SHUBHAMOY MONDAL

Comedy Drama Horror

3  

SHUBHAMOY MONDAL

Comedy Drama Horror

ভয় হয়

ভয় হয়

9 mins
228



আমি তখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। হোস্টেলে থাকতাম। তখনকার পরীক্ষার নিয়মটাও ছিলো অন্যরকম - প্রথম দু'বছর পড়ার পর পার্ট ওয়ান, তৃতীয় বছরে পার্ট টু।

আমাদের যাদের অনার্স ছিল, তাও বিজ্ঞান বিভাগে, সত্যি বলতে কি - এই অদ্ভুত পরীক্ষার নিয়মটা, তাদের জন্য, একপ্রকার অত্যাচার গোত্রীয় ছিলো।

কলেজে উঠলে যা হয় - সবাই তখন বাঁধনছাড়া হবার খুশিতে, প্রাণ খুলে এনজয় করেই ফার্স্ট ইয়ারটা কাটাতো।

পড়ার সমস্ত চাপটা, হুড়মুড়িয়ে পড়তো - সেকেণ্ড ইয়ারের মধ্যভাগে এসে। তখন - পাসের পাঁচটা পেপার, অনার্সের চারটে পেপার, অনার্স-পাস মিলিয়ে তিন টাইপের প্র্যাক্টিকেল পেপার - মাগো, মনে পড়লে, এখনও জ্বর এসে যায়!

ফার্স্ট ইয়ারে, যত স্টুডেন্ট প্রেমে পড়তো - তাদের সর্বাধিক কাহিনীর, ইতি হতো এই সময়ে। আর তার সিংহভাগ কাহিনী হতো, আমাদের মত হতভাগাগুলোরই।

ফার্স্ট ইয়ারের ভাই-বোনেদের উচ্ছলতা দেখে, মনে মনে, যীশু খ্রীষ্টের মত বলতে ইচ্ছে হতো - হে ঈশ্বর, এরা জানেনা, এরা কি করছে। এদের তুমি ক্ষমা করো।

শুধু আমাদেরই নয়, সেকেণ্ড ইয়ারে ওঠার পর, এমন দার্শনিক ভাব তখন - কমবেশি অনার্সের সব ছাত্রছাত্রীদেরই হতো।

কি আর করা যাবে, ভুল শোধরানোর তখন একটাই উপায় থাকতো - দিনরাত পড়ে, সিলেবাসটা কমপ্লীট করা।

তো, আমারও যথারীতি, সেই দুঃসময় এলো। প্রেম, হোস্টেলের জানালা দিয়ে, কখন ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে গেলো - আমি টেরও পেলাম না!

উঁকি ঝুঁকি মারতেই, দুজনের মাঝে জমে ওঠা, বিস্তর বইয়ের স্তুপে, বাধা পেলাম। বুঝলাম, এই বাধা না টপকাতে পারলে - প্রেম তো নস্য, নিজের জীবনেও কিছু করা অসম্ভব!

অগত্যা, সমস্ত বদ অভ্যাস সঙ্গী করে, শুধু পড়ায় মনোনিবেশ করতে বাধ্য হলাম। মাসের পর মাস তখন সেলুনে যাওয়া নেই, তেল-সাবান-শ্যাম্পুর মুখ দেখারও সময় নেই।

শুধু, ইলেক্ট্রিক কেটলে জল গরম করে, ঘরেই চা বা কফি বানিয়ে, নয়তো সিগারেট স্মোক করেই অবসাদ কাটাতাম! পড়া থামানোর উপায় নেই, তাহলেই ডাঁহা ফেল।

আমার মত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেদের, ঐসব ভারী ভারী সাবজেক্টে, অনার্স নেওয়াটা অপরাধ বলেই গণ্য করতো অনেকে। তাই, ফেল করলে - বাড়িতে অর্ধচন্দ্র লাভ নিশ্চিতই ছিলো।

