুণী ফারাও পত্নীর কক্ষ পর্যন্ত। কক্ষ থেকে ছুটে বেরিয়েছিলেন রাণী। তবু পৌঁছতে পারেননি ফারাও এর কক্ষে। তারপর? কোথায় গেলেন ফারাও পত্নী? কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেেছে তিনি। হারিয়ে গিয়েছেন আঙ্খেসেনামুন।