সে'বছর, দূর্গাপুজোর একাদশীর দিনই, আমি বাড়ি ছেড়ে দৌড়ালাম হোস্টেলে। যদিও লক্ষ্মী পুজো পর্যন্ত সবার ছুটি, তবুও ঠিক করলাম - একাই মাঝের ক'দিন ওখানে, নিশ্চিন্তে পড়াশুনা করবো।

আমাদের কলেজটার সম্পর্কে একটু বলে রাখি - কলেজ ক্যাম্পাসটা বিরাট। প্রায় এগারো একর পরিমাপের, একটা বর্গাকার ভূখণ্ড জুড়ে তার বিস্তৃতি। প্রাচীরে ঘেরা ছিলো তার সীমানাটা।

ক্যাম্পাসের একটা দিক জুড়ে ছিলো - শুধু খেলার মাঠ। ঐ মাঠের পাশে, এক প্রান্তে বয়েজ হোস্টেল, অন্যপ্রান্তের বাকি সীমানা জুড়ে স্টাফ কোয়ার্টার।

বয়েজ হোস্টেলের পাশেই বাস্কেটবল গ্রাউণ্ড আর সুইমুং পুল। তার পাশে কমনরুম, লাইব্রেরী, মঞ্চ। তারপর ঐ পাশের বাকিটা জুড়ে - ক্লাসরুম, প্রাক্টিকেল রুম, স্টাফরুম ইত্যাদি নিয়ে মেন বিল্ডিংটা আর গ্যারেজ।

স্টাফ কোয়ার্টারের পাশে, মেন বিল্ডিংয়ের ঠিক নাক বড়াবড় মেন গেটের পাশেই ছিল - গার্লস হোস্টেল।

একদিকে স্টাফ কোয়ার্টার, গার্লস হোস্টেল আর অন্যদিকে কলেজের মেন বিল্ডিং, মঞ্চ আর লাইব্রেরী - মাঝখান জুড়ে ছিলো, ভলিবল গ্রাউণ্ড, খো-খো গ্রাউণ্ড আর ব্যাটমিন্টন গ্রাউণ্ড।

এই তিন গ্রাউণ্ড আর মেন বিল্ডিং, মঞ্চ, লাইব্রেরীর মাঝ দিয়ে ছিলো - লাল মাটির রাস্তা। দুপাশে বিরাট বিরাট সব অশোক গাছে ঢাকা, সেই রাস্তাটা বাস্কেটবল গ্রাউণ্ড পাড় হয়ে, বেঁকে বয়েজ হোস্টেলে গিয়ে থেমেছে।

স্টাফ কোয়ার্টারের পিছনের দিক থেকে শুরু হয়ে, গার্লস হোস্টেল, ব্যাটমিন্টন গ্রাউণ্ড, মেন গেট, গ্যারেজ, মেন বিল্ডিং, সুইমিং পুল, বয়েজ হোস্টেলের পাশ দিয়ে, বাউণ্ডারি ওয়াল ঘেষেই, একটা পাকা রাস্তা ছিলো।

রাস্তাটার ঠিক উল্টোদিকে - বিস্তৃত ফাঁকা নদীর চড়। দূরে, কয়'ঘর মানুষের একটা ছোট বস্তি। প্রতি সপ্তাহে, সেই চড়ে বসতো - বেশ জমজমাট একটা পশু হাট।

চড়ের মধ্যিখানে - মা রটন্তী কালীর মন্দির। আর তার ঠিক সামনেই শ্মশান। কয়েকটা বিরাট বিরাট বট গাছও ছিলো তার পাশে। নদীটার নাম কুনুড়।

আমাদের হোস্টেল জীবনের, সবথেকে পছন্দের রীক্রিয়েশন ছিলো - ভয়। খোঁজ খবর রাখলে, হোস্টেলে ভীতু মানুষ আবিষ্কার করাটা, কোন বড় বিষয় ছিলো না।

আমাদের সময়েরই, দু'জন মানুষের কথা বলি। একজন, আমার সহপাঠী বন্ধু - থাক, তার নামটা নাহয়, নাইবা বললাম। সে লজ্জা পাবে!

তো, তার একা থাকতে ভয় করতো। আমরা যারা দোতলায় থাকতাম - খাবার সময়, নিচের ডাইনিং হলে আসতে হতো তাদের।

কয়েকদিনের মধ্যেই, আবিষ্কার হলো - ঐ বন্ধুটি রাতে, খাওয়া দাওয়ার পরেও, ওখানে বসে থাকে - কারোর সঙ্গে, ওপরে নিজেরই ঘরে, যাবে বলে!

ঠিক হলো, তাকে নিয়ে মস্করা করা হবে। সেই মতো, একদিন রাতে, খাওয়া দাওয়ার পর, তার সঙ্গে আমি ওপরে এলাম। সে যেই নিজের ঘরে ঢুকলো, আমিও বাইরে থেকে, তার ঘরের মেন সুইচটা অফ করে দিলাম।

ভিতরে আমাদের দুই বন্ধু - সুজন আর সন্দীপন, আগে থেকেই তার খাটের নিচে লুকিয়ে ছিলো। ঘর অন্ধকার হতেই, সে তো ভয়ে গুটি সুটি হয়ে, বসলো গিয়ে তার খাটের ওপর!

জ্যোতিদা, তখন ঘরের কোণে, সাদা বেডশীটে সর্বাঙ্গ ঢেকে, তার ভিতরে একটা গ্যাস লাইটার জ্বেলে, ওর দিকে ঘুড়ে দাঁড়িয়ে, বজ্রগম্ভীর কন্ঠে, কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো - জাগোওওওও.....

সুজন আর সন্দীপনও তাল মিলিয়ে, নিচে থেকে ঠেলে, তার খাটটাকে ওপরে তুলতে লাগলো! সে তখন ভয়ে - বাবারে, বলে লাফিয়ে, ধপ করে পড়লো মেঝেয়!

সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। আমিও সুইচ অন করে দিলাম। কিন্তু, দেখি - সে ভয়ের চোটে জ্ঞানই হারিয়েছে! তাড়াতাড়ি চোখে মুখে জলের ছিটে দিয়ে, তার জ্ঞান ফেরাতে ব্যস্ত হলো সবাই।

অনেক রাতে অবশেষে, জ্ঞান ফিরলো তার। কিন্তু জেগে উঠে, সে কারোর সাথেই, কথাবার্তা বিশেষ বললো না। চুপ করে, পাশ ফিরে, শুয়ে রইলো।

আমরা ভাবলাম বুঝি রাগ করেছে। কিন্তু তার সাথে কথা বলতে গিয়ে, দেখি - সে কেমন অদ্ভুতভাবে, সবার পানে, ফ্যাল ফ্যাল করে চাইছে - কাউকেই চিনতে পারছে না!

আমরা মনে মনে, সবাই একটু ভয়ই পেলাম - কি হলো আবার, কে জানে? সেই রাতে ওকে আর না ঘাঁটিয়ে, বিশ্রাম নিতে দিলাম।

কিন্তু সকালে উঠেও, তার আচরণে কোন পরিবর্তন দেখলাম না। এদিকে, খেয়ে উঠে দিব্যি সে, ক্লাস করতে চলে গেলো! ঠিক করলাম, ওর ওপর নজর রাখা যাক।

তাই, ওকে না জানিয়ে, চুপি চুপি ওর ক্লাসরুমের জানালায় উঁকি মেরে, দেখি - বেটা দিব্যি ফূর্তিতে আছে! বন্ধুদের সাথে, রীতিমতো হই হই করছে, তাদের নাম ধরে ডাকাডাকিও করছে!

হোস্টেলে ফিরে এসে, সেকথা জানাতেই, সবাই তো রেগে লাল। যতই হোক, এতক্ষণ তার ঐ স্মৃতিশক্তি খোয়ানোর অভিনয়, আমাদের সবাইকেই, বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো।

তারপর আর কি, ক্লাস থেকে ফিরতেই, তাকে ডাকা হলো কমন রুমে। সে যথারীতি আবার নাটক শুরু করতেই, বেধরক মার - আমাদের সঙ্গে মস্করা? নিজের নাটক ধরা পড়েছে বুঝে, বাধ্য হয়েই তাকে তখন - স্বাভাবিক হতে হলো!

দ্বিতীয় জন ছিলো - হোস্টেলেরই দুই রাঁধুনী দাদার, একজন। তাঁর নামটাও নিলাম না। ধরে নিন, তিনি - শিবুদা। রাতের বেলা, একা বাইরে বেড়োতে, তাঁরও ছিলো - ভীষণ ভয়!

সেই কারণেই, তাঁরা নিজেদের মধ্যে, আমাদের দুবেলা খাওয়ানোর ডিউটি ভাগ করার সময় - শিবুদাই সকালের ডিউটিটা নেন।

তাঁর অজুহাত ছিলো - হোস্টেল থেকে, তাঁর বাড়িটা যেহেতু, তিন চার কিলোমিটার দূরে, তাই লোড শেডিং হলে, রাতে অন্ধকারে ফিরতে, কষ্ট হবে!

অন্যজনের বাড়ি - অনেক দূরের গ্রামে হওয়ায়, কলেজের বাইরেই, তিনি ঘরভাড়া নিয়ে থাকতেন। শিবুদার প্রস্তাবটা, তাই তিনিও মেনেই নেন।

একবার, ঐ দাদা তাঁর দেশের বাড়ি গেছেন - তো বেচারা শিবুদাকে, দুবেলাই ডিউটি করতে হচ্ছে। সেই সময়, সন্ধ্যের আটটাও বাজতে না বাজতেই, শিবুদা রান্নাটা সেরে, সবার ঘরে ঘরে এসে বলতেন - রান্না হয়ে গেছে, গরম গরম খেয়ে নাও, এসো।

ব্যাপারটা, প্রথম প্রথম ভালোই লাগতো। কিন্তু একদিন, বাপন কিভাবে জানতে পেরে, সন্ধ্যে বেলায় এসে জানালো - শিবুদা নাকি, রাতে একা বাইরে বেরোতে, ভয় পায়।

সে'জন্যই নাকি, সবাইকে ন'টার মধ্যেই খাইয়ে দিয়ে, বাইরের সব দোকানপাট বন্ধ হবার আগেই, দৌড় দেয় - বাড়ি পানে।

ঠিক হলো, সেদিন রাতেই - বিষয়টা পরীক্ষা করে দেখবো। তাই, শিবুদা সেদিন রান্না শেষ করে, যেই ওপরে উঠছে, সবাই লুকিয়ে গেলাম - দু' একজন বাদে।

শিবুদা, তাদেরকেই ডেকে নিয়ে গিয়ে, খেতে বসিয়ে দিলো! এরপর, দু'জন-চারজন করে করে, খেতে আসতে শুরু করলাম। শিবুদাও, আমাদের ঐ গ্রুপে গ্রুপে খাবার দিতে, এত ব্যস্ত হয়ে গেলো যে, তার আর সময়ের হিসাব থাকলো না।

সেদিন রাতে, সবাইকে খাইয়ে শিবুদা বের হবে; ঘড়ি পানে তাকিয়ে তো, তার চক্ষু চড়ক গাছ! রাত দশটা বেজে গেছে - মানে, দোকান পাট সব, বন্ধ হয়ে গেছে - অনেকক্ষণ আগেই!

তার ওপর, বৃহস্পতিবার বলে, এমনিও ওখানে, বাজার বন্ধ। চারিদিক বেশ অন্ধকার। তখনও শীত তেমন না পড়লেও - রাতের দিকে, গায়ে হাওয়া লাগলে, একটা শিরশিরানি অনুভব হচ্ছিলো বৈকি!

শিবুদার তো মুখ চুন। এদিক ওদিক চেয়েও, কাউকেই দেখতে পেলো না। কারণ, আমরা তো সবাই লুকিয়ে, তার হাবভাবই দেখছি!

শিবুদা, এক গ্লাস জল খেয়ে, একটু ঢোক গিলে, দোতলার দিকে তাকালো। কিন্তু, কাউকে দেখতে না পেয়ে, মুখটা ভয়ে পাংশুবর্ণ করে, সাইকেলটা নিয়ে অগত্যা, একাই বের হলো।

হোস্টেল থেকে বেরিয়ে, বাস্কেটবল গ্রাউণ্ডের বাঁকটা ঘুরেই দেখে - মাঠের দিকের গাছটা থেকে, গলায় দড়ি বাঁধা একটা লাশ ঝুলছে!

মুখ ঘুরিয়ে, জোর গলায় - রাম রাম রাম রাম করতে করতে, একটু এগিয়ে যেতেই দেখে - মঞ্চের দিকের, একটা গাছ থেকেও ঝুলছে - আর একটা লাশ!

এবার তো, তারস্বরে রাম রাম করতে করতে, সাইকেলটা চালিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই, দেখে - কলেজের গেটের ঠিক কয়েক মিটার আগে, একটা গাছের ডাল থেকে, রাস্তার ওপরেই ঝুলছে - আরও একটা লাশ!

ব্যস, আর সহ্য হলো না শিবুদার। সাইকেল সমেত, ভয়ে আছড়ে পড়লো - রাস্তার পাশে ঘাসের ওপর, আর মুখ দিয়ে - ভূ-ভূ-ভূ করে, চিৎকার করতে লাগলো, চোখ বুজে!

তার কাণ্ড দেখে, লাশ তিনটে তখন, ঝপ ঝপ করে গাছের ডাল থেকে নেমে, দৌড়ে এলো - শিবুদা, ও শিবুদা, কি হয়েছে, কি হয়েছে?

আর কি হয়েছে - তার মুখ থেকে তখন, ভূ ভূ ছাড়া আর কোন আওয়াজই বেরোচ্ছে না! পাশেই, ক্যান্টিনের 'শীতল পানীয় জলে'র ট্যাপ থেকে, ঠাণ্ডা জলই এনে, তার মুখে ছিটা দেওয়া হলো।

অনেকক্ষণ আমাদের সবার ধাক্কাধাক্কির পর, তার ঘোর কাটলো। কিন্তু সে চোখ খুললো না কিছুতেই। বললো - আমাকে তোমরা বাড়ি দিয়ে আসবে চলো!

কিচ্ছু করার নেই, মস্করার সাজা ভুগতেই হলো। দশাসই চেহারার সেই জ্যান্ত লাশকে, তার আধভাঙা সাইকেলে চাপিয়ে, চারজনে ধরাধরি করে ঠেলতে ঠেলতে, চার কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে, তার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এলাম!

এরপর, শিবুদা রাতে থাকলে, আমরাই আগ বাড়িয়ে, হাজির হতাম ডাইনিং রুমে - আটটার মধ্যেই। পাছে আবার, তাকে বাড়ি ছাড়তে যেতে হয়! তার চেয়ে, রাতে ক্ষিধে পেলে বরং - টিফিন করে নেওয়া যাবে!

এই ছিলো, আমাদের হোস্টেলের - ভয়কেন্দ্রিক, নানা মস্করার দুটো নমুনা। যাই হোক, এবার আসি - নিজের সেদিন হোস্টেলে ফেরার কথায়।

হোস্টেলের কেয়ার টেকার দাদা - আমায় খুব ভালোবাসতেন। তাই, সহজেই আমি ঐ ছুটির সময়েও, ফাঁকা হোস্টেলেই, নিজের ঘরে ঢোকার এবং থাকার অনুমতি পেয়ে গেলাম।

রাতে চটপট, একটা হোটেলে খেয়ে এসে, পড়তে বসে গেলাম। রাত তখন প্রায় তিনটে, পড়া শেষে শোবার আগে, ঘরটায় গরম লাগায়, আলোটা নিভিয়ে, জানালাটা খুলে দিলাম।

খানিক পরেই কানে আসলো - কারা যেন নিজেদের মধ্যে ফিস ফিস করে কথা বলছেঃ

- তুই সত্যিই আগে, এখানে এসেছিস?

- হ্যাঁ রে, ঐ ড্রেনের পাশে, ঐতো, ঐ শিশু গাছটার, মোটা যে ডালটা বেড়িয়েছে না, ওখানে বসেই তো নিজের পেট ভরাতাম।

-তুই ওখান থেকে হাত বাড়িয়ে, খাবার নিতিস?

-আরে না রে, মানুষের কথায় শুনিস না - ঐ যে, গন্ধে অর্ধেক ভোজন?

-সেটা আবার কি?

-এই হোস্টেলে যত রান্না হয় না, ছেলেগুলো তার অনেক কিছুই না খেয়ে, ফেলে দেয় তো! বেঁচে থাকতে, এর আদ্দেক পেলেও এতোদিন....

যাক গে, তো ওগুলো পচলে, তার থেকে এমন সুন্দর, একটা উৎকট গন্ধ আসে, শুঁকলেই পেট ভরে যায়। আহা, ঐ দুর্গন্ধটা নাকে আসলেই - পশ্চিম কোণের বেলগাছের, ঐ পেত্নীটার কথা মনে পড়ে, জানিস?

সেও বেঁচে থাকতে, অমনই সব কত সেন্ট, না কি সব যেন মাখতো! আমার তো তখন থেকেই, ওকে খুব মনে ধরে। কলেজ থেকে স্টেশন যাবার সময়, কতবার আমার রিক্সায় নিয়ে গেছি ওকে!

- তা মনে ধরতো যখন, তাকে বলিস নি কেন?

- বলবো কি, তার আগেই তো নিজেই ছ্যাঁকা খেয়ে, ঐ খালে মানে এখন যেটাতে, সব সাঁতার টাতার কাটে না, ওখানেই ডুবে মরেছিলো ও।

- তাহলে, এখন গিয়ে বল।

- সেকি আর বলিনি? একবারে তেড়ে এলো! বলে কিনা - মুখ্যু রিক্সাওয়ালার সাথে, তার মতো লেকা পড়া জানা পেত্নীর, প্রেম করতে ভারি বয়েই গেছে! শালা, মরেও - রিক্সা ঠেলার আর অশিক্ষিত হবার জ্বালা জুড়ালো না?

..........

আমি, এসব শুনে ভারী আশ্চর্য হলাম - কারা কথা বলছে? চুপিচুপি গুটি গুটি পায়ে, ছাদে গেলাম। আমার ঘরের আসপাশে, ছাদের সর্বত্র ভালো করে, চোখ বোলালাম - কেউ কোথাও নেই!

নিচেও কাউকে দেখতে পেলাম না! গাছগুলোতেও যেটুকু আলো পড়ছিলো, তাতেও কিছুই নজর এলো না। গা'টাও একটু ছমছম করছিলো বলে, ঘরে চলে এলাম।

জানালার পাশের দেওয়ালে, বালিশটা রেখে, ঠেস দিয়ে বসে, যেই একটা সিগারেট ধরিয়েছি - অমনি আওয়াজ এলো, রাস্তা থেকে - বলো হরি, হরি বোল। বলো হরি, হরি বোল। তাকিয়ে দেখি - শবদেহ কাঁধে চলেছে চারজন, আর তাদের পিছনে আরও জনা পাঁচেক লোক!

আমার জানালা দিয়ে, নদীর চরটার পুরোটাই দেখা যেত - এমনকি সেই শ্মশানের চুল্লিটাও! শবদাহ করতে তারা চুল্লিতে আগুন জ্বালতেই, জানালা দিয়ে তার ছটা পড়লো - আমার ঘরেও।

সেই ছটায়, হোস্টেলের পিছনের ঐ শিশু গাছটারও, ছায়া পড়লো দেওয়ালে। সেই ছায়ার মধ্যে দেখি - তার ডালে বসা দুজনের ছায়াও রয়েছে!

আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম - সত্যিই, দুটো সাদা কাপড়ে মোড়া মূর্তি, শ্মশানের দিকে মুখ করে, ঐ শিশু গাছের ডালে বসে, গল্প করছে!

আমি জানালাটা বন্ধ করে, ঘরের লাইটটা জ্বেলে, ফ্যানটা পুরোদমে চালিয়ে দিলাম। তবুও, দরদর করে ঘামতে থাকলাম!



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